একটি বিলম্বিত জন্মদিনের শুভেচ্ছা



সারদা মা বলেছিলেন, নিজের শান্তি চাইলে পরের দোষ না দেখতে। শান্তি না হলেও চলবে, নিজের দোষ আমি দেখব না কিছুতেই, মরে গেলেও না। এই যে দশই জানুয়ারি আমার বাবার বাষট্টি বছরের জন্মদিন চলে গেল, আর সে জন্মদিনে যে আমি লখনৌয়ের ভ্রমণবৃত্তান্ত লিখতে লিখতে গলদঘর্ম হলাম, বাবার জন্য দু’লাইন অবান্তরে ছেপে উঠতে পারলাম না, সে দোষ আমার নয়। লখনৌয়ের। আর আমার ক্যামেরার। কে বলেছিল ওকে খচাৎ খচাৎ করে হাজার হাজার ছবি তুলে ফোল্ডার ভর্তি করতে? তাহলেই তো আমার সে ফোল্ডার ঝাড়তে মুছতে বাছতে অত কোটি কোটি ঘণ্টা লাগত না।

সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে আজ, এই চারদিন পর বাবার জন্মদিন উদযাপন করছি অবান্তরে। সেটা করতে গিয়ে আবার একটা পাপ করে ফেলছি যদিও, কারণ নতুন পোস্ট না লিখে বাবার তিন বছর আগের জন্মদিনে ইংরিজি হরফে লেখা একটা পোস্ট মেজেঘষে বাংলা হরফে লিখে চালিয়ে দিচ্ছি।

তা বলে ভাববেন না আমি বাবার জন্মদিন ভুলে গিয়েছিলাম। দশ তারিখ সকালবেলা উঠে বাবাকে ফোনে ঠিকই হ্যাপি বার্থডে বলেছি, শব্দ না করে ঠোঁট নাড়িয়ে “বাবাকে হ্যাপি বার্থডে বল” নির্দেশ সহকারে অর্চিষ্মানের কানে ফোন গুঁজে দিয়েছি। আমার বাবা তখন কোথায় ছিলেন? যেখানে বাবা সবথেকে খুশি থাকেন। পথে। চোল সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ বন্দরশহর পুম্পুহর দেখে, ভেলাংকানির ব্যাসিলিকা দেখে বাবা তখন ট্রেনে চেপে চলেছিলেন ম্যাঙ্গালোরের পথে। মহেন্দ্রপর্বত থেকে সহ্যাদ্রি। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে যাবে ম্যাঙ্গালোর। ম্যাঙ্গালোরে একদিন থাকবেন বাবা, তারপর চলে যাবেন গোকর্ণের সমুদ্রতটে। সেখানে চটি খুলে পাশে রেখে বালির ওপর বসে বসে সূর্যাস্ত দেখবেন। দিগন্তের আগুন আকাশ ছাড়িয়ে যখন আরব সাগরের জল ছুঁয়ে ফেলবে তখন বাবার হঠাৎ সম্বিৎ ফিরবে, দ্রুত পকেট থেকে ফোন বার করে ভিডিও চালু করবেন। যাক, বাড়ির লোককে দেখানো যাবে।

আমরা বাবাকে হ্যাপি বার্থডে জানালাম। আমাদের জন্মদিনে বাবা আমাদের যা যা বলেন, সেগুলোই আমরা উল্টে বাবাকে বললাম। বললাম আজকের দিনটা যেন বাবা ভালো করে, ভালো জামা পরে আর ভালো খাবার খেয়ে কাটান। বাবা বাধ্য ছেলের মতো বললেন, “নিশ্চয় নিশ্চয়।” শুধু বললেন না, ম্যাঙ্গালোর পৌঁছে হোটেলের তিনতলার ভিউওয়ালা ঘরে চেক ইন করে আমাদের ফোন করে জানালেন, ম্যাঙ্গালোর জংশনে নেমেই তিনি ওয়েটিংরুমের ক্যান্টিনে চিকেন বিরিয়ানি খেয়ে নিয়েছেন। খাওয়ার পর ছোট টেট্রাপ্যাকে, যেগুলোর গায়ে সেলোটেপ দিয়ে স্ট্র আঁটা থাকে, পাইনঅ্যাপেল জুস খেয়েছেন। বাবার ফেভারিট ডেজার্ট।


*****


একজন হেসেখেলে ছ’ফুট, একজন টেনেটুনে পাঁচ আড়াই। একজন ব্রণ কী তাই জানেন না, একজনের গাল স্তরীভূত শিলাগঠিত পর্বতমালার সার্থক উদাহরণ। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে টেবিলটেনিস অফিস চ্যাম্পিয়নশিপে জিতে আনা ট্রফিশোভিত একজনের শোকেস, একজন পিটি ক্লাসে নিয়মিত কানমলা।

দুজনেরই কথায় কথায় রাগ হয়ে যায়, দুজনেই রাগলে শাটডাউন হয়ে যায়, দুজনেই আনন্দবাজার খুলে প্রথমে ম্যানড্রেক আর অরণ্যদেব পড়ে, দুজনেরই কখন  কোথায় থামতে হবে – তাসের ঠেকে, শখের নাটকের মহড়ায়, ইউটিউবে কিংবা একতরফা প্রেমে – জানা নেই। দুজনের কেউই বাংলাদেশ দেখেনি কোনওদিন, দুজনেরই ইস্টবেঙ্গল হারলে মন খারাপ হয়।

একজনের প্রিয় ফল কাঁঠাল, একজন কাঁঠাল শুনলে ছুটে পালায়, একজনের প্রিয় হিরো গোবিন্দা, একজন “লার্স ভন ট্রায়ারের শুধু নাম না, নামের বানানও জানি” গর্বে বুক ফুলিয়ে মশমশিয়ে চলে, একজন গত চল্লিশ বছর ধরে একটাই হাতঘড়ি পরে, একজনের আলমারিতে এই মুহূর্তে হিসেবমতো সাতটা হাতঘড়ি থাকার কথা, যদিও দরকারের সময় একটাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

একজন ফরওয়ার্ড পাঠায়, একজন ডিলিট করে, একজন ঘুম থেকে উঠে ললিত, ঘুমোতে যাওয়ার আগে বাগেশ্রী, মেঘ করলে মল্লার শোনে, একজন সকালবেলা অফিসের জন্য রেডি হওয়ার সময় এম টিভি চালায়, একজন খিদে না পেলে খায় না কিন্তু যখন পায় তখন স্টেশনরোডে দাঁড়িয়ে নির্দ্বিধায়, অবলীলায় পাঁচটা সিঙাড়া আর সাতটা বেগুনি সাঁটায়, একজনের ভরা পেটে বিস্কুট খায় আর খাতার পেছনের পাতায় চুপিচুপি ক্যালরির হিসেব রাখে, একজন এই বাষট্টি বছরেও চৌত্রিশ বছরের একজন ধেড়ে মানুষের সব সুখ সব দুঃখ সব দুশ্চিন্তা সব উদ্বেগের দায়িত্বপালনের জন্য মুখিয়ে থাকে, একজন এই চৌত্রিশ বছরেও ঘোর বিপদের মুখে পড়লে একজন বাষট্টি বছরের মানুষের মুখ মনে করে। নিজেকে মনে মনে বলে, “কিচ্ছু হবে না, সব ঠিক হয়ে যাবে, বাবা তো আছে।”

হ্যাপি বার্থডে বাবা। তুমি  আরও বাষট্টি বাষট্টি হাজার বছর ধরে পৃথিবীর পথে পথে ঘুরে বেড়াও, স্টেশনের নাম না জানা ক্যান্টিনে বসে বিরিয়ানি আর চিলিচিকেন খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলো, সমুদ্রের তীরে বসে সূর্য উঠতে আর ডুবতে দেখো। সমুদ্রতট খালি হয়ে গেলে, বালি ঝেড়ে চটি পায়ে গলিয়ে নিয়ে হোটেলের দিকে ফিরতে ফিরতে শুধু আমাকে একটা ফোন কোরো। বোলো, “সোনামা, আর কোথাও যদি না-ও যাস, এই জায়গাটায় অবশ্য করে আসিস।”



Comments

  1. বাবাকে ফোন করে কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায় ফ্যান ক্লাবের তরফ থেকে হ্যাপি বার্থডে বলে দেবেন। আর কেক খেতে কোথায় আসবো, সেটাও আমাদের জানিয়ে দেবেন।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, এই ক্লাবটা ভালো তো বেশ, আমিও ভাবছি মেম্বার হই, চাঁদা কত?

      বাবাকে নিশ্চয় জানাব শুভেচ্ছার কথা, থ্যাংক ইউ দেবাশিস। কেকের ব্যাপারটা জানাচ্ছি।

      Delete
  2. Happy birthday Abantor-sroshtar baba! Ajker din ta bhalo katey jano. Oboshyi Gokarna gele bhalo katari kotha. :)

    Oi neel jama pora puchke ta tumi? :D

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমিই তো। রাস্তায় দৌড়ে বেড়াচ্ছিলাম, বাবা চেপে ধরে সামনে দাঁড় করিয়ে ছবি তুলে নিয়েছে।

      তুমি গোকর্ণ গেছ, বিম্ববতী? ভালো জায়গা? তাহলে আমিও যাব।

      Delete
  3. darun hoyeche lekheta :) kakuke janmodiner shubheccha ! tinni

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, তিন্নি। বাবাকে জানিয়ে দেব।

      Delete
  4. bah besh to....Baba o khushi r amrao.........:)

    ReplyDelete
  5. Bilombito Subhechha amader tarof thekeo... ki sundor onar beranor barnona diechho ... khub bhalo laglo .

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, ইচ্ছাডানা।

      Delete
  6. একদম সত্যি কথা কুন্তলা, 'বাবাতো আছে' এই ভাবনাটা যে কি শান্তির, কি আরামের, সর্বভয়হর, যাদের আছে তারাই জানে। আজ দশবছর হল, আমার আর সেইটা ভাবার উপায় নেই।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এর উত্তরে কী বলব বলুন দেখি, মালবিকা। কাজেই আপনি ভালো থাকুন, আনন্দে থাকুন, এইটুকুই বললাম।

      Delete
  7. আমিও তাঁকে জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাল্ম। আরো অনেক ভ্রমণ করুন। :)

    ReplyDelete
  8. Replies
    1. ধন্যবাদ, অরিজিত। বাবাকে জানিয়ে দেব আপনার শুভেচ্ছার কথা।

      Delete
  9. kaku ke happy birthday janalam. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, কুহেলি। বাবাকে নিশ্চয় জানাব।

      Delete
  10. K. , tomar "baba-ma fan club" er torof theke tomar baba ke happy happy bday!!!
    sange ei gaan ta https://www.youtube.com/watch?v=ehOGkkVZfz4

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই গানটা যে বাবার কী পছন্দ হবে, কী পছন্দ হবে, সে যদি তোমাকে আমি বলে বোঝাতে পারতাম, শম্পা। অবশ্য তুমি হয়তো আন্দাজ করেই পাঠিয়েছ, কাজেই আমার বোঝানোর দরকার নেই।

      তুমি যে ক্লাবটার কথা বললে, সেটায় আমি আজীবনের মেম্বারশিপ।

      Delete
    2. Jibone prathom janmadine gaan upohaar pelama. Sarthok. Gaanta download kore rekhe dilam. Jakhon ichhhe sunte pabo. Prerakke dhanyabad o snehashish.

      Delete
  11. জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবেন...

    ReplyDelete
    Replies
    1. নিশ্চয়, সৌরাংশু। অনেক ধন্যবাদ।

      Delete
  12. Happy birthday.... Sustho thakun o dapiye beran..

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, 'দাপিয়ে বেড়ান' শুভেচ্ছাটা দারুণ, হীরক। বাবা খুব খুশি হবে শুনলে। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  13. Happy Birthday wishes amar torof thekeo. :-)
    Mangalore e Gajalee bole ekta daroon sea food restaurant ache!
    -Ramyani.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, রম্যাণি। বাবা তো এখন ম্যাঙ্গালোর থেকে চলে এসেছেন, আমরা যখন যাব তখন মনে করে গজালিতে খাব।

      Delete
  14. Tomar post ta kaal pore boddo Bapir kotha mone porlo. Phone korlam ar ekhane comment likhte bhule gelam. :-)
    Jonmodiner shubheccha roilo.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, শর্মিলা। বাবাকে নিশ্চয় জানাব।

      Delete
  15. kakur er porer next trip kothay? Pore amar babar kotha mone porlo. Amar baba o berate khub bhalobase..

    ReplyDelete
    Replies
    1. কাকুর ট্রিপের হিসেব রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়, চুপকথা, তাই আমি সে চেষ্টাও করি না। তোমার বাবার বেড়াতে যাওয়ার ভালোলাগাটা কি তোমার মধ্যেও চারিয়েছে?

      Delete
  16. Meshomasahai ke jonmodiner bilombito subhechha. Ar tumi ekta miler kotha likhte bhule giyecho Kuntala -- dujonei berate bhalobashe! Ekjon choto weekend trip, arekjon dhiresusthe onekdiner trip!

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, রুণা। না না ভুলিনি, খুব ইচ্ছে করছিল নিজেকেও বাবার মতো ভ্রমণপিপাসু বলে চালানোর, কিন্তু সেটা প্রাণে ধরে লিখতে পারলাম না। আমার হচ্ছে শখের বেড়ানো। কাজ ফুরোলে তবে যাওয়া। আমার বাবা কাজ ফেলে রেখেও বেড়াতে চলে যান, বেড়াতে যাওয়ার টান বাবার এমনই।

      Delete
    2. Aha joa bolei toh amra eto sundor, sundor lekha pai! Meshomashai sujoj peyechhen bolei toh sujoger sadbyabohar korechhen! Tumi pele tumio korbe ei shubhechha roilo!

      Delete
  17. দারুণ হয়েছে লেখাটা, কুন্তলাদি। বাবাকে পড়াব।

    তুমি তো ঠিক মনে করে কাকুর জন্মদিনেই উইশ করেছ! আমি যে কি বাজে রকমের ভুলো লোক; কারোর জন্মদিনই ঠিকঠাক মনে রাখতে পারিনা। মাঝে উদ্যোগ নিয়ে মোবাইলে রিমাইন্ডার দিয়ে রাখা শুরু করেছিলাম। সেটা লোকজনের চোখে পড়ে যাওয়ায় এবং তার ফলস্বরূপ প্রচুর আওয়াজ খাওয়ায় সে কাজ থেকে বিরত হয়েছি।

    বাবার, বন্ধুদের জন্মদিনের বেলায় মা মনে করিয়ে দেয় প্রতিবার। বাড়ি থেকে দূরে থাকাকালীন আগের দিন মেসেজ পাঠিয়ে মনে করিয়ে দেয়! নিজের জন্মদিনের কথাটা আর লজ্জার মাথা খেয়ে মনে করিয়ে দিতে পারে না। এবারেও মায়ের জন্মদিন যথারীতি ভুলে মেরে দিয়েছি। সেই দিনই সকালবেলা আপিস যেতে যেতে রোজকার মতো রুটিনমাফিক যা কথা হওয়ার তো হয়েছে। লাঞ্চ টাইমে ফোনে কথা বলার সময়ে বর মনে করিয়ে দিল। “এই যাঃ! একদম ভুলে গেছি” বলে লাফ মেরে তার ফোন কেটে মাকে ফোন করে উইশ করেছি । মা এবার বেশ আশ্বস্ত হয়েছে আমাকে অন্যের জন্মদিন মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য আরেকজন কাছের লোক আছে ভেবে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. গুড, সায়নী। ভুলে গেলে ক্ষতি নেই, যদি মনে করিয়ে দেওয়ার লোক থাকে। তুমি সে লোক পেয়ে গেছ দেখে খুশি হলাম।

      Delete
  18. Lars Von Trier!!! Shobbonash!!! Apni esob vari vari cinema dekhen!!!
    P.S- Jonmodiner onek subhechha jethu ke..

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, অর্ণব। বাবাকে জানিয়ে দেব।

      Delete
  19. Kaku ke amar torof theke belated happy birthday bole dis... ebar rishra te kobe asbi age theke obantor a notify kore dis ....... tahole ekta uttarpara rishra get together kirano jabe... ar tor choya peye amar tuktuk ta jodi tor moto bhalo likhte pare kokhono...........

    ReplyDelete
    Replies
    1. সর্বনাশ, আমার মতো লিখতে যাবে কেন, আমার থেকে অনেক ভালো লিখবে টুকটুক। বাবাকে তোর শুভেচ্ছা নিশ্চয় জানাব, ভট্টা। বাবা খুব খুশি হবে।

      Delete
  20. ei post ta pore kede fellam..nah didibhai..ache apnar modhdhey..lekhay ache dom...manusher chokh theke jol bar kora lekhanir sahajye..khub e kothin kaj

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ। আমার মন ভালো করে দিলেন আপনি।

      Delete

Post a Comment