ইঁদুরকল ও তড়কা প্যান
লৌকিকতার ক্লান্তি অতুলনীয়। বিয়েবাড়ি থেকে নাকতলা ফিরে শাড়ি ছেড়ে শুয়ে পড়লাম। সকালে ডাইনিং টেবিলে চা নিয়ে বসে গত তিনদিনের ঘটনাবলী রিক্যাপ করে রেডি হতে গেলাম। উবার এল। টাটা বলে দুজনে গাড়িতে উঠলাম।
দাদা বললেন, রিষড়া?
রিষড়া।
শ্রীরামপুর কোন্নগর সাইডে?
শ্রীরামপুর কোন্নগর সাইডে।
দাদা গাড়ি ছেড়ে দিলেন। জানালার বাইরে রোদমেঘের খেলা চলল। অর্চিষ্মানকে বললাম, গান শুনব? অর্চিষ্মান বলল, নিশ্চয় শুনবে। ডান কানে ইয়ারফোন গুঁজে বললাম, বাঁ কান খোলা থাকল, তোমার গল্প করার ইচ্ছে করলেই বলবে, অন্য কান থেকেও গান টেনে খুলে ফেলব। অর্চিষ্মান বলল, বুঝেছি কুন্তলা। থ্যাংক ইউ।
এস পি বালাসুব্রমনিয়াম গান ধরলেন। জিস হাথ মে এক হাথ হ্যায়ঁ, উস হাথ কি কেয়া বাত হ্যায়ঁ। সুনতে থে হাম ইয়ে জিন্দগি, গম অওর খুশি কা মেল হ্যাঁ/ হামকো মগর আয়া নজর ইয়ে জিন্দগি ও খেল হ্যায়ঁ/ কোই সব জিতে সব কোই হার দে/ অপনি তো হার হ্যায়ঁ ইয়ার মেরে।
দাদাকে বলা ছিল, দ্বিতীয় হুগলী সেতু থেকে নেমে ট্যাক্সি থামালেন। রাস্তার ধারের দোকান থেকে তিন ভাঁড় চা খাওয়া হল। তারপর সোজা বাড়ি।
*****
খাওয়াদাওয়ার পর বাবা বললেন, ছাদে যা। সারপ্রাইজ আছে।
তক্তা সেঁটে জেড লেখা দরজার খিল নামিয়ে ছিটকিনি খুলে ছাদে পা রাখলাম। নীল শেড দেওয়া ছাদ। প্রথমবার যা শেল ঠেকেছিল এখন তা সেফটিপিন। আমার আর মায়ের ছাদটা আর নেই। ছাদের ওপর আকাশ নেই। মা নেই। আমি আছি।
যাকগে।
জেড সাঁটা দরজার খিল নামিয়ে ছিটকিনি খুলে ছাদে বেরোলাম আর সারপ্রাইজ চোখের সামনে আত্মপ্রকাশ করল।
ক্যাম্পখাটটার কথা ভুলেই গেছিলাম। ঝকঝকে স্টিলরং পায়া নতুন নীলসাদা বুনুনি পরে ঝকঝকে হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে কোনও হিন্ট নেই, আমাদের সাদা বাড়িরও নীল বর্ডার। দু'হাজার এগারোর অনেক আগে থেকে। আমার মায়ের পছন্দের কম্বো। তা বলে মা সম্পর্কেও কোনও হিন্ট নেই।
খাট জাতীয় জিনিস দেখলে অর্চিষ্মান, পরিস্থিতি অসুবিধেজনক না হলে, সোজা শুয়ে পড়ে। ওই মুহূর্তে পরিস্থিতি অত্যন্ত সুবিধেজনক, আশেপাশে আমি ছাড়া নিম কাঁঠাল আম নারকেল সুপুরি। অর্চিষ্মান চিৎপাত হয়ে পড়ল। প্রায় পুরোটা খাটই জুড়ে গেল, আমি কোণা ঘেঁষে বসলাম। একটু পর দরজায় শব্দ হল। অর্চিষ্মান ভদ্রতা করে উঠে বসল, বিজলীদি বলল শুয়ে থাকো শুয়ে থাকো, আমি এটা দিয়েই চলে যাব। একটা ছোট স্টিলের টিফিনবাক্স। ভেতরে আমলকির মিষ্টি চ্যাটচেটে আচার।
ততক্ষণে আরামে অর্চিষ্মানের চোখ প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে। আমি টিফিনবাক্স অর্চিষ্মানের ডান হাতের কাছে সেট করে দিলাম, অর্চিষ্মান একটা একটা করে আমলকি তুলে মুখে পুরতে লাগল।
অর্চিষ্মান একদিন বলছিল, আচ্ছা সবাই যে বলে অমুক শহরে লাইফ ফাস্ট তমুক শহরে লাইফ স্লো - মানে কী?
আমিও এটা নিয়ে ভেবেছি এবং মানে বার করতে পারিনি। ফাস্ট লাইফ ব্যাপারটা এখনও ক্লিয়ার না। স্লো সম্ভবতঃ ওই রকমের দুপুরকে বলে, যে রকম দুপুরে আমি আর অর্চিষ্মান ছাদে ক্যাম্পখাট পেতে (বাবা পেতেছেন। বাবাও না, মোস্ট প্রব্যাবলি বিজলীদি পেতেছে) শুয়েবসে আছি, ভূমিকম্প সুনামি বোমাবর্ষণ টাইপের আরবিট ও র্যান্ডম ঘটনা বাদ দিলে আর কিছু ঘটবে না গ্যারান্টি দেওয়া যায়, আমরা কোথাও যাব না, কেউ আমাদের কাছে আসবে না।
অর্চিষ্মান বলল, তাই হবে। বলে একটা আমলকি মুখে পুরে চোখ আবার হাফ এবং মুখ ফুল বুজে ফেলল। আমিও চুপ করে গেলাম। চারপাশ সরব হয়ে উঠল। পাখি ডাকল। কুকুর চেঁচাল। গাছের পাতা সরসর করল। তারপর পিয়েস দ রেসিস্তন্স - ভোঁ বাজিয়ে ট্রেন গেল।
নিমের নবীন পাতা ফুঁড়ে রোদ্দুর অর্চিষ্মানের নীল সোয়েটারে পড়ল। সে সব রৌদ্রোজ্জ্বল নিমপাতার
দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ভাবলাম কী দেখছি? নিমপাতা? রোদ্দুর? নাকি স্বয়ং সালোকসংশ্লেষ এসে সামনে দাঁড়িয়েছেন?
যাই দেখি, একটা জিনিস স্পষ্ট দেখলাম। সময় লম্বা হতে শুরু করছে। এক একটা মুহূর্ত - মুহূর্তের থেকে দীর্ঘতর।
একটা সাদা প্রজাপতি উড়ছিল। অর্চিষ্মান এক চোখ পুরো খুলে ‘যে-জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের’ বলে - টিফিনবাক্সের লাস্ট আমলকিটা মুখে পুরে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিছুক্ষণ পর নিমের পাতার ছায়া ধেবড়ে, ক্যাম্পখাট ছায়ায় ঢেকে, রোদ্দুর সিঁড়িঘরের ওপারে অদৃশ্য হল। অর্চিষ্মান উঠে হাই তুলে, আড়মোড়া ভেঙে বলল, গ্রামে বিয়ে করার কিন্তু আরাম আছে।
তারপর চটাস করে নিজের গায়ে থাপ্পড় মেরে বলল, মশাও আছে, বাপ রে বাপ রে বাপ।
*****
মশা ছাড়াও আরও অনেক কিছু আছে। প্রথম রাতে খচমচ শুনেছি, গুরুত্ব দিইনি। ইগনোরেন্স ইজ ব্লিস। সকালে উঠে শ্যামলী যেই বলল, কাল রাতে যা জ্বালিয়েছে ইঁদুরটা, পরের রাত থেকে আর ঘুমোতেই পারছি না। অথচ বাড়ি গেলে চমৎকার ঘুমোই। দিল্লির বিছানায় রাত তিনটে পর্যন্ত আমাদের সঙ্গে দুটো ল্যাপটপ, তিনটে ফোন শুয়ে থাকে। সানডে সাসপেন্সে শার্লক হোমস ডেভনশায়ারের চোরাবালিময় জলাভূমিতে ভুতুড়ে কুকুর ধরতে ছুটে বেড়ান।
রিষড়ায় দশটার সময় শ্যামলী মশারি গুঁজে সব আলো নিভিয়ে দেয়। একটা ছোট আলো জ্বালিয়ে রাখবে নাকি গো? জ্বলছে তো। কোথায়? ওই যে? বলে, আমাদের পুরোনো বাড়ির সুরকির দেওয়ালের খোলা বাংকে রাখা ইনভার্টারের ছোট্ট লাল বিন্দুর দিকে আঙুল দেখায়। রাতে ওইটুকু আলোই দেখবে কত বড় মনে হচ্ছে।
চোখ বুজি। চোখ থেকে অবিরাম আলো, কান থেকে ননস্টপ গান সরে গেলে কেমন লাগে অনেকদিন পর টের পাই। এবং খচমচ শুরু হয়।
আমি বললাম, হোয়াট! ইঁদুর?
শ্যামলী বলল, পাগল করে দিচ্ছে গো সোনা। একদিন নাকি শ্যামলীর টিফিনবাক্সের ঢাকনা নিয়ে গিয়ে গোল করে কেটেছে, আর একদিন রুটি খেয়ে নিয়েছে। আমি বললাম, জামাকাপড়ও কাটছে নাকি? ব্যাগে বিয়েবাড়ি ফেরত অর্চিষ্মানের পাঞ্জাবি, মায়ের নিজে হাতে কেনা প্রিয় আসাম সিল্ক। শাড়ি গেলে শাড়ি পাবি রে পাগলা, মায়ের শাড়ি গেলে আর তো পাবি না। সবাই আশ্বাস দিল, জামাকাপড় কাটে না, অন্ততঃ কাটেনি এতদিন।
জামাকাপড় না হয় আলমারিতে তালা দিয়ে রাখা যাবে, অর্চিষ্মানের জন্য কেনা বাদামচাক আর তিলচাকের ঠোঙাগুলোও সুটকেসে পুরে রাখব। কিন্তু আমি ঘুমোব আর ইঁদুর ঘরময় দাপাবে - অ্যালাউ করা যাবে না।
ইঁদুর তাড়ানোর পরিকল্পনা হল। বললাম, বিষটিষের ব্যাপার থাকলে আমি গেলে কোরো। সবাই বলল, না না বিষটিষ দেওয়া হবে না। আলতো করে কলে পুরে আস্তে করে পুকুরধারে ছেড়ে আসা হবে। কল কোথায় পাতা হবে? সোনার ঘরে বেশি লাফালাফি করে যখন সোনার ঘরেই পাতা হোক।
বললাম, ধরা পড়লে চেঁচাবে না? বাবা বললেন, সে তো চেঁচাবেই। তোকে ধরে খাঁচায় পুরলে তুই চুপ করে থাকতিস?
তাহলে আমার ঘরে (আমার ঘর আমার ঘর কেন করছি কে জানে, ওটা ঠাকুমার ঘর) কল পাতার দরকার নেই। আমি সারারাত অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে ইঁদুরের অভিশাপ গুনতে পারব না।
কাজেই বিজলীদি বাড়ির অন্য কোথায় যেন কল পেতে এল। ইঁদুরকে প্রলোভিত করার জন্য তরকারি থেকে এক পিস আলু তুলে কলে রাখা হল। সকালে উঠে দেখা গেল খাঁচা ফাঁকা।
শ্যামলী বলল, আলুফালুতে হবে না, বিকেলে সোনার জন্য পনীরের চপ আনব, ওটা ভেঙে একটুখানি দিলেই হবে। কড়াইশুঁটির মিক্সচার আছে ফ্রিজে, একটা মিনি কচুরি ভেজে কলে রাখলেও কাজে দেবে।
কচুরি ভাজতে হয়নি, ইঁদুর পনীরের চপেই ধরা দিল। কল তুলে বারান্দায় নিয়ে যাওয়া হল। বারান্দায় কলের ভেতর বসে সে রাগত কিচকিচে আকাশবাতাস ফাটিয়ে ফেলল। সকালবেলা শিখা এসে বলল, বাবাগো এটা কী? একটু পর মীরামাসি এসে বলল, বাবাগো এটা কী? দুধ দিতে এসে দাদা তো বারান্দাতে উঠতেই রিফিউজ করলেন। বিজলীদির পা একবার কলে লেগে যাওয়ায় গর্জন দ্বিগুণ হল। বিজলীদি বলল, অ্যাই চেঁচাচ্ছিস কেন রে, আমি তোকে মেরেছি না ধরেছি? পনীরের চপের লোভ দেখিয়ে খাঁচায় পোরার দায়টা কী অম্লানবদনে এড়িয়ে গেল দেখে আমি মুগ্ধ। এগারোটা নাগাদ বিজলীদি বাবাকে তাড়া দিল, দাদা যান ছেড়ে আসুন, সকাল থেকে বন্দী পড়ে রয়েছে।
বাবা ইঁদুরশুদ্ধু কল হাতে ঝুলিয়ে পুকুরের দিকে চললেন। উল্টোদিকের বাড়ি থেকে বুবুনের বউ গোপা চেঁচাল, আরিব্বাস, বারবিকিউ হবে নাকি জেঠু?
বাবা বললেন, হ্যাঁ রে। বারবিকিউ উইথ পেরি পেরি সস।
*****
অন্যদিন সকাল থেকে ছাদে ঘুরি, সেদিন বারান্দায় যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম। বাবা ইঁদুর নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর কে জানে কত শতাব্দী পর শ্বাস নিয়ে বারান্দায় এসে ফ্যান চালিয়ে উঁচু চেয়ারটায় বসে পা দোলাতে লাগলাম। বারান্দার ওই কোণে বাবার হারকিউলিস সাইকেল। সাইকেলসংক্রান্ত একটা সারপ্রাইজ দেবেন বলেছিলেন বাবা। চোখ সরু করলাম। ত্রিভুজের বাঁদিকের হেলানো রডে একটা আয়তাকার কালো বাক্স।
বাবার সাইকেলের ইঞ্জিন। সাইকেলের হ্যান্ডেলে ইঞ্জিনের সুইচ। অন করলে ইঞ্জিন চালু হয়। সাইকেল আপনি চলে, প্যাডেলে পা রেখে বাবা স্থির বসে থাকেন। ব্যাপারটা এখনও অ্যাকশনে কল্পনা করতে পারিনি, চোখে দেখলে হয়তো পারব। ইঞ্জিনের সুইচের পাশে একটা লাল সুইচ। লাল সুইচের মধ্যে একটা ব্যাপার আছে, সামনে পেলেই হাতে কলমে পরীক্ষা করে দেখতে ইচ্ছে করে। পরীক্ষা করলাম। পাড়ার বেলা এগারোটার শান্তি ছিঁড়ে বিকট হর্ন বেজে উঠল।
জিনের কী খেলা। সেজকাকুর সাইকেলে একসময় রিকশার হর্ন লাগানো হয়েছিল। কারণ সাইকেলের বেল দিলে নাকি লোকজন কাকুর মনোমতো দ্রুততায় সরত না। কাকু হুমকি দিয়ে রেখেছিলেন, রিকশার হর্নে কাজ না দিলে পাঞ্জাব লরির হর্ন লাগাবেন।
বাবা গেট দিয়ে ঢুকতে ঢুকতে বললেন, ভালো হয়েছে না?
দারুণ হয়েছে বাবা।
আমি মরলে সাইকেলটা একটা বেদীটেদি করে রেখে দিস। কত সালের সাইকেল বলত?
বাবা যে ছাতাটা রোজ ব্যবহার করেন সেটা আমার ঠাকুরদার। ওই মুহূর্তে যে সোয়েটারটা আমি পরে ঘুরছি বাবার সোয়েটার। আমার জন্মের আগে মা বুনেছিলেন। বাবার জামা যে সব ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্ট্রেংথ-এর হ্যাংগারে ঝোলে সেগুলো কবেকার বাবা নিজেই ভুলে গেছেন।
আমার একটা সিম্পটম দেখা গেছে আজকাল, ইতিহাসের সূত্র বলতে উনিশশো আশিতে গিয়ে আটকে যাই। অফ কোর্স, তার আগেও জিনিসপত্র ঘটেছে। বারোশো নিরানব্বইয়ে আলাউদ্দিন খিলজি সোমনাথ মন্দির আক্রমণ করেছেন, উনিশশো উনিশ কুড়িতে রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় মাটি খুঁড়ে মহেঞ্জোদারো বার করেছেন, উনিশশো একচল্লিশে বাঙালি রবীন্দ্রনাথের দাড়ি ওপড়াতে শুরু করেছে। এ সব তথ্য থিওরেটিক্যালি জানা সত্ত্বেও আমার মাথার ভেতর আধুনিক মানবসভ্যতার ইতিহাস শুরু হয় উনিশশো আশিতে।
বাবার ক্ষমতাকে আন্ডারএস্টিমেট করব না বলে সাইকেলের জন্মসাল সভ্যতার শুরুতে নিয়ে ফেললাম।
উনিশশো আশি?
উনিশশো ছেষট্টি।
ঊনষাট বছরে স্পোকটোক ভেঙেছে। ফার্নিশিং অর্থাৎ সিটের কভারটভার চেঞ্জ করতে হয়েছে। কয়েকবছর এক বিশেষ আরোহীর জন্য মেন সিট আর হ্যান্ডেলের মাঝখানের রডে একটা ছোট সিট লাগানো হয়েছিল, সে তো নিজে চোখেই দেখেছি। কিন্তু পৃথিবীর প্রতিটি সাইকেলের যে সোল, সত্তা - রডের ত্রিভুজ, চাকার দুটি বৃত্ত, হ্যান্ডেল ও সিটের বেস - ছেষট্টির। বাবা এ সাইকেল নিয়ে খিদিরপুর থেকে হাজারিবাগ আপ ডাউন করেছেন। পেছনের সিটে মাকে বসিয়ে রিষড়া ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন, ছুটির দিনে আমাকে ওপারের পাকড়াশী পার্কে নিয়ে গেছেন। আমাদের সোম টু শুক্র বিকেলের ঘাস ওঠা, একটা স্লিপ, একটা ঢেঁকি, একটা নাগরদোলাওয়ালা সুকান্ত শিশু উদ্যানের তুলনা পাকড়াশী ছিল আস্ত ডিজনি ওয়ার্ল্ড।
*****
রাতভর কুকুরগুলো চেঁচাল। রোগা রোগা কুকুরবেড়াল, প্রতি ভাদ্রে বংশবৃদ্ধি করে চলেছে। পুনাচি উপন্যাসে পুরুষ ছাগলের ভ্যাসেকটমির প্রক্রিয়া মনে পড়লে দম বন্ধ হয়ে যায়, কাজেই আমি চাই না একটি প্রাণীকেও ওই কষ্টের মধ্য দিয়ে যেতে হোক। কাজেই সমাধান কী আমি জানি না। শুধু রাতভরের চিৎকারও অসহনীয়।
ঠিক চারটের সময়, চারটে মানে চারটে, থেমে যায়। ঘড়ি পরে চেঁচায় নাকি?
সকালে মীরামাসি আসে। কী খাবে সোনা? বাবা জিজ্ঞাসা করেন, সোনা কী খাবি?
সৎ উত্তর হচ্ছে কিছুই খাব না। বিকেল সাড়ে চারটে পর্যন্ত তোমাদের সাইজের কাপের আট কাপ কালো চা খাব চিনি ছাড়া, তারপর সাড়ে চারটের সময় ভাতের ছোট হাঁড়িটার হাফ হাঁড়ি মুড়ি খাব। চানাচুর থাকলে দিয়ো, না দিলে নালিশ করব না। রাতে খিদে পেলে খাব, মোস্ট প্রব্যাবলি পাবে না, আড়াইটে নাগাদ উঠে ম্যাগি করে খাব। চুপচাপ বানাব। দুমদাম করে তোমাদের ঘুম ভাঙাব না, প্রমিস।
কিন্তু সৎ উত্তর দেওয়া যাবে না। এই পৃথিবীতে রকেট সায়েন্সও জলের মতো বুঝিয়ে দেওয়া যায়, নিজের লাইফস্টাইল অন্য কারও কাছে জাস্টিফাই করা যায় না। আমার জীবনযাপন বাবার মাথায় ঢুকবে না, বাবার বেঁচে থাকা আমার ব্যাখ্যার অতীত ঠেকবে। কাজেই অসৎ উত্তর দিই। বাবা, মীরামাসি যে উত্তরগুলো এক্সপেক্ট করছে। চিঁড়ের পোলাও। রুটি তরকারি। উপমা। দুপুরে পঞ্চব্যঞ্জন সহকারে ভাত। হিঞ্চের বড়া। বিজলীদির বাড়ি থেকে রেঁধে আনা আলুসয়াবিনের লংকারসুনঠাসা তরকারি। আমড়ার ডাল। চালতার চাটনি। বিকেলে আলুকাবলি। সন্ধেবেলা শ্যামলীর আনা ধোকলা, চপ, রোল। চালডাল ভিজিয়ে, বেটে, অসামান্য হাঙ্গামা করে হাতে বানানো সরুচাকলি। গাছ থেকে নামানো ফার্স্ট ফ্লাশ খেজুর গুড় সহকারে।
চাকলির শেষ গ্রাস তখনও মুখে, রাতে কী খাবি সোনা?
অল্পের ওপর সারব, বাবা। একটা রুটি আর আলুভাজা, ব্যস।
বাবা বলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, জোরের কোনও ব্যাপারই নেই। আমার প্রিন্সিপল হচ্ছে শরীরের ওপর নো চাপ। যা ইচ্ছে, যতটুকু ইচ্ছে। শ্যামলী, রুটি আলুভাজা কর, আর ফ্রিজে দেখ কাঁচাগোল্লা আছে, খাওয়ার পর দিয়ো একটা করে।
দিল্লি এসে রিসেট সপ্তাহ উদযাপন করি। কফি আর ম্যাগি। ম্যাগির পর আবার কফি।
এবার ঠিক করে গেছিলাম, যা-ই হয়ে যাক, চা, চিনি, নারীবাদ - কোনও বিষয় নিয়েই বাবার সঙ্গে মতামত বিনিময়ে যাব না। যাইওনি। আমার ধারণা বাবাও সে রকম একটা কিছু ঠিক করে রেখেছিলেন। চা, চিনি, নারীবাদের দশ ফুটের মধ্যে গিয়ে পড়তে পারে এমন কোনও বিষয়ে ঢোকেননি। আমারই তো বাবা। মাথা আর কত আলাদা চলবে। দুজনে আনন্দে দিন কাটাইলাম। বাবা জিতেন্দ্র অভিষেকীর অমৃতবর্ষিণী শুনতে শুনতে বিছানায় বসে নেক্সট বেড়ানোর প্ল্যান করলেন, আমি চেয়ারে বসে ক্যান্ডি ক্রাশ খেললাম। টিভিতে আগে সারাদিন 'তারক মেহতা কা উলটা চশমা' চলত, এখন সারাদিন 'ক্রাইম পেট্রল সতর্ক' চলে। আমিও দেখলাম। এ সব জিনিসের একটা অসুবিধে হচ্ছে যত খারাপই হোক না কেন, শুরু করলে শেষ না করে ওঠা যায় না। অন্ততঃ আমি পারি না। মাঝখানে কতক্ষণ করে অ্যাড দেখায়, বাপরে। বাবা বললেন, চার মিনিট তো হবেই। আমি বললাম, হেসেখেলে পনেরো। পরের ব্রেকে দুজন অমৃতবর্ষিণী আর ক্যান্ডি ক্রাশ ছাড়ান দিয়ে টিভি আর টিভির ওপর দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বাবার থেকে আমি বেশি ঠিক। অ্যাড ব্রেক দশ মিনিটের।
একদিন বিজলীদির সঙ্গে বাজারে গেলাম। কে যে কোথা থেকে সোনা বলে ডাকে। তিনি আবার মুখে মাস্ক পরে আছেন। কবে এলি, কবে যাবি, বাবা কেমন আছে, বাবাকে দিল্লি নিয়ে যা। এত প্রাসঙ্গিক প্রশ্নোত্তর যখন আমাকে ঠিকই চিনেছেন। আমি চিনিনি। মাস্ক খুলুন, চিনব - বলার উৎসাহও বোধ করছিলাম না। বিজলীদিও চিনতে পারেনি। ফেরার পথে টোটোতে দুজনে, আচ্ছা উনি হতে পারেন? তিনি হতে পারেন? করলাম কিন্তু ঠিক লোককে বার করা গেল না।
বাজারে ফল তরকারি কেনার ছিল, মুখ্য ছিল পালকো বাসনালয়ে প্রেশার কুকার এক্সচেঞ্জ। পালকো-তে মায়ের সঙ্গে কত যে এসেছি। পুরোনো প্রেশার কুকারের বদলে হকিন্সের মিস মেরি কিনে আনা হল। বাসনের দোকানে গেলেই আমার মনে হয় এই কিনি সেই কিনি। হাতা কিনি খুন্তি কিনি। চকচকে সাঁড়াশি কিনি। আমার লাগবে না, প্রসেনজিতের হয়তো লাগবে। সত্যিটা হচ্ছে প্রসেনজিতেরও লাগবে না। শেষমেশ গরম কড়াইটড়াই নামিয়ে রাখার চারটে স্ট্যান্ড কিনলাম, আর টমেটোবেগুন পোড়ানোর জালি। বেরিয়ে আসতে গিয়ে হুকে ঝোলানো তড়কা প্যানের দিকে চোখ পড়ল।
অর্চিষ্মান নেপালি আলু সদেকো রাঁধতে শিখেছে বলেছিলাম কি? শুধু শেখেনি, ভীষণ ভালো শিখেছে। আলু সেদ্ধ করা, পেঁয়াজ কাটা, কাঁচালংকা কুচোনো, আলুর খোসা ছাড়িয়ে মাপমতো কাটা - সব নিজে করে। শুধু করে না, যতক্ষণ করে আমাকে রান্নাঘরে ঢুকতেও অ্যালাউ করে না। রেসিপির শেষে সর্ষের তেলে মেথি লংকার সম্বারের স্টেপটায় এখনও কনফিডেন্স পায়নি, তখন আমি এন্ট্রি নিই।
(বাসনটাও আমি মাজি কারণ অর্চিষ্মান তিনটে থালা মাজতে হাফ ভিম ফুরিয়ে ফেলে। আমার বুক ধড়ফড়ায়। অর্চিষ্মানকে আক্ষরিক ঠেলা মেরে বাসন মাজা থেকে প্রতিহত করেছি এমনও ঘটেছে)।
প্রথম দিন যখন সম্বার দিতে ফ্রাইং প্যান নামিয়েছিলাম, অর্চিষ্মান বলেছিল, আমাদের ওইটা নেই, না?
যে ইউটিউউব ভিডিও দেখে অর্চিষ্মান সদেকো বানাচ্ছে সেখানে রাঁধুনি তড়কা প্যানে তেল গরম করে মেথি লংকা ছেড়েছিলেন। আমাদের তড়কা প্যান নেই। ফ্রাইং প্যানে তেল ঢালতে ঢালতে বলেছিলাম, না অর্চিষ্মান, আমাদের ওইটা নেই, কিন্তু তাতে স্বাদের এক ইঞ্চি তফাৎ হবে না, ট্রাস্ট মি।
প্রতিবাদ করেনি, কিন্তু আমি জানি অর্চিষ্মান আমাকে পুরোটা বিশ্বাসও করেনি। বিশ্বাসঅবিশ্বাস স্বাদবিস্বাদ ছেড়ে দিলাম, প্রথমদিন একবুক আশা নিয়ে রান্না করতে ঢুকে রান্নাঘরে বাসন কম পড়ে যাওয়া? স্থির করেছিলাম এ অনাচারের প্রতিকার করব। পালকোতে তড়কা প্যান দেখে একটা নিয়ে নিলাম। দাদা বললেন, মারওয়াড়িরা ডালে এ জিনিস দিয়ে ফোড়ন দেয়। রিষড়ায় বিপুল সংখ্যক মারওয়াড়ি কাজেই তাঁদের রান্নার উপযোগী বাসনপত্র রাখতে হয়।
ডিসেম্বরের বাইশ তারিখ দিল্লি ফিরেছি, এর মধ্যে একবারও আলু সদেকো হয়নি। তড়কা প্যান কোথায় সেটাও শিওর নই। ক'দিন আগে কাবার্ডে বেগুনটমেটো পোড়ানোর জালিটা দেখলাম মনে হল। তড়কা প্যান দেখলাম বলে তো মনে পড়ছে না। উইকএন্ডে ওটা খুঁজে বার করে আলু সদেকো বানিয়ে বউনি করে ফেলতে হবে।
(শেষ)
"এই পৃথিবীতে রকেট সায়েন্সও জলের মতো বুঝিয়ে দেওয়া যায়, নিজের লাইফস্টাইল অন্য কারও কাছে জাস্টিফাই করা যায় না। আমার জীবনযাপন বাবার মাথায় ঢুকবে না, বাবার বেঁচে থাকা আমার ব্যাখ্যার অতীত ঠেকবে। " how true!
ReplyDeleteসে জন্য ব্যাখ্যা ছাড়ান দিয়েছি, অন্বেষা। কমপ্লেনও করি না, এক্সপ্লেনও করি না।
Deleteএটা পড়তে পড়তে ছোটবেলার বেশ কিছু স্মৃতি মনে এলো। যেমন, জেড লেখা খিল দেওয়া দরজা (যেটা এখন আর দেখতে পাই না এই ফ্ল্যাটবাড়ির ভিড়ে), বাইসাইকেল চালানো (কোলকাতার বাইরে থাকার সময়ে, "অ্যাভন" কোম্পানির একটা ছোটদের বাইসাইকেল কিনে দিয়েছিলো বাবা, যেটা কোলকাতায় আসার পর আর ব্যবহার হতো না)।
ReplyDeleteইঁদুরের সাথে এনকাউন্টারও ছোটবেলায় বেশ কয়েকবার হয়েছে, কিন্তু ইঁদুর ধরার বা মারার কোনোরকম কল জীবনে এখনও পর্যন্ত নিজের চোখে একবারও দেখা হয়নি, যদিও ছোটবেলা থেকেই একটু কৌতহল আছে জিনিসটা কিভাবে কাজ করে সেটা নিয়ে। বাকেট লিস্ট থাকলে অ্যাড করে নেওয়া যেত।
ভাবছি পরের বারের কমেন্টে, পড়া ধরার মতো জিগেশ করাটা ঠিক হবে কিনা, যে তড়কা প্যানে আলু সদেকো রান্না হোলো কিনা! হাহা!
সিরিজের শেষ লেখা যখন, এটা পড়ে যখন পুরো সিরিজটার কথা ভাবছি, যদি তারিখ বা দিনের উল্লেখগুলো অতিরিক্ত মনোযোগ দিয়ে হিসেবে না করি, বেশ একটা "অনেকদিনের গল্প, অনেকটা সময় ব্যাপী, কত কিছু হয়েছে ..." ভাব আসছে।
অ্যাভন খুব কায়দার সাইকেল ছিল, আমার মনে আছে। আমারটা ছিল হিরো। লাল রঙের। মফঃস্বলে সাইকেল ছাড়া জীবন চালানো যায় না, জানেন নিশ্চয়, কাজেই সে সাইকেল আমার লাইফ লাইন ছিল।
Deleteতড়কা প্যানে আলু সদেকো এই উইকেন্ডে হবে না। অর্চিষ্মান যে রকম মুখ করে কাজ করছে, চা খাবে কি না জিজ্ঞাসা করতেই বুক ধড়ফড় করছে, আলু সদেকো করতে বললে ভাববে আমার সিপ্রালেক্স ফুরিয়ে গেছে। দেখা যাক কবে হয়।
Tomar deya link ta dekhe aloo sodeko barombar baniechi, kheyechi ar mone mone tomake thank you bolechi Kuntala.
ReplyDeleteআরে তাই নাকি? বাহ বাহ। শুনে ভারী আনন্দ পেলাম, শর্মিলা। ভালো কি না খাবারটা, বল?
Deleteআমাদের বাড়ির ছাদের দরজাটাও জেড লেখা, আবার ডবল জেড। ফাস্ট আর স্লো লাইফের কথা যেটা বললেন সেটা মোক্ষম। এই যে দুদিন হুগলিতে এসেছি, আর স্রেফ কিচ্ছু না করে সারাদিন কেটে যাচ্ছে, এটাকেই স্লো লাইফ বলে। ফাস্ট আর স্লোয়ের মধ্যে আমার কোনটা বেশি পছন্দ সেটা গেস করার জন্য কোনও প্রাইজ নেই।
ReplyDeleteঅ্যাজ ইউজুয়াল আপনার লেখা আর বর্ণনা লা-জবাব।
ডবল জেড-এ হাই ফাইভ। আপনার হুগলীবাস দারুণ আরামের আর দারুণ স্লো হোক। বাড়ি যাওয়া হল না, না হলে অবশ্যই দেখা হত। গরমকে কাঁচকলা দেখিয়ে।
Delete