শেষার্ধ


ড্রাইভারদাদা জিজ্ঞাসা করলেন হাওড়া নতুন প্ল্যাটফর্ম না পুরোনো? বললাম পুরোনো। অর্চিষ্মান বলল শিওর? কী বলব। গাড়ি থেকে নেমে টিকিট কাউন্টার। আমার সব পাঁচশো। অর্চিষ্মান পকেট থেকে একশোর নোট বার করে দিল। দিদি বললেন দশ টাকা দিন। অর্চিষ্মান বলল দশ দশ কুড়ি? আমি বললাম পাঁচ পাঁচ দশ।

বড় বড় বোর্ডে ট্রেনের নাম জ্বলছে। পাঁচে বর্ধমান দিয়েছে। কর্ড। অর্চিষ্মান বলছে কর্ড যাবে না রিষড়ায়? কোনদিন জানতে চাইবে সূর্য পশ্চিমদিকে উঠবে না? একে বর্ধমান মেন ঢুকছে। গ্যালপিং। শিওর রিষড়া ধরবে না। অর্চিষ্মান মুচকি হাসছে। রিষড়া তেমন জরুরি স্টেশন নয় বুঝি? পাঁচ মিনিট কাটতে না কাটতেই অধৈর্য। এতগুলো ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে কোনওটা রিষড়া যাবে না? হতে পারে? তুমি গোলমাল করছ নির্ঘাত। আমাকেই দেখতে হবে।

বললাম মাস্টারশেফ অস্ট্রেলিয়া না ক্যানাডায় একবার প্রতিযোগীদের চোখ বেঁধে, ডমিন্যান্ট হাত পিঠে সেলোটেপ দিয়ে সেঁটে রান্না করতে দিয়েছিল মনে আছে? তুমি যদি আমার চশমা খুলে নিয়ে, দু’কানে তুলো গুঁজে, দু হাত পিছমোড়া করে . . . অর্চিষ্মান বলল বুঝেছি কুন্তলা, নাও কী বলছে শোনো।

মহিলাকণ্ঠে দৈববাণী হল, তারকেশ্বর ঢুকছে তিনে। ইয়েস। চলে এস। অর্চিষ্মান বলল এটা যদি না থামে রিষড়ায়? আমি বললাম এমন তারকেশ্বর ভূভারতে জন্মায়নি যেটা রিষড়ায় থামে না।

প্ল্যাটফর্মে যাত্রীভর্তি ট্রেন ঢুকলে একরকম ক্রাইসিস। নামার ভিড় ওঠার ভিড়ের সঙ্গে ঠেলাঠেলি। কারশেড থেকে ফাঁকা ট্রেন ঢুক্লে আরেকরকম। রানিং উঠতে হবে। যাতে দিনের সময় বুঝে জানালার ধার নয়তো সাইডের আধখানা সিট নিশ্চিত করা যায়। এই ট্রেনটা কারশেড থেকে ঢুকছে। এই নন-অফিস টাইমে জানালার ধার না পেলে আজীবন আয়নার সামনে দাঁড়াতে পারব না। রেডি হলাম।

নিজে সাতপাক না ঘুরলেও প্রচুর লোককে ঘুরতে দেখেছি। প্রথম তিন না চার পাক বর আগে আগে হাঁটে, তারপরের পাকগুলো বউ আগে যায়। মাঝপথে পজিশন চেঞ্জের কারণ পড়েছিলাম এক জায়গায়। কনফার্মড না হয়ে সে কারণ লিখে দেওয়া এই বাজারে বিপজ্জনক। গুগল করতে গেলাম। কাজের কাজ কিছু হল না শুধু বোঝা গেল আনন্দবাজার সাতপাক নিয়ে সিরিয়াসলি ভেবেছে। দু'তিনবার শব্দ সিন্ট্যাক্স বদলে সার্চ করতে গিয়ে নরনারীর নৈতিক জীবনে বিবাহের তাৎপর্য জাতীয় আর্টিকল বেরোতে লাগল, ট্যাব নিভিয়ে পালিয়ে এলাম।

মোদ্দা কথা, তারকেশ্বর তিন নম্বরে গুঁড়ি মেরে ঢুকতে লাগল, আমি অর্চিষ্মানকে পেছনে ফেলে সামনে গেলাম। দুই ভদ্রলোক আমার আগে লাফিয়ে উঠলেন, উঠে বাঁদিকে টার্ন নিলেন, আমি তিন নম্বরে উঠে ডানদিকে বেঁকলাম। হোপফুলি অর্চিষ্মান ছয় বা সাতে ম্যানেজ করতে পারবে। নিজে সিট দখল করে  ক্লান্ত ঘর্মাক্ত যাত্রীদের নাকের সামনে পাশের সিটে রুমাল রেখে বলব সরি দাদা আপনি প্রাণ হাতে নিয়ে উঠলে কী হবে এই সিটটা আমার বরের - অত স্মার্ট আমি নই। নিজের সিটটা ওকে ছেড়ে দেব বরং।

দরকার পড়ল না। জানালার পাশের সিটে বডি ফেলা মাত্র অর্চিষ্মান এসে গায়ে সেঁটে গেল। আমার ঠিক পেছন পেছন উঠে পড়েছে। কেয়া বাত। তিনবার কোভিড হলে কী হবে, অর্চিষ্মান আশ্চর্যরকম ফিট। বললেই মেলা গ্রাউন্ড তিন পাক দৌড়ে আসবে। তেমন না হাঁপিয়েই।

বসে বলল, উঠেই তো অতগুলো জানালা ছিল এত দূরেরটায় এলে কেন। ক'বছর আগে এক্স্যাক্টলি এই প্রশ্নের ষোলো নম্বরের উত্তর দিয়েছিলাম ওকে। ভুলে মেরে দিয়েছে। আবার বোঝালাম। চারটে জানালা। আটটা জানালার সিট। তাদের মধ্যে চারটে সিটের জানালার দেওয়াল ঢাকা অর্থাৎ হাওয়া কম। চারটের কাটা অর্থাৎ হাওয়া বেশি। অর্চিষ্মান বলল ওয়েট ঢাকা জানালা কাটা জানালা কী? এটাও আগে বুঝিয়েছি, আবার বোঝালাম। নমুনা হাতের কাছেই ছিল, দেখিয়ে এক্সপ্লেন করলাম। অর্চিষ্মান মুখ ভেচকালো। কুন্তলা, ঢাকা কাটা এক্স্যাক্টলি এক। কথা বাড়ালাম না। তিনতাল আর কাহারবা শুনেও অর্চিষ্মান সেম প্রতিক্রিয়া দিয়েছিল। কাটা জানালাওয়ালা চারটে সিটের মধ্যে দুটো হাওয়ার উল্টোদিকে। অর্থাৎ ট্রেন যেদিকে যাবে তার উল্টোদিকে মুখ ফেরানো। ও জানালায় বসাও যা না বসাও তা। বাকি রইল দুটো সিট। যে দুটোর একটা থেকে হিন্দমোটর আর কোন্নগরের মাঝখানের জলাজমির ওপারে সূর্যাস্ত দেখা যাবে। অগত্যা জানালার পাশের আটটা সিটের মধ্যে এফেক্টিভলি অপশন একটা। সেটাই আমি নিয়েছি।

যদিও সূর্যাস্ত দেখা যায়নি। হিন্দমোটর কারখানার বিস্তৃত ফাঁকা জমি লিজ নিয়ে হাউসিং হচ্ছে। ক্রেন দেখলাম। বহুতল দেখলাম। একটা আস্ত সূর্যাস্ত খুন হয়ে গেছে।

ট্রেনের দরজার সামনের ফাঁকা জায়গা ভরে উঠে লোক ক্রমে উপচে গলির ভেতর এসে পড়ল। অর্চিষ্মান কানের কাছে মুখ নিয়ে এসে বলল, ট্রেনে যা বুঝছি, অবশ্য বাসেও তাই, বডি কনট্যাক্ট এড়ানো খুব মুশকিল। আমি বললাম কেন তোমার কষ্ট হচ্ছে? অর্চিষ্মান বলল একটুও না। বললাম কিন্তু এই এতখানি রাস্তাটা দশ টাকায় সেটা ভাবো। অর্চিষ্মান বলল আমিও এক্স্যাক্টলি এই কথাটা ভাবছিলাম। এর জায়গায় উবারকে কত টাকা দিই। দুজনে চুপ করে রইলাম। পাবলিক ট্রান্সপোর্টের প্রতি সম্ভ্রমে, সেই ট্রান্সপোর্টের নাগালের বাইরে নিজেদের নিয়ে ফেলার প্রিভিলেজে, বাবামা নিজেদের দু'দুখানা সফল কেরিয়ার ট্রেনেবাসে নামিয়ে দিলেন আর আমি অটোতে বসেও গরমে গলে যাচ্ছি আজকাল,এসি ট্যাক্সি ডাকতে হচ্ছে - সব মনে পড়ে একটা ঘণ্টপাকানো ফিলিং মাথা ছেয়ে ফেলল। কথা না বাড়িয়ে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

যাত্রীর ভিড়ে অবাঙালির অনুপাত বলার মতো বেড়েছে। তাঁদের বাংলা বলার মতো বেটার হয়েছে। একটা ছেলে, বত্রিশতেত্রিশ, শার্টপ্যান্ট, মাথায় টিকি, কপালে সিঁদুর। হাওড়ায় ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকাকালীন ছেলেটার পাশের সিটের মহিলাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম ট্রেন ক’টায় ছাড়বে? মহিলা ইতস্তত করছিলেন, ছেলেটা ফোন দেখে বলল বেয়াল্লিশ। বেয়াল্লিশটা আমার থেকে বেটার উচ্চারণে বলল। জানালার বাইরে ভিড়। ভিড়ের চোখে চশমা, কাজল। আর ক্লান্তি।বাচ্চা মেয়েরা সবাই কোঅর্ড পিস পরে চলেছে। ছেলেদের ফ্যাশনও অবিকল জি কে টু-তে ওই বয়সের ছেলেরা যা পরে। কোয়ালিটি আলাদা হতে পারে, যারা পরেছ তাদের হাবভাব তো ডেফিনিটলি আলাদা, কিন্তু ফ্যাশনটা সেম।

উত্তরপাড়া ঢুকল। প্ল্যাটফর্ম শেষ হওয়ার পরেও জানালার বাইরে হাত বার করে দেখালাম। এই যে এই ঢাল বেয়ে নেমে সোজা গিয়ে, এই গলি বেয়ে তারপর মিনিট দশ ডানদিক বাঁদিক করলেই দেবীশ্বরী। অর্চিষ্মান বলল হাত ভেতরে ঢোকাও কুন্তলা। হিন্দমোটর গেল। কোন্নগর ঢুকছে। গেটের মুখে মিনি কুরুক্ষেত্র বেধেছে। ইস্যু পঁয়ত্রিশ বছরে বদলায়নি, নেক্সট পঁয়ত্রিশেও বদলাবে না। কোন্নগর নামবে না এমন কিছু লোক গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। কোন্নগরে যারা নামবে তারা সে সব লোকের চোদ্দপুরুষ একাকার করছে। অর্চিষ্মান নার্ভাস। এগোবে নাকি? আমি বলছি ধুর এখন কী। কোন্নগর যাক। কোন্নগর এসে গেছে। গেটে দুএকজন খুন হয়ে গেলে অবাক হব না।

কোন্নগর গেল। অর্চিষ্মান আমার পরামর্শের অপেক্ষা না করে উঠে পড়েছে। আমিও না ঘাঁটিয়ে উঠে পড়লাম। এবার চাইনিজ হুইসপার খেলতে হবে। আমি সামনের মহিলাকে জিজ্ঞাসা করব আপনি কি রিষড়া? মহিলা তাঁর সামনের ভদ্রলোককে জিজ্ঞাসা করবেন আপনি কি রিষড়া? তিনি আবার সামনের লোককে। এই করে চলবে। এর মধ্যে কেউ যদি বলে বসেন না আমি রিষড়া না তাহলেই সংগ্রাম।

সে রকম কেউ বললেন না। মোটামুটি নীরবেই রিষড়া ঢুকল। অত আগে উঠে পড়া সত্ত্বেও নামার ভিড়ের একেবারে ল্যাজে আমরা। ল্যাজে থাকার একটা অসুবিধে হচ্ছে পেছন থেকে ঠেলার কেউ থাকে না। ঠেলার দায় থাকলে নিজেদেরই হাতা গোটাতে হবে। অবশ্য আমরা ঠেলিনি। ঠেলা দূর, কাউকে টাচ পর্যন্ত করিনি। অন গড ফাদার মাদার। আমরাও নামলাম, ট্রেনও ভোঁ দিল। অর্চিষ্মান আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। আমি অর্চিষ্মানের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। ভোঁ দিলেও তক্ষুনি ছাড়ল না ট্রেন। হয়তো সিগন্যাল পায়নি। গার্ড ভদ্রলোক দরজা ধরে স্লাইট ঝুঁকে সামনের দিকে দেখছেন। ট্রেনলাইনে বড় হওয়া বাচ্চাদের ড্রাইভার নিয়ে মুগ্ধতার ঐতিহ্য আছে, আমার চোখ খারাপ বলে বা অন্য কোনও কারণেই হোক আমি ড্রাইভার ভদ্রলোককে ঠিক করে কোনওদিন দেখতে পাইনি। আমি চিরদিন দেখেছি ট্রেনের পেছনের ফালি দরজার হ্যান্ডেল ধরে ঈষৎ ঝুঁকে থাকা গার্ড ভদ্রলোককে। ছিয়াশি সাল থেকে দেখে আসছি। উচ্চতা আনুমানিক পাঁচ সাত। কমবেশি সত্তর কেজি। ঈষৎ টেরি, কান ঢাকা জুলপি, কুচকুচে গোঁফ, ধপধপে শার্টপ্যান্ট। মৃদু ভুঁড়িতে চেপে বসা কালো বেল্ট। পিকাসো তাঁর প্রতিকৃতি আঁকার মাঝপথে গার্ট্রুড স্টাইন সেই যে পয়েন্ট আউট করেছিলেন, আই ডোন্ট লুক লাইক দ্যাট, আর পিকাসো বলেছিলেন ডোন্ট ওয়রি, ইউ উইল, ওয়ান্স দা পোর্ট্রেট ইজ ফিনিশড, আমারও এক্স্যাকটলি সেই মত। গার্ডের চাকরিতে ঢোকার আগে আপনি যেমনই দেখতে হোন, চাকরিতে ঢোকার পর আপনি সে রকম দেখতে হয়ে যাবেন যেমন আমি বর্ণনা করলাম।

মিষ্টি কিনে টোটোতে চড়ে বাড়ি চলে এলাম। বিজলীদি আধঘণ্টা আগে বেরিয়ে গেছে। শ্যামলী এখনও ঢোকেনি। বাবা চা করে খাওয়ানোর অফার দিয়েছিলেন, রিফিউজ করলাম। আমিই চা করলাম, বাবার ভ্যারাইটি বিস্কুট নিমকির সম্ভার সহযোগে খাওয়া হল। বাথরুমের র‍্যাকে আনকোরা ফোম ফেসওয়াশ। প্যারাবেন-ফ্রি শ্যাম্পু। প্ল্যান ছিল না তবু ফেসওয়াশ মেখে, মাথা ঘষে স্নান করলাম। বেরিয়ে বাবাকে থ্যাংক ইউ বলতে গিয়ে দেখি হাতে সূর্য মোদকের বাক্স নিয়ে শ্যামলী ঢুকছে। ওর বাড়ি চন্দননগর স্টেশনে নেমে যেতে হয়। অর্চিষ্মানের জন্য সূর্য মোদকের জলভরা আনতে বলে দিয়েছিলেন বাবা। বাবা শ্যামলীকে বলেছিলেন। শ্যামলী বিজয়কে বলেছিল। বিজয়কে আমরা কেউ দেখিনি, শ্যামলীর মুখে গল্প শুনেছি। বিজয় অনাথআশ্রমে বড় হয়েছে। পরীক্ষা দিয়ে প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতায় ঢুকেছে, প্রাইমারি থেকে হাইস্কুলে। শ্যামলীকে বলেছে দিদি, আমি একদিন কলেজে পড়াব। আমি জানি, সকলেই জানে বিজয় একদিন কলেজে পড়াবে। নিজেকে দেওয়া কথা রাখার একটা টাইপ লাগে। বিজয় সেই টাইপ। আমি সেই টাইপ না। অন্যের কথা না রাখার গ্লানি এক, নিজের কথা না রাখার আরেক। নিজের প্রসঙ্গ বিজয়ের প্রসঙ্গে আনার দরকার ছিল না। কিন্তু যে কোনও প্রসঙ্গে নিজের প্রসঙ্গ এনে ফেলা আমার টাইপ।

নিজের জন্য কাছের বাজার থেকে মাটন আনেন বাবা, অর্চিষ্মানের জন্য জাহাঙ্গিরের দোকানে যান। রাতে খেতে বসে মাংস মুখে দিয়ে আহাউহু করে উঠল অর্চিষ্মান। ওর জন্য মাংস ছিল, মাছ ছিল, মাছের ডিমের বড়াও। অর্চিষ্মান মাছ স্কিপ করে মাছের ডিমের বড়া বাছল। আমারও এমন কিছু দুঃখের সিন হয়নি। সামনের তিনদিন খারকোলপাতা বাটা, শুষনি শাক ভাজা, নিমবেগুন, আমড়ার ডাল, সজনেডাঁটার চচ্চড়ি, ডালের বড়ার ঝোল, আলুপোস্ত, আমি ভালোবাসি বলে বিজলীদির বাড়ি থেকে বানিয়ে আনা আলুসয়াবিন, গুড় আম, আমড়ার টক।  দুপুরে আলুকাবলি। ক্লিশে হলেও সত্যি - বিজলীদি আলুকাবলির দোকান দিতে পারে। অত ভালো আলুকাবলি; প্রফেশনালদের হাতেও খাইনি। ইউটিউবে কত কাণ্ড করে লোকে। সিক্রেট মশলা, চাট মশলা, অল্প একটু জায়ফল ছেঁচে। লাস্ট বাট নট দা লিস্ট, স্বাদ ব্যালান্স করার জন্য এক চা-চামচ চিনি। দিয়েই দেখুন, ঠকবেন না। বিজলীদির রেসিপিতে আলু সেদ্ধ, ছোলা সেদ্ধ, পেঁয়াজকুচি, কাঁচা লংকা কুচি, তেঁতুলের জল। ধনে একটু বেশি, জিরে একটু কম, গোলমরিচ, শুকনো লংকা। শেষ চারটে উপকরণ শুকনো খোলায় টেলে, গুঁড়িয়ে, প্রথম পাঁচটায় মিশিয়ে দিলেই ওয়ার্ল্ড ক্লাস আলুকাবলি। বারান্দার ফ্যান চালান, চেয়ার টানুন, প্লেটের দিকে তাকিয়ে পা দুলিয়ে দুলিয়ে খান।

প্রত্যেকবার খেতে খেতে বলি এবার বাড়ি গিয়ে বানাব। দু'নম্বর মার্কেটে এক প্লেট আলুকাবলির দাম করেছে পঞ্চাশ টাকা। বাড়িতে বানালে সব মিলিয়ে হয়তো দশ টাকাও লাগবে না। সবথেকে বড় কথা খেতে এক কোটিগুণ বেটার হবে। কিন্তু আমি জানি বানাব না। বিজলীদিও জানে। কোনও দরকার নেই অত ঝামেলার সোনা। খেতে ইচ্ছে করলে টিকিট কেটে সোজা বাড়ি চলে আসবে। আমি বানিয়ে দেব।

এটাকেই সম্ভবতঃ লাইফস্টাইল ফেমিনিজম বলে। যা শুধু ব্যক্তিমানুষের জীবনকে, পেশায় এবং পরিবারে একটা মোটামুটি সাম্য, সম্মানের জায়গায় দাঁড় করায়। এমন পরিধিতে ঘোরাঘুরির সুযোগ দেয় (অফ কোর্স, জন্মের জোর ম্যাটার করবে) যাতে হোপফুলি, ফিংগারস ক্রসড, কেউ দু'বেলা মোটা গলায় 'যেটা বোঝ না সেটা নিয়ে কথা বোলো না' বলে  ওঠে না। একটা ব্যক্তিগত বৃত্তের বিলাসের সুযোগ পাওয়া যায় আর পাওয়া যায় প্রিভিলেজোঁ কা প্রিভিলেজঃ নিজের সময়ের মালিকানা। যে সময়টা একটা লোক তার যা ইচ্ছে, যেমন ইচ্ছে খরচ করতে পারে। আর এই ব্যক্তি প্রিভিলেজের প্রাসাদ উঠবে সমষ্টির প্রিভিলেজহীনতার যুগযুগান্তের ভিতের ওপর। এক নারীর স্বাধীনতা লালিতপালিত হবে অন্য নারীদের পরিশ্রমের জমিতে। ফেমিনিজমের ফুরফুরে বাতাস কোনওদিন যাঁদের একপশলা ছোঁবে না। বিজলীদি দুপুরের ঘুম জলাঞ্জলি দিয়ে গরমের মধ্যে গ্যাসের আঁচে দাঁড়িয়ে আলুকাবলি বানাবে। মীরামাসি এসে সকালবেলা খাটের রেলিং-এ কনুই রেখে দাঁড়াবে। কী খাবে সোনা। শুধু চা খেলে শরীর নষ্ট হয়ে যাবে। চিঁড়ের পোলাও করে দিই। বিজলীদি ভুরু নাচিয়ে বলবে খাটের নিচে দেখেছ? আগের বার সিলিং থেকে কলার কাঁদি ঝুলছিল এবার খাটের নিচে আলু পেঁয়াজের কার্পেট। পঞ্চাশ কেজি আলু, পঞ্চাশ কেজি পেঁয়াজ। বাবা গিয়ে শ্যামলীদের পাড়ার ক্ষেত থেকে নিয়ে এসেছেন। আগের বার শ্যামলী বয়ে এনেছিল। ব্লিংকিটে চল্লিশ টাকা রেট চলছে আলুর। বাবা পনেরোতে পেয়েছেন। কিন্তু কিনে রাখলেই হয় না। সেগুলো দেখাশোনা করতে হয়। আমরা যাওয়ার আগের দিন শ্যামলী গুঁড়ি মেরে খাটের নিচে ঢুকে একটা একটা আলু পেঁয়াজ নাকের কাছে ধরে ঝেড়েছে বেছেছে, পাছে পচে ওঠা আলুপেঁয়াজের গন্ধে কলকেতার জামাইয়ের নাক পুড়ে যায়। অর্চিষ্মান বাড়িতে পরার পাজামা আনতে ভুলে গেছে। নো প্রবলেম, গোলটেবিলে সুটকেস দেখতে পাচ্ছি। খুললেই ধোয়া, কাচা, ইস্তিরি করা বাঁধনি প্রিন্টের সুতির লাল সালওয়ার কামিজ উইথ ওড়না থেকে শুরু করে অর্চিষ্মানের ধপধপে পাজামা পাঞ্জাবী শার্ট টিশার্ট ট্র্যাকসুট আরও যা যা আনুষঙ্গিক। বিজলীদি রেডি করে রেখেছে। হাওয়াইচটি জোড়াও আলমারির নিচে পরিপাটি। যাতে আমাকে চটি কোথায় গামছা কোথায় এসব হাবিজাবিতে মাথা ঘামাতে না হয়। যাতে আমি নিশ্চিন্তে নিজের বৃত্তে ঢুকে নিজের সময় নিয়ে ক্যান্ডি ক্রাশ খেলতে পারি।

ইউটিউবে ফুডকা চ্যানেলের জিলা সিরিজে শ্রীরামপুর কোন্নগরের তেলেভাজার এপিসোড দেখা থেকে অর্চিষ্মান "মদনে চল, ভণ্ডুলে চল" করছে। মদন শ্রীরামপুরের লিজেন্ডারি চপের দোকান। ভণ্ডুল কোন্নগরের বিখ্যাত বোমার দোকান। বোমা অর্থে মাংসের চপ। ফুলুরিটুলুরিও পাওয়া যায়। অর্চিষ্মানকে শ্বশুরবাড়ির এলাকার ফেমাস খাবার খাওয়ানো হয়নি এমন না। ফেলু মোদক, সূর্য মোদক, অমরের মিষ্টি। ওর চপ-পৃষ্ঠপোষকতার খবর পেয়ে সেজকাকু ওকে টমেটোর চপ, বিটের চপ গোটা ধনেপাতার গোটা ঝাড় বেসনে ডুবিয়ে ভাজা এনেও খাইয়েছে। কিন্তু যেহেতু ইউটিউবে মীর, মদন, ভণ্ডুল আর বাসন্তী কেবিনে খেয়েছেন, অর্চিষ্মানের রাতে ঘুম হচ্ছে না ওসব দোকানে না খেলে। প্রত্যেকবারই পণ করি এবার যাব, প্রত্যেকবারই যাওয়া হয় না। অর্চিষ্মান কম সময়ের জন্য আসে, তার মধ্যে চপ খেতে গেলে বাড়িতে থাকা হয় না। তাছাড়া আমাদের যা খাওয়ার ক্ষমতা মদনের ফিশ ফ্রাই ভণ্ডুলের বোমা পেটে পড়লে নেক্সট দেড়বেলা কিছুই খেয়ে ওঠা হবে না। বাবার মাথা খাটিয়ে করিয়ে রাখা রান্নাবান্না নষ্ট হবে। এবারও মদনভণ্ডুল যাওয়া হল না। শুনেছি আমাদের সবার জীবনেই একটা নর্থ স্টার থাকে যেটার দিকে তাকিয়ে আমরা জীবনের পথ হাঁটি। যতই হাঁটি সেটা নাগালের বাইরে থেকে যায় আর থেকে যায় বলেই আমাদের গোটা রাস্তা হাঁটাও হয়ে যায়। মদন এবং ভণ্ডুল - অর্চিষ্মানের জীবনের সেই একটিমাত্র নয়, দু’দুটি নর্থ স্টার।

রবিবার সকালে উঠে সেজকাকুর বাড়ি গেলাম। নেব না নেব না করেও রিকশা নিলাম। যা গরম। চারদিকে লোকনাথপুজোর মাইক বাজছে। মহামায়া মিষ্টান্নে প্যাকেট প্যাকেট অমৃতি প্যাক হচ্ছে। লোকনাথের পছন্দের প্রসাদ যে অমৃতি সেটা এবার বাড়ি গিয়ে জানলাম। কাকুর বাড়ির সামনে নেমে ভাড়া মিটিয়ে থ্যাংক ইউ বলাতে ভদ্রলোক বকে দিলেন। তুমি বাঙালির মেয়ে, ধন্যবাদ বলবে। আমি লজ্জা পেলাম, অর্চিষ্মান দাঁত বার করল।

কাকু আর শ্যামাদির বাড়ির অনেক মজা। এক, বিস্কুট। কাকুর বাড়ি গেছি এবং আনকোরা নতুন রকম বিস্কুট খাইনি এ রকম হয়নি। দুই, বেড়ানোর গল্প। পশ্চিমবঙ্গের একটি বিখ্যাত ট্র্যাভেল কোম্পানিতে কাকু দীর্ঘদিন চাকরি করতেন। এখনও নিয়মিত বেড়াতে যান। এখন যেটা এক্সট্রা করেন সেটা হচ্ছে বেড়িয়ে এসে লিখে ফেলা। নিজের লেখা ভ্রমণকাহিনী পড়ে শোনান কাকু। কৈশোর যৌবনে পাড়ার নাটকে প্রত্যেকবার মেন পার্ট পেতেন, যার ঝলক এখনও কাকুর পাঠে শোনা যায়। কিন্তু সবথেকে মজা হচ্ছে কাকুর রাজনৈতিক বক্তব্য শোনা। কাকুকে প্রথম দেখার পর অর্চিষ্মান বলেছিল, তোমার রাগের রহস্য এতদিনে বোঝা গেল। রাগী তো বটেই, কাকু অত্যন্ত খারাপ রকমের তার্কিক। যুক্তির থেকে গলার জোর বেশি ব্যবহার করেন, উত্তেজিত হয়ে খাটবিছানা চেয়ারটেবিল পেটান, তর্ক শুরু হওয়ার দেড় মিনিটের মধ্যে ব্যক্তিগত অ্যাটাকে যান। বিপক্ষে থাকলে কেমন লাগত জানি না কিন্তু রাজনৈতিক মতে কাকু আমাদের পক্ষে। কাজেই কাকুর সঙ্গে রাজনীতির আলোচনায় আমরা অসামান্য আনন্দ পাই। যে আমি পলিটিক্সের প শুনলেই কানে আঙুল দিই, কাকুর বাড়িতে গিয়ে কাকুর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চেঁচিয়ে রাজনৈতিক মত প্রকাশ করি।

এবার যদিও ভয়ে ভয়ে গেছিলাম। কারণ শ্যামাদির কাছে ক্ষমাপ্রার্থনার ব্যাপার ছিল। শ্যামাদির বাবা মারা গেছেন কয়েকমাস আগে। মা মারা গেছিলেন আমরা ছোট থাকতেই, বাবাও চলে গেলেন। একটা ফোন পর্যন্ত করিনি। মানবিকতা ইত্যাদি যদি ছেড়েও দিই, স্রেফ ট্র্যানজ্যাকশন হিসেবে দেখলেও, ফোন তো বটেই, আরও অনেক বেশি করে শ্যামাদির সঙ্গে থাকা উচিত ছিল। আমার মা মারা যাওয়ার সময় শ্যামাদি আমার ছায়া হয়ে ছিল। আজকাল মনে হয় যা হয়েছে তার প্রতিটি বিন্দু ডিজার্ভ করি। আরও খারাপ যে কিছু হয়নি সেটাই কপাল।

কপাল এবারেও কাজ করল। ক্ষমা চাইলাম। শ্যামাদি বলল সোনা তোর ওপর রাগ করেছিলাম সত্যি কিন্তু সে রাগ ছেড়ে দিলাম, এই নে। বলে সুন্দর কাপে চা করে এনে দিল, কাকুর বিখ্যাত বিস্কুট দিয়ে সে চা খেলাম। ভাত খেয়ে যাওয়ার জন্য জোরাজুরি করল দুজনেই, কথা দিয়ে এলাম পরের বার এসে খাব। খাবই।

বাড়ি ফিরে দুপুরের খাবার খেয়ে অর্চিষ্মান রওনা দিল। সব বাড়িতেই মেনুর শেষদিকে এমন কিছু পদ থাকে, রসগোল্লার পায়েস বা মিষ্টি দই, যেগুলো অতিথি খাওয়ার সময় খেতে অপারগ হন এবং বেরোনোর আগে খেয়ে বেরোনোর বন্ড সই করেন। বিজলীদি মনে করাল অর্চিষ্মানের মিষ্টি দই বাকি আছে। অর্চিষ্মান করুণ মুখ করল। বিজলীদি বেনেভোলেন্ট হাসল। বাবা বললেন না না অনেকদূরের রাস্তা, অনিচ্ছেয় খেলে শরীর খারাপ করবে। অর্চিষ্মানের ফোনের স্ক্রিনে উবার ভেসে ভেসে লিলুয়াপাড়ায় ঢুকে পড়েছে, অর্চিষ্মান জুতোয় পা গলিয়ে ফেলেছে, এমন সময় বিজলীদি কপাল চাপড়ে দৌড়ে রান্নাঘরে গেল। একটা প্লেটে চামচ গুঁজে নিয়ে এসেছে। এটা খেয়ে যেতেই হবে। তালশাঁস। সন্দেশ তালশাঁস না, সত্যি সত্যি তালের শাঁস। অর্চিষ্মান বলল নাহ্‌ এটা খেতে পারি। বাবা বললেন ভাবো এইরকম তুলতুলে একটা জিনিস হয়ে যাবে তালের সবথেকে শক্ত পার্ট আঁটি। আর শাঁসের খোসা যেটা এখন খাওয়াই যাচ্ছে না সেটা হয়ে যাবে তালের সবথেকে সুস্বাদু অংশ।

তালের জীবনচক্রের কথা ভাবতে ভাবতে তক্তপোষে বাবু হয়ে বসা বাবা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলেন। আমি চেয়ারে বসে মেঝের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। অর্চিষ্মান চামচ দিয়ে কেটে কেটে তালশাঁস খেল। বিজলীদি ডানহাত দিয়ে বাঁ কনুই চুলকোতে লাগল। উবার বাড়ির সামনে হর্ন দিল। অর্চিষ্মান প্লেট নামিয়ে রাখার আগেই বিজলীদি এসে ছোঁ মারল। অর্চিষ্মান বাবাকে প্রণাম করে বলল আসি কাকু। খুব ভালো লাগল। কত কিছু খেলাম। গরমটা একটু কমলে একবার দিল্লি আসুন।

বাবা বললেন সোনা একটা কথা জানতিস? অর্থাৎ আমার জানার কোনও চান্সই নেই। পাড়ার এক জেঠু মারা গেছেন তাও বোধহয় বছর তিনেক হয়ে গেল। লাস্ট মৃত্যুবার্ষিকীতে নাকি জেঠুর একটা ভালো নাম বেরিয়েছে। বাবা তিপ্পান্ন বছর পাড়ায় আছেন। এত বছর শ্যামলদার সঙ্গে ছায়ার মতো থেকেছি লোকটার নাম জানতাম না?

থাকার কথায় মনে পড়ল। খাটে স্টারফিশের ভঙ্গিতে শুয়ে আছি। অর্চিষ্মান দেখছে। কী ব্যাপার জানতে চাওয়ায় বলল দেখছি, তোমার আরাম। এ তো দিল্লিতেও দেখো। নাকতলাতেও। নাকতলাতে স্টারফিশ হয়তো হই না, সেটুকু সহবত এখনও গোল্লায় দিইনি কিন্তু শবাসন তো দেখোই। অর্চিষ্মান বলল, নাহ, ডিফারেন্স আছে। দিল্লির আরামের ভঙ্গি আর এই আরামের ভঙ্গি এক নয়। এখানে তুমি পুরো তুমি। কমপ্লিট তুমি। পৃথিবীর সমস্ত জায়গার তোমার থেকে বেশি করে তুমি।

এটা আরেকটা প্রসঙ্গেও বলে অর্চিষ্মান। আমি আমার মামাতো, জেঠতুতো দু'দিকের ভাইবোনদের সঙ্গেই ক্লোজ। যে রকম ক্লোজনেসের সঙ্গে প্রিয় বই, প্রিয় বাদ, প্রিয় রাজনীতির সম্পর্ক নেই। ক্লোজ কারণ রক্তের সম্পর্ক। বিয়ের পর প্রথমবার দু'বাড়ি বেড়ানো সারা হলে অর্চিষ্মান বলেছিল গল্প শুনে তো মনে হয়েছিল তুমি তোমার মামাতো ভাইবোনদের সঙ্গে অনেক বেশি ক্লোজ। মনা-টুনার সঙ্গে এত বেশি ক্লোজ তো বলোনি? প্রতিবাদ করেছিলাম। ধুস। দু'পক্ষের সঙ্গে এক্স্যাকটলি একরকম ক্লোজ। অ্যাকচুয়ালি, দোলনসুমনের সঙ্গে অনেক বেশি সময় কাটিয়েছি। কত দৌড়োদৌড়ি, হাহাহিহি, রাত জেগে ভুতের গল্প। মনাটুনাকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি কিন্তু সঙ্গ তুলনায় কম পেয়েছি। মাথা নেড়েছিল অর্চিষ্মান। কমবেশি জানি না, চারজনের সঙ্গেই তোমাকে দেখলাম তো। তুমি মামাবাড়িতে ভীষণ আনন্দে থাকো মানছি, কিন্তু ও আনন্দটা বেড়াতে যাওয়ার আনন্দ। মনাটুনার সঙ্গে তোমাকে দেখলে বোঝা যায় এরা তোমার বাড়ির লোক। একবাড়িতে থাকো আর না-ই থাকো, সময় কাটাও বা না কাটাও, তুমি আসলে এদের।

কে যে আসলে কার। যদি এমন হয় যে সারা জীবন বুঝতেই পারলাম না আমি আসলে কার? কোথাকার? কেরিয়ার, শহর, বাড়ি - কী সাঙ্ঘাতিক হবে যদি প্রতিটি ক্ষেত্রে যেখানকার নই সেখানটায় থেকে যাই? নাকি এ রকমই হয়েছে অলরেডি? না হলে দিনরাতগুলো এত কঠিন ঠেকছে কেন? যা নই, যাদের নই, যেখানকার নই, জোর করে সেখানে নিজেকে গুঁজে রেখেছি বলেই কি প্রতিটি দিন সিসিফাসের পাথর হয়ে উঠছে?

ভাইবোনের ব্যাপার জানি না, আমি যে রিষড়ার বাড়ির সেটা নিয়ে আমারও কোনও সন্দেহ নেই। এই বাড়িটা সমস্ত অর্থে আমার পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস। বাড়িটা ঠিক বাড়ি নেই, আমার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের অংশ হয়ে গেছে। রাদার আমি বাড়িটার নাটবল্টুর অংশ হয়ে গেছি। জন্মের দু'দিন পর যে বাড়িতে তোয়ালেপেঁচা হয়ে এসে ঢুকেছিলাম সাড়ে তেতাল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত সে বাড়িতেই ফিরে ফিরে আসছি, চেনা লোকজনের মধ্যে এমন উদাহরণ বেশি বাকি নেই। হাতে থাকলে নিজের মৃত্যুটাও এই বাড়িতে অ্যারেঞ্জ করতাম। জন্মে থেকে যে তিন নারীকে চিনেছি - মা, ঠাকুমা, পিসি, সবাই এই বাড়িতে থাকতে থাকতেই মরেছেন। তাঁদের অগস্ট কম্প্যানিতে জুটতে পারলে ভালোই হত। মোস্ট প্রব্যাবলি পারব না। আমি মরার আগে এ বাড়ি মরবে। বুলডোজার এসে বাড়িকে মাটিতে মিশিয়ে দেবে। তার থেকেও বেশি অসহনীয় - অবশ্য এতদিনে বুঝে গেছি সব অসহনীয়ই সয়ে নেওয়া যায় - এই আম কাঁঠাল নারকেল সুপুরি পেয়ারা নিম বেল কলা কলকে কাঞ্চন কামিনী গন্ধরাজ শিউলি রঙ্গন খারকোল আমআদা একদিন ধ্বংস হবে।

মন ভালো করতে পাড়া বেড়াতে যাই। মতলব করে যাই বলেই হয়তো অনেক সময় ভালোর বদলে খারাপ নিয়ে ফিরে আসি। বয়স যে হয়েছে আয়নায় বুঝতে পারি। বলিরেখা দিয়ে নয়। চামড়ায় মাধ্যাকর্ষণের টান দিয়ে নয়। আমার এখনকার মুখ দেখে কুড়ি বছর পরে কেমন দেখতে হব সেটা কল্পনা করা সোজা দ্যান কুড়ি বছর আগে কেমন দেখতে ছিলাম - সেই সত্যিটা দিয়ে। বয়স হওয়ার আরেকটা লক্ষণ, এখন পাড়া বেড়াতে যাই ছোটদের সঙ্গে দেখা করতে নয়, নিজের বয়সীদের সঙ্গে দেখা করতেও নয়, এখন ভালো লাগে জেঠিমাকাকিমাদের সঙ্গ। তা বলে বাকিদের সঙ্গে দেখা হলে কি খারাপ লাগে? বাচ্চাদের সঙ্গ অবধারিত মন ভালো করে। তবে বাচ্চাওয়ালা বাড়িতে যাওয়া রিস্কি হয়ে পড়েছে। সর্বদাই তাদের পড়াশুনো চলে। পরীক্ষার সময়েও, গরমের ছুটিতেও। বাবামায়েরা  পড়তে বসার জন্য এমন  বকাঝকা করতে থাকেন, অতিথির সামনেই; অনেক সময় বাচ্চাকে ছেড়ে বাবা মাকে বকতে থাকেন, মা বাবাকে - তারপরেও গ্যাঁট হয়ে বসে থাকতে হলে চামড়ার জোর লাগে।

অর্চিষ্মান অবশ্য বলবে দ্যাট প্রুভস নাথিং। এর মধ্যে কবে একটা দুঃখের কথা বলতে গেলাম, ফোঁস করে উঠল। কুন্তলা, কারও দোষ নেই, তোমার চামড়া বাড়াবাড়ি রকম পাতলা। ও নিন্দে হিসেবেই বলেছিল, আমি কমপ্লিমেন্ট হিসেবেই নিলাম। পাটিসাপটা আর মানুষ - দুইই পাতলা চামড়াসম্পন্ন ভ্যারাইটির প্রেফার করি। যাই হোক, অর্চিষ্মান যতটা বলছে ততটা পাতলাও নিশ্চয় নয় কারণ গতবার খারাপ অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েও এবার আবার একজনের বাড়ি গেলাম। গেলাম কারণ সে বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ প্রজন্ম  বলেছিলেন সোনা আসিস। আগের বারের মতো না হলেও অল্প করে একই জিনিস ঘটল। বাড়ি ফিরে ছাদে ঘুরতে ঘুরতে ভাবলাম কেমন এমন ঘটছে। হয় সমস্যাটা পড়তে বসাটসা নিয়ে নয়, আমাকে নিয়ে। আমি কিছু একটা বেচাল করেছি যেটা আমার মনে নেই বা চিহ্নিত করতে পারছি না। দুই, নিজেদের মধ্যে কিছু একটা গোলমাল চলছে সেটার প্রকাশ এইভাবে ঘটছে। যেটাই হোক, পরের বার এই প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি না হয়ে ব্যাপারটা ম্যানেজ করা যায় কী করে ভাবতে হবে।

সবটাই খারাপ না। গসিপ জোগাড় হয়। টুকাইদার বাড়ি বিক্রি হচ্ছে না। দাম বেশি পাবে বলে যতবার মারওয়াড়ি খদ্দের জোগাড় করছে টুকাইদা, পাড়ার অলিখিত 'অবাঙালি ঠেকাও' কমিটি ভাঙচি দিচ্ছে।

বাড়িতে ফিরে ঠাকুমার ঘরেই থাকি। ওই ঘরে এসি। বাবা মেয়েকে ছেড়ে দিয়ে নিজে গরমে সামনের ঘরে বসে আছেন। আমি যে খুব এসি চালাই তেমন না। ওইরকম গাছপালার চক্রব্যূহের ভেতর বাড়ি, তার ওপর তাপমাত্রা চল্লিশের নিচে বা বড় জোর বেয়াল্লিশ - এসি চালানোর দরকার পড়ে না। আমি যদিও বাবার জন্য কিছু ছাড়িটাড়ি না। এই যে ছ'বেলা থাকলাম, মনে মনে শপথ করে গেছিলাম, মাথা গরম করব না। পারলাম না। বাবার একটা সামান্য কথার উত্তরে তিনটে কথা শুনিয়ে দিলাম। বাবা চুপ করে রইলেন। রাতে খেলাম না। শ্যামলী বলল মশারি টাঙিয়ে দিই সোনা? বন্ধ দরজার এ পার থেকে লাগবে না বলে দুমদাম মশারি টাঙিয়ে শুয়ে পড়লাম। এদিকে বাবা ফোনে আমার গলায় ক্লান্তি টের পেলে সারাদিন গান পাঠান।

লোককে বলি বাবার সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি, আসলে বাবার সঙ্গে আমার দেখা হয় না। বাবাকে আমি দেখতেই পাই না। সেদিন ইউটিউব রিলে একটা থিওরি থমকে দিল। আমরা ততক্ষণ নিজেদের বাবামাকে দেখতে পাই না যতক্ষণ নিজেরা বাবামা না হই। তার মানে আমি আমার মাবাবাকে কোনওদিন দেখতেই পাইনি।

দুঃখ ভুলতে ছাদে যাই। নতুন করে দুঃখ পেতেও ছাদে যাই। ভুলে যাওয়া দুঃখ মনে করতে ছাদে যাই। আনন্দ পেয়ে, না পেয়ে ছাদে যাই। বাড়ি গেলে জাগরণের অধিকাংশ সময়টা ছাদে কাটে। এই গরমে ব্যাপারটা পাগলের কাণ্ড কিন্তু হু কেয়ারস। এই ক’দিনে আমাকে খোলা আকাশের নিচে ঘোরাঘুরির ঘড়া পূর্ণ করে বাড়ি ফিরতে হয়। কানে গান চলে। ইউটিউব প্রিমিয়াম নেই আমার, গানের ফাঁকে কোটি কোটি অ্যাড। দোশ টাকায় কাপড় কাচার সোস্তা সোহজ সোমাধান। রাতে নিমগাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে টুকাইদার দোতলা এফোঁড় ওফোঁড় করে মোড়ের ল্যাম্পপোস্টের আলো চোখে এসে পড়ে। চৈতালিবৌদি মারা গেছে অনেকদিন, টুকাইদার মেয়ের বিয়েও হয়ে গেছে বেশ ক’বছর। বাড়ি তো ফাঁকাই ছিল। কতবার ছাদে উঠেছি, কোনওদিন এফোঁড় ওফোঁড়  দেখতে পাইনি। বাড়ির লোক কমলে নয়, বাড়ির লোকের মন বাড়ি থেকে উঠে গেলে বাড়ি বেশি করে ফাঁকা হয়ে যায়।

সে জন্যই হয়তো আমাদের বাড়িটা এখনও খালি লাগে না। বাবা একা থাকা সত্ত্বেও। বিজলীদি শ্যামলী মীরামাসি শিখা - এঁরা আছেন, তাছাড়া কোটি কোটি বেড়ালছানা ট্রেসপাস করছে হরবখত। বাবা দেখলেই তাড়ান কিন্তু রত্নাকাকিমা আর গঙ্গারাম পাড়ার কুকুরবেড়ালদের যত্ন করে। কাকিমার পাঁচিল বেয়ে বেড়াল আর তাদের ছানারা লাইন দিয়ে হাঁটে। এমন কি ফুল সাইজ কুকুরগুলোও। বকুনির শব্দ শুনে ছাদ থেকে উঁকি মেরে দেখি একটা বিস্কুটরং নেড়ি বুক চিতিয়ে পাঁচিলের ওপর দাঁড়িয়ে আছে আর রত্নাকাকিমা নেড়ির পায়ে ছোট ছোট চড় মেরে তাকে নামানোর চেষ্টা করছেন। আমি মন্তব্য পাস করাতে কাকিমা বললেন পাঁচিলঘেঁষা রঙ্গন গাছটা নাকি ধেড়ে কুকুরের ঠেলা খেয়ে খেয়ে বেঁকে যাচ্ছে।

বাবা বলেন রত্না আর এই গঙ্গারাম দুজন মিলে গোটা পাড়ার কুকুরবেড়ালদের লাই দিয়ে মাথায় তুলছে। আমার বাবার শরীরের একটি রক্তবিন্দুও লাই দেওয়া টাইপ নয়, এই বয়সে বদলানোর আশা অলীক। একদিন এক বেড়ালছানাকে তাড়া দেওয়ার সময় এক পথচারী নাকি বাবাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। এ কি? এইটুকু বাচ্চাকে তাড়াচ্ছেন কেন। বাবা বলেছেন আমার বাড়ি আমি তাড়াব। আপনার অসুবিধে হলে আপনি বাড়ি নিয়ে যান। তখন নাকি ভদ্রলোক বলেছেন জানেন এরা মানুষের থেকে অনেক ভালো? বাবা বলেছেন সে হতে পারে তা বলে মানুষের সঙ্গ এক্ষুনি ত্যাগ করছি না। ডাক্তার ডাকতে হলে আমি মানুষকেই পাঠাব আপনি রেসকিউ করা বেড়ালছানা পাঠানোর অ্যাটেম্পট নিয়ে দেখতে পারেন।

গঙ্গারামও বাবার মতো একা। বাবার থেকে অনেক বেশি একা। একসময় গঙ্গারামের বাড়িভর্তি লোক ছিল। বাবা মা দিদি। তখন গঙ্গারাম তাদের সঙ্গে সারাদিন ঝগড়া করত। কাক চিল কুকুর বেড়াল ঘেঁষতে পারত না। জেঠু মারা যাওয়ার পরেও গঙ্গারামের তেজ বজায় ছিল। মাঝে মাঝে দিদি বাড়ি এলে কুরুক্ষেত্র। গালিগালাজ, তাণ্ডব। পাড়ার লোকদের রেগুলার হস্তক্ষেপ করতে হত। রোজ রাতে টলতে টলতে বাড়ি ফিরত। শ্যামলী বলেছিল ধুর, যত না মাতাল টলে তার থেকে বেশি। জেঠি মারা যাওয়ার পর ঝগড়া করার লোক ফুরিয়েছে, গঙ্গারামের মেজাজও ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। সাইকেলের হ্যান্ডেলে ব্যাগ ঝুলিয়ে বাজারের দিক থেকে আসে। সারাদিন ঘুরে ঘুরে বাড়ির কাজ করে। জেঠি মারা যাওয়ার পর দিদি এসে ভাইয়ের নামে বাবার রেখে যাওয়া এফ ডি-র কাগজপত্র বুঝিয়ে দিয়ে গেছে। সাক্ষী হিসেবে বাবাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল।

পাড়ার সাউন্ডস্কেপ বদলে গেছে। এই প্রথম, নাকি এই প্রথম খেয়াল করলাম জানি না, একদিনও সন্ধের মুখে হারমোনিয়াম রবীন্দ্রসংগীত বা ইমন ভেসে এল না। অর্চিষ্মান বলল আজকাল বাচ্চারা ও সব শেখে না। তোমার চেনা লোকের বাচ্চারা কী শেখে ভেবে দেখো? দেখলাম। তাইকোন্ডু, পিয়ানো, গিটার, ফুটবল। রবীন্দ্রসংগীত প্রায় কেউই শেখে না। এ ট্রেন্ড যদি না বদলায় অবশেষে বাঙালির ওপর থেকে গুরুদেবের স্ট্রংহোল্ড কমতে চলেছে।

ভোট মেটার উদযাপনে জোম্যাটো থেকে মটকা কুলফি আনালাম। দেশী মালাই আর ড্রাই ফ্রুটস। খাওয়া শেষ করে কুলফির মটকাটা বিজলীদিকে দিয়ে বাবা বলল, এটা ফেলো না কিন্তু ধুয়ে রাখো।  মনে পড়ল রান্নাঘরে কাবার্ড খুলে টি ব্যাগ আর চাপাতার বয়ামের পেছনে পাঁচ রো ইন্টু চার কলামের কুলফির মটকার সজ্জা দেখে অর্চিষ্মান কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। এগুলো কী হবে কুন্তলা? বলেছিলাম হবেই যে বলতে পারছি না কিন্তু ধর যদি ইউটিউব দেখে কোনওদিন মিষ্টি দই জমানো হয় তাহলে এই মটকাগুলোয় জমানো যেতে পারে আর তারপর এসি চালিয়ে হইচই দেখতে দেখতে ছোট ছোট কাঠের চামচ দিয়ে সেটা খাওয়া যেতে পারে। বলে কাবার্ডের কোণে জমানো ছোট ছোট কাঠের চামচগুলো দেখিয়েছিলাম। অর্চিষ্মান মাথা নেড়েছিল। তুমিও জানো হবে না।

বলেছিলাম, হওয়া না হওয়া পরের কথা, হতে যে পারে সেই সম্ভাবনাটা মনে মনে জিইয়ে রাখাটাই কি আসল আনন্দ না?

একদিন সন্ধের মুখে কুন্ডুবাড়ির ছাদের জলের পাইপের ওপর সাদা বিন্দু। লক্ষ্মীপ্যাঁচা। কী অসম্ভব স্থির। আমিও স্থির হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে থাকি। ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে কি না বুঝতে পারি না। আমি আমার চোখের এই পাওয়ার নিয়ে যদি ওকে দেখতে পাই, ও ওর চোখের ওই পাওয়ার নিয়ে আমাকে দেখতে পাচ্ছে না হতে পারে না। পরের তিন সন্ধেবেলাই প্যাঁচাটা এসে পাইপের মাথায় বসে। ব্রেনে ঝলক দেয়, কেমন হবে যদি প্যাঁচাটার সঙ্গে দেখা করাই  জীবনের কলিং করে নিই? সব ছেড়ে শুধু প্রতি সন্ধেয় প্যাঁচার অপেক্ষা? যতদিন প্যাঁচাটা আসে? তারপর না হয় . . .

মালক্ষ্মীর প্যাঁচা দেখতে পাওয়া নাকি প্রায় মালক্ষ্মীকেই পাওয়ার সমান। কিন্তু কে পাবে? কুণ্ডুদের ছাদ কুণ্ডুদের জলের পাইপ, কুণ্ডুরা? বাবার ছাদে দাঁড়িয়ে দেখছি, বাবা? নাকি আমি দেখছি বলে আমি আর অর্চিষ্মান? বিষয়চিন্তা বিসর্জন দিয়ে অর্চিষ্মানকে প্যাঁচাটা দেখানো মনস্থ করি। ছবি তুলে পাঠাই। অর্চিষ্মানের উত্তর আসে, আহ্‌ কী মায়া।

মায়াই তো সব।

ট্রু।

বেলা তিনটেয় প্লেন। সাড়ে বারোটায় গোপু আসে গাড়ি নিয়ে। টা টা করে উঠে পড়ি। গ্রিলের গেটে হাত রেখে বাবা বলেন সময় পেলে চলে আসিস। বলি আসব। বিজলীদি বলে সব দেখে নিয়েছ তো সোনা?  এবার সত্যি সত্যি সব দেখে নিয়েছি। (নিইনি। সবথেকে প্রিয় জামাটাই ফেলে এসেছি। আরও কিছু আনুষঙ্গিকের সঙ্গে।) ডিজিযাত্রা আছে, চেক-ইন করার ব্যাগ নেই তবু লাইনে দাঁড়াই। ওয়েব চেক ইনে অ্যাসাইনড মাঝের সিট জানালার সিটে পরিবর্তিত করার অ্যাটেম্পট নিতে হবে।

আস্ক, অ্যান্ড ইউ শ্যাল রিসিভ। জানালার সিট বাগিয়ে সিকিউরিটি সেরে বাবাকে জানাই। বই খুলে বসি। এতরকম লোক, মন বসানো শক্ত। বোর্ডিং শুরু হয়। ফ্যামিলিজ উইথ ইনফ্যান্টদেরও আগে দুই সরকারি দেখতে ভদ্রলোক ভিড়ের সামনে দিয়ে গটমটিয়ে  যান। প্লেনে উঠে দেখি ওঁদের পাশের জানালাটাই আমার। আইলের ভদ্রলোকের অবিরাম ফোন থেকে ফিগার আউট করি দিল্লিতে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে চলেছেন। এয়ারপোর্টে আমাদের রিসিভ করতে আসবে। রিসিভ শব্দটায় জোর দিয়ে ফোনে জানান ভদ্রলোক। একটা ফোন রাখতে না রাখতে আরেকটা ফোন আসে। হ্যাঁ বল। এই তো ছাড়বে। আমাদের যে শপথগ্রহণে ডেকেছে সেটা ডাক্তারবাবুকে বলে দিয়ো। ফোন রেখে আবার ডায়াল করেন। দিল্লির নেমন্তন্নের খবরটা দেন। এয়ারপোর্টে ওঁদের রিসিভ করার খবরটাও।

প্লেন ছুটতে শুরু করে। বইয়ের পাতায় আঙুল ঢুকিয়ে জানালায় মাথা ঠেকাই। ভিস্তারার ডানা বৃষ্টির ফোঁটায় ঢেকে যায়।

Comments

  1. বৈজয়ন্তীJuly 9, 2024 at 9:01 PM

    অনেকগুলো লুকিয়ে রাখা নরম জায়গায় আঙুল পড়ে গেলো।
    মায়ায় মাখামাখি পোস্ট। আমারও ওরকমই লাগছে। বাড়ি পাচ্ছে খুব করে।
    যদিও দূরত্ব এতটাই বেশি, ঝপ করে ঘুরে আসার সুযোগ নেই।
    বাড়িতে কেউ থাকেনা, তবে নিজের সাথে দেখা করা যায়..

    বেশ হয়েছে ছবিটা। টুকাইদাদের দোতলা? চাইলে রোম্যান্স, চাইলে হরর.. কিন্তু যাই হোক গল্প আছে বেশ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. মোবাইলের স্ক্রিনে প্যাঁচার সিলুয়েট টা বুঝতে পারিনি। ল্যাপটপ দেখে বুঝলাম।

      Delete
    2. হররটা ঠিকই ধরেছেন, বৈজয়ন্তী। লাইভ দেখে আমারও গা ছমছমই করেছিল প্রথমে। ওটা কুণ্ডুদের ছাদ। আর আলো জ্বলছে অভিজিৎদাদের দোতলায়। টুকাইদার বাড়ি ছাদের অন্যদিকে।

      বাড়ি যাওয়া আসলে বোধহয় নিজের সঙ্গে দেখা করতেই যাওয়া।

      Delete
  2. দারুন হয়েছে লেখাটা। আগেরটাও ভালো লেগেছিলো।

    একদম ঠিক - ট্রেনের জানলার সিটের মধ্যে র‍্যাংকিং আছেই।
    আর কাউকে টাচ না করে ওরম ভিড় ট্রেন থেকে নেমে পড়লেন! এটা তো দারুন কঠিন স্কিল।

    কর্ড লাইন মেন লাইন শুনে ছোটবেলার স্মৃতি মনে পড়লো একটু - বর্ধমানে ক্লাস ২ থেকে ক্লাস ৫ অবধি ছিলাম - বাবার ট্রান্সফারের চাকরির সুবাদে। তখন প্রায়ই হাওড়া-বর্ধমান করা হতো ট্রেনে, কর্ড লাইনটাই নেওয়া হতো বেশি। বর্ধমানে বিশাল বাগান সমেত সরকারি কোয়ার্টার ছিল। সেখানে একদিন লোড-শেড্ডিং এর মধ্যে, জীবনে প্রথম সাদা লক্ষ্মীপ্যাঁচা দেখেছিলাম, বাগানের একটা গাছের ডালে বসে ছিল, মা ডেকে দেখিয়েছিলো, এখনও আবছা আবছা মনে পরে।

    ছবিটা সুন্দর, লেখাটার সাথে একদম মানানসইও হয়েছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আহা টাচ না করে মানে ইন্টেনশনালি টাচ না করে। একশো বেয়াল্লিশ কোটির দেশে গায়ে গায়ে না ঠেকা অসম্ভব।

      সরকারি কোয়ার্টারের বর্ণনা শুনেই মন ভালো হয়ে গেল। কেমন হত যদি আমাদের সবার একটা অমন কোয়ার্টার থাকত।

      Delete
  3. Khub bhalo bhalo laglo ei lekhata. Boro maya jorano, pornto roddurer moto hothat asa bristir moto mayamoy. Bhalo thakben Kuntala, sab kichhu joriye.

    Hater boiti ki chhilo?

    Kaku bhalo thakun khub.

    ReplyDelete
    Replies
    1. মন ভালো হয়ে যায় এমন সাড়া পেলে। ব্যাগে দুটো বই ছিল, ওই মুহূর্তে হাতে কোনটা ছিল মনে পড়ছে না, তাই দুটোর নামই লিখে দিচ্ছি।

      ১। অভিজিৎ দাশগুপ্তর 'শাম্ব আর সেই নুয়ে পড়া মানুষ'
      ২। মনীষ গায়কোয়াড়ের 'The Last Courtesan: Writing My Mother's Memoir'

      Delete
  4. সব সময় কমেন্ট করা হয়না। হয়না আমার আলসেমীর জন্যে না, গুগলের বদামিতে। অ্যানোনিমাস কমেন্ট লিখতে গেলেই বেশীরভাগ সময় এরর ছোঁড়ে। কিন্তু সাড়া দেওয়াটা খুব জরুরী, আমার মনে হয়। নিজে সাড়া পেতে ভালোবাসি বলেই মিনে হয় হয়তো। বড় ভালো পোস্টটা। মায়ায় জড়ানো, নিজেকে ছোঁয়া। কাকুর বিড়াল নিয়ে কমেন্টটা সেরা। আমিও উৎপটাং বেড়ালপ্রেমীদের বলব এটা।
    বাড়িটায় বুলডোজার না পড়ুক। অবান্তর যতদিন থাকবে ততদিন। তোমার বাড়ি তোমার সাথে আমাদের, মানে অবান্তরের পাঠকদের মনেও জায়গা করে নিয়েছে কিনা।
    ছবিটাও চমৎকার।

    -প্রদীপ্ত

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, প্রদীপ্ত। তোমার কথাটার সঙ্গে একসময় সলিডারিটি প্রকাশ করতে পারতাম। সাড়া দেওয়া নয়, সাড়া পাওয়ার ব্যাপারে। সাড়া দেওয়া জরুরি হলে দায়ভারটা অন্যের ঘাড়ে পড়ে, যার ওপর আমার বিন্দুমাত্র কন্ট্রোল নেই। সাড়া পাওয়া জরুরি মনে হত একসময়। তারপর বুঝলাম সেটাও জরুরি না। জরুরি হচ্ছে বিনা সাড়ায় চলতে থাকার ক্ষমতা কালটিভেট করা। কারণ সাড়া-জেনারেটিং ভেরিয়েবলগুলোও আসলে আমার হাতে নেই। বাকি সব যদি ছেড়েও দিই, এটাও তো হতেই পারে যে সাড়া পাওয়ার মতো জিনিস প্রোডিউস করছি না। এবার দুটো অপশন। ভস্মে ঘি ঢালা বন্ধ করে অন্য কিছু করা, নয় বিনা সাড়ায় একলা চলো রে। সাপ ব্যাং বিচ্ছু যাই হোক, যতক্ষণ আমার টাইমপাস হচ্ছে ততক্ষণ অল গুড।

      অনেক কথা বলে ফেললাম কারণ এটা নিয়ে ভেবেছি। সেগুলো বেরিয়ে এল।

      তোমার মন্তব্য সবসময়ের মতোই আনন্দ দিল। থ্যাংক ইউ।

      Delete
    2. তোমার ফিরতি মন্তব্য দেখতে আসি প্রতিবারেই। অবান্তরে খানিক আড্ডাও হতে পারে নিশ্চয়ই? সেই সুবাদেই ফের লিখছি, তুমি যেটা বললে সেটা ভয়ানক দরকারি। যে।পারে সে স্থিতধী ব্যক্তি। নিজের ভালো লাগা অন্যের উপর নির্ভরশীল হওয়াটা একেবারেই কাজের কথা না, এবং খুব সত্যি কথা সে ক্ষেত্রে সেই ভালোবাসায় হয়ত সন্দেহও হওয়ার কথা।
      তবুও, মানুষ বলেই হয়তো খানিক সাড়াশব্দ ভালো লাগতে পারে। অবান্তরের বেশীরভাগ লেখাই আমার পছন্দের, কোনোটায়।চিলতে হাসি বা কোনোটায় মনকেমন কিন্তু ভালোলাগে।

      ও হ্যাঁ তোমার বেড়ানোর লেখাগুলো আমি খুব ফিরে ফিরে পড়ি সেটাও বলে যাই। অনেক অনেক পুরোনো সব লেখাও।

      -প্রদীপ্ত

      Delete
  5. এই রিষড়া টপিক সবসময় হিট। বলছি
    ভদ্রেশ্বরে মৃত্যুঞ্জয়ের মিষ্টি খাওনি? এখন শ্রীরামপুরেও খুলেছে। খেয়ে দেখো। ভালো কোয়ালিটি। আমার লিস্টে এক নম্বর।

    ReplyDelete
    Replies
    1. তাই বুঝি? খাইনি রে ঊর্মি। তবে তুই বললি যখন নিশ্চয় এর পরের বার ট্রাই করব। দরকার হলে ভদ্রেশ্বর গিয়ে ট্রাই করব।

      আমারও এই ধরণের পোস্টে তোর কমেন্ট পেলে ভালো লাগে। দেবীশ্বরীর কথা লিখলাম আর একটুকরো দেবীশ্বরী সশরীরে এসে গেল।

      Delete
  6. Kuntala aha ki bhalo laglo .rik kintu ekhono iman,rabindrasangeet i practice kore.

    ReplyDelete
    Replies
    1. বাহ, এটা চারপাশে সত্যিই কম দেখি। গান শেখা প্রায় উঠতে বসেছে। তবে আমি গোলমেলে চারপাশে বাস করছি সেটা হতে পারে।

      Delete

Post a Comment