ক্যাফিন ট্যানিন
আমার আজকাল কফির ঝোঁক উঠেছে। নয় নয় করে দিনে তিনবার তো খেয়েই ফেলি। এর কারণ নতুন কফি মেশিন। জন্মদিনের উপহার হিসেবে অনেক মাথা চুলকে অবশেষে কফি মেশিন ভেবে পাওয়া গেছে। বাজেটের মধ্যে এবং কাজে লাগবে আশায়।
লোকের বাড়িতে অনেক জটিল এবং গুরুগম্ভীর কফি মেশিন দেখেছি। আমাদের এক বন্ধুর বাড়িতে, ক্যাফে কফি ডে ইত্যাদি দোকানে যেমন মেশিন থাকে, একটা হ্যান্ডেলওয়ালা ছাঁকনির মতো পাত্র মাধ্যাকর্ষণ উপেক্ষা করে ঝুলতে থাকে, সেরকম ছিল। আমাদের কফির যন্ত্র সরল এবং সিধে। ফিল্টারের খোপে গ্রাউন্ড কফি ঢেলে দাও। জলের খোপে জল। তারপর ঢাকনা বন্ধ করে চানে ঢোক বা দশটা অসভ্য লোক আজ নতুন কী অসভ্যতা করল ইন্টারনেটে দেখে এলেই ফোঁটা ফোঁটা কফি টপ টপ করে পাত্রে জমা হয়ে রেডি। দাবিমতো সে কফি গরমও রয়েছে। তবে চা কফির ক্ষেত্রে গরমের সংজ্ঞা আমার সঙ্গে অধিকাংশ লোকেরই মেলে না। প্রথম চুমুকে জিভ পুড়ে না গেলে গরম কীসের? তাছাড়া ফ্রিজ থেকে দুধ বার করে মেশাতে কফি আরেকটু ঠাণ্ডা হয়ে যায়, কাজেই আমি কাপশুদ্ধু আবার এক মিনিটের জন্য মাইক্রোওয়েভে ঘুরিয়ে নিই।
এমন নয় যে ইনস্ট্যান্ট কফি আর মুখে রুচছিল না। কফি যে ইনস্ট্যান্ট ছাড়া অন্য কিছু হয়, সেটা আমি জেনেইছি অনেক পর। ইউটিউবে দেখেছি কফি কনোসিওররা (শব্দটার আসল উচ্চারণ বান্টি বহু বছর আগে শিখিয়েছিল, কিন্তু মফঃস্বলের বাংলা মিডিয়াম জিভে ও জিনিস রপ্ত হয়নি, এই দিয়েই চালিয়ে নিন) কাঁচা কফি বিন কিনে নিজের পছন্দ মতো বিভিন্ন ডিগ্রিতে - লাইট, মিডিয়াম, ডার্ক - ঝলসে, গুঁড়ো করে, জলে গুলে খায়। এতদিন ইনস্ট্যান্ট কফি খেতে খেতে সে সব ভিডিও দেখতাম, এখন গ্রাউন্ড কফি খেতে খেতে দেখি।
তবু কফিমেকার কেনা হল। একে অপরের জন্মদিনে খানিকটা পয়সা খরচ না করলে ভালো দেখায় না। তাছাড়া জীবনে যে রকম উত্তেজনার অভাব, একটা নতুন কিছু নিয়ে কয়েকদিন মেতে থাকা স্বাস্থ্যকর। জিনিসটা যন্ত্র হলে সুবিধে। মুখে মুখে তর্ক করে না, বোকামি দেখে হাসে না, হাসলেও টের পাওয়ার জো নেই।
চা কফির গোটা ব্যাপারটা মেশিনের হাতে ছেড়ে দিতে পেরে আমি খুশি। অনেকেই হবেন না। বহু চা-প্রেমী আমি টি ব্যাগের চা খাই জেনে আমার স্বঘোষিত চা-প্রেমকে নস্যাৎ করবেন। তাঁদের মতে চা খেতে হলে খেতে হবে অথেনটিক প্রক্রিয়ায় বানিয়ে। চায়ের জন্য নির্দিষ্ট করে কেনা সসপ্যানে জল, দুধ, চিনি ফুটিয়ে। তবে চা চায়ের মতো খেতে হবে, আর তা না হলে খেয়ে লাভ কী?
আমি সে মতের পথিক নই। কোনও আত্মসম্মানসম্পন্ন মাতাল যেমন "আমি কেবল একটা নির্দিষ্ট গুণমানের ওপরের মদ খেয়েই নেশা করি, নইলে করি না" দাবি করবে না, আমার ব্যাপারটাও সেম। সকালে ঘুম থেকে ওঠার দশ মিনিটের মধ্যে চা খাই, খেতে হয়, কারণ না খেলে মাথা ধরে, হাত পা কাঁপে, কোনও কিছুতে ফোকাস করতে পারি না। আর তার পর দেড় ঘণ্টা অন্তর অন্তর চা খাই, খেতে হয়, কারণ দেড় ঘণ্টা অন্তর অন্তর বোর হয়ে যাই আর বোর হয়ে গেলে কোনও কাজ করা যায় না। আর দেড় ঘণ্টা দেড় ঘণ্টা বাদে বাদে চায়ের সসপ্যান মাজা আমার রুটিনে লেখা নেই। আমার আছে ইলেকট্রিক কেটলি, যাতে জল ফোটে, ফুটে আমার জন্য অপেক্ষা করে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় না। টি ব্যাগ ছাঁকনির স্টেপ স্কিপ করতে দেয়, জল ফুটে গেলে কেটলি থেকে জল সরাসরি কাপে ঢেলে নেওয়া যায়। সসপ্যানের স্টেপও স্কিপ। দুধ যদি কেউ চায় গুঁড়ো দুধ আছে, চট করে গুলে যায়, গরম করতে হয় না।
তবে আমার বাড়িতে "নর্ম্যাল" চায়েরও পূর্ণ ব্যবস্থা আছে। অতিথি বাড়িতে এলে আমি তাঁদের সেই চা-ই বানিয়ে খাওয়াই। কারণ আমি জানি না হলে "শেমড" হওয়ার সম্ভাবনা। এক অতিথি এসেছিলেন, তিনি জানতেন আমি টি-ব্যাগের চা খাই। 'চা বসাই?' এর উত্তরে তিনি বলেছিলেন, 'ইয়ে, ডোন্ট মাইন্ড, আমার জন্য যদি টি ব্যাগের বদলে রিয়েল চা করে খাওয়াতে পার তাহলে ভালো হয় আরকি।' তারপর একদিন তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখলাম যে টি ব্যাগ। বললেন তিনদিন কাজের মাসি আসেনি। তাছাড়া টি ব্যাগ তো খারাপ না? দিব্যি। বালাই ষাট, অদিব্যি কেন হতে যাবে, উনি ধরেছেন যখন। এতদিন উনি গুঁড়ো/পাতা চা ফুটিয়ে খাচ্ছিলেন তাই টি ব্যাগ জঘন্য ছিল। দশচক্রে কেমন ভগবান ভূত হয়েছে দেখে সেদিন তাঁর বাড়ির চায়ে চুমুক দিয়ে এক্সট্রা আরাম হয়েছিল। ছ'মাস আগে আমার বাড়িতে গিয়ে আমার টি ব্যাগকে কেমন অপমান করেছিলেন সেটা মনে করাতে পারলে আরও একটু আরাম মিলত হয়তো, কিন্তু পরে আফসোস হত। কেন বললাম। না বললেই হত। ঝগড়ুটে ভাবল। ইমেজ খারাপ হল। উচিত কথা না শোনানোর সংযম দেখিয়েই বেশি আরাম হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেটাই হয়। আমার প্রতি উচ্চারণ করা অন্যের স্পষ্ট কথায় তো কষ্ট পাইই, অন্যের প্রতি নিজের উচ্চারণ করা স্পষ্ট কথাও অনেক সময়েই নিজেকেই কষ্ট দেয়। তাই আমি সাধারণতঃ স্পষ্ট কথা পরিহার করে চলি।
তার মানে কি আর ভালো চা মন্দ চায়ের তফাৎ বুঝি না বা কদর করি না? লোকে যাই ধারণা পোষণ করুক,বাজারে হুদ্দুহুদ্দু টি ব্যাগ পাওয়া যায় যাতে উচ্চমার্গের চা পাওয়া যায়। কখনও কখনও ইচ্ছে হলে সেগুলো আমরা কিনি না তেমনও নয়। কিন্তু ওগুলো শখেই। মাসে একবার বিরিয়ানি খাওয়ার মতো। আমার একজন তবলা মাস্টারমশাই ছিলেন যার জীবনের মোটো ছিল যে তিনি যাই খাবেন, যত কমই খান, ভালো খাবেন। যা-ই শিখুন, ভালো শিখবেন, কম শিখলেও। এটা জীবনের পথে চলার একটা নীতি। যুক্তিপূর্ণও বটে। আবার জীবনের পথে চলার আরও একটা যুক্তি আছে, যেটা লাইব্রেরির আশুকাকু শিখিয়েছিলেন। বলেছিলেন, আর যাই করো, বই বেছে পড়তে যেয়ো না। পরে অনেককে দেখেছি কেবল ভালো বইই পড়তে। বাজে বই ছুঁয়েও না দেখতে। আমার খুবই কৌতূহল জাগে, যে না পড়ে তাঁরা টের পান কী করে বইটা বাজে না ভালো। নিশ্চয় কোনও রাস্তা আছে, যা আমার জানা নেই।
গল্পের বই, চা ইত্যাদির ক্ষেত্রে আমার ওই দ্বিতীয় নীতিটা বেশি সুবিধেজনক লাগে। যা পাই তাই পড়ি, যেমন পাই তেমন খাই।
আমার মাঝে মাঝে মনে হয় এই যে অর্চিষ্মানের সঙ্গে আমার মোটের ওপর গলাগলি সহাবস্থান, এর কারণ কী। কপাল জাতীয় অবভিয়াস কারণ যদি ছেড়ে দিই, হয়তো দুজনেই বাংলা বলি বলে, সুমনের গানে দুজনের গায়েই কাঁটা দেয় বলে, দুজনেরই শপিং-এ যাওয়ার সম্ভাবনায় সমান কান্না পায় বলে, দুজনেরই অথরিটির মুখোমুখি দাঁড়াতে সমান হাঁটু কাঁপে বলে ইত্যাদি প্রভৃতি।
একটা কারণ অনেকসময়েই তলিয়ে দেখি না, সেটা হচ্ছে দুজনেরই চা কফি, বিশেষতঃ চায়ের প্রতি অত্যধিক নির্ভরতার ব্যাপারটা।
কমন নেশা যেমন দ্রুত এবং যেমন পোক্তভাবে সম্পর্কের ভিত্তি যেমন হয়ে উঠতে পারে তেমন কম জিনিসই পারে। আর একা একা করার থেকে দল বেঁধে নেশা করা সবসময়েই বেটার। তাস, থিয়েটার, রাজনীতি - কোনওটাই নিভৃতে করার ব্যাপার নয়। চাও যে নেশা, সেটার প্রমাণও ওই ভিড়ে। মোটামুটি আত্মসম্মানসম্পন্ন কোনও চায়ের দোকানই কখনও খালি থাকে না।
সেদিন এক উপন্যাসের এক চরিত্র বলছিল যে আজকাল বন্ধুত্ব হওয়ার জন্য একটা ক্রাইটেরিয়া খুব ঝপ করে কাজে দেয়। সেটা হচ্ছে ধূমপান। জগৎ জুড়ে তাড়া খাওয়া এক জনজাতির কমন মেম্বারশিপ বন্ধুত্ব হওয়ার একটা মারাত্মক শক্ত মাটি যোগায়। এয়ারপোর্টে অনেকসময় দেখি একটা ঘুপচি ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে কয়েকটা লোক, ঠোঁটে ধিকিধিকি আগুন। কেউ কারও সঙ্গে কথা বলছে না কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা একে অপরের অচেনা। যাতায়াতের পথে ফুসফুসে নিকোটিন ভরে নেওয়ার দু'দণ্ড বিরতিতে দেখা হয়েছে। কিন্তু যদি আমাকে বলেন যে ঘুপচি খাঁচার বাধ্যতামূলক বন্দিত্বদশা এবং বাইরের পৃথিবীর গটমট হেঁটে যাওয়া তাঁদের মনে কোনও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে না এবং ওই ভাগ করে নেওয়া বিদ্বেষ ওই ঘুপচি ঘরে দাঁড়ানো লোকগুলোর মধ্যে কোনওরকম সেতুবন্ধন ঘটায় না, আমি বিশ্বাস করব না।
পারসিকিউটেডও নই, মাইনরিটি তো নইই, তবু চাসুড়েদের মধ্যে একটা বন্ডিং হয় দেখেছি। এর কারণ রিভিল্ড প্রেফারেন্স। নাম জানি না, ধাম জানি না, বই পড়তে ভালোবাসে কি না জানি না, কবিতা লেখে কি না জানি না, এও জানি না দুবেলা বাড়িতে 'সব সইতে পারি, সিউডো ফেমিনিজম সইতে পারি না,' আস্ফালন করে কি না যাতে সন্দেহ হয় কী জানি অথেনটিক ফেমিনিজম হাতের কাছে পেলে জীবনে বরণ করে নেবেন বোধহয়। শুধু জানি জুলাই মাসের দুপুর দুটোয় ঘামতে ঘামতে চা খান। জীবনের ওই জায়গাটা অথেনটিক। ওই ভালোবাসাটা রিয়েল। ওটা ফেক করা যায় না। আমার ঠাকুমা আর ব্যানার্জিজেঠির আঠার মতো বন্ধুত্ব ছিল। একজন বেঁটে একজন লম্বা, একজন নাদুসনুদুস অন্যজন পাখির মতো, ঠাকুমাজেঠিমাদের রাজনৈতিক চেতনা বা ওয়ার্ল্ডভিউ নিয়ে তো মাথাঘামানোর প্রয়োজন করিনি কখনও, করলে মনে হয় সেখানেও খুব মিল বেরোনোর চান্স কম ছিল। দুজনের শুধু চাইনিজ চেকারের নেশা ছিল, রোজ বিকেলবেলা দুনিয়া রসাতলে গেলেও খেলতেন। অফিস যাওয়ার নেশা হয় না, না হলে অফিসেও লোকের গলাগলি বন্ধু হত। নেশা হয় না বলেই জায়গাটা ব্যাকবাইটিং-এর ডিপো হয়ে রয়ে গেল।
অর্চিষ্মান বলে লোকের মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা সাংঘাতিক। বিশেষ করে সম্পর্কটম্পর্কের ব্যাপারে। কে যে কার সঙ্গে থাকে, থেকে যায়, থেকে যেতে পারে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। আমি গোড়াতে অতটাও মানতে চাইতাম না, ভাবতাম মনের মিলটিল কি একেবারে গাঁজাখুরি? ক্রমে বিশ্বাস বদলাচ্ছে। সেদিন রেডিওতে এক মহিলার ইন্টারভিউ শুনছিলাম যিনি দিব্যি পাঁচটা সুস্থ লোকের মতো, কিন্তু তাঁর প্রেমিক নিও-নাৎজি। প্রেমিক বিশ্বাস করেন যে ইদানীং জগতের যত বিজ্ঞানী, শিল্পী, সাহিত্যিক সব শ্বেতাঙ্গদের দাবিয়ে রাখতে ষড়যন্ত্র ফেঁদেছেন এবং এক্ষুনি প্রতিরোধে না নামলে অসাদা-রা সাদাদের এতদিনের এত কষ্টের, এত শ্রেষ্ঠত্বের পরীক্ষায় পাশ দিয়ে দিয়ে, যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে, অর্জন করা ওয়ার্ল্ড ডমিনেশন খানখান করে দেবে। মহিলা হেসে হেসে বলছিলেন যে আমরা আমাদের রাজনৈতিক মতভেদ মেনে নিয়েছি, এগ্রিড টু ডিসএগ্রি, ডোন্ট টক অ্যাবাউট ইট এনি মোর, ও সারাদুপুর বেসমেন্টে বসে হোয়াইট সুপ্রিমেসির স্লোগান লেখা টি শার্ট ডিজাইন করে, আমি আমার মতো অফিস যাই।
আমার এদিকে এখনও কল্পনায় কুলোয় না অর্চিষ্মান চাসুড়ে না হলে আমাদের সম্পর্কের চেহারা কী হত। প্রথমতঃ, কুঁড়ে মানুষের স্বার্থের দিক থেকে বলতে গেলে, দিনের অন্তত পঞ্চাশ পার সেন্ট চা যে অন্য কাউকে দিয়ে করানো যায় সেটা একটা মারাত্মক সুবিধের ব্যাপার, কিন্তু সঙ্গটাও তো উড়িয়ে দেওয়ার নয়।
যে সঙ্গের আশায় আমার মা আমাকে চা ধরিয়েছিলেন। একা একা চা খেতে বিরক্ত লাগত নিশ্চয়, চাতকপাখির মতো অপেক্ষা করেছিলেন কবে আমি একটা ভদ্রস্থ বয়সে পৌঁছব। মাধ্যমিক দেওয়ার সময় মায়ের মনে হল যে যথেষ্ট হয়েছে, আর সময় নষ্ট করে লাভ নেই। তার আগে আমি একটুও চা খেতাম না। ছোট বয়সে মারি বিস্কুট (তখন মেরি বলতাম) হয়তো কোনও দয়ালু লোক তার চায়ের কাপে ডুবোতে অনুমতি দিল, মেনলি ঠাকুমাই, ততটুকুই ছিল আমার চা খাওয়ার দৌড়।। টেস্টের পরের তিনমাসে, যার মধ্যে একমাস মা ছুটি নিয়ে বাড়িতে ছিলেন আমাকে বৈতরণী পার করাবেন বলে, প্রতিদিন এগারোটা বাজলেই 'এক কাপ চা খাবি সোনা?', আর বিকেল চারটে বাজলেই, 'আরেক কাপ চা খাবি সোনা?' করে দু'কাপ চা নিয়ে আসতেন। মাধ্যমিকও পেরোলো, চাও আমাকে ধরে ফেলল। মা "গুড জব, ওয়েল ডান' বলে নিজের পিঠ চাপড়ে হাত ঝাড়লেন।
তাছাড়া বিনা বাক্যব্যয়ে সামনে এনে রাখা এক কাপ ধূমায়িত চায়ের থেকে বেটার সন্ধিপ্রস্তাব এ পৃথিবীতে আর কিছু আছে কি?
আজকাল কফি মেশিন কেনার পর কফি খাওয়া বেড়ে গেছে। যেহেতু ব্যাপারটা তৈরি হয়েই আছে, রান্নাঘরে ঢুকছি আর ঘটাঘট কাপে ঢেলে খাচ্ছি। চিনির অভ্যেস অনেকদিনই ছেড়ে গেছে, তবে আমার জিভে এখনও কালো কফি তেতো লাগে বলে দুধ দিতেই হয়। আর তারপর যেটা হয় যে প্রত্যেক বার দু'চামচ করে গরম দুধ খেতে খেতে পেট ভরে ওঠে। তাছাড়া কফি খাওয়া বেড়েছে বলে তো চা খাওয়া কমেনি। কয়েকটা চা, কফি দিয়ে রিপ্লেস করে দেওয়াই যায়, সেটা আমি করে উঠতে পারি না। অপরাধী লাগে। যে আমাকে এতদিন দেখল, তাকে ফেলে অন্যকে মাথায় তুলব? সেই চারটাকা মাইনের স্কুলে এবং সমানুপাতিক মাইনের কলেজ আর ইউনিভার্সিটিতে পড়িয়ে যাবতীয় যা ডিগ্রি দিল সরকার এদিকে বেড়াতে গিয়ে আমি টাকা দেব ক্লাব মহিন্দ্রাকে আর ট্যুরিজম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের বোর্ড দেখলে নাক টিপব?
সেই একই লজিকে আমি কফি বেশি খাচ্ছি কিন্তু চাকেও ছাড়িনি। ইলেকট্রিক কেটলি আর কফি মেশিন দুটো পাশাপাশি রাখা আছে, কাবার্ডে চায়ের বাক্স আর কফির প্যাকেটও ঘেঁষাঘেঁষি। কফি নিতে গিয়েই চোখে চোখ পড়ে যায় আর আমি প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফেলি, এই তো দু'ঘণ্টা পরেই, আচ্ছা, দেড় ঘণ্টাই ধরলাম, তোমাকে মনোযোগ দেব, প্রমিস। তাতে অসুবিধে যেটা হয়েছে চা কফি অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। সকালবেলা চা দিয়ে শুরু করি, ঘণ্টাখানেক বাদে এক কাপ কফি খাই। তার ঘণ্টাখানেক বাদে চা, খেয়ে উঠে কফি, বিকেলে চা, সন্ধেবেলায় কফি, রাতে খেয়ে উঠে চা।
অনেক বলে, ঘুমোও কী করে? কে জানে। শরীরের নাম মহাশয় হওয়াটা সম্ভবতঃ সাহায্য করে।
নেশা বলেই আমাদের চায়ের ব্যাপারে আমরা ফ্যান্সি না হলেও পিউরিট্যান। খুব অ্যাডভেঞ্চারাস হলে বড়জোর আদা আর লেবু, আর কিছু আমরা চায়ে অ্যালাউ করি না। আমার একটা বিশ্বাস আছে, একটা জিনিসকে তখনই খুব সাজ পরাতে হয় যখন তার সাজহীন চেহারাটা আমার ততটাও মনে ধরে না। অনেকেই অমত হবেন, কিছু করার নেই। লোকে কী কাণ্ড করে চা নিয়ে, চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। জবাফুল, চেরিফল, পুদিনার রস, বিছুটির নির্যাস - সবেরই চা হয় এবং লোকে খেয়ে থাকে। আমার সত্যি বলছি ওই দেদার দুধ, দারচিনি এলাচ দিয়ে ফোটানো বিরিয়ানি চাও বিতিকিচ্ছিরি লাগে। বেস্ট হচ্ছে প্লেন অ্যান্ড সিম্পল চা। এবং বলা বাহুল্য, শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর হওয়া নন-নেগোশিয়েবল। একবার এক উচ্চমার্গের দোকান থেকে আমি চায়ের বাক্স কিনে এনে প্লাস্টিক ছিঁড়তে গিয়ে দেখি ডিক্যাফ চা। সারা সন্ধে, রাত, এমনকী পরের দিন ভোর পর্যন্ত চাহীন কাটাতে হয়েছিল। আমি যে রকম কিপটে, ও বাক্স একবার প্লাস্টিক ছিঁড়ে ফেললে হাতে ধরে ফেলে দিতে পারব না, আর সামনের আটচল্লিশ দিন দিনে একটা করে ডিক্যাফ টি গেলাও আমার পক্ষে শূলে চড়ার সমতুল হবে। কোনওমতে মাইন্ড ওভার ম্যাটার করে সন্ধে, রাত, পরদিন ভোর কাটিয়ে দোকান খোলা মাত্র লজ্জার মাথা খেয়ে গিয়ে দামি চা বদলে সস্তা চা নিয়ে এসেছিলাম। আন্তরিক ভাবেই বলেছিলাম যে আমি বাকি টাকাটা দিয়ে অন্য কিছু কিনে নিচ্ছি কিন্তু ওঁরা সেদিন ভালো মুডে ছিলেন বোধহয়, আমাকে টাকা ফেরত দিয়ে দিয়েছিলেন।
সেই থেকে শিক্ষা পেয়েছি। এক, আগের চা ফুরোনোর আগেই নতুন চা বাক্স আনাই, দুই, ফ্যান্সি দোকান প্রাণ থাকত পরিহার করি।
কড়া কফির নেশা-করিয়েরাও অমন হন দেখেছি, এমনকি দুধেও আপত্তি। একজনের পেছনে দাঁড়িয়েছিলাম এক কফির দোকানে। স্টারবাকসের যে সব অর্ডার নিয়ে ইন্টারনেটে মিম বানানো হয়, সে রকম অর্ডার তাঁরা দেন না। লাইনের মাথায় পৌঁছে বলেন, এককাপ কফি দেখি, ব্যস। উত্তরে বারিস্তা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, 'দুধ দেব কি?' তাতে মহিলা উদাস গলায় বলেছিলেন, 'ইফ ইউ ওয়ান্ট টু রুইন ইট।' যারা অতটাও কফি খেতে ভালোবাসেন না, তাঁরা নানারকম কায়দা অ্যালাউ করেন।
মোদ্দা কথা, চাকফির নেশা নিয়ে আমরা খুশি, এবং আপাতত এ নেশা থেকে মুক্তির চেষ্টা করছি না। এ নেশা এখনও আমাদের দাগা দেয়নি। চা খেয়ে বিপদে পড়েছিলাম একবার মনে আছে, তবে সম্পূর্ণ নিজেদের দোষে।
সে বছর দিল্লিতে প্রতি বছরের মতোই গুছিয়ে গরম পড়েছিল। ঠিক করলাম বাড়িতেই আইস টি বানানো যাক, কত আর শক্ত হবে। রেসিপিতে দুটো টি ব্যাগ দিতে বলেছিল। দোকানে ট্যালটেলে আইস টি খেতে খেতে আমরা তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছিলাম আর রেসিপির ছবিটাও ছিল ওই দোকানের আইসটির মতোই ফ্যাকাসে তাই দুটোর বদলে আটটা টি ব্যাগ দিয়েছিলাম আর রেকমেন্ডেড চল্লিশ মিনিটের বদলে সারারাত ফ্রিজে রেখে পরের দিন মিনিমাম বরফ ব্যবহার করে আয়েস করে, 'এই না হলে আইস টি,' বলে চুমুক দিয়ে বড় বড় এক এক গ্লাস শেষ করার ঠিক দশ মিনিট পর থেকে অস্বস্তি শুরু হয়েছিল। মাথা ঘোরা, বমি ভাব, দৃষ্টিতে ক্রমবর্ধমান অন্ধকার। দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে কেবল 'আইস টি' বলার সুযোগটুকু পেয়ে চক্ষু মুদেছিলাম। যতক্ষণ না সে ঘূর্ণিবাত শান্ত হয়েছিল, নড়াচড়ার শক্তি ছিল না। তারপর ওই কালো কুটকুটে কনককশনের এক চামচের সঙ্গে একগ্লাস জলে মিশিয়ে নেক্সট পনেরোদিন ধরে তাকে শেষ করতে হয়েছিল।
চা কফির নেশার আরেকটা সুবিধে হচ্ছে, নেশাটা সস্তা। বা চাইলে সস্তা রাখা যায়। অনেকে দামি নেশা করে। আমাদের এক চেনার ছিল ফাউন্টেন পেনের নেশা। তার একেকটার দাম নাকি আঠেরো হাজার। আঠেরো লাখ টাকার চাকরি করেও তার সেভিন্স অ্যাকাউন্টে মাঝে মাঝে আঠেরোশো টাকা থাকত না বলে সে দুঃখ করত।
আমরাও সস্তা চা খাই। নীল প্যাকেটে টেটলি ব্ল্যাক টি ব্যাগ। অনেকসময় সৌরভ স্টোর্সের স্টক ফুরোলে হলুদ লিপটন কিংবা নীল তাজমহল, ব্যস। অনেক চা-প্রেমীর আড্ডায় শুনি টাটা গোল্ড খেয়ে তাঁদের বমি পেয়ে গেছে, স্বীকার করছি, আমার পায় না। তবে আমরা চা ভালোবাসি শুনে যারা আমাদের ভালোবাসে তারা নানারকম চা নিয়ে আসে বেড়াতে গেলে। তারা আবার চা বাগান জাতীয় জায়গায় বেড়াতে যেতে ভালোবাসে, কাজেই আমাদের সৌভাগ্যের সীমা নেই। সিকিমের, দার্জিলিঙের, আসামের চা, রিয়েল পাতা চা, আমাদের কাবার্ডের কুল, ড্রাই কোণে বয়াম ভরে রাখা আছে। সেগুলোর জন্য আমরা জালিদার গোলক কিনে রেখেছি, ইংরিজিতে ইনফিউসার বলে, চা পাতা পুরে কাপের কানায় ঝুলিয়ে দিলেই কাজ শেষ।
কফি মেশিন কিনে একটা আপাত অসুবিধে টের পাচ্ছি, ইনস্ট্যান্ট নেসক্যাফের শক্তপোক্ত মোটাসোটা কাঁচের বোতলগুলোর আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে। ওই বোতলগুলো টবে শিফট করার আগে প্রাথমিকভাবে গাছের শিকড় গজানোর জন্য আর পথোসটথোসের ক্ষেত্রে পার্মানেন্ট টব করে রেখে দেওয়া যায়। গ্রাউন্ড কফির বাক্স ছুঁড়ে ফেলা ছাড়া আর কিছু করা যায় না। নেসক্যাফে আবার মাঝে মাঝে কাপটাপ ফ্রি দেয়, ওই যে লাল কাপটা নিয়ে চালশে পোস্টে কথা হচ্ছিল। নেসলে কোম্পানি এটা নিয়মিত করে থাকে। ম্যাগির সঙ্গে হ্যান্ডেলওয়ালা হলুদ বাটি, কফির সঙ্গে লাল কাপ। আমার বাড়িতে কোটি কোটি আছে। রান্নাঘরে ঢুকলেই লালহলুদের মেলা আমার বাঙালত্বের প্রমাণ দিচ্ছে।
কালই অর্চিষ্মানের কাছে নালিশ করছিলাম যে এই যে তিনবেলা কী খাব আর কী খাবে, এ আর সয় না। এই যে কফি খেয়ে পেট ভরে যাচ্ছে, এই দেখে আমার আশা জেগেছে যে অর্ধেক রাস্তা তো পার হয়েই আসা গেছে, এমন যদি হত, এত ফুল, ফলের ফ্লেভার না মিশিয়ে যদি কোনও বিজ্ঞানী চা কফিতে আমাদের জীবনের জন্য দরকারি এ বি সি ডি ভিটামিনটিটামিনগুলো মিশিয়ে দিতে পারতেন তাহলে চা কফি খেয়েই দিব্যি বেঁচে থাকা যেত আর তার থেকে ভালো আর কিছুই হত না।
Coffee nesharu der doley swagoto! Amio sokale uthe 15 minute er modhye ek cup kalo coffee (oi Nescafe laal cup ta kore) na khele matha ghore, pet byatha hoy, haat paa obosh hoye ashe. Er moto bhalo nesha ar hoy na.
ReplyDeleteOboshyi amar mone hoy protita shohorer nijoswo nesha thake. Kolkatar jerom cha. Goto bochhor shohore pherar ek masher modhye roj bikele cha er nesha dhoreche. Ekhon tomar moto coffee/cha alternately kheye kheye ordhekta din kete jachche. Mondo lagchhe na kintu. :D
চা-কফি অত্যন্ত ভালো, ছিমছাম, পরিষ্কার নেশা, বিম্ববতী। তুমি যেমন আমাকে কফি-ক্লাবে স্বাগত জানালে, আমার তরফ থেকেও চায়ের ঠেকে তোমাকে অভ্যর্থনা পাঠালাম।
Delete"কড়া কফির নেশা-করিয়েরাও অমন হন দেখেছি, এমনকি দুধেও আপত্তি। একজনের পেছনে দাঁড়িয়েছিলাম এক কফির দোকানে। স্টারবাকসের যে সব অর্ডার নিয়ে ইন্টারনেটে মিম বানানো হয়, সে রকম তাঁরা দেন না। লাইনের মাথায় পৌঁছে বলেন, এককাপ কফি দেখি, ব্যস। উত্তরে বারিস্তা জিজ্ঞাসা করেছিলেন, 'দুধ দেব কি?' তাতে মহিলা উদাস গলায় বলেছিলেন, 'ইফ ইউ ওয়ান্ট টু রুইন ইট।' যারা অতটাও কফি খেতে ভালোবাসেন না, তাঁরা নানারকম কায়দা অ্যালাউ করেন।" ekdom !
ReplyDeleteki brand er coffee machine kinlen ?
ফিলিপস, অন্বেষা।
DeleteKhub khub bhalo lekha :)
ReplyDeleteহাহা, থ্যাংক ইউ, সায়ন।
DeleteFrom one chashure to another....puro Darjeeling cha er flavour pelam lekhata pore....
ReplyDeleteহাহা, হাই ফাইভ, রণিতা।
Deleteক্যাফিন ট্যানিন না থাকলে আমার জীবন অন্ধকার। রাত দুটো হোক বা জুলাইয়ের দুপুর দুটো, আমার চলে। তবে চায়ের মধ্যে অন্য গন্ধ বেশি হলে সেটা একদম চলেনা। তাই গরম মশলা, এলাচ, তন্দুরি, বিরিয়ানি এসব কায়দার চা আমিও এড়িয়ে চলি। হাই ফাইভ।
ReplyDeleteইনস্ট্যান্ট কফি শুধু জলে খেলে টকটক লাগে। আবার দুধ পছন্দ না। তাই অফিসে মেশিনের কালো কফি খেলেও বাড়িতে কফি নিয়ে মহা সমস্যা।
আরেকটা গল্প না বললেই না। গা বমি, শরীর খারাপ, মন খারাপ, মাথা ব্যাথা এসব সময়ে চা এর টিন টা পাশে রাখি। মাঝে মাঝে শুঁকলে বেশ ভালো লাগে।
চায়ের টিনের গন্ধ শোঁকা! এই মচৎকার নেশাটা তো ট্রাই করে দেখতেই হচ্ছে! আইডিয়া দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ, বৈজয়ন্তী। চায়ের ক্ষেত্রে 'সিম্পলিসিটি ইজ দ্য বেস্ট পলিসি'তে হাই ফাইভ।
Deleteলেখাটা দারুণ হয়েছে কুন্তলা। ice-teaর গল্পটা পড়ে খুব হাসলাম... পুরো লেখাটাই মচৎকার... লেখাটা পড়ে আমার একটা ঘটনা মনে পরে গেল।
ReplyDeleteতখন আমি কলেজে পড়ি, টালিগঞ্জ স্টেশনে একটা চায়ের দোকান ছিল বাঁধা -- আমি লাস্ট কম্পার্টমেন্টে উঠতাম যাতে নুঙ্গিতে (আমার বাড়ির স্টেশন) নেমে অটো পেতে সুবিধা হয়, চায়ের দোকানটা ছিল টালিগঞ্জ স্টেশনে ওই জায়গাতেই....
টালিগঞ্জ স্টেশনের একটা মজার ব্যাপার হলো, লেক গার্ডেন্স স্টেশনটা দেখা যেত, টালিগঞ্জ-এ single line বলে লেক গার্ডেন্সে crossing হত, এদিকের ট্রেন আগে গেলে ওদিকের ট্রেন অপেক্ষা করত, আর ওদিকেরটা আগে এলে এদিকেরটা।
এই রকম বহুদিন হয়েছে, গিয়েছি, দুটো ট্রেন-ই লেক গার্ডেন্স স্টেশনে পৌঁছে গেছে, এক মিনিটে টালিগঞ্জ-এ ঢুকলো বলে, চায়ের দোকানের দাদা আমায় দেখেই একটা চা দিয়ে দিতেন হাতে, একদম ঠিক তাপমাত্রার যাতে চা শেষ করেই আমি ট্রেন-এ উঠে পড়তে পারি...
কোনোদিন ওনার সাথে কথা হয় নি, বন্ধুর সাথে একটার পর একটা চা খেতাম আর আড্ডা দিতাম। ফেরার সময় at least, এক cup চা ছিল বাঁধা। একটা অদ্ভুত সমীকরণ ছিল ওনার সাথে, বলতেও হতো না চা দিন, ওদিকে একবার তাকালেই চা এসে যেত (আমাদের মতন, চিনি কম...) ...
তারপর, হঠাৎ একদিন (মনে হয় পরীক্ষার পরে) গিয়ে দেখি, স্টেশন ভেঙে দিয়েছে.... এবড়োখেবড়ো টালিগঞ্জ স্টেশন ঝকঝকে বানানোর জন্য, যারা প্লাটফর্মের নিচে থাকতো, রেল লাইনের পাশে থাকতো, তাদের অন্য কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছে... একটা লেবু চায়ের দোকান বসল, কিন্তু দুধ চাখোররা তখনো লেবু চা খেতাম না.... এখনো মনে হয় ওই দাদার মতন চা কেউ বানায় না.... প্রথম ভেবেছিলাম, ওনাদের সাথে দেখা করতে যাবো (আনন্দবাজারে শ্রীজাত বা অঞ্জন দত্ত লিখেছিল যাদের উচ্ছেদ করা হয়েছিল টালিগঞ্জ থেকে তাঁদের নিয়ে -- কোথায় পাঠানো হলো, কেমন আছেন), যাইনি... ভেবেছিলাম ওই দাদাই ফিরে আবার দোকান দেবেন, আসেননি...
ইস , কী ভালো আর মনখারাপ করা গল্প, দ্যোতনা। এই চায়ের দাদারা একবার উঠে গেলে আর আসেন না। আমাদের রাজুদাও আর আসেননি। রাজুদার চায়ের বিজনেস যারা লাটে তুলেছে তাদের আমি পার্মানেন্ট অভিশাপ দিয়ে রেখেছি, কাজ দিক না দিক।
Deleteচায়ের ব্যাপারে এই নিয়ম/রুটিনটা ভীষণ জরুরি হয়ে দাঁড়ায়। এই যে আমি ঠিক কেমন চা খাই এটা একজন জানে, এটা অলমোস্ট এই আশ্বাস দেয় যে পৃথিবীতে অন্তত একটা লোক 'রিয়েল' আমিকে চেনে, জানে। ওই যে দাদা কিছু না বলতেই, আপনার কাস্টমাইজড চা-টা আপনার জন্য রেডি রাখতেন, এটা কী মারাত্মক ভালোলাগা না? আন্টিজিকেও কিছু বলতে হত না। গিয়ে দাঁড়াতাম, আন্টিজি অনেকসময় দেখতে পেলেন কিনা টেরও পেতাম না, হঠাৎ কানে আসত, নেহি নেহি, এই ফিকি চা ওই ম্যাডামের জন্য কোনও, আপনার জন্য না বলে কোনও অত্যুৎসাহী খদ্দেরকে মৃদু ধমক লাগাচ্ছেন আন্টি। নেক্সট এক ঘণ্টার জন্য মন ভালো হয়ে যেত।
``এই যে আমি ঠিক কেমন চা খাই এটা একজন জানে, এটা অলমোস্ট এই আশ্বাস দেয় যে পৃথিবীতে অন্তত একটা লোক 'রিয়েল' আমিকে চেনে, জানে" -- একদম। আপনার পুরনো অফিসের আন্টি আর তার অনেকখানি ঘোমটা দেওয়া বৌমার গল্প খুব ভালো লাগতো আমার।
Deleteপুরোনো পোস্ট কারও মনে আছে জানলে অবিশ্বাস আর ভালোলাগা একই সঙ্গে হয় । থ্যাংক ইউ, দ্যোতনা।
Deleteহাই ফাইব কুন্তলাদি। চা না হলে আমার বাবা, মা, আমি, দিদি সক্কলের অস্থির লাগে। এবং আমাদের চা টাটা টি গোল্ড, আগে আগে পাড়ার দোকান থেকে নির্দিষ্ট পরিমান গুঁড়ো আর পাতা চা মেশানো। বউয়ের অবশ্য চায়ের নেশা নেই, তাই তার শৌখিন চা , দামী চা, ফ্লেভার চা এমনকি সবচেয়ে খারাপ গ্রীন টিও ভালো লাগে। এতো দিন ভাবতাম আমাদের হয়তো সঠিক চা-জ্ঞান নেই। এখন বুঝিবোরইবাসলে নেশা নেই তাই যাতা দিয়ে চলে না।
ReplyDeleteগ্রিন টি!! রাম রাম রাম। তবে দোষ দিচ্ছি না, প্রদীপ্ত। নেশা যে নেই সেটা মাথায় রাখছি। গ্রিন টি খেয়ে যে কারও নেশা হয় না, এটা আমার মতে গ্রিন টির চায়ের ক্লাবের মেম্বারশিপ বাজেয়াপ্ত করার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি।
DeleteBah..coffee jinish ta amaaro khub pochhondo..amaar besh 3/4 rokomer coffee aar shei onujai jontro pati achhe...
ReplyDeleteTatey coffee je darun bhaalo hoy kina bolte parbo na...tobe banate bhaalo laagey..aar ei work from home-er shomoy dupurer ghum ta jaatey banate giye
হ্যাঁ, দুপুরের ঘুমটা তাড়ানো মারাত্মক জরুরি ব্যাপার, অর্পণ।
Deleteনতুন কফি মেশিনের জন্য অভিনন্দন| খুব এনজয় করো অনেক কফি খাও| আমি এদেশের কফি খেতে শিখেছি জিমের কফি খেয়ে| রাতে ঘুম হয়না অথচ সারাদিন চালাতে হবে তাই জিমে গিয়ে কফি মেশিনের কফি খেতাম ওষুধের মতো| সেই খেয়ে আস্তে আস্তে অভ্যেস হয়ে গেছে | কিন্তু বাড়িতে মেশিন নেই কারণ জায়গা নেই|
ReplyDeleteচা আমিও সারাদিন ধরে খাই নানা রকম| আমার বরের জন্য দু রকম পাতা মিশিয়ে দুধ চিনি দিয়ে দুই তিন বার করতে হয়| মেয়ে গ্রীন মাচা টি উইথ oatmilk. আমি এই দুটো বাদে সব রকম চা খাই| শ্বশুর শাশুড়ি লাল চা| আমি গ্রীন টিও ভালোবাসি| ওটা একটু অভ্যাসের ব্যাপার কিন্তু একবার অভ্যেস হয়ে গেলে ওটাই সব থেকে আরামদায়ক চা| আমি তো কাপে জাস্ট কিছু পাতা দিয়ে গরম জল ঢেলে দেই, সেটা ফুরোলে আবার গরম জল অ্যাড করি| আমার এক এক কাপ চা খেতে দু ঘন্টা সময় লাগে আর চা ঠান্ডা হয়ে যায় আর বার বার মাইক্রোওয়েভে গরম করতে হয়| আমার তাই নতুন উপহার প্রাপ্তি হয়েছে Ember Tea Mug. যা টেম্পারেচার চাই চা ততটাই গরম থাকবে অন্তত দেড় ঘন্টা| তারপর আবার প্লেটের ওপর বসিয়ে চার্জ করতে হবে| আরো একটু আলসেমি করা যাবে আর কি!
হাহা, হয়তো আপনি হাসির জন্য বলেননি কিন্তু এই জায়গা না থাকার জন্য কফি মেশিন না থাকার সপাট স্বীকারোক্তিটা পড়ে আমার কেন যেন হাসি পেয়ে গেল, অমিতা। মেশিন কিনতেই হবে কাজেই জায়গা বার করতে হবে, এই ভাবে যে মেশিন কেনেননি তার জন্য আমার স্যালুট নেবেন। গ্রিন টি-টা আমি সত্যি বলছি এখনও হজম করতে পারি না, তবে এটা জানি যে ব্যাপারটা প্রেজুডিস হতে পারে। এই সময় নিয়ে চা খাওয়াটা খুব ভালো ব্যাপার, আমার এই অভ্যেসটা করার ইচ্ছে আছে। আপনার উপহার পাওয়া কাপের কনসেপ্ট ভালো তো, যাই দেখি অ্যামাজনে। যদিও আমার বাড়িতেও আর জায়গা নেই।
Deleteআমার কাউন্টারটপ দেখলে আর হাসি পেতোনা কুন্তলা! তবে এটা ঠিক কোনো জায়গা নেই বলার পরেও আরো অনেক জিনিস জুটেছে, সে হয় পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের আলাদা আলাদা প্রয়োজনে বা আমার নিজেরই বেশি useful গ্যাজেট দিয়ে | আমার যেমন insomnia তাতে করে coffeemaker না কেনাই উচিত|
Deleteচ নিয়ে এত কথা হলো আর kombucha-এর কথা বলা হলোনা | Chinese/Russian ফার্মেন্টেড এন্ড কার্বোনেটেড টি নেক্সট জেনেরেশনের হাত দিয়ে ঘরে ঢুকেছে আর আস্তে আস্তে অন্যরাও সমঝদার হয়েছে| দোকানে এত দাম যে এখন বাড়িতেই কম্বুচা ফার্মেন্ট আর carbonate করা,ফ্ল্যাভর অ্যাড করা সব শিখে নিয়েছি| pandemic-এ এটা আমার নতুন শেখা project. Delhir দিকে কি এসেছে কম্বুচা?
সৌরভ স্টোরসে এসেছে বলে মনে হয় না, অমিতা। তবে হাবভাব যা দেখি, মডার্ন বাজার গোছের দোকানে না এলে অবাক হব।
DeleteAmar o cha er nesha ar tomar Ma r moton amio bhabtam kobe ekta cha khaoar shongi pabo. Kintu unfortunatley baki ra barite shob coffee bhokto.
ReplyDeleteEkhon ami amar cha-time ta ke me-time kore niyechi, cha khete khete golper boi pori ba Netflix dekhi. Nijer sebong cha er ei time katabno ta khub i bhalo laage ajkal.
* Nijer ebong cha er shonge
Deleteএটা ভালো করেছেন বং মম। যদি তোর ডাক শুনে কেউ... ইত্যাদি প্রভৃতি। টি-টাইম আর মি-টাইমের মতো জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য দুটো টাইমের মেলবন্ধন যদি ঘটানো যায়, তাহলে তো মচৎকার।
DeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteচায়ের ব্যাপারে হাই ফাইভ, আধিরা। আর ভেজিটারিয়ান ভিগ্যানের ব্যাপারটা একটু ভুল হয়ে গেল। নিচে অরিজিন্যাল পোস্ট কোট করছি।
Delete"ভেজিটারিয়ানে ব্রেক কষলাম কেন, একেবারে ভিগ্যানে (ভেজিটারিয়ান ভে হলে ভেগান ভিগ্যান হবে কেন এটা আমার মাথায় ঢোকে না) গিয়ে থামলাম না কেন, সেটা প্রশ্ন উঠতে পারে।
আমিষ ছাড়ছি শুনে আমার মায়ের পাঁচ কেজি ওজন কমে গিয়েছিল, দুধ দইও বাদ পড়বে শুনলে মা অজ্ঞান হয়ে যেতেন। তাছাড়া, কাউ মিল্কের তুলনায় প্ল্যান্ট বেসড মিল্ক অন্যায্য রকমের দামি। তবে এগুলো সব ছেঁদো যুক্তি। ভিগ্যান না হওয়ার প্রধান যুক্তিটা হচ্ছে, আমি কনফিডেন্ট ছিলাম না আজীবন একরকম খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে অন্যরকম খাদ্যাভ্যাসে থিতু হতে পারব। আমিষটা সত্যি সত্যি ছাড়তে চেয়েছিলাম। নিজের ওপর চাপ বাড়িয়ে, ফেল করে, পাছে তিনবেলা কাবাবে রিবাউন্ড করি, সেই ভয়ে ভিগ্যান হইনি। এখন আত্মবিশ্বাস বেড়েছে, তবে এখনও খাতায়কলমে ভিগ্যান হইনি। প্রাণিজ দুধ দই খাওয়া কমিয়ে এনেছি অনেক; হাতের সামনে ভিগ্যান পেলে ভিগ্যানই খাই।"
http://abantor-prolaap.blogspot.com/2020/01/vegetarian.html
আমার হাতের সামনে এখনও ভিগ্যান দুধ থাকে না। কারণ আমি কফিতে ছাড়া আর কোনও সময় দুধ খাই না। চা-ও অধিকাংশ সময় কালো খাই। সারাদিনে তিন চামচ দুধের জন্য প্ল্যান্ট বেসড মিল্ক কেনাটা আমার কাছে এখনও অপচয় মনে হয়। শুধু পয়সা নয়, আরও অনেক কিছুর নিরিখে। কাজেই আমি এখনও ভেজিটারিয়ান, ভিগ্যান নই।
এহে, ভুলে গেছিলাম, ক্ষমা করবেন।
Deleteআরে ক্ষমার ব্যাপার নেই, আধিরা। যা দিনকাল, এই ব্যাপারগুলো চট করে ঘোরালো দিকে যেতে পারে, তাই লাফিয়ে পড়ে আত্মপক্ষ সমর্থন করলাম আরকি।
Deleteমেলে নাই.. কফি খেতে খুব ভালো লাগে.. কিন্তু বছর দশ আগে মাইগ্রেন সাইনাস সব মিলে মাথা ব্যথা হওয়ায় ENT বললেন কফি বন্ধ!! এখন খুব কম খাই .. চা পাই তাই খাই.. তবে সেই তুমি লিখেছিলে কোথায় খাচ্ছি সেটা important.. জানলা দিয়ে পাহাড় দেখতে দেখতে চা খাওয়া খুব পছন্দের..
ReplyDeleteওহ, তোর মাইগ্রেন আছে বুঝি, ঊর্মি? শুনেছি তো মহা কষ্ট, ষাট ষাট...
Deleteইস কবে পাহাড়ে যাব আর জানালার পাশে বসে চা খাব।
অনেকদিন পর আপনার পাড়ায় । ভুলে থাকি, এই লজ্জায় তাই নামপ্রকাশ করলাম না আর ।
ReplyDeleteআপনার লেখাগুলো যেরকম হয় এটাও তাই, নিজের কিছু কথা লেখার ইচ্ছাও জাগিয়ে তোলে বার বার ।
বাবার এক অফিস কলিগ ছিলেন, বাবার থেকে প্রায় ৫-৬ বছরের বড়, বাবাদের জমানায় জেঠুরা সেরামিক টি পটে করে চা বানিয়ে খেতেন |
বাবার রিটায়ারমেন্টের প্রায় ১৫ বছর পর, যখন স্ট্রোকের প্রকোপ কাটিয়ে বাবা কোনোমতে ওয়াকার নিয়ে হাটতে পারছেন, শুনলাম জেঠুর ও শরীর ভালো নয়। মনে হলো আর যদি না হয়, তাই খানিক জোর করে মা, বাবা ও এক কাকু-কাকিমাকে ( বাবার আরেক অফিস কলিগ) নিয়ে জেঠুর বাড়ি গেলাম, দশবছরে আমি প্রথমবার।
জেঠু সোজা হাটতে পারেন না , ৮০ পেরিয়েছেন সদ্য । সেদিন ৩ তলা থেকে সিঁড়ি ধরে ধরে ১ বছর পর নেমে, টোটো করে মিষ্টির দোকানে গিয়ে বাবার জন্য মিষ্টি এনেছেন । থরথর হাতে প্লেট থেকে সেই মিষ্টি বাবাকে চামচ করে খাইয়ে দিলেন। তারপর বড়মা বললেন চা-টা জেঠু নিজে করবেন বলছেন। জেঠু চললেন চা করতে, আমি গেলাম সাহায্য করতে । রান্না ঘরে গ্যাসের ওভেনে চা এর জল চাপানো হল । পাশে কালো গ্রানাইটের স্ল্যাবে পরিষ্কার পাতলা টাওয়েল পাতা , তার ওপর বহুযুগের সাক্ষী সেরামিকের সেই টিপট । পাশে ৬টা একরকম প্লেটের ওপরে ওল্টানো ৬টা কাপ । জল ফুটে উঠলে একটা স্টিলের কৌটো খুলে দিতে বললেন আমাকে, ভেতরে ছোট একটা স্টিলের চামচ । মাপ মতো চা দিলেন টি পটে , আমাকে বললেন জল ঢেলে দিতে । তারপর খানিক পর ঢাকনা খুলে একবার লম্বা একটা চামচ দিয়ে টিপটের জল নেড়ে , খানিক রেখে কাপগুলো তে পরিমান মতো চিনি রেখে টিপট থেকে আমাকে বললেন চা ঢেলে দিতে। সেই চা এর মতো চা আর কোনো দিন আমি খাই নি যেন । জেঠু মারা গেছেন, জেঠিমা মারা যাওয়ার মাস তিনেক আগে। প্রায় বছর চার পাঁচ হয়ে গেল, এখনো যেই সকালের চা টা চাপাই, একবারের জন্য অন্ততঃ মনে পড়ে কি অপরিসীম যত্নে জেঠু সেদিন চা টা বানিয়েছিলেন ।
প্রসঙ্গতঃ জেঠুর সাথে আমার কোনোদিন খুব একটা আত্মিক যোগ ছিল না আগে, যেটা ওই চা বানানোর ১০ মিনিটে হয়ে উঠেছিল ।
এমন অসামান্য স্মৃতিচারণার জন্য আপনার ভুলে থাকা অগ্রাহ্য করা গেল। আত্মার যোগ হতে যে দশ মিনিটের বেশি লাগে না, অনেকক্ষেত্রে তার অনেক কমেই ঘটে যায়, আপনার আর আপনার জেঠুর চা বানানোর গল্পটা শুনে সেটা নিজেকে আবার মনে করালাম। থ্যাংক ইউ।
Delete"মনে হলো আর যদি না হয়, তাই খানিক জোর করে মা, বাবা ও এক কাকু-কাকিমাকে ( বাবার আরেক অফিস কলিগ) নিয়ে জেঠুর বাড়ি গেলাম,"... এই কাজটা করে যে রেটে পুণ্য অর্জন করেছেন, সে জন্য হিংসেও রইল। এমন সৎবুদ্ধির উদয় আমার কেন ঘটে না কে জানে।
যাই হোক, আপনার এমন মচৎকার কমেন্ট আমার হিংসুটেপনা দিয়ে মলিন করব না। ভালো থাকবেন।
চা কফি না খেলে মানুষ মানুষ হয় না😛
ReplyDeleteএকমত, সুদীপ।
Delete