লখনৌ ২০২৪
অটো থেকে নামতে নামতে অর্চিষ্মান বলল, দোকানে যে লোকগুলো বসে আছে তাদের চেহারাগুলো দেখ।
নিজেদের অগোচরে যখন লোকজন বসে থাকে - জাস্ট বসে থাকে, কোনও কথা না বলে, ফোন না ঘেঁটে - তাদের বিশ্বমানের পেন্টিং-এর মতো দেখায়। আমিনাবাগের নেত রাম মিঠাইয়ের সামনে বসে থাকা লোকগুলোকেও দেখাচ্ছে। চোখেমুখে শূন্যতা, ক্লান্তি, হতাশা মিলিয়ে যে ভাবটা ফুটে উঠেছে, সেটার এক কথায় প্রকাশ আমাদের জানা। অনেকক্ষণ কথা না হলে বা কথা বলার মতো কিছু না পেলে যখন একজন লেখে, ‘আজ রাতে কী মজা হবে?’ আর অন্যজন সটাং লিখে দেয় ‘জানি না’ বা ‘কে জানে’ বা ‘কোনও মজা হবে না কাল সাবমিশন’, তখন প্রথমজন যে শব্দটা টাইপ করে।
হেউ।
অন্ততঃ লিখে প্রকাশ করতে গেলে 'হেউ'-ই টাইপ করতে হয়। আসলে ব্যাপারটা একটা ধ্বনি। কুকুরের রিয়েলিস্টিক ডাক যেমন ঘেউ-ও না, ঘৌ-ও না, মাঝামাঝি, হেউ-ও তাই। উচ্চারণ করতে এক সেকেন্ডের কম লাগবে। উচ্চারণ অস্পষ্ট হবে, ঠোঁট যথাসম্ভব কম ফাঁক হবে, উৎস হবে পেটের বদলে গলার পেছন। যে আবেগটা প্রকাশিত হবে সেটাও ধূসর। ধুসও না, হুসও না, মাঝামাঝি। শেষ হয়ে গেলে নিচের ঠোঁট উঠে এসে ওপরেরটার সঙ্গে মিশবে।
হেউ-এর মর্মার্থ হচ্ছে, আপনার জীবনের ঘটমান বর্তমানটা আপনার খুব খারাপ লাগছে কিন্তু কী ঘটলে যে ভালো লাগবে সেটাও বুঝে উঠতে পারছেন না। আমার খুব চেনা একজনের চব্বিশ ঘণ্টার ফিলিং।
লখনৌেয়ের আমিনাবাদের নেত রাম মিঠাই-এর সামনে কিছু লোক বেলা দশটার সময় হেউ মুখে বসে ছিল। দোকানের বাইরে তেলভর্তি কড়াইয়ের এ কানা থেকে ও কানায় জিলিপি তোলার লম্বা শিক সাস্পেন্ড করে যিনি বসে ছিলেন তাঁর মুখ হেউ। ছড়ানোছেটানো দু’চারজন খদ্দেরদের মুখ হেউ। কাউন্টারের পেছনের ভদ্রলোকের মুখ হেউ। মাথায় নেট পরা এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে আমাদের পথ দেখিয়ে দোকানের ভেতর নিয়ে গেলেন, খালি তাঁর মুখই হেউ নয়।
দোকানের পেছনে পাকানো সিঁড়ি - যার প্রতিটি ধাপের মধ্যে ফাঁকা - উঠতে উঠতে কালকাজীর আগরওয়াল সুইটস মনে পড়ল। এক্স্যাক্টলি এ রকম ঘোরানো সিঁড়ি। সিঁড়িটার জন্য মনে পড়ল তেমন না, মনে পড়ল ফিলিংটার জন্য। আগরওয়াল আর নেত রামের সিঁড়ি দিয়ে ওঠার ফিলিংটা এক। কর্তৃপক্ষ দোকান খুলে নিজেদের মনে নিজেদের কাজ করছিলেন, এর মধ্যে যে কেউ দোকানে চলে আসতে পারে, এসে 'খেতে দিন' আবদার জুড়তে পারে, কল্পনাও করেননি।
ভারতবর্ষের প্রাচীন প্রবাদ, অতিথিকে খালি পেটে ফেরাতে নেই। কাজেই ওঁরা পথ ছেড়ে দিয়েছেন, আমরা ফাঁকা ফাঁকা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠছি।
দোতলায় সানমাইকার টেবিলটপ ঘিরে স্টিল-পিঠের চেয়ার। দুটো টেবিল জড়ো করে পাঁচজন বসে আছেন। অর্ডার প্যাক হচ্ছে। কচুরি, চাটনি, সবজি। ক’প্যাকেট? একশো? পাঁচশো? হাজার? সারা মেঝে জুড়ে কার্ডবোর্ডের কার্টন ছত্রাকার। তিনটে কার্টন অলরেডি প্যাক হয়ে গেছে, একজন ভদ্রলোক বন্দুকের মতো সেলোটেপ মেশিন দিয়ে সেগুলোর মুখ সাঁটছেন। বিরাট বর্তনে কচুরির পর্বত, সবজির পুকুর। চাটনির বাসনে চামচ টেনে টেনে কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত করার উপক্রম করছেন একজন। সবাই নিজের জায়গায় স্থির হয়ে বসে বলাবলি করছেন, চাটনি লা। কে ফাইন্যালি ঘাড় পাতবে বোঝা যাচ্ছে না, অ্যাকচুয়ালি যাচ্ছে, কারণ জমায়েতে একজনই অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর। সে চাটনি আনতে যাওয়ার আগে জানালার পাশের একটা টেবিল মুছে দিয়ে গেল। আমরা বসলাম। নেটমাথা ভদ্রলোক মেনু দেখালেন।
নেত রাম মিঠাই অর্চিষ্মানই খুঁজে বার করেছে। দিল্লি ফুড ওয়াক আর গোলগাপ্পা গার্ল - দুজনের ভিডিওতেই নাকি নিরামিষাশীদের জন্য আমিনাবাদের নেত রাম এবং নেত রামের কচুরিকে গলা খুলে রেকমেন্ড করা হয়েছে। ফুল প্লেটে চারটে কচুরি, হাফ প্লেটে দুটো। এ সব দিকের কচুরির ভার সম্পর্কে আইডিয়া আছে, কাজেই দো হাফ প্লেট কচৌরি লাইয়ে, প্লিজ। ভদ্রলোক, বহোত আচ্ছা, বলে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে জানালার পাশে দাঁড় করানো একটা কালো, দাঁত বার করা পেডেস্ট্যাল ফ্যান চালিয়ে দিলেন। হাওয়া কম, ঝড় বেশি। আমার অলরেডি ঝোড়ো চুল কচুরি শেষ হতে হতে মহাদেবের জটায় পর্যবসিত হবে। অর্চিষ্মানের সঙ্গে চেয়ার বদলাবদলি করলাম। সেদিন তিন্নি নিজের চমৎকার ঘন কালো চুল নিয়ে অতৃপ্তি প্রকাশ করল। বলল বাড়ি থেকে চুল আঁচড়ে বেরোনোর আধঘণ্টার মধ্যে নাকি ওর চুল হীরু ডাকাতের চুলের মতো হয়ে যায়।
বললাম, তোর তো তাও হীরু ডাকাত। আমার চুল দেখেছিস? মনে হয় মাথার ভেতরের ঘুঁটেগুলো পুড়ছে আর তার সাদা ধোঁয়া মাথা ফুঁড়ে বেরোচ্ছে।
তিন্নি ভদ্রতা করে হ্যাট বলল, আমি বললাম আরে হ্যাট কী, ট্রুথ ইজ ট্রুথ।
তিন্নির শখ সে রকম চুলের যা কুচকুচে আর চকচকে আর মাথার সঙ্গে খুব লেপটে থাকে, একটুও এদিকওদিক হয় না। বললাম, শোন, ফিজিক্সের ল মেনে মানুষের ও রকম চুল হয় না। ও সবের জন্য দোকান থেকে একগাদা দামি দামি জিনিস কিনে মাখতে হয় আর বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে ভালো করে চুল ইস্তিরি করতে হয়। ঝামেলাহীন সস্তা বিকল্পও আছে, ঠাকুমাদিদিমার চয়েস - প্যারাশুট।
তিন্নি ভাবল। নাঃ হীরু ডাকাতই ভালো।
এক্স্যাক্টলি। আমারও ঘুঁটেপোড়া ধোঁয়াই ঠিক আছে।
অর্চিষ্মান ভাইসাবকে পিছু ডাকল। ভাইসাব, চায় মিলেগি?
নেহি মিলেগি কিন্তু, হাত নেড়ে দোকানের উত্তরদিক নির্দেশ করলেন ভাইসাব। চায়ের দোকান খুলে গিয়ে থাকলে উনি আনিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবেন।
কচুরি এল। সঙ্গে রায়তা, চাটনি, দুটো তরকারি। আলু কুমড়োর তরকারিটার কুমড়োর অধিকাংশ গলে গিয়ে মাখো মাখো টেক্সচার তৈরি করেছে, সাদা ছিটছিট সবুজ স্কিনের কিয়দংশ এখনও দৃশ্যমান। পৃথিবীর যে কোনও রাঁধুনি এ জিনিস রেঁধে গর্বিত হবেন। বুঁদির রায়তা যেমন হয়। আমের মিষ্টি, চিটচিটে চাটনিটা দিয়ে খাওয়ার জন্য মা লাস্ট লুচি বা কচুরিটা বাঁচিয়ে রাখতেনই রাখতেন।
কিন্তু আসল খেলোয়াড়, বা খেলোয়াড়েরা এঁরা কেউ নন। আসল খেলোয়াড়েরা হলেন ঝোলের ভেতর শুয়ে থাকা আউটলাইন ঘেঁটে যাওয়া সেই সব আলুর টুকরো, যাঁদের একটা নিজস্ব নাম দেওয়ার সম্মান কেউ দেখায়নি। 'পুরিওয়ালি আলু কি সবজি' ডেকে ক্ষান্ত দিয়েছে। উত্তর ভারতের সব রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাস, রাস্তার মোড়ে যার ডেকচি নিয়ে দেশের টপ রন্ধনশিল্পীরা সকাল দুপুর বিকেল বসে থাকেন। অথবা এই সব রেস্টোর্যান্টের সানমাইকা-চটা টেবিলে টেবিলে। রবিবার সকালের স্পেশাল ব্রেকফাস্টে কিংবা র্যান্ডম বুধবার বিকেলে খিদের মুখে, যতবার এঁদের মুখোমুখি হবেন চমকাবেন। থমকাবেন। কত কমে কত ভালো হওয়া যায়, আরও একবার উপলব্ধি করে মন অলমোস্ট খারাপ হয়ে যাবে।
চামচ মুখে পুরে অর্চিষ্মানের সঙ্গে চোখাচোখি করে হাসলাম। কিন্তু আরও কাউকে কিছু একটা বলা দরকার। নেটমস্তক ভদ্রলোক একটু দূরে দেওয়ালজোড়া জানালার চৌকাঠে তশরিফ রেখে পা মেলে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন। ওঁর দিকে ডানহাতের তর্জনী বুড়ো আঙুল গোল করে মধ্যমা অনামিকা কনিষ্ঠা জাপানি হাতপাখার মতো ছড়ালাম।
ভদ্রলোক বললেন, আরও দুটো করে কচুরি দিই?
আমি কুণ্ঠিত না বললাম, অর্চিষ্মান লজ্জিত হ্যাঁ বলল। তরকারিও সেধেছিলেন ভদ্রলোক, অর্চিষ্মান এক্সট্রা কচুরি নিয়েই তরকারি নিচ্ছে না, আমি কী করে নেব?
কচুরি শেষ, এবার জিলিপি। একশো গ্রাম দুজনের জন্য এনাফ। জিলিপি জিনিসটা আশেপাশে আছে টের পেলেই মনে হয় খাই, কিন্তু খেয়ে প্রত্যেকবার আশাহতও হই। এদিকের জিলিপিওয়ালাদের অধিকাংশেরই ধারণা জিলিপির ভেতর যত বেশি রস ঠেসে ঢোকানো যাবে তত ব্যাপারটা উৎকৃষ্ট হবে। সেটা করতে গেলে চামড়া মোটা করতে হয়, যা মানুষের মতো জিলিপিরও লাভের থেকে ক্ষতি বেশি করে। এঁরা সেই ভুলটা করেননি। পাতলা মুচমুচে ত্বক যতটুকু হ্যান্ডল করতে পারে, ততটুকুই রস। দেখতেও আলাদা। ছোট ছোট জিলিপি, অনেকগুলো লাইন করে জোড়া। কিন্তু জিলিপি একা আসেনি, পাশে আরেকটা বাটিতে সাদা মতো কী। এসব দিকে রাবড়ি দিয়ে জিলিপি খাওয়ার চল আছে, সেটাই নাকি? অন্য কারও অর্ডার ভুল করে আমাদের টেবিলে চলে আসছে কি না ভেরিফাই করতে বললাম, এটা কী?
দহি আপনে নেহি বোলা? এ পরিবেশকের মাথায় নেট নেই।
নেহি তো।
সাথ মে লিজিয়ে, আচ্ছা লাগেগা। নেট পরা ভদ্রলোক দোতলায় উঠে এসেছেন।
যে কোনও রকম এটা দিয়ে ওটা, ওটা দিয়ে সেটার বিরোধী আমি। কিন্তু ভদ্রলোক আমাদের ওঁর পছন্দের কম্বো খাওয়ানোর মতো আপন ভেবেছেন, এখানে নিজের পছন্দঅপছন্দ জাহির করে রাক্ষসে। কাজেই এক কামড় জিলিপি এক চামচ দই - এই স্ট্র্যাটেজিতে এগোব স্থির করলাম। অর্চিষ্মানের অত প্যাকনা নেই, ও জিলিপিটাকেই চামচের মতো ব্যবহার করে দই খাচ্ছে।
জিলিপিতে কামড় দিলাম। অগ্ন্যাশয় থেকে গলগলিয়ে ইনসুলিন বেরোল, মস্তিষ্ক থেকে ফুরফুরিয়ে ডোপামাইন। দইয়ের চামচ মুখে তুললাম। জনাব-এ-আলি, কোন কামধেনুর দুধ দুয়ে কোন দইয়ের সাজা দিয়ে এ মহিন অমৃত পাতা হয়েছে? নেটমস্তক ভদ্রলোক দূর থেকে নজর রাখছেন। চামচ সরিয়ে রেখে একটুখানি জিলিপি ভেঙে, অল্প দইয়ের সঙ্গে পাঁচ আঙুলে মুখে পুরলাম। হোপফুলি স্যানিটাইজার আছে ব্যাগে, কারণ দোকানের কমন বেসিনে আমি হাত ধুচ্ছি না। একদিনে এতগুলো প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে গেলে বদহজম হবে। দইয়ের ঠাণ্ডা, জিলিপির গরমে জিভ প্লেজেন্টলি কনফিউজড। রস আঙুল বেয়ে থালায় পড়ছে। পাবলিক প্লেসে এত আনন্দ পাওয়া আইনসম্মত কি না ভেবে নার্ভাস বোধ করছি।
নেট পরা ভদ্রলোক দু'হাতে দুটো কাপপ্লেট ব্যালেন্স করে সিঁড়ি দিয়ে উঠে এলেন। একটা কাপের অর্ধেক চা চলকে প্লেটে পড়েছে। অনেক দূর থেকে আনানো চায়ের ওপর পাতলা সর। সিটিসি চা, গন্ধ যেটুকু ছিল ফুটিয়ে তার চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করে দেওয়া হয়েছে। অর্চিষ্মানের এ রকমই পছন্দ জানি, এও জানি ফোটানো দুধের চা খাওয়ামাত্র আমার অম্বল হবে। সব থেকে যেটা বেশি করে জানি এগুলো ম্যাটার করে না।
যেটা ম্যাটার করে সেটা হচ্ছে যে এই দু’কাপ চা অর্চিষ্মান আর আমাকে একটা টেবিলের এপারে ওপারে কিছুক্ষণ বসে থাকার সুযোগ করে দেবে। বসে বসে লোক দেখার, গল্প করার, বা চুপ করে যে যার নিজস্ব হাবিজাবি ভাবনায় ঘুরে বেড়ানোর আড়াল দেবে। একটা বিভ্রমের বুদবুদ নির্মাণ করবে আমাদের চারপাশে। যদিও ব্রহ্মাণ্ড পাঁইপাঁই ঘুরছে, ডেডলাইনরা বাঁইবাঁই ছুটে আসছে, সবাই সাঁইসাঁই উন্নতি করছে, ওই বুদবুদটুকুর ভেতর সব স্থির। দুটো জীবনের পজ বাটন যেন টিপে দিয়েছে কেউ। আমাদের বয়স বাড়ছে না, চুল পাকছে না, কেউ বকছে না। ফ্যানের তাণ্ডবে বুদবুদের চারপাশে ব্যবহৃত অব্যবহৃত টিস্যুপেপার তুলোফুলের মতো উড়ছে। গলির ওপারের বাড়ি থেকে মহিলার পিছু পিছু বেরিয়ে এসেছে বালিকা, হাঁটুঝুল ফ্রক, পিঠে বেল্টের ফুল, মাথার দুপাশে তৈলাক্ত ঝুঁটি, হাতে পলিথিনের প্যাকেট। এক কানে দুল পরা ছেড়ে দেব যদি ওই প্যাকেটের ভেতর হয় গান শেখার খাতা নয় নাচের ঘুঙুর নয় ড্রয়িং-এর সরঞ্জাম না থাকে। এ কোন টাইম ওয়ার্পে ঢুকে পড়েছি? দু'হাজার চব্বিশের ভারতবর্ষে এ রকম বালিকারা ঘুরে বেড়ায় এখনও? অর্চিষ্মানকে বলছি, দেখো দেখো, ওটা আমি। ওটা এক্স্যাক্টলি আমি।
বিল মিটিয়ে একতলায় এলাম। কাউন্টারে ভিড়। চারদিক থেকে ইভি-ভাইসাব, অটোভাইসাবরা কোথায় যাবেন কোথায় যাবেন উত্যক্ত করছেন। যত বলছি আমাদের অটো বুক করা হয়ে গেছে কানে নিচ্ছেন না। যে মহিলা বারো প্যাকেট কচুরি প্যাক করাচ্ছিলেন, বেরিয়ে এসেছেন। গাড়িটা পার্ক করেছেন প্রায় রাস্তার মাঝখানে তাই দৌড়োদৌড়ি করে মালপত্র গাড়িতে তুলছেন।
অর্চিষ্মানকে বললাম, তোমাকে এই চেকশার্টটায় সত্যিই ভালো দেখতে লাগে। সিরিয়াসলি ভালো।
বুঝেছি, কুন্তলা।
আরে সিরিয়াসলি। মহিলাও তাকাচ্ছিলেন, দেখলে না? তোমার সামনে দিয়ে যে দুবার দৌড়ে গেলেন দু’বারই আড়চোখে তাকিয়ে গেলেন। সোজা তাকালে তবু খানিকটা সংশয় থাকত।
একটা অটো মোড় ঘুরে ফেরারির স্পিডে সর্বাঙ্গ কাঁপিয়ে আমাদের দিকে এগোচ্ছে। অর্চিষ্মান কনুই ধরে টানল। উফ্ কুন্তলা চল, অটো এসে গেছে। এত বেশি তাড়া দেখাল যে সন্দেহজনক।
*****
তেজসমেজস ভালো ট্রেন হয়? নাতনির বয়ফ্রেন্ড হাওড়ার জানতে পেরে এক দিদিমা জানতে চেয়েছিলেন, হাওড়ার ছেলেরা ভালো হয়? ট্রেন বলতে আমি জেনেছি রাজধানী, শতাব্দী, দুরন্ত, কালকা, পূর্বা, করমণ্ডল। ভালো ট্রেন বলতে রাজধানী, শতাব্দী, দুরন্ত। হালে একবার ভুল করে বন্দেভারতে উঠে পড়া ছাড়া অভিজ্ঞতা নেই। কিন্তু শতাব্দী বন্দেভারতে টিকিট নেই। শুক্রবার রাতেও না, শনিবার সকালেও না। তেজসে আছে।
অর্চিষ্মানও তেজস জানত না। খোঁজ নিয়ে বলল, অত হেলাফেলা কোরো না কুন্তলা, ভারতে যে তিনটে সেমি হাইস্পিড ট্রেন চলে, তেজস তার মধ্যে একটা। পাঁচশো এগারো কিলোমিটার পথ, বিকেল সাড়ে তিনটেয় ছেড়ে দশটায় ঢুকে যাবে। আবার অটোমেটিক দরজা, উইকিপিডিয়ায় লিখেছে।
আমার অটোমেটিক দরজা চাই না, ল্যাপটপ গোঁজার প্লাগ পয়েন্ট চাই। ওয়ার্কিং। সে ব্যাপারে কিছু লেখেনি, অর্চিষ্মান দেখে বলল। না লিখলেও আছে। ওয়ার্কিং প্লাগপয়েন্ট। তাড়াতাড়ি ল্যাপটপ গুঁজে দখল করলাম। ইউটিউবের মনোবিদদের মতানুযায়ী আমার স্কেয়ারসিটি মাইন্ডসেট। কী আছে সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে কী নেই, কী কোনওদিন পাব না ভেবে ভেবে পাগল হচ্ছি। এ ধরণের লোকদের বিশেষত্ব হচ্ছে, পুওর ডিসিশন মেকিং এবং অবান্তর কমপিটিশনের প্রবণতা। অর্চিষ্মান বলল, এরা তো তোমাকে আমার থেকে বেশি চিনে ফেলেছে দেখছি।
প্লাগ পয়েন্টটয়েন্ট বলার জন্য বলা, আমার আসল যেটা দরকার সেটা থাকবে জানতাম। কারণ সেটা বাদ দিয়ে মালগাড়ি ছাড়া ভূভারতে ট্রেন বানানো হয় বলে শুনিনি। একটাই চিন্তা, জানালার কাঁচ পরিষ্কার থাকবে কি না।
তেজসের জানালা ঝকঝকে। শহরের বাইরে বেরোলে বিস্তীর্ণ মাঠ, বড় বড় প্রাচীন গাছ, কখনও একলা কখনও দল বেঁধে। একেকটা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে একটা কুকুর পর্যন্ত গোল পাকিয়ে শুয়ে নেই, কিন্তু দুবেলা ট্রেন যায়, সরু ধুলোপথ মাঠের মধ্য দিয়ে দিগন্তে বনের দিকে ছোটে। তার মানে বনের ওপারে বসতি আছে। আবার কোনও স্টেশনের গা ঘেঁষে বাড়িঘরদোর, তাদের দেওয়ালে আহুজা সিমেন্টের বিজ্ঞাপন।
তোমার কোনও বন্ধুর বাড়ি স্টেশনের পাশে ছিল?
বন্ধু জিনিসটাই আগের জন্মের মনে হয়। তাদের কারও কারও বাড়িতে রোজ যেতাম, কারও কারও বাড়িতে সপ্তাহে একবার, কারও কারও বাড়িতে জীবনে একবার হয়তো জল খেতে ঢুকেছি। ব্যানার বাড়ি যেমন। ব্যানার্জি ছোট করে নিয়ে ব্যানা। চ্যাটার্জিকে ছোট করে চ্যাটা, গাঙ্গুলিকে গ্যাঙা, মুখার্জিকে লম্বু, আর আরেক মুখার্জিকে 'নীল গ্রুপ' ডাকতাম। এদের সবারই নাম মৌমিতা তাই কাউকেই নাম ধরে ডাকা অসম্ভব ছিল।
স্কুল থেকে অন্যান্য স্কুলে সরস্বতী পুজোর নেমন্তন্ন করতে বেরোনো হয়েছিল (আসল উৎসাহ ছিল উত্তরপাড়া গভর্নমেন্ট)। ফেরার পথে ব্যানার বাড়িতে জল খেতে ঢুকেছিলাম। দিব্যি স্বাভাবিক বাড়ি আর্কিটেকচারাল মার্ভেল কিছু নেই, কিন্তু ঘর থেকে ঘরে আনন্দ ভেসে বেড়াচ্ছে। গোটা পনেরো ক্লাস এইটের মেয়ের বিনা নোটিসে বাড়িতে ঢুকে পড়া কাকিমাকে (যাঁর নিজের সন্তান ওই একটিমাত্র মেয়ে) টসকাতে পারেনি। বাড়ির সমস্ত বোতলের জল শেষ করে, বিস্কুট চানাচুর ধ্বংস করে, সোফা চেয়ার ধামসে দশ মিনিটের মধ্যে আবার বেরোচ্ছি যখন (কারণ স্কুলে ফিরতে হত) কাকিমা ফ্রিজ খুলে প্রত্যেকের হাতে একটা করে সল্টেড বাদামের প্যাকেট (যে প্যাকেটগুলো তখন দশটাকা করে ট্রেনে পাওয়া যেত, এখন চল্লিশফল্লিশ হবে। দাম বাড়লেও কোয়ালিটি ডেফিনিটলি পড়েছে) ধরিয়েছিলেন। খেতে খেতে চলে যা।
অত ইমপ্রেসড জীবনে খুব কম জিনিসে হয়েছি। কোনও প্যারালাল ইউনিভার্সে যদি ক্লাস এইটে পড়া আমার একটা বাচ্চা থাকে, সে বাচ্চার দুম করে এসে পড়া বন্ধুদের জন্য ফ্রিজে সল্টেড বাদামের প্যাকেটও থাকবে।
এসি কামরার জানালা থেকে শব্দহীন গন্ধহীন তাপহীন রোদের বিকেল এক অসামান্য বিষণ্ণতা সৃষ্টি করে। ইন্ডিয়া ভারতবর্ষ হয়ে যায়, রমাপদ চৌধুরীর আণ্ডা হল্ট বাস্তব হয়ে ওঠে। এ সময় বাড়িতে থাকলে প্রসেনজিৎ আসে। ভাত হবে না রুটি, ফ্রিজে কী কী পচছে দেখে সেগুলো দিয়ে যা খুশি কিছু বানিয়ে দিয়ে যাও ইত্যাদি কথোপকথন চলে। সেই অভ্যেসে ফাঁক পড়ে ব্রেন থতমত খেয়ে গেছে, ধুলো ঝেড়ে ফুঁ দিয়ে একের পর এক মুখ, ফোনালাপের একেকটি শব্দ, এক লাইন চ্যাট, এমন সব ঘটে যাওয়া দৃশ্য যাতে আমার থাকা উচিত ছিল, এমন দৃশ্য যা আদৌ ঘটেনি ঘটার চান্সও নেই কিন্তু ঘটলে আমি তাতে ডেফিনিটলি উপস্থিত থাকতে চাইব - তুলে আনছে।
দনকৌর গেল।
আমরা অ্যাকচুয়ালি বাড়ির দিকে যাচ্ছি।
তাই বুঝি?
অর্চিষ্মান এ পথে অগুন্তিবার গেছে কাজেই দনকৌর ওর জানার কথা। গাজা ইউক্রেনের ম্যাপ নখদর্পণে অথচ বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোনদিকে বেঁকলে হালদার কোনদিকে বেঁকলে গাঙ্গুলি বলতে পারবে না, যদিও দু’বাড়ির সামনেই নেমপ্লেট ঝকঝক করছে।
এর পর একটা স্টেশন আসবে, দাউদ খান। হিন্দু বাঙালিদের অনেকের সারনেম খান হয়। আমাদের পাড়ায় একজন ছিল, নীলাদ্রি খান। তুমি এ রকম কোনও খানকে চিনতে?
অফিসে ব্যস্ততার গৌরব দেখাতে গিয়ে লাঞ্চ স্কিপ করেছে, আই আর সি টি সি না কোন সাইটে ঢুকে মেনু পড়ছে অর্চিষ্মান। তুমি ভেজ প্রেফারেন্স দিয়েছিলে তো? তাহলে তোমাকে পনীর টিক্কা দেবে, আমাকে চিকেন। বাকি ডালফাল, আচার, দই, আইস ক্রিম, হার্বাল হ্যান্ড ওয়াশ সব কমন। তুমিও পাবে।
বছর দশবারো আগে আমার ধারণা রেলওয়ে ফুড একটা অলটাইম লো হিট করেছিল, যখন লাল রঙের মিনিস্কিউল ট্রে আর কে জানে কবে ধোওয়া ফ্লাস্কে চা আসত। এখন তার থেকে বেটার, মাচ বেটার। চা কফি তো বেশ ভালো। তিনকুচি বাঁধাকপি এককুচি গাজর মেয়োনিজে লেবড়ে কাঁচা পাউরুটিতে পুরে স্যান্ডউইচের ধ্যাষ্টামোও নেই। একটা খাস্তা কচুরি দিয়েছে যেটার দিকে তাকালেও অম্বল হবে, কাজেই প্রাণপণে চোখ ফিরিয়ে রেখেছি। আপেলের জুসবক্সেও আমি নেই, অর্চিষ্মানের ভাগ্যে দুটো নাচছে। মশলা মুড়ির প্যাকেটটা চায়ের সঙ্গে চলতে পারে। যদিও ভাবছি কফি খাব। নেসক্যাফের লাল গাঢ় বাদামি প্যাকেট এক্সপেক্ট করেছিলাম, অচেনা প্যাকেটে থ্রি ইন ওয়ান কফি মিক্স। রাতের খাবারও রীতিমতো ভালো। পনীর, চিকেন দুইই পর্যাপ্ত ও সুস্বাদু।
রাত দশটায় তেজস লখনৌ জাংশন ঢুকে গেল, উবারের অটোভাইসাব ছোটি প্ল্যাটফর্মে ঢুকে গেলেন, আমরা হজরতগঞ্জের সপরু মার্গের ইউ পি টি ডি সি-র গোমতী হোটেলে ঢুকে গেলাম। ততক্ষণে রিসেপশনের আলো কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। আমি ঘরে ঢুকেই জামাজুতো ছুঁড়ে ফেলে এসি চালিয়ে লেপমুড়ি দিলাম, ঘুমের আগের মুহূর্তে শুনলাম অর্চিষ্মান রুম সার্ভিসে ফোন করে জিজ্ঞাসা করছে শামি কাবাব পাওয়া যাবে কি না। ঠিক হ্যায়, এক প্লেট ভেজ পকোড়া ভেজিয়ে, উইথ ফ্রেশ লাইম সোডা।
পরদিন সকালে উঠে দেখলাম প্লেটে তিনটে পকোড়া পড়ে আছে।
*****
ক্যাফেস ইন লখনৌ উইথ ওয়াইফাই সার্চ করাতে অনেকগুলো অপশন এসেছিল যার মধ্যে সপরু মার্গের বারিস্তা হোটেলের সবথেকে কাছে। কিন্তু আমাদের দূরেই পছন্দ। লখনৌয়ের আর কোনও জায়গা যাব না, নো বড়া ইমামবাড়া, ছোটা ইমামবাড়া, ভুলভুলাইয়া, কাজেই অটো চড়ে হোটেল টু কফিশপ, কফিশপ টু হোটেলই আমাদের লখনৌ ঘোরা। রেলওয়ে স্টেশন রোডের রোস্টারি কফি হাউস সে উদ্দেশ্য সাধন করবে। নেত রাম থেকে প্রায় দশ কিলোমিটার।
চওড়া রাস্তা, প্রবল প্রতাপান্বিত মোড়, শান্ত বুলেভার্ড, সরু গলি। গরিব লখনৌ, বড়লোক লখনৌ। নোংরা লখনৌ, স্বচ্ছ লখনৌ। হদ্দ গরিব লখনৌ, স্টিংকিং রিচ লখনৌ। আমাদের হোটেলের আশপাশে এবং অল্প দুরেও - বেসিক্যালি গোটা শহর জুড়েই - মিশনারি সমিতি। চার্চ, লাইব্রেরি, কবরখানা, স্কুল। স্কুলের মাঠে মাঠে প্রেয়ারের লাইন পড়েছে, আকাশবাতাস ভুলে অটোর ফোঁকর দিয়ে গলা বার করে সেই সব দেখতে দেখতে চলেছি।
হিন্দুস্তান পার্কের ফ্যাব ইন্ডিয়ার উল্টোদিকের সাউথ ইন্ডিয়ান ক্যান্টিন ভেঙে যে রোস্টারি হয়েছে, লখনৌেয়ের রেলওয়ে স্টেশন রোডের রোস্টারিরও সেই এক্স্যাক্ট হলুদ বাড়ি, সাদা বর্ডার, বড় বড় টবে বড় বড় পাম গাছ, কালো সাদা চৌকো টাইলের মেঝে, কমফর্টেবল চেয়ারটেবিল, প্রশস্ত জানালা। তার মানে ভারতবর্ষের সব রোস্টারি কফি কোম্পানির দোকানই এক রকম দেখতে। সেটাই হওয়ার কথা, কিন্তু হওয়ার কথা তো অনেক কিছুই।
কফিশপ দু'রকম হয়। এক রকমের চেহারা দেখেই বোঝা যায় এখানে কোটি কোটি মিটিং হয়, পুরোনো ব্যবসা মরে, নতুন স্টার্ট আপ জন্মায়, রোজ সকালে আয়নায় নিজেকে হাই ফাইভ দেওয়া আর টুইটার বায়োতে ‘গো গেটার’ লেখা পাবলিক যারা বসের ঘরে গিয়ে হাত কচলায় আর সাবঅর্ডিনেটকে হোয়্যার ইজ দা পিপিটি-র পর চারটে প্রশ্নচিহ্ন দিয়ে ইমেল পাঠায় (বসকে সিসি করে) - কিলবিল করে।
রোস্টারির চেহারা দ্বিতীয় রকমের। সবাই ধীরে কথা কয়, সকালে উঠে শিওরশট চ্যান্টিং করে। এখানে ল্যাপটপ খাটিয়ে বসে পড়া ভালো চোখে দেখা হবে কি না ভেবে বাধোবাধো ঠেকছিল তাই প্রথমেই প্লাগ পয়েন্ট কোথায় জিজ্ঞাসা করলাম। ব্যান্ডেড এক টানেই তোলা ভালো। মেয়েটি ঘাড় নাড়ল। হাসিমুখে। যাক। সারাদিন এখানে কাটানো যাবে।
ওয়াই ফাই কানেক্টেড হল। প্রাণ এল। অনেকগুলো মেসেজও। শারদীয়ায় লেখা বেরিয়েছে সবার, কারও কবিতা, কারও প্রবন্ধ, কারও উপন্যাস। সকলেই ভীষণ মনখারাপ নিয়ে সেগুলো শেয়ার করছেন। আরেকজন ভারাক্রান্ত মন নিয়ে দমদমে চেক ইন করেছেন - নেহাত টিকিট কাটা ছিল তাই কাশ্মীরটা কাটানো যাচ্ছে না। আরেকজন চেনা, যিনি একসময় নাস্তিক পার্টির হয়ে অন্য পার্টির পোস্টার ছিঁড়ে বেড়াতেন, মনখারাপের চোটে রাতে ঘুমোতে না পেরে ব্রাহ্মমুহূর্তে তর্পণ করতে চলে গেছেন।
পৃথিবীতে যত রকম ফুল আর ফল আছে, গাঁদা, জবা, টগর, পেয়ারা, লিচু, আতা - সব ফ্লেভারের কফি পাওয়া যায় রোস্টারিতে। আমি লিচু কিংবা গাঁদার বাজি ধরেছিলাম, অর্চিষ্মান ক্র্যানবেরি কফি অর্ডার করল। আমি সেই পোর ওভার মিডিয়াম রোস্ট। আমার গোবদা কাপে কফি এল, অর্চিষ্মানের লং স্টেমড ওয়াইন গ্লাসে। কয়েকটি সেটপিস পরিস্থিতি ও কথোপকথনের বারংবার পুনরাবৃত্তিই বিবাহ। নিজে চুমুক দেওয়ারও আগে অর্চিষ্মান আমাকে ঝুলোঝুলি করতে লাগল। এক চুমুক খেয়ে দেখো প্লিজ, খুব ভালো খেতে। আমি পাগলের মতো মাথা নেড়ে না না করছি, তখন বলল, আরে খাও কুন্তলা, কফি কাপের আকারপ্রকার দিয়ে কিছু পৌরুষ প্রমাণ হয় না। তখন ডেইন্টি আঙুলে স্টেম তুলে ধরে পিংকি আপ করে চুমুক দিতেই হল। অর্চিষ্মান জিজ্ঞাসা করল, ভালো না? আমি বললাম, তোমার ভালো লাগবে।
আমি কাজের বদলে ইউটিউব দেখতে লাগলাম, অর্চিষ্মান টুইটারে ঘুরতে লাগল। ঘুরতে ঘুরতে কখনও মুচকি কখনও কেঁপে কেঁপে হাসতে লাগল। ইন্ডিয়াতে নাকি ফেক পাঁচশো টাকা বেরিয়েছে, গান্ধীর বদলে অনুপম খেরের মুখ। চারপাশে লোকজন এলেন, বসলেন, গেলেন। অর্চিষ্মান আমাকে বলল, তোমার পেছনেে যা ফোটো সেশন চলছে যদি দেখতে। আমি অর্চিষ্মানকে বললাম, তোমার পেছনে যা প্রেম, কপালে চুমুফুমু। পরিবেশক পাশের টেবিলের ট্রে নিয়ে যেতে যেতে অর্চিষ্মানের ক্র্যানবেরি কফির দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দু’সেকেন্ডের দ্বিধা পেরিয়ে এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে "গুলে নিন" বলেই চলে গেলেন। অর্চিষ্মান হেসে ঘাড় নাড়ল কিন্তু আমি জানি এত আস্তে কথা, তাও এত অতর্কিতে, ও শুনতে পায়নি। পরিবেশক সম্মানজনক দূরত্বে যাওয়ার পর আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে জিজ্ঞাসা করল, কী বলল? চারজন কুল ব্রো পাশের টেবিলে এসে বসলেন। কবজিতে সুতো, পায়ে স্নিকার, কুলতম ব্রোয়ের পরনে টাইট হাফপ্যান্ট। চিৎকার করে কথা বলছেন, উন্মুক্ত রোমশ ঊরু থাবড়ে হাহা হাসছেন, ফোন এসেছে, স্পিকারে দিয়ে চারজন একসঙ্গে কথা বলছেন। বলছেন কারণ বলবেন না-ই বা কেন? কে কী বলবে?
মাঝে মাঝে পালা করে উঠে বাইরে যাচ্ছিলাম। একসঙ্গে গেলে বেশি মজা হত, কিন্তু টেবিল জুড়ে দু'জনের ল্যাপটপ মেলা। অত সৎ নিজেরা এখনও হতে পারিনি যে নতুন শহরের নতুন মানুষজনের সততায় ভরসা রাখব। অর্চিষ্মান এসে বলল, পাড়াটা খুব সুন্দর। আমি গেলাম। পাড়াটা সত্যি সুন্দর। পথের দু'পাশে একতলা, বড়জোর দোতলা বাড়ি, রিয়েল মাটি ফুঁড়ে ওঠা রিয়েল গাছের ছায়ায় রোদের ঝিকিমিকি, পানের দোকানে গান ।
*****
আমার খিদে নেই, অর্চিষ্মানেরও না, কিন্তু লখনৌ এসে একবেলার খাওয়া মিস করা পাপ। বিরিয়ানি খেতে হলে ইদ্রিস, লাল্লা, দস্তরখোয়ানে যেতে হয়, কাবাব হলে টুন্ডে বা নৌশিজান। অর্চিষ্মান কাবাব খাবে। টুন্ডেতে আগে খাওয়া হয়েছে কাজেই এবার নৌশিজান।
উবার অটো চড়ে গোমতী পার হলাম। হুগলী জলঙ্গী ইছামতী দেখে যারা বড় হয়েছে, তাদের কাছে নালা। পদ্মা ব্রহ্মপুত্রওয়ালাদের কাছে সম্ভবতঃ পুকুর। কিন্তু সাইজ কোনও কোনও ক্ষেত্রে সত্যিই ম্যাটার করে না। অটো করে ব্রিজ পেরোতে পেরোতে বিকেলের আলোয় এদিকওদিক বিছিয়ে থাকা গোমতীকে ভালো লাগবেই।
ব্রিজ পার হয়ে নদীর পাড় ধরে উত্তরদিকে অটো চলল। শান্ত, ফাঁকা রাস্তা। দু'পাশে উদ্যানের নামে প্রায় জঙ্গল। ফাঁকে ফাঁকে চিকমিক রোদ্দুর। দূরে ডানদিকে একটা বড় গেট, গেটের সামনে অল্প জটলা। একটা ট্রাকের ছাদে খাটে ধপধপে চাদরের ওপর গাঁদাফুলের উজ্জ্বল ঢিপি।
যাহ্, গেল। কেউ একটা। কারও একটা। চুপ করে গেলাম। যেন রেস্টোর্যান্টে পরিবেশক গ্লাসে জল রিফিল করতে এসেছেন। বাংলা সংস্কৃতির অন্তর্জলি যাত্রা, সিনেমার কোমাটোজ অবস্থা নিয়ে যত রক্ত গরম আলোচনাই চলতে থাকুক, যতক্ষণ তিনি ঘাড় এবং জলের পাত্র কাত করে গ্লাসে গ্লাসে জল ঢালবেন, ততক্ষণ টেবিলশুদ্ধু লোককে চুপ করে সে দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে হবে।
আমরাও চুপ করে থাকলাম। যতক্ষণ না দৃষ্টি এবং মগজ থেকে গাঁদার উজ্জ্বলতা পিছু হটল। এই সব নদীতীর ও রৌদ্রকরোজ্জ্বল উদ্যানের মায়া ছিঁড়েখুঁড়ে রিয়েলিটি চেক। কোনটা রিয়েল, কোনটা আনরিয়েল। কোনটা ফ্লাই, কোনটা অয়েন্টমেন্ট। কোনটা অ্যাডিশন্যাল, কোনটা কম্পালসারি।
নৌশিজানে অর্চিষ্মান রুমালি রুটি, শামি কাবাব আর মাটন পসন্দা খাবে। খাওয়া শুরু করার আগে সরি বলল, খেতে খেতে সরি বলল, সরি দিয়ে খাওয়া শেষ করল। কারণ ও খাচ্ছে আমি কিছু খাচ্ছি না। ওর দুঃখ ঘোচাতে এক গ্লাস থামস আপ নিয়ে বসলাম। নৌশিজানের ভদ্রলোক এসে বললেন, ম্যাডাম আপনি তো কিছুই খেলেন না।। অর্চিষ্মান বলল, ম্যাডাম এগুলো খেতে পারবেন না। ভদ্রলোক বললেন, আমাদের তো ভেজও অনেক কিছু আছে। ঠিকই। নৌশিজানের মেনুতে নিরামিষও অনেক কিছু আছে। আমি শিওর সেগুলোও সমান সুস্বাদু, কিন্তু আমি খাচ্ছি না অ্যাভেলেবিলিটির অভাবে না, পেটে জায়গা নেই বলে। ভদ্রলোককে আশ্বাস দিলাম।
তখন বলেনি। বাড়ি ফেরারও সাতদশদিন কেটে যাওয়ার পর অর্চিষ্মান মাঝরাতে কাকে দা ধাবা না কোত্থেকে শিক কাবাব অর্ডার করে খেতে খেতে বলেছিল। গিল্টি হেসে। এবার লখনৌয়ের কাবাব খেয়ে মনে হল দিল্লির কাবাব বেটার। এক্স্যাক্ট এই মন্তব্যটা, কাবাবের বদলে চাট প্রসঙ্গে আগের বার লখনৌ থেকে ফিরে বলেছিলাম। লখনৌয়ের চাট ভালো, কিন্তু নট আ প্যাচ অন দিল্লি। অর্চিষ্মানের দিল্লির কাবাব বেস্ট লাগছে, আমার দিল্লির চাট ভালো লাগছে, দু'জনেরই দিল্লির পার্ক, কফি শপ, শীত আসার মুখটায় বাতাসে ছাতিমের গন্ধ ক্রমশ ভালো এবং আরও ভালো লাগছে। এ সব ভালোলাগা তবু ক্ষমা করা যায়, সেদিন কাকে কী একটা বলতে গিয়ে সাড়ে তিন সেকেন্ড ভেবেও বিঘ্ন ঘটানোয় দুঃখিত শব্দবন্ধটা মনে পড়ল না। বললাম, প্লিজ কিছু মনে করিস না টাং আড়াতে বাধ্য হচ্ছি। অর্চিষ্মানকে পইপই করে বলছি, এই বেলা পশ্চিমবঙ্গে ফিরে চল না হলে রক্ষা থাকবে না।
প্ল্যান ছিল রবিবার বিকেলের প্লেন ধরে রাতে বাড়ি ফিরে সোমবারে গা ভাসানো, হোটেলে ফিরে খেয়াল হল বাড়ি ফেরার টিকিট কাটা হয়নি। রবিবার বিকেলের বন্দেভারত, স্বর্ণশতাব্দীর তৎকাল টিকিট পেতে হলে অ্যাট লিস্ট শনিবার সকালে কাটতে হত, ভুলে গেছি। চেক করলাম, সব ভর্তি। আর এ সি-ও না, ওয়েটিং। এদিকে সোমবার অফিস যেতেই হবে। প্লেন চেক করলাম, কোনও মানে হয় না এই দাম দেওয়ার। একটাই অপশন, তেজস। একটাই ঝামেলা, কাল অর্থাৎ রবিবার ভোরে ছাড়ে। আমরা যে ভেবেছিলাম রবিবার সারাদিনটাও রোস্টারিতে বসব, দুপুরে ধীরেসুস্থে বিরিয়ানি খেয়ে বিকেলে হেলেদুলে স্টেশনে উপস্থিত হয়ে ট্রেনে চড়ে বাড়ি চলে যাব, সকালে ইচ্ছে হলে একবার রেসিডেন্সি দেখে আসা যেতে পারে সে সব কিছুই হবে না, কারণ তেজস ছাড়ে ভোরবেলা।
বল কী করবে? অর্চিষ্মান আমার ঘাড়ে বন্দুক ট্রান্সফার করেছে। বললাম, তেজস কেটে ফেলি।
রাতে খুঁজেপেতে চারবাগের মিলন রেস্টোর্যান্টে বিরিয়ানি খেতে গেলাম। লখনৌয়ের ট্র্যাফিক, ভারতবর্ষের বাকি সব শহরের ট্র্যাফিকের মতো। পাঁচ পারসেন্ট ফুরফুরে, পঁচানব্বই পারসেন্ট নরক। লখনৌয়ের মানুষও ভারতবর্ষের বাকি শহরের মানুষের মতো। পাঁচ পারসেন্ট উদার, পঁচানব্বই পারসেন্ট নিজের সুবিধে ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। রাত ন'টার চারবাগ, বীরভোগ্যা বসুন্ধরা। সিগন্যালগুলো পুজোর লাইটিং-এ পর্যবসিত হয়েছে, বাস অটো টেম্পো রিকশা ঠেলা পথচারী - কেউ যে কী করে কোথাও পৌঁছচ্ছে রহস্য। অটোভাইসাব এক কিলোমিটার রাস্তা বাকি থাকতে বলে চলেছেন ডেস্টিনেশন তো ইয়েহিঁ পে দিখা রহা হ্যায়, যদিও ওঁর ম্যাপে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ডেস্টিনেশন এখনও এক কিলোমিটার, সেটা পয়েন্ট আউট করলে বলছেন ম্যাপ গলত দিখাতা হ্যায়।
নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করছি দিনভর পরিশ্রমের শেষে ভাইসাবের জ্যামে না ঢোকার ইচ্ছেটা স্বাভাবিক। আমি নিজে কোনও শ্রম করি না, শ্রমের মর্যাদাহানি যেন না করে ফেলি। কিন্তু এগুলো ভাবতেই সোজা, ভাইসাবের সঙ্গে অ্যাকচুয়াল নেগোশিয়েশনে নামলে সব ভুলে ঝগড়া করে ফেলব। তাই শুধু শরীরটাকে অটোর ভেতর রেখে মনটাকে হাওয়ায় ছেড়ে দিয়েছি। অর্চিষ্মান ইস্পাতস্নায়ু ও বরফমগজ নিয়ে ভাইসাবকে নিয়ে চারবাগ নেভিগেট করাচ্ছে।
জানতাম অর্চিষ্মান জিতবে, জিতল। মিলন রেস্টোর্যান্টের দরজায় নামিয়ে দিয়ে ভাইসাব অন্তর্হিত হলেন। সরু দোকানের ভেতরে গিয়ে বসে বিরিয়ানি অর্ডার দিলাম। অর্চিষ্মান মাটন, আমি ভেজ। দাদা বললেন, মাটন বিরিয়ানি শেষ।
লখনৌয়ের দোকানে, তাও আবার টপ গুগল রেটিং পাওয়া, মাটন বিরিয়ানি শেষ হয়ে যায়? আক্ষরিক হাঁ করেছিলাম। অর্চিষ্মান বলল, আহা পজিটিভটা দেখো, তার মানে হাইপটা সত্যি। শেষে আমরা দুজনেই ভেজ বিরিয়ানি অর্ডার দিলাম। অর্চিষ্মানের জন্য মনখারাপ হল। অর্চিষ্মান ভালোমন্দ কিছুই বলল না, আমার খুবই ভালো লাগল। কী সুগন্ধ। কী ঝাড়াঝাপটা। কী মোলায়েম। একটাকে ভালো বলতে গেলে অন্যটাকে খারাপ বলতে হবে তেমন কোনও কথা নেই, তবু অন্যান্য বিরিয়ানির সঙ্গে তুলনা এসেই যায়। আওয়ধি বিরিয়ানির এই সুখী পায়রা চরিত্রটা আমার পছন্দের। কলকাতা বিরিয়ানিতে এই লেভেলের সুখ নেই, কিন্তু একটা বিবাগী সুর আছে। হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি একেবারে ইউটিলিটারিয়ান, পেটভরানো মাংসভাত। মানে আমার স্মৃতি যা বলছে।
একজন ছেলে, একা অর্ডার নিচ্ছেন, পরিবেশন করছেন, বিল বানাচ্ছেন, উদ্বৃত্ত খাবার প্যাক করছেন। স্বাভাবিকভাবেই চাওয়ার পরেও জল দেওয়ার কথা মনে রাখতে পারেননি, সুইট আর সল্টি লাইম সোডাতে গুলিয়েছেন। বিল মিটিয়ে বেরোলাম। চারবাগ সামান্য হলেও শান্ত হওয়ার দিকে কি? অটো করে হোটেলের দিকে যাচ্ছি, কিন্তু হোটেলে না। হোটেল থেকে খুব দূরেও না। হজরতগঞ্জের নওলকিশোর রোডে 'রাম আসরে সুইটস অ্যান্ড স্ন্যাক্স'। রাম আসরে রাম আশ্রয় হওয়ার চান্স আছে কিন্তু খুব জোর গলায় সেটা দাবি করতে পারছি না। দিল্লির রামজস কলেজের নামের সঙ্গে রামের যশের যে কোনও সম্পর্ক নেই অনেক বড় বয়সে জেনেছি। গুড়গাঁও কোনওমতেই গুরুগ্রামের তদ্ভব ভার্শান নয়।
রাম আসরে-তে মালাই পান পাওয়া যায়। পান জিনিসটা আমার ভেতর কোনও অনুভূতির জন্ম দেয় না (অ্যাকচুয়ালি দেয়, স্লাইটলি নেগেটিভ, ছোট থেকেই দিত, কিন্তু অসুবিধেটা এক্স্যাক্টলি কী চিনতে পারিনি কোনওদিন। জুনিয়র সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের একটা লেখা পড়ার পর চিনেছি। পান খেলে লোককে বাড়াবাড়ি রকম সুখী দেখতে লাগে, সেটাতেই আমার গা শিরশির করে।) অর্চিষ্মানের ভেতর উত্তরাধিকার সূত্রে ওই পান চিবোতে চিবোতে, ধুতির কোঁচা সামলে বাগবাজারের মোড়ে টানা রিকশা থেকে নামার ব্যাপারটা আছে। পান দেখলে নিজেকে সামলাতে পারে না। সে রেগুলার পান হোক বা রাম আসরের মালাই পান বা মালাই গিলোরি। পানের পাতাটা হচ্ছে সরের পুরু স্তর। সুপুরি খয়ের চুন জর্দার বদলে পাক দেওয়া মাওয়া, পেস্তা, জাফরানের পুর। সে পুর ভরে সর তিনকোণা ভাঁজ করে শালপাতায় কাঠের চামচ দিয়ে খেতে হয়।
বিরাট দোকান, টিউবের আলো ধপধপে মার্বেলে ঠিকরোচ্ছে, কেজি দর লেখা বোর্ড গোঁজা ঘি জবজবে বাদাম ঠাসা মিষ্টির থাক। এক কোণায় চাট, সামোসা ইত্যাদির স্টেশন। অর্চিষ্মান মিষ্টির কাউন্টারে মালাই পানের খোঁজ করল, ভাইসাব ঘাড় নাড়লেন। খতম হো গয়া।
দেজা ভু। ঠিক এই দৃশ্যটা আমাদের সঙ্গে আগে ঘটেছে। মনে পড়ে গেছে। আগের বারও অর্চিষ্মান দিল্লি ফুড ওয়াকের ভিডিও দেখে মালাই গিলোরির পারসিউটে রাম আসরে-তে এসেছিল। সেদিনও রাত হয়ে গেছিল, দোকান ফাঁকা ফাঁকা, মালাই পান সেদিনও ফুরিয়ে গিয়েছিল। অর্চিষ্মান যথারীতি ভুলে গেছে, আমি ভুলিনি। রিজেকশন আমি সাধারণতঃ ভুলি না, ভুললে এই কাণ্ড হয়, আবার রিজেকটেড হতে হয়।
সন্ধের অটো রাইড, চারবাগের কেওস, অর্চিষ্মানের ব্যর্থ ডিনারের পর রাম আসরের রিজেকশনে প্রসন্নতার শেষ বিন্দুটুকু অন্তর্হিত হল। আর কোনও দিন রাম আসরে-তে তো আসবই না, আমার হাতে থাকলে লখনৌও এই শেষ। গোটা বেড়ানোটা মিনিংলেস। হুট করে বেরোনোর একটা মজা আছে, কিন্তু আটঘাট বেঁধে বেরোলেই কি বেটার হত? ঘুরে ঘুরে দেখা দ্রষ্টব্য আবার দেখার মানে হয় না ঠিকই কিন্তু স্রেফ একটা দুপুর কফি শপে বসার জন্য এত টাকা খরচ করে দিল্লি ছেড়ে আসা? কাল ভোরে রেসিডেন্সি দেখা হবে না সেটা তো বিরক্তিকরই, কিন্তু কাল বিকেলে ট্রেনে ওঠার আগে পর্যন্ত রোস্টারির জানালা দিয়ে আসা রোদে সারা দুপুর পিঠ পেতে বসে থাকা যাবে না-টায় আরও ফ্রাস্ট্রেটেড লাগছে।
হাত বাড়িয়ে কাঁধ জড়াল অর্চিষ্মান। ম্যাটার করে না, কুন্তলা। দুপুরে দেখলে তো।
দপ করে উঠল। সফেদ চাদর, গাঁদাফুলের উজ্জ্বল ঢিপি।
সেই। কীসের বিরিয়ানি, কীসের মালাই পান, কীসের কফি শপ। মনে পড়ে গেল। কোনটা অ্যাডিশনাল, কোনটা কমপালসরি।
ঝাঁপ ফেলা লখনৌয়ের নির্জন রাজপথ ধরে হেঁটে চললাম। মোড়ে টিমটিম করছে পানের কিওস্ক। মালাই হল না, নর্ম্যাল মিষ্টি পানই হোক। অর্চিষ্মান একটা কিনে মুখে পুরল। দশ মিনিট হেঁটে ডানদিকে বেঁকে সপরু মার্গ। খাঁখাঁ রিসেপশনে একজন কর্মী মোবাইল দেখছেন। চেক আউট সেরে নিলাম। কাল শেষরাতে বেরোব। একে অপরকে মনে করালাম, শোওয়ার আগে উবার শেডিউল করে রাখা বুদ্ধিমানের হবে।
(শেষ)
এইযে হালকা করে একটু থ্রিলার টাইপ ছন্দ অদল - বদল, বেশ লাগলো।
ReplyDeleteব্যাপারটা হচ্ছে,
লখনওয়ের লেখায় আপনার কীবোর্ডের নবাবী বেরিয়ে পড়ে। লেখার মেজাজই আলাদা।
আগের বারেরটা যদি বড় মিঞা হয়, এটাও মিনি মিঞা হয়েছে।
আরে থ্যাংক ইউ, বৈজয়ন্তী। আপনার মন্তব্য পড়ে একটা গান মনে পড়ে গেছে, মাথা থেকে বেরোচ্ছে না। গানটিতে লিপ দিয়েছেন বাংলা সিনেমার বিখ্যাততম হিরো, গানটি নিজেও বিখ্যাত এবং আমার ঘোর অপছন্দের।
Deleteনেত রামের কচুরি খেতে খেতে এই মেজাজের কথাই হচ্ছিল। বিরিয়ানির জায়গাটা লেখার সময় মাথা ওই দিকেই চলছিল যদিও অল্পে সেরেছি। প্রতিটি মানুষ, শহর, কুইজিনের স্বতন্ত্র মেজাজ আছে। নেত রামের কচুরি খেতে খেতে আমরা দিল্লির পাঞ্জাবী রেস্টোর্যান্টের খাবারের (স্যাডলি যে খাবারগুলো "ইন্ডিয়ান" বলে বিশ্বে পরিচিত হয়েছে) মেজাজের নিন্দে করছিলাম। ইউ পি-র খাবারের বাহার প্রচুর - মুকুটে পালক, গলায় সাতলহরী মুক্তোর হার - এদিকে "মোহতর্মা" ডেকে হাফ বাও করে দাঁড়ালেই বেরিয়ে পড়বেন একজন নিরীহ, মিষ্টি কাকু বা কাকিমা। লখনৌয়ের লোকজনের ব্যবহার দেখলেও বোঝা যায়। দাপটের থেকে সৌজন্যের দর বেশি। দিল্লির লোকজনদের ঘাবড়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
"ম্যাটার করে না, কুন্তলা। দুপুরে দেখলে তো।" <3
ReplyDelete😵😵😵
Deleteতোমার লখনৌ যাওয়া আর সেখানে খাওয়া এই কম্বিনেশন সবসময় হিট । আমি আগের বারের লেখাটা মাঝে মাঝে পড়ি এখনো।
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, ঊর্মি। লখনৌ জায়গাটাই চমৎকার।
Delete'হেউ মোড' থেকে ' অমল মহিমা' মোমেন্টে ট্র্যানজিশন হয় একমাত্র অবান্তর প্রলাপে এলে। গোটা লেখা তদুপরি এক একটা মুহূর্ত আমাকে বদলে দেয়। খুব লিখতে ইচ্ছে হয় তখন, হয়তো হয়ে ওঠে না তৎক্ষণাৎ কিন্তু মুহূর্তটা দীর্ঘক্ষণ সঙ্গে থেকে যায়- কুন্তলা আর অর্চিষ্মানের ঐ বিভ্রম বুদবুদের মতো- কেউ পজ বাটন টিপে দিয়েছে আর আমি আর আমার না হয়ে ওঠা লেখা মুখোমুখি বসে রয়েছি। এটা বার বার হয়, এই ব্লগে এলে। লেখার এক একটা লাইন, এক একটা মুহূর্ত একটা বাটন প্রেস করে দেয় কোথাও আর ঐ বুদবুদ তৈরি হয়ে যায়। গত পুজোর লেখার প্রতিমা বিসর্জনের মুহূর্তটা যেমন বা এই লেখায় "একটা ট্রাকের ছাদে খাটে ধপধপে চাদরের ওপর গাঁদাফুলের উজ্জ্বল ঢিপি"র মুহূর্তটা। যার আগে পরে অনেক কথা, অনেক হই হই, কিন্তু জাস্ট ঐখানটায় অদৃশ্য বোতামে চাপ পড়ে গেল।
ReplyDeleteএকটু দেরি করেই প্রতিক্রিয়া লিখলাম, আসলে মুহূর্তটা জিইয়ে রাখলাম কিছুক্ষণ।
আরো যেটা বলার, হর্ষ, বিষাদ, নির্লিপ্তি, 'হেউ' এমন আশ্চর্য স্বাভাবিকভাবে পাশাপাশি থাকে যেন মনের ভিতরে ঢুকে পড়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটছি আর দুপাশে ঘর দোর দোকান ফুলগাছের মতো অনুভূতিরা সব সার দিয়ে দাঁড়িয়ে।
ReplyDeleteএই যেমন চুলের ধরণ ধারণ থেকে কুমড়োর টেক্সচারে যেতে যেতে চাটনির লাইনটা এসে গেল, যেন ঝকঝকের রোদের ওপর দিয়ে একটা মেঘের ভেলা জাস্ট ভেসে বেরিয়ে গেল, পাঠক চকিতে সানগ্লাস খুলে নিয়ে আবার পরে নিলেন।
আমিও দেরি করেই উত্তর দিচ্ছি, কারণটা আর বলছি না। কমেন্টগুলো লেখার থেকে বেটার হয়েছে, কিন্তু সে অন্য প্রসঙ্গ।
Deleteভালো থাকবেন, ইন্দ্রাণী। কথা হবে।
কচুরিতে খুব লোভ দিলাম, vegetable বিরিয়ানি এত ভালো হয় জানতামনা | সাইটসিইং বা কচুরি খেতে কোনো উপলক্ষেই লখনৌ যাওয়া হবে বলে মনে হয়না কখনো | তবে এত ভালো বর্ণনা পড়লে না যাবার দুঃখ থাকা উচিত না| আগের লেখা আর এবারেরটা দুটোই ভীষণ ভাল|
ReplyDeleteভেজিটেবল বিরিয়ানি যদি লাগে তাহলে নিরামিষাশীদেরই ভালো লাগবে, অমিতা। রেগুলার বিরিয়ানি খাওয়া লোকদের ভালো লাগবে না।
Delete