বর্ণনামূলক
ইদানীং সকালে উঠে রোজ যে অনুভূতিটা হয় সেটা হচ্ছে জলাতংক। মাসে মাসে গাঁটের
কড়ি খরচা করে কেনা মহার্ঘ জল, কল খুললেই ঝরঝর বেগে পড়বে, কিন্তু তার তলায়
পাঁচমিনিট হাত রাখলে একটাদুটো আঙুল যে খসে পড়ে যাবে না এমন কথা বিশ্বাস করা শক্ত।
কী ঠাণ্ডা, কী ঠাণ্ডা। তবু অবিশ্বাস্য ঘটনাটাই রোজ রোজ ঘটে। ‘শরীরের নাম মহাশয়/ যা
সওয়াবে তাই সয়’ কথাটা সাধে লেখেনি শাস্ত্রে। প্রতিদিন ওই জলেই দাঁত মেজে, চায়ের
কাপ ধুয়ে, স্নানপরবর্তী জামাকাপড় কেচে যখন বারান্দায় মেলতে আসি, দেখি বেড়ালটা তখনও
আরাম করে ঘুমোচ্ছে।
বেড়ালটা আমরা ফাউ পেয়েছি বারান্দার সঙ্গে। আগের বছর ডিসেম্বর মাসে অফিসফেরতা
দু’জনে যখন বাড়িটা দেখতে এসেছিলাম, তখন ঠাণ্ডা অন্ধকার বারান্দার কোণাঘুঁজি
খুঁটিয়ে দেখার আর উৎসাহ হয়নি। হলে নির্ঘাত বেড়ালবাবাজির সঙ্গে দেখা হত। হয়নি একদিক
থেকে ভালোই হয়েছে, জীবনে সারপ্রাইজ আরও একটা বেড়েছে। আমার আর অর্চিষ্মানের অনেক
মিলের একটা মিল হল, আমরা কেউই পশুপ্রেমী নই। বেড়াল দেখে আমাদের তাই তাড়ানোর কথাটাই
প্রথম মাথায় এসেছিল। বারদুয়েক ‘হ্যাট্ হ্যাট্’ বলে তাড়ানোর চেষ্টা করতেই তিনি
পিঠ ধনুকের মতো বাঁকিয়ে, ল্যাজ ফুলিয়ে, গলার ভেতর থেকে এমন ফ্যাঁস ফ্যাঁস আওয়াজ
বার করতে লাগলেন যে আমরা লাফ মেরে ঘরে ঢুকে দরজায় ছিটকিনি তুলে দিলাম।
থাকতে চাইছে যখন থাক। সাক্ষাৎ মা ষষ্ঠীর জীব বলে কথা।
সেই থেকে সে বেড়াল আছে। একে অপরকে না ঘাঁটানোর অলিখিত চুক্তিপত্র সই করেছি দু’পক্ষই।
আমরাও হ্যাট্ হ্যাট্ বলব না, উনিও ফ্যাঁসফোঁস করবেন না।
বেড়াল না-তাড়িয়ে ঘরে ফিরে এসে জামাকাপড় পরি, দরজায় চাবি ঘুরিয়ে বেরোই।
সর্বাঙ্গ ঢাকা, শুধু মুখে যে হাওয়াটুকু লাগে তাতেই প্রাণ বেরোনোর জোগাড় হয়। বাবা
খুব খুশি হয়ে খবর দিয়েছেন, এ বছরও নাকি দিল্লির শীত কোন্ একটা রেকর্ড ভেঙেছে। গত
সতেরো বছরে নাকি এমন ঠাণ্ডা আর পড়েনি। গত বছর অবশ্য চল্লিশ বছরের রেকর্ড চূর্ণ
হয়েছিল। সে তুলনায় পারফরম্যানস্ খারাপই বলতে হবে।
এরপর অটো, অটোর পর মেট্রো, মেট্রো থেকে নেমে মিনিট দশের এগারো নম্বর চড়ন।
এগারো নম্বর কাকে বলে জানেন তো? দাঁড়িয়ে থাকলে আমাদের দুটো পা ইলেভেন-এর মতো দেখতে
লাগে, তাই পায়ে হেঁটে কোথাও যেতে গেলে বলা হয় এগারো নম্বরে চেপে যাচ্ছি। এগারো
নম্বর আমার প্রিয় বাহন। ট্র্যাফিক জ্যাম কেটে অনায়াসে বেরোতে পারে, স্টার্ট নেয়
এবং ব্রেক কষে এমন নিঃশব্দ মসৃণতায়---কোনও বিএমডবলিউ-র ঠাকুরদার সাধ্য নেই এর
সঙ্গে পাঙ্গা নেওয়ার। সবথেকে বড় কথা, সারারাস্তা ধারাবাহিক এবং অপটিমাম গতি মেনটেন
করে, যাতে চারপাশের কিছু দেখা মিস না হয়ে যায়।
কুয়াশা ততক্ষণে মাটি ছেড়ে উঠে গিয়েছে সিগন্যাল পোস্টের মাথায়। আমার পাঁচফুটিয়া
দৃষ্টি লেজার-রশ্মির মতো এদিকওদিক ছোটে। ঝোপঝাড়ের মধ্যে ধিকিধিকি জ্বলা ইঁটের উনুন
ধিকিধিকি জ্বলে, তার পাশে গোল হয়ে বসে থাকে ছেঁড়া কম্বলমোড়া ভিখিরি আর কুকুরছানার
দল। ভিখিরির হাতে প্লাস্টিকের কাপে চা আর হাতে লেড়ো বিস্কুট। কুকুরছানার সবটুকু
মনোযোগ এবং ঘনঘন ল্যাজ-আন্দোলন সেই বিস্কুটের প্রতি ধায়। ভিক্ষাজীবী মানুষ ও
সারমেয়দের পারস্পরিক ভালোবাসার রিগ্রেশন, যে কোনও পিয়ার-রিভিউড্ জার্নালোপযোগী
পাবলিকেশনের বিষয়বস্তু হতে পারে।
বাকি দিনটুকু নিজস্ব ছন্দে কেটে যায়। আলাদা করে বলার মতো কিছু ঘটে না। দুপুরবেলা
পোস্ট-মধ্যাহ্নভোজ ওয়াকে বেরিয়ে ঠ্যালাগাড়িবোঝাই পেয়ারা থেকে বেছেবুছে, টিপেটুপে
একটা পেয়ারা কিনে খেতে খেতে, রোদ সেঁকতে সেঁকতে অফিসে ফিরি, সেইটা ছাড়া।
সারাদিনের একঘেয়ে ছন্দটা ভাঙব বলেই রোজ সন্ধ্যেবেলা আমরা একটা খেলা খেলি।
কতরকম ভাবে আমাদের বাড়ি পৌঁছনো যায় সেই খেলা। ভীষণ ঝাল ঝালমুড়ি ‘হুস্হাস্’ করে
চিবোতেচিবোতে হঠাৎ বাঁক ঘুরে অচেনা গলিতে ঢুকে পড়ি। এইটা কোথায় গেছে দেখা যাক চলো।
পুঙ্খানুপুঙ্খ প্ল্যান করে বানানো শহরের গলি, জ্যামিতিক নির্ভুলতায় একটা আরেকটার
ঘাড়ে গিয়ে ওঠে। কোনওটা আমাদের বাড়ির পেছনদিকে গিয়ে শেষ হয়, কোনওটা সামনেদিকে,
কোনওটা তেরিয়া ভঙ্গিতে ছুটে গিয়ে সোজা গোঁত্তা মারে পাশের বাড়ির দেওয়ালে। যেটা
ধরেই যাও না কেন, বাড়ি পৌঁছবে। সকালে যে বাড়িটা ছেড়ে বেরিয়েছিলে, সেই বেড়াল-বারান্দা
বাড়িটায়। বারান্দার ফোল্ডিং আলনায় ঝুলন্ত আকাশি তোয়ালেওয়ালা বাড়িটায়। এখানে কোনও
সারপ্রাইজ নেই। পথ হারানোর ভয়ও নেই অবশ্য। দেরি হতে পারে, হেঁটে হেঁটে পা ব্যথা
হতে পারে, কিন্তু ব্যথার শেষে বাড়ির উষ্ণ কোমল বিছানা অপেক্ষা করে আছে, সে নিয়েও
কোনও দ্বিধা নেই।
দেখতে চাইলে এই গোটা ব্যাপারটার মধ্যে অনেক গভীর সিম্বলের দেখা পাওয়া যেত হয়তো,
কিন্তু সাতপাঁচ ভেবে আমি সেসব কিছু না দেখাই সাব্যস্ত করলাম।
Apni পশুপ্রেমী non jene bejay mormahoto holam... :(
ReplyDeleteতাই সৌমেশ? আমার তো ধারণা আমাকে দেখেই বোঝা যায় যে আমি কুকুরবেড়াল দেখলে অন্যদিকে দৌড়ই।
Delete'পশুপ্রেমী ' nao shune ami abar jar pornai khusi. Tomar chokh die (obossoi lekha die) Delhi r shiter sokal ......darun !!!
ReplyDeleteপশু-উদাসীনতায় হাই ফাইভ ইচ্ছাডানা।
Deleteকি কান্ড! আপনিও ওই খেলাটা খেলেন? আমি ওটা স্কুলে থাকতে আর কলেজে থাকতে খুব খেলেছি - রোজ একটা নতুন রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরা। তারপর নেওয়ার্কে এসে ওসব ইয়ার্কি ঘুচে গেছে। নতুন রাস্তায় নতুন নতুন বিপদ থাকে তো, তাই।
ReplyDeleteখুব ভালো লাগল আপনার লেখা পড়ে। আমার ছোটবেলায় এলাহাবাদের শীতে সক্কাল সক্কাল উঠে ওই জলাতঙ্ক পেরিয়ে কুয়াশা মোড়া রাস্তা দিয়ে ইস্কুল যাওয়ার কথা মনে পড়ে গেল। অন্য সময়ে যতই হাসাহাসি করি, ওই একটা সময়ে মনে হত বাঁদুরে টুপির মতন ভালো জিনিস পৃথিবীতে আজ অবধি আর একটা আবিষ্কার হয়নি।
বাঁদুরে টুপি যুগ যুগ জিও। হ্যাঁ, আপনাদের নেওয়ার্কের যা সব গপ্প শুনেছি, তাতে বেশি অ্যাডভেঞ্চার না করাই ভালো।
Deletedarun laglo pore..last lineta asadharan ...ekhane ville parle bole akta jaygay pg thaktam 1 bachar,takhan roj rate kono dokane khawar por ami ar sayak besh kicchukkhan erakam natun rastay kichukkhan hantbar por je jar pg te firtam...besh majai lagto :)
ReplyDeleteহাঁটাহাঁটি খুব ভালো ব্যাপার তিন্নি। রাতে খাওয়ার পর তো বিশেষ করে।
DeleteEki. Amar kukur, beral, bnador, pnyacha, haati, ghora...sob poshu bhalo lagey. Ekdin tomar bari giye beral take ador kore ashboo khon. :D
ReplyDeleteAmay roj sokale uthe 7tar modhye yoga class korte berote hoy. Kuasha makha rastay khude khude bachchara lal neel tupi ar gorom jama pore ishkooler buser jonyo opekkha korey. Amar DAROON lagey dekhte. Dillir sheeter kintu ekta byapar achhe, boltei hobe.
পশুপ্রেমে লো ফাইভ দিতেই হচ্ছে বিম্ববতী। স্যাড। তুমি এই ঠাণ্ডায় ইয়োগা করতে যাও! প্রতিভা তো! আমি রোজ ভাবি বাড়িতেই করব, কিন্তু ভাবাই সার হয়। স্কুলের বাচ্চা দেখতে আমারও দারুণ লাগে। বিশেষ করে যে সব বাচ্চা খুব গম্ভীর হয়, তাদের।
Deleteআমিও বেজায় খুশি তুই পশুপ্রেমী নোস্ বলে। আমার পশুপ্রেম প্লেটে সীমাবদ্ধ থাকে।
ReplyDeleteআমার পশুপ্রেম প্লেটে সীমাবদ্ধ থাকে - eta daruuun bolechen Abhishek...:)
Deleteযাক, কেউ খুশি হয়েছে।
Deleteei bivinno rasta diye bari fera baparta amar o daruuun romantic mone hoy. Nije koreo dekhechi khub moja r. Delhi r thanda chutiye upovog koro, Kolkatay to thanda lukochuri khelche. Boimelay tomar sathe dekha hobe ei ashay royechi.
ReplyDeleteহ্যাঁ হ্যাঁ, দেখা হলে দারুণ মজা হবে রাখী। কলকাতার ঠাণ্ডাও খুব ভালো তো, সোয়েটারও পরা হল, আবার বেশি কষ্টও হল না।
Deleteবেশ মজাদার লেখা...আপনার লেখা যেমন হয় আর কি! :)
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ অরিজিৎ।
Delete