Posts

Showing posts from April, 2017

সুবিধে অসুবিধে

সাধারণত সকাল ছ’টা নাগাদ জানালার পর্দার ছায়া আমার চেয়ারের পেছনে লম্বা হয়ে পড়ে। কাল পড়ল না। সাধারণত ছ’টা নাগাদ আমাদের দক্ষিণের জানালাওয়ালা বাথরুম আলোয় ভেসে যায়, কাল গেল না। আমি বারান্দায় বেরোলাম তদন্ত করতে। দেখি রোদ তো নেইই, তার বদলে শনশনে হাওয়া। সারা পাড়া জুড়ে গত ক’দিন ধরেই একটাদুটো সাদা সাদা রোঁয়ার বল উড়ে বেড়াচ্ছিল, আজ তারা দলে দলে চলেছে গলি দিয়ে বাঁদিক থেকে ডানদিক, ডানদিক থেকে বাঁদিক। গলির মুখটায় একজন সিকিউরিটি দাদা সারা রাত বসে থাকেন, ছ’টায় তাঁর ছুটি। অন্যদিন পাঁচটা পঞ্চান্নতে তিনি টিফিনবাক্স ব্যাগে পুরে, সাইকেলে চড়ে, এক পা প্যাডেলে রেখে রেডি থাকেন, আজ চেয়ারের পিঠে হেলান দিয়ে, পা জোড়া সামনের একটা ভাঙাচোরা মোড়ায় তুলে মুখ হাঁ করে ঘুমোচ্ছেন।  এদিকে অর্চিষ্মানের ঘুম ভেঙে গেছে। চা নিয়ে বসে আমরা সাদা বলের মিছিল দেখলাম। হাওয়ার বেগ ক্রমে ঊর্ধ্বগামী, বাড়িওয়ালার সজনে গাছের নরম কাণ্ড, জমির এক হাত ওপর থেকে দুলতে শুরু করেছে। কচি সজনেগুলো সরু ডাল ধরে ঝুলে আছে, প্রাণভয়ে না মহানন্দে, এক্সপ্রেশন দেখে বোঝার উপায় নেই। মাঝে মাঝে গাছটার অস্তিত্ব ভুলে গেলে পর্দার  ওপাশে দুলন্ত ডালপালা দেখে ভয়

পুরোনো ফ্রেম

কাল বেলা এগারোটা নাগাদ আন্টিজির দোকানের দিকে হাঁটছিলাম। রোজই যে রকম হাঁটি। কানে ফোন লাগানো ছিল। রোজই যে রকম থাকে। ফোনের ওপারে হয় দুই মায়ের একজন, নয় তিন্নি, নয় অর্চিষ্মান ছিল। রোজই যেমন থাকে। এমনিতে ওই সময় ফোনের ওপাশে এই চারজনের মধ্যে কে ছিল আমার পক্ষে মনে করা বলা অসম্ভব, কিন্তু কাল কে ছিল বলতে পারব।  অর্চিষ্মান। কারণ কালকের কথোপকথনটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। অথচ মনে থাকার কথা নয়। কারণ রোজই আমাদের কথোপকথন একটা গত ধরে চলে।   “কী চলছে? লাইফে ইন্টারেস্টিং কিছু ঘটল?  -কিছু না। তোমার? -আমারও না। জঘন্য।  -সিরিয়াসলি। ওকে টাটা। -ওকে টাটা।” কালকেও কথাবার্তা এই গতেই চলছিল। কিন্তু  "সিরিয়াসলি" আর "ওকে টাটা" বলার মাঝখানের মুহূর্তে আমি একটা দৃশ্য দেখলাম যা আমাদের কথোপকথনের মোড় ঘুরিয়ে দিল।  আমি দেখলাম সামনে চারপাঁচটা ছোট ছোট জটলা। অল্পবয়সী ছেলেমেয়ের।  আপনি বলবেন, এতে মোড় ঘোরানোর কী আছে? অল্পবয়সীদের স্বভাবই জটলা করা।  ঠিক। আমার বাবামায়েরা করতেন, ঠাকুমাদাদুরা করতেন (যদিও আমার ধারণা তাঁদের আমলের জটলাগুলো ওনলি মেল কিংবা ওনলি ফিমেল হত), আমরা করতাম, আ

এ মাসের বই/ এপ্রিল ২০১৭/ ১

Image
We/Yevgeny Zamyatin উৎস গুগল ইমেজেস জর্জ অরওয়েলের ‘নাইনটিন এইটি ফোর’ যাঁরা পড়েছেন আর Yevgeny Zamyatin -এর ‘উই’ যাঁরা পড়েননি, খুব সহজেই তাঁদের সঙ্গে দ্বিতীয় বইটির পরিচয় করানো যায়। দুটি বইয়ের চরিত্র, ঘটনাবলী, ক্লাইম্যাক্স অবিকল এক।  Yevgeny Zamyatin -এর ‘উই’ লেখা হয়েছিল অরওয়েলের নাইনটিন এইটি ফোর লেখা হওয়ার পঁচিশ বছর আগে। হয়তো দৈববলে দুই লেখকের মগজে একই প্লট, একই চরিত্রেরা হাজির হয়েছিল? হয়তো জর্জ অরওয়েল ‘উই’-এর কথা জানতেনই না? এই সম্ভাবনা শূন্য, কারণ উনিশশো ছেচল্লিশে, নাইনটিন এইটি ফোর প্রকাশের তিন বছর আগে অরওয়েল ‘উই’ উপন্যাসের একটি সমালোচনা লেখেন “ট্রিবিউন” পত্রিকায়।  ‘উই’ উপন্যাসের ঘটনা ঘটছে ভবিষ্যতের কোনও একটি সময়ে। এক হাজার বছর আগে এক দীর্ঘ সংগ্রামের পৃথিবী অ্যামেরিকার অধীনতা স্বীকার করেছে, এখন গোটা পৃথিবীটাই ওয়ান স্টেট এবং সেই স্টেটটি হল অ্যামেরিকা। উইনস্টন স্মিথ-এর বদলে 'উই'-এ আমাদের বক্তা ডি- ৫০৩। মিনিস্ট্রি অফ ট্রুথ-এ ইতিহাস সংশোধনের বদলে ডি ৫০৩-এর কাজ হল স্পেসশিপ বানানো। ‘ইনটিগ্র্যাল’ নামের মহাকাশযান বানানোর প্রোজেক্টের তিনি চিফ ইঞ্জিনিয়ার। ওয়ান স্

And Then The Murders Began

নিজের বইকে অন্যের বই থেকে ঢের ভালো, ঢের ইন্টারেস্টিং আর ঢের বেশি বিক্রি করতে চান? এই ট্রিকটা কাজে লাগিয়ে দেখতে পারেন।

দাদুর ছবি

সোমবার যখন ছুটি নিতেই হবে তখন অত তাড়াহুড়ো দেখিয়ে, বাড়ির লোকের ঘুম মাটি করে সকালের প্লেন ধরার মানে ছিল না। আরাম করে বাড়ি থেকে খেয়েদেয়ে বিকেলে বেরিয়ে রাতে ফিরলেই হত।   কিন্তু অবান্তরের পাঠকরা জানেন, বাড়িতে আমার বড় জোর বিশ্রাম হতে পারে, আরাম হয় না। তবে আরামই তো একমাত্র উদ্দেশ্য নয়, বাড়ি গেলে আরও অনেক ভালো ভালো জিনিস হয়। দু’পক্ষের মাবাবার সঙ্গে দেখা হয়, পোস্তবাটা, বেগুনপোড়া আর এঁচোড়ের তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়া হয়, বুদ্ধি করে তাক বুঝে যেতে পারলে (যেমন আমরা গেলাম) পয়লা বৈশাখের উপহার মেলে। আর যদি এ সবের কিছুই না হয়, ঠাকুমার সঙ্গে দেখা তো আছেই। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, এখন যতটুকু দেখা হয় ততটুকুই কম।  এত সব কাজের মাঝে একেকটা মুহূর্ত আসে যা নিখাদ আরামের। রবিবার দুপুরে যেমন এসেছিল। কোন একটা চ্যানেলে ‘ব্যোমকেশ পর্ব‘ দিয়েছিল, মামেয়ে দেখলাম বসে বসে। এ ব্যোমকেশ ঘোড়ায় চড়তে পারে, লাঠি খেলতে পারে, আইটেম সঙের সঙ্গে হাতে ফুলের মালা জড়িয়ে চপল চোখে তাকাতে পারে। পরের সিনেমাগুলোয় আরও কী কী পারবে ভাবতেই আমার হৃৎকম্প হচ্ছে। তবে এসব খালি নিন্দে করার জন্য করা, মায়ের পাশে বসে যখন  টিভিতে সিনেমাটা দেখছিলা

A Table of One's Own

স্টিফেন কিং-এর ‘অন রাইটিং’-এ একটা টেবিলের কথা আছে। লন্ডনের এক ঝাঁ চকচকে হোটেলের একটি প্রকাণ্ড রাজকীয় টেবিল। সিঁড়ির মাথায় কিংবা লবিতে কোথায় যেন সেটা রাখা ছিল। এমন কোথাও যা লোকের চোখে পড়বে। (সবটাই স্মৃতি থেকে লিখছি। উঠে গিয়ে বুককেস থেকে বই পেড়ে আনতে পারি। কিন্তু আড়াইশো পাতার বইয়ে কন্ট্রোল এফ ছাড়া “টেবিল” কে খুঁজবে? কাজেই শহর মানুষ ইত্যাদি বিশেষ্য গোলমাল হয়ে যেতে পারে। কিন্তু মূল ভাবটার হবে না, প্রমিস।) কিং-এরও চোখ পড়ল। হোটেলের কর্তৃপক্ষ তাঁকে গর্বিত মুখে জানালেন, এই টেবিলটা একজন লেজেন্ডারি লেখকের। হোটেলবাসের এক রাতে কিং-এর ভয়ানক লেখা পেল, উঠে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কাগজ পেন পাওয়া যাবে? বেয়ারারা দৌড়ে এনে দিল। কিং জিজ্ঞাসা করলেন এই টেবিলে বসে লেখা যাবে? ম্যানেজার দৌড়ে এসে ঘেরাটোপ সরিয়ে জায়গা করে দিল। টেবিলে বসে স্টিফেন কিং ফসফস করে লিখে ফেললেন ষোলো পাতা। লং হ্যান্ড। এমনিতে কিন্তু কিং লং হ্যান্ড লেখেন না। আমি জানি, ওঁর লেখা নিয়ে আরেকটা লেখায় আমি পড়েছি। কিং লং হ্যান্ড লিখতে পছন্দ করেন, কিন্তু মাথা যে বেগে চলে, পেন সে বেগে চলে না, সে এক ভজঘট ব্যাপার হয়। মাথার সঙ্গে পাল্লা দিতে কি-বোর্ড

পাড়াপড়শি

কোথায় থাক-র উত্তরের একটা চেনা প্রত্যুত্তর আছে। সেটা হচ্ছে আমি যেখানে থাকি তার আশেপাশের প্রশ্নকর্তার চেনা কেউ একজন থাকে, তাঁকে আমি চিনি কি না। “আশপাশ”-এর পরিধি জায়গা ভেদে বদলে যায়। নাকতলার আশপাশ ৮বি থেকে টালিগঞ্জ। রিষড়ার ক্ষেত্রে সেটা হয়ে যায় লিলুয়া থেকে তারকেশ্বর।  "ভদ্রেশ্বরে আমার পিসতুতো মামি থাকেন, চেনেন?"   "আচ্ছা, শ্রীরামপুরে মামাতো পিসি?"  কাঁহাতক আর লোককে হতাশ করা যায়। আমি পাড়ার নাম শুনে খানিকক্ষণ কপাল কুঁচকে থাকি, উনিশশো নিরানব্বইয়ে একবার গেছিলাম বটে ওই পাড়ায়। "কী রকম দেখতে বলুন তো আপনার পিসি? রসগোল্লার মতো মুখ, বাতাসার মতো টিপ?"   "বাতাসা টিপ মিলে গেছে, মুখটা খালি রসগোল্লার বদলে লর্ড চমচম। মনে পড়ছে?" আমি সেকেন্ডখানেক সময় নিয়ে চোখ বিস্ফারিত করি, "হ্যাঁ হ্যাঁ, পড়ছে পড়ছে। তিন নম্বর বাসে করে যেতেন আসতেন তো? ওঁকে তো দেখেছি কতবার।"  খুশি হয়ে সামনের লোক চলে যান। আজ রাতে নির্ঘাত পিসির বাড়ি ফোন যাবে। "তোমাদের ওদিকের একজন, রিষড়ায় থাকে, মাশরুমের মতো নাক আর ছাগলের মতো চোখ। চেন নাকি?" একমাত্র সি আর

আদা লজেন্স

মাবাবা গিয়েছিলেন বাদামি বিজাপুর সেকেন্দ্রাবাদ। রুটে কোনও মতেই দিল্লি পড়ে না, তবু ফেরার পথে দিল্লি হয়ে গেলেন। শনিবার ভোরে বেংগালুরু রাজধানী নিজামুদ্দিনে ঢুকল, বাড়ি এসে দুপুরবেলা যাওয়া হল বিহার ভবন। আর বাকি সময় আড্ডা, বিশ্রাম, উপহার…প্রদানের বদলে কেবল আদান। নতুন জামাকাপড়, অফিস যাওয়ার ব্যাগ। সেকেন্দ্রাবাদ ষ্টেশনে আঙুর কেনা হয়েছিল। মিষ্টি বেরোতে নিজেরা না খেয়ে বাকিটুকু প্যাক করে এনেছেন, দিল্লিতে মিষ্টি আঙুর পাওয়ায় যায় না যায়। মায়ের ব্যাগে আর একটা প্যাকেটের ভেতর সাদা সাদা গুঁড়ো গুঁড়ো কী সব। ময়দা। আরেকটা ছোট পলিথিন মোড়া বেকিং পাউডারের বাক্স আর ভ্যানিলার শিশি। আর একটা প্রেশার কুকারের সেপারেটর। একমাত্র মাখন, ডিম, চিনি আর প্রেশার কুকারটা ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়ে এসেছেন মা। ওহ, আর উলের কাঁটা। চল্লিশ মিনিট পর বিঁধিয়ে দেখা হবে কেক হয়েছে কি না। খুব ইচ্ছে ছিল কেকের ছবি তুলে রাখি অবান্তরের জন্য। তারপর মনে হল ওর থেকে সুদর্শন কেক আপনারা সবাই দেখেছেন। রেস্টোর‍্যান্টে দোকানে ফুড ব্লগে ওর থেকে ঢের বেশি দ্রষ্টব্য কেকের নমুনা অহরহ দেখা যায়। যদি কিছু রাখতেই হত তবে সে হল কেকের স্বাদ আর বাবা মা অর্চিষ্মানের

বুবুনের মা

মূল গল্পঃ Why Herbert Killed His Mother লেখকঃ Winifred Holtby ***** বুবুনের মা’কে আমরা প্রথমে বুবুনের মা বলে চিনতাম না। শুধু আমরা না, কেউই চিনত না। আমরা মালবিকা বউদি বলে চিনতাম, বুবুনের দিদিমা দাদাই মিলি বলে চিনতেন, বুবুনের ঠাকুমা ঠাকুরদা, ছোটকা, রাঙাপিসি কেউ বড়বৌমা, কেউ বড়বৌদি ইত্যাদি নামে চিনতেন, বুবুনের বাবা প্রকাশ্যে মালবিকা এবং আড়ালে সোনা বলে চিনতেন, আর স্কুলের বন্ধুরা, যাদের সঙ্গে বুবুনের মা যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেননি, তারা মালবিকা, মালু, মালা ইত্যাদি নামে চিনত।  এ সবই বুবুন হওয়ার আগে।  আমাদের ইদানীং সন্দেহ হয়, একমাত্র বুবুনের মা-ই হয়তো নিজেকে বুবুনের মা বলে চিনতেন, গোড়া থেকেই। অন্য সব নামগুলোর আড়ালে তিনি তাঁর আসল পরিচয়টা লুকিয়ে রেখেছিলেন। না হলে মাতৃসদনের দোতলার জানালার ধারের বেডে বুবুনকে পরিষ্কারটরিশকার করে শুইয়ে রেখে যাওয়ার (বুবুনের মায়ের নির্দেশ ছিল, রক্ত, শ্লেষ্মা মাখামাখি অবস্থায় কেউ যেন বুবুনকে না দেখে) মুহূর্ত থেকে মালবিকা, মিলি, মালা এবং আরও যাবতীয় পরিচয় ঝেড়ে ফেলে, বুবুনের মা নিজেকে ‘বুবুনের মা’ হিসেবে যেভাবে পৃথিবীর সামনে উন্মোচিত করলেন, তা অসম্ভব