দাদুর ছবি



সোমবার যখন ছুটি নিতেই হবে তখন অত তাড়াহুড়ো দেখিয়ে, বাড়ির লোকের ঘুম মাটি করে সকালের প্লেন ধরার মানে ছিল না। আরাম করে বাড়ি থেকে খেয়েদেয়ে বিকেলে বেরিয়ে রাতে ফিরলেই হত।  

কিন্তু অবান্তরের পাঠকরা জানেন, বাড়িতে আমার বড় জোর বিশ্রাম হতে পারে, আরাম হয় না। তবে আরামই তো একমাত্র উদ্দেশ্য নয়, বাড়ি গেলে আরও অনেক ভালো ভালো জিনিস হয়। দু’পক্ষের মাবাবার সঙ্গে দেখা হয়, পোস্তবাটা, বেগুনপোড়া আর এঁচোড়ের তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়া হয়, বুদ্ধি করে তাক বুঝে যেতে পারলে (যেমন আমরা গেলাম) পয়লা বৈশাখের উপহার মেলে। আর যদি এ সবের কিছুই না হয়, ঠাকুমার সঙ্গে দেখা তো আছেই। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, এখন যতটুকু দেখা হয় ততটুকুই কম। 

এত সব কাজের মাঝে একেকটা মুহূর্ত আসে যা নিখাদ আরামের। রবিবার দুপুরে যেমন এসেছিল। কোন একটা চ্যানেলে ‘ব্যোমকেশ পর্ব‘ দিয়েছিল, মামেয়ে দেখলাম বসে বসে। এ ব্যোমকেশ ঘোড়ায় চড়তে পারে, লাঠি খেলতে পারে, আইটেম সঙের সঙ্গে হাতে ফুলের মালা জড়িয়ে চপল চোখে তাকাতে পারে। পরের সিনেমাগুলোয় আরও কী কী পারবে ভাবতেই আমার হৃৎকম্প হচ্ছে।

তবে এসব খালি নিন্দে করার জন্য করা, মায়ের পাশে বসে যখন  টিভিতে সিনেমাটা দেখছিলাম তখন আমার শুধু ভালোই লাগছিল। পর্দা নামিয়ে ঘর ছায়া করা ছিল, মাথার ওপর ফ্যান অল্প বেগে ঘুরছিল, চোখের সামনে বাঙালি গোয়েন্দা বাংলা রহস্য সমাধান করছিল, খারাপ লাগার জায়গাই নেই। 

আরামের ষোলোকলা পূর্ণ করেছিল তেজপুর থেকে বাবার আনা বাঁশের চেয়ারটা। সাড়ে পাঁচ ফুটের নিচে হাইটওলা যে কেউ গোটা শরীরটা নিয়ে চেয়ারের মধ্যে ঢুকে যেতে পারে। এখন ওই চেয়ারটায় বসার জন্য বাড়িতে রীতিমত মিউজিক্যাল চেয়ার খেলা হয়, অথচ আমরা এই চেয়ারের কার্যকারিতা নিয়ে কত সন্দেহই না প্রকাশ করেছিলাম। 

সন্দেহের কারণ সেই দর্শনধারিতা। বা তার অভাব। বেশিরভাগ কাজের জিনিসের মতোই চেয়ারটার চেহারা খুব একটা সুবিধের নয়। যেটা চেয়ারটার সবথেকে বড় গুণ, সেটাই ওটার সবথেকে বড় দোষ। তা হল চেয়ারটার বেঢপত্ব। তেজপুর থেকে চিরদিনের মতো ট্রান্সফার হয়ে চলে আসার সময় বাবা যখন ওই চেয়ার আর সঙ্গে মানানসই একখানা টেবিল নিয়ে হাজির হলেন, মা হতভম্ব হয়ে বলেছিলেন, "এ জিনিস কোথায় রাখব?" বাবা একটুও দমে না গিয়ে সামনের ঘরের দরজা আর তক্তপোশের মাঝখানের জায়গাটা দেখিয়ে বললেন, "কেন এইখানে দিব্যি ফিট করে যাবে।" 

গেলও। দেওয়ালে ঝুলন্ত ঘোর নীলবর্ণ মাকালীর ছবির নিচে। মাঝে মাঝে মাকালীর মাথায় গোঁজা জবাফুল চেয়ারের ওপর খসে পড়ে থাকে, আমরা বসার আগে সে ফুল ওই চেয়ারের ওপর দাঁড়িয়েই মায়ের মাথায় আবার ফিট করে দিই। 

চেয়ারের বিরুদ্ধে শেষ, অক্ষম প্রতিবাদ হিসেবে মা বিড়বিড় করেছিলেন, সামনের ঘরের লুকটা একেবারে খারাপ হয়ে গেল। 

মায়ের সঙ্গে সাধারণত আমি সব বিষয়েই সহমত হই কিন্তু এটাতে না হেসে পারিনি। মা নিজেও হেসেছিলেন অবশ্য। কারণ আমাদের সামনের ঘরের লুক অলরেডি চমৎকার। কোনও বেঢপ চেয়ারের সাধ্য নেই তাকে মাটি করে। একটা তক্তপোষ, দুটো চেয়ার, প্লাস্টিকের তিন থাক টেবিলের ওপর একটা টিভি, অবশেষে ফ্ল্যাট স্ক্রিন হয়েছে এই বছরকয়েক আগে। দেওয়ালে জালি দেওয়া জানালা, গজালে ঝোলানো বেঁটে বুককেস, অসংখ্য তার, অসংখ্য ফোটো, কোনওটার সঙ্গে কোনওটার সাইজের মিল নেই। নীল মাকালীর পাশে গেরুয়া বিবেকানন্দের পাশে হাতে আঁকা রবীন্দ্রনাথ। সাঁতরাগাছি কারখানায় ইঞ্জিনের সামনে সাদাকালো গ্রুপছবি। আমার যুবক ঠাকুরদার পাশে বৃদ্ধ রামঠাকুর। গলায় কণ্ঠি, হাড় বার করা শরীরে সাদা কাপড় জড়ানো, বাবু হয়ে বসে আছেন। বাঁ হাঁটুর নিচ দিয়ে ডান পায়ের পাতা বেরিয়ে আছে। লম্বা গড়নের সঙ্গে মানিয়ে সে পায়ের পাতাও রীতিমত দীর্ঘ। বছরের বিশেষ বিশেষ সময়ে, সম্ভবত রামঠাকুরের জন্মতিথির কাছাকাছি সময়ে ওই পায়ের পাতার দৈর্ঘ্য আরও বাড়ে। ফটোর ভেতরেই। ঠাকুমার বন্ধুবান্ধবরা সকলেই দেখতে পেত। ঠাকুমাও পেতেন। আমি ঠিক শিওর হতে পারছি না বুঝে আমার দিকে এমন অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে তাকাতেন যে আমি নার্ভাসটার্ভাস হয়ে বলতাম, "হ্যাঁ হ্যাঁ, এই তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, ইঞ্চিদুয়েক বেড়েছে।"

এই ছবিটা নিয়ে একটা গল্প আছে। গত সাড়ে সাত বছরে সেটা আপনাদের বলেছি নিশ্চয়, তবু আরেকবার শুনুন। আমাদের এক দূরসম্পর্কের আত্মীয় ছিলেন। দূর মানে রিয়েলি দূর। রাস্তায় তাঁকে দেখলে আমি চিনতে পারব না, তিনিও আমাকে পারবেন না। দু’দিকের ঠাকুরদার বাবারা কেমন যেন কাজিন ছিলেন, পড়শিটড়শিও হতে পারেন। যাই হোক, তিনি তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে এসেছিলেন আমাদের বাড়িতে। সেও অনেকদিন আগে। বাবাকাকার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে তখনও আমার রীতিমত ঘাড় ব্যথা করে। ভদ্রলোকও লম্বাচওড়া ছিলেন এটুকু মনে আছে, বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর ভঙ্গিটাও। তাঁর স্ত্রী এদিকে মেরেকেটে পাঁচ ফুট, পঁয়তাল্লিশ কেজি। ঘোমটাঘেরা মুখে শান্ত ভালোমানুষি মাখামাখি। গাঁকগাঁক করে জেঠু সবার সঙ্গে আলাপ করছিলেন, বাবাকাকার পিঠ চাপড়ে দিচ্ছিলেন। এমন সময় জেঠুর চোখে দেওয়ালের ছবিতে পড়ল। “ওই দেখ আমার কাকা…কেমন সুন্দর চেহারা ছিল দেখেছ?” ভুরু নাচিয়ে জেঠিকে উদ্দেশ্য করে বললেন তিনি। 

জেঠি তৎক্ষণাৎ ঘোমটা ভালো করে টেনে দেওয়ালের দিকে দু’পা এগিয়ে গিয়ে বুকের কাছে দু’হাত জড়ো করে মন দিয়ে নমো করলেন। গদগদ স্বরে বললেন, “আহা, কী সাধকের মতো চেহারা।” 

ঘরশুদ্ধু সবাই ঘাবড়ে গিয়ে চুপ করে রইল, জেঠুই প্রথম ধাতস্থ হয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “উফ, ওটা কাকা কেন হতে যাবে, ওটা রামঠাকুর, কাকা পাশেরটা…”

পরে সবাই খুব হেসেছিল, এখনও হাসে। জেঠির প্রতি কোনওরকম অশ্রদ্ধা থেকে নয়, একেবারেই নির্মল হাসি। হাসির আরও বেশি কারণ হল আমার দাদুর ছবিটা। জোয়ান বয়স, পরিষ্কার কামানো দাড়ি, নিখুঁত ছাঁটা গোঁফ, কুচকুচে কালো একমাথা চুলের সামনেটা সিঙাড়ার মতো উঁচু। ফটোগ্রাফারের নির্দেশেই নিশ্চয়, দাদু সামান্য ডানদিকে বেঁকে দাঁড়িয়ে তেরছা চোখে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছেন। 

মোট কথা, তাঁকে সাধক বলে সন্দেহ কেউ করবে না। আর যারা তাঁকে ফোটোর বাইরে চিনত তারা তো নয়ই। রেলের চাকরি নিয়ে এদেশে আসার আগে দাদু যাত্রাদলে বাঁশি বাজাতেন, ছেলেমেয়ের বাবা হওয়ার পরও সিনেমার পাতা খুঁটিয়ে পড়তেন। দাদু তাঁর চারের মধ্যে তিন ছেলের থেকে প্রায় এক ফুট করে বেঁটে ছিলেন। সে জন্যই বোধহয় মেজাজটাকে তিনি সর্বদাই টঙে বেঁধে রাখতেন। দিনে অন্তত একবার করে সবাইকে স্মরণ করাতেন, এটা তাঁর বাড়ি, তাঁর সংসার। তাঁর সংসার চালানোর সিস্টেম কারও পছন্দ না হলে সদর দরজা খোলাই আছে, বেরিয়ে গিয়ে নিজের সংসার বানিয়ে নিজের সিস্টেমে চালাও।

সেদিন লুচি খাচ্ছি বসে বসে। আমি তক্তপোশে, জামাই বলে মা অর্চিষ্মানকে সেই চেয়ারটায় বসিয়েছেন। তরকারি শেষ, হাফ লুচি বাঁচিয়ে রেখেছি, লাস্টে পায়েস দিয়ে খাব। এমন সময় অর্চিষ্মান বলল, “তোমার দাদুর ছবিটা দেখলে ঘনাদার কথা মনে পড়ে কিন্তু।”

ঘনাদা? আমার দাদু? রাগই হল একটু। মাথাটাথা খারাপ নাকি? অন্ধও দাদুকে ঘনাদার সঙ্গে গোলাবে না। 

অর্চিষ্মান বলল, "আহা, সে হয়তো সামনাসামনি অন্যরকম দেখতে ছিলেন, আমি বলছি এই ছবিটার কথা।" 

তারপর ও ধরে ধরে দেখিয়ে দিল। দাদুর খাড়া নাক, চওড়া কপাল, আর কপালের ওপর কালো চুলের সিঙাড়া। বিশেষ করে ওই সিঙাড়াটা। ঘনাদা ঘনাদা একটা ছাপ আছে বটে। মেনে নিলাম আমি।  

কে জানে হয়তো দাদুর মুখে সাধকের ভাবও থাকতে পারে, আমাদের বাসি চোখে ধরা পড়ে না।


Comments

  1. Darun :) khub bhalo laglo pore !! Jishnur asadharan khamata .. Sasurbarite bose Dadasasur ke Ghonada bola :p :p Ami Rishrate shiggiri jete chai :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. kintu chapal chokher Byomkesh kemon?

      Delete
    2. আমার তো আবীরকে ভালোই লাগে, তিন্নি, কাজেই ভালোই লেগেছে। জিষ্ণু অবশ্য প্রশংসাসূচক ভঙ্গিতেই বলেছিল কাজেই সাহসের বেশি দরকার পড়েনি। রিষড়ার লোকও তোকে শিগগিরি দেখতে চায়। একবার সবাই মিলে যাওয়া যাক।

      Delete
  2. অর্চিষ্মানবাবু তো প্রশংসাই করেছিলেন, বিয়ের বছর চারেক পর থেকে সবাই ভুল বুঝতে শুরু করে। ঘনাদা হওয়া কি মুখের কথা!

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, সেরকমই দেখা যাচ্ছে, দেবাশিস।

      Delete
  3. Nabo borsher onek shubheccha o bhalobasha niyo Kuntala. Aaj shokaley e bhabchi Abantor e kono update neyi, nischoi tomra berate beriyecho. :-)

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, বাড়িতে ঝটিকাসফর সেরে এলাম, শর্মিলা। তোমার নববর্ষ ভালো কেটেছে আশা করি।

      Delete
  4. Barir golpo sobsomoy mon khushi kore daey �� Bratati.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, ব্রততী।

      Delete
  5. Bah khub bhalo ketechhe to tahole noboborsho :). upri paona, ebar lokke bolte parbe tumi "Ghonadar" natni. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেটাই তো মুশকিল, চুপকথা। আমার দাদুকে যারা দেখেছে, তারা অট্টহাস্য করবে। আমার দাদুর মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত কোনও জায়গার ঘনাদার ঘ পর্যন্ত নেই। অর্চিষ্মান যে কী দেখল কে জানে।

      আমার নববর্ষের বিলম্বিত শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা জেনো।

      Delete
  6. Chhobi koi? Dadur... baa Aapnaar Aatoure gharer ba bedhap chair tar... ekta kichhu to diten..


    Khub ananda pelam pore.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, চন্দ্রচূড়।

      Delete
  7. আমার.আরাম কোথায় হয় বলতো? যেখানে অবান্তর পড়তে পারি সেখানেই। তোমার মতো আমার মেয়েটাও বাড়িতে আরাম পায়না বোঝাই যায়, আসতে হয় আসে, কিন্তু নিজের এপার্টমেন্টে ফিরে গেলেই শান্তি পায়। আই টোটালি আন্ডারস্ট্যান্ড। বুদ্ধি করে তাক বুঝে - দারুন! আর ওই চেয়ার এর ছবি দাও। তেজপুরের চেয়ার এর ছবি দেখার আমার একটা হক আছে সেটা তো স্বীকার করো । খুব আরাম হলো পড়ে ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ, অমিতা। আরামকে আমি খুব গুরুত্ব দিই, অবান্তর আপনাকে সে আরাম দিতে পারে জেনে সত্যি ভালো লাগল। চেয়ারের ছবির মুশকিলটা হচ্ছে, এখন তো আমি বাড়িতে নেই, আর মাবাবাকে চেয়ারের ছবি তুলে পাঠাও ব্লগে ছাপব বললে আমার মানসিক সুস্থতা নিয়ে যেটুকু আশা তাঁদের ছিল তাও যাবে। তবে আপনার হকটা আমি মানি, পরের বার গেলে ছবি তুলে এনে দেখাব।

      Delete
  8. Replies
    1. হাহা, থ্যাংক ইউ, ঘনাদা।

      Delete

Post a Comment