পুরোনো ফ্রেম



কাল বেলা এগারোটা নাগাদ আন্টিজির দোকানের দিকে হাঁটছিলাম। রোজই যে রকম হাঁটি। কানে ফোন লাগানো ছিল। রোজই যে রকম থাকে। ফোনের ওপারে হয় দুই মায়ের একজন, নয় তিন্নি, নয় অর্চিষ্মান ছিল। রোজই যেমন থাকে। এমনিতে ওই সময় ফোনের ওপাশে এই চারজনের মধ্যে কে ছিল আমার পক্ষে মনে করা বলা অসম্ভব, কিন্তু কাল কে ছিল বলতে পারব। 

অর্চিষ্মান।

কারণ কালকের কথোপকথনটা আমার স্পষ্ট মনে আছে। অথচ মনে থাকার কথা নয়। কারণ রোজই আমাদের কথোপকথন একটা গত ধরে চলে।  

“কী চলছে? লাইফে ইন্টারেস্টিং কিছু ঘটল? 
-কিছু না। তোমার?
-আমারও না। জঘন্য। 
-সিরিয়াসলি। ওকে টাটা।
-ওকে টাটা।”

কালকেও কথাবার্তা এই গতেই চলছিল। কিন্তু  "সিরিয়াসলি" আর "ওকে টাটা" বলার মাঝখানের মুহূর্তে আমি একটা দৃশ্য দেখলাম যা আমাদের কথোপকথনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। 

আমি দেখলাম সামনে চারপাঁচটা ছোট ছোট জটলা। অল্পবয়সী ছেলেমেয়ের। 

আপনি বলবেন, এতে মোড় ঘোরানোর কী আছে? অল্পবয়সীদের স্বভাবই জটলা করা। 

ঠিক। আমার বাবামায়েরা করতেন, ঠাকুমাদাদুরা করতেন (যদিও আমার ধারণা তাঁদের আমলের জটলাগুলো ওনলি মেল কিংবা ওনলি ফিমেল হত), আমরা করতাম, আজকালকার ছেলেপুলেরাও করছে, এদের ছেলেমেয়ে, নাতিপুতিরাও করবে। 

কারণ ওই বয়সটাই জটলা করার। যৌবন বন্ধু আকর্ষণ করে, বয়স বেড়ে গেলে লোকে বোকা হয়ে যায়, সেই সঙ্গে একাও। তখন আর কেউ তার সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চায় না। তখন খালি একা একা চা খেতে যেতে হয়, আর বাড়ির লোককে ঘণ্টায় ঘণ্টায় ফোন করে চাতকের মতো জানতে চাইতে হয়, ইন্টারেস্টিং কিছু ঘটল কি না। 

জটলা চিরন্তন, কিন্তু দেশকাল ভেদে জটলার চরিত্র, অনুষঙ্গ আলাদা। আমাদের বাবাদের জটলায় রক একটা বড় অনুষঙ্গ ছিল।  আমাদের মফস্বলের জটলায় গুরুত্বপূর্ণ ছিল সাইকেল। কোনও কোনও জটলার হাতে থাকত সিগারেট, কারও হাতে খুরির চা কিংবা ফুচকার শালপাতা, কারও হাতে গাঁজার জয়েন্ট। কোনও কোনও জটলার প্রপস এত সুস্বাদু কিন্তু রোমাঞ্চকর হত না, যেমন ফুলবাগানের গলির জেরক্সের দোকানের সামনে আমাদের জটলা। আমাদের জটলার কপালে জুটত কেবল নোটের তাড়া। 

ইদানীং যে সব জটলাগুলো দেখি সেগুলোর এত করুণ দশা নয়। সব জটলার আশেপাশে প্যাজেরো, হোন্ডা সিটি হয়তো পার্ক করা থাকে না, কিন্তু খুব দুঃখী জটলাতেও স্মার্টফোন থাকে। ইন ফ্যাক্ট, কিছু কিছু জটলা এই ফোন ঘিরেই গড়ে ওঠে। আমি দূর থেকে বুঝিনি যে এই জটলাগুলোও সেই গোত্রের। তারপর দেখলাম প্রতি জটলা থেকে একজনের হাত আকাশের দিকে উঠে আছে, আর সেই হাতে স্মার্ট ফোন, তখন আমার কাছে জটলার চরিত্র স্পষ্ট হয়ে গেল। 

এ হচ্ছে সেলফি জটলা। 

আরেকটু এগোতে আর সন্দেহের অবকাশ রইল না। 

এ সব জটলার চেহারা, অনেক শহরে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের মিছিলের যে চেনা ভাস্কর্য থাকে, সেরকম। মিছিলের অগ্রে নেতার হাতে শুধু পতাকার বদলে ফোন, তার একটু পেছনে বা পাশে সবাই সারিবদ্ধ দাঁড়িয়ে। কারও কারও (মহিলাদের) হাঁটু ভাঙা, এক পায়ের পাতা মাটিতে, অন্য পায়ের আঙুলের ডগা জাস্ট মেঝে ছুঁয়ে আছে, ঠোঁট ছুঁচোলো, চোখে কৃত্রিম বিস্ময়। পুরুষরা যদিও দু’পা মাটিতে রেখেছেন, অনেকেই আঙুল শ্যাম্পু করা চুলের মধ্যে চালিয়ে কপাল চওড়া করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। কবজি থেকে মানতের সুতোর শেষপ্রান্ত দোল খাচ্ছে। 

পর পর এ রকম তিনটে জটলা পেরিয়ে আমি আর হাসি চাপতে পারলাম না। এই যৌবন যে আমার আর ফিরে আসবে না, সেই হিংসেতেই হবে। তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে অকুস্থল পেরিয়ে ঘটনার বিবরণ দিয়ে আমি অর্চিষ্মানকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা, এই ছবিগুলো পরে দেখলে নিজেদের হাসি পাবে না?”

অর্চিষ্মান একটু ভেবে বলল, “অল্প পুরোনো হলে হয়তো হাসি পেলেও পেতে পারে, কিন্তু বেশি পুরোনো হয়ে গেলে আবার ভালো লাগবে।”

কথাটা সত্যি। বাড়িতে গেলে পুরোনো ছবি দেখি, খাটো আঁচল ছোট ছাতা সানগ্লাস মাসিপিসি, বেলবটম বাবা - হাসি পায় না একটুও, বরং বুকের ভেতর কেমন একটা হয়, সাহেবরা যাকে ওয়ার্ম ফাজি ফিলিং বলে ঠিক সে রকম। নাকতলার বাড়িতে সকালে মা যখন চা আর জলখাবার করছিলেন আর বাবা ঘুরে ঘুরে বাড়ির দরজা জানালা খুলছিলেন, নিচে যাচ্ছিলেন বাজার করতে, আমি আর অর্চিষ্মান খাটের ওপর পুরোনো অ্যালবাম পেড়ে ছবি দেখছিলাম। সামান্য হলুদ হয়ে যাওয়া ছবি। মাবাবার ছবি, মামামিমির ছবি, তিন্নি, অর্চিষ্মানের ছবি। অর্চিষ্মানের একদম ছোটবেলার ছবি খুব মজার, কিন্তু আমার বিশেষ উৎসাহ লাগে না। শিশুদের সব ছবিই একরকম, কে অর্চিষ্মান, কে কুন্তলা, কে তিন্নি বোঝার উপায় নেই। সকলেই ভয়ানক মোটা, সকলেরই মুখে বুড়ো আঙুল, সকলেই গামলার জলে ঘটের মতো বসে আছে। এক্সপ্রেশনও অতি লিমিটেড, কান্না কিংবা আতংক। 

আমার ইন্টারেস্টিং লাগে তিন্নির একটু বড় বয়সের ছবি দেখতে। কারণ আমার বাড়ির অ্যালবামে অবিকল ওইরকম ছবি আছে অনেক। আমার ছবি। তিন্নি আমার থেকে প্রায় এক হাত লম্বা, তা ছাড়া বাকি সব এক। হেয়ারব্যান্ড, জামার ছিট, ফ্রকের কাট, চশমার ফ্রেম। গোল, প্রকাণ্ড, এবং গোলাপি রঙের।

রিষড়ার বাড়ির অ্যালবামের ছবি দেখে প্রথম ওই জিনিসটাই চিনেছিল অর্চিষ্মান। “তোমারও এই ফ্রেম! এই বীভৎস ফ্রেমটা দিদিকেও পরাত বাবা মা।”

আমি সেই থেকে ভাবছি, আর ক’বছর কাটলে, অ্যালবামের ছবিগুলো আরেকটু হলদে হয়ে গেলে কি আমারও ওগুলো ভালো লাগবে? মনে হবে, দেখেছ, আমাদের সময়ের চশমার ফ্রেমগুলোও এখনকার থেকে ভালো ছিল? 


Comments

  1. Eyi chobiguloi ek shomoye lifeline hoye othe. Ami shob shomoye bhabtam chobi tolar kono mane hoye na, unless kono notun jayega te berate giye tola, kintu ekhon purono chobi te shudhu chena manush e noye, purono bari, purono ghor, purono rasta emonki purono kukur chana ke o peye jai. :-)

    ReplyDelete
    Replies
    1. একমত, শর্মিলা। আমার ছোটবেলায় তোলা ছবিগুলো তো ঠিক একা আমার ছবি নয়, ওই সময়টার ছবি। তবে এখন যে রেটে ছবি তুলি, তাতে ছবির ধক কমে যাওয়ার আশংকাটা থেকেই যায়।

      Delete
  2. Ki sundar lekha..khub bhalo laglo 😊

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, তিন্নি।

      Delete
  3. khub khub bhalo lekha. Amio purono diner chhobi fire dekhi. Ar vabi sadakalo oi samaytai bujhi chhilo valo. :-)

    ReplyDelete
    Replies
    1. পুরোনো ছবির কেরামতি, সায়ন। লেখা ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  4. প্রথম ঝলকে মনে হল প্রথম প্রেম লিখতে গিয়ে ভুল করে প্রথম ফ্রেম লিখেছেন। তারপর আস্তে আস্তে যখন বুঝলাম যে ফ্রেমই হবে, তখন মনে হল বোধহয় ফোটো ফ্রেমে গিয়ে গল্প দাঁড়াবে। একদম ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছে, যখন অমরীশ পুরী ঊর্ধ্বশ্বাস পালাচ্ছেন, তখন বুঝলাম, ও হরি এ তো চশমার ফ্রেম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওরে বাবা, এত জটিল রাস্তা তো আমার মাথাতেই আসেনি।

      Delete
  5. purono chobi dekhte amar keno janina icchei hoy na . lekhata jobbor hoyeche - PB

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, প্রদীপ্ত। আমারও ঝাড়াবাছা লোকের ঝাড়াবাছা পুরোনো ছবি দেখতেই ভালো লাগে।

      Delete
  6. Ki kore eto mon chhnoya lekho boloto?- Bratati

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে, থ্যাংক ইউ, ব্রততী।

      Delete
  7. Jonmo theke babar mathay taak dekhe purono akbum e ekta chheler matha vorti dheu khelano chul dekhe chinte parini otai baba.. Amar to khub bhalo lage.. Tobe onno loker barite onek somoy album dekhbe album dekhbe kore purono photo dekhay.. Seigulo kichukhon Por e khub boring lage...

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেটাই ঊর্মি, নিজের লোকের পুরোনো ছবি আর পরের লোকের পুরোনো ছবি দেখার মধ্যে অনেক তফাৎ।

      Delete

Post a Comment