জালৌরি পাস, সেরওলসর লেক, চেহনি কোঠি/ ৩ (শেষ)





সোঝায় একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের ক্লায়েন্টেলের সঙ্গে মোলাকাত হল। গোশৈণীতে যাঁদের দেখেছিলাম তাঁরা হয় স্পিরিচুয়াল হিলিং-এর খোঁজে এসেছিলেন নয় ভিড় মোটে সহ্য হয় না বলে শহর ছেড়ে পালিয়েছিলেন। সোঝাতে যাঁদের দেখলাম তাঁরা একা বেড়ানোয় নেই। দলে যত বেশি লোক হয় তত ভালো। এঁদের টিমে অন্তত চল্লিশ শতাংশ শিশু থাকে। যারা যতক্ষণ জেগে থাকে হয় চেঁচায় নয় কাঁদে নয় ধুপধাপ দৌড়য়। রাতে নারী এবং শিশুরা নেপথ্যে চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ পাতলা দেওয়ালের ওপাশ থেকে টুং টাং ঠুং ঠাং ভেসে আসে আর সেই সঙ্গে মোটা গলায়, সবই তো বুঝলাম, বাট ডু উই হ্যাভ এনি অলটারনেটিভ? এঁরা তৈরি হতে শুরু করেন ভোর পাঁচটায়, তৈরি হয়ে বেরোতে, সেলফি তুলতে, লোক গুনতে, জিনিস বাঁধতে সাড়ে ন’টা বাজান। ন’টা পঁয়তাল্লিশে যখন শেষ এস ইউ ভি-টি বাঁক ঘুরে অদৃশ্য হয় তখন বোঝা যায় যে জায়গাটায় এসেছি সেটা আসলে একটা শান্ত, সুন্দর জায়গা।

রাতেও বোঝা যায় অবশ্য। শিলাবৃষ্টিতে ভিজে কাঁপতে কাঁপতে ফিরেছি। চা পকোড়া খেয়ে ঘণ্টাদুয়েক শুয়ে শুয়ে বই পড়ে আর ক্যান্ডি ক্রাশ খেলে (আর পাশের ঘর থেকে ভেসে আসা বিকল্পহীনতার হাড়হিম করা নিদান শুনে) খাওয়াদাওয়াও সেরে নিয়েছি। রুটি মিক্সড ভেজ। সোঝা হলিডে ইনের মিক্সড ভেজের প্রেমে পড়ে গেছি। জিনিসটা সত্যি সত্যি পর্যাপ্ত পরিমাণে কপি, মাশরুম, পনীর, মটরশুঁটি আলুর মিক্সড ভেজ, দিল্লির অনেক দোকানের মতো খালি আলু গাজর আর ক্যাপসিকামের ঘ্যাঁট না। গরম গরম রুটির সঙ্গে চেটেপুটে খেয়ে শুতে গিয়ে ঘুম চটকে গেল। বিছানাটা তো ঠাণ্ডা কনকনে বটেই গায়ে দেওয়ার লেপখানা ফিলস লাইক মাইনাস পঁয়তাল্লিশ। সারা রাত দাঁড়িয়ে যেহেতু থাকা যাবে না ওর মধ্যেই সেঁধোলাম। অর্চিষ্মান ফোন খুলে সেরওলসর লেক যাওয়ার ভ্রমণবর্ণনা খুঁজে জোরে জোরে রিডিং পড়ে শোনাতে লাগল। আমার ঘনঘন হাই উঠছিল, শোনার উৎসাহ মোটেই ছিল না কিন্তু হাড়কাঁপানো শীতে একা একা জেগে বাইরের পিনড্রপ সাইলেন্স শোনার থেকে যতক্ষণ না নিজের ঘুম আসছে অন্যকে যথাসাধ্য উত্যক্ত করে জাগিয়ে রাখাটাই স্ট্র্যাটেজি। আমি হলেও তাই করতাম কাজেই বেশি বিরক্ত হতে পারলাম না।

কাল আমরা লেক যাব। সোঝা ইনের পাশ দিয়ে যে বাসগুলো ওপর দিকে যাচ্ছে সেগুলোর একটায় চড়ে জালৌরি পাসে জালৌরি মাতার মন্দিরের সামনে নামব। পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে সেরওলসর লেক। বাসের জন্য অপেক্ষা না করে, এলুরামজীর গাড়িতেও জালৌরি পাস পর্যন্ত যেতে আসতে পারি। যদি চাই এলুরামজী আমাদের লেক পর্যন্ত সঙ্গে সঙ্গে যাবেন এবং আসবেন, চাই কি আসার সময় একটা নতুন ট্রেল ধরেও ফিরিয়ে আনতে পারেন। তবে অফ কোর্স সবেরই চার্জ আছে। আমরা তখনও মনস্থির করিনি। সকালে উঠে যা ইচ্ছে হবে করব ভেবে সিদ্ধান্ত মুলতুবি রেখেছি। এমন সময় অর্চিষ্মান রিডিং পড়ল, জালৌরি পাস থেকে লেক যাওয়ার জঙ্গলের পথে নাকি নানারকম জীবজন্তুর দেখা মেলে। যথাক্রমে, লঙ্গুর... বলেই চুপ। তিরিশ সেকেন্ড পর বলল, এলুরামজীর সঙ্গেই যাওয়া ভালো, বুঝলে।

বললাম, কেন কেন? অর্চিষ্মান বলল, এখানে লিখেছে জঙ্গলের পথে নাকি যথাক্রমে লঙ্গুর, ভালু এবং লেপার্ডের দেখা মেলে।

আমি কনফিউজড। এলুরামজী অত্যন্ত ফিট মানুষ দেখলেই বোঝা যায়, কিন্তু তা বলে খালি হাতে ভালু কিংবা লেপার্ডের সঙ্গে ফাইট দেবেন এমন ভাবাটা বাড়াবাড়ি। অর্চিষ্মান লজ্জিত মুখে চুপ করে রইল। বলল আমি অবশ্য ঠিক সেটা ভাবছিলাম না।

ও নাকি ভাবছে যে দু’জনে থাকলে ভালু কিংবা লেপার্ডের খাদ্য হওয়ার যা প্রব্যাবিলিটি, তিনজনে থাকলে সেটা একটু কমবে। 

ওর প্ল্যানের ভুল ধরাতে বাধ্য হলাম। ভালু কিংবা লেপার্ড এলে তিনজনেই দৌড়ব এবং পাহাড়ি পথে এলুরামজী আমাদের দুজনের থেকেই যে জোরে দৌড়বেন তাতে কোনও সন্দেহ থাকা উচিত না। এও ধরে নেওয়া যেতেই পারে যে লোকাল লেপার্ডরা সকলেই এলুরামজীর পরিচিত। সেই সুবাদে এলুরামজীকে হয়তো নমস্তে ভাইসাব বলে কপালে হাত ছোঁয়াল তারপর আমাদের দুই থাবড়া মেরে সাবাড় করল।


*****


সকালসকাল বেরিয়ে পড়লাম। জালৌরি পাসে গাড়ি পার্ক করে মাতার মন্দিরে নমো সেরে হাঁটা শুরু হল। রাস্তা সোজা। আমার মতো মডারেটলি আনফিট লোকে ধীরেসুস্থে দু’ঘণ্টায় পার করতে পারে। গোড়ার দেড়-দু’কিলোমিটার তো প্রায় সমতল কাঁচা রাস্তা, তারপর একটু পর্বতসুলভ ওঠা নামা,দু'পাশে চেপে আসা পাথরের মধ্যে সরু ফাঁক এইসব আছে। সামান্য ঝামেলা যোগ করেছিল গলতে শুরু করা বরফ। তাও এ বছর অনেকদিন ধরে অনেক বেশি বরফ পড়েছে বলে এখনও বরফ আছে, না হলে মধ্য এপ্রিলে সব ফয়লা হয়ে যাওয়ার কথা।


চমৎকার দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে চললাম। শ্যাওলা ঢাকা দীর্ঘ বৃক্ষের শরীর থেকে গিঁট বাঁধা নুলো হাতের মতো শাখাপ্রশাখা। দূরে পাহাড়। মাঝে মাঝে জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে নিচে সমতল ঘাসজমিতে সরকারি তাঁবু। আধভাঙা গাছের কাটা গুঁড়ি (সবল গাছ কাটা বারণ হয়ে গেছে অনেকদিন) ঢিপি বেঁধে মজদুরদের অপেক্ষায়। মিনিট পাঁচের ইন্টারভ্যাল নিয়ে লেকে পৌঁছলাম।

শেষ বরফের রাস্তাটুকু আমি আর এলুরামজী ট্যাংগো নাচতে নাচতে নামছি

বরফ আর জঙ্গলঢাকা পাহাড়ের মুকুটে মণির মতো দিঘিটি এবং দিঘিসংলগ্ন সৌন্দর্যের প্রতি সুবিচার আমার কিট লেন্সওয়ালা সস্তা ক্যামেরার ছবিতে যেমন অসম্ভব, তেমনই অসম্ভব আমার ভাষাজ্ঞান দিয়ে সে সৌন্দর্যের বর্ণনা করা। ভেবেচিন্তে আমি তাই আমার ক্যামেরার কাঁধেই বন্দুক রাখলাম।


ঘোর বর্ষা অর্থাৎ জুন জুলাই অগস্ট আর ঘোর শীত অর্থাৎ ডিসেম্বর জানুয়ারি ফেব্রুয়ারি ছাড়া সারাবছরই লেকদর্শনে যাওয়া যায়। কিন্তু সারাবছর এক রূপ থাকে না। সেপ্টেম্বর অক্টোবর নভেম্বরেও প্রচুর লোক আসেন। সে সময় বরফ থাকে না কিন্তু শরৎকালের আকাশ লেকের ওপর নিশ্চয় চমৎকার ছায়া ফেলে। বরফ দেখতে চাইলে মার্চ নাগাদ যাওয়া ভালো। 



এ ছাড়া লেক দেখতে যাওয়ার আমার এক, এবং দুই, এবং তিন এবং চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয় এবং দশ নম্বর টিপঃ সকাল সকাল যাওয়া। যদি না আপনার আরও পাঁচশো লোকের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করার বাসনা থাকে। সোজা ট্রেকিং কাজেই কাঁধে বুমবক্স নিয়ে রকসাইন দেখাতে দেখাতেও লোকে চলেছে। আরেকটা কথা মনে রাখতে হবে, সেরওলসর লেক স্থানীয় লোকদের কাছে একটা জনপ্রিয় তীর্থস্থান এবং আনন্দ করার জায়গা। মানেআমরা যখন নামছি তখন একটা দল কেকপ্যাস্ট্রির বাক্স নিয়ে খুব সেজেগুজে চলেছে। তাছাড়াও বরফ গলার পর থেকে নিয়মিত বুঢ়ি নাগিনের পুজো শুরু হয়, লোকে ফুটোওয়ালা ঘটি করে গব্যঘৃত ছড়াতে ছড়াতে লেকের চারপাশের পাথরবাঁধানো পথে আর মন্দির ঘিরে ঘোরে। সেই গরম ঘিয়ের কালো কালো দাগের চিহ্ন মন্দিরের চাতাল জুড়ে।। 

এই পারে আমি আর ওই পারে বুঢ়ি নাগিনের মন্দির

মোদ্দা কথা, আপনি সকাল সকাল গিয়ে বহিরাগত উইকএন্ডার টুরিস্টদের এড়াতে পারলেও হয়তো যেদিন গেলেন সেদিন পুজোর মধ্যে পড়লেন। তবে যখনই যান না কেন, যার মধ্যেই পড়ুন না কেন, সেরওলসর লেকের যে রূপই দেখুন না কেন, তা যে দেখার মতো হবে ধরে নেওয়াই যায়। 

*****

সকালে মাখন পাউরুটি চা খেয়েই বেরিয়েছিলাম তবু লেক দেখা সেরে খাই খাই ভাব হচ্ছিল। খাওয়ার জায়গাও আছে। অস্থায়ী চা ম্যাগির দোকান। আমার ধারণা জায়গা দেখেই খিদে  পেয়েছে কিন্তু এলুরামজী সহানুভুতিশীল, বললেন, ব্রেডবাটারে পেট ভরে না, আমি তো রোটি সবজি খেয়েছি কি না। তাই আমার খিদে পায়নি। এই কীসে খিদে মিটবে আর মিটবে না, এটা ইন্টারেস্টিং। ক্যালরি মাপলে, দুটো রুটি তরকারির থেকে স্টারবাকসের এক কাপ কফির ক্যালরি বেশি। তরল কঠিনের ব্যাপারটা মেনে নিয়ে যদি রুটি তরকারি আর আলুর চপের মধ্যে তুলনা করি, তাহলেও চপের ক্যালরি বেশি হবে। অথচ বেশিরভাগ লোকই আলুর চপকে ন্যায্য ডিনার বলে গণ্য করবেন না। আটটার সময় চপ সিঙাড়া রোল খেয়েও এগারোটার সময় ভাত ডাল মাছ দিয়ে পরিপূর্ণ ডিনার করবেন। পেট ভরা না ভরার ব্যাপারটা খানিকাংশে যে মানসিক সেটা ফাইনাল। 

এলুরামজী যাই বলুন না কেন, আমাদের তখন না খেলেও চলত। তবু চা ম্যাগি অর্ডার করলাম। এলুরামজীও ম্যাগির ভক্ত। বললেন ম্যাগি নাকি ডায়েটের জন্য ভালো। কারণ একবার খেলে অনেকক্ষণ খিদে পায় না। 


বলতেই পারতাম এমন টমেটো পেঁয়াজ ক্যাপসিকামসম্বলিত সুস্বাদু ম্যাগি আমি আর জীবনে খাইনি কিন্তু বলছি না। কারণ একা বাড়িতে অফিস থেকে হাক্লান্ত হয়ে ফিরে এসে যে ম্যাগি বানাই,  জলে সেদ্ধ প্যাকেটের মশলা মেশানো ন্যাড়াবোঁচা ম্যাগি,এল ই ডি আলোকিত একা ঘরে সে ম্যাগিও কিছু কম সুস্বাদু নয়। পরিস্থিতি বিশেষে ম্যাগি খাবার নয়, থেরাপি। তার স্বাদ কিংবা কার্যকারিতার তুলনা করা মূর্খামি। তবু পাহাড়ের ম্যাগি সবসময়েই খেতে ভালো লাগে। এ আমি খেয়াল করে দেখেছি। চন্দ্রশীলা থেকে নামার পথে তুঙ্গনাথ মন্দিরের পাশে বসে ম্যাগি খেয়েছিলাম, সেও চমৎকার। 

নামার পথে ওঠার দলের লোকদের সঙ্গে দেখা হল। কেউ কেউ জিজ্ঞাসা করছিলেন, হাউ ফার? অওর কিতনা? অর্চিষ্মান এ সব ক্ষেত্রে সর্বদা শুষ্কং কাষ্ঠং, ফ্যাক্টব বেসড জবাব দেওয়ার পক্ষপাতী। ওর যদি সন্দেহ থাকে পাহাড়চুড়ো সাতশো মিটারের বেশি আর আটশো মিটারের কম দূর, ও দাড়ি চুলকে সাড়ে সাতশো মিটার উত্তর দেবে এবং আর কিছুই বলবে না। 

আমি এ রকম নই, বলাই বাহুল্য। আমি বলি, এই তো একটুখানি, মেরে এনেছেন, চালিয়ে যান, ওয়ার্থ ইট, দারুণ দৃশ্যপট, খবরদার ফেরার কথা মাথাতেও আনবেন না। অর্চিষ্মান প্রাণভয়ে আছে, কোনদিন না ‘কদম কদম বঢ়ায়ে যা’ গান ধরে ফেলি।

 *****

পালে পালে লোক উঠছিল। আমরা, উঃ এখন নিশ্চয় মেলা বসে গেছে, এখন নিশ্চয় বরফ সব নোংরা হয়ে গেছে, এখন নিশ্চয় ওর ছোঁড়া বরফের গোলা এর গায়ে এসে লাগছে, এই সব বলাবলি করতে করতে আর সকাল সকাল লেকে আসার সিদ্ধান্তে নিজেদের পিঠ চাপড়াতে চাপড়াতে চললাম। মাঝপথে একটা উঁচু টিলায় ওঠা হল। টিলার ওপার থেকে নাকি অন্য একটা ট্রেল ধরে নামা যায়, যেটা নতুনত্বও হল আবার শর্টও। টিলার ওপর থেকে দেখা গেল সে ট্রেল পুরো বরফে ঢাকা। এলুরামজী বললেন সাইড দিয়ে নাকি চাইলে চলা যেতে পারে, কিন্তু আমি আর অর্চিষ্মান কেউই রিস্ক নিতে রাজি হলাম না। এলুরামজী জানালেন এ জায়গার কাছাকাছিই 'ইয়ে জওয়ানি ইয়ে দিওয়ানি'র শুটিং হয়েছিল। শিহরিত হলাম। বললাম, রণবীর কাপুর আর দীপিকা পাডুকোন কি হেঁটেই উঠেছিলেন? এলুরামজী বললেন, আর কোনও উপায় তো নেই। হিন্ট দিলাম, হেলিপ্যাড টেলিপ্যাড? উঁহু। নাহ্‌, সিনেমার হিরোহিরোইন হওয়া যথেষ্ট ঝামেলার ব্যাপার। না হয়ে ভালোই হয়েছে।

*****

জালৌরি মন্দিরের পতাকা দেখা গেল। অর্চিষ্মান এগিয়ে গিয়েছিল। এলুরামজী গাড়ি আনতে গেলেন। একমুহূর্ত দাঁড়ালাম পথের পাশে। সামনে স্তরে স্তরে পাহাড়ে। সবুজের নানা শেড।  অনেক নিচে রাস্তা এঁকেবেঁকে চলে গেছে সিমলার দিকে, রাস্তার ধারে একটা সাদা বাস দাঁড় করানো। পেছনে জালৌরি মাতার মন্দিরে ঢং ঢং ঘণ্টা বাজছে মাঝে মাঝে। যখন বাজছে না, কানের ভেতর হাওয়ার শব্দ শোঁশোঁ করছে। নাকের ডগা টনটন করছিল একটু আগে, চোখ ট্যারা করলে দেখতে পাচ্ছি চামড়া ফেটে ছোট ছোট সাদা ফণা তুলেছে। দুই হাত দিয়ে আড়াল করলে আরাম লাগছে বেশ। হাতের তেলোয় কেমন একটা বুনো গন্ধ। ভীষণ মৃদু। দিল্লি দূর অস্ত, এলুরামজীর গেস্ট হাউস পর্যন্তও থাকবে না। ঘন ঘন মুখের কাছে তুলে এনে শুঁকছি।

আমার স্পিরিচুয়াল হিলিং প্রায় সম্পূর্ণ হয় হয়, এমন সময় ঘণ্টা, শোঁশোঁ ছাপিয়ে, চা বলব তো? কী গো, তোমার জন্য চা বলব তো? 

দশ হাত নিচে, জালৌরি মন্দিরের বাঁকে গজিয়ে ওঠা ঝুপড়িদোকানগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে অর্চিষ্মান মুখ তুলে দাঁড়িয়ে আমার মোক্ষলাভে বাগড়া দিচ্ছে। 

*****

সব মানুষেরই জীবনের একেকটা মোক্ষ থাকে। বড় চাকরি, বড় গাড়ি, খ্যাতি, ফ্রেন্ডস এইসব বহিরঙ্গের মোক্ষ পেরিয়ে গভীরতর মোক্ষ। একটা দৃশ্য, যার ভেতরে সে নিজেকে দেখতে চায়। যেখানে সে সবথেকে সুখী, সবথকে রিয়েল।

অর্চিষ্মানের সেই মোক্ষটা কোথায় আমি জানি। উত্তর কলকাতার, প্রেফারেবলি বাগবাজারের, কোনও একটা সরু গলি যা বড় রাস্তায় এসে মিশেছে। মোড়ের মাথায় কোনও এক চায়ের দোকানে বা তেলেভাজার ঝুপড়ি বা মুদিদোকান বা কেমিস্ট শপ, যা-ই হোক ঝাঁ চকচকে না হলেই চলবে, সেই রকম একটা দোকানের সামনে কাঠের বেঞ্চিতে আরও কিছু সমবয়স্ক মানুষের সঙ্গে বসে সামনে দিয়ে বয়ে চলা রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকা। জালৌরি মন্দিরের মোড়ে বসে চা খেতে খেতে ভুরু নাচিয়ে আমাকে দেখাল অর্চিষ্মান। রাস্তার উল্টোদিকের দোকানের সামনে বেঞ্চিতে, অ্যাসবেসটসের ছায়ায় দুজন বসে আছেন। পাহাড়ি নিয়ম মেনে মুখে গভীর ভাঁজ, মাথায় টুপি, পরনে ধ্রুপদী পাহাড়ি পোশাক, মাথায় ঝালর দেওয়া টুপি। অর্চিষ্মানের মোক্ষ। একটু পরে লজঝড় করতে করতে বাস এল, ভদ্রলোক দুজন বাসে উঠে চলে গেলেন।

অর্চিষ্মান দৌড়ে গিয়ে তাঁদের জায়গাটা অধিকার করল। আমিও গেলাম। এলুরামজী সামনে ঘোরাঘুরি করছিলেন। ওঁর গাড়ির সামনে একগাদা গাড়ি পার্ক হয়ে গেছে। তাই একটু টাইম লাগবে। অর্চিষ্মান ততক্ষণে নিজের মোক্ষের কাছাকাছি পৌঁছেছে, আমার থেকেও সোৎসাহে বলল, কুছ পরোয়া নেই। যত ইচ্ছে টাইম নিন। আমরা লোক দেখতে লাগলাম। অর্চিষ্মান বার বলতে লাগল, এখানে এসেই তো বসে থাকা যায়, যায় না? বল?


সত্যি দেখার মতো অনেক লোক। স্থানীয় লোকেরা তো এসেছেনই। মাতার মন্দিরে মাথা ঠেকে যাচ্ছেন। টুরিস্টও আছেন। বাইকারও আছেন। অর্চিষ্মানের থেকেও আধহাত লম্বা সাহেব। রোদে পুড়ে রং প্রায় আমার কাছাকাছি পৌঁছেছে। কোমর ছাপানো জটা। হঠাৎ 'হাআআআআই!' গোশৈণীর রাজু ভারতীর কটেজে আলাপ হয়েছিল। এই সবে এলেন জালৌরি পাস। এখানে আর কী কী করা যায় সাজেশন চাইছেন। খুব মেঘ করেছে। এলুরামজী হাত নাড়ছেন। গাড়ি উদ্ধার হয়েছে। এবার ওঠা যাক।


*****

পরদিন সকাল এগারোটার সময় বাস আসবে, নিয়ে যাবে বানজার, বানজার থেকে বাস নিয়ে আমরা যাব কুল্লু। সেখান থেকে ভলভো বুক করা আছে দিল্লির। এলুরামজী আরেকটা বুদ্ধি দিলেন। ফোন করে ওঁর চেনা একজনকে আনিয়ে নিলেন। তাঁর জিপ নিয়ে তিনি যাচ্ছিলেন বানজার। তিনি আমাদের জিভি হয়ে চেহনি কোঠি দেখিয়ে বানজারে ছেড়ে দিয়ে যাবেন। 


চেহনি কোঠি. এ অঞ্চলের আরেকটা সোজা ট্রেক। ঘণ্টাখানেকের হাঁটা। রাস্তাটা শক্ত নয় একেবারেই, খালি চড়াইটা সামান্য বেশি। তবে আশেপাশের গাছপালা, ফুল, আপেল বনের দেখতে দেখতে চললে চড়াইয়ের কষ্ট গায়ে লাগবে না। পথে জঙ্গলের ভেতর শৃঙ্গ ঋষির শান্ত মন্দির দেখে নিতে পারেন। আমরা তাড়ায় ছিলাম তাই দেখিনি, সোজা টঙে উঠে গেছি।



চেহনি কোঠি হচ্ছে দুটি প্রাচীন ওয়াচ টাওয়ার। এদের প্রাচীনত্ব সম্পর্কে ইন্টারনেটে একজায়গায় লিখেছে পনেরোশো বছর, আরেক জায়গায় পাঁচশো, আরেক জায়গায় দুশো। খালি লম্বা টাওয়ারটার উচ্চতা তিরিশ মিটার এইটা নিশ্চিত। আর ওইরকম ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় সিমেন্ট কংক্রিট ছাড়া কাঠ আর চুনাপাথরের মাঝে মাটি আর গোবরের মিশ্রণ লেপে এতখানি দু’খানা উঁচু উঁচু প্রহরাতোরণ বানানো যে মির‍্যাকল, সেটাও।


চেহনি কোঠির চারপাশে চেহনি গ্রাম। হাতে গোনা কয়েকটা ঘেঁষাঘেঁষি কাঠের বাড়ি। গ্রামের মাঝের চত্বরে ধুলোধূসরিত বাচ্চারা খালি জলের ড্রাম নিয়ে খেলা করছে। নোংরা কুকুরছানা রোদে শুয়ে ঘুমোচ্ছে। আমরা পাশ দিয়ে যাওয়ামাত্র উঠে এসে গা ঝেড়ে অর্চিষ্মানের পায়ের পাশে আবার লম্বা হয়ে চোখ বুজল। পিঠে শিশু বেঁধে একটি মেয়ে দুই হাতে ভারি ভারি জলের ড্রাম নিয়ে সিঁড়ি উঠছে নামছে। একজন পুরুষ হাসিমুখে এগিয়ে এসে অর্চিষ্মানের সঙ্গে আলাপ জমালেন। আলাপ না বলে জেরা বলাই ভালো। কোথায় থাকেন, কী চাকরি করেন, কবে এসেছেন, কবে যাবেন। তবে পাহাড়ি চাল মেনে অতি বন্ধুত্বপূর্ণ জেরা, কাজেই আপত্তিজনক নয় মোটেই। আমরা একটু পর নামতে শুরু করলাম। 

রাস্তা ইধার হ্যায়। 

অর্চিষ্মান কনফিডেন্টলি একটি বাড়ির রান্নাঘরে ঢুকে যাচ্ছে দেখে সতর্ক করছেন এক ভদ্রমহিলা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাশের বালতি থেকে ভেজা কাপড় নিয়ে ঝেড়ে ঝেড়ে দড়িতে ঝোলাচ্ছেন আর আমাদের বোকামো দেখে হাসছেন। একটিও দাঁত না থাকা, হাসিটিকে একটি আলাদা মাত্রা দিয়েছে। 

আমরাও হেসে শুক্রিয়া বলে ঠিক দিকে পা বাড়ালাম। মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন আমরা কোথা থেকে এসেছি, দিল্লি শুনে চোখ কপালে তুললেন। বাপরে, বহোৎ গরমি। আমরা দুঃখী মুখে মাথা নাড়লাম। গরমি বলে গরমি। আমি জুড়ে দিলাম, আপনাদের গ্রামটি ভারি সুন্দর। এবার মহিলার দুঃখী মুখ করার পালা। সুন্দর তো বটেই, কিন্তু শীতে যখন বরফ পড়ে তখন, বলে হাত দিয়ে কোমরের কাছ পর্যন্ত দেখালেন। সত্যি। এই চড়াইয়ের বাজারে কোমর পর্যন্ত বরফ ঠেলে জীবনধারণ কঠিন ব্যাপার। মহিলা আরেকটা কাপড় ঝড়াৎ ঝেড়ে দড়িতে ঝোলাত ঝোলাতে বললেন ওঁর মৌসার কোন লতায় পাতায় সম্বন্ধী যেন দিল্লিতে…অর্চিষ্মান এগিয়ে গেছে, আমি অর্ধেক শরীর দিয়ে অর্চিষ্মানকে অনুসরণ করতে করতে গিয়ে শরীরের ওপরের অর্ধাংশ মুচড়ে মহিলার দিকে মনোযোগ দিতে গিয়ে পাশের একটা ঝোপের ওপর পপাত চ হলাম। মহিলা 'আহা আহা' বললেন, অর্চিষ্মান 'আরে আরে' বলে দৌড়ে এল, আমি নিজের হেনস্থায় একরাশ লজ্জা পেলাম আর ঝোপের যে জায়গাটায় আমার বাঁ কবজিটা লেগেছিল সেটা দেখতে দেখতে লাল হয়ে ফুঁসে উঠল। আর যা চুলকোলো বলার নয়।

মহিলা বললেন, বিছৌটি কেয়া? আমি বললাম, সেইরকমই মালুম হচ্ছে। মহিলা হাতে হাত ঘষার ভঙ্গি করে আশ্বাস দিলেন, কুছ নহি হোতা। ওঁর দেখানো পদ্ধতিতে হাতে হাত ঘষতে ঘষতে নিচে নেমে এলাম।



*****

ব্যস, বেড়ানো শেষ। পাহাড়ের নিচে জিপ নিয়ে অপেক্ষারত ভাইসাব আমাদের বানজার বাসস্ট্যান্ড পৌঁছে দিলেন, বানজার থেকে বাস ধরে কুল্লু এলাম। কুল্লু বাসস্টপে তেলচুপচুপে চাউমিন খেয়ে, অ্যাভোমিন গিলে, অটো নিয়ে বিয়াসের তীরবর্তী বৈষ্ণো মাতার মন্দিরের লোকেশনে পৌঁছলাম। ওটা বেসরকারি ভলভোর স্টপ। আরও অনেক বাক্সপ্যাঁটরাওয়ালা যাত্রীর সঙ্গে দাঁড়ালাম। একের পর এক বাস এল। আমাদেরটাও। নম্বর মিলিয়ে উঠে পড়লাম। সারা সন্ধে, রাত কাটিয়ে সে আমাদের দিল্লি আই এস বি টি-তে নামিয়ে দিল সকাল সাতটায়। 

উবার নিয়ে বাড়ির দিকে আসছি, কবজির দিকে চোখ পড়ল। চুলকুনি তো আগেই গিয়েছিল, চামড়াটা যে লাল কাঁটা কাঁটা হয়ে ফুলে উঠেছিল সেও মিলিয়ে গিয়ে আগের মতো প্লেন হয়ে গেছে। ঘটনাটা যে ঘটেছিল, সেটার কোনও প্রমাণ নেই। বিছুটির জ্বালা, পাহাড়, আপেলের বন, বরফ, বুনো ফুলের গন্ধ সব, স্বপ্নের মতো উড়ে গেছে।

মনটা খারাপই হয়ে গেল।

(শেষ)

Comments

  1. bichuti lagle sekhane gobor dite hoi na?

    ReplyDelete
    Replies
    1. হয় বুঝি? ভাগ্যিস বলেননি মহিলা। ওখানে গরুও ঘোরাঘুরি করছিল কয়েকটা গোবরটোবর গায়ে মাখতে হলে ভয়ানক খারাপ ব্যাপার হত।

      Delete
  2. Interesting jaiga mone hochhe. Er naam aage shunini. Kono din uttor paane gele pore jaoar ichchhe roilo!
    iti
    Shuteertho

    ReplyDelete
    Replies
    1. যাবেন সুতীর্থ। আমাদের খুবই ভালো লেগেছে। খুব সুন্দর জায়গাটা।

      Delete
  3. Siggiri jabar ichhe roilo. 'Machine ka thanda paani' season is back :(

    ReplyDelete
    Replies
    1. জুলাই অগস্টে কী হবে ভাবতেই ভয় লাগছে। এই সময় সোঝা পালানোই ভালো।

      Delete
  4. ইসস শেষ হয়ে যেতে আমারও বড় দুঃখ হলো ...আমি লেক ধরে বরফ রাস্তায় হেঁটে , ম্যাগি খেয়ে, বিছিটি এড়িয়ে চলছিলাম ...ওইদিকটা যেতেই হবেই শিজ্ঞির ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ঘুরে এস, প্রদীপ্ত।

      Delete
  5. Bah.. ei jayga tay ese darun jome gelo.. Sojha to khub sundor dekhchi.. Ar 1 din thakle aro bhalo hoto bodhoy.. Ranbir ar Dipika er shooting er ekta jayga amio ei chuti te ghure elam.. Venice :) tar theke tomar jawa jayga ta besi bhalo mone hocche..

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে দারুণ ব্যাপার তো ঊর্মি। ভেনিস কেমন লাগল?

      Delete
    2. Bhalo legeche.. Venetian lagoon khub sundor.. italian khabar bhalo legeche.. shohor tao khub onnorokom.. tobe gondola ta overhyped legeche... gondola ride ta ekta special experience thik e.. tobe Alleppy te houseboat ba choto shikara te ghora amar onek besi sundor legechilo..

      Delete
    3. তাহলে আলেপ্পিতেই বোটে চড়ে আসব নাহয়।

      Delete
  6. Ki bhalo laglo porte...comment jodiyo deri te korlam. Kichhudin kaajer sutre baire chhilam. fire ese porlam. boro bhalo laglo...Himachal er eto sundar sundar jaigai beranor eto manorom lekha....chhabi .....sab sundar.

    ei berano gulor erokom anondo bideshe sabsomoy paoa jaina...tar jonyo oi ruti-mixed veg ba cha-pakorar boro proyojon...bijatiyo khadyo sabsomoy saman indriyosukh daina..

    ---Susmita.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, সুস্মিতা। রুটি মিক্সড ভেজ বেড়ানোর আনন্দ বাড়িয়ে দেয়, এটা আমারও মত। আপনার লেখাটা ভালো লেগেছে জেনে আমারও খুব ভালো লাগল।

      Delete

Post a Comment