চৌকোড়ী ২/২




চৌকোড়ীতে আমরা থাকতে থাকতেই একটি বাঙালি দল এসে উপস্থিত। আসাটা অপ্রত্যাশিত নয় কারণ উত্তরাখণ্ডে আসা ভ্রমণার্থীর একটা বিরাট অংশ (ক্যান্টিনের ভাইসাব বললেন, এইটি পার সেন্ট। একটু কমিয়ে ধরলেও ফিফটি পার সেন্ট এর বেশি ধরেই নেওয়া যায়)। অ্যান্থনিজি আরও এক পা এগিয়ে বললেন যে পাহাড়ের অনেক অল্পজানা জায়গাই নাকি বাঙালি ভ্রমণার্থীরাই তাঁদের চিনিয়েছেন। 

দলটির অর্ধেক এসেছেন কলকাতা থেকে, অর্ধেক মুম্বই থেকে। দিল্লিতে মিলিত হয়ে ইনোভা ভাড়া করে কৌশানি গেছেন, তারপর চৌকোড়ী এসেছেন, চৌকোড়ী থেকে মুন্সিয়ারি হয়ে বিনসর ঘুরে বাড়ি যাবেন। আমরা কাল রাতে এসেছি আবার কাল ভোরে বেরিয়ে যাব শুনে অবাক। এ রকম ঘোরার মানে কী? আসতে যেতেই তো সব সময় চলে গেল। একটু বেশি দিন না থাকলে পাহাড়ের ফিলিংস হৃদয়ঙ্গম করা যায় নাকি? তাছাড়া কাছাকাছেই পাতাল ভুবনেশ্বর, মাটির তলায় টোটাল গুহাসিস্টেম; বিরথি জলপ্রপাত, পঁচিশ কিলোমিটার দূর থেকে যার সাদা পপাতমান ফেনা দেখা যায়; আর মুন্সিয়ারি, যেখান থেকে হাত বাড়ালেই হিমালয়ের রেঞ্জ। এগুলোর সবকটাই আমরা না দেখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি শুনে ওঁরা আগেই এত অবাক হয়ে ছিলেন বলেই আর অবাক হতে পারলেন না।

চৌকোড়ীতে গিয়ে আমরা তবে করলামটা কী? 

আমি দুটো গোয়েন্দা গল্প শেষ করলাম। একটা আবার কিন্ডলে সেদিনই কিনে সেদিনই শেষ। এর রোমাঞ্চই আলাদা। অর্চিষ্মান রবি টু বৃহস্পতি চার ঘণ্টা করে ঘুমোয়, ঘুমোলো। টিভিতে মিঠুনের যুগান্ধর দিচ্ছিল, আমি বই পড়তে পড়তে, অর্চিষ্মান হাফ ঘুমিয়ে হাফ জেগে দেখল। প্লট অতি সরল, দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন। মিঠুন বিংশ শতাব্দীর কৃষ্ণঠাকুরের অবতার, গ্রামের লোকেদের লুট হওয়া জমি উদ্ধার করার জন্য অস্ত্র হাতে নিয়েছেন। কাণ্ডকারখানা দেখে হাসিই পায়, তবু আমরা একমত হলাম যে ওয়াইন খেতে খেতে কাব্যিক সমস্যা আলোচনার থেকে এই টপিক ঢের ভালো। 

আর খাওয়াদাওয়া তো আছেই। খাটের পাশে ঘটা করে একখানা সুদৃশ্য ছাপা মেনু রাখা বটে কিন্তু অভিজ্ঞতায় জানতাম খাওয়ার সময় ও সবের কিছুই মিলবে না। মিলেগা খালি ডাল, রোটি, চাওল, মিক্স ভেজ, আলুটমাটর, আলুজিরা, ননভেজ মে আণ্ডা কারি। 

তবু ফোন তুলে জিজ্ঞাসা করলাম, কেয়া মিলেগা ভাইসাব? ভাইসাব বিনীত হয়ে জানালেন, আপকো যো চাহিয়ে সব মিলেগা ম্যাডাম। ডাল, রোটি, চাওল, মিক্স ভেজ, আলুটমাটর, আলুজিরা, ননভেজ মে আণ্ডা কারি। 

ভাবছি ঠাকুমাদত্ত নামখানা বদলে খনা জুনিয়র করব নাকি, এমন সময় ফোনের ওপারে আবছা কথোপকথনের আভাস। ভাইসাব মুখ রিসিভারের দিকে ফিরিয়ে আনতে আনতে বললেন, অওর ভিন্ডি ভি মিলেগা ম্যাডাম।

বেগুন আমার কাছে যা, ঢ্যাঁড়স অর্চিষ্মানের কাছে তাই। অর্ডার করলাম ডাল রুটি ঢ্যাঁড়স। আর যেহেতু আলু ছাড়া কোনও মিল সম্পূর্ণ করা আমার গুরুর বারণ, আলুজিরা। শুনতে যতই সাদামাটা হোক না কেন, আমার কাছে এই মেনু পোলাও কালিয়াকে বলে বলে হারাবে যে কোনও দিন। উত্তর ভারতের লোকেরা ডাল এবং রুটি দুটোই মচৎকার বানায়, আর ঢ্যাঁড়স আর আলু তো খারাপ লাগার কোনও কারণ নেই। সঙ্গে শশা টমেটো পেঁয়াজ আর গোটাদুয়েক কাঁচালংকা থাকলে নেক্সট কুড়ি মিনিটের জন্য ডাইনিং টেবিল স্বর্গ। অর্চিষ্মানও এমন খাওয়া ভালোবেসে খায়, কিন্তু আমার বাঁধনছাড়া প্রশংসার মুখে বাঁধ দিতেই বোধহয় বলল, রোজ খেতে ভালো লাগবে না। 

মুখে বললাম, হতে পারে। মনে জানি আর কারও লাগুক না লাগুক আমার এ খাবার রোজ, তিন বেলা ভালো লাগবে।

রাতের অন্ধকারে সোয়েটশার্ট পরে কাঁপতে কাঁপতে খেতে গেছি আর এসেছি, আকাশে মেঘ জমেছে কিনা টের পাইনি। খেয়ে এসে বিছানায় গা ঠেকাতেই সারাদিনের ক্লান্তি ঝেঁপে এসেছে। পড়ামাত্র ঘুম।

ঘুম ভাঙল বৃষ্টির আওয়াজে। আমার অ্যালার্ম তখনও বাজেনি, অর্থাৎ চারটে বাজতে তখনও বাকি। অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে বৃষ্টির আওয়াজ শুনলাম। ঠাণ্ডা বেড়েছে। ভালোই হয়েছে ঘুম ভেঙে গিয়ে। লেপটা ভালো করে মুড়িশুড়ি দিয়ে কিন্ডল খুললাম।

গল্প এগিয়ে চলল, বৃষ্টি পড়ে চলল। খুনী ধরা পড়ল শেষ পাতায়, কিন্তু বৃষ্টি থামল না। একটানা ঝমঝম। ততক্ষণে পর্দার বাইরে আলো ফুটেছে। উঁকিঝুঁকি মারলাম। ঘাস, ফুল, পাতা, বাড়ির ছাদ সব ভেজা। ওর মধ্যেই মেঘের ভেতর খানিকটা ফাঁক খুঁজে কয়েকটা পাহাড় মাথা বার করেছে দেখলাম। অর্চিষ্মানকে ডেকে দেখালাম। আবার গল্পে ফেরত গেলাম। সাড়ে সাতটা নাগাদ ছাতা মাথায় চা এল, খেয়ে আবার গল্প। বেলা বাড়তে অল্প ভিজে ভিজে গেলাম পরোটা খেতে। ক্যান্টিনের ভারপ্রাপ্ত ভাইসাব গল্প জুড়লেন। আমাদের পাহাড় ভালো লাগে শুনে বললেন, একবার আমাদের সঙ্গে কৈলাস চলুন। সন্দেহ চাপা দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে জিজ্ঞাসা করলাম, আমরা কারা? বললেন, কেন কে এম ভি এন। সরকারি লোক সরকারি জিনিসের বিজ্ঞাপন করছে দেখে মন খুশি হয়ে গেল। আমার মাও ঘোর বি এস এন এলী ছিলেন আজীবন। যার নুন খাওয়া তার গুণ গাওয়া - কৃতজ্ঞতার এই সহজ হিসেবে মায়ের আস্থা ছিল। আমরা খানিকটা উৎসাহে, খানিকটা ভদ্রতায় খোঁজখবর নিলাম। বললাম, নেক্সট বছর চেষ্টা করব যাওয়ার। ভদ্রলোক বললেন, নিশ্চয় নিশ্চয়। তারপর এক সেকেন্ড থেমে বললেন, তবে কী জানেন, শেষমেশ সবই কপাল। ভোলে কা বুলাওয়া আনা চাহিয়ে।


খাওয়া শেষে বেড়াতে বেরোলাম। চৌকোড়ী হয়তো একসময় নির্জন ছিল। এখন বেশ হোটেলটোটেল গজিয়েছে। বেশিরভাগই ফাঁকা। যা লোক সব কে এম ভি এন-এ। বৃষ্টির বাজারে রাস্তাতেও বিশেষ লোক নেই। খালি বাদামি লোমওয়ালা মোটাসোটা একজন একখানা অর্ধেক তৈরি বাড়ির বারান্দায় মুড়িশুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছিল, আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই উঠে এসে ফাঁকা রাস্তায় আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলল। 

হাঁটতে হাঁটতে আমরা পরবর্তী কর্মপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করলাম। আমরা একবার ভেবেছিলাম গাড়ি নিয়ে যাব এদিকসেদিক, পাতাল ভুবনেশ্বর, কিন্তু সত্যি বলতে এনার্জি কিংবা ইচ্ছে কোনওটাই টের পাচ্ছিলাম না। পাতাল ভুবনেশ্বর হচ্ছে ভূগর্ভস্থ গুহাসিস্টেম, সেখানে পাথরে নানারকম দেবদেবী রাক্ষসখোক্কসের ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠতে দেখা যায়। সাপের খোলসও নাকি আছে। একজন গাইড থাকেন, সব ব্যাখ্যা করে দেন। গোটা গুহাটা নাকি ইলেকট্রিক লাইট দিয়ে সাজানো। ব্রেনস্টর্মিং করে অবশেষে ঐকমত্যে পৌঁছলাম যে গুহার থেকে হোটেলের খাট আর এই পাহাড়ের ফাঁকা রাস্তা আমাদের বেশি লোভনীয় ঠেকছে। 


দুপুরে খাওয়ার পর অন্যদিকে হাঁটতে বেরোলাম। এদিকটা বেশিরভাগই জঙ্গল। পাথর ফেলা রাস্তা নেমে গেছে পাহাড়ের গা দিয়ে। পুরোটাই উতরাই। আমরা প্রথমে নামব না ঠিক করেছিলাম কারণ উঠতেও হবে, তারপর একটা হাম্বাহাম্বা হাসি শুনে ঘাড় তুলে দেখি একটা গরু ঘাস খাচ্ছে আর ফ্যাচফ্যাচ করে হাসছে আমাদের দেখে। খানিকটা ওকে দেখিয়ে দেওয়ার জন্যই নামতে হল।


ভালো লাগছিল বেশ। জঙ্গলের মাঝখানে আচমকা বাড়ি। বাড়ির চাতালে নেহরু টুপি মাথায় দেওয়া এক বয়স্ক ভদ্রলোক গান ধরেছেন। কথা বিশেষ নেই, সুর আছে। তারপর বুঝলাম ওটা গান না, ওটা হচ্ছে ওঁর পোষ্যদের সঙ্গে কথা বলার ভাষা। পোষ্যরা বেশিরভাগই গোমাতা। ছাগলও আছে, তবে কম। ভদ্রলোক গান গাইছেন আর জঙ্গলের এ কোণ ও কোণ থেকে সাদা কালো বাদামী খয়েরি মোটা মোটা গরুরা নেমে আসছে। গরুদের দেখলে যতটা আনফিট মনে হয় ততটা ওরা নয়। এ আমি পাহাড়ে বেড়াতে না গেলে বুঝতাম না। 

নামব না নামব না করতে করতে প্রায় ঘণ্টাখানেকের পথ পার হয়ে গিয়েছিল। উঠতে প্রাণান্ত হল ঠিকই, কিন্তু দুপুরের খাবার হজমও হল। বাঁচা গেল, ভেজ পকোড়া মিস হবে না। কে এম ভি এন-এ একটা ঢ্যাঙা ওয়াচটাওয়ার আছে তার ওপর উঠে খানিকক্ষণ জিরোলাম, তারপর লেমন টি আর ভেজ পকোড়ার পিছু পিছু ঘরে চলে গেলাম। সত্যি বলতে মন অনেকক্ষণ ধরেই যাই যাই করছিল। গল্পটা একটা দারুণ ইন্টারেস্টিং জায়গায় ছেড়ে এসেছি।

ব্যস, হয়ে গেল আমাদের বিশ্রামপূর্ণ চৌকোড়ী ভ্রমণ। পরদিন ভোর সাড়ে ছ’টায় টা টা বলে কে এম ভি এন থেকে বেরিয়ে পড়লাম। চৌকোড়ী ছেড়েই উদিয়ারি মোড়, থেমে এলাচ দেওয়া চা খেলাম। তারপর দীর্ঘ নামা শুরু হল। পাহাড়ের কোলে কোলে তখনও সাদা কুয়াশা আটকা পড়ে আছে, জঙ্গলের সবুজ ক্রমে ছায়া থেকে আলো হয়ে উঠছে। আবার কবে এ দৃশ্য দেখব। আবার কবে ভোলেবাবা ডাকবেন।

ওহ, আলমোড়া ঢোকার একটু আগে চিতই গোলু দেবীর মন্দিরের উল্টোদিকে আলুপরোটা খাওয়ার জন্য থেমেছিলাম। তন্দুরে সেঁকা আলুপরোটা আগে খাইনি কখনও। এর পরে কোথাও পেলে যে আবার খাব সন্দেহ নেই। আপনারাও পেলে ছাড়বেন না।



Comments

  1. Khub bhalo laglo...berate giye ei 'list check' korar byapar ta majhe majhe khub tiring hoye jay.. nije nije kothao hete jaoa i onek somoy best lage.. ar amra ta sobai pray NCR theke weekend trip ei jai..tai ek-du diner besi thakao hoyna...

    Tomar HK er Lama kitchen bhalo legechhe shune khub bhalo laglo..Gurgaon te ar kono hidden gem khuje paoa khub tough :( Tumi ekbar cyberhub ese dekhte paro..hoyto Burma Burma, Viet-nom, Cicchetti esob bhalo lagte pare :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, রণদীপ। সত্যি, বড় ছুটি নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার অভ্যেসটাই চলে গেছে। ছোটবেলায় কেমন পনেরোদিনের ছুটিতে যাওয়া হত। এখন পনেরোদিন ছুটি নেওয়ার কথা কল্পনা করলেই হৃৎকম্প, যদিও অকারণ।

      আমি সাকেতের বার্মা বার্মা-তে খেয়েছি, মচৎকার। যদি ওদিকে যাওয়া হয় কখনও ভিয়েত-নমে যাওয়ার ইচ্ছে রইল। আমার অন্যতম ফেভারিট কুইজিন।

      Delete
  2. Bah. Chimcham ghora.

    Ekhon to amar pray i Delhi jaoa hoy, protibar i bhabi kachepithe kothao dhnu marbo, kintu haridwar aar dehradun-musoorie baad e kothao i jaoa hoyni. aar ei jaygagulo chotobyala teo gechi. Ichhe ache Gushaini aar Choukori jaoar. Raju's cottage er tripadvisor page je kotobar khule dekhe bondho korechi, Raju bhai janle boro maaper discount dite pare.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, রাজু ভাইয়ার ডিসকাউন্ট দেওয়া উচিত, সুমনা। ওঁর আবাসের মতো চালু আবাস হিমালয়ে দুটি আছে কি না সন্দেহ।

      Delete
  3. Onek din por apnar prolap porte aslam :)

    Ar esei Choukori er golpo pore besh moja laglo ... Keno bolun tow ?? Ei Srirampore theke otodur gechhilam poshaki bhashar honeymoon e. Koto chhoto chhoto katha mone pore gelo.


    Apnar 4no platform er golpotao bejay bhalo.
    10 bochhor purno korar jonnyo Abantor ke onek shuvecha.

    Bhalo thakben...

    ReplyDelete
    Replies
    1. শ্রীরামপুর? আত্মদীপ?

      চৌকোড়ী কমন পড়ায় হাই ফাইভ। মধুচন্দ্রিমাটা অবশ্য কমন পড়েনি, ওটা আমাদের শিলং-এ হয়েছিল। আরও কোথাও গিয়েছিলেন চৌকোড়ী থেকে, নাকি ওখানেই ছিলেন?

      চার নম্বরের গল্প ভালো লেগেছে জেনে খুশি। জন্মদিনের শুভেচ্ছা পেয়েও। থ্যাংক ইউ।

      Delete
    2. :)Ekdom thik ... Amra choukori theke Munsiari jabar plan korechhilam. Kintu borof er jonnyo rasta bondho chhilo ... tai firey esechhilam Nainitaal e.:(

      Delete
  4. আমার এরকম বেড়ানো বেশ পছন্দ। দুঃখের বিষয় বেড়ানোর সময়ে দেখা যায় আমিই সাইট সিইং-এর পিছনে দৌড়ে বেড়াচ্ছি। তবে কোথাও দ্বিতীয়বার গেলে অবশ্যই এরকম বেড়াই। কি বই পড়লেন?

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওই সময় আমি রুথ ওয়্যারের ট্রিপে ছিলাম সম্ভবতঃ, সুগত।

      Delete

Post a Comment