রিচুয়াল



থ্যাংকসগিভিং আর ক্রিসমাসের আশেপাশে আমেরিকা অধ্যুষিত ইন্টারনেটে নানরকম পোস্ট ঘুরে বেড়ায়। বিশেষতঃ থ্যাংকসগিভিং-এর আশেপাশে। খাওয়াদাওয়া রান্নাবান্না রেসিপি ইত্যাদি তো কমন বিষয়, আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে ঝগড়া না বাধিয়ে কথোপকথন চালানোর টিপস, সম্ভাব্য বিষয়ের লিস্ট ইত্যাদির বাজারও তেজী।

অন্যদের সবকিছুই বাড়াবাড়ি মনে হয় -  এই যে আমাদের বাড়িতে এখন জন্মদিনে কী কী মজা করা যেতে পারে অষ্টপ্রহর গবেষণা চলছে, কানে গেলে আমার ঠাকুরদা বাড়াবাড়ির চূড়ান্ত বলে মাথা নাড়তেন - তবু স্বীকার করছি প্রাপ্তবয়স্কদের কথা বলার টপিকের লিস্ট নিয়ে ঘোরাঘুরি আমার বাড়াবাড়ি বোধ হয়। ওরকম লিস্ট ধরে টপিক বেছে কথা বলতে গেলে কথোপকথনটা কেমন হবে সেটাও, সম্ভবতঃ কল্পনা করতে পারি না বলেই, মহা অস্বস্তিজনক ঠেকে। 

নিষিদ্ধ বিষয়ের লিস্টে চমকহীন প্রথম বিষয় পলিটিক্স। আমার মাথার ভেতর নিষিদ্ধ বিষয়ের লিস্টেও পলিটিক্স সর্বাগ্রে। ঝগড়া বাধানোতে পলিটিক্সের থেকে কার্যকরী আর কিছু নেই। ইঞ্চি মেপে রাজনৈতিক অবস্থান যাদের সমানসমান, যেমন আমার আর অর্চিষ্মানের, পলিটিক্স তাদেরও সেন্টিমিটার পরিমাণ বিভেদ বার করে দিতে পারে। একমাত্র আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মোনোলগ না চালালে ঐকমত্যের চান্স নেই।  

অনেকে বলবেন, কে বলেছে ঝগড়া না করে পলিটিক্স নিয়ে কথা বলা যায় না? দিব্যি যায়। আমি জানি যায়, আমি নিজের অপারগতার কথা বলছি। নিজের এই দুর্বলতাটা আমি অনেক পরে আবিষ্কার করেছি এবং অবশেষে রাজনীতিসংক্রান্ত আলোচনায় মৌনব্রত ধারণের শপথ নিয়েছি। শপথ নিয়েছি বলেই কিছুদিন আগের একটা লজ্জাজনক অভিজ্ঞতার কথা স্বীকার করছি। কারণ জানি ও ঘটনা আর ঘটবে না। আমাদের এক ঘনিষ্ঠ পরিচিতের হার্নিয়া না কী অপারেশন হয়েছিল। মফস্বলের গলির নার্সিং হোম, ভিজিটিং টাইমে একটাই গোলাপি স্লিপ নিয়ে দুজনের বদলে ছ’জন ঢুকেছি। রোগী ততদিনে অনেকটা সেরে উঠেছেন, কথাবার্তা চলছে। ঘরে আরও দু’খানা বেডে আরও দুজন রোগী, তাঁরাও ছুটির পথে। ভবসাগর থেকে নয়, নার্সিংহোম থেকে।

কথা ঘুরতে ঘুরতে কী করে যেন পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে গিয়ে পড়ল। শুরুতে সকলেই বুঝে খেলছিলেন, তারপর গলা চড়ল। বাকি দুই বেডের রোগী এবং ভিজিটররা আড়চোখে তাকাতে লাগলেন। কিন্তু একবার পিক আপ নিয়ে ফেললে অত সহজে কি আর ব্রেক কষা যায়। শেষে রোগীশুদ্ধু সকলে চিৎকার করতে লাগল, আশেপাশের বেডের রোগী এবং ভিজিটররা ফোড়ন কাটতে লাগলেন আর আমি আর না পেরে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বললাম, এই চললাম। আর এক মুহূর্তও আমি এখানে থাকব না।

সবাই, রোগীশুদ্ধু, হাত ধরে টেনে বসাল। আমার মাথা ঠাণ্ডা করতে গিয়ে দু’দলের মধ্যে ভাব হয়ে গেল, সবাই দাঁত বার করে হাসতে লাগল, অন্য খাটের রোগী আর ভিজিটররাও। আমরা নিশ্চিত ছিলাম কেউ এসে আমাদের কান ধরে বার করে দেবে কিন্তু কেউই এল না। পরে শুনেছিলাম দিনের দ্বিতীয় রাউন্ড দিতে এসে ডাক্তারবাবু আমাদের রোগীকে দেখে চমৎকৃত হয়েছিলেন। বাঃ, আপনি বারোঘণ্টাতেই দারুণ উন্নতি করেছেন তো। ফ্যাকাশে মুখে বেশ রক্তাভা ফুটেছে, কাহিল শরীর চনমনেত্ব জেগেছে।

পলিটিক্সের এত বদনাম করছি কিন্তু ঝগড়া লাগবে না, বা ঝগড়া লাগানো যাবে না এমন কোনও টপিক আদৌ জগতে আছে কি না সেটাও ভাবার বিষয়। একটা লিস্টে দেখলাম থ্যাংকসগিভিং টেবিলে সম্ভাব্য শান্তিপূর্ণ কথোপকথনের বিষয় হিসেবে রাখা হয়েছে "স্পোর্টস"। এঁরা কারা? কোন জগতে বাস করেন? ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান, ফুটবল ক্রিকেট,  ইন্ডিয়া পাকিস্তান, গাভাসকর কপিল, গাঙ্গুলি তেণ্ডুলকর এ সব নিয়ে কত বন্ধুবিচ্ছেদ হয়েছে, কত রক্তগঙ্গা বয়েছে খবর রাখেন না নাকি?  

এতদিন তবু ওয়েদার নিয়ে কলহবিহীন কথোপকথন চালানো যেত, গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর যুগে সে সুখও ঘুচেছে। প্রথমতঃ, গ্লোবাল ওয়ার্মিং আদৌ ঘটে কি না সে নিয়ে দ্বন্দ্বসৃষ্টির অবকাশ আছে, যাঁরা সে সংশয় পার হয়ে এসেছেন তাঁদের মধ্যেও এই ক্রাইসিস ঠেকাতে সমষ্টিগত অবস্থান বনাম ব্যক্তিগত ব্যবস্থাগ্রহণের উপযোগিতা নিয়ে কাকচিল তাড়াতে দেখেছি আমি নিজে।  

ঝগড়া না বাধাতে হলে বিষয় ব্যান করার থেকে জরুরি এবং সত্যি বলতে একমাত্র ফুলপ্রুফ ব্যবস্থা হচ্ছে ঝগড়ুটে না হওয়া। বিষয়ের লিস্টের বদলে টেবিলের চারপাশে ‘গোপাল অতি সুবোধ বালক, সে অন্যান্য বালকদের সহিত কদাপি কলহ করে না,’ বা ওঁদের যা কাউন্টারপার্ট যা আছে, থাকতে বাধ্য, তার প্রিন্ট আউট নিয়ে বিলি করলে যদি ঝগড়া এড়ানো যায়। 

ব্লগফিডে সফল হলিডে সিজন যাপনের আরেকটা টোটকা দেখলাম, উৎসবভিত্তিক রিচুয়াল তৈরি করা। মানে থ্যাংকসগিভিং-এ ট্যাবু আর ক্রিসমাস ইভে পিকশনারি, কিন্তু উল্টোটা কখনওই নয়, সেই রকম রিচুয়াল। আমার এক দিশি বন্ধুর কথা মনে পড়ে গেল, যে বলেছিল, এরা খুব ভালো নাম দিতে পারে। বাবার সঙ্গে কফি খেতে যাবে, রিচুয়াল। মায়ের সঙ্গে চালডাল কিনতে মুদির দোকান যাবে,  রিচুয়াল।

সেরকম ভাবে দেখতে গেলে থ্যাংকসগিভিং-এ গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করাও রিচুয়াল বলে ধরে নিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। যাকগে, এই সব পড়তে পড়তে আমারও আমার জীবনের রিচুয়ালগুলো মনে পড়ে গেল। যেগুলোকে তখন ‘রিচুয়াল’ বলে চিনতে পারিনি। প্রতিদিনের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা বলে তুলোয় মুড়ে রাখার প্রয়োজন বোধ করিনি।

দরজা খুলেই কী এনেছ? থেকে শুরু করে মামাবাড়ি থেকে ফেরার পথে রথতলা হাওড়া মিনিবাস থেকে প্রাণ হাতে করে নেমে লিমকার বোতল হাতে ব্রহ্মতালু জ্বালানো প্রথম ঢেঁকুরখানার জন্য চোখনাক কুঁচকে অপেক্ষা, লোডশেডিং-এর রাতে মাদুরে শুয়ে তারাভরা নীল আকাশের ভিউতে হাতপাখার ছন্দোবদ্ধ ইন্টারাপশন - গোটা জীবনটা আমার রিচুয়ালে রিচুয়ালে ছয়লাপ। 

এই বুড়ো বয়সেও কত যে রিচুয়াল ছিল। বেলা তিনটে নাগাদ যখন হাই চেপে চেপে চোখে জল, পাওয়ার ন্যাপের জন্য প্রাণ আকুলিবিকুলি, ফোন তুলে বলতাম, আরেকটু হলেই তিনে কত্তি তিন কেস হয়ে যাচ্ছিল, বুঝলে।

মা বলতেন, হ্যাভ আ কাপ অফ টি বাবু।

এখনও রোজ তিনটে বাজে, রোজ হাই ওঠে, রোজ উঠে চা খেতে যাই। রোজ চায়ে চুমুক দিতে দিতে মাথার ভেতর আমাদের সেই রিচুয়ালের রেকর্ডখানা বাজাই। আমার স্থির বিশ্বাস, চায়ে নয়, ঘুমটা ওতেই কাটে।


Comments

  1. সব কিছু নিয়ে কমেন্ট করা যায় না, মানে আমি পারিনা ...এ লেখার শেষের বিষাদটাও তাই । ভাল থেকো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, প্রদীপ্ত। তুমিও ভালো থেকো। তাড়োবা সেকেন্ড পার্টটা আয়েশ করে পড়ব বলে জমিয়ে রেখেছি। আজকালের মধ্যেই ফাঁক পেয়ে যাব আশা করি।

      Delete
    2. আরে থ্যাংক ইউ । আমার ব্লগ মনে হয় আমি ছাড়া তুমিই এক্সেস করো :D

      Delete
  2. last line ta ar konko comment korte dilona

    ReplyDelete
  3. debasri.chakrabarti@gmail.comDecember 12, 2019 at 1:08 PM

    बीती हुई बतियाँ कोई दोहराये भूले हुए नाम से कोई तो बुलाये....এই লাইনটাই মনে পড়লো শেষের অংশটুকু পড়ে

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই গানটা আমার ভীষণ প্রিয়, দেবশ্রী।

      Delete
  4. politics er medical gunn ta dekhanor jonne dhonnyobaad - beparta pholiye dekhar sujog er opekkhay roilaam.
    aar sotti, 'weather' ta etodin safe bishoy chhilo, ekhon eta-teo torko shuru hoy.
    chhotobelay dorja khulei 'amar jonne ki enechho'-r ekta obbhyesh amaar-o chhilo, sei smriti ta mone pore gelo.

    ReplyDelete
    Replies
    1. দরজা খোলা বাচ্চাদের ওটা ইউনিভার্সাল প্রশ্ন বলেই আমার বিশ্বাস, রাজর্ষি।

      Delete
  5. Shomporker prothom 8 bochhor amader rirual chhilo roj raat 9tay phone. Tarpor 12 bochhorer ritual chhilo oi 9ta/10ta nagad bari dhokar agey phone kore jigesh kora alu/pauruti/eggroll ityadi kichhu lagbe kina. Meyer sathe roj raater ritual chhilo ghumonor agey baap-beti tey entar bajey boka, haha hihi. Aj der mash holo ami shei ritual er proxy dewar bajey cheshta korchhi meyer shamne.
    Ei ritual gulo toiri kore jara kichhu na bole hothath chole jay tader ki shashti dewa uchit bolun to?

    ReplyDelete
    Replies
    1. কী আর শাস্তি দেবেন ঈপ্সিতা, তারা তো সব মায়া কেটে পালিয়েছে। রিচুয়ালের স্মৃতি নিয়ে বসে থাকা, আর যথাসম্ভব সে রিচুয়াল নিজের দিক থেকে পালন করা, যা আপনি করে চলেছেন, ছাড়া আর তো কোনও উপায় দেখি না।

      Delete
  6. "বাবার সঙ্গে কফি খেতে যাবে, রিচুয়াল। মায়ের সঙ্গে চালডাল কিনতে মুদির দোকান যাবে, রিচুয়াল।"
    - অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি :)
    শেষের বিষাদ টুকু লেখার গুনে মুগ্ধ করলো,ওই রিচুয়াল গুলোই বাঁচিয়ে রাখে আমাদের।

    ReplyDelete

Post a Comment