এসে গেছে!



অর্চিষ্মান দিল্লিতে নেমেছে। এরোসিটির কোয়ারেনটাইন হোটেল — আপাতত অর্চিষ্মানের হোম অ্যাওয়ে ফ্রম হোম। চোদ্দ সাতদিনের বাধ্যতামূলক বনবাস। আমার মুণ্ডুর ওজন কিলো পাঁচেক কমে গেছে, শিরদাঁড়ার গাঁট খুলে গেছে, অফিস যাওয়ার আগে যে গানগুলো শুনতে শুনতে রেডি হতাম, সেগুলোও পর্যন্ত ইউটিউবে ফের শুনছি। কারণ আমাদের টিভি খারাপ হয়ে গেছে।

বাই দ্য ওয়ে, লিংকে ক্লিক করার আগে হেডফোন জোগাড় করে নিলে ভালো।

রীতা, গীতাদি আসা শুরু করেছেন মাসের শুরু থেকেই। আমি আবার সারা-সকালের হাফ শবাসনে (মাথাটা বালিশ উঁচু করে ঠ্যাকনা দেওয়া) ফিরে গেছি। রান্নার বদলে ফ্রিজ খুলে খাবার পাচ্ছি। গায়ের আরামটাকে অস্বীকার না করেই বলছি, মনের আরামটাও কম নয়। বাবাকাকা থাকার দরুন আমাদের প্রাতঃকালীন চা-সভা বসছিল না এতদিন, এখন বসছে। খবরের কাগজ পড়ে লোকে দেশেরদশের খবর পায়, আমি ওই দশ মিনিটে পাড়ার সবার হাঁড়ির খবর জোগাড় করি (আমার খবরও ওই ফাঁক দিয়েই বাইরে যায়; সে নিয়ে আমার সন্দেহ কিংবা আপত্তি কোনওটাই নেই)। আমার ভালো থাকায় সকালের ওই দশ মিনিটের চায়ের আড্ডার (যা অনেকসময় তর্কাতর্কিতেও পর্যবসিত হয়) অবদান আগে বুঝিনি।

অর্চিষ্মান দিল্লিতে নামার পর থেকে ফুল চাঙ্গা বোধ করছি। এবার সব একধারসে নামিয়ে ফেলব। পেপার, উপন্যাস, বাড়ি পরিষ্কার। চারমাস আগে অর্চিষ্মান টাটা বলে ট্যাক্সিতে ওঠার পর ভেবেছিলাম নেক্সট তিনমাসে জীবনের সব স্বপ্ন পূর্ণ করে ফেলব। করোনা এসে সে প্ল্যান মাটি করল। ওয়ার্ক ফ্রম হোম চালু হওয়ার পর ভাবলাম এই সুযোগ। লকডাউন শুরু হল, শেষ হল। বাবাকাকা চলে যাওয়ার পরও সাতদিন কেটে গেছে, কিছুই করিনি, কারণ অর্চিষ্মানের ফেরা নিয়ে ফুলটাইম টেনশন করছিলাম। এইবার অর্চিষ্মান দিল্লি এসে গেছে, আর চিন্তা নেই। এবার আমার কাজের স্রোত কেউ আটকাতে পারবে না।

অর্চিষ্মানের আসার অভিজ্ঞতা ভালোই। গলাকাটা দাম নিয়েছে, কিন্তু ভ্যালু ফর মানি। প্লেনে ওঠা নিশ্চিত করতে ওইরকম ঠাণ্ডা মাথার ছেলেরও ঘাম ছুটে গিয়েছিল, কিন্তু ওঠার পর থেকে গোটা ব্যাপারটা কেকওয়াক। চল্লিশ জন প্যাসেঞ্জারের জন্য দশ জন ইমিগ্রেশন অফিসার। হোটেলে বেলায় বেলায় পর্যাপ্ত, রকমারি খাবার। চুয়াল্লিশ ডিগ্রির দিল্লিতে ফুল ব্লাস্ট এসি। টিভিতে অবিরাম ডাবড তেলুগু সিনেমা।

আমারও বহুদিন পর চান করতে করতে গান। ভুলে যাওয়া ছাতুর বয়াম আবিষ্কার করে কাঁচালংকা লেবু নুন দিয়ে মেখে হুসহাস খাওয়া। অস্ট্রেলিয়ান পুলিস প্রসিডিওরাল মার্ডার কল-এর সিজনের পর সিজন গিলতে গিলতে, ফোনে রি-ইন্সটল করা ক্যান্ডি ক্রাশ খেলতে খেলতে দিনের টু ডু লিস্ট নিয়ে আলগোছে প্ল্যানিং। কাঁচা আমের ডালের শেষটুকু ভাতে ঢেলে নিতে নিতে ভাবা, কাল গীতাদিকে বলব ফ্রিজের উচ্ছে দিয়ে তেতোর ডাল বানাতে। টক আর তেতো, গরমের মোকাবিলায় আমার কবচ আর কুণ্ডল।

টুং টাং টুং টাং। ল্যান্ডলাইন কিংবা মোবাইল, আর কোনও কিছু বাজলেই, নম্বর দেখার আগে বোঝা যায় না কে করেছে। কিন্তু  গুগল হ্যাংআউটের এই আওয়াজটা হলেই বুঝে যাই কে আমাকে ফোন করেছে। কারণ এখানে আমাকে আর কেউ ফোন করে না।

কী করছ, কী খাব, কী মজা করব, কে কোথায় কী বোকামো করছে-র পর টাটা বলার আগে অর্চিষ্মান খবরটা দিল। এ বাজারে মামুলি খবর। কোথায় যেন ব্রিজের তলায় মানুষ বসে আছেন। পাঁচদিন ধরে। নিজের দেশে এ রাজ্য থেকে ও রাজ্যে যেতে পারছেন না। হয়তো মোটে কয়েকশো মাইলের রাস্তা। সমুদ্রপাড়ির হাঙ্গামা নেই। ভিসা লাগে না। পাসপোর্টের দরকার নেই। তবু যেতে পারছেন না। খাবার নেই, জল নেই, অনুমতি নেই।

এই জন্য আমি খবর শুনি না, দেখিও না। আমার ওষুধ খেয়ে ভালো রাখা তুলতুলে মন বিচলিত হয়। এতদিন বাদে আমার এত কষ্টে অর্জন করা হকের শান্তি টলোমলো। প্রাণপণ এড়াতে চাওয়া সত্ত্বেও নিজের প্রিভিলেজের দিকে চোখ পড়ে যাওয়া।

চোখ পড়েই বা কী হবে। এমন তো নয় আমি আমার প্রিভিলেজের পাহাড় থেকে নেমে কারও জন্য একচিলতে কিছু করব। সেটা যখন করব না, তখন স্রেফ মন খারাপ করাটা সময় নষ্ট। অনেকদিন আগে একটা চুটকি পড়েছিলাম কোথায়। জেনারেলাইজেশন, কিন্তু জোক মাত্রেই জেনেরালাইজেশন। মোল্লার দৌড় যেমন মসজিদ অবধি, লিবারেলের দৌড় তেমন “ফিলিং ব্যাড” পর্যন্ত।


Comments

  1. খুব ভালো খবর। ভালো থেকো দুজনেই।

    মনখারাপের এই কি শেষ? এবার বারে বারে ওইটাই মনে হচ্ছে। মাথার উপর শক্তপোক্ত ছাদ সত্ত্বেও দু তিনদিন কি অসহায় লাগছিলো.... আর যাদের কথা তুমি বলেছ তাঁদের জন্যে ভাবলেই কষ্ট হচ্ছে।

    গানগুলো কিন্তু জব্বর। :-D

    ReplyDelete
    Replies
    1. - ইচ্ছাডানা

      Delete
    2. গানগুলো ভালো কি না, বলুন?

      Delete
  2. Replies
    1. কী যে আরাম লাগছে, কী বলব।

      Delete
  3. Baah khub bhalo khobor....aapnara bhalo thakun.

    Susmita

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ সুস্মিতা, ধড়ে প্রাণ এসেছে, এইবার আরাম করা যাবে।

      Delete
    2. Haan ekdam relax korun eibar. Aar sundar sundar lekha share korun amader sathe...

      Delete
    3. হাহা, যা বলেছেন।

      Delete
  4. Heading dekhei bhalo khobor ta bujhte perechi...relax koro.. Mon halka howa ei time e sobtheke kajer kaj.. ashona gan ta sunechilam aj prothom video dekhlam.. ��
    Khobor dekha sotti khub e baje ajkal tar modhyeo tuktak bhalo lage.. bridge er tolar kichu lok ke jokhon Sonu sood je Salman Khan er kache mar khawa villain hisebe porichito bus e kore bari ferar babostha kore dicche ei sob khobor dekhi..

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভালো খবর যদি বেছেবেছে দেখা যেত তাহলে আর কোনও সমস্যাই থাকত না রে ঊর্মি। কিন্তু একটা ভালো খবরের ফাঁক দিয়ে নিরানব্বইটা ভয়াবহ খবরও ব্রেনে ঢুকে পড়ে যে, সেই জন্য আমি ভালোমন্দ দুইই বাদ দিয়েছি। তোরা সবাই ভালো আছিস আশা করি?

      Delete
    2. Hya thik.. percentage ta erokom e... Amra ekhono obdhi thik achi go..

      Delete
  5. কদিন বাদে খুলে অবান্তরের ভালো খবর পেলাম | তোমার লেখার মধ্যে মনের ফুরফুরে ভাব পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে | এতদিনের বিরক্তি সব উধাও| শেষের লাইনটা মোক্ষম | এখন রোজ ভালো ভালো লেখা দাও|
    তোমার বাড়ির লোক ফিৱে এলো আর আমার বাড়ির ছেলে অনেক দূরে ইন্টার্নশিপ করতে গেল|

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওহ, তার মানে কি ধীরে ধীরে সব খুলতে শুরু করেছে আপনাদের ওদিকে, অমিতা? এই সময় দূরে যাওয়া খুব চিন্তার, তবে সব ঠিকই থাকবে আশা করি।

      Delete
  6. এখানে তো দেশের মতো এত কড়াকড়ি কখনো হয়নি তবে বন্ধ ছিল ঠিকই প্রায় সব কিছু| এখন আস্তে আস্তে খুলছে আর তাতে পক্ষে আর বিপক্ষে দুদিকেরই অনেক বক্তব্য প্রতিবাদ ইত্যাদি আছে| সাউথে আরো আগে খুলতে শুরু করেছে আর আমার ছেলে সেখানেই গেছে আর আরো তিনজনের সাথে এক বাড়িতে থাকছে| সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিঙ বাড়িতে বা কাজে কোথাও হচ্ছেনা| তবে চিন্তা করে তো লাভ নেই|
    আমাদের মারিয়াকে এখনো আসতে বলিনি, কবে শুরু করা ঠিক হবে বুঝতে পারছিনা|

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওহ। সত্যি বলতে আমার এখন বেশি চিন্তা হচ্ছে, অমিতা। বাবাকাকা বাড়ি গেছেন, ওদিকে পশ্চিমবঙ্গে যেটুকু যা সিরিয়াসনেস ছিল করোনাসম্পর্কিত, এই আম্ফানে সব উড়ে গেছে। বাবা বলছিলেন, অর্ধেক লোকের মাস্ক নেই, সবাই একে অপরের ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে বাজার করছে। কী যে হবে ভগবানই জানেন। আমি তো ফাটা রেকর্ডের মতো দুবেলা আউড়ে যাচ্ছি, মাস্ক পরবে আর ভিড়ের মধ্যে যাবে না।

      কী সব হার্ড ইমিউনিটির গল্প শুনছিলাম, সেই গ্রো করার অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই মনে হচ্ছে।

      Delete
  7. তোমার বাবা আর কাকা দুজনেই এসে ছিলেন তোমার কাছে? বুঝতেই পারছি কত চিন্তা হচ্ছে ওনাদের জন্য তোমার| সবাই নিজের সাবধান হওয়া ছাড়া আর কি করার আছে | কিন্তু একটা সময়ের পর আমারই মনে থাকছে না প্রত্যেকবার বাজার করে স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে, নরম্যালাইজ হওয়া কাকে বলে বুঝতে পারছি!

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওঁরা ল্যান্ডোর বেড়াতে বেরিয়েছিলেন, অমিতা। ফেরার পথে আমার বাড়ি দুদিন থাকতে গিয়ে দুমাসের জন্য লকডাউনে ফেঁসে গেছিলেন। খুবই বিশ্রী ব্যাপার। একশোবার টিকিট কাটা, ক্যান্সেল, টাকা ফেরত না পাওয়া, নাস্তানাবুদের একশেষ হয়েছেন। তারপর বাড়ি গিয়ে পৌঁছেছেন আম্ফানের দিন। ভাবুন। যাই হোক, এখন সব শান্ত।

      Delete

Post a Comment