বইপড়ার মাঝবছরের হিসেবনিকেশ



বুকটিউবে নানাবিধ খেলাধুলো চলে সারা বছর। বছরের শেষে প্রিয় বই, বছরের শুরুতে মোস্ট এক্সপেক্টেড বই ইত্যাদি নিয়ে ভিডিওর বন্যা। বছরের মাঝমাঝির এই গয়ংগচ্ছ মাসকয়েকের জন্যও বুকটিউব নানা খেলাধুলোর জোগাড়যন্ত্র করে রেখেছে। যেমন মিড-ইয়ার বুক ফ্রিক আউট ট্যাগ।

ফ্রিক আউট কেন? সব বছর তো ২০২০-র মতো হয় না, সারা বছরই ফ্রিক আউট; অন্যান্য বছরে, এই তো মুড়ি খেতে খেতে স্টার আনন্দে তারকাদের সাক্ষাৎকার দেখতে দেখতে নতুন বছর আহ্বান করলাম", অলরেডি বছরের হাফ ফুরিয়ে গেল, মৃত্যুর দিকে আরও ছ'মাস এগিয়ে গেলাম, রেজলিউশনের লিস্ট এখনও ছুঁয়ে দেখা হল না, এই সব কারণে ফ্রিক আউট হয়েই থাকে। 

খেলায় গোটা পনেরো ষোলো প্রশ্ন আছে। আমি আমার সাইজমতো কেটে ছেঁটে নিয়েছি। যেমন একটা প্রশ্ন ছিল সেরা সিকোয়েল কী পড়েছ। বুকটিউবের মাস্তান হচ্ছে ইয়াং অ্যাডাল্ট সাহিত্য। সে ঘরানায় মিনিমাম তিন বইয়ের সিরিজ ছাড়া বই প্রায় দেখাই যায় না। অধিকাংশ গল্পই চলে পাঁচ বা সাত বই ধরে। আমার মতো বুড়ো পাঠকদের অত ধৈর্য নেই, স্ট্যান্ড অ্যালোন ছাড়া পারতপক্ষে ঘেঁষি না। এ বছর তাও একখানা সিকোয়েল পড়ে ফেলেছি, মার্গারেট অ্যাটউডের 'দ্য টেস্টামেন্টস'। ব্যস, ওই একখানি। কাজেই বেটার ওয়ার্স হিসেবে যাওয়ার সুযোগ নেই। 

তারপর ধরুন আরেকটা প্রশ্ন, ফেভারিট ক্যারেকটার/ক্যারেকটার ক্রাশ। চরিত্রকে সত্যি ভেবে নেওয়া, নিয়ে তার প্রেমে পড়া, এই সব ম্যাজিকাল সময় অনেকদিন গত হয়েছে। এখন ক্যারেকটারের বর্ণনায় চেহারার চিকনত্ব টের পেলেও, বা কথাবার্তায় মারাত্মক গভীরতা নয়তো জ্বলন্ত চতুরতা, হাত পুড়িয়ে বুঝেছি, এ সবই প্রেমে পড়ার ক্রাইটেরিয়া হিসেবে সমান খুঁতো। প্রেম করতে হলে ভদ্রলোকের সঙ্গে করা উচিত। আর একটা লোক ভদ্রলোক কি না, সেটা, ওয়েল, দুঃখজনক ভাবে সামনে থেকে ঘুরিয়েফিরিয়ে না পরখ করলে বোঝা অসম্ভব। গল্পের বইয়ের পাতায় তো আরওই অসম্ভব। তাছাড়া ভদ্রতা যেহেতু নায়কোচিত কোয়ালিটি নয়, কাজেই লেখকরা সে বিষয়ে আলোকপাত করেন না। খালি কে কত জানে আর কে কেমন দেখতে আর কে কত বলিয়ে কইয়ে। ব্যস।

কাজেই ওই প্রশ্নও আমার ক্ষেত্রে অবান্তর। বাকি প্রশ্নগুলোর উত্তর এই রইল।

১। ২০২০য় এখনও পর্যন্ত ক'টা বই পড়েছ? 

সাতাশটা।

২। সবথেকে বেশি কী ধরণের বই পড়েছ?

একটা লিটারেরি, একটা ডিসটোপিয়ান, একটা সাই-ফাই বাদ দিয়ে চব্বিশখানা বইই আমি পড়েছি রহস্যরোমাঞ্চ গোত্রের। চুল চিরতে বসলে তার মধ্যে কোজি, কিশোরোপযোগী, প্যাস্টিশ, নোয়্যার হ্যানাত্যানা বেরোবে, কিন্তু মোটের ওপর সবই খুনখারাপি, চুরিছিনতাই, থানাপুলিস। 

৩। এ বছরের পড়া সেরা বই 

Olga Tocarzuk-এর Drive Your Plough Over The Bones of the Dead। 



৪। সবথেকে হতাশ কোন বই পড়ে হয়েছ?

যদি আমাকে জিজ্ঞাসা করা হত সবথেকে বাজে কোন বই পড়েছ তাহলে আমি গত মাসে পড়া সেই বইটার নাম বলতাম, যেটা একশো পাতা পড়ে পাতা উল্টে লাস্ট পাতায় গিয়ে উপস্থিত হয়ে চ্যাপ্টার ধরে ধরে পিছোতে শুরু করে একশো এক পাতা পর্যন্ত এসেছিলাম। কতটা তিতিবিরক্ত হলে লোকে একটা রহস্যগল্প পড়তে বসে এটা করতে পারে কল্পনা করতে পারছেন? কিন্তু আমাকে সেই প্রশ্ন করা হয়নি। জানতে যাওয়া হয়েছে আমাকে সবথেকে বেশি হতাশ করা বইয়ের কথা। যে বইয়ের সম্পর্কে ঝুড়ি ঝুড়ি প্রশংসা শুনে পড়তে বসে অতি জোলো লেগেছে, গাছে তুলে মই কেড়ে নেওয়ার ফিলিং হয়েছে, তাহলে বলব A J Finn-এর The Woman in the Window-র নাম।

রহস্য ঘরানাতে 'উওম্যান' বা 'গার্ল' সাবঘরানা নিজস্ব সাবঘরানা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে বেশ কয়েক বছর। সে ঘরানার সাম্প্রতিকতম নক্ষত্র হল উওম্যান ইন দ্য উইন্ডো। সিনেমা হয়েছে অলরেডি বা হবে হবে করছে। ট্রেলার ও দেখেছি। জুলি অ্যান্ড জুলিয়া'র জুলি রোলে অ্যাকটিং করেছিলেন যে মহিলা, কী যেন নাম মনে পড়ছে না, অভিনয় করেছেন। 



রহস্যের ভিত্তি হচ্ছে এ বাড়ির জানালা থেকে ও বাড়ির জানালাতে ঘটতে দেখা একটা খুন। অতি চেনা প্লট। শত শত বছর ধরে এই প্লট নিয়ে মিস্ট্রি গল্প লেখা হচ্ছে, সিনেমা বানানো হচ্ছে। 'রিয়ার উইন্ডো' থেকে শুরু করে '4:50 ফ্রম প্যাডিংটন'-এর নাম সবাই জানে, ভাবলে আরও অগুনতি বেরোবে। সে বেরোক, অরিজিন্যালিটি ইজ ওভাররেটেড। নরনারীর প্রেম কেন্দ্র করে যত শিল্পসাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে তাতে অরিজিন্যালিটির অসুবিধে যদি কারও না হয়ে থাকে তবে আর কিছু নিয়েই হওয়ার কথা নয়।

উওম্যান ইন দ্য উইনডো-র সমস্যা হচ্ছে অন্য জায়গায়। পাতা উল্টে যেতে বাধ্য করার মতো তরতরে লেখা, সম্পাদনাও নিখুঁত, কিন্তু শেষে গিয়ে গোটা ব্যাপারটার এমন হাস্যকর রকম সমাধান যে খানিকক্ষণ হাঁ করে থাকতে হয়। রহস্য যদি হয় যে একটা লোককে ওখানে খুন করতে পষ্ট দেখা গেছে আবার একই সঙ্গে বাড়িতে বসে পেঁপে ছেঁচকি দিয়ে ভাত মেখে খেতে দেখা গেছে আর শেষে গিয়ে যদি উদ্ধার হয় যে লোকটার একটা যমজ ভাই আছে, তাহলে যেমন হয় তেমন আরকি। (WITW তে কিন্তু যমজটমজ নেই, কাজেই স্পয়েল করার অভিযোগ কেউ তুলতে পারবে না।)

৫। কোন বই পড়ে সবথেকে চমকেছ?

Drive Your Plough Over The Bones of the Dead-এর নাম বলছি না, কারণ এটা বললে পি জি উডহাউস পড়ে “ভদ্রলোকের রসবোধ কিন্তু সত্যি তারিফ করার মতো, তাই না?” গোছের হয়ে যাবে। তার থেকে এমন দুটো বইয়ের কথা বলি যেটা আমি কোনও আশা না নিয়ে শুরু করেছিলাম এবং পড়ার পর চমকে গেছি। তা হল James Lovegrove-এর শার্লক হোমসের প্যাস্টিশ।

অ্যান্থনি হরোউইটজ আমার অসম্ভব প্রিয় লেখক। ওঁকেও আমি আবিষ্কার করেছিলাম শার্লক হোমসের প্যাস্টিশ দিয়েই। কিন্তু হরোউইটজ সাহেবের কাছে ক্ষমা চেয়ে আমাকে স্বীকার করতে হবে, জেমস লাভগ্রোভের লেখা যেন আরও সরেস, আরও তরল, আরও মোলায়েম। লাভগ্রোভের দুটো প্যাস্টিশ পড়লাম, Sherlock Holmes & the Christmas Demon, আর The Stuff of Nightmares। শার্লক হোমসের সার্থক প্যাস্টিশ হয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজনীয় মালমশলা, উনিশ শতকের শেষদিকের লন্ডন শহর, ক্রাইম, মরিয়ার্টি সবই আছে। অনেকদিন আগে পড়েছি কাজেই প্লট-ট্‌লট্‌ অত মনে নেই কিন্তু এক নিঃশ্বাসে পড়ে যে গেছিলাম আর পড়ে মনে মনে "মচৎকার!" বলে উঠেছিলাম সেটা স্পষ্ট মনে আছে। 



৬। নতুন প্রিয় লেখক 

গত বছর থেকেই নতুন পছন্দের রহস্যগল্প লেখক খোঁজার প্র্যাকটিস শুরু করেছিলাম। লেখকের প্রথম গল্পটা পড়ে ভালো লাগলে/ তিনতারার ওপর রেটিং দিলে তাঁর আরও কয়েকটা বই পড়ে দেখার প্র্যাকটিস। এই করে রুথ ওয়্যারের বেশ কয়েকটা নভেল পড়া হয়ে গিয়েছিল। এ বছরও সে রকম লেখক কয়েকজন পাওয়া গেছে। 


প্রথম, Peter Swanson। ওঁর দুটো বই পড়লাম। প্রথম বই হচ্ছে Eight Perfect Murders। বস্টন শহরের একটি ইন্ডি বুক স্টোর। বইয়ের দোকানের স্পেশালাইজেশন হচ্ছে রহস্যরোমাঞ্চ সাহিত্য। একদিন এই গল্পের দোকানের মালিক, ম্যালকম কারশ'র কাছে আসেন একজন এফ বি আই অধিকর্তা। শহরের আশেপাশে কয়েকটা খুন হয়েছে সে বিষয়ে ম্যালকমের মতামত চাই। ম্যালকম তো হাঁ। তখন অধিকর্তা খোলসা করলেন যে তিনিও গোয়েন্দাগল্পের পোকা, এবং আর কেউ বুঝুক না বুঝুক তিনি বুঝেছেন যে খুনগুলো হয়েছে রহস্য সাহিত্যের বিখ্যাত কয়েকটি বইয়ে বর্ণিত খুনের অনুপ্রেরণাতে। ম্যালকম তখনও মাথা চুলকোচ্ছেন দেখে অধিকর্তা ঝেড়ে কাশলেন। বললেন, আপনি একটা ব্লগপোস্ট লিখেছিলেন মনে আছে কয়েক বছর আগে? ম্যালকমের মনে পড়ে গেল, অনেক বছর আগে একটা ব্লগ তিনি লেখা শুরু করেছিলেন বটে। কেউ পড়ে না বলে ছাড়ান দিয়েছেন। এফ বি আইয়ের মহিলা বললেন, ওই ব্লগের সবথেকে পঠিত পোস্টটা কী নিয়ে লিখেছিলেন মনে আছে? মালিকের মনে পড়ে গেল, মার্ডার মিস্ট্রি সাহিত্যের আটটি পারফেক্ট খুনের লিস্ট। মালিকের সন্দেহ এফ বি আই অফিসার কনফার্ম করলেন। খুনি ওই লিস্ট ধরেই এগোচ্ছে।

ম্যালকম কারশ-র পারফেক্ট মার্ডারের লিস্টে কোন কোন বইয়ের নাম ছিল জানতে যাঁরা কৌতূহল বোধ করছেন তাঁদের জন্য রইল।

1. The Sittaford Mystery (1931) by Agatha Christie 
2. The Nine Tailors (1934) by Dorothy L. Sayers 
3. The Corpse in the Snowman (1941) by Nicholas Blake 
4. Tied Up in Tinsel (1972) by Ngaio Marsh 
5. The Shining (1977) by Stephen King 
6. Gorky Park (1981) by Martin Cruz Smith 
7. Smilla’s Sense of Snow (1992) by Peter Høeg 
8. A Simple Plan (1993) by Scott Smith 
9. The Ice Harvest (2000) by Scott Phillips 
10. Raven Black (2006) by Ann Cleeves 

গত কয়েকবছরে কিছু রহস্যোপন্যাস পড়ে সামান্য থতমত খেয়েছিলাম যেখানে রহস্যের থেকে লেখকের কাব্যপ্রতিভা আর গোয়েন্দার ডিপ্রেশন বেশি জায়গা নিয়েছিল। গোটা ইন্ডাস্ট্রির কথা বলতে পারব না, আমার পড়া মিস্ট্রির মধ্যে, খুব ধীরে হলেও, সেই ট্রেন্ডের থেকে সামান্য শিফট লক্ষ্য করছি। একটা মধ্যপন্থার খোঁজ চলছে, যেখানে লিখনপ্রতিভার মাসল-ফ্লেক্সিং আর রহস্যের ঠাসবুনন, দুইয়ের প্রতিই সুবিচারের চেষ্টা দেখা যাচ্ছে।

পিটার সোয়্যানসন আমার মতে এই ভারসাম্যটা খুব ভালো করে আয়ত্ত করেছেন। মানে বরফঢাকা বস্টনের অলিগলি, বরফঝরা দিনে ছোট, ঠাসা বইয়ের দোকানের ফায়ারপ্লেসের ওম, ইত্যাদিকে যথাযথ মর্যাদা দিয়েও ভদ্রলোক ধাঁধাটাকেই গল্পের সিংহাসনে রাখেন। এইট পারফেক্ট মার্ডারস আমার খুবই ভালো লেগেছে, তবে মাঝে মাঝে বিশ্বাসের দাবিটা একটু বেশি হয়ে গেছে বলেও মনে হয়েছে। লিস্টের বইয়ের খুনগুলো পারফেক্ট কি না সে তর্কে যদি নাও যাই, সে খুনগুলো রেপ্লিকেট করা, করার মোটিভ, সব বিষয়েই অল্পস্বল্প 'হ্যাঃ, এ রকম আবার হয় নাকি'-র স্কোপ থেকে গেছে।

এইট পারফেক্ট মার্ডারস পড়ে উঠেই লাফিয়ে আমি সোয়্যানসন-এর আরেকটা বই পড়ে ফেলেছি, The Kind Worth Kiling। এই বইটা নিয়ে নাকি সিনেমা হচ্ছে। সিনেমা হওয়ার মতোই প্লট। এয়ারপোর্টে দুজন অসুখী মানুষের আলাপ হয়; তারা নিজেদের মধ্যে একটা প্ল্যান করে। সেই যে সেই গল্পটার কথা মনে করুন, Patricia Highsmith-র Strangers on a Train। বইটা নিয়ে একটা সিনেমাও হয়েছিল। ট্রেনের কামরায় দুজন মানুষের আলাপ হয়। অনেকের মতো এঁরাও মনে করেন যে মার্ডার করে ধরা পড়ার মূল কারণ হচ্ছে মোটিভ। একজন খুন হলে তাকে কার কার খুন করার কারণ থাকতে পারে সেটা খুঁজে বার করতে পারলেই অর্ধেক তদন্ত সারা। কিন্তু যদি এমন কেউ এমন কাউকে খুন করে যার মৃত্যু হলে খুনির বিন্দুমাত্র লাভলোকসান নেই, তাহলে খুনের সমাধান অসম্ভব। কাজেই দুজনে মিলে প্ল্যান করা হয় যে এ যদি ওর পথের কাঁটা সরিয়ে দেয় আর ও এর, তাহলে কেউ আর খুনের কিনারা করতে পারবে না।

আমার লেখকসন্ধান সিরিজের পরের লেখক হচ্ছেন Nicci French। বুকটিউবে যারা কবিতা আর প্রবন্ধ ছাড়া কিছু পড়েন না, তাঁরাও লজ্জা লজ্জা মুখ করে স্বীকার করেছেন যে তাঁরাও যেহেতু রক্তমাংসের মানুষ তাঁদেরও মাঝে মাঝে লাইট এন্টারটেনমেন্টের দরকার পড়ে। আর "প্যালেট ক্লেন্সার" হিসেবে নিকি ফ্রেঞ্চ নাকি দারুণ। এর ওপর কোনও কথা চলতে পারে না, তাই আমি নিকি ফ্রেঞ্চ-এর তিনতিনটে বই পড়ে ফেলেছি।

নিকি ফ্রেঞ্চ কিন্তু একজন লোক নন। নিকি জেরার্ড আর শন ফ্রেঞ্চ, স্বামী স্ত্রী জুটি মিলে বই লেখেন। স্ট্যান্ড অ্যালোনও যেমন লিখেছেন তেমন ফ্রিডা ক্লাইন নামের এক সাইকোঅ্যানালিস্ট গোয়েন্দার সিরিজও লিখেছেন। আমি ওঁর/ওঁদের দুটো স্ট্যান্ড অ্যালোন, The Lying Room, The Red Room আর ফ্রিডা ক্লাইন সিরিজের প্রথম উপন্যাস, Blue Monday পড়লাম। ফ্রিডা ক্লাইন লন্ডন শহরের একজন সাইকোঅ্যানালিস্ট, রোগী দেখার সঙ্গে সঙ্গে ঘাড়ে এসে পড়া খুনের তদন্তও করেন। কখনও পুলিসের ডাকে সাড়া দিয়ে, কখনও নিজের তাগিদে। 


তিনটে বইয়ের প্লট লিখছি না, তাহলে আর পোস্ট এ বছর ছাপা হবে না। তবে নিকি ফ্রেঞ্চের গোয়েন্দাগল্পের যে ক'টা স্যালিয়েন্ট পয়েন্ট আবিষ্কার করেছি তা হল, আনলাইকেবল, বিশেষত আনলাইকেবল মহিলা চরিত্র, সাইকোপ্যাথ, প্রেমের মুখ চেয়ে একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত ইত্যাদি। লেখকজোড়ার লেখার হাত অতি দড় কিন্তু গল্পে ঢুকতে বড় বেশি সময় নেন। অধৈর্য হয়ে পাঠকের বই বন্ধ করে উঠে যাওয়া আটকাতে বইয়ের শুরুতে একটা প্রোলগের টোপ দেওয়া থাকে, সেই প্রোলগের সুতো ফের ধরতে ধরতে আবার বইয়ের মাঝখান।

বুঝতেই পারছেন, নিকি ফ্রেঞ্চকে সবার যত ভালো লেগেছে আমার তত ভালো লাগেনি।

আমার চোখ বরং টেনেছেন Lucy Foley। ওঁর দুটো উপন্যাস পড়লাম, The Guest List আর The Hunting Party। প্রথম গল্পের ঘটনাস্থল বিজন দ্বীপে আয়োজিত একটি 'ডেসটিনেশন ওয়েডিং' আর দ্বিতীয় উপন্যাসের প্রেক্ষাপট হচ্ছে ঘন জঙ্গলের ভেতর গেস্টহাউসে কয়েকজন বন্ধুর নববর্ষ উদযাপন।

প্রথমেই বলে নিই, ফোলিকে কেন কারও খারাপ লাগতে পারে। প্রথম এবং প্রধান কারণ, একটি বিশেষ ট্রোপের প্রতি মহিলার পক্ষপাতিত্ব। একলাইনের বর্ণনা দুটো পড়ে আন্দাজ করতে পারছেন নিশ্চয় ট্রোপটা কী। আইসোলেশন। সোজা কথায়, And Then There Were None-এর ট্রোপ। যোগাযোগবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া একদল লোক যারা মনে মনে কেউ কাউকে দু'চক্ষে দেখতে পারে না, এদিকে ওপর ওপর বন্ধুত্বের ভড়ং আছে ষোলো আনার ওপর আঠেরো আনা।

ফোলির দুটো উপন্যাসেই আরেকটা ট্রোপ হচ্ছে, অনেকে বলেন যে ট্রোপের জন্মদাতা Donna Tartt-এর Secret History। চরিত্ররা পুরোনো বন্ধু। কাজেই সবাই সবাই পুরোনো পাপের কথা জানে, আর ঘৃণা জমাট বাঁধার সময়ও পেয়েছে যথেষ্ট। 



আমার লুসি ফোলির উপন্যাস ভালো লাগার কারণ ভদ্রমহিলার টানটান প্লট, বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র তৈরি আর দ্রুত অথচ ডিটেলড গল্প বলার ক্ষমতা।

৭। কোন বই পড়ে কেঁদেছ? 

Drive Your Plough Over The Bones of the Dead। মানুষের নিষ্ঠুরতার ক্ষমতার এমন যথার্থ প্রতিবেদন, না কাঁদলেই অদ্ভুত হত।

৮। কোন বই পড়ে হেসেছ? 

Drive Your Plough Over The Bones of the Dead পড়ে বেদম হেসেছি। একেবারে প্রথম পাতা থেকে, যেখানে Jana নিজের পুঙ্খানুপুঙ্খ বেডটাইম রুটিন, অর্থাৎ হাত পা মুখ ভালো করে ধুয়ে, চুল বেঁধে ঘুমোতে যাওয়ার কারণ হিসেবে বলছে, ওর যা বয়স তাতে মাঝরাতে মেডিক্যাল এমারজেন্সি হয়ে প্যারামেডিক সহযোগে অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে হাসপাতাল যাওয়া আশ্চর্য নয়। কাজেই ফিটফাট হয়ে শুতে যাওয়াই সেফ।

৯। এ বছর কী কী বই পড়তে চাও

চাই তো অনেক বইই পড়তে, লুসি ফোলির আরও খান কয়েক বই পড়াই যায়। Homegoing-এর লেখক Yaa Gyasi-র দ্বিতীয় উপন্যাস Transcendent Kingdom বেরোচ্ছে, সেটাও পড়ার ভয়ানক ইচ্ছে। কিন্তু সে সব বাদ দিয়ে আগে যে বইগুলো আপাতত আমার টু বি রেড লিস্টে বসে বসে পচছে সেগুলো সম্পর্কে বলি। 

A Thousand Ships by Natalie Heynes 


“I have picked up the old stories and I have shaken them until the hidden women appear in plain sight,” বলেছেন লেখক। বইটি মারাত্মক নাম করেছে, বিবিধ পুরস্কারের তালিকায় নাম তুলেছে।

আ থাউজ্যান্ড শিপস হচ্ছে ট্রয়যুদ্ধের ফিমেল রিটেলিং। অ্যাকিলিস, অ্যাগামেমননরা নেপথ্যে সরে গেছেন, সামনে চলে এসেছেন আড়ালে আবডালে থাকা মহিলা নায়কেরা। এক নায়িকার নাম তো সকলেই জানি, হেলেন, যিনি বীরপুরুষদের কামভাব জাগ্রত করে যুদ্ধের ফিতে কেটেছিলেন। কিন্তু আমি অ্যান্ড্রোম্যাকির নাম জানতাম না, যিনি হেক্টরের স্ত্রী এবং যুদ্ধের পর যাঁকে অ্যাকিলিসের পুত্র নিওপটলেমাসের হাতে বীরত্বের পুরস্কার হিসেবে তুলে দেওয়া হয়। সেই নিওপটলেমাস, যিনি অ্যান্ড্রোম্যাকির শিশুসন্তানকে হত্যা করেন। বলা বাহুল্য, অ্যাকিলিসের ট্র্যাজেডি নিয়ে যত কাঁদুনি হোমার গেয়েছেন তার গোড়ালিপরিমাণও এই মহিলার প্রতি খরচ করেননি।

"Consider the mountain nymph Oenone, whom Paris abandons with their baby when he goes in pursuit of Menelaus’s wife Helen, triggering the 10-year conflict. “Is Oenone less of a hero than Menelaus?” asks Calliope. “He loses his wife so he stirs up an army to bring her back to him, costing countless lives and creating countless widows, orphans and slaves. Oenone loses her husband and she raises her son. Which is the more heroic act?”

প্রশ্নগুলো সহজ আর উত্তরও তো জানা। 

Hamnet by Maggie O’Farrel 


এই বইটি নিয়েও হইচই তুঙ্গে। উপন্যাসের কেন্দ্রে আছে শেক্সপিয়র এবং শেক্সপিয়ারের স্ত্রী অ্যাগনেসের সন্তান হ্যামনেটের অকালমৃত্যু। হ্যামনেটের স্মৃতিতেই নাকি শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট লিখতে বসা। সন্তানশোক নিয়ে লেখা একটি উপন্যাস আমি গতবছর পড়েছিলাম যা সারাজীবনের প্রিয়তম বইয়ের লিস্টে জায়গা করে নিয়েছে। জর্জ সন্ডারসের লিংকন ইন দ্য বার্ডো। বলতে বাধা নেই, এখন থেকে সন্তানশোক আশ্রয় করে লেখা যে কোনও রচনাই আমাকে সন্ডার্সের উপন্যাসটির কথা মনে করাবে এবং তুলনা টানতে বাধ্য করবে। 

যাই হোক, নানা কারণে হ্যামনেট আমার পড়ার ইচ্ছে। সন্তানশোককে কেন্দ্রে রেখে এই উপন্যাস নাকি শেক্সপিয়ারের নিরক্ষর স্ত্রী অ্যাগনেসের চমৎকার চরিত্রচিত্রণ আছে। গোটা গল্পে একবারও নাকি শেক্সপিয়ারের নাম নেওয়া হয়নি। কেউ বলছেন এটা ঠিক হয়েছে কারণ শেক্সপিয়ার যে রেটে সেলিব্রিটি, নাম বলে দিলে আর পাঁচজন সন্তানশোকতপ্ত বাবার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে অসুবিধে হত। কেউ বলছেন, সবাই যখন বুঝতেই পারছে যে শেক্সপিয়ারের কথা বলা হচ্ছে তখন আর এই ভড়ং-এর দরকার কী ছিল। এর মধ্যে কোন মতটা আমার ভোট পাবে সে তো বইটা পড়ার পরই বোঝা যাবে। 

Women Talking by Miriam Toews


দু'হাজার পাঁচ থেকে দু'হাজার নয়,  বলিভিয়ার ম্যানিটোবা মেনোনাইট কমিউনিটির মহিলা, বালিকা ও নাবালিকারা দিনের পর দিন ঘুম থেকে উঠে নিজেদের শরীরে বীর্য, যোনিতে যন্ত্রণা, রক্ত এবং আরও নানাবিধ আঘাত আবিষ্কার করতে থাকে। সবাই জানে, মেয়েদের শরীর একটা চাপাচুপি দিয়ে রাখার ব্যাপার। হেবি গরম বলে ফ্যানের তলায় উদোম গায়ে ভিডিও তুলে ফেসবুকে ছেড়ে দেওয়া ব্যাপার নয় বা স্রেফ একখানি গামছা পরে বাইক চালিয়ে পাশের পাড়ার মুদির দোকান থেকে চট করে সর্ষের তেল নিয়ে এলাম, আসাযাওয়ার পথে যত চেনা লোক দেখলাম হাঁকডাক করে সবার মনোযোগ আকৃষ্ট করলাম - প্রগতিশীল ভাষাগোষ্ঠীতেই এ সব কেউ কল্পনা করতে পারে না আর এ তো আধুনিক সভ্যতা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া, ঘোর ধার্মিক মেনোনাইট সম্প্রদায়। কাজেই আলোচনা মেয়েলি ফিসফিসানিতেই আটকে থাকে। মেয়ে মা-কে বলতে লজ্জা পায়, মা মেয়েকে। যদি বা ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়েও পড়ে, এই সিদ্ধান্তে পৌঁছনো হয় যে বাড়িতে কোনও ডেমনের উপদ্রব হয়েছে। আরও একটা জ্বলন্ত সত্যিও তো অস্বীকার করার উপায় নেই। তোমার রেপ হয়েছে বলছ, কিন্তু পাশের বাড়ির ওর তো হয়নি। তাহলে তোমারই কেন হল? বলতে চাও তোমার রেপে তোমার কোনও দায় নেই? কাজেই কোনও অজানা পাপের শাস্তি হিসেবে মেয়েরা সকালের পর সকাল নিজেদের ধর্ষিত, রক্তাক্ত শরীর আবিষ্কার করতে থাকে। কী হয়েছে কিছু স্মৃতি নেই।

তারপর বেরোয় যে ডেমনটেমন কিছু নয়, আসলে রক্তমাংসের আটজন পুরুষ, গবাদি পশুর মুষ্কচ্ছেদন করার সময় ব্যবহৃত অ্যানাস্থেশিয়ার গ্যাস স্প্রে করে, রাতের পর রাত মহিলাদের ওপর আক্রমণ ও ধর্ষণ চালিয়ে গেছে। গুনেগেঁথে দেখা যায়, চার বছরে আক্রান্ত মহিলার রিপোর্টেড সংখ্যা একশো একান্ন। ভিকটিমদের বয়স তিন থেকে পঁয়ষট্টি।

ধর্ষকদের পুলিস ধরে নিয়ে যায়। বাকি পুরুষরা দল বেঁধে থানায় ছোটাছুটি করতে থাকেন তাদের মুক্তির জন্য। ধর্মগুরু আদেশ দেন ধর্ষকরা ফিরলে মহিলাদের কাছে দুটো রাস্তা খোলা। এক, ধর্ষকদের ক্ষমা করে দেওয়া কারণ ক্ষমাই স্বর্গে যাওয়ার উপায়; দুই, কমিউনিটি থেকে বহিষ্কৃত হওয়া।

মিরিয়াম টেভসের সংক্ষিপ্ত উপন্যাস শুরু হয়েছে এই পরিস্থিতিতে, যেখানে আটজন বিভিন্ন বয়সের মহিলা, বাধ্যতামূলকভাবে অক্ষরপরিচয় এবং বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ - হীন, (কারণ গোটা সমাজের স্বর্গলাভের জন্য এ দুটো আবশ্যিক শর্ত) একটি গোপন কক্ষে জমা হয়ে নিজেদের মধ্যে কথোপকথন শুরু করেন, তৃতীয় একটি রাস্তা নিয়ে।

কোথাও না গিয়ে, জমি না ছেড়ে, শেষ দেখার রাস্তা।

১০। বাকি বছরের পড়াসংক্রান্ত লক্ষ্যঃ

লক্ষ্য আপাতত পড়ে চলাতেই। বছরের শুরুতে পঞ্চাশটা বই পড়ার চ্যালেঞ্জ যতখানি পিক আপ নিয়ে শুরু করেছিলাম, তাতে ঢিলে পড়েছে। আবার কোমর বেঁধে লাগতে হবে। গোয়েন্দাগল্প ছাড়া আর কিছুতে মন বসাতে পারলে ভালো লাগবে। তবে নিজের মনকে চোখ ঠারিয়ে লাভ নেই। সিলেবাসের পড়াই যে কোনওদিন পরিশ্রম করে পড়েনি, সে গল্পের বই পড়বে খেটেখুটে? কাজেই যা মুখে রুচবে তাই পড়ব। বছরের শেষে সে সব বইয়ের খবর দেব আপনাদের।


Comments

  1. Duto khub biroktikor onurodh:

    1: Rahasyo boi somporke apnar ar amar motamot prae sobsamayi mile jae. Se ijonyo apnar recommend kora jotogulo boi pai pore feli.
    - Christie ghoranar apnar priyo boi ar cinemar ekta talika (apnar katha shune Knives Out dekhe fellam, mochotkar laglo)

    2. Onekdin kono quiz pachchi na :( :( :(

    ReplyDelete
    Replies
    1. প্রথম বিষয়টার সমাধান তো দ্রুত করা যায়, এতদিন যে কেন করিনি সেটাই রহস্য। আইডিয়া দেওয়ার জন্য থ্যাংক ইউ।

      কুইজের সমস্যাটা হচ্ছে, আর পাঁচটা পোস্ট যেমন নিজের মনে নিজে বিড়বিড় বকার মতো লিখে চলা যায়, কুইজটা ঠিক সে রকম যায় না। প্রশ্ন করলে উত্তরও লাগে। পাঠকের পার্টিসিপেশন জরুরি হয়ে যায়। এইবার পাঠকের পার্টিসিপেশন নিশ্চিত করার বিদ্যে আমার জানা নেই। কাজেই কুইজ ছেপে সাসপেন্সে থাকা, যেচে সে কষ্ট আর করব না ঠিক করেছি।

      Delete
  2. সত্যি কথা বলতে কি আমফান এর পর থেকে একটাও বই শেষ করে উঠতে পারিনি। মন বসেনি বিশেষ কিছুতেই। এরম একটা লিস্ট বেশ উপকারী। একটা কোন বই বেছে দেখব যদি অরুচি কাটে!

    আশা করি যে বছর পঞ্চাশ কেন, একশটা বই যেন পড়ে ফেলতে পারো। :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, এ বছরটা যা যাচ্ছে তাতে গল্পের বইতে মনোনিবেশ করা টাফ, বিম্ববতী।

      Delete
  3. kotokichu janlam... dukkho o hocche amar eto boi pora hoy na... :( character crush ta ekdom thik bolecho.. ar Troy er pore otao jantam na.. interesting lagche ota..

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, আ থাউজ্যান্ড শিপস সম্পর্কে আমিও উৎসাহ বোধ করছি, ঊর্মি। দেখা যাক।

      Delete

Post a Comment