মার্ডার ইন দ্য হিলস



উৎসঃ ইন্টারনেট


শবরীর প্রতীক্ষা যাকে বলে, সেটাই করছিলাম আমি, অঞ্জন দত্তর মার্ডার ইন দ্য হিলস-এর জন্য। অঞ্জন দত্ত মচৎকার নাম দিতে পারেন। শুনলেই রোমাঞ্চ হচ্ছিল। তর সইছিল না। প্রতীক্ষা সহনীয় করার জন্য ট্রেলর দেখে বেড়াচ্ছিলাম, যেখানে যা ইন্টারভিউ পাওয়া যাচ্ছে শুনছিলাম।

অবশেষে তেইশে জুলাই আগত হল। হইচইয়ে ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার।

শুরুতে দেখা গেল যে অঞ্জন দত্ত অর্থাৎ টোনি রায়, মারাত্মক ফ্ল্যামবয়েন্ট পার্সোন্যালিটি, প্রাত্যহিক প্রাত্যুষিক রুটে হাঁটতে বেড়িয়েছেন। বোঝা গেল টোনি রায় দার্জিলিং শহরের কেউকেটা লোক, লোকে ডাকখোঁজ করে, ছবিটবি তোলে পাশে দাঁড়িয়ে। ক্রমে বোঝা যাবে যে টোনি একজন ফিল্মস্টার, হেঁজিপেঁজি না, সত্যজিৎ রায় থেকে পোল্যানস্কির ছবিতে পর্যন্ত কাজ করেছেন। সেদিন রাতে তাঁর বাড়িতে তাঁর ছেষট্টিতম জন্মদিনের পার্টি, সে বাবদে টোনি বিভিন্ন লোকজনকে নেমন্তন্ন করছেন। নিমন্ত্রিতদের মধ্যে আছেন  ডাক্তার নিমা প্রধান, নেপালি ভাষাশিক্ষক শীলা, সফল চিত্রপরিচালক বিজয় মুখার্জি যিনি টোনিকে নিজের সিনেমায় কাজ করানোর জন্য চক্কর কাটছেন। রজত গাঙ্গুলি যিনি বিখ্যাত গোয়েন্দাগল্প লেখক এবং টোনি রায়ের বন্ধু, প্রাক্তন ফুটবল তারকা এবং বর্তমান ফুটবল কোচ বব দাস, ডি এস পি শুভংকর ব্যানার্জি। টোনির নেমন্তন্ন ব্যতিরেকে, নেপালি ভাষাশিক্ষিকা শীলার প্রেমিক হিসেবে পার্টিতে বাড়তি আসে অমিতাভ ব্যানার্জি, যে বম্বেতে ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজমের চাকরি যাওয়ার পর কলকাতার একটা ছোট কাগজের প্রতিবেদক হয়ে দার্জিলিং-এ অবস্থিত।

যদি কেউ আগাথা ক্রিস্টির গল্প পড়ে থাকেন তাহলে একটা গল্পের কথা মনে পড়েছেই পড়েছে। কার্ডস অন দ্য টেবিল। একজন একসেনট্রিক লোক, লোক জড়ো করছে পার্টির জন্য।

বুকটা কেমন করে উঠল। টোকা বলে নয়। টোকাটুকি নিয়ে ব্রাহ্মপনা আমার গড়পড়তার থেকে কম। আমার বুক কেমন করল এই ভেবে যে টোকা যদি সত্যি হয় তাহলে টোকা শেষ হয়ে নিজের কেরামতি শুরু হওয়ার সম্ভাবনাটাও সত্যি হতে পারে।

যাই হোক, সন্ধেবেলা টোনি সবাইকে বাড়িতে ডেকে খুব হাঁকডাক করে, নাটকীয় হাত পা নেড়ে বলতে লাগলেন যে তাঁর সবাইকে জোটানোর কারণ তিনি এদের মধ্যে কাউকে একটা খুন করতে চান। ব্র্যান্ডিতে বিষ মেশানো আছে, কে মরবে কেউ জানে না। একসেন্ট্রিক অভিনেতার বাড়ির পার্টিতে বিষ মদ খেয়ে টপকে যাওয়া থ্রি অ্যাকট ট্র্যাজেডি-র কথা মনে পড়ালো। আবার আমার বুক ধড়াস করল। 

এবং আমার ধড়াস সত্যি করে টোকাটুকি বন্ধ হয়ে গল্প মৌলিক রাস্তা ধরল।

টোনি বোস যখন হাত পা নেড়ে খুনের বদমতলবের ইজাহার করছিলেন, তখন কে খুন হবে বোঝার জন্য এক লাইনও গোয়েন্দা গল্পও পড়ার দরকার নেই। টোনি দড়াম করে পড়ে গিয়ে ছটফট করলেন। হাসপাতালে নিতে নিতেই পটল। গোলেমালে ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্ট অমিতাভ তদন্ত শুরু করল। টোনির জীবনের অতীতের একটি ঘটনা উন্মোচিত হল। সে ঘটনার পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে অমিতাভ সংশ্লিষ্ট লোকজনের, ডাক্তার, ফুটবল কোচ, পুলিস, চিত্রপরিচালক, গোয়েন্দা লেখকের থেকে প্রতিরোধ এমনকি হিংসারও মুখোমুখি হল। দার্জিলিং-এর প্রভাবশালী বদ প্রোমোটার জয়সওয়াল, অমিতাভকে তুলে নিয়ে গিয়ে ঠ্যাঙালো। টোনি রায়ের স্ত্রী রমা সিনে আবির্ভূত হলেন। এ সবের ওপর বিষফোঁড়ার মতো জেগে থাকল ভাষাশিক্ষকের সঙ্গে হৃদয়াবেগঘটিত জটিলতা।

আট এপিসোডের এই গল্পে কী রইল না তাহলে? 

লোকে ঠ্যাঙা নিয়ে তেড়ে আসবে, যদি বলি যে কোজিনেস। কারণ গোয়েন্দা গল্প মানেই কোজি নয়। মানছি। বিশেষ করে অঞ্জন দত্ত নিজে একাধিক জায়গায় বলেছেন যে তিনি অনেক বেশি চ্যান্ডলার ঘরানায় দীক্ষিত, যেখানে কোজি প্রায় নিষিদ্ধ শব্দ। কিন্তু তাতে এটাও অস্বীকার করা যাবে না যে গল্পটার ধরতাই একেবারেই আগাথা ক্রিস্টি সুলভ কোজি মিস্ট্রির ছাঁদে। কুয়াশা ঘেরা শহরে একটি খুন কেন্দ্র করে ঘুরছে কতগুলো মানুষ। সেখানে কথোপকথন থাকবে, এভিডেন্স পরীক্ষা থাকবে, রেড হেরিং থাকবে, ক্লু থাকবে।

এসব কিছু নেই। কারণ অমিতাভ, অর্থাৎ এই গল্পের গোয়েন্দা অত্যন্ত কৌতূহলোদ্দীপক ভাবে, চোখের সামনে যে খুনটা হল সেটার প্রতি বিন্দুমাত্র মনোযোগ না খরচ করে  চলে গেলেন তিরিশ বছর আগে কী হয়েছিল সেটা নিয়ে লেবু কচলাতে। এই খুনটা আদৌ খুন কি না সে বিষয়ে কেউ নিশ্চিত হল না, কিন্তু যদি খুন হয় তাহলে কেন খুন সেই নিয়েই দেদার মাথাব্যথা হল। অপরচুনিটিটুনিটি গোল্লায় যাক, মোটিভই শেষ কথা।

আসলে বিষ ব্র্যান্ডিতে ছিল নাকি জলের বোতলে সে নিয়ে চুল চেরাচিরিতে আজকাল আর কেউ ইন্টারেস্টেড না। আমার ধারণা এই ডিসইন্টারেস্টের পেছনে অপারগতা একটা বড় কারণ। গোঁজামিল দিয়েও একটা মোটামুটি ধাঁধা তৈরি করা সোজা কাজ নয়। অনেকে বলবে চেষ্টা করলে ওই ধাঁধাটা বানানো এমন কিছু শক্ত না, লোকে চাইছে না তাই করছে না। হবে হয়তো। লোকে আসলে আজকাল চায় নাটক। হিউম্যান ড্রামা। প্রেম, শরীর, প্রতিশোধ, রিরংসা - এই সব। এদিকে গোয়েন্দার বাজার তেজি তাই তার মোড়কে পরিবেশন করলে প্রাথমিক আগ্রহটা জাগানো সহজ হয়। ফার্স্ট এপিসোডে খুন থাকবে আর লাস্ট এপিসোডে খুনিকে ধরা। মাঝখানে বিশুদ্ধ ড্রামা। এই প্রসঙ্গে আরেকটি সাম্প্রতিক কালের আরেকটি বিখ্যাত সিরিজের কথাও মনে পড়ছে। মেয়ার অফ ইস্টটাউন। গোয়েন্দাগল্পের ছুতোয় বিশুদ্ধ হিউম্যান ড্রামা।

মার্ডার ইন দ্য হিলস-এ দ্বিতীয় যেটা নেই, সেটা হচ্ছে চরিত্রদের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার সুযোগ। পার্শ্বচরিত্ররা একজন ঝগড়ুটে ডাক্তার, একজন পাকা ফিল্ম পরিচালক, একজন রহস্যময় বন্ধু এইরকম হয়েই রয়ে যায়। সে না হয় এতগুলো চরিত্রর নানারকম শেড দেখানো এই পরিসরে সম্ভব নয় মানছি, তা বলে যে প্রোটাগনিস্ট, তার প্রতি আরেকটু আবেগ অনুভব করার আশা করে দর্শক বা পাঠক। আবেগটা ভালোলাগা, করুণা, ঘৃণা যা কিছু হতে পারে। অমিতাভর সঙ্গে এই সংযোগটা কখনও ঘটে না। অমিতাভ একজন ইনভেস্টিগেটিভ সাংবাদিক হয়ে থেকে যায়। পার্টিকুলার এই পরিস্থিতিটার বাইরের অমিতাভ কেমন সেটা দর্শকের কাছে, অন্তত আমার কাছে, রহস্যাবৃত রয়ে যায়। গোটা গল্পের সবথেকে ইন্টারেস্টিং চরিত্র বয়স্ক টোনি অর্থাৎ অঞ্জন। আমার অল্পবয়স্ক টোনিকেও খারাপ লাগেনি। তাও কিছু অনুভূতি জাগাতে সমর্থ হয় সে দর্শকের প্রাণে।

অঞ্জন দত্তর আরেকটা ব্যাপারে ঝোঁক আছে যেটা আমার ভালো লাগে না। ব্যোমকেশেও উনি ব্যাপারটা করে থাকেন এবং ওখানেও সমান কানে লাগে। সিনেমাটা দেখাতে দেখাতে ওঁর মনে হয় সম্ভবত সবটা বলা হচ্ছে না, তাই পেছনে ভয়েসওভারে বক্তা চরিত্রকে দিয়ে ব্যাখ্যা দিতে থাকেন। ব্যোমকেশকে দেখতেশুনতে নশ্বর মনে হলেও আসলে সে যে দেবতা সেইটা যদি পাছে দর্শক/পাঠক মিস করে যায়, অঞ্জনবাবুর রাতে ঘুম হবে না, তাই অজিতকে দিয়ে  “আমার বন্ধু” “আমার বন্ধু” করে বক্তৃতা দিয়ে জানিয়ে দেন যে ব্যোমকেশ গোয়েন্দাগিরি করে বেড়ালেও একাধারে প্রগাঢ় সমাজচিন্তক এবং বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া করার মতো গেরস্ত।

এখানেও তাই হয়। পরিষ্কার তো দেখাই যাচ্ছে অমিতাভ কেন গোয়েন্দাগিরিতে নামল, তাও আবার পরের এপিসোড শুরু হওয়ার আগে অত কথা বলানোর দরকার কি? ওই নেপথ্য বক্তৃতাটুকু না থাকলে কিছু ক্ষতিবৃদ্ধি হত না। সবাই সব বুঝতে পারত।

আমি বুঝতে পেরেছিলাম কি, রহস্যের সমাধান? পেরেছিলাম। খুব শক্ত নয়, আপনিও পারবেন। তবে সেটা ইমমেটেরিয়াল। আগেও অনেকবার বলেছি, আবার বলছি, একটা গোয়েন্দাগল্প ভালো লাগা না-লাগায় অপরাধীর পরিচয় ধরে ফেলতে পারাটা সবঘেকে তুচ্ছ অংশ বলে আমি বিশ্বাস করি।

তা বলে কি মার্ডার ইন দ্য হিলস দেখবেন না? অবশ্যই দেখবেন। আমি অলরেডি দুবার দেখেছি। আমার মতো অকর্মা নন আপনারা কেউ, তাই একবার দেখলেই যথেষ্ট হবে মনে হয়। দার্জিলিং-এর একটা অন্য চেহারা দেখতে পাবেন। একটা ইন্টারভিউতে প্রশ্নকর্তা অঞ্জন দত্তর প্রতি সেই প্রত্যাশিত অভিযোগটা করেছিলেন যে আবাআআআর দার্জিলিং কেন। উত্তরে অঞ্জন জানিয়েছিলেন যে প্রথম কারণ, জায়গাটা তাঁর হাতের তালুর মতো চেনা। দুই, দার্জিলিংকেন্দ্রিক নাটকনভেল আমরা সাধারণত ভ্রমণার্থীর চোখ দিয়ে দেখে থাকি। এখানে ঘটনা ঘটছে এমন কিছু লোকজনকে ঘিরে, যারা ওখানে থাকে, ক’দিনের জন্য বেড়াতে যায়নি। কাজেই তাদের চোখ দিয়ে আমরা চর্বিতচর্বণের বাইরের একটা দার্জিলিং দেখতে পাব। দাবিটা মিথ্যে নয়।

Comments

  1. মোটের ওপর আমার কিন্তু ভালোই লেগেছে। অনেকদিন পরে আবার অবান্তর খুলে পড়লাম । তবে অঞ্জন দত্তকে নিয়ে তোমার অভিযোগ গুলো মিথ্যে নয়, কুন্তলা-দি |😁

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, অনেকদিন পর দেখা হয়ে ভালো লাগল, হংসরাজ।

      Delete
  2. Dekha hoy ni. Apnar lekhati pore satyi i dekhar ichchhe holo.

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই রে, দেখে আবার গালি দেওয়ার ইচ্ছে হতে পারে। তবে এক কাজ করতে পারেন, আট রাত খাওয়ার সময় একটা একটা এপিসোড করে যদি দেখে নেন তাহলে বেশি সময় নষ্ট হবে না, আর আমিও নিরাপদ থাকব।

      Delete
  3. আপনার লেখা পড়ে আশা করছি আমার‌ও ‌একদিন সাহস আর ধৈর্য্য হবে তখন আমিও অঞ্জন, শিবু - নন্দিতা সব দেখে ফেলব।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সে সাহস আর ধৈর্য না হওয়াই ভালো মনে হয়। এর থেকে অনেক বেটার কাজ করার আছে জীবনে।

      Delete
  4. আমি ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতে নিতে অবান্তরে আসলাম, তখন বাজছিল এগারোটা।
    আর এখন আমি অ্যাকচুয়ালি যাচ্ছি ঘুমাতে।
    কেমন লাগছে এখন? সেটা আর বললাম না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. মার্ডার ইন দ্য হিলস দেখলে নাকি?

      Delete
    2. আজ্ঞে। সরি, আমারই আরেকটু ক্লিয়ার করে বলা উচিত ছিল।

      Delete
  5. এক বছর হইচইয়ের সাবস্ক্রিপশন রেখে গোয়েন্দা গল্পের নামে "একেনবাবু" আর "তানসেনের তানপুরা" দেখে বিরক্ত হয়ে কিছুদিন হল কাটিয়ে দিয়েছি। আবার কখনও যদি চালু করি তবে নিশ্চয়ই দেখব। তবে অঞ্জন দত্তর ব্যোমকেশ দেখে যেটুকু ধারণা হয়েছে, শুধু এটা দেখার জন্য আবার সাবস্ক্রিপশন নেব, সে সম্ভাবনা কম। আপনার লেখাটা, অ্যাজ ইউজুয়াল, ভাল হয়েছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হইচই আমি রেখেছি বাজে জিনিস দেখব বলেই। তানপুরা, একেন, দময়ন্তী। অঞ্জন দত্ত এদের তুলনায় তারকভস্কি। তবে সাবস্ক্রিপশন নিয়ে একেবারেই দেখবেন না।

      Delete
    2. " অঞ্জন দত্ত এদের তুলনায় তারকভস্কি। " বাবাগো :P

      Delete

Post a Comment