ডিয়ারেস্ট ডায়রি



চৌকো, মোটাসোটা জিনিসটা অর্চিষ্মান ব্যাগ থেকে বার করে টেবিলে রাখা মাত্র শিরদাঁড়া টানটান, ইন্দ্রিয়রা সচকিত হল। চোখের কোণ দিয়ে দেখা, তবু চিনেছি। তাছাড়া জানুয়ারি মাস। একমাসের মাইনে বাজি ধরতে পারি ওটা কী।

কনফারেন্সে দিল?

হ্যাঁ।

আমি নেব?

ডায়রিটা অলরেডি হাতে তুলে নিয়েছিল অর্চিষ্মান, প্রশ্নটা শেষ হওয়ারও আগে আমার হাতে এসে গেল।

আর আমার আনন্দ হল। কীসে আমার আনন্দ জিজ্ঞেস করলে, কেউ করে না, কিন্তু ফ্যান চালিয়ে শুয়ে যখন পারসুইট অফ হ্যাপিনেসট্যাপিনেস নিয়ে ভাবিটাবি, কীসে আমার আনন্দ, অ্যাকচুয়াল আনন্দ - অটোগ্রাফ বিতরণ, বিশ্বভ্রমণ, হিমালয়গমন ইত্যাদি মনে পড়ে। এ সব গ্র্যান্ড ইভেন্টের তুলনায় একখানা নতুন ডায়রির মালিকানা যে ওই পরিমাণ আনন্দ উৎপাদন করতে পারে আবিষ্কার করে আমি চমকে গেলাম।

হয়তো আবিষ্কার করে নয়। হয়তো মনে পড়ে। কারণ এই আনন্দটা আগেও হয়েছে। এত আগে যে ভুলে গেছি। বাবামা অফিস থেকে গুচ্ছের ডায়রি পেতেন, তাদের এক বা একাধিকের মালিকানা পেতাম প্রতি বছর। সঙ্গে অপরিমেয় আনন্দ। হতে পারে ব্রেনে আনন্দটা জমা ছিল, জাস্ট ধুলো ঝাড়ল। সেরোটোনিন ঝরিয়ে গেল সেই সময়টার অনন্ত সম্ভাবনারা। এই পার্টিকুলার ডায়রিটা নয়।

তবু এ নিমিত্ত তো বটে। ডায়রিটা হস্তগত করলাম এবং প্রম্পটলি রোজ সকালে মনের কথা লিখতে বসলাম।

ডায়রি লেখা কবে শুরু করেছিলাম কখন মনে নেই। লিখতে শেখার খুব পরে নয়। কবে থামিয়েছিলাম মনে আছে। কেন শুরু করেছিলাম ভুলিনি। নিজের যাবতীয় মনের ভাব - তুচ্ছ, হাস্যকর, বোরিং ও গোপন - একটা কোথাও উপুড় করতে। কেন ছেড়েছিলাম তাও না।

প্রত্যেকবার সে সব ডায়রি কেউ না কেউ খুলে পড়েছিল। মূলত মা। খানিকটা কৌতূহলে, খানিকটা গোকুলে কোনও বিপদ বাড়ছে কি না অবগত থাকতে। শিওর বাকিরাও পড়ত, মা আমার মা বলেই, ধরা পড়ে যেতেন।

ধরা পড়ে লজ্জা কখনও পেয়েছেন মনে পড়ে না। কারণ গোপন কাজটা তো মা করেননি, করেছি আমি। ঠাকুরদা বাড়ি তৈরির সময় ইন্ডিভিজুয়াল ঘরের দরজা পর্যন্ত দরকারি মনে করেননি। পর্দা টেনে বসে থাকাকেও চরিত্রগঠনের পরিপন্থী মনে করা হত। চরিত্র হবে অ্যায়সা যে কোনও কিছুর ওপর পর্দা টানতেই হবে না জীবনে।

বাড়ির লোকের কাঠখড় পোড়ানো সত্ত্বেও যথাসময়ে জীবনে কিছু অনুভূতির উদ্রেক ঘটল যেগুলো ব্যক্তিগত রাখাই সুবিধেজনক। এ এক আশ্চর্য জানা। কাউকে বলে দিতে হয় না। কাউকে চিনিয়ে দিতে হয় না। কোনটা প্রাইভেট, কোনটা প্রাইভেট না। কোনটা সবার, কোনটা আমার। বাড়ির চরিত্রগঠনের পদ্ধতিতে একটা গোড়ার গলদ ছিল। অত দরজা খোলা পর্দা তোলা বাড়িতে গোপন করার জিনিসও বেশি থাকে। ঘুরিয়ে বললে সবকিছুই গোপনীয়তার যোগ্য বলে প্রতিভাত হয়। সমস্ত অনুভূতিকেই চাপাচুপি দিয়ে রাখার তাগিদ জন্মায়।

তাছাড়া দরজা খোলা, পর্দা তোলায় সব এনার্জি খরচ না করে ফেলে জীবনের বেসিক সত্যগুলো সম্পর্কে যদি তাঁরা আরেকটু সাবলীল হতেন এবং আমাকেও সাবলীল হতে সাহায্য করতেন তাহলে হয়তো বুঝতে পারতাম, যে অনুভূতিগুলো লুকোতে প্রাণপাত করছি, সেগুলো আসলে কমনস্য কমন, পৃথিবীর সাত বিলিয়ন লোকের মধ্যে (তিরিশ বছর আগে ক'বিলিয়ন ছিল জানি না, গুগল করার এনার্জি নেই) ছয় দশমিক নয় নয় নয় নয় নয় নয় বিলিয়ন লোকেরই ওগুলো জাগে। কারণ অনুভূতিগুলো মনের নয়, হরমোনের।

শুনেছি আমাদের সবথেকে ড্যামেজ তারাই করে যারা আমাদের সবথেকে বেশি ভালোবাসে। পর্দা টানার পারমিশন না দিলেও ভালো যে তাঁরা আমাকে খুবই বাসতেন সেটা সত্যি। এও শুনেছি জীবনের যুদ্ধে জেতার জন্য টাকা পয়সা রূপ স্ট্যাটাসকেই অস্ত্র বলে চেনানো হলেও একটা বড়সড় শক্তির সাপ্লাই আসে জীবনের গোড়ার একটা গুরুতর সময়ে আমাদের কেউ কতটা ভালোবেসেছিল সেইটা থেকে। সেদিক থেকে দেখলে, এখনও যে চেস্ট আউট চিন আপ করে দাঁড়িয়ে আছি, মাঠ ছেড়ে পিঠটান দিইনি, তার কৃতিত্বও আমার থেকে বেশি তাঁদেরই।

তবু মনে যখন বিবিধ প্রাইভেট ফিলিংস জাগতে শুরু করল বুঝলাম যে সেগুলো মরে গেলেও ডায়রিতে লেখা যাবে না কারণ কেউ না কেউ সেগুলো পড়বেই আর পড়লে বাড়ির নাম হয়ে যাবে হস্তিনাপুর আর আমার জীবন কুরুক্ষেত্র।

ফিলিংস বাদ দিয়ে কী খেলাম, কী পরলাম, আজ স্কুলে কী হল এই সব লিখে পাতা ভরানো যেত। বুদ্ধি খাটিয়ে, ঠাকুমা কাল কী ভালো কচুর লতি রেঁধেছিলেন, পিসি আমাকে কেমন সুন্দর কাঠের বাউল কিনে এনে দিয়েছে মেলা থেকে, মা এত ব্যস্ততার মধ্যেও আমার সব বইখাতায় মলাট দিয়ে মুক্তাক্ষরে লেবেল লিখে সেঁটে দিয়েছেন সে সব লিখলে জীবনটা কেকওয়াক হতে পারত। সে সব কিছুই না করে আমি ডায়রি লেখা ত্যাগ দিলাম।

আরেক ভাবে ব্যাপারটা হ্যান্ডল করা যেত। আমার এক ক্লাসমেট ছিল, জীবনচক্রের নিয়ম মেনে তারও হরমোন ছিল আর ছিল ডায়রি। সেই ডায়রিতে সে তার যাবতীয় ফিলিংস লিখেছিল আর কাকিমাও সে ডায়রি পড়তে গিয়ে ধরা পড়েছিলেন। ধরা পড়েছিলেন কারণ লুকোনোর চেষ্টা করেননি। লুকোনোর মতো কাজ তো তিনি করেননি, করেছে আমার বন্ধু।

আমার ক্লাস সেভেনের লম্বা বিনুনি বন্ধু ব্যাপারটি আবিষ্কার করে, তুমি আমার প্রাইভেট ডায়রি পড়লে কেন বলে চেঁচিয়ে, হাত পা ছুঁড়ে, কেঁদে এমন সিনক্রিয়েট করেছিল আর কোনওদিন কেউ তার কোনও জিনিসে হাত দেওয়ার সাহস দেখায়নি। কিন্তু যে কোনও রকমের 'সিন'-এর প্রতি মর্ট্যাল ফিয়ার ততদিনে আমার বাড়ির লোকজন আমার মধ্যে জাগ্রত করতে করতে সক্ষম হয়েছিলেন। কাজেই আমার পক্ষে তার পন্থা অবলম্বন সম্ভব হয়নি।

পার্সোন্যাল স্পেসের ধার না ধারা লোকজনের থেকে দূরে গিয়েও ডায়রির কাছে আর ফেরা হয়নি। অচর্চায় অতি তীব্র প্রেম, ঘৃণা, ঈর্ষারও ধার ভোঁতা হয়, ডায়রি লেখার অভ্যেসও আমার মরে গিয়েছিল। তাছাড়া ততদিনে দিনলিপিবিষয়ক রবীন্দ্রনাথের মত জেনে ফেলেছি। মতটা ঠিকই। দিনলিপি অত্যন্ত বেশি রকমের সাম্প্রতিকতা দোষে দুষ্ট। একটা কোনও ঘটনার মধ্যে থাকার সময় তার ঘনঘটা সর্বগ্রাসী মনে হয়। যে কষ্টগুলোতে মরে যাব মনে হয়, পাঁচ বছর কাটতে না কাটতে তারাই হাস্যকর প্রতিভাত হয়। সেটা অবশ্য একটা ভালোই ব্যাপার। ডায়রি হাতেগরম প্রমাণ নিয়ে বসে আছে, এখনকার কষ্টগুলোর পরিণতি অন্য হবে না।

তবু ডায়রিটা পেয়ে আমার মনের কথা লিখতে বসার কথা মনে হল। লিখতে বসলামও। শুনেছি কেবল নিজের জন্য নিজের কথা লিখতে লিখতে জটিল সরল হতে পারে, ঝাপসা স্পষ্ট হতে পারে, অসম্ভব সম্ভব হতে পারে। ইট ক্যান ট্রুলি চেঞ্জ ইয়োর লাইফ।

মির‍্যাকলের আশায় নয়, ডায়রিটা লিখতে শুরু করেছি লোভ সামলাতে পারেনি বলেই। বেসিক্যালি তো একটা খাতা, বাঁধানো, লাইনটানা। কিন্তু ডায়রির মধ্যে এমন একটা আস্থা জাগানোর ক্ষমতা আছে যা আর কোনও খাতা তো দূর, মানুষেরও নেই। টেবিলল্যাম্পের আলোয় যখন শুয়ে থাকে মনে হয় সত্যি তো। অন্য কেউ খুলে পড়ে নিলে এ বেচারার তো কিছু করার নেই।  কিন্তু নিজে থেকে এ কোনওদিন, কোনও পরিস্থিতিতে, কোনও টর্চারের উত্তরে আমার গভীর গোপন কথা কাউকে বলে দেবে না।

সত্যি বলতে গোপনীয়তা রক্ষার গ্যারান্টিটাও জরুরি না। আমার গোপন কথা আসলে সকলেরই গোপন কথা সে এতদিনে বুঝেছি, কাজেই এক্সট্রা লজ্জা পাই না আর। ডায়রির কাছে যাই সে শোনে বলে। কেউ শোনে না। আমিও না। সকলেই বলতে ব্যস্ত। আমিও। আমার যাবতীয় প্রলাপ, দিবাস্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ যা পৃথিবীর সাত বিলিয়ন লোকের প্রলাপ, স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গের জেরক্সকপি, কাজেই তাঁরা আমারটা শুনবেন কেন, সেগুলো ডায়রি শোনে। বিনা বাক্যব্যয়ে।

ডায়রির ওপর ছোট সোনালি পাতে বেঁকিয়েচুরিয়ে অর্চিষ্মানের নাম লেখা। সে থাক। উপহারটা তো ওরই। ভেতরে নামঠিকানার জায়গায় নিজের নাম লিখে জয়েন্ট হোল্ডারের অধিকার সুরক্ষিত করে পাতা উল্টে আধখানা হৃৎস্পন্দন মিস হল। প্রথমপাতায় অর্চিষ্মান কীসব লিখেছে। ভাবলাম কনফারেন্সের নোট নিয়েছে বোধহয়। বলল, হুস, কীসের নোট। রিফিল পরীক্ষা করছিলাম।

সেও ক্ষমা করে দেওয়া যেত। হাতের লেখাটা যদি দেখতেন। তিন লাইন জুড়ে একেকটা অক্ষর। একটা ঠ্যাং কাকের হলে আরেকটা বকের।

ডায়রির প্রথম পাতায় যারা খারাপ হাতের লেখায় লিখতে পারে তারা অন্যরকম। কিটক্যাট যারা না ভেঙে কামড়ে খেতে পারে তাদের মতো। পাতাটা মাঝখান থেকে ভাঁজ করে রাখলাম। ডায়রির প্রথম পাতা নোংরা হয়ে গেছে বলে যারা ছিঁড়ে ফেলে তাদের মতো হতে চাই না বলে।

কাল ব্যাগ থেকে ডায়রি বার করে দেখি কেমন অন্যরকম দেখতে লাগছে। ব্যাগে কিছু পড়ে রইল কি না হাঁটকাতে ছোটমতো কী হাতে ঠেকল। অর্চিষ্মানের নাম লেখা সোনালি পাতটা। খুলে পড়ে গেছে। দৈব অবশেষে নির্ঘোষ পাঠিয়েছেন। জয়েন্টটয়েন্ট না, ডায়রি অবশেষে সম্পূর্ণভাবে আমার। শুধুই আমার।

হাসিহাসি মুখে ঘোরাঘুরি করতে করতে কথাটা মাথায় এল। নাম যারই থাকুক, বাইরে সোনালি পাতে ক্যালিগ্রাফিতে, কিংবা ভেতরে বাটা কোম্পানির অফারে পাওয়া ইউজ অ্যান্ড থ্রো-র জ্যালজেলে জেলে, ডায়রি আসলে এদের কারও না। ডায়রি আসলে ডায়রিকে বিশ্বাস করে মনের কথা যে বলে তার।

সোনালি চৌকোটা আবার ডায়রির ওপর সেঁটে রেখেছি।

Comments

  1. Baaah... Daarun laglo..

    aami bhaier diary poRe hasahasi korechilam bole se diary lekha cheRe diyechilo.. aami deservedly ekhono khnota shuni taar

    aami chotabelay kokhono diary likhtam na.. oto ke mehonot korbe..

    tarpor ek somoy shunlam/poRlaam je diary likhle matha thanda hoy.. digitally on and off likhte shuru korlam.. tarpor poRlam je longhand e sokale uthe diary likhle naaki daarun kaaj hoy - oi aar ki.. matha thanda kora jaay.. kichu jot chaRano jaay.. diner moood set hoy.. aar likhte gele jeta 5 ghonta brood korchilam, seta hasyokor rokomer insignificant laage..

    tai aamio mash khanek dhore sokale uthe diary (naki journaling) likhchi.. mone toh hocche laabh hocche.. otishoy boring o gyane bhora se lekha oboshyo :) :)

    khub bhalo thakben..

    Indrani

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনাকে বকার একটা বিষয় এতদিনে আবিষ্কার করা গেল, ইন্দ্রাণী। ভাইয়ের ডায়রি পড়ে আপনি মোটেই ভালো কাজ করেননি। ভাইয়ের পক্ষে সে যন্ত্রণা পুষে রাখাই স্বাভাবিক।

      কিন্তু আপনি যে ডায়রি লেখা ধরেছেন সেটা খুবই ভালো ব্যাপার। আমি মাঝে মাঝে ফাঁকি মারছি, কিন্তু লিখতে শুরু করলে এত ভালো লাগছে যে অনেকটা লিখে ফেলছি। লিখতে লিখতে ভাবনা কেমন শিফট করতে থাকে না? এই বিষয়টা নিয়ে ঘ্যানঘ্যান করব বলে শুরু করে তিনটে সেন্টেন্স হতে না হতে কমপ্লিটলি অন্য একটা বিষয় উড়ে এসে জুড়ে বসে।

      জার্নালিং যে বলে বলুক, আমি ডায়রিই লিখেছি আজীবন, আমরণ তাই লিখব।

      Delete
  2. Nijer privacy niye ami borabor otyonto protective. Diary likhle shobai pore phelbe eta jantam bolei konodin ek line likhini.

    Tobe kins..jodio ei personal space ke infringe Kors ek photao pochhondo korina, tao sajkaal majhe majhe monehoy keu jodi khuchiye bar bar 'kire kemon achhish ' jiggesh kore birokto korto, kharap hoto na

    ReplyDelete
    Replies
    1. একমত। করে গোনা কেউ কেউ থাকে বটে যে ইনফ্রিঞ্জ করলেই মনে মনে খুশি হই। ডায়রি খুলে পড়া ডিগ্রিতে নয়, কিন্তু ওই আরকি একা বসে বোর হচ্ছি বা বোর না হওয়ার ভান করছি, সে এসে খোঁচালো। মুশকিলটা হচ্ছে, তুমি যেমন বললে, এই খোঁচানোর প্রিভিলেজটা খোঁচানোর লোকগুলো হাওয়া না হয়ে গেলে মর্যাদা করা যায় না।

      Delete
  3. আগে সহানুভূতি জানাই - নতুন ডায়েরির প্রথম পাতায় রিফিল টেস্ট পাওয়াটা খুব দুঃখদায়ক বেপার।

    ছোটবেলায় আমার বাবাও প্রত্যেক বছর অনেক ডায়েরি পেত। তার থেকে অন্তত দুটো তো আমি বাজেয়াপ্ত করতাম। একদম ছোটবেলায় শ্রেফ জমিয়ে রাখতাম, তারপর একদিন (মনে হয় ক্লাস ৩ বা ৪ হবে) "ডাঃ মুনসীর ডায়েরি" পড়ে, ঠিক করে ফেললাম আমিও ডায়েরি লিখবো। শুরুতে শ্রেফ দিনের ক্রিয়াকলাপ লিখতাম, কয়েক ক্লাস পর থেকে ফিলিংস আর মতামতও জায়গা পেতে লাগলো। ইংলিশ মিডিয়ামে পড়তাম, শুরু করেছিলাম ইংরেজিতে লেখা নিয়ে, পরে মাঝে মাঝে বাংলাতে লিখতাম।

    প্রাইভেসির সমস্যাটা ছিল। তাই বলে অত প্রচন্ড গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলোই লিখবো না, সেটাও মেনে নেওয়া যায়না। তাই কখনো কখনো ছোট্ট করে ফিলিংসের কিছু জিনিস "কোডে" লিখতাম, যাতে অন্য কেউ বুঝতে না পারে। কোডটাও কোনো গোয়েন্দা গল্পেই পেয়েছিলাম, ফেলুদা হতে পারে, এটা আর ঠিক মনে নেই।

    এখনও লিখি, তবে অনেক অনেক কম। আর, পুরানো ডায়েরিগুলো এখনও আছে। কখনো যখন বের করে পড়েছি, বেশ লেগেছে।

    আর একটা জিনিস দেখেছি, যে অনলাইন প্রচুর লিখেছি, কিন্তু কাগজে লেখায় একটা আলাদা আনন্দ পাই। কে জানে, সেটা হয়ত অর্ধেক জীবন কাগজে কাটানোর, আর নস্টালজিয়ার, সম্মিলিত কারণে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমার ভাবতে ভালো লাগছে কোডের ব্যাপারটা আপনি ছিন্নমস্তার অভিশাপ থেকে পেয়েছেন, রাজর্ষি, তবে নাও যে পেতে পারেন তাও জানি। কোডে লেখার চেষ্টা আমিও করেছিলাম, নেহাতই কাঁচা বয়সে, কিন্তু নিজেই বুঝেছিলাম যে কোডগুলো খুবই নড়বড়ে হচ্ছে। আমার বাড়ির লোকের কৌতূহলের মুখে তারা বালির বাঁধ।

      কাগজে লিখতে আমারও ভালো লাগে। ওটা মনে হয় মাসল মেমোরির ব্যাপার। তাছাড়া পাশে সতেরোটা ট্যাব খোলা থাকে না সেটা বিরাট প্লাস পয়েন্ট। আমার তো লেখার ফ্লোও বেটার হয় বলে মনে হয়, কিন্তু যেহেতু টাইপ করার তুলনায় ব্যাপারটা ঢিলে, তাই একটু পর ধৈর্য চলে যায়।

      Delete
    2. ছিন্নমস্তার অভিশাপের ডিটেল মনে ছিল না, সেরা সত্যজিৎ খুলে দেখে নিলাম। তবে না, আমি ওই কোড ব্যবহার করিনি, ওই কোডে বাক্য গঠন করতে কল্পনা খাটিয়ে আগে বাক্য ঐভাবে মানানসই করতে হবে, সহজ নয়। আমি শ্রেফ ইংরেজিই হরফ গুলো নম্বরে বদলে লিখতাম। যেমন a=1 , b=2, c=3, ইত্যাদি। এটা সহজ, যদিও সময় সাপেক্ষ, আর তাই ছোট্ট সেন্টেন্সই হত, কয়েকটা মাত্র।

      কাগজে লিখতে আমার আজকাল সময়ও বেশি লাগে, লেখা আস্তে হয়ে গেছে। আবার দেড় পাতার মতো লিখতে গেলেই আঙ্গুলকে বিশ্রাম দিতে লাগে। স্কুলের বাংলা পরীক্ষায় আজ হটাৎ কেউ বসিয়ে দিলে কোনোমতেই উত্তর লেখা সময়ের মধ্যে শেষ করতে পারব না।

      Delete
    3. আমি সম্ভবতঃ পারব, তবে তার সঙ্গে লেখার স্পিডের কোনও সম্পর্ক নেই। স্কুলে পড়ার সময় প্রচুর হাবিজাবি লিখে পাতা ভরাতাম, সেইরকমই ট্রেনিং হয়েছিল। এখন উত্তরগুলোর সাইজ হাফ কি তারও কম হয়ে যাবে।

      Delete
  4. Diary majhe majhe chotobelay amio likhtam kintu amar dharona chilo amar dada segulo pore fele sobar samne hashahashi korbe. Ei bhoy e aar likhini. Prottek bangali poribarer golpo mone hoi ekdom ek. Ar lekha bolte to oi feelings aar protidiner ghotona. Chotobelay er theke beshi aar ki lekhar thake. Ekhon office e boshe kagoje kolome ektu banglae likhte khub bhalo lage. Puro PhD life e office e boshe banglae dukhher kotha likhtam. PhD shush hoar por desk faka kore jedin chole asbo sedin lekha gulo pore khub hashlaam ar kagoj gulo kuchi kuchi kore chire fele rekhe elam. io 5 years khub koste chilam, dukhher smriti sathe kore rakhte chai ni ......apnar dairy r golpo pore onek kichu mone porey galo. Dhonnobaad........Moutushi

    ReplyDelete
    Replies
    1. পি এইচ ডি জুড়ে বাংলা লেখার অভ্যেসটা দারুণ তো, মৌটুসি। দাদাসংক্রান্ত ভয়টা অত্যন্ত রিয়েল। কাজেই ভালোই করেছেন না লিখে। ছোটবেলার ডায়রির গল্প মেলাটা তো ভালো বটেই, কিন্তু বড়বেলায় কাগজেকলমে বাংলা লিখতে ভালো লাগার ব্যাপারটা যে মিলে গেছে আমাদের অনেকেরই সেটাও দারুণ ভালো।

      Delete
  5. ডায়রি উপহার পাওয়ার মতো আনন্দ কম‌ই হয়। নিয়মিত প্রতি বছর এক আধদিন ডায়রি লিখি, তাই প্রাইভেসির সমস্যা নেই যদিও অন্যের লেখা ডায়রি পড়তে ভালো লাগে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেই ভালোলাগাটার জন্যই সম্ভবতঃ ডায়রি পড়ার অত ক্যান্ডিডেট, নালক। আমার আবার অন্যের, মানে আমার চেনা লোকের, ডায়রি পড়তে ভয় লাগবে। এক, আমার সম্পর্কে এমন কিছু লিখে রেখেছে যা জানলে আমার রাতের ঘুম উড়ে যাবে, দুই, নিজের সম্পর্কে এমন কিছু লিখে রেখেছে যা জানলে আমার রাতের ঘুম উড়ে যাবে। কাজেই আমি ওই রাস্তায় নেই।

      Delete
  6. প্রাইভেসির সমস্যা মনে হয় আমাদের মধ্যবিত্ত ভারতীয় বাঙালি বাড়ি গুলোয় ভয়াবহ!(এতো স্পেসিফিক বললাম কারন আমার বাকিদের নিয়ে কোনো ধারনাই নেই)। ছেলে মেয়েদের আবার গোপন জিনিস কী থাকতে পারে যা বাবা মা জানবে না এরকম একটা ধারনা৷ অতি তুচ্ছ সেসব জিনিস কিন্তু এতটাই পার্সোনাল বোঝানোই যায় না! আমি আমার বাড়ির লোককে ব্লক করে গোপন প্রোফাইল থেকে লিখি। ইনফ্যাক্ট বড় হয়েও আমার পার্সোনাল স্পেসটা বোঝাতে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে!
    এই ডায়রি লেখাটা আর সে লেখা বাড়ির লোকের পড়ে নেওয়ার মতো দু:খজনক অপরাধ এত কমন বলে বোঝানো যাবে না।
    আমিও লিখেছি এবং লোকে পড়ে নিয়েছে, তাও আমি সব উজাড় করে লিখিনি!।তারপর বন্ধও হয়েছে লেখা।
    -প্রদীপ্ত

    ReplyDelete
    Replies
    1. তুমি একটা ইন্টারেস্টিং শব্দ ব্যবহার করলে, প্রদীপ্ত, "অপরাধ", আমার ধারণা করে গোনা লোক এই শব্দটা লুকিয়ে ডায়রি পড়ে ফেলার সঙ্গে অ্যাসোসিয়েট করবে। বাচ্চার ডায়রিটায়রি তো কোন ছার, আমি অ্যাডাল্ট ছেলেমেয়ের ব্যাগ হাঁটকে প্রেমপত্র পড়ে ফেলার কেসও শুনেছি। পড়ে আবার ছেলেমেয়েকেই চমকেছে। অদ্ভুত। গভীর মনস্তাত্ত্বিক ঝামেলা এগুলো, এখন মনে হয়।

      Delete
    2. সন্তান হল বাবা মায়ের সম্পত্তি, সে আলাদা একজন এনটিটি এ কথা ভারতীয় সমাজে প্রচলিত নয় তাই এইসব করা সোজা আর কি।
      -প্রদীপ্ত

      Delete
  7. বৈজয়ন্তীFebruary 22, 2023 at 12:10 AM

    বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ডায়েরি লিখতাম ইংরেজিতে লেখা অভ্যাস করার জন্য। কিছু উন্নতি হয়েছিল কিনা জানিনা, তবে চেষ্টা করেছিলাম। আর কলেজের পর থেকে সব ডায়েরি লেখা হতো বাংলায়, লেখার অভ্যাসটা চালিয়ে যাবার জন্য।
    স্কুলবেলায় বড়ো ডায়েরিতে খুব লোভ ছিল, আগে বাবার থেকে 'ঝাঁপতাম', পরে বাবা নিজেই দিয়ে দিতেন। প্রাইভেসির জন্য পড়ার ডেস্কে চাবিও ছিল..
    বাবার স্কুল ওখানে হওয়ায় প্রায়ই কলেজ স্ট্রিট যাওয়া হতো, আর ডিসেম্বর জানুয়ারি ভর ফুটপাথে ডায়েরির সারি দেখে অসম্ভব ইচ্ছে হতো কেনার।
    এখন আর ওরম ব্যাপারটা নেই..তবে স্টেশনারী আইলের সামনে গিয়ে লোভে পায়ের নখ থেকে মাথার চুল অবধি টনটন করে ওঠাটা এখনো রয়ে গেছে...পেন, ডায়েরি, স্কেচখাতা, রংতুলি, এমনকি কাগজের বান্ডিল ..
    একবার খুব শখ করে হ্যান্ডমেড কাগজের ডায়েরি কিনেছিলাম। তারপর দেখলাম, তাতে লেখা অত্যন্ত চাপের ব্যাপার। ঠিক মতো কালি পড়েনা, কোথাও নিব পিছলে যায়, কোথাও কালি শুষে নেয়, হাতের লেখাও ট্যারাবেঁকা হয়ে যাচ্ছে। সিনেমায় দেখা জিনিস যে বাস্তবসম্মত নয়, তার আবার একটা প্রমাণ পাওয়া গেছিলো।
    এখন আবার ডায়েরির শক্ত বাঁধাইটা খুব অস্বস্তিজনক লাগে, তাই একটা ডায়েরির মতো ভালো দেখতে খাতায় সরে পড়েছি।

    আপনাকে ঝাঁ চকচকে সুন্দর ডায়েরির অনেক শুভেচ্ছা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যান্ডমেড কাগজের ডায়রিতে লেখার দুঃস্বপ্ন আমারও হয়েছে, বৈজয়ন্তী। দেখতেও ভালো, কাজেও ভালো, এ কম্বিনেশনের সোনার পাথরবাটিত্ব আবার নতুন করে চিনেছিলাম। স্টেশনারির লোভ কাটিয়ে উঠেছি কারণ ভীষণ জঞ্জাল হয়। লাস্ট যে স্টেশনারি খরচটা করেছিলাম, এই নববর্ষের সিজনেই, ইউটিউবে পনেরো মিনিটের সেলিব্রিটিদের মুখে ভিশন বোর্ডের কথা শুনে একটা বোর্ড কিনে, তাতে নাকি জীবনের ব্লু প্রিন্ট গেঁথে রাখব। জীবন যে ছাড়া গরু সেই ছাড়া গরুই রয়ে গেছে, আসতে যেতে বোর্ডটার দিকে চোখ পড়লে খালি বুকের মধ্যে চারশো টাকার খোঁচা। পুশ পিনও কেনা হয়েছিল আবার ট্রান্সপারেন্ট ভ্যারাইটির। এখন কোথায় কোনও আইডিয়া নেই।

      Delete
  8. Ei topic ta besh kintu 😊, lekhatar songeo sobar jiboner ki mil.. Amar ekta khub favourite tala chabi dewa diary chilo school e porte, onek likhe ekdin kichu rag dukkho hobar karone ami sob patagulo favicol diye atke diyechilam 😁, ekhono diary kini colourful dekhe , ekhon keu pore felar bhoy nei tao lekha hoy kom.. ekhon chheler diary lekha cholche, tobe amakei onek spelling bole diye hoy haha, moja lagche kichudin por kemon hobe seita vebe.

    ReplyDelete
    Replies
    1. nam likhte bhule gechilam.

      Delete
    2. ফেভিকল দিয়ে ফ্রাস্ট্রেশন প্রকাশটা চমৎকার তো, ঊর্মি। তালাচাবি ডায়রি স্কুলে কিছু লোকের কাছে দেখেছিলাম বটে, কিন্তু শিওর ছিলাম ও সব আমার ভাগ্যে জুটবে না।

      Delete

Post a Comment