পুজো ২০২৩
পঞ্চমী
যদিও রেজলিউশন নিয়েছিলাম যে ফেলুদাব্যোমকেশের পাশ থেকে সরে দাঁড়াব কিন্তু দাঁড়াব কোথায়? আবার শোনা যাচ্ছে এটা অনির্বাণের লাস্ট ব্যোমকেশ। পাছে ইতিহাস মিস করে হাত কামড়াই, হইচই-তে দুর্গ রহস্য খুলে বসতে হল। গোড়াতে গুলিয়ে যাচ্ছিল, মনোযোগ দিচ্ছিলাম না বলেই নিশ্চয়, কে উত্তমকুমার, কে ব্যোমকেশ। অর্চিষ্মান বুঝিয়ে দিল। অনির্বাণ ব্যোমকেশ। কাল্পনিক ব্যোমকেশ। অনির্বাণ কাল্পনিক না। অনির্বাণ রিয়েল। উত্তমকুমারও রিয়েল। সত্যজিৎ রিয়েল। চিড়িয়াখানা সিনেমাটাও রিয়েল। নিজের জীবনের কেস নিয়ে বানানো সেই রিয়েল সিনেমা দেখতে গেছে কাল্পনিক ব্যোমকেশ। গিয়ে মবড হচ্ছে।
গোটা সিরিজটা যদি ব্যাখ্যা করতে করতে দেখতে হয় সেই ভয়েই বোধহয় অর্চিষ্মান বলল, চল বেরোই।
সন্ধে থেকে প্যান্ডেলের গানের চোটে জানালা কাঁপছে। রাস্তায় ভিড়। ঘোলে চুমুক দেওয়ার মতো করেই বলাবলি করি, পঞ্চমীতেই এই্, শনিরবি কী হবে বুঝতে পারছ? আজ তো আসল পুজো না তাই টি শার্ট জিনস পরেই বেরোলাম। অর্চিষ্মানও সেই ধুদ্ধুড়ে জামাই পরেছে অথচ আমাকে বলছে, ভালো জামা পরলে না? বললাম, কাল পরব। ষষ্ঠীতে নতুন জামা পরতে হয়। ঠাকুমা বলেছে। না-পরা জামা একটাই আছে, আজ পরে ফেললে কাল থাকবে না।
জুতো গলাতে গলাতেও ফিরে এলাম। টি শার্ট ছেড়ে একটা ভালো জামা, নতুন না, কিন্তু ভালো, গলালাম। পঞ্চমী বলে কথা, একেবারে কালাপাহাড় হলে ভালো দেখায় না।
আজ কলেজ স্কোয়্যারের উত্তরটা কভার করব, কাল দক্ষিণ, পরশু শ্রীরামপুর, তরশু কোন্নগর এই সব হবে না। হওয়াতে চাওয়ালে হয়। আজ সি আর পার্ক, কাল নয়ডা, পরশু গুড়গাঁও, তরশু কাশ্মীরী গেট, কিন্তু অত এনার্জি নেই। আমরা বেসিক্যালি সি আর পার্কের প্যান্ডেলগুলো দেখব। পঞ্চমী টু দশমী, ওই পাঁচটা প্যান্ডেলেই। প্যান্ডেল একই থাকবে। আমরা একই থাকব। আমাদের চারপাশের ভিড় বদলাবে। প্যান্ডেলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বদলাবে। গুড এনাফ।
পাড়ার ঠাকুর দিয়েই শুরু করা ভালো। পাড়া মানে গুগল ম্যাপের মতে পাড়া। এ ছাড়া পাড়া শব্দটা আমার মধ্যে যা যা অ্যাসোসিয়েশন তৈরি করে তার কোনওটার সঙ্গেই মিল নেই এই জায়গাটার। ঢাক বাজছে। বাড়ির উল্টোদিকের গেট দিয়ে মাঠে ঢোকা যাবে না। সিকিউরিটি দিদি দাঁড়িয়ে হাই তুলছেন। ঘুরে মেন গেট দিয়ে ঢুকলাম। আজ লাইন নেই অ্যাট লিস্ট।
আরে এই মূর্তিটা দেখেছি তো। দিনতিনেক আগে এই মূর্তিটার টেম্পোর পেছনে আমার অটো আটকেছিল। আরও অনেক অটো, টোটো, ভ্যান, ঠেলাগাড়ি, গাড়ির মতো। টেম্পোর আগেপিছে বাইকবাহিনী লগা হাতে তার তুলতে তুলতে আসছিল। তারপর ফাঁক পেয়ে অটোভাইসাব মাদুর্গাকে ওভারটেক করলেন। একবার সন্দেহ হয়েছিল প্রতিমাটা মেলা গ্রাউন্ডেরই কি না, শিওর ছিলাম না।
ঢাক বাজছে। বাবামায়েরা গেঁড়ি বাচ্চাকে ঘাড়ে তুলে ভিড়ের মাথার ওপর দিয়ে দেখাচ্ছে। কিছু লোক নাচছে। কিছু লোক ভুরু কোঁচকাচ্ছে। কিছু লোক ভুরু কুঁচকে ভাবছে, ইস যদি নাচার সাহস থাকত। এগুলো যা বুঝেছি, প্রতিবর্ত ক্রিয়া। চল্লিশ বছর আগেও হত। চল্লিশ বছর পরেও হবে। মোবাইলটোবাইল বাদ দিলে ভেতরটা তো বদলায়নি, বদলায় না। প্যান্ডেলের বাইরে মাঠের বাকিটাও গত কে জানে কত বছরের মতোই। অর্থাৎ, কোণার দিকে যেখানে কাবাবটাবাবগুলো থাকার কথা সেখানেই আছে, বিরিয়ানি, দোসার স্থানাংকেও বদল ঘটেনি, মাঠের মাঝখানে গুচ্ছ বেঁধে কফি, ঝালমুড়ি, চুসকি যেমন থাকে। অর্চিষ্মান মুহ্যমান। খেয়ে বেরিয়েছি। কাল অর্থাৎ চতুর্থীতে রাহুল এসেছিল একগাদা খাবারদাবার নিয়ে। খেয়ে যা বেঁচেছে আরও তিনদিন চলবে। লিট্টি চোখার একটা না, দুটো স্টল বসেছে। আগুনের ওপর তারের জালি, জালির ওপর গোল গোল লিট্টি। আমরা দুজনেই বিশ্বাস করি #ইস্টইঅরওয়েস্টবিহারিখাবারইজদাবেস্ট। অর্চিষ্মান ইনকনসোলেবল হয়ে পড়ল। এই মুহূর্তে পেটের মাথায় বন্দুক ধরলেও লিট্টি খাওয়া সম্ভব নয়। যাই একটু কাছ দিয়ে হেঁটে আসি অ্যাট লিস্ট। বলে উনুনের খুব কাছ দিয়ে হেঁটে গেল।
এইচ ব্লকের গেটের কাছে ট্যারো কার্ড রিডিং-এর স্টল। অর্চিষ্মান এদিকওদিক তাকাচ্ছে। বলছে, শোনো, ফাঁকা দেখে আসতে হবে, কেউ দেখে ফেললে কেস। আমি যখন রিডিং করাব তখন তুমি আমাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকবে, তুমি যখন রিডিং করাবে আমি আড়াল করে দাঁড়িয়ে থাকব। বললাম, হ্যাঁ আর রণথম্ভোরে সাফারিতে একটা ফ্লপি টুপি দিয়েছিল মনে আছে, চিবুকের তলায় দড়ি বাঁধা? সেই টুপিটা আর মাস্ক পরে আসলে কারও চেনার চান্স নেই। যদি না তোমার হাইট দেখে ধরে ফেলে। দোকানের খুব কাছে দাঁড়িয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে এই সব বলাবলি করছি, এমন সময় একজোড়া মা মেয়ে দোকানে ঢুকলেন। ভালো করে দেখব বলে ঘাড় ঘোরাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল। হতেই ওঁরা সেই হাসিটা হাসলেন যেটা আমরাও ওঁদের জায়গায় থাকলে হাসতাম। হাসির মানে হচ্ছে, আমরা এ সব বুজরুকিতে বিশ্বাস করি ভাববেন না যেন, জাস্ট টাইমপাস।
অর্চিষ্মান শেষটায় না পেরে একটা মুড়ি অর্ডার করে ফেলল। অর্থাৎ ভাইসাবকে গিয়ে বলল, ভেলপুরি দিজিয়ে। দোকানের সামনের বোর্ডটা তো পরবে পরবে বদলানো যায় না, সেখানে চনমনে অক্ষরে ভেলপুরিই লেখা আছে। আস্তে করে বললাম, ঝালমুড়ি। অর্চিষ্মান বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, ঝালমুড়ি, ঝালমুড়ি দিজিয়ে। তারপর বলল, দুটোর মধ্যে যে তফাৎ আছে ভুলে যাই। এই সব কমেন্টে রিঅ্যাক্ট করা ছেড়ে দিয়েছি অনেকদিন। কোনদিন বলবে, রবীন্দ্রনাথের যে দাড়ি ছিল মনেই থাকে না। আমাকে কালা খাট্টা চুসকি খাওয়ার জন্য তা দিল খুব, খেলাম না। কারণ প্রতিবারই খাই আর খেয়েই মনে হয়, যত আনন্দ হওয়ার কথা ছিল ততটা তো হল না। স্প্রাইটের মিনি বোতল কিনে মাঠ ছাড়লাম।
রাস্তার দুপাশে মুড়ি, কচুরি, রোল, বিরিয়ানি। হার, দুল, বেলুন, মুখোশ, আলোর শিং। আচার, মুখশুদ্ধি, চুরন। চুরনের ঠেলার ওপার থেকে এক ভদ্রলোক, কথা নেই বার্তা নেই, মুচকি হেসে ভুরু নাচাচ্ছেন। ঠিক দেখলাম কিনা কনফার্ম করতে তৃতীয়বার তাকিয়ে টের পেলাম, ও হরি, ইনি আমার বাঁধা ভুট্টাবিক্রেতা। কনটেক্সট কী ইম্পরট্যান্ট। ভুট্টার ঠেলা চুরনের ঠেলা হয়ে গেছে বলে রোজ বিকেলে দেখা একটা লোককে চিনতে পারছি না।
কালীমন্দিরের ঠাকুরের মুখ কাগজঢাকা। আমাদের মেলা গ্রাউন্ডের চালচলন ঘোর কমার্শিয়াল। মায়ের মুখ ঢাকাফাকার ব্যাপার নেই। মন্দিরে প্রত্যাশিতভাবেই নিয়মনিষ্ঠার জাঁক, পঞ্চমীতে প্রতিমার মুখ দেখা নিষিদ্ধ। পাশে স্টেজ বেঁধে গান হচ্ছে। মাসখানেক ধরেই হচ্ছে। প্রতিবছরই পুজোর আগে অ্যানুয়াল সাংস্কৃতিক নাচগানের প্রতিযোগিতা চলে। কয়েকদিন আগে এক নম্বর মার্কেটে অর্চিষ্মানের ছবি তোলাতে এসে ঢুকেছিলাম। সেদিন লিটল চ্যাম্পস, অর্থাৎ ক্লাস সিক্স থেকে টেনের বাংলা ও হিন্দি গানের কম্পিটিশন চলছিল। মোটা চশমা পরা, কদমছাঁট বাচ্চারা খুব দরদ দিয়ে 'এ কোন সকাল, রাতের চেয়েও অন্ধকার' গাইছিল। এক প্লেট বেগুনি নিয়ে পেছনের দিকের দুটো চেয়ারে বসে খেতে খেতে শুনেছিলাম। প্রায় সব গানই শুধু জানি না, মুখস্থ। অর্চিষ্মান আবার কোনও গানই নাকি শোনেনি। বাঙালির ছেলের যখন এ সব গান শোনার কথা তখন উনি পিয়ার প্রেশারে দুলে দুলে পিংক ফ্লয়েড মুখস্থ করছিলেন। মন্দিরের বাইরে বড় ব্যানারে এ বছরের কম্পিটিশনের নির্ঘণ্ট। অর্চিষ্মানকে বললাম সামনের বছর আমি এটায় নাম দিচ্ছি। বলে 'ষোল অ্যান্ড অ্যাবাভ' ক্যাটেগরিটার দিকে দেখালাম। বলে নিজেই সম্ভাব্য কথোপকথন কল্পনা করতে লাগলাম। প্রথমেই জিজ্ঞাসা করবে নির্ঘাত, আপনার বাচ্চা কোন ক্যাটেগরিতে কমপিট করবে ম্যাম? অর্চিষ্মান বলল, তারপর তোমার নাম এন্ট্রি করে ইমিডিয়েটলি ক্যাটেগরির নাম বদলে ষোল টু পঁচিশ করে দেবে।
যাই হোক, আজ বোধহয় সেই ষোল অ্যান্ড অ্যাবাভ-এর ফাইন্যাল । একটি ছেলে, পঁচিশ মতো বয়স, খুব দরদ দিয়ে 'মন মাঝি রে' গাইছে। এই গানটা যে পরের পাঁচদিন কত প্যান্ডেলে শুনলাম। কম্পাউন্ডে যে কারণেই ঢোকা হোক না কেন, অর্চিষ্মান একবার মন্দিরে ঢুঁ মারবেই। আমার সন্দেহ অর্চিষ্মানের মধ্যে একটা সুপ্ত ভক্ত প্রহ্লাদ আছে, বুড়ো হলে দাঁতনখ বার করবে। মন্দিরের টাইলস সর্বদাই এত ঠাণ্ডা থাকে মনে হয় শুয়ে পড়ি। ওই জন্যই অত লোক সাষ্টাঙ্গ হয় কি? বাবার কোলে চড়া বাচ্চারা জোরে জোরে ঘণ্টা বাজাচ্ছে। পেছনের মাঠে বাঁশ পোঁতাপুঁতি হচ্ছে। কাল থেকে জগঝম্প শুরু হবে। আসব।
নবপল্লী আর ডি ব্লকের ঠাকুরের মুখও নিউজপেপার ঢাকা। কোঅপারেটিভের ঠাকুরটাও আজ থাক। কাল হবে। এখন বাড়ি যাওয়া যাক। পুরোনো পাড়ার রাস্তা ধরে ফিরি। রাস্তার এই অংশটায় পেছনের প্যান্ডেলের আলো ফুরিয়েছে অনেকক্ষণ, সামনের প্যান্ডেলের আলো শুরু হয়নি। কিংস আইসক্রিমের এই আউটলেটটা আগে ছিল? অর্চিষ্মান বাটারস্কচ কাপ আইসক্রিম নিল, আমি কেসরপিস্তা স্টিক কুলফিতে স্টিক করলাম।
ষষ্ঠী
এখনও ছ’টা বাজেনি। ঢাক বাজছে। বোধহয় পুজো হচ্ছে। কোন প্যান্ডেলে কে জানে। জানা থাকলে গেলে হত। না থাক। কাজ প্রচুর। অ্যাকচুয়ালি, পুজো নাও হতে পারে। ঢাকের শব্দটা মোবাইল। ঢাকিরা এলেন বুঝি কোনও প্যান্ডেলে।
অর্চিষ্মানকে খুঁচিয়ে তুললাম। ষষ্ঠীর সকাল মজাহীন ভালো দেখায় না। ভালো কিছু ব্রেকফাস্ট করে কাজ শুরু করা যাক। এত সকালে দোসা ইডলি ছাড়া কিছু খাওয়া শক্ত, পাওয়াও মুশকিল। এত সকালে মজা করার ইচ্ছে হলে সাধারণত আমরা জাগারনাট বলে একটা দোকানে যাই। অর্চিষ্মান দাঁত মাজতে মাজতে বলল ওর অফিসের কে নাকি বলেছে সিপি-তে একটা নতুন দোকান খুলেছে, সাউথ ইন্ডিয়ান এবং ভালো। বলে টুথব্রাশ গালে গুঁজে সিলিং-এর দিকে তাকিয়ে ভিষ্ ভিষ্ করতে লাগল। আমি বললাম, ভিষ্ণুদাস বালাপোরিয়া? অর্চিষ্মান চোখ ঘোরাল।
কনট প্লেস লোকেশন সেট করে জোম্যাটোতে বি এইচ টাইপ করলাম। খুব আস্তে আস্তে যাতে জোম্যাটো ধরতে না পারে যে আমি বি এইচ এর পরের অক্ষরগুলো জানি না। তার আগেই অটো সাজেশনে দোকানটার নাম বলে দেয়। ট্যাকটিক্স কাজে দিল। বি-এর পর তিন সেকেন্ড গ্যাপ দিয়ে এইচ টাইপ করাতেই সাজেশনে ভীমেশ্বরা এসে গেল। আজকাল ভোরে বা গভীর রাতে অটো নিলে ঠাণ্ডা লাগে। তাই উবার গো ডাকা হল। ফাঁকা রাস্তায় উড়ে গেলাম। মেনু স্ট্যান্ডার্ড। একটাই ক্যাচ। বেশি ভালো ভালো খাবারগুলো লাঞ্চে পাওয়া যায়, সকালে শুধু দোসা ইডলি উত্থাপাম। আমি ভীমেশ্বরা স্পেশাল দোসা্ অর্ডার করলাম, অর্চিষ্মান সেএএএই মাইসোর মসালা। লাস্টে ফিলটার কফি।
বিকেলে প্রসেনজিৎ দেরি করে এল। ষষ্ঠীতেই ছুটি নেবে বলেনি। বলেনি বলেই ফোন করে হাঁকাহাঁকিও ভালো দেখায় না। একঘণ্টা পর দেখি বেল বাজছে। মাঞ্জা দেওয়া পাঞ্জাবী পরে প্রসেনজিৎ। বলল, কত মজা হল আনন্দমেলায়। আঠেরো নম্বর টেবিল, মেনু সিম্পল, পাওভাজি আর বিটের হালুয়া। তিন বাটি হালুয়া, বাটির বিরাটত্ব বোঝাতে দুই হাত ছড়াল, সব শেষ। মুখ চুন করলাম। শেষ? অর্চিষ্মান বলেছিল আনন্দমেলায় খাবে। প্রসেনজিৎ বলল, এই রে, বল তো দৌড়ে গিয়ে কিনে আনি, যদি কিছু পাই। বললাম, দরকার নেই। তারপর বললাম, এত ভালো জামা পরে কাজ করতে হবে না। হেসে উড়িয়ে হাতা গুটিয়ে ঝাঁটার খোঁজে গেল। অন্ততঃ রান্নাটা বাদ দাও, বললাম আমি। কোনওরকম উদারতা থেকে নয়। কাল কান মুলেছি। বাড়িতে আর খাচ্ছি না। সি আর পার্কের প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে যে প্যান-ইন্ডিয়ান কুইজিনের বিস্ফোরণ ঘটেছে তাকে বৃথা যেতে দেওয়া যায় না।
মেলা গ্রাউন্ডে এক মহিলা গাইয়ে আসর জমিয়েছিলেন। সোহাগ চাঁদবদনি ধনী, পিন্ডারি পলাশের বন ইত্যাদি গান ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ স্পিডে গেয়ে ভিড়কে নাচতে উদ্বুদ্ধ করার প্রাণপণ চেষ্টা করছেন, কেউ নাচছে না। ইতিহাস পরীক্ষার দিন ভূগোল পড়ে চলে যাওয়ার পর সেকেন্ড মোস্ট ফ্রিকোয়েন্ট দুঃস্বপ্ন আমার। আমি লাফিয়েঝাঁপিয়ে ডিগবাজি খেয়ে লোকজনকে চাঙ্গা করতে একশা হচ্ছি, এদিকে সবাই কাঠ হয়ে বসে সোজা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হাই তুলছে। ওই জন্য আমি কক্ষনও দর্শকাসনে বসে (বা এক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে) হাই তুলি না। জোরে জোরে হাততালি দিই। এঁকেও দিলাম। দিয়ে খাবারের খোঁজে গেলাম। অর্চিষ্মান চিকেন টিক্কা আর শামি কাবাব খেল, আমি আলুর চপ। খেয়েদেয়ে আবার চেনা রুটে চেনা পরিক্রমা। কালীমন্দিরের পেছনের মাঠে বাঁশ পোঁতা শেষ, সাইকেডেলিক আলো বনবন ঘুরছে। কলকাতা থেকে গানের দল নাচের দল সব এয়েচে, ভিড় উপচে পড়ছে। আমাদের এখানে ম্যাজিক ওয়ার্ড, কলকাতা। বাজারে যান, একই উচ্ছের দুটো ঢিপি। একটা এখানকার। অন্য ঢিপিটা কলকাতার, বলার সময় দুই হাত ছিটকে বুকের কাছে জড়ো। দাম ডবল। আমরা ভিড় গলে ভদ্রস্থ জায়গায় পৌঁছতে পৌঁছতে গানের অনুষ্ঠান শেষ, নাচ শুরু। মেন দিদিমণি দুর্গা সেজেছেন, মেন দাদাভাই অসুর। বাকি সবাই পেছনে সারি বেঁধে গ্রামবাসী। টিমপ্লেয়ার নই বলেই এই সব নাচের দল গানের দল দেখলে অস্বস্তি হয়। যে যত ভালোই নাচুক না কেন, আসলে তো দাদামণিই সামনে নাচবেন। যে যত সুরেই গাক, গলাভাঙা দমফুরোনো দিদিমণিই মাইক পাবেন। যাই হোক, ষষ্ঠীর দিন এ সব হাবিজাবি কথা ভাবতে নেই। মহিষাসুরের পোশাকটা আমার মন টেনেছে, অর্চিষ্মানকে পরের পুজোয় ওই ডিজাইনের একটা জামা বানিয়ে দেব।
আমাদের সামনে দুই পুলিসদিদি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাচ দেখছিলেন। আমরাও দেখলাম। নাচগান যথেষ্ট ভালো হওয়া সত্ত্বেও হাসাহাসি করলাম। ওটার সঙ্গে নাচগানের কোয়ালিটির কোনও সম্পর্ক নেই, আমাদের স্বভাবের আর ফুর্তির আছে। এই সব অনুষ্ঠানে নাচের মাঝেমাঝে গ্রন্থনা টাইপের একটা ব্যাপার হয়। গলা কাঁপিয়ে কিছু গভীর কথা, কোটেশনখচিত। মেটেরিয়ালিস্টিক হবেন না। সত্যের পেছনে ছুটুন। শুভ দিয়ে অশুভকে মারুন।
চল্লিশ পেরিয়ে আমার মধ্যে একটা গ্যাদগেদে ব্যাপার জন্মেছে, পুজোয় বেপাড়ার লোক দেখলে মনের ভেতর অতিথি আপ্যায়নের ভাব জেগে ওঠে। বাঙালি বাচ্চা ভেঁপু বাজালে কান চেপে অকুস্থল ত্যাগ করি, কালকাজী থেকে বাবামা দিদির সঙ্গে আসা লেহেঙ্গা চোলি পরা চারবছর বয়সী ছোট বোন, ভেঁপু আমার কানের মধ্যে ঢুকিয়ে বাজালেও মনে হয়, আহা, বাচ্চা। মনে হয় বলি, আসুন আসুন, ঠাকুর দেখুন, কী খাবেন বলুন। কোর্মা থেকে কচুরি, সব আছে। একটা জিনিস দেখেছি, বাঙালি পুজো যে সব অবাঙালিরা দেখতে আসেন, বিশেষ করে ননভেজ হওয়া সত্ত্বেও নভরাত্রিতে যাঁদের ম্যান্ডেটরি পুরিসুজি, দুর্গাপুজোর প্যান্ডেলে তাঁদের চৈত পরব। বাঙালিরা খাবে কী, কালকাজীর যত সর্দারজী হোল ফ্যামিলি নিয়ে ফিশফ্রাই ফুরিয়ে ফেলছেন।
বাচ্চাদের দেখতে তো অবভিয়াস কারণেই ভালো লাগে। স্কুলের শেষ থেকে কলেজের শুরুর বয়সটাও চমৎকার। হয় দু'জন হাতে হাত গলিয়ে, নয় দল বেঁধে ঘুরছে। উড়ছে বলাই সঙ্গত। অর্চিষ্মানকে বলি, এরা কিন্তু আমাদের দেখতে পাচ্ছে না। আমরা এদের কাছে সমস্ত অর্থেই অদৃশ্য। ইনভিজিবল। অর্চিষ্মান বলল, ঠিক যেমন বুড়োবুড়িরা আমাদের কাছে।
অপরাধবোধ ঘোচাতে আবার খেতে হল। ফুচকাটা ফুচকা বলেই খাওয়া গেল। চা-টা চা হওয়া সত্ত্বেও খাওয়া গেল না। প্রফিট মার্জিন বাড়াতে এক গঙ্গা জলে এক চিমটি চা দিয়ে ফুটিয়েছে। জঘন্য। সে চা-ও শান্তিতে দাঁড়িয়ে খাওয়ার উপায় নেই। লোকে এদিকওদিক থেকে ধাক্কা মারে। ধাক্কা না মারলেও কার ফোনের ফ্রেমে কখন ঢুকে পড়ছি খেয়াল রাখতে প্রাণান্ত। ভঙ্গিটা রাখি, সরি সরি, দেখতে পাইনি আপনারা ছবি তুলছিলেন, আমাদের একটু দৌড়ে চলে যেতে দিন, আসল ফিলিংটা হচ্ছে ওই সব ভয়ানক ছবিতে চিরজীবনের মতো এক্সট্রা হয়ে থেকে যেতে চাই না।
একটা ভালো ব্যাপার ঘটল। কে জানে কত বছর পর অর্চিষ্মান একটা প্রশংসাবাক্য দাঁতের ফাঁক থেকে বার করল। প্রশংসা ও করে ঘনঘনই, কিন্তু সেগুলো শুনতে সন্দেহজনক। যেমন, হাফচেনা কেউ দূর থেকে হাসিমুখে এগোচ্ছে দেখলে বলে, তোমার তো হ্যাজাতে ভালো লাগে, লৌকিকতাটা তুমিই কর। বা, ভালো ম্যানিপুলেট করলে তো সিচুয়েশনটা। আজ গলা ঝেড়ে বলল, তোমার সঙ্গে পুজো দেখতে বেরোনোর সুবিধে আছে। বললাম, কী সুবিধে শুনি? বলল, দেড় সেকেন্ড পরপর ছবি তুলে দিতে হয় না।
বলেই কনুই টানল। অত ভিড়ের মধ্যে কী দেখাচ্ছে বুঝতেই লেগে গেল পনেরো সেকেন্ড। তারপর দেখতে পেলাম। একজোড়া মামেয়ে। দেখান কারণটাও বুঝলাম। দুই প্রজন্ম একরকমের দেখতে হলে সেটা অর্চিষ্মানের কাছে ফ্যাসিনেটিং প্রতিভাত হয়।
এই জুটির একজন আরেকজনের থেকে বছর পঁচিশ-তিরিশের বড়। একজন মোটার দিকে একজন টিংটিং। একজনের খোঁপা আরেকজনের ববছাঁট। এ ছাড়া আর কোনও অমিল নেই। নাক মুখ চোখ হাসি, কন্ট্রোল সি কন্ট্রোল ভি। একটা মানুষ, নিজের ভবিষ্যতের ভার্শান সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে। আরেকটা মানুষ, নিজের অতীতকে নিয়ে। প্রতিমাকে পেছনে রেখে একটা সেলফি তোলার চেষ্টায় রত। প্যান্ডেলের ওই পরিস্থিতিতে ব্যাপারটা রীতিমত স্ট্রাগল, হয় তোলার মুহূর্তে কেউ ঠাকুরের মুখ ব্লক করে দিচ্ছে, নয়তো সোজা ধাক্কা। দুজনের আরেকটা মিল। ধাক্কাখাওয়া ছবি দেখে বিচলিত হওয়ার বদলে হেসে ওড়াচ্ছেন, নতুন একটা জায়গা পছন্দ করে দাঁড়াচ্ছেন।<
ভালোবাসা খুব একটা শক্ত ব্যাপার নয়। অনেকদিন পাশাপাশি রেখে দিলে, রক্তের সম্পর্কটম্পর্ক থাকলে তো হয়েই গেল, অভ্যেস, দেওয়ানেওয়া মিলিয়েমিশিয়ে একধরণের ভালোবাসা তৈরি হয়েই যায়। যেটা তৈরি হয় না, যেটা তৈরি করা যায় না, সেটা ভালোলাগা। এ যদি আমার কেউ না হত, এর সঙ্গে যদি আমার কোনও দেওয়ানেওয়া থাকত না, তবু কি আমার একে ভালো লাগত? সে রকম কারও সঙ্গে যদি কপালগুণে জুটে যাওয়া যায়, রক্তের সম্পর্ক থাকলে তো কথাই নেই, একটা স্পেশাল কিছু ঘটে। কেমন স্পেশাল, কতটা স্পেশাল যার ঘটে সে জানে।
খুকখুক হাসির শব্দ। দুটো মাথা, একটা কাঁচা, একটা কাঁচাপাকা, ফোনের ওপর ঝুঁকে হাসছে।
চোখ সরিয়ে নিলাম। অর্চিষ্মানকে বললাম, চল বেরোনো যাক।
*****
যদিও পুজোর তিনদিনের গল্প বাকি রইল, কিন্তু পুজো শেষ, লক্ষ্মীপুজোও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শুরু হল বলে। শুভ বিজয়াটা এবার না সারলেই নয়। আপনাদের সবার জন্য অনেক ভালোবাসা, ভালোচাওয়া আর কোলাকুলি রইল। সব ভালো হোক।
সব ভালো হোক। শুভ বিজয়া।
ReplyDelete-প্রদীপ্ত
আমার তরফ থেকে তোমার আর তোমার পরিবারের প্রতি শুভেচ্ছা রইল।
Deleteশুভ বিজয়া
ReplyDeleteশুভ বিজয়া।
DeleteShubha Bijaya
ReplyDeleteআপনাকেও বিজয়ার শুভেচ্ছা, হীরক।
Deleteশুভ বিজয়া
ReplyDeleteশুভ বিজয়া।
Deleteশুভ বিজয়ার কোলাকুলি, প্রণাম, ঘুগনি, নারকেল নাড়ু, ইত্যাদি।
ReplyDeleteবিষ্ণুদাস বালাপোড়িয়া টা পড়ে অনেকক্ষণ হাসলাম।
তোমার জন্যও কোলাকুলি, ঘুগনি, নাড়ু, নিমকি, বিম্ববতী। সবাই মিলে খুব ভালো থাকো।
Deleteমহিষাসুরের পোশাকটা আমার মন টেনেছে, অর্চিষ্মানকে পরের পুজোয় ওই ডিজাইনের একটা জামা বানিয়ে দেব। ----- eta pore jata rokomer haschhi Kuntala.
ReplyDeleteShubha Bijaya apnader. Emontai thakun :)
আপনাদের সবাইকেও অনেক শুভেচ্ছা ভালোবাসা কোলাকুলি। পুজো ভালো কেটেছে আশা করি।
Deleteমহিষাসুরের পোশাকটা দেখলে শিওর কেঁদে ফেলতেন। রোমহর্ষক যাকে বলে।
শুভ বিজয়া কুন্তলা দি, পুজোর বাকি গল্পও শুনতে চাই ।
ReplyDeleteতোর আর তোর বাড়ির সবার জন্য অনেক শুভেচ্ছা, ঊর্মি। শুভ বিজয়া।
Deleteশুভ বিজয়া কুন্তলাদি, খুব ভালো থাকুন।
ReplyDeleteবাকি তিনদিনের গল্পও ঝটপট পোস্ট করুন।
আধিরা, শুভ বিজয়ার অনেক ভালোবাসা আর কোলাকুলি তোমার জন্য। হ্যাঁ, বাকিটা লিখে ফেলব এইবার।
Deleteশুভ বিজয়া কুন্তলা! তোমার লেখা আমার এবারের পূজাবার্ষিকী| বাকি দিনগুলোর গল্প লিখে ফেলো, অপেক্ষায় থাকবো|
ReplyDeleteপ্রসেনজিৎ কবে থেকে তোমার বাড়িতে কাজ করে? আগে আর একজন দিদি বা মাসি ছিলোনা যে পিঠের ষ্টল দিতো?
শুভ বিজয়া, অমিতা। অনেক শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা জানবেন।
Deleteআপনার স্মৃতিশক্তি বটে। ওটা ছিল রীতা। রীতা পৌষমেলায় পিঠের স্টল দিত, আর আমাদের পিঠে খাইয়ে কিছুতেই পয়সা নিতে চাইত না। সে এক বিড়ম্বনা।
আপনাকে জানাই বিজয়ের শুভেচ্ছা। আনন্দে থাকুন, আনন্দে লিখুন।
ReplyDeleteআপনাকেও অনেক শুভেচ্ছা, রাজর্ষি। সব ভালো হোক।
Delete