প্রথমার্ধ


অশুভ শক্তিকে ঠেকাতে অর্চিষ্মান বাড়ি গেল। জুটে গেলাম। প্লেনের জানালা দিয়ে এয়ারপোর্টের মাঠে জল জমা মাঠ দেখলাম। সিঁড়িতে পা রেখে ভেজা হাওয়া গায়ে লাগল। দিল্লিতে ঝড়বৃষ্টি হয় কিন্তু এমন হাওয়া গায়ে লাগে না। আকাশবাতাসের কনস্ট্যান্ট ছলছলে ভাবটাও মিসিং। যখন ঝরার ঝরল তারপর খটখটে। রাত গয়ি বাত গয়ি বলে চোখ মুছে মুভ অন।

প্রিপেড থেকে উবার পঞ্চাশটাকা কম। চেনা রাস্তা। চেনা ল্যান্ডমার্ক। চেনা স্টিমুলাসে পাভলভের পঞ্চুর চেনা ভৌ। বিগ বেন দেখে হাসি। হলদিরাম ক্রস করতে করতে অর্চিষ্মানকে বলি এর পেছনে অমুকদের ফ্ল্যাট ছিল। আরেকটু এগিয়ে বাঁদিকের গোলাপি রঙের পাঁচতলা বাড়ির টপ ফ্লোর দেখিয়ে অর্চিষ্মান বলে চিনতে পারছ?

মাসিমেসোর ফ্ল্যাট। কত এসেছি। নিচ থেকে মিষ্টি কিনে ওপরে উঠতাম। মাসি ওপর থেকে নিচে নেমে চপ কিনে আবার ওপরে উঠত। সুন্দর প্লেটে যত্ন করে সাজিয়ে আদর করে খাওয়াত। মাসি মেসো সায়ন নতুন হাউসিং-এ চলে গেছে। ফ্ল্যাটটা বিক্রির অপেক্ষায় ছিল। অর্চিষ্মান বলল হয়ে গেছে তো বিক্রি, শোনোনি? একজন অল্পবয়সী মেয়ে কিনেছে। তারপর বলল অবশ্য মায়ের ডেফিনিশনে অল্পবয়সী। নাকতলার মাকে গান শেখাতে আসেন যে পঞ্চাশোর্ধ্ব দিদিমণি, মা তাঁকেও বাচ্চা মেয়ে বলেছিলেন।

পথের ধারে বিজ্ঞাপনের বোর্ডে কিউট কিডনির কার্টুন। কানে ফোন ধরে হ্যালো হ্যালো। অলিন্দ, নিলয়, শিরা মহাশিরা ধমনী মহাধমনী ঝিল্লিটিল্লি নিয়ে লাইফলাইক হৃদয়। বাঁধন ছিঁড়ে লাফিয়ে উঠছে। মালাইচাকি দৌড়চ্ছে। সাঁই সাঁই স্পিড বোঝাতে আশেপাশে হাওয়ার আঁচড়। ভেলোর নয়, চেন্নাই নয়, বম্বে নয় - হার্ট কিডনি হাঁটু সব সারবে এবার কলকাতাতেই। শহরে চিকিৎসার সুযোগ বাড়ছে। বা রোগী। হাসপাতালের বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে কষা মাংস আর বিরিয়ানির বিজ্ঞাপন।

এ সব রাস্তাঘাট দেখে কোনও তলতলে অনুভূতি আমার জাগে না। রিষড়ার রাস্তাঘাট দেখলেই জাগে না। কলেজের সামনে দিয়ে গেলে এক ধরণের ফ্যামিলিয়ারিটির বোধ টের পাই। তার থেকে বরং মুখ বেশি হাসি হাসি হয় ডালহাউসি এলে। মায়ের যৌবনের উপবন। রঙ্গরসিকতা থামিয়ে জানালা দিয়ে টেলিফোন ভবনের লম্বা সাদা বাড়িটা, যতক্ষণ দেখা যায়, দেখি। বাড়িটা না থাকলে মায়ের জীবন অন্যরকম হত। আমিও অন্যরকম হতাম। ভালো হতাম না মন্দ সেটা কথা না। আমি আমি হতাম না।

পরপর মেট্রোস্টেশনের নিচ দিয়ে ট্যাক্সি গলে যায়। আরেকটা অভ্যস্ত রসিকতায় রত হই। ভাবো কাউকে ডিরেকশন দিচ্ছঃ সত্যজিৎ রায়ে নেমে আমার প্রিয় রবিঠাকুরের মোড় পেরিয়ে উত্তমকুমারের দিকে হাঁটবেন। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দীর নিচ দিয়ে গলতে গলতে দশের মধ্যে সাতবার অর্চিষ্মান বলে, আশ্চর্য না? কথা নেই বার্তা নেই হঠাৎ জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী? ওকে বলিনি কখনও, কিন্তু ওর বিস্ময় ইন্টারেস্টিং ঠেকে। জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী অর্চিষ্মানের কাছের লেখক। তাঁর নামে মেট্রো স্টেশনের নাম রাখায় ওর বিস্ময়ে খুশির ভাগ আরেকটু বেশি হওয়া এক্সপেক্টেড না? আমার কানে অর্চিষ্মানের বিস্ময়, বিশুদ্ধ বিস্ময়; হয়তো দু'ফোঁটা বিরক্তিই মিশে আছে। যেন ও মন থেকে খুশি হতে পারছে না উত্তম সত্যজিৎ রবিঠাকুরদের মতো এ-লিস্টারদের মাঝখানে জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী ঢুকে পড়ায়।

অর্চিষ্মান চটে যাবে হয়তো। কিন্তু চটার কিছু নেই। এটাই মানুষের চরিত্র। আন্ডাররেটেড কিছুকে, আন্ডারডগ কাউকে, অ্যাপ্রিশিয়েট করার ব্যক্তিগত ও গভীর গ্লোরি বিশ্বের সঙ্গে ভাগ করে নিতে কারওরই ভালো লাগে না। আমারও চন্দ্রবিন্দু তখন ভালো লাগত যখন বিশ্বাস করতাম চন্দ্রবিন্দু বেশি লোকে বোঝে না। 'বন্ধুরা পার্স খুলে একে ওকে তাকে তোলে' থেকে 'বিয়ের আগেই আসল মজা ভিক্টোরিয়ায় বাদাম ভাজা, আর বিয়ের পরেই বরের পকেট থেকে হাপিস করে ক্যাশ' - হাসিহাসি মুখে শুনতাম। তারপর সবাই এবং সবার পিসিমা চন্দ্রবিন্দুর ফ্যান হতে শুরু করলেন। মন ঘুরতে শুরু করল। এখন চন্দ্রবিন্দুর ফ্যানবেস দেখলে গায়ে কাঁটা দেয়। এখন মনে হয় অত লাফালাফির দরকার ছিল না। চন্দ্রিলকে তুলে নিলে চন্দ্রবিন্দুর সঙ্গে বাকি পাঁচশো বাহাত্তরটা বাঙালি ব্যান্ডের কোনওদিন তফাৎ ছিল না, থাকার কথাও ছিল না।

জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী চন্দ্রবিন্দুটিন্দু তো অনেক বড় ব্যাপার। এক ভদ্রলোকের গল্প শুনেছিলাম; সোশ্যাল মিডিয়ায় মহিলাদের খোঁচা মেরে বেড়াতেন। তিনি যে ধর্মের ষাঁড় নন, তিনি যে সেফ, প্রতিপন্ন করার জন্য চ্যাটের তৃতীয় লাইনে নিজের লং টার্ম গার্লফ্রেন্ডের ঘোষণা সেরে নিতেন। "ও খুব সাধারণ, সে জন্যই ওর প্রেমে পড়া"। বলে মুচকি ইমোজি দিয়ে চুপ করতেন। যেন কয়লা ঘেঁটে হীরে বার করার জন্য এবার ওঁকে মেডেল দিতে হবে। সেই সাধারণ মেয়েকে পকেটে রেখে উনি রোজ লাঞ্চের পর মেসেঞ্জারে অসাধারণ মেয়েদের অ্যাটেনশন মেগে বেড়াচ্ছেন কেন সেটা অবশ্য জানা যায়নি।

সেফ প্রতিপন্ন করা প্রসঙ্গে একটা অপ্রাসঙ্গিক ঘটনা মনে পড়ল। তখন ঘাপটি মেরে ফেসবুকে ঘুরতাম। একদল ফুডি খুব আসর জমাতেন। তাঁদের প্রিয় গোয়েন্দা ফেলু, প্রিয় বাঙালি ব্যোমকেশ, পশ্চিমবঙ্গে হিন্দি আগ্রাসনের আতংক তাঁদের রাতে ঘুমোতে দিত না, তাঁদের সন্ততি সব ইংরিজি মিডিয়ামে পড়ত, তাঁদের ট্রু হ্যাপিনেস ছিল বিরিয়ানি (মাটন) আর বেদনা এই যে শরদিন্দুর প্রতিভার আজও মূল্যায়ন হল না।

এঁদের আরেকটা কমন চরিত্র ছিল পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের প্রতি বিদ্বেষ। তখন থেকেই দুনিয়াটা ওঁদের সাহসী চিন্তাভাবনার পক্ষে বড্ড বেশি পলিটিক্যালি কারেক্ট হয়ে পড়ছিল। কানাকে কানা বলা যাচ্ছে না, খোঁড়াকে খোঁড়া, রিকশাওয়ালাকে রিকশাওয়ালা। সেই নিয়ে তাঁরা সর্বক্ষণ আফসোস করতেন। সঙ্গে সঙ্গে একে অপরকে উদ্বুদ্ধও। নাকতলার সেই প্রতিবেশী বাবাকে যেমন করছিলেন। কবে নাকি হনুমান এসেছিল, প্রতি বছরই আমের সিজনে যেমন আসে। এসে ছাদ থেকে ছাদে ধুপধাপ লাফিয়ে, কাঁচা আমগুলো ছিঁড়ে, কামড়ে, থু থু করে ফেলছিল। গাছের মালিকরা বারান্দার গ্রিল, ছাদের দরজা, চিলেকোঠার জানালার আড়াল থেকে ব্যর্থ হুশ হুশ হ্যাট হ্যাট করছিলেন। একজন প্রতিবেশী নাকি সিঁড়ির দরজা এক ইঞ্চি ফাঁক করে চিৎকার করে বলছিলেন, বন্দীবাবু, এ বাঁদরামি সহ্য করবেন না, বেরিয়ে আসুন, প্রতিবাদ করুন, হনুমানদের চোখে চোখ রেখে দাঁড়ান। বয়াম থেকে পাঁচনম্বর ক্রিম ক্র্যাকার বার করে বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, দাঁড়ালেন? চোখে চোখ রেখে? বাবা হেসেছিলেন। অবিকল অর্চিষ্মানের মুচকি হাসি। নাহ্‌। যথাসম্ভব গলা তুলে, না না এই আমগুলো সত্যিই টক, আমরাও খাই না, বলে দরজা বন্ধ করে নিচে নেমে এসেছিলাম।

সবাই বাবা হন না, কেউ কেউ উদ্বুদ্ধ হয়ে পড়েন। অবশ্য তাঁদের দোষ না। হাজার হাজার ফ্রেন্ড, আরও হাজার হাজার গোপন প্রাউলারদের সাক্ষী রেখে চারদিক থেকে 'আরে বলে দে যা মনে আসছে', 'কারও খাস না পরিসও না', 'মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বলো রে' চ্যান্টিং - রক্ত গরম না হলেই সন্দেহজনক। সেই ফেলুফেটিশ ব্যোমকেশবাফ গ্রুপেও তেমন একজন ছিলেন, ঠোঁটের নিচের খাঁজে দাড়ির বিউটিস্পট, পলিটিক্যাল ইনকারেক্টনেসের চকচকে আপেলে কামড় দিয়ে ফেললেন। মগজে দিবারাত্র ঘাই মারা কদর্য ভাবনাগুলোর একটাকে ফস করে লিখে ফেললেন।

যতক্ষণে ব্যাকল্যাশ শুরু হল তা-দেনেওয়ালারা হাওয়া, বিউটিস্পট দাড়ি একলা অভিমন্যু। সেই দু'হাজার ছয় সালের ছাব্বিশে সেপ্টেম্বর অ্যাকাউন্ট খোলা থেকে টাইমলাইন স্ক্যান করে যাবতীয় গোলমেলে বক্তব্যের এসএস, সেকেন্ডে সাতটা করে শেয়ার করছে পাবলিক। এবং এসে গেছে, সমস্ত ভার্চুয়াল গণপিটুনির ফেভারিট চোর, ফেমিনিজম। কেউ বলছে গোটাটাই ফেক, যারা মাকে শ্রদ্ধা করে তারা বলছে ভোটাধিকার তো হয়ে গেছে, সতীদাহও ব্যান, এবার আর অত জোরে কথা বলার দরকার নেই, যারা মা বউ প্রেমিকা সবাইকে শ্রদ্ধা করে তারা বলছে আপনাদের না দিদি, রাস্তায় বেরোনো উচিত না।  ফেমিনিস্টরাও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গোল খাচ্ছেন না অফ কোর্স, কেনই বা খাবেন। তাঁদের মধ্যে একজন এসে দাড়িওয়ালাকে "মিসোজিনিস্ট" ডেকে চম্পট দিয়েছেন।

মিসোজিনিস্ট? আমি মিসোজিনিস্ট? বিউটিস্পট ফেটে পড়লেন। আমার বলে বাড়িতে চারমাসের মেয়ে আছে, আমি মিসোজিনিস্ট? বলে চারমাস আগে শেয়ার করা পিংক টাওয়েল জড়ানো সদ্যজাত কন্যারয যে কিউট ছবি #গ্রেটেস্টফিলিং #প্রাউডড্যাড #পাপাকিপরি সহকারে ছেপেছিলেন আবার ছাপলেন। উনি বোধহয় জানেন না, নির্ভয়ার খুনী-রেপিস্টরাও একেকজন জলজ্যান্ত মেয়ের বাপ ছিল। ও দিয়ে কিছু প্রমাণ হয় না। একবার লোভ হয়েছিল ফেক প্রোফাইল থেকেই তথ্যটা জানিয়ে দিই। তারপর চিত্রচোরের অ্যাডাপ্টেশনেই সম্ভবতঃ,আবীর, নাকি যীশুর, সংলাপ মনে পড়ল। আমরা ক্রিকেট ম্যাচ দেখতে এসেছি, মাঠে ঢুকে খেলতে না।

অর্চিষ্মানের জানালার ফাঁকে প্রকাণ্ড কোমরকাটা ফুটবলার। বাংলায় ভালো হরর হয় না কেন জানতে চাইলেই নিশ্চয় সেই এক পোঁ ধরবেন সবাই - বাজেট নেই। অ্যাটমসফেরিক হরর বানাতে হলে গোটা ইউনিট নিয়ে চটকপুর ছোটো। রডোডেনড্রনের স্যাঁতসেঁতে বন, ফগ মেশিন চালিয়ে এক্সট্রা ধূম্রজালে আচ্ছন্ন করে প্রতিহিংসাপরায়ণ শ্যাওলাঢাকা দেবীর ঘুম ভাঙাও। নয়তো বীরভুম যাও। রাজবাড়ির দেওয়াল ধ্বসিয়ে নরখাদিকা কালী আত্মপ্রকাশ করাও। কম বাজেটে কামালগাজির ফাঁকা ফ্ল্যাটে ভয় জমাতে গেলে অতৃপ্ত আত্মার রান্নাঘরের থালাবাটি ঠনঠন ছোঁড়াছুড়ি ছাড়া আর কিছু জুটবে না। আপ ডাউন যতবার এই কোমরকাটা খেলোয়াড়কে পাস করি মনে হয় পরিচালকদের ডেকে বলি, কুয়াশা লাগবে না, জঙ্গল লাগবে না, তন্ত্রমন্ত্র লাগবে না। স্পষ্ট দিবালোকে তিনতলা উঁচু, হাফপ্যান্টশোভিত একজোড়া মাংসল পা, বিশ্ববাংলার ব লেখা ফুটবল শহরময় লাথিয়ে বেড়াচ্ছে দেখালে নেক্সট ছ'মাস আর রাতে বাথরুমে একলা যেতে হবে না।

পাটুলির দিঘির পাড়ে পার্মানেন্ট ঝুলন। অর্চিষ্মান ঘাড় শক্ত করে ঘুরিয়ে রাখে। ঝুলন পেরিয়ে ট্যাক্সি ডানদিকে বাঁক নিলেই সোজা হয়ে বসে আঙুল দেখায়। এই যে এই বাড়িতে আশাপূর্ণা দেবী থাকতেন। কী গো, দেখছ? এই গলিতে আলি আকবরের ডেরা ছিল, এবাড়ির গ্রাউন্ড ফ্লোরে অমুক থাকতেন, ও'বাড়ির দোতলায় তমুক। তোমাদের রিষড়ায় আছেন নাকি এ রকম কেউকেটা কেউ? উঁহু, হুব্বা শ্যামল বা লেবুবাবু বাদ দিয়ে? সেদিন সোল কানেকশন পডকাস্টে তরুণ ক্ল্যাসিক্যাল তবলিয়া ঈশান ঘোষের ইন্টারভিউ চলছিল। ঈশান বললেন ওঁর পূর্বপুরুষ, বিখ্যাত বাঁশুরিয়া পান্নালাল ঘোষের আদি বাড়ি বরিশাল। বাসন মাজা থামিয়ে হাত ধুয়ে এ ঘরে এসে অর্চিষ্মানের নাকের ডগায় কর গুনতে গুনতে বললাম পান্নালাল ঘোষ বরিশাল, কাদম্বিনী গাঙ্গুলি বরিশাল, জীবনানন্দ দাশ বরিশাল, উৎপল দত্ত বরিশাল, নচিকেতা বরিশাল। এমন কেউ আছেন যিনি পাটুলি থেকে শুরু হয়েছেন? অলরেডি কেউকেটা হয়ে এসে পাটুলিতে সস্তায় বাড়িভাড়া নেননি? অর্চিষ্মান হুশ হুশ হাত নাড়ল। যাও যাও আমার মিটিং শুরু হবে বলে ইউটিউবের পাশের পার্মানেন্টলি খোলা গুগল মিটের ট্যাবে ক্লিক করল।

বরিশালের কথা যতবার বলি, ঢাকার কথা বলি না বলে অপরাধবোধ হয়। অথচ আমি যতটা বরিশালের ততটাই তো ঢাকারও। এমনও না যে ঢাকা থেকে আমদানি হওয়া সেলিব্রিটির অভাব পশ্চিমবঙ্গে। অর্চিষ্মান বলল ও-ও নাকি বলে না। আমি বললাম কী বল না? অর্চিষ্মান বলল তোমার হাফ সেট ঠাকুমাদাদু যে বরিশালের সেটা বলি, বাকি হাফ যে ঢাকার সেটা বলি না। আমি বললাম বলবেই বা কেন? কাকেই বা বলবে? কোথায় বলবে? কী প্রসঙ্গে বলবে? অর্চিষ্মান বলল কেন বাংলাদেশে যে এত ঘনঘন যাই তখন বলি। জানেন তো আমার স্ত্রী বরিশালের। মানে ওর ঠাকুমাদাদু বরিশাল থেকে কলকাতা গিয়েছিলেন। কিউরিয়াস হলাম। ঢাকার বল না কেন? অর্চিষ্মান দাঁত বার করল। শুরুতে বলতাম। শুনে লোকে 'ও আচ্ছা' বলে মুভ অন করে যেত। বরিশালের অংশটুকু শুনে হাতের কাজ থমকে যেত, চোখ বিস্ফারিত, নাকের পাটা কম্পমান। দুয়েকজন নাকি অস্ফুটে আহারে-ও বলে ফেলেছিলেন। তারপর থেকে অর্চিষ্মান বউপ্রসঙ্গে ঢাকাটা বাদ দিয়ে শুধু বরিশালের পার্টটা বলে। তাতে নাকি সেমিনারঅন্তে কিউ অ্যান্ড এ সেশনে অর্চিষ্মানকে ত্যাঁদড় প্রশ্ন ফেস করতে হয় না, লাঞ্চে সবাই যেচে বড় কাবাবটা ওর প্লেটে তুলে দেন, এয়ারপোর্টে ছাড়তে এসে বারবার বলেন আবার আসবেন দাদা। বৌদিরে নিয়া আসবেন প্রায় কেউই বলেন না।

নাকতলা নাকতলা বলি বটে কিন্তু অর্চিষ্মানদের বাড়ি আসলে নাকতলায় নয়। অফিসের একজনকে শ্বশুরবাড়ি কোথায় বলতে গিয়ে একবার বলেছিলাম নাকতলা। তিনি বললেন এই তো কাকে পাটুলি বলছিলে। আমি বললাম হ্যাঁ পাটুলিও বলা যায়। তিনি গলা মোটা করলেন। না যায় না। দুটো কমপ্লিটলি আলাদা জায়গা। আমি বললাম ঠিকই বলেছেন। অ্যাকচুয়ালি পাটুলিও না নাকতলাও না, অর্চিষ্মানের বাড়ি গড়িয়া আর নাকতলার মাঝখানে। টালিগঞ্জ আর নাকতলার মাঝখানেও হতে পারে। ভদ্রমহিলার ভুরু ভয়ানক কুঁচকে গেল। নার্ভাস হয়ে বললাম আচ্ছা এইবার ফাইন্যাল। গাঙ্গুলিবাগান চেনেন? অর্চিষ্মানের বাড়ি আসলে গাঙ্গুলিবাগানে। উনি বললেন গাঙ্গুলিবাগানের কোথায়? ওদিকে আমার যাতায়াত আছে। আমি বললাম ইয়ে ঠিক গাঙ্গুলিবাগানে না, গাঙ্গুলিবাগান আর রামগড়ের মাঝখানে।

তিনি বললেন শ্বশুরবাড়ি যেখানেই হোক তোমার বাড়ি তো কলকাতায় মনে হচ্ছে না। কান ধরে জিভ কাটলাম। খেপেছেন? আমি মফঃস্বল। মেন লাইন।

সত্যনারায়ণ মিষ্টান্ন থেকে ট্যাক্সি ডাইনে বাঁকল। ল্যাম্পপোস্টে পতাকা, দেওয়ালে কার্টুন, পোস্টারে স্লোগান পড়তে পড়তে এঁকেবেঁকে চললাম। সাঁচিস্তুপ আদলের গেটের সামনে গাড়ি থামতে অর্চিষ্মানের ঘোর ভাঙল। কাকে দেব ভাবছি। বললাম, রুটি সুজি লুচিকেই দাও, আই মিন, রুটি রুজি রুচিকে।

দমদমে ভেজা মাটি দেখেছিলাম, নাকতলা পৌঁছতে পৌঁছতে সব খটখটে। কুন্তলা যেদিকে চায়, বৃষ্টি থামিয়া যায়। শুক্রবার পৌঁছেছি, শনিবার সকালে অর্চিষ্মান ভোট দেবে, বিকেলে রিষড়া যাব। এই গরমে আর কোথাও যাব না। শুয়ে বসে তিন্নির সঙ্গে গল্প করে কাটাব। নানার খাটের ওই রেলিং-এ হেলান দিয়ে তিন্নি বসে এই রেলিং-এ আমি। ফ্যান ঘোরে, পর্দা ওড়ে, আমরা গুনগুনাই। মা এসে দরজা ধরে দাঁড়ান। দাঁড়িয়ে কেন, আসুন বসুন গল্পে যোগ দিন প্রস্তাবে অসম্মত হন। আমি আর মিঠু এ রকম গল্প করতাম বলে খুশি হয়ে চলে যান। তিন্নির সিনেমার প্রাইভেট স্ক্রিনিং আছে, আবীর চট্টোপাধ্যায় আসবেন। ইরা তিন্নি রেডি হয়ে বেরিয়ে যায়, হাত বাড়িয়ে টেবিলের ওপর বইয়ের ঢিপির চুড়োর বইটা তুলে নিই। এয়ারপোর্ট থেকে কিনে এনেছে তিন্নি। সলমান রুশদি-র নাইফ:মেডিটেশনস আফটার অ্যান অ্যাটেম্পটেড মার্ডার। দুহাজার বাইশের অগস্টে নিউ ইয়র্কে এক বদমাশের আক্রমণে একটা গোটা চোখ নষ্ট হয়ে গেল, আর সেই ঘটনা নিয়ে বই লিখে রুশদি চব্বিশের এপ্রিলে ছাপিয়ে ফেললেন। ছিন্নপত্র সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে চন্দ্রিল বলছিলেন, রবীন্দ্রনাথের সম্ভবতঃ নিজের সঙ্গে চুক্তি ছিল যে সারাদিনে (ফলতঃ সারাজীবনে) ওঁর মনে যা যা উদয় হবে সব বাংলা ভাষায় লিখে ফেলার। নাইফ পড়তে পড়তে সেই কথাটাই মনে হল। এই ভয়ানক ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় রুশদি আর কী-ই বা করতে পারতেন, একটা বই লিখে ফেলা ছাড়া? জেমস বল্ডউইনের একটা লেখাতেও দেখলাম। নতুন লেখকদের আরও নানা টিপস দেওয়ার সঙ্গে বলছেন নিজের জীবনকে একেবারে নিংড়ে লিখে ফেলো। এক বিন্দুও নষ্ট কোরো না। তোমার জীবনই তোমার কনটেন্ট।

এই সব ভাবতে ভাবতে বই বুকের ওপর ঢলে পড়ে, চোখ বুজে আসে। এ এক স্বর্গীয় মুহূর্ত। শরীর হাল ছেড়ে দিয়েছে, ব্রেনের যে কোণাটা এখনও ফাইট দিচ্ছে সেখানে বড় বড় জানালায় ফুরফুরে পর্দা টানা অসামান্য ঘরটায় শুয়ে শুয়ে শ্বশুরবাড়ির কর্মযজ্ঞের শব্দের রেশ এসে পৌঁছচ্ছে। চোদ্দ বছর বয়সে ঠাকুমা যে শ্বশুরবাড়িটায় এসে ঢুকেছিলেন সেটা কল্পনা করার চেষ্টা করছি, তার অনেক বছর পর মা যে শ্বশুরবাড়িটায় এসে নামলেন সেটাও। দূর থেকে কে যেন ডাকছে। আমার নাম ধরে ডাকছে বলেই শুনতে পাচ্ছি অন্যের হলে পেতাম না। ডাকটা জোর হচ্ছে। চোখ এক মিলিমিটার খুলছি। অলরেডি মৃদু স্বর আরও মৃদু করে মা জিজ্ঞাসা করছেন কুন্তলা খাবার দেব? বেলা হয়ে গেছে অনেক। দেবেন? দিন। বলে হাই তুলে আড়মোড়া ভেঙে গিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে আলুপোস্ত, দই পটল, এঁচোড়, ধোঁকা, আমের চাটনি, রসগোল্লার পায়েস খাচ্ছি। মা, গৌরী, আরেকজনের নাম মনে পড়ছে না, সবাই মিলে রান্না করে রেখেছেন। সেকেন্ড, থার্ড হেল্পিং নিচ্ছি। বাবা জিজ্ঞাসা করছেন বিকেলে কী খাবে কুন্তলা? খাচ্ছি আর মন দিয়ে ভাবছি, রাতে কী খাওয়া যায়। খাওয়া শেষ। ব্যাক টু বিছানা। এবার জানালার ফিনফিনে পর্দার ওপর মোটা, ডার্ক রঙের পর্দা টেনে দিয়েছি।

শনিবার সকালে তিন্নি অর্চিষ্মান ভোট দিতে গেল। আমি কী করলাম মনে পড়ছে না, যাই করি শুয়ে শুয়েই করছিলাম। একটু পর খুব কলকলিয়ে তিন্নি অর্চিষ্মান ফিরল। বুথের বাইরে ভাইবোনের পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছাপদেওয়া আঙুলতোলা সেলফি পোস্ট করেছে তিন্নি, অলরেডি কমেন্ট পড়তে শুরু করেছে। ছবিটা সত্যি ভালো উঠেছে। বুথে দুজনের সঙ্গে দেখা হয়েছে ওদের। একজন অর্চিষ্মানের পুরোনো বন্ধু আরেকজন কাঞ্চন মল্লিক। দেখা হয়েছে মানে ওরা কাঞ্চন মল্লিককে দেখেছে, কাঞ্চন মল্লিক ওদের দেখেননি। কাঞ্চনবাবুকে নাকি চর্মচক্ষে বেটার দেখতে। এটা আবীর সম্পর্কেও তিন্নি বলল। পর্দায় আর কী ভালো রে, সামনাসামনি আরও ভালো।

খেয়েদেয়ে বিকেল চারটে নাগাদ বেরোলাম। নর্ম্যালি উবার নিই; ভোটের বাজারে যদি না পাওয়া যায় বা পরে সমস্যা হয় তাই হাওড়া পর্যন্ত গাড়ি তারপর ট্রেন। মা বাবা তিন্নি ইরাকে টাটা বাইবাই আবার যেন দেখা পাই বলে গাড়িতে উঠলাম। প্রচণ্ড রোদের তাত। সামনে সামনে একটা গড়িয়া যাদবপুর অটো চলেছে। হলুদ গায়ে কালো কালিতে লেখা "তুমি ডালে আমি খালে, দেখা হবে মরণকালে।"

Comments

  1. osadharon bhalo laglo. mon bhalo hoye gelo. bhalo thakben.

    Indrani

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনিও, ইন্দ্রাণী।

      Delete
  2. সত্যনারায়ণ মিষ্টান্ন আসার আগে অশুভ শক্তি ঠেকানো টা কী হতে পারে ভেবেই যাচ্ছিলাম ... হাহা , ভাল লাগল, দ্বিতীয়ার্ধের অপেক্ষায় থাকলাম।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই রে, আমি ভয়ানক কৌতূহল বোধ করছি ঊর্মি। সত্যনারায়ণের সঙ্গে অশুভ শক্তির লিংকটা কী জানতে।

      অনেক গড়িমসি করেছি প্রথমার্ধটা লিখতে। দ্বিতীয়ার্ধ চটপট লিখব।

      Delete
    2. হাহা , না মিষ্টির দোকানে নয়, তার পরের কথায় বুঝলাম কি করতে কলকাতা যাওয়া 😊

      Delete
    3. ও আচ্ছা, দেওয়াল লিখন। আমিও এবার বুঝলাম।

      Delete
  3. আপনি লিখতে গড়িমসি না করলে এবারে একসঙ্গে বসে স্ট্র দিয়ে কোক জিরো খাওয়াটা হয়েই যেত। তবে আমার কারেন্ট ভুঁড়িটা ওই বিশ্ব বাংলার গ্লোবের মতন, তাই দেখা হলে হয়তো আপনার দুঃস্বপ্নের উদ্রেক হত। আমি এখনও হুগলি-বাগবাজার করে বেড়াচ্ছি। এবারে প্রথম ভোটও দিয়েছি। লেখাটা বলাই বাহুল্য, খুব ভাল হয়েছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে, সত্যি তো। আগে জানলে এবার দেখা করতাম সত্যিই। যাই হোক, পরের বারের জন্য তোলা রইল।

      Delete
  4. Khub bhalo laglo ei lekhata Kuntala. Monbhalo kora lekha. Purono Abantor e emon lekha peta,. ekhon komiye diyechhen. Abantor e please niyomito likhun.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, সায়ন। অবান্তরে সত্যিই লেখা বাড়ানো উচিত। সময় নেই বলে লিখছি না তেমন তো নয়। দেখি অ্যাকচুয়ালি করে উঠতে পারি কি না।

      Delete
  5. Auto ba bus er pechone lekha gulo r ekta all time compilation hoa uchit - depression niramok compilation :) - Parama

    ReplyDelete

Post a Comment