সোলমেট
দু'হাজার তেইশের অক্টোবরটক্টোবরে কৃত্তিবাসে গল্পটা বেরিয়েছিল। গল্প চাওয়ার সময় আমার জন্মদিন জানতে চেয়েছিলেন সম্পাদক। অবাক হয়েছিলাম, প্রকাশ করিনি। মানে অবাকত্বটা প্রকাশ করিনি, জন্মদিন সানন্দে করেছিলাম।
সংখ্যা হাতে পাওয়ার পর দেখলাম, অনূর্ধ্ব পঁয়তাল্লিশ লেখকদের গল্পসংখ্যা। তখন বুঝলাম। আমার সন্দেহ আমার জন্যই সীমাটা চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ করতে হয়েছে। না হলে এই সব সীমাটিমা সাধারণত তিরিশ চল্লিশ জাতীয় মাইলস্টোনেই সেট করা হয়। একমাত্র এক্সেপশন অনূর্ধ্ব পঁচিশ।
লজ্জাই হয়েছিল। সবেতে এত দেরি হয়ে যায় আমার।
ছাপা হওয়ার ছ'মাস পর থেকে ভাবছি এবার গল্পটা অবান্তরে দিই, তাতেও দেরি। কিছু লেখা গত দু'বছর ধরে গলায় আটকে ছিল সেগুলো নিয়ে তানানানা করে অনেকটা সময় গেল। মন খারাপ তো আছেই। সারাদিন এত দুঃখ হলে শুধু ক্যান্ডি ক্রাশ খেলা ছাড়া আর কিছু করা যায় না।
ক্যান্ডি ক্রাশের লাইফ ফুরোলে, মন মোটামুটি মন্দের ভালো অবস্থায় পৌঁছলে, বাকি লেখাগুলো অবশেষে, অ ব শে ষে, ঘাড় থেকে নামলে এই গল্পটার গুগল ডকটা খুলি।
এক লাইন পড়ি। দু'লাইন পড়ি। আস্তে করে উত্তরপূর্ব কোণের কাটা চিহ্নে কার্সার নিয়ে যাই। ক্লিক করি।
ক্লোজ কারেন্ট ট্যাব? ক্লোজ অল ট্যাবস?
ক্লোজ এভরিথিং। ইফ পসিবল ক্লোজ মাই লাইফ। ল্যাপটপের ডালা নামাই। শূন্যে অশরীরী ট্যাব হলোগ্রামের মতো জ্বলে, ট্যাবে আমার মগজ থেকে আঙুল বেয়ে নিঃসৃত সোয়া তিন হাজার শব্দ কালপুরুষ এগারো ফন্টে দাঁত বার করে দাঁড়িয়ে থাকে। ফোন আর কানের তার নিয়ে ঘর ছাড়ি। কানে গান গুঁজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট হেঁটে যদি সামলানো যায়।
ছি ছি ছি ছি ছি।
এই জঞ্জাল আমি উৎপন্ন করেছি ভেবে লজ্জাও হয় আর আমার এই প্রয়াসে যারা প্রশ্রয় দিয়েছেন তাঁদের ওপর রাগও। আমি না হয় লিখেছি, ওঁরা ছাপালেন কী বলে? এই করে বাংলা সাহিত্যের এই অবস্থা।
ওই পাতা আবার খোলার সাহস সঞ্চয় করতে আরও দেড় মাস যায়। পৃথিবী আরও পঁয়তাল্লিশবার আহ্নিক গতি সারে, লোকে নিজের প্রোডাকটিভিটি পঁয়তাল্লিশ গুণ বাড়ায়, আমি ক্যান্ডি ক্রাশের পঁয়তাল্লিশশো ধাপে আরোহণ করার পুরস্কার হিসেবে পঁয়তাল্লিশটি সোনার বার ফ্রি পাই।
এ বারও শক লাগে। কিন্তু এবার আমি প্রস্তুত। ওয়ান ওয়ার্ড অ্যাট আ টাইম। নিজের পাপের আগুনের মধ্যে দিয়ে নিজেকেই হাঁটতে হবে। দা ওনলি ওয়ে ইজ থ্রু।
প্লট বদলানোর প্ল্যান ছিল না, কিন্তু গোটা এক বছরে জীবন দেখার দৃষ্টি যে টুকু বদলেছে সেটুকু তো বদলাতেই হবে। ভাষা ছিটকে দিয়েছিল সবথেকে বেশি, সেটা সারানোর চেষ্টা হল। কিন্তু যেটা আসল সারানো হল সেটা হচ্ছে সাইজ।
আমার ইদানীং ধারণা হয়েছে আমার আর একজন প্রপার লেখক-এর মধ্যে ফারাক হচ্ছে বেশি লিখতে পারার। আমি বড় হয়ে লেখক হতে চাই, এমনকি ক্যান্ডি ক্রাশ খেলার থেকেও বেশি করে চাই। কাজেই আমাকে বেশি লেখা শিখতে হবে। শীর্ষেন্দুও বলেছেন, পাঠকরা মোটা বই পছন্দ করে। আপনারা খেয়াল করেছেন কি না জানি না, অবান্তরের পোস্ট ক্রমশঃ ইতিহাস পরীক্ষার ষোল নম্বর প্রশ্নের উত্তরের আয়তন ধারণ করছে। কী লিখছি-তে গুলি মেরে কত লিখছি-তে কনসেনট্রেট করেছি।
কিন্তু ছাপা পত্রিকার শব্দসংখ্যা বাঁধা থাকে। খুব বেশি হলে আড়াই হাজার। এক সময় ওর মধ্যেই লিখতে পারতাম। এখন পারছি না কারণ চাইছি না। প্রথমে সাড়ে চার হাজার না কত শব্দের গল্প পাঠিয়ে আঙুলে আঙুল পেঁচিয়ে বসে ছিলাম। ফেরত এল। কুন্তলা, সবাই আড়াই হাজারের মধ্যে গল্প পাঠিয়েছেন, আপনিও ওর মধ্যেই পাঠান। লজ্জা পেলাম। চোখ বেঁধে দু'হাতে কাস্তে চালিয়ে গল্প তিন হাজার তিনশোয় নামল। বললাম, আর পারছি না। ওঁরা দয়া করে ছেপে দিলেন।
যদিও উচিত ছিল না।
এখন সেই গল্প পাঁচ হাজার সাতশো চুয়াত্তর। হয়তো বাড়তি পুরোটাই ফ্লাফ। তবু লিখলাম। টাইপিং-এর স্পিড বাড়ল, রাইটিং মাসল-এরও এক্সারসাইজ হল। বড় হয়ে লেখক হতে কাজে লাগবে।
বাই দা ওয়ে, চ্যাট জিপিটি বলছে শব্দসংখ্যা এক থেকে সাড়ে সাত হাজারের মধ্যে হলেই সেটা ছোটগল্প। অধিকাংশ ছোটগল্প চার থেকে সাত হাজার শব্দের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। চ্যাট জিপিটিকে অবিশ্বাস করার এখনও কারণ ঘটেনি এখনও পর্যন্ত, কাজেই সোলমেট এখনও ছোটই আছে, বড় হয়নি।
আমার সেই ছোটগল্প 'সোলমেট' নিচে থাকল।
*****
সোলমেট
কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়
টকটক, টকাটক। স্বচ্ছ সিলিন্ডারের দেওয়ালে ধাক্কা খাচ্ছে কালো ফুটকিমণ্ডিত সাদা ঘনক। সিলিন্ডারের মুখ চেপে রেখেছে তন্বী তর্জনী, নিচে সাপোর্ট দিয়েছে ফর্সা বুড়ো আঙুল।
লালের তিনটে গুটি উঠে গেছে। চতুর্থটা লাস্ট ল্যাপে। ম্যাক্সিমাম তিন দান, তার পরেই গলিতে ঢুকে যাবে। নীল মরে গেলেও নাগাল পাবে না। নীলের দুটো গুটি উঠেছে, বাকি দুটো ছুটছে।
নীলকে দেখছিল লাল। টেপা ঠোঁট, কোঁচকানো ভুরু, স্ট্রেসড কাঁধ কান ছুঁয়েছে। পেপার সাবমিশন, মায়ের ছানি, নিজের বর্ডারলাইন হাই কোলেস্টেরল হাওয়া। চেতনা জুড়ে শুধু লুডোর বোর্ড, গুটি, ডাইস। আর সংকল্প। লালকে গোহারা হারানোর। মাটিতে এমন মিশিয়ে দেওয়ার যেন লাল জীবনে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে।
চাআআআর! চেঁচিয়ে উঠল নীল। ট্যাক ট্যাক ট্যাক ট্যাক ট্যাক। এগিয়ে এসে লালের পাকা টুসটুসে গুটি ছুঁল। দীর্ঘ পলক তুলে কালো চোখ রাখল লালের চোখে। চোদ্দ বছর আগে রাজধানী এক্সপ্রেসের এদিকের লোয়ার বার্থ থেকে ওদিকের আপার বার্থে যেমন রেখেছিল।
ছিটকে গেল লালের গুটি। বোর্ড থেকে - আর একটু হলে বিছানা পেরিয়ে মেঝেতে পড়ে যেত। একটা নির্দোষ, নিরস্ত্র গুটির প্রতি এই পরিমাণ হিংস্রতা? দানের আশায় হাত বাড়াল লাল। নীল হাত সরিয়ে নিল। খাওয়ার দান। টকটক টকাটক। সাদা ঘনক ফের নাচতে শুরু করল সিলিন্ডারের ভেতর।
ছক্কা!
টকটক টকাটক।
আবার ছক্কা!
সিলিন্ডার কপালে ঠেকিয়ে চোখ বুজে বিড়বিড় করছে নীল। তিন ছক্কা ঠেকাতে নাস্তিক নীলের বন্ধ চোখের পাতায় কে আবির্ভূত হচ্ছেন - ব্রহ্মাবিষ্ণুশিব না সন্তোষী মা?
বোর্ডে ঘনক উল্টেপাল্টে পাঁচ। নীলের উল্লাস শ্লীলতার সীমা ছাড়ায় ছাড়ায়।
লালের পুট।
নীলের পাঁচ।
লালের দুই।
নীলের ছক্কা চার।
লালের ফের পুট।
খাওয়া গুটিটা বেরোলোই না ঘর থেকে। ফাঁকা বোর্ডে স্পুটনিকের বেগে ঘুরতে ঘুরতে নীলের লাস্ট গুটি উঠে গেল।
উঠে দাঁড়িয়ে কুর্তা ঝাড়ল নীল। হাঁটতে যাচ্ছি। দেড় সেকেন্ড যতি দিয়ে বলল, তুই যাবি?
নাহ্, ল্যাদ লাগছে। তুই ঘুরে আয়।
দরজায় শব্দ তুলে বেরিয়ে গেল নীল। বিছানায় চিৎপাত পড়ে রইল লাল। কতদিন পর লুডো খেলা হল। খেলাই হল তো? লালের দিক থেকে খেলাই ছিল। নীলের দিক থেকে কী ছিল কে জানে। আগে নীলই ঘ্যানঘ্যান করত, কতদিন একসঙ্গে কিছু করা হয় না। কাজের চাপে দুজনেরই দিনরাত একাকার। ছ’মাসে একবার শনি বা রবি দেখে হাফ-ডে ট্রিপ। পশ্চিমঘাটের কোনও পিকচারেস্ক স্পট। শেষ গেছিল - লাল ফ্যানের ব্লেডের ঝুলে মনোস্থাপন করল - জানুয়ারিতে। দশ মাস হয়ে গেল। আকাশবাতাস কী দেখেছিল মনে নেই, গোটা সময়টা নীলের নতুন আই ফোন ফিফটিনে ছবি তুলতে হয়েছিল। ঝাঁকড়া গিরিপুষ্পর নিচে একবার ডান একবার বাঁ পা এগিয়ে, একবার গাছের কাণ্ড একবার নিজের কোমর ছুঁয়ে, একবার শূন্যে উদাস একবার ক্যামেরায় মদির দৃষ্টি মেলে পোজ দিচ্ছিল নীল। দৌড়ে এসে ছবি চেক করছিল। জিভ দাঁতের সংগতে অতৃপ্তির আওয়াজ তুলছিল। দৈনিক ষোলঘণ্টা উপোস করা নীলের ফিগারের ভাঁজ আইফোন সামহাউ ক্যাচ করতে পারছিল না। দেড়ঘণ্টা পর পাহাড় থেকে নেমে বুড়োবুড়ির চেনা ঝুপড়িতে নীলের জন্য প্লেন, নিজের জন্য মসালা দোসা অর্ডার দিয়ে সরু, টলমলে বেঞ্চে বসেছিল লাল। অপেক্ষা করছিল কখন ওর কাঁধে কনুই রেখে নীল আগের মতো বলে উঠবে, চ’, চাকরিবাকরি কাটিয়ে দিই। দোসা বিক্রি করি।
রাস্তার ধারে ঝুপড়ি বেঁধে? তুই রাঁধুনি, আমি ওয়েটার?
হ্যাট। রেস্টোর্যান্ট খুলব। কোয়েন্ট ইন্টেরিয়র, প্লাশ ফারনিশিং। ব্যাকগ্রাউন্ডে সুদিং ভলিউমে বালাসুব্রামনিয়ামের বেহালা। সিরিয়াসলি, খুলবি?
বুঝেছি। তুই দোসাওয়ালা হতে চাস না, মুনাফাজীবী পুঁজিবাদী হতে চাস। ক’পারসেন্টের পার্টনারশিপ বলিস।
দোসা, দোসার পর ফিল্টার কফি। নীলেরটা চিনি ছাড়া। গোটা সময়টা ভুরু কুঁচকে ছবি এডিট করেছিল নীল। সাতটা প্রোফাইলের ডিপি বদলেছিল। বাড়ি ফেরার প’নে দু’ঘণ্টা ননস্টপ নোটিফিকেশনে আইফোন কেঁপেছিল। গাড়ি থেকে নামতে নামতে, লিফটে উঠতে উঠতে, দরজা খুলে ফ্ল্যাটে ঢুকতে ঢুকতেও নীলের চোখ স্ক্রিনে সাঁটা, বুড়ো আঙুল কি-বোর্ডে ছুটছিল।
উঠে পড়ল লাল। সন্ধের মুখে ঘুমোলে বিশ্রী লাগবে। কফিবিনের প্যাকেটটা ডেলিভারি দিয়ে গেছে দুপুরে। কফির পৃষ্ঠপোষকতা লালের বেশিদিনের না। গত বছর এক শুক্রবার গ্রাইন্ডারের হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে আস্ত কফিবিন গুঁড়িয়ে, ফ্রেঞ্চ প্রেসে কফি বানিয়ে মাগে ঢেলে হাতে হাতে ধরিয়েছিল সবুজ। গর্ব গর্ব মুখে তাকিয়ে ছিল যতক্ষণ না কফিতে চুমুক দিয়ে লাল বলে উঠেছিল, ওয়াও। নীল চোখ ঘুরিয়েছিল। ওয়াও না হাতি। ব্ল্যাক কফি সহ্য করতে পারে না লাল। তোর মন রাখতে বলছে। ফেরার পথে সিগন্যালে দাঁড়িয়ে লাল অ্যামাজন খুলেছিল। ম্যানুয়াল কফি গ্রাইন্ডার উইথ অ্যাডজাস্টেবল সেটিংস। হান্ড্রেড পার সেন্ট রোবাস্টা বিন, মিডিয়াম ডার্ক রোস্ট, ফ্রেশ এস্টেট।
নীল চোখ ঘুরিয়েছিল। লোকের যা দেখবি টুকতে হবে?
গত শুক্রবার কফির মাগ হাতে দিয়ে সবুজ বলল, দেখ তো তফাৎ টের পাস কি না? বিনটা ডিরেক্ট চিকমাগালুরের প্ল্যান্ট থেকে আনিয়েছি। গ্রাইন্ডারটাও আপগ্রেড করলাম। বোডাম। ড্যানিশ ব্র্যান্ড। ভাবা যায় না।
বোডাম আপাতত কার্টে সেভ করে রেখেছে লাল, নেক্সট মাসে আনাবে। নীল দেখলে চোখ ঘোরাবে। সবুজকে বলেও দিতে পারে। আপাতত চিকমাগালুরের কফিবিনটা আনিয়েছে।
সাসটেনেবল প্যাকেজিং-এর (রিমেমবার, দেয়ার ইজ নো প্ল্যানেট বি!) ভালভ সিল ভাঙল লাল। কফিবিনের বাদামী অন্ধকারে ক্রিমরং ছোট্ট বাক্স, বাক্সের ভেতর কফি মাপার মিনিম্যালিস্ট চামচ। রিইউজেবল। উইথ কমপ্লিমেন্টস।
বোডামের সঙ্গে একটা ওয়েইং মেশিন আনিয়ে নিতে হবে - নিজেকে মনে করাল লাল। ওয়েট ইজ মোর প্রিসাইজ দ্যান ভলিউম। চামচ দিয়ে বিন মেপে গ্রাইন্ডারে ঢেলে জল আছে কি না চেক করে কেটলির সুইচ অন করল। গ্রাইন্ডারের হাতল ঘোরাতে ঘোরাতেই খট - জল ফুটে গেছে। গুঁড়ো কফি ফ্রেঞ্চ প্রেসে ঢেলে দশ ইঞ্চি ওপর থেকে স্লো মোশনে কেটলি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কফি ভেজাল। বলিষ্ঠ, গাঢ় গন্ধ রোমকূপ চুঁইয়ে শরীরে ঢুকে গেল।
টাইমারে চার মিনিট সেট করে কাউন্টারে হেলান দিয়ে টুইটার খুলল লাল। জিতেছি যতটা হেরেছিও ততটাই, লুডো খেলে গেছি কামনায় অনুভবে . . .
যে দানে নীল ওর পাকা গুটিটা খেল, চার পড়েছিল। অথচ নীল এগোল পাঁচ ঘর। লাল দেখেও কিছু বলল না। আগে হলে বলত। সহজে হার মানার অভ্যেস নেই লালের। লুডোতে, অফিসে, বিছানায়। সেটা নীল একসময় অ্যাপ্রিশিয়েট করত। কম লোকেই করে। নীলের আগেও একাধিক সম্পর্ক হয়েছিল লালের। টেঁকেনি। লাল ধরেই নিয়েছিল ওর সঙ্গে কারও বনবে না, সারাজীবন একা একা ভেসে বেড়াতে হবে। তারপর রাজধানীর লোয়ার বার্থ থেকে চোখ তুলল দুটো চোখ। নিজের সমস্ত অ্যাগ্রেশনের আশ্রয় খুঁজে পেল লাল। যাবতীয় অস্থিরতার শান্তি।
পেয়েছিল, রাদার। পাস্ট টেন্স। নীল আর সে নীল নেই। যখন তখন ফেটে পড়ে। পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া বাধায়। শুরুর দিকে করত, এখন আর লাল এনগেজ করে না। একার দায়িত্বে নীল ফাটতে থাকে। যতক্ষণ না বারুদ ফুরোয়। তখন লাল চোখকানের কাল্পনিক তুলো খুলে দৈনন্দিনতার স্রোতে ভাসে।
পুরোনো নীলের জন্য মনখারাপ হয় লালের। পুরোনো নীলের সঙ্গে ওর জীবনটার জন্য। হাওড়া নিউ দিল্লি রাজধানী এক্সপ্রেস। ইউনিভার্সিটি। ক্যাম্পাসিং। সতেরো সতেরো চৌত্রিশ কেজির দুটো স্যামসোনাইট নিয়ে স্পাইসজেটের ইকনমি চড়ে নতুন শহর। লালনীল সংসার। লালের গোটা জীবনটা নীলের সঙ্গে সুতোর মতো জড়িয়ে। যে সুতোটার ওপর ক্রমাগত ব্লেড চালাচ্ছে নীল। রোঁয়া উঠে সরু হয়ে যাচ্ছে সুতোটা। নীল কি টের পাচ্ছে না? কী চাইছে নীল? কী পাচ্ছে না?
পরিস্থিতি কতটা হাতের বাইরে গেছে টের পেয়েছিল নিউ ইয়ার ইভে। লোনাভালায় নীলের অফিস রিট্রিটে সিগ্নিফিক্যান্ট আদার হিসেবে গিয়ে। ভাংড়ামিক্সের সঙ্গে বনফায়ার ঘিরে লোকজন নাচছিল। নিরাপদ দূরত্বে বসে ছিল লাল। উন্মুক্ত লনে শরীরের কাঁপুনি সামলাতে ট্রে থেকে ঘনঘন ওয়াইনের গ্লাস তুলে নিচ্ছিল। পাশে বসে ছিল নীলের অফিসের একটা মেয়ে - নতুন রিক্রুট। জাস্ট বসেই ছিল। টুকটাক কথা হচ্ছিল। নীলও কিছু একাবোকা ঘুরছিল না। ওদের হেলথ টিমের হেড আলি মেহেদির সঙ্গে সারা সন্ধে গুজগুজ করছিল, দরকারের বেশি হাসছিল, চুলে হাতও ছোঁয়াচ্ছিল। অথচ রাত দুটোয় রুমে ফিরে, চেয়ারের পিঠে জামা ছুঁড়ে ফেলা না ওইরকমই রিডিকিউলাস কী একটা ইস্যুতে ফেটে পড়ল। চিৎকার করে বলল, তুই একটা দুশ্চরিত্র, লম্পট। বাচ্চা না করে তুই আমার জীবন নষ্ট করে দিয়েছিস।
ডাহা মিথ্যে কথা। বাচ্চা না করার সিদ্ধান্তটা লালের ঠিকই কিন্তু নীলের সম্মতি ছিল ষোলোআনা। ঝাড়াঝাপটা, ডাবল-ইনকাম-নো-কিডস জীবনযাপনে নীলের উৎসাহ কম ছিল না। এখন চেঁচিয়ে মিথ্যেটাকে সত্যি করার চেষ্টা করছে। রিট্রিটের রাতেও করেছিল। লালের ফোন ছিনিয়ে বলেছিল, পাসওয়ার্ড দে। জিমেলের। ফেসবুকের। হোয়াটসঅ্যাপের। আমি দেখতে চাই তুই কোথায় কী করে বেড়াচ্ছিস।
এত হতভম্ব হয়েছিল লাল - প্রত্যাখ্যানের পসিবিলিটি মাথায় আসেনি। সম্ভবও ছিল না। নীল তাণ্ডবের ডিগ্রি বাড়াত। নিশ্চিত করত যাতে রিট্রিটের সব ঘর থেকে ঝগড়াটা শোনা যায়। যে কোনও রকম সিনক্রিয়েটের প্রতি লালের আতংককে সমস্ত শক্তি দিয়ে দোহন করত।
পাসওয়ার্ড বলে দিয়েছিল লাল। নীল খুলে খুলে দেখেছিল সব। দেখার কিছু ছিল না। হার্মলেস ফ্লার্টিং, টুকটাক ছেনালিপনা। এমন কিছুই না যা নীল অলরেডি জানত না।
রিট্রিট থেকে ফিরে সেকেন্ড ফোনটা অর্ডার দেয় লাল। নীলকে লুকিয়ে। লুকোনো ফোনে লুকোনো ফেসবুক, লুকোনো হোয়াটসঅ্যাপ, লুকোনো ইনস্ট্যা খোলে। গিল্ট? নাহ্। পুলিস সাজতে নীলের গিল্ট না হলে চোর সাজতে লালেরই বা হবে কেন? নীলকে একজন বুদ্ধিমান মানুষ ভেবেছিল লাল। আশা করেছিল নীল বুঝবে - ফ্লিংস কাম, ফ্লিংস গো। এমনকি প্রেমও আসে এবং ফিরে যায়। থাকে শুধু বন্ধুত্ব। লালের জীবনের গভীরতম বন্ধুত্বটিকে ধ্বংস করেছে নীল। লাল কোনওদিন নীলকে ক্ষমা করবে না।
চার মিনিট শেষ। প্লাঞ্জারের কালো নবে আলতো চাপ দিতে কফি বিপদসীমার ওপর উঠে এল। কফিভর্তি মাগ নাকের কাছে এনে গভীর শ্বাস নিল লাল।
আহ্। স্মল প্লেজারস অফ লাইফ। আনন্দকণা।
***
দেওয়াল টু দেওয়াল, মেঝে টু সিলিং বুককেস। বুককেস কমন, তাক যার যার। লালের তাকে ফেলুদা, টিনটিন, গোগোল, পাণ্ডব গোয়েন্দা, শারদীয়া, শরদিন্দু। নীলের তাকে ভার্জিনিয়া উলফ, ডরিস লেসিং, সিলভিয়া প্ল্যাথ, উরসুলা, আশাপূর্ণা, মহাশ্বেতা। কমন তাকে - যা কেউই ছুঁয়ে দেখে না - চমস্কি, রোম্যা রোলাঁ, রবীন্দ্রনাথ।
কাল রাতে শুতে যাওয়ার আগে ফোনটা বাদশাহী আংটির ভেতর রেখেছিল। রেখেছিল বলেই যে এখনও সেখানেই থাকবে তেমন নয়। ওর সিক্রেট ফোন যে আর সিক্রেট নেই সে সত্য আবিষ্কারের মুহূর্ত এখনও দগদগে। অফিসে বেরোনোর আগে মাসিকে লাস্ট রাউন্ডের নির্দেশ দিচ্ছিল নীল। সেই ফাঁকে পাণ্ডব গোয়েন্দা প্রথম খণ্ড থেকে ফোনটা বার করে নিতে এ ঘরে এসেছিল লাল।
পাণ্ডব গোয়েন্দার পর ঐতিহাসিক রোম্যান্স, আবোলতাবোল, গ্যাংটকে গণ্ডগোল হাঁটকে যখন লালের কপালে ঘাম, গলা খটখটে, কান গরম - নীলের তাকে চোখ গিয়েছিল। চটি বই - একশো পাতাও হবে না। ‘মরমী করাত’। প্রকটভাবেই ফুলে আছে।
অফিসের গোটা রাস্তা কথা বলে গিয়েছিল নীল। ডেডলাইনের চাপ। এইচ আরের টির্যানি। মাসতুতো বোনের চার বছরের কন্যার ফেমিনিস্ট উক্তিতে পারিবারিক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সম্মিলিত অর্গ্যাজম। গোটা রাস্তা গলা দিয়ে আওয়াজ বার করতে পারেনি লাল। চোখের সূচ, কানের আগুন চাপা দেওয়ার চেষ্টা করতে করতে গাড়ি চালিয়েছিল।
সেই থেকে সপ্তাহের এ মাথায় ও মাথায় বা মাসখানেক পরপর লাল আবিষ্কার করে ওর লুকোনো ফোন তুঙ্গভদ্রার তীর থেকে তুলে তিতাস নামে একটি নদীর পারে রেখে এসেছে নীল। টিনটিন ইন কঙ্গো থেকে টু দা লাইটহাউস। ফেলুদার গোয়েন্দাগিরির বদলে ফিনিগ্যান’স ওয়েক। লাল জানে ফোনের ভেতর নীল ঢুকতে পারেনি। পাসওয়ার্ড দেওয়া আছে। লাল এও জানে ফোনের ভেতর ঢোকা নীলের উদ্দেশ্য নয়। নীলের উদ্দেশ্য লালকে ভুলতে না দেওয়া - তুই একটা চোর।
বাদশাহী আংটির ভেতর থেকেই বেরোল। ফোন অন করল লাল। এই মুহূর্তটায় এক সময় উত্তেজনা কাঁপত, এখন আতংক হয়। এতদিনের খেলাধুলো কিছু ল্যান্ডমাইন পুঁতে গেছে লালের জীবনে। মেসেঞ্জারে হাই বলেছিল গোলাপি। সেক্সি, সুন্দরী, সাড়ে তেইশ। চ্যাট করতে করতে, কফি শপে দেখা করতে করতে, রেস্টোর্যান্টের নির্জন সিঁড়িতে চট করে চুমু খেয়ে নিতে নিতে লাল এমন একটা সময় ফিরে পাচ্ছিল যেটা ও ভেবেছিল চিরদিনের মতো হারিয়ে গেছে।
সাত মাস পর হোটেলের ধপধপে বিছানায় বালিশচাদরের ধপধপে ঢিপির নিচে লালের বুকে মাথা রেখে গোলাপি জিজ্ঞাসা করেছিল, সত্যি সত্যি ভালোবাসো?
সত্যি সত্যি বাসি।
লাফ দিয়ে উঠে বসেছিল গোলাপি। তাহলে তোমার ওয়াইফকে আমাদের ব্যাপারটা বলে দাও। বল যে উই লাভ ইচ আদার সো উই আর গোয়িং টু গেট ম্যারেড।
সাত মাসের ছাগলামোর প্রায়শ্চিত্তে আরও সাত মাস খরচ হয়েছিল লালের। কান্নাকাটি। আত্মহত্যার হুমকি। বাড়িতে চলে আসার ব্ল্যাকমেল। সাড়ে তেইশের আত্মসর্বস্বতা - পেখম মেলে ঝলমলে দাঁড়িয়েছিল। কিরে কেটেছিল লাল। নো মোর সিংগল প্রেমিকা, ওনলি পরস্ত্রী। যার খুঁটি অলরেডি অন্য কোথাও বাঁধা। হ্যাপিলি বাঁধা হলে আরও ভালো।
এই সব শর্ত মেলালে হলুদ লালের জন্য পারফেক্ট। হলুদ - সবুজের বউ। চোখাচোখি অনেকদিন ধরেই চলছিল, কাউন্টার দিতে নিতে আঙুলে আঙুল। কবে যে ফুলফ্লেজড অ্যাফেয়ারের চেহারা নিল বুঝতেই পারেনি লাল। উৎসাহ বেশি ছিল হলুদের দিক থেকে। এত চেনা পরিসরে খেলায় অস্বস্তি ছিল লালের। কিঞ্চিৎ উত্তেজনাও। কফি গ্রাইন্ডার টোকা এক, রাত বারোটায় বউয়ের সঙ্গে রিস্কে চ্যাট আর এক। আপগ্রেডটা যে ওর মধ্যে একটা মুচকি হাসির জন্ম দিচ্ছিল অস্বীকার করার মতো অসৎ নয় লাল। নিজেকে বুঝিয়েছিল, হলুদ সেফ। টাকা, কেরিয়ার, পেডিগ্রি সব দিক থেকেই সবুজ লালের থেকে শক্ত খুঁটি। যেচে সে খুঁটি নড়বড়ে করে হলুদ ওর ঘাড়ে আসবে না।
কিন্তু লাল ক্রমে আবিষ্কার করেছে - যত দিন যাচ্ছে বেশি করে করছে - শারীরবৃত্তীয় বা হোয়াটেভার কারণে, মেয়েরা খুঁটি ডাইভার্সিফিকেশনে বিশ্বাসী। যার ফিনানশিয়াল খুঁটি শক্তপোক্ত সে ইমোশন্যাল খুঁটির খোঁজে হন্যে। ফিনানশিয়াল, ইমোশন্যাল দুইই ঠিকঠাক হলে সেক্সের খুঁটি নড়বড়ে। মেয়েদের অধিকারবোধও প্রবল। শনিরবি কথা না হওয়া নিয়ে হলুদের ঘ্যানঘ্যান বাড়ছে। সবুজের নামে চব্বিশঘণ্টা বিষোদ্গার। লাল চুপচাপ শোনে, সহানুভুতির কণা দাঁতের ফাঁক দিয়ে বার করে না। আড়চোখে দেখে হলুদের কাটাকাটা নাকচোখমুখ দিনকে দিন ঘুড়ির মতো হয়ে যাচ্ছে। একটা কাটা ঘুড়ি। ওর হাইট ছয় তিন হতে পারে, তা বলে ল্যাম্পপোস্ট হতে লাল রাজি না।
হলুদের সাতটা আনরেড মেসেজ টপকে বেগুনির চ্যাট খুলল। সপ্তাহ দুই ধরে লালের মেসেঞ্জারে ঘাই মারছেন। টাটকা প্রোফাইল পিকে কালো শিফন ফুঁড়ে সাড়ে তিন ইঞ্চি খাঁজ। পরশু না কবে লাল লিখেছিল বটে, কালোতে আপনাকে মানাবে ভালো। ‘স্নিগ্ধ’ লিখতে গিয়ে এস এন টাইপ করেও ব্যাকস্পেস মারল। আঠেরো মিনিট আগে মহিলা ‘হাই’ পাঠিয়েছেন। আঠেরো ঘণ্টা যাক। করেসপন্ডেন্সের এই স্টেজটা ক্রিটিক্যাল। এখন ক্ষমতার যে সমীকরণ প্রতিষ্ঠা হবে পরবর্তী যোগাযোগের চেহারা নির্ধারণ করবে সেটাই।
কফিতে চুমুক দিল লাল। বউ সামলাতে না পারলে কী হবে, সবুজের কফির টেস্ট ইমপেকাবল্।
তিনটে ডট ঢেউ তুলছে। লালকে অনলাইন দেখে বেগুনি জাগ্রত হয়েছেন। ফাঁকা? কল করব? রোবাস্টা ছাপিয়ে ডেসপারেশন ধাক্কা মারল নাকে। স্টিল, হলুদের প্যাসিভ অ্যাগ্রেশন ডিল করার থেকে বেটার। জিভকাটা ইমোজি দিয়ে লিখল, বউ বাড়িতে। রাতে ফাঁকা থাকলে জানাচ্ছি।
***
লিফটে ঢুকে গ্রাউন্ড ফ্লোরের বোতাম না থেমে সাতবার টিপল নীল। করিডরে বাঁক নিচ্ছে কোশলকর বুড়ি। নীল বুড়িকে দেখেছে, বুড়ি নীলকে দেখেনি। এই মুহূর্তে লিফটে সহযাত্রী চায় না নীল। বুড়িকে তো নয়ই। পুনেরি সুতির সাদা থান, ফর্সা গোল মুখ, সাদা চুলে সিঁথি-ওপচানো টকটকে সিঁদুর। ফুল মাতৃমূর্তি। এদিকে দেখা হলেই, বেবি কিউঁ নেহি লিয়া? সারনেম অলগ কিউঁ? কাস্ট ভি কেয়া . . . ?
লিফটের দরজা বন্ধ হল। শ্বাস নিল নীল। মনে হল অনন্তকাল পর। ঠোঁট দিয়ে সশব্দে হাওয়া ছাড়ল। ঘাড় ডাইনেবাঁয়ে ঘোরাল - গিঁট যদি ছাড়ে। একটা ভায়োলেন্স আজকাল চব্বিশ ঘণ্টা বনবন ঘোরে শরীরের ভেতর। মাথা ফাটিয়ে বেরোনোর চেষ্টা করে যখনতখন। সেটা রিলিজ করতে লুডোতে ওই রকম অ্যাগ্রেসিভ হতে হল। চোট্টামো করে লালের পাকা গুটি খেতে হল। লাল দেখছে জেনেও। ইন ফ্যাক্ট, লাল দেখছে বলেই বেশি করে খেল। দেখেও যে লাল ওকে ঘাঁটাতে সাহস পেল না সেটা নীলকে আরাম দিল। মাথার আগুনটা নতুন করে উসকেও দিল।
কুর্তার পকেট থেকে ফোন বার করল নীল। সকাল থেকে নিঃসাড়। এক মাস আগেও এ জিনিস ঘটত না। হাওয়া নিশ্চিতভাবে ঘুরছে।
টিং। লিফটের দরজা খুলল। সুইমিং পুলে থলথলে বাচ্চারা ঝাঁপাচ্ছে। মঙ্গলসূত্রমণ্ডিত মায়েদের জটলা আই কন্ট্যাক্ট এড়িয়ে পেরিয়ে গেল। সবুজ লন চিরে কংক্রিটের ফুটপাথ কম্পাউন্ডের সীমানার দিকে চলে গেছে। সীমানা ঘেঁষে নিম, তেঁতুল, ছাতিম, পিপুল। ভরদুপুরেই আলো ঢোকে না, এখন অন্ধকার। অন্ধকারে দূরে দূরে স্টিলের বেঞ্চ। যেগুলোতে নীল ছাড়া কেউ বসার আগ্রহ দেখায়নি কোনও দিন, থ্যাংকফুলি।
সবথেকে অন্ধকার বেঞ্চটায় বসল নীল। দূরে বিকেল ফুরিয়ে আসছে। পুলের হুল্লোড় এখানে অস্পষ্ট। ঠাণ্ডাও বেশি। পকেট থেকে ফোন বার করে আর একবার চেক করল। সাইলেন্ট মোড অফ করে পাশে নামিয়ে, দুই হাঁটু বুকে জাপটে চিবুক রাখল।
গোটা ডিজ্যাস্টারটা এড়ানো যেত যদি সেদিন হলুদসবুজের বাড়িতে বিরিয়ানি রেঁধে খাওয়ার হাওয়া না তুলত লাল। প্রতিদিনই তো অর্ডার হয়, একদিন সবাই মিলে রান্না হোক। ‘হোক হোক’ - আধো গলায় ধুয়ো ধরেছিল হলুদ। লাল সাততলা থেকে লাফাতে বললেও রাজি হয়ে যাবে মালটা। আটটায় পেঁয়াজ কাটা শুরু করে মদগাঁজার ব্রেক নিয়ে মাটন গ্যাসে চড়ল সাড়ে এগারোটায়। জায়ফলের বৈজ্ঞানিক নাম নিয়ে লাল হলুদের খুনসুটি ভেসে আসছিল রান্নাঘর থেকে। সেটাকে চাপা দিতেই ও একের পর এক পেগ নিচ্ছিল? নাকি সবুজ সাধছিল বলে? নকল টিফ্যানি ল্যাম্প রঙিন পাপড়ি মেলেছিল হলুদসবুজের ফ্ল্যাটের লাইল্যাক দেওয়ালে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নীল যে মুহূর্তে রিয়েলাইজ করল রান্নাঘরে পিনড্রপ নীরবতা, ডিভানের ওপ্রান্তে আধশোয়া সবুজ কনুইয়ে ভর দিয়ে এগিয়ে এসে ওর পায়ের পাতায় ঠোঁট চেপে ধরল।
কী অনুভব করেছিল নীল? ঘৃণা? শিহরণ? অপরাধবোধ? রান্নাঘর থেকে লাল হলুদ যখন ফাইন্যালি বেরিয়ে এল - যে যার ফোনে চোখ সেঁটে - ভেবেছিল বলে দেবে। বলেনি। ফেরার পথে খাঁ খাঁ সিগন্যালে দাঁড়িয়ে লাল যখন সাবধানী গলায় জানতে চাইল, এভরিথিং অলরাইট? তখনও বলে দিতে পারত, বলেনি। পরদিন সকাল সাতটা সতেরোয় যখন সবুজ ‘গুড মর্নিং’ পাঠাল আর এগারোটা সাতান্নয় ও ‘মর্নিং’ ফেরত পাঠাল, তখনও না।
অপেক্ষা করেছিল নীল - লাল টের পেয়ে যাবে। লাল টের পেল না। রোজ রাতে এক ফুট দূরে ঘুমোতে গিয়ে, রোজ সকালে এক ফুট দূরে ঘুম ভেঙেও লাল জানতেই পারল না পাশের লোকটা তলিয়ে যাচ্ছে প্রতি সকালের ‘গুড মর্নিং’ আর গভীর রাতের ‘আছ?’-র পাঁকে।
কেন পেল না? না পাওয়া কি সম্ভব? লালের মণির নড়াচড়া দেখে তো নীল ধরে ফেলে লালের ভেতর কী চলছে, নীলের জীবনের এত বড় একটা ঘটনা লাল ধরতে পারল না? পারল না? নাকি চাইল না? লাল পারল না, একটা বাচ্চা থাকলে কি পারত? নীলকে টেনে তুলতে?
লোনাভালা রিট্রিটের রিঅ্যাকশনটা বাড়াবাড়ি হয়েছিল। রাগটা ঠিক কার ওপর হচ্ছিল? লালের মহৎ অন্ধত্বের ওপর? নাকি নিজের ওপর? এই স্বখাত সলিলে ডোবার জন্য?
সংসারমনস্কতার এক বিরল ঠেলায় বুককেসের ধুলো ঝাড়তে গিয়ে লালের লুকোনো ফোন মেঝেতে পড়েছিল। মুহূর্তটা বারবার রিওয়াইন্ড করে দেখেছে নীল। কত পারসেন্ট রাগ হয়েছিল? কত পারসেন্ট রিলিফ? বুকের ভেতর পাপবোধের পাথরটা এক ঝটকায় কতটা হালকা হয়েছিল?
হাঁটুতে কপাল নামাল নীল। চোদ্দ বছর আগে রাজধানীর কামরায় দেখা হওয়ার পর থেকে ওর জীবন পাক খেয়েছে লালকে ঘিরে। অন্য কাউকে কি ভালো লাগেনি? লেগেছে। কেটেও গেছে। কারও কারও সঙ্গে বন্ধুত্বও হয়েছে। আলির সঙ্গে কত লাঞ্চ, কত কফি, অফিস পলিটিক্স নিয়ে কত পি এন পি সি। লাল বলেছে, মালটা তোর প্রেমে পড়বে কিন্তু, তখন আমাকে বলতে আসিস না। নীল কাঁধ ঝাঁকিয়েছে। প্রথম কথা পড়বে না, আর পড়লেই বা কী? ও তো লালের। এ জন্মের মতো।
প্রেম কি না কে জানে, কিছু একটা তো এল। লালকে ঠকানোর অপরাধবোধ, কেচ্ছার ভয়, ডিগনিটি হারানোর আতংক - কিচ্ছু আটকাতে পারল না। একটা মদ্যপ ঠোঁটের এক মুহূর্তের ছোঁয়ায় এত জোর? মনে পড়লে এখনও কেঁপে ওঠে নীল। জীবনের এই জাংচারে যে আর একটা বয়ঃসন্ধি ঘাপটি মেরে আছে, কেউ তো বলেনি আগে। বললে আটঘাঁট বেঁধে জলে নামতে পারত। হড়পা বানে ভেসে যাওয়ার নাকানিচোবানিটা এড়ানো যেত।
ভেসেও কি যেতে পারছে নীল? এতদিন বিশ্বাস করত টুকটাক ফ্লার্টের লক্ষ্মণরেখা মেন্টেন করে লাল - ফোন আবিষ্কারের পর থেকে সে বিশ্বাস ভেঙেছে। লালের পক্ষে সবই সম্ভব। তাহলে ওর পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না কেন? বিবাহ নামক বায়বীয়, দানবীয় একটা প্রতিষ্ঠান ওর চেতনায়, শরীরে হাতিবাঁধা শেকলের মতো পেঁচিয়ে আছে কেন? যে বিয়ের চিহ্নমাত্র শরীরে ধারণ করতে রিফিউজ করেছে নীল, রিলেশনশিপ স্টেটাসের খোপে বুক ফুলিয়ে লিখে রেখেছে ‘ইন আ ডোমেস্টিক পার্টনারশিপ’, সেই জরাজীর্ণ, প্রাগৈতিহাসিক একটা প্রতিষ্ঠানকে কাঁচকলা দেখাতে এত কীসের বাধছে?
সবুজ বলে, বিয়ে হচ্ছে গরু কার, ছেলে কার রফার জন্য বানানো সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট। নাথিং মোর, নাথিং লেস। আজকাল গরুভাগাভাগি ইররেলেভ্যান্ট, ছেলেপুলেও অবান্তরতার দিকে এগোচ্ছে। অ্যাজ আলোকপ্রাপ্ত মেম্বারস অফ মানবসমাজ আমাদের উচিত সামাজিক প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের সুযোগসুবিধে মতো টুইক করে নেওয়া। বছরের পর বছর দুটো মানুষ এমন একটা কনট্র্যাক্টে থেকে যাবে যেটার কোনও রিনিউয়্যাল নেই, এক্সপায়ারি নেই? তাছাড়া কনট্র্যাক্টটা কীসের? যৌন দাসত্বের? মানুষ ন্যাচারালি পলিঅ্যামোরাস। মধ্যযুগফুগে সামাজিক অর্ডার মেন্টেন করতে হয়তো মোনোগ্যামির দরকার ছিল - আন্ডারস্ট্যান্ডিং কাঁধ ঝাঁকায় সবুজ - কিন্তু আজকের যুগে এ সব নিদান মেনে চলা মানে মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতার বিরুদ্ধে যাওয়া। আউটরাইট হিপোক্রিসি।
বক্তৃতা থামিয়ে মিটিমিটি হাসে। যেন কানায় কানায় ভর্তি ইডেন গার্ডেনের স্ট্যান্ডিং ওভেশন শুনতে পাচ্ছে ও - বাকিরা না পেলেও। সোৎসাহ ঐকমত্যে হলুদ মাথা নাড়ে। ভেপের গাঢ় ধোঁয়ার আড়ালে মৌন লালকে আড়চোখে দেখে নীল। লালেরও কি একই মত? লালও কি মনে করে বিয়ে জিনিসটা ব্যাকডেটেড? ইচ্ছেমতো বাঁকিয়েচুরিয়ে নেওয়ার? আজ যদি নীল একটা বাঁকা বিয়ের বায়না ধরে একটুও হিংসে হবে না লালের? কান্না পাবে না? নাকি লালও গুমে গুমে সেদ্ধ হয়ে রয়েছে, নীল প্রস্তাব দিলেই দুই হাত তুলে ‘ছুটি ছুটি’ চেঁচাতে চেঁচাতে বেরিয়ে যাবে?
নাকি লাল অলরেডি বেরিয়ে গেছে?
সহ্যাদ্রির হাওয়া চুলে বিলি কাটে। মুখ তুলে গাল মোছে নীল। লাল আছে না গেছে সেটা এই পয়েন্টে ইমমেটেরিয়াল। নীল থাকতে চায় কি না সেটাই প্রশ্ন। নীলের যা ইচ্ছে নীল সেটাই করবে। লুডোতে জিততে ইচ্ছে হলে যেনতেনপ্রকারেণ জিতবে। তাছাড়া সত্যিটাকে ফেস করাই তো উচিত। ওরা কেউই যদি বিয়েটার প্রতি একনিষ্ঠ না থাকে তাহলে এই প্রহসন কার জন্য? সকালবিকেল ফোন লুকোনো, লুকোনো ফোন খুঁজে বার করে আবার লুকোনো - ডিগনিটির মা-মাসি এক করে বাঁচার থেকে সেটাই বেটার না?
স্টিলের বেঞ্চ কেঁপে ওঠে। ফোনের স্ক্রিনে একটা লাল একটা সবুজ রিসিভার দপদপায়। ফোন নাচতে নাচতে সরে। বেঞ্চের অবতল অংশ পেরিয়ে ঢেউয়ের মাথায় চড়ে। কিনারায় পৌঁছয়। আর একটা গোটা রিং-ও লাগবে না। ফোন কাত হয়। শূন্য ছোঁয়।
হাত বাড়িয়ে তুলে নেয় নীল।
হ্যালো।
***
স্লাইডিং ডোর সরিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে পশ্চিমের বারান্দায় বেরোল লাল। পায়ের তলায় মার্বেল অলরেডি তাপ ছাড়তে শুরু করেছে। হাওয়াও ঠাণ্ডা। ক’দিন পর চাদর লাগবে। নীলের সঙ্গে ও একমত, পশ্চিমমুখো এই বারান্দাটা ওদের ফ্ল্যাটের বেস্ট স্পট। ছ’মাস ঘোরানোর পর ফ্ল্যাটটা দেখিয়েছিল সন্তোষ। পছন্দ হবেই - চোখ বুজে ঘাড় হেলিয়ে হাত তুলেছিল। ছ’মাস ধরে শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত সন্তোষের হিরো স্প্লেন্ডার শ্যাডো করে ততদিনে ওরা ক্লান্ত। এত করে বলছে, এটা দেখে আসা যাক, তারপর স্ট্রেট ল্যাং - ঠিক করেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল।
সোসাইটির লোকেশন ভালো, মেন্টেন্যান্স ঠিকঠাক, ফ্ল্যাটটা নতুন। তিনটে বেডরুম, আড়াইটে বাথরুম, ফুললি ফিটেড কিচেন, ডাইনিং, ডাইনিং-এর একপাশে খোপ কেটে বানানো প্রেয়ার রুমের দেওয়ালে অলরেডি খোদাই করা ‘ওঁ’। লালকে ইন-হাউজিং জিমের ব্রশিওর ধরিয়ে, নীলকে ডিশওয়াশার বুঝিয়ে ফ্ল্যাটের দ্বিতীয় ও শেষ ব্যালকনির দিকে এগিয়েছিল সন্তোষ। আসুন - উদার হাত ছড়িয়েছিল।
সবার প্রথম বারান্দায় পা রেখেছিল লাল। লালের তিন পা পেছনে নীল। নীলের চার পা পেছনে সন্তোষ। সেদিনও সূর্যাস্ত ঘটছিল। কমলা থেকে ম্যাজেন্টা ছুঁয়ে গাঢ়তর রঙে ভেঙেচুরে যাচ্ছিল আকাশ। একটা কালো ঘুড়ি উড়ছিল, মনে আছে লালের।
সন্তোষ আঙুল তুলে দেখাচ্ছিল নব্বই শতাংশ কাজ হয়ে আসা মেট্রোলাইন, বেদভূমি পার্ক, পার্কে দেশের উচ্চতম শিবমূর্তি বসানোর প্ল্যান পাস হয়ে গেছে গত মাসে। লাল ঘুড়িটা দেখছিল। নীলও ঘুড়িটাই দেখছিল। ঘুড়ি থেকে চোখ ফিরিয়ে একে অপরের চোখে চোখ রেখেছিল লালনীল।
বাড়িময় বন্ধ কার্টন ছড়িয়ে এই বারান্দায় বসে মুভ ইন উদযাপন করেছিল ওরা। প্লাস্টিকের গ্লাসে রুম টেম্পারেচার বম্বে স্যাফায়ার, রুম টেম্পারেচার স্প্রাইট। বসার ঘরের সোফা, বেডরুমের নতুন খাট কেনার আগে বারান্দার লাউঞ্জ চেয়ারটেবিলের সেট কেনা হয়েছিল। এক রবিবার দু’জনে গিয়ে লোক্যাল নার্সারি থেকে মনস্টেরা ডেলিসিওসা, অ্যান্থরিয়াম রেড, পিস লিলি। রেলিং-এ পেঁচানোর ইংলিশ আইভি। বাঁদিকের দেওয়ালের দাঁতমুখ খিঁচোনো হুইচল মুখোশ লাল এনেছিল মেক্সিকো সিটির ওয়ার্কশপ থেকে, ডানদিকের ঝলমলে হলুদ সিল্ক স্ক্রোল বেজিং থেকে নীল। হুক থেকে ঝোলানো নুড়িটুরি পালকফালক দেওয়া যে ড্রিমক্যাচারটা অল্প অল্প দুলছে আর পেতলের পুঁচকে ঘণ্টার ঠোক্কর মারছে লালের মাথায় - ক্র্যাফট ভিলেজে ঘুরতে ঘুরতে থমকে সেটাতেই উদাস মুখে হাত বোলাচ্ছিল নীল।
আনকমন বেশ।
লাল বলেছিল, নিয়ে নে। নীল বলেছিল, নাহ্, দরকার তো নেই। লাল বলেছিল, আরে দরকার তো কিছুরই নেই। পার্কিং থেকে বেরিয়ে রাস্তার এপারে পৌঁছে হ্যাজার্ড লাইটস অন করে গাড়ি থেকে নেমে ট্র্যাফিকের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে দৌড়ে ভিলেজে ঢুকে দোকানটা বার করতে অসুবিধে হয়নি। ড্রিমক্যাচার হুক থেকে নামিয়ে খবরের কাগজে মুড়ে দড়ি বেঁধে দিয়েছিল বাচ্চা ছেলেটা। সেটা হাতে নিয়ে রাস্তার ওপারে ট্র্যাফিকের স্রোত কমার অপেক্ষা করতে করতে গাড়ির জানালায় চোখ পড়েছিল।
নীল। ওর দিকে তাকিয়ে আছে। যেন প্রথমবার দেখছে। নীলের চুলে, গালে রোদ ঝিলমিল করছে।
নীলের ওই রোদঝিলমিল মুখটা মনে করে রেখেছে লাল। আজকাল অন্য অনেক মুখ ভেসে উঠে মুখটা চাপা দিয়ে দিতে চায়। ফোনে টাইপ করে যাওয়া উদাসী মুখ, কান্নায় ভেঙেচুরে যাওয়া দুঃখী মুখ, প্রতিশোধস্পৃহায় ছাই হয়ে যাওয়া রাগী মুখ।
বারান্দার শেষ বিন্দু ছেড়ে রোদ্দুর হাওয়া। পুলের হইচই স্তিমিত। মোটা বাচ্চারা - যাদের দেখলেই কানের গোড়ায় দিতে ইচ্ছে করে লালের - মোটা মায়েদের বাড়ানো তোয়ালেতে ধরা দিয়ে কুলায় ফিরছে। এই স্পটে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখতে দেখতে নীলের সঙ্গে কত হেসেছে লাল এক সময়। এখন রিস্ক নেয় না। পাছে নীলের “অপূর্ণ মাতৃত্ব” দাঁতনখ বার করে দাঁড়ায়।
দশ মিনিটে অন্ধকার নামবে। কম্পাউন্ডজোড়া ফুটপাথের জালে চোখ বোলায় লাল। ওখানেই কোথাও আছে নীল। জোরে জোরে হাঁটছে। লাস্ট চেক আপে বর্ডারলাইন হাই কোলেস্টেরল বেশি বেরোনোর পর স্বাস্থ্য নিয়ে মারাত্মক সিরিয়াস হয়ে গেছে। সকালে লেবু গরম জল দিয়ে শুরু করে, সন্ধে ছ’টার পর নো কার্বস। অফিস থেকে ফিরতে যত দেরিই হোক, হাঁটতে যায়। মিনিমাম আধঘণ্টা, কোনও কোনওদিন চল্লিশ মিনিট। কিছু ডেডিকেশন, মাইরি। ‘হট হয়ে যাচ্ছিস তো,’ রসিকতার চেষ্টা করেছিল, নীল হাসেনি। লাল চেপে গেছে।
ওই তো। পাঁচিলঘেঁষা জঙ্গলে ছায়া নড়ছে। একবার এদিকে যাচ্ছে, একবার ওদিকে। বসে বা দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলতে পারে না নীল। হনহনিয়ে হাঁটতে হয়।
চোখ সরিয়ে গোপন ফোনে রিল স্ক্রোল করে লাল, কফিতে চুমুক দেয়। ড্রিমক্যাচারের পালক কপালে আঙুল বোলায়। পেতলের ঘণ্টা টুংটাং ঠোনা মারে। তিনতলা কেকে গোঁজা সাত ও শূন্যের মোমবাতিতে ফুঁ দেন হুইলচেয়ারে বসা লোলচর্ম জাপানি বৃদ্ধবৃদ্ধা।
জন্মদিন নয়। বিবাহবার্ষিকী।
গ্লোবাল ভোক্তাদের সুবিধার্থে ইংরিজি সাবটাইটেল ফোটে। টেল আস দা সিক্রেট অফ ইয়োর সাকসেসফুল ম্যারেজ। দন্তহীন মাড়ি বার করে বুড়ি বলে, লাভ। দন্তহীন মাড়ি বার করে বুড়ো হাসে। স্ক্রিন জুড়ে কনফেটি। লুপ ফের শুরু হয়, টেল আস দা সিক্রেট অফ ইয়োর সাকসেসফুল ম্যারেজ।
লাভ।
লাভ।
লাভ।
কেউ জানতে চায় না সত্তর বছরের বিবাহে কে চোর ছিল কে পুলিস? কে আসামী কে বিচারক? সত্তর ইনটু তিনশো পঁয়ষট্টি রাতের মধ্যে ক’রাত ঘুম ভেঙে মনে হয়েছিল দু’হাত দূরে শুয়ে থাকা লোকটা না থাকলে, কে জানে, হয়তো আর একটু কম একা লাগত?
ড্রিমক্যাচারের ঘণ্টার শব্দ বদলে যায়। বুক ধড়াস করে ওঠে লালের - ফোন সাইলেন্ট করা নেই নাকি? নাঃ, এটা নীলের ফোনের রিংটোন। কয়েক সেকেন্ড নেয় ধাতস্থ হতে। ঘরে যায়। নীলের দিকের বেডসাইড টেবিলে ফোন জ্বলছেনিভছে। মা কলিং।
হ্যাঁ কাকিমা, বলুন। না, ও নিচে হাঁটতে গেছে।
নীলের ছোটমামির হাঁটু অপারেশনের ডেট ফিক্স হয়ে গেছে। সেজমাসি তোমাদের কথা জিজ্ঞাসা করছিলেন। অনেক বয়স হয়েছে, ক’দিনই বা থাকবেন। বাচ্চাদের দেখতে পেলে ভালো লাগে। পুজোতে আসতে পারলে না, বড়দিনে পারবে?
লাল বলে, দেখি কবে হয়।
দেখো। টুম্পাও ছেলেমেয়ে নিয়ে আসবে মিনেসোটা থেকে। সবার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। আমরা তো আর বেশিদিন নেই, তোমাদেরই নিজেদের মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ যোগাযোগ রাখতে হবে। হ্যালো? শুনতে পাচ্ছ? হ্যালো?
লালের ঘোর ভাঙে। হ্যাঁ কাকিমা, বলুন। শুনতে পাচ্ছি।
মিনিটদুয়েক কথা বলে ফোন রেখে দেন নীলের মা। লাল দাঁড়িয়ে থাকে। মগজ জুড়ে নীলের ছায়া পিপুলবনে কানে ফোন চেপে হনহন হাঁটে।
***
বিজি? ইজ ইট আ গুড টাইম টু টক?
লম্বা রিং হওয়ার প্রতিক্রিয়ায় ইংরিজিতে কথা শুরু করে সবুজ।
নীল ভাবে বলবে, কাজ কীসের, এই তো নিষ্কর্ম বসে আছি। বলে না। লাল ছাড়া আর কাউকে প্যাসিভ অ্যাগ্রেশন দেখানোর সাহস নেই ওর।
সবুজ নিশ্চিন্ত হয়। কথা বলে যায় তাই নিয়ে যা ওর ইন্টারেস্টিং লাগে বা জরুরি মনে হয়। নীল হুঁ হাঁ করে, যথাস্থানে হাসে, বিস্মিত হয়, সবুজের লবিবাজ সহকর্মীর প্রতি মাপমতো বিরক্তি প্রকাশ করে।
সবুজের কথা ফুরোয়। শোন, আজ রাখছি, কাল কথা হবে আবার।
শিওর, নীল বলে। ফোন কেটে যায়।
সবুজের স্টেলার কেরিয়ারের সিক্রেট হচ্ছে - দু’পেগের পর যা সবুজ সবার সঙ্গে শেয়ার করে - ছক। এ হাতে গ্লাস ও হাতে সিগারেট নিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে, জীবনটা হচ্ছে ছক, মামা। ওয়ানস্ ইউ ফিগার দা ছক আউট, নো ব্লাডি বডি ক্যান স্টপ ইউ।
নীলের সঙ্গে ছকটা নেমে যাওয়ার পর - প্রিভিলেজ প্যাকেজের অংশ হিসেবেই সম্ভবতঃ - ওর সাফল্যের অন্য সিক্রেটটা নীলকে দেখিয়েছিল সবুজ। প্রোডাক্টিভিটি অ্যাপ। মাসিক সাবস্ক্রিপশন ঊনপঞ্চাশ ডলার। বছরেরটা একবারে কেনে বলে পাঁচশো ডলারে পায়।
সস্তা অ্যাপ? কেন থাকবে না? ফ্রি অ্যাপও আছে। সে সবে শুধু টাইমার, লিস্ট মেকিং হাবিজাবি। এটায় গোল সেটিং, ইমেল সর্টিং, প্রোডাক্টিভিটি ট্র্যাকিং, ডে থিমিং, ডিসট্র্যাকশন ব্লকিং সব পাবি। পোমোদোরো টেকনিক, আইজেনআওয়ার মেট্রিক্স, এইটি/টোয়েন্টি রুল। ঘাড় ধরে কাজ করিয়ে নেবে।
সাকসেস হ্যাজ ইট প্রাইস, মামা। লাইফ ইজ নট আ ফ্রি লাঞ্চ।
আর একটা কুল জিনিস দেখবি? স্ক্রিনের কোণে গাছের আইকনে ক্লিক করেছিল সবুজ। যে দিন টু ডু লিস্টের সবক’টা আইটেম কাটা পড়ে, প্রোডাক্টিভিটি ঘড়ি টানা চোদ্দ ঘণ্টা ছোটে, ন'টা টু ন'টা নিষিদ্ধ ইউ আর এল-এ একবারও ক্লিক হয় না - জলদস্যু পেটিতে বাড়তি কয়েন জমা পড়ে। জমতে জমতে পেটির ঢাকনা খুলে উপচে পড়লে অ্যাপ কর্তৃপক্ষ ইউজারের তরফ থেকে গাছ পোঁতেন। ইট’স অল অ্যাবাউট গিভিং ব্যাক। মার্ক্স যেটা বোঝেনি, সোশ্যালিস্টরা যেখানে ধেড়িয়েছে - এরা করে দেখিয়েছে। এফেক্টিভ অলট্রুইজম। টাকা কামাও, সেই টাকায় ক্লাইমেট চেঞ্জ, দারিদ্র্য, বর্ণবিদ্বেষ, রেসিজম ভাগাও। এমনকি তোদের ইকুয়াল অপরচুনিটিও স্পনসর করো।
সতেরো মাস আগে সাবস্ক্রিপশন নেওয়ার পর থেকে সাতটা গাছ পুঁতেছে সবুজ। বুরুন্ডিতে দুটো, মার্শাল আইল্যান্ডে তিনটে, টোংগায় একটা। ইস্ট টিমোরের গাছটারও শিকড়, কাণ্ড হয়ে গেছে - ডালপালা আর পাতা বাকি। সামনের দু’সপ্তাহ নাক চোখ মুখ বুজে টেনে দিলেই হয়ে যাবে।
কিন্তু আসল কাজের জিনিস হচ্ছে এইটা। স্ক্রিনের ঈশান কোণের আইকনে ক্লিক করেছিল সবুজ। ওর সাফল্যের আসল সিক্রেট।
একটা এক্সেল শিট। সোম থেকে বৃহস্পতি - ভোর পাঁচটা চল্লিশ থেকে রাত দশটা কুড়ি। শনিরবি - ছ’টা চল্লিশ থেকে দশটা কুড়ি। শুক্রবার দিন শুরু পাঁচটা চল্লিশে, রাত আনলিমিটেড। সবুজের টুইটারের মোটোঃ ওয়ার্ক হার্ড, প্লে হার্ডার।
এরিয়াল আট ফন্ট পড়তে স্ক্রিনের ওপর ঝুঁকে পড়েছিল নীল। মানে ভদ্রতার সীমা লঙ্ঘন না করে যতখানি ঝুঁকে পড়া যায়।
সত্তর পারসেন্ট খোপ কেরিয়ারসংক্রান্ত এবং সোনালি। সম্ভবতঃ সবুজের ভবিষ্যতের দ্যোতক। অধিকাংশই মিটিং। বাকি খোপে ওয়ার্ক-লাইফ ভারসাম্য। ঘুম থেকে উঠে বিপাসনা চ্যান্টিং। ডিপ ব্রিদিং। শেভিং। ঘুমোতে যাওয়ার আগে আবার চ্যান্টিং, ডিপ ব্রিদিং, আধঘণ্টা রিডিং। প্রতিদিন কোনও একটা বইয়ের দশ পাতা করে পড়ে সবুজ। মাইক্রো টুডে, মেগা টুমরো। স্টপ থিংকিং, স্টার্ট অ্যাচিভিং। হিল ইয়োর ইনার চাইল্ড, আনলিশ ইয়োর ইনার সি ই ও। দিনের শেষ কাজ - চ্যারিটি। ফিডিং ডাউনস্টেয়ারস ডগস।
কান থেকে ফোন নামিয়ে সময় দেখল নীল। সন্ধে সাড়ে ছ’টা থেকে সাতটা খোপটার নাম সবুজ কী রেখেছে কল্পনা করতে সাহস পেল না।
***
অন্ধকার রান্নাঘরে কফিমেশিন, মাইক্রোওয়েভ, ওয়াটার পিউরিফায়ারের আলোকবিন্দু। জানালার বাইরে টানটান অন্ধকার। দিগন্তে ফুলে ওঠা পশ্চিমঘাটের ছায়া। দপদপ করতে করতে এরোপ্লেন যায় জানালার এই ফ্রেম থেকে ওই ফ্রেম। ফ্রিজ গোঙায়। আকাশ শব্দহীন লালনীল ফুলকিতে ভরে ওঠে। ম্যাচ ছিল? নাকি লোকে ভাইফোঁটাতেও বাজি ফাটাচ্ছে আজকাল?
বৈধ ফোনে নোটিফিকেশন আসে। মেমোরিজ। অটোপ্লে-তে সরে সরে যায় বাগডোগরা এয়ারপোর্ট, পাহাড়, পাইনবন চেরা পিচরাস্তা।
টুয়েলভ ইয়ারস এগো।
হোমস্টের কাঠের বারান্দা। রেলিং রোদ্দুরের কাটাকুটি - নতুন ডি এস এল আর-এ ধরতে প্রায় শুয়ে পড়েছিল লাল। ক্যামেরাটা কোথায়? এ বাড়িতে আনা হয়েছে অ্যাট অল? বাঁশের টেবিলে লালের আলুপরাঠা অরেঞ্জ জুস, নীলের টোস্ট আর ব্ল্যাক কফি। এই বারান্দাতেই নাকি ইজি চেয়ার পেতে রবীন্দ্রনাথ শুয়ে থাকতেন। সারাদিন পয়েন্ট থেকে পয়েন্টে ঘুরতে ঘুরতেও এখানে রবীন্দ্রনাথ, সেখানে রবীন্দ্রনাথ। কলকাতায় সব চপের দোকানেই নেতাজি চপ খেয়েছিলেন - সেই কেস মনে হয়, বলাবলি করেছিল ওরা। আরও পাহাড়। ঝর্না। রেলিং-এ হেলান দিয়ে বারো বছর আগের নীল।
আঙুল রেখে অটোপ্লে থামায় লাল। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসছে নীল। দু'হাত দিয়ে নিজেকে জাপটে ধরে আছে। ঠাণ্ডা লাগছিল মনে হয়। ওয়েদার অদ্ভুত ছিল সেদিন। সূর্য থাকলে দিব্যি, মেঘের আড়ালে গেলে হাড়ে হাড়ে কাঁপুনি। ওই মুহূর্তে মেঘ এসেছিল হয়তো। একটা সোয়েটারে ওই ঠাণ্ডা ম্যানেজ হওয়ার কথা নয়।
ফোন চোখের কাছে আনে লাল। দু’আঙুলে নীলকে বড় করে। চোখের কোলে ক্লান্তি। অত জার্নি করে? নাকি গত কয়েকদিনের তাণ্ডবে? কপালের কিনারায় লালচে আভাস। বুড়ো আঙুল দিয়ে স্ক্রিন ঘষে লাল। নাহ্, ছোপটা নীলের কপালেই। কী করে? জাস্ট রেজিস্ট্রি হয়েছিল তো ওদের। রাআআইট। মনে পড়েছে। সইসাবুদ হয়ে যাওয়ার পর টুম্পার শাশুড়ি না কে যেন টুপি থেকে খরগোশ বার করার মতো করে সিঁদুরকৌটো বার করেছিলেন। মালাবদলের গোড়ের মালা। প্রাথমিক থতমত কাটিয়ে নীল ভুরু কুঁচকেছিল। মুখও খুলে ফেলেছে, লাল চোখে চোখ রেখে ইমপার্সেপ্টিবল ঘাড় নেড়েছিল।
সিনক্রিয়েট করিস না। এই যুদ্ধটা এই পয়েন্টে অবান্তর।
উলুধ্বনি ও উল্লাসের মধ্যে মালাবদল সেরে, কৌটো থেকে এক চিমটি সিঁদুর নিয়ে নীলের সিঁথিতে টাচ করিয়ে বাকিটা লাল হাত ঝেড়ে ফেলে দিয়েছিল মাটিতে। বউভাতের পরদিন সকালেই ওরা বেরিয়েছিল, কাজেই এটা বিয়ের তিনদিন পর। দাগটা প্রায় উঠে এসেছে। আর হয়তো দু'একদিনই থাকবে। বা দু'একঘণ্টা।
সবুজের মতো গরুভাগাভাগির লেভেলে নামিয়ে না আনলেও, লালও চিরদিন মনে করেছে বিয়ে জিনিসটা মোটের ওপর আলংকারিক। একটা ল্যামিনেটেড কাগজে দুটো টিপছাপ, তিনজন সাক্ষীর সই ছাড়াও তো নীলের সঙ্গে সারাজীবন একসঙ্গে থাকতে পারত ও। থাকাটাই তো আসল কথা। বিয়ে কীসে লাগে?
আমাদের মন রাখছ ধরে নাও, বলেছিল বাড়ির লোক। নীল বলেছিল, সার্কাস। লাল বলেছিল, জাস্ট একটা ফর্ম্যালিটি হিসেবে ট্রিট কর।
এক বাড়ি থেকে বেরিয়ে এক প্লেনে চড়ে ফর্ম্যালিটি সারতে এসেছিল ওরা। বিয়ে করে আবার এক বাড়িতে ফেরত গেছিল। প্রায় দেড় বছর লিভ ইন, একে অপরের শরীরের এক মিলিমিটারও অচেনা ছিল না, মনের যাবতীয় নীচতা ও মাধুর্য অলরেডি আত্মপ্রকাশ করেছিল। তবু ওই বিয়ে, বা সার্কাস, বা ফর্ম্যালিটির তিনটে দিন লালের ভেতর একটা অস্বস্তির জন্ম দিচ্ছিল। কীসের - পিনপয়েন্ট করতে পারছিল না লাল।
পকেট থেকে ভেপ বার করল। চার্জ ফুরিয়ে গেছে। পকেটে ঢুকিয়ে রাখল।
অনেকবার ভেবেছিল নীলকে জিজ্ঞাসা করবে, অস্বস্তিটা ওরও হচ্ছে কি না। করেনি। যদি না হয়ে থাকে? যদি নীল চোখ ঘোরায়?
হুল্লোড় ফুরোলে শেষরাতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে দমদম পৌঁছে, বাগডোগরায় নেমে ট্যাক্সি নিয়ে পাহাড়ি পথ পেরিয়ে, কাঠের বাংলোয় রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে পরোটা খেয়ে পয়েন্ট দর্শনে বেরোনোর সময়েও অস্বস্তিটা রয়ে গেল। বাড়ল, অ্যাকচুয়ালি।
তারপর ড্রাইভারজি গাড়ি থামিয়ে আদেশ করলেন, নিচে ওয়াটারফল হ্যায়, দেখকে আইয়ে। পাহাড়ের গা কেটে ফাঁকা ফাঁকা লোহার সিঁড়ি। নীল সামনে সামনে, নীলকে ক্রমাগত সাবধান করতে করতে পেছনে পেছনে লাল নামল। সিঁড়ির শেষে ঝুলন্ত কাঠের পাটাতন। শূন্য পেরিয়ে ওপারে পাহাড়ের গা বেয়ে রাগী জলপ্রপাত ঝরছে।
রেলিং-এ হেলান দিয়ে নীল হাত নেড়ে ডেকেছিল। কাউকে বল, আমাদের দু'জনের একসঙ্গে তুলে দেবে।
না বস্। তুই দাঁড়া। তোর একটা ছবি তুলে দিই।
ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখেছিল লাল। মেঘ এসে রোদ ঢেকে দিচ্ছে। হাওয়ায় নীলের কুচো চুল উড়ছে। নীল হাসছে, দু'হাতে নিজেকে জড়াচ্ছে।
গত বাহাত্তর ঘণ্টার অস্বস্তি একটি ক্রিস্ট্যালকণায় সংহত হয়ে ঝলসে উঠেছিল।
দিস ইজ ইট।
এই আট বিলিয়ন লোকের পৃথিবীতে, একটি গোটা মানুষ, একটি সম্পূর্ণ নারী, মাথা থেকে পা পর্যন্ত - ওর। সে নারীর আনন্দ ওর, দুঃখ ওর। হাসি কান্না হর্ষ বিষাদ ক্রোধ শীৎকার ডিপ্রেশন - সব ওর। তার প্রাপ্তি ও হতাশায়, ক্রোধে ও কান্নায়, স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গে - একা লালের অধিকার।
আর কারও না।
সবুজ বলবে সোশ্যাল কন্ডিশনিং, কিন্তু সোসাইটিও সত্যি, কন্ডিশনিং-ও মিথ্যে নয়। যে কন্ডিশন এই অবিশ্বাস্য, অবাস্তব, অলৌকিক ব্যাপার সম্ভব করেছে তাকে গরুভাগাভাগির উপায় বা দাসখত বলে মানতে রাজি নয় লাল। লালের জীবনে তা স্যাক্রোস্যাংক্ট। অলঙ্ঘ্যনীয়। ধ্রুব।
অনেকক্ষণ একটাও এরোপ্লেন যায়নি। বাজি ফাটেনি। ফ্রিজটাও স্তব্ধ।
একটা কিছু আছড়ে ভাঙতে ইচ্ছে করে লালের।
***
আকাশ থেকে কুয়াশার মতো ঠাণ্ডা নামছে। মাটি থেকে স্টিলের বেঞ্চ বেয়ে জিনস ফুঁড়ে ঠাণ্ডা উঠছে। নীলের হাঁটুর ভাঁজে, ঘাড়ের কাছে, কানের পেছনে জমছে। হাওয়ার ধারে নীলের নাকের ডগা জ্বলছে। একটা কুকুর একবার ডেকে চুপ করে গেল।
জন্মদিনে, বিজয়াদশমীতে, রেজাল্ট বেরোলে সবাই জানতে চেয়েছে বড় হয়ে কী হতে চায় নীল। একবার প্রফেসর বলেছে নীল, একবার অ্যাস্ট্রোনট, একবার দাবাড়ু। কিন্তু যত বয়স বেড়েছে, যত দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বেড়েছে, উত্তরটা ওর কাছে স্পষ্ট হয়েছে। আসলে ও কিছুই হতে চায় না।
বা যা-ই হোক না কেন, আসলে ও সমান সমান হতে চায়।
দেখতেশুনতে সহজ, কিন্তু নীল জানে ব্যাপারটা কতটা কঠিন। সাম্য এখনও কতটা মরীচিকা, কতটা আলেয়া। লাস্ট পাবলিকেশন পিয়ার রিভিউড জার্নালে অ্যাকসেপ্টেড হওয়ার পর ডিরেক্টর নীলের হাত ঝাঁকিয়ে অভিনন্দন জানালে, এতদিনের বন্ধু, সহকর্মী, আগুনখেকো অ্যালাই আলি, গলার ভেতর হাসির মতো শব্দ করে।
সিম্প।
ছ'মাসের রাতজাগা, নাওয়াখাওয়া ডকে তোলা - একটি সিলেবেলে যৌনতার অ্যাডভান্টেজে পর্যবসিত হয়।
গায়ে পোকা বসার নির্বিকল্পতায় ঝেড়ে ফেলে নীল। নীল অনেক কিছু, বোকা নয়। নীল বাস্তব চেনে। নীলের আতংকটা অন্য জায়গায়। নীল ভ্যাকুয়ামে বড় হয়নি। নীলও আলির সমাজেরই ফসল। নীলের মাথাও এক্স্যাকটলি আলির পথেই চলে। আলির মাথায় যে চোরাবালি নীলের মাথাতেও তা-ই। কাজেই নিজেই নিজেকে ক্রমাগত মনে করাতে হয়, একমুহূর্ত ঢিলে দেওয়ার বিলাসিতা দেখালে চলে না।
আমি সমান। আমি সমান। আমি সমান।
হাওয়ায় পিপুলের পাতা দোলে। নীল কেঁপে ওঠে। আতংকটা যে সত্যি নীল নিজে প্রমাণ করেছে। আলোকপ্রাপ্ত নীল, স্বাধীনচেতা নীল, ডিগনিটির জন্য সব ত্যাগ দেওয়া যায় বিশ্বাস করা নীল স্বেচ্ছায় একটি সম্পর্ক তৈরি করেছে যার সম্পূর্ণ কন্ট্রোল অপরপক্ষের হাতে। সজ্ঞানতায় এমন এক সমীকরণের অংশ হয়েছে যার কোথাও কোনও সমানচিহ্ন নেই। কোনওদিন থাকবে না। থাকার কথাই ছিল না। দাতার উল্টোদিকে নীল গ্রহীতা দাঁড়িয়েছে। দাতা যা চাইবে, যতটুকু চাইবে, যতক্ষণের জন্য চাইবে হাত পেতে নিতে সাগ্রহে রাজি হয়েছে।
গত ক'মাস এই ফোনটা এলে মনে হত একটা জানালা খুলল। কথা ফুরোলে জানালা বন্ধ হয়ে যেত, চব্বিশঘণ্টার মতো।
নীলের মাথার ওপর ডালপালার আদিম আঙুলের ঠাস বুনুনি। অন্ধকার আগের থেকেও জমাট। সে অন্ধকারে ফোন হাতে নীল বসে থাকে। ভাবে। কী ঢুকল জানালাটা দিয়ে? কতটা অক্সিজেন? কতখানি ভিটামিন ডি? কতটা রোদ্দুর?
শীতল সোঁদা অন্ধকারে ফোন হাতে বসে রোদ্দুরের স্বপ্ন দেখে নীল। ঝলমলে রোদ্দুর। একটা দুপুর এসে দাঁড়ায়। বছর দুই আগের হবে - মনে হয় পূর্বজন্ম। ক্র্যাফট ভিলেজে কুমাওনি কুইজিনের পপ আপ। জীবনে প্রথমবার ভাতে মেখে ভাঙের চাটনি। মাচায় বসে ক্রাফট মিউজিয়ামের দেওয়ালে ঘর্মাক্ত, মনোযোগী যুবক শিল্পীর তুলিতে গোন্দ হরিণ। হরিণের শিং শাখাপ্রশাখা মেলে দেওয়ালজোড়া অরণ্য হয়ে যায়। সে উজ্জ্বল অরণ্যে খালি গা ধ্যানরত সন্ন্যাসীর মাথায় এসে বসে নীলকণ্ঠ পাখি।
পাখি থেকে চোখ সরাতে ঝুলন্ত ড্রিমক্যাচারটায় চোখ পড়েছিল। পরিপাটি, সন্নিবদ্ধ সতীর্থদের থেকে আলাদা। পালক, নুড়ি, কাঁচ, পেতলের ঘণ্টাটন্টা নিয়ে এলোমেলো, অগোছালো। নীলের এলোমেলো, অগোছালো স্বপ্ন ক্যাচ করার জন্য পারফেক্ট।
আধঘণ্টা পর খবরের কাগজের মোড়ক (গাড়ি দাঁড় করিয়ে নেমে যাওয়ার সময়েই নীল জানত লাল কোথায় যাচ্ছে) হাতে ভিলেজ থেকে বেরিয়ে এসেছিল। নীল জিন্স, কালো শার্ট, চাবুকের মতো লাল, নীলের ড্রিমক্যাচার নিয়ে ঝলমলে রোদ্দুরে চোখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে ছিল।
ওই রোদের মুহূর্তটায় নোঙর ফেলে নীল। রাজধানী এক্সপ্রেসে চোখে চোখ পড়ার পর থেকে ওদের যুগ্ম জীবনের প্রতিটি সেকেন্ড চিরুনি দিয়ে আঁচড়ে দেখে।
একটাও সেকেন্ড এমন নেই যেখানে লালের থেকে একচুল কম পড়েছে নীল। বা এক কণা বেশি। এই পৃথিবীর আট বিলিয়ন ভিড়ে, আশ্চর্য মির্যাকলে এমন একটা লোকের সঙ্গে দেখা হয়েছে নীলের, যার সঙ্গে ও একেবারে সমান সমান।
পা মাটিতে রাখে নীল। ঝিঁঝিঁ ধরে গেছে। পায়ের পাতা যথাক্রমে ক্লক ও অ্যান্টিক্লকওয়াইজ ঘোরায়, ঝুঁকে পড়ে হাত দিয়ে ঘষে। উঠে দাঁড়িয়ে বাড়ির দিকে হাঁটে। বিল্ডিং সি-র ছাদের আকাশ লালনীল ফুলকিতে ভরে যায়।
***
নীল বেল বাজায়। লাল চেঁচায়, দাঁড়া আসছি। রান্নাঘরের আলো জ্বালে। বাথরুমে ঢুকে চোখেমুখে জল ছেটায়।
নীলের খিদে খিদে পায়। নীল আবার বেল বাজায়। লাল দরজা খোলে।
কফি খাবি? ভালো কফি। বানিয়েছি।
নীল ফ্রিজের দরজা খুলে দাঁড়ায়। দশ সেকেন্ড পর বন্ধ করে।
চ’ দোসা খেয়ে আসি।
লাল চুল আঁচড়ায়, নীল জামা ছাড়ে। আয়নার কাছে ঝুঁকে নীল কপালে টিপ সাঁটে, পেছনে দাঁড়িয়ে লাল চুলে আঙুল চালায়। লাল ফোনে ট্র্যাফিক চেক করে, নীল গ্যাসের নব। নীল ফায়ার এক্সিটের দরজা টেনে পরীক্ষা করে, লাল জুতো গলায়। লাল টেবিল থেকে গাড়ির চাবি তোলে, নীল দরজার হুক থেকে বাড়ির চাবি নামায়।
রেডি?
রেডি।
***
উনিশশো কিলোমিটার দূরে বরাকর স্টেশন পার করে অন্ধকার চিরে ভোঁ দিতে দিতে রাজধানী ফুলস্পিডে ছোটে।
Darun likhechen!
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, অভিজিৎ। ভালো লাগল।
Deleteসুন্দর লাগলো পড়ে।
ReplyDeleteচরিত্রের নামকরণগুলো বেশ লাগলো।
গল্পের শুরুতে পাঁচটা "ট্যাক" দেখে ভেবেছিলাম নিশ্চিই টাইপো - পরে বুঝলাম "ওহ"।
আপনার লেখায় "আট বিলিয়ন"টা পেলে আমার সেই পোস্ট-টার কথা মনে পড়ে যায় - শিল্প-শিল্পী আর গোবেচারা ফুল - হাহা।
আর ক্যান্ডি ক্রাশ-কে আপনি একদম স্মরণীয় করে দিয়েছেন। নিজে না খেলা সত্ত্বেও, 'ওয়ার্ড এসোসিয়েশন গেম' জাতীয় কিছুতে 'মোবাইল গেমিং' শুনে আমি 'ক্যান্ডি ক্রাশ' বলে ফেললে সে দায় আপনার!!
ধন্যবাদ, রাজর্ষি। ক্যান্ডি ক্রাশ যুগ যুগ জিয়ো।
Deleteঅসাধারণ লিখেছেন। শেষ করতে বেশ কয়েকদিন লাগল, তবে সেটা আপনার লেখার দোষে নয়, সম্পূর্ণ আমার পড়ার দোষে। শেষ করার পরেও বহুক্ষণ রেশ থেকে যায়।
ReplyDeleteআপনাকে বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হয় আমার, সুগত। কাজেই বিশ্বাস করলাম। খুব খুব খুব খুশিও হলাম। এই খুশিরও রেশ থাকবে আমার।
Delete