বিয়েবাড়ি
সোজা বাড়ি ফিরলেই হয়, কিন্তু হওয়ানোর দরকার নেই। চল, ওই মোড়টা পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে যাই, মোড় থেকে কিছু একটা ধরব। না পেলে উবার ডাকব। মোড়ে একজন দিদি চায়ের দোকান খুলে বসে আছেন। কাজেই আমাদের কর্তব্য চা খাওয়া। দোকানের সামনে পেয়ারা আধখানা খেয়ে ফেলে রেখে গেছে কেউ। পেয়ারা ঘিরে মাছিদের পার্টি। মাছিভনভন আধগলা পেয়ারা থেকে চোখ যথাসম্ভব ফিরিয়ে চায়ের অপেক্ষা করলাম। চা এল। একটা অটোও। যাবেন দাদা? দাদা হাসলেন। না দিদি। আমরা চা খেতে লাগলাম। দাদাও চা খেতে লাগলেন। এক ভদ্রলোক, সাইকেলের হ্যান্ডেলে বাজারের ব্যাগ ঝুলিয়ে এসে জানালেন তিনিও চা খাবেন।
অটো আর সাইকেল একে অপরের চেনা। অটো জানতে চাইলেন, সাইকেল বিকেলে কী করছেন। সাইকেলের ভয়েস ব্যারিটোন। মিটিং আছে।
অটোর চোখ কপালে। আবার? বাংলাদেশীরাও এত মিটিং করছে না তোরা যত মিটিং করছিস। বাপ রে বাপ রে বাপ।
সাইকেল হাসলেন। আমিও হাসলাম। অটোও হাসলেন। একা অর্চিষ্মান অভদ্রের মতো গম্ভীর হয়ে রইল। কী গো হাসো? না হলে এঁরা কী মনে করবেন, বলে কনুইয়ের খোঁচা মারতে গিয়ে দেখি অর্চিষ্মান ভাঁড় ঠোঁটে ছুঁইয়ে ভুরু কুঁচকে কী একটা দেখছে।
ওর ভুরু ফলো করে আমিও দেখলাম। আপনাদেরও দেখানোর চেষ্টা করি। দেখুন দেখতে পান কি না।
দুপুর দুটো। প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোড। নো গাছ, নো ছায়া। ওনলি মানুষ, ওনলি গাড়ি। ধোঁয়া, হর্ন, ধুলো। তার মধ্যে এক সোমত্ত যুবক, মেরে ফেললেও বয়স পঁয়ত্রিশের ওপর না, চারপাশের নারকীয় হুলহুলার মধ্যে দিয়ে সাইকেল চালিয়ে (ম্যানুয়াল সাইকেল মানে যেগুলোতে আরোহীদের প্যাডেল করতে হয়। ডিস্টিংশনটা করলাম কেন পরের পর্বে বুঝা যাইবে) চলেছেন। অর্থাৎ ভদ্রলোকের রীতিমত সিরিয়াস কার্ডিওভাসকুলার অ্যাকটিভিটি চলছে।
দুপুর দুটোয় ঝাঁ ঝাঁ রোদের মধ্যে এই রীতিমত সিরিয়াস কার্ডিওভাসকুলার অ্যাকটিভিটি করাকালীন ভদ্রলোক পরে আছেন সোয়েটার, জ্যাকেট, টুপি। গলায় মাফলার। মাফলার ঠিক না, একটা টিউবের মতো জিনিস। শ্যামলী কিনেছে। গলায় পরে থাকা যায়, দরকার মতো টেনে তুলে নাক ঢেকে ফেলা যায়। শ্যামলী একদিন ভোর পাঁচটায় নাক ঢেকে আমাদের পাড়ায় ঢুকেছে, চারটে কুকুর ভৌভৌ করে তেড়ে এসেছে। শ্যামলী তাড়াতাড়ি নাক থেকে টেনে নামাতেই আবার সব ঠাণ্ডা।
শুনুন, এটা আমার শহরে তোর শহরের থেকে বেশি ঠাণ্ডা পড়ে কাজেই আমি তোর থেকে বেশি কুল বা আমি তোর থেকে কম সোয়েটার পরি বলে আমি তোর থেকে বেশি আলফা - সে রকম না। সে রকম বোকামো আমার একমাত্র ফুচকায় ঝাল নিয়ে আছে। ঠাণ্ডা নিয়ে নেই। অন গড ফাদার মাদার।
তবু কনফিডেন্সের সঙ্গে বলতে পারি, গড় বাঙালিরযে পরিমাণ ঠাণ্ডা লাগে সে পরিমাণ ঠাণ্ডা কোনও মানুষের ফিজিক্যালি, বায়োলজিক্যালি, রিয়েলিস্টিক্যালি লাগা সম্ভব না। এটা পিওরলি সাইকোলজিক্যাল ঠাণ্ডা। বাবামা যে ছোটবেলায় জোর করে বাঁদুরে টুপি পরাতেন তার ট্রমা। পি টি এস ডি।
*****
সংগীতনৃত্য সহকারে বিয়েবাড়ি শুরু হল। নাচগান দেখতে দেখতে কফি খেলাম। প্রথম তিন কাপ টেবিলে গিয়েই খেয়েছিলাম। তারপর ট্রে নিয়ে ছেলেটা ঘুরে ঘুরে কেবল আমার দিকেই আসতে লাগল। ম্যাম, কফি?
না বলায় আমার চিরদিনের সমস্যা, আরও তিন কাপ খেতে হল। ততক্ষণে বুফে লেগে গেল, আমি চয়ন অর্চিষ্মান স্টার্টার নিয়ে বাইরে এলাম।
চমৎকার জলাশয়ের ধারে বিয়ের আয়োজন। বিয়ের আগেপরে পূর্ণিমা ছিল মনে হয়, জলে চাঁদ ভাসছিল। দূরে আইফেল টাওয়ারের মাথায় অন্য কোনও উদযাপনের ফুলঝুরি। বাকি সাত আশ্চর্যও নাকি ঘাপটি মেরে ছিল ইতিউতি। আমরা প্লেট হাতে জলের ধারে এসে দাঁড়ালাম। ওদের প্লেটে চিকেনমটন, আমার মাশরুম। বললাম, মাশরুমটা টেস্ট করে দেখো অ্যাটলিস্ট। হেবি হয়েছে।
চয়ন বেনেভোলেন্ট হেসে হাত তুলল। উই আর গুড, কুন্তলা। তারপর আমাকে আন্তরিক ধন্যবাদ দিল। ভেজিটারিয়ান হয়ে গিয়ে ওদের ভাগের চিকেনমটনের ভাগ বাড়ানোর জন্য।
একটা গোবদা ইঁদুর, প্রায় খাটাশের সাইজ, ঝোপ থেকে ঝোপে দৌড়োদৌড়ি করছিল। স্লো মোশনে। মনে হল ঠারেঠোরে বলতে চাইছে, আস্তে দৌড়চ্ছি, এইবেলা চাও তো কাবাবটিক্কা দিতেটিতে লজ্জা পেয়ো না। চয়ন বলল, যে সাইজ, হতে পারে এটাই এর ফুলস্পিড। স্লো মোশনটোশন না।
তক্ষুনি কে একটা কুন্তলা বলে ডাকল, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি শ্রাবণীমামি ঢুকছে। শ্রাবণীমামি আমার অন্যতম ফেভারিট মামি। দৌড়ে গেলাম। গল্পটল্প করে আবার একবার বুফেতে ঢুঁ মারলাম। ট্রে ফাঁকা, কোণে একটা শুঁটকো মতো মাশরুম পড়ে আছে। ছেলেটি আশ্বাস দিল। আরও আসছে ম্যাম, একটু দাঁড়িয়ে যান।
দাঁড়িয়ে তো থাকা যায় না, লাস্ট মাশরুমটাও সহবতের মাথা খেয়ে নিয়ে নেওয়া যায় না। ফাঁকা প্লেট নিয়েই ফিরে এলাম। চয়ন আর অর্চিষ্মান তখনও খাচ্ছে। দুজনের প্লেটেই ডাঁই মাশরুম। চয়ন বলল, ঠিকই বলেছ, মাশরুমটা ঘ্যামা করেছে। এ কী তোমার প্লেট খালি কেন, যাও মাশরুম নিয়ে এসো। কখন শেষ হয়ে যায়।
*****
তিনদিন ধরে মজা হল, আড্ডা হল, মণ্ডা মিঠাই খাওয়া হল। আমি সে সবের সঙ্গে এক্সট্রা খেলাম আছাড়।
আছাড় আমার একটা রেগুলার ফুড গ্রুপ। আমি নিয়মিত ইন্টারভ্যালে আছাড় খেয়ে থাকি। ফিল্ডে যাওয়ার সময় অর্চিষ্মান বলে যায়, কুন্তলা ভালো হয়ে থেকো আর দয়া করে পড়ে যেয়ো না।
গত ছ’মাসে অন্ততঃ ছ’বার পড়েছি। নোটেবল পড়াগুলোর মধ্যে একটা ছিল দু’নম্বরে চেনা ফুচকাস্ট্যান্ডের সামনে। জনাদশেকের অবাঙালি পরিবার সাপ্তাহিক "বংগালি পুচকা” এক্সকারশনে এসেছিল, শালপাতার বাটি ফেলে ‘আন্টিজিকো উঠাও ইয়ার’ বলে দৌড়ে এল।
একদিন চার নম্বরের সামনে পড়ে গেলাম। সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ। তখনও লোকজন আড়মোড়া ভাঙছে। মর্নিংওয়াকে বেরোনো এক মহিলা ছাড়া আর কেউ তুলতে আসেননি।
একদিন ব্লু টোকাইতে পড়লাম। রিসেন্ট পাস্টে এই পতনটাই সবথেকে জিল্লতের। দু’দিন আগেই কফি শপে সবার এমব্যারাসিং অভিজ্ঞতা নিয়ে কথোপকথন হচ্ছিল।
একজন ছিটকিনি না দিয়ে বাথরুম করতে বসেছিলেন। একজনের মুখ থেকে অ্যালপেনলিবে বুলেটের মতো বেরিয়ে পাশের টেবিলের সাওয়ারডো টোস্টে চটকানো অ্যাভোকাডোয় গিয়ে গেঁথেছিল। একজন পটেটো ওয়েজ অর্ডার করতে গিয়ে ওয়েজি বলে ফেলেছিলেন।
পেট চেপে এপাশওপাশ করে হেসেছিলাম কারণ আমার এ সব কিছুই হয়নি। ঠিক পরদিন পাওয়ার কর্ডে পা জড়িয়ে পড়ে গেলাম।
পতন অনেক রকমের হয়। পতনভেদে প্রতিক্রিয়াও নানারকমের হয়। তিনতলা থেকে কাউকে পড়ে যেতে দেখলে পাগল ছাড়া কেউ হাসে না। আবার স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় লোক্যাল ট্রেনে এক মোটা মহিলা এক ঝুড়ি কমলালেবুর ওপর পড়ে গেছিলেন আর রোগা লেবুওয়ালা - যে ঝুড়ি রেখে দু'হাতে ছয় ছয় বারোটা লেবু নিয়ে কামরার ও প্রান্তে বিক্রি করতে গেছিল - গেল গেল বলে দৌড়ে আসছিল, সেই দেখে আমি আর সোমা দাস হাসির চোটে চলন্ত ট্রেন থেকে পড়ে যাচ্ছিলাম। ভদ্রমহিলা খচমচ করে ঝুড়ি থেকে উঠে আমাদের বাড়িতে এবং স্কুলে যে কোনওরকম শিক্ষাদীক্ষাই দেওয়া হয়নি সেই নিয়ে গরম গরম লেকচার দিয়েছিলেন।
পাওয়ার কর্ডে ট্রিপ করে স্লো মোশনে পড়ে গেলে, যে রকম পতনে কালশিটেও পড়ে না, খালি টেবিলচেয়ারের ফাঁকে ল্যামডা হয়ে শুয়ে থাকতে হয়, যে রকম পতনের একমাত্র কারণ বিশ্বমানের ক্যাবলামো - না হাসলেই অস্বাভাবিক।
ব্লু টোকাইতে সকলেই মোটের ওপর স্বাভাবিক কাজেই সকলেই হেসেছিল। হাসতে হাসতেই তুলতে এসেছিল। ইন ফ্যাক্ট, এখনও হাসছে। চোখ মটকাচ্ছে আর বলছে, কুন্তলা ইজ ডেফিনিটলি উইনিং।
উইনিং অ্যাট এমব্যারাসিং মাইসেলফ। আমার জীবনের ট্যাগলাইন।
*****
বিয়েবাড়িতেও খেলাম আছাড়। উৎসববাড়িতে দুপুরবেলা একটা ঝিমুনির হাইফেন তৈরি হয়। তখন সবাই কাছাকাছি উদারহৃদয় লোকজনের বাড়ি গিয়ে বিউটি স্লিপ দেয়। আমরাও গেলাম মামামিমির বাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে আমি পড়ে গেলাম।
চারদিকে শ্বশুরবাড়ির গণ্যমান্য আত্মীয়স্বজন, আমি গড়াগড়ি খাচ্ছি। একটাই সুবিধে, বাবা, মা, মাসি, মাম মিমি তো হেসে খুন হবেন না। হনওনি। তাঁরা যথোচিত আহাউহু করলেন। ষাট ষাট। লাগেনি তো? চল চল ওপরে, বরফ দেবে।
একটুও লাগেনি, একটি চুলও এদিক থেকে ওদিক হয়নি, শুধু চটি থেকে স্ট্র্যাপ খুলে এসেছে। ওই একপাটি চটি নিয়েই দিল্লি থেকে এসেছি। ওটা রিপ্লেস না করা গেলে সন্ধেবেলা আসাম সিল্কের সঙ্গে কনভার্স পরে ঘুরতে হবে। বিকল্প - মিমির বাড়তি হাওয়াই চটি।
টেনশন হচ্ছিল। কিন্তু চুয়াল্লিশে পৌঁছে একটা জিনিস ক্লিয়ার - ভালনারেবিলিটি জিনিসটা সব জায়গায় প্রকাশ করার নয়। আজ পর্যন্ত তিনটে ফুললি নিরাপদ জায়গা পেয়েছি। দু’টো জন্মসূত্রে, একটা বিবাহসূত্রে। যাঁদের জব ডেসক্রিপশনে আমার রোগশোকভয়তাপ হ্যান্ডল করার শর্ত লেখা আছে। লেখা থাকলেই যে সে শর্ত পূরণ করতে হবে এমন কোনও কথা নেই। কপাল ভালো, তিনজনেই করেছেন।
পনেরো মিনিট বাদে পরের গাড়িতে অর্চিষ্মান এল। বেল বাজিয়ে ঘরে ঢুকল। আমি ভেতরের ঘরে মিমির ব্র্যান্ড নিউ কাফতান পরে চিৎপাত হয়ে ক্যান্ডি ক্রাশ খেলতে খেলছিলাম। শুনতে পেলাম সবাই ওকে খবর দিচ্ছে, কুন্তলার চটি ছিঁড়ে গেছে, কুন্তলা পড়ে গেছে। অর্চিষ্মান বলছে, আবার?
মিমিদের হাউসিং-এর মধ্যেই নাকি জুতোর দোকান। চয়ন বলল, উত্তেজিত হয়ো না, মোস্ট প্রব্যাবলি বাটাফাটার থেকে বেটার কিছু পাবে না।
এ যেন আমাকে বলা, বিস্কুট খেতে ইচ্ছে করছে? ভেরি সরি, বাড়িতে ব্রিটানিয়াফিটানিয়া ছাড়া কিছু নেই।
বা ফুচকা খেতে গিয়ে ফুচকাওয়ালার কাছে শোনা, দিদি দইও নেই মিষ্টি চাটনিও শেষ, আপনাকে স্রেফ টকজলফকজল দিয়েই চালিয়ে নিতে হবে।
মিমির বাড়তি হাওয়াই চটি পরে বাটায় গেলাম। গিয়ে চিত্ত চমৎকার। লাস্টবার বাটায় গেছিলাম সি পি-তে। কোটি কোটি জুতো। একটাও আমার এক্স্যাক্ট মনের মতো না। নিউটাউনের বাটায় স্টক কম, দাম কম, সবক'টা মনের মতো।
সংস্কৃতিচর্চা কম পড়ে যাচ্ছে বলে অর্চিষ্মানকে "পশ্চিমবঙ্গে চল পশ্চিমবঙ্গে চল" কবে থেকে ঠেলছি, কান দিচ্ছে না। এবার থেকে সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে সস্তায় পছন্দসই চটিজুতোর অ্যাভেলিবিলিটির যুক্তিও দিতে হবে। যদি কাজ দেয়।
*****
অর্চিষ্মান আর আমার দেড়খানা মিলের একটা - আমাদের সাজতে অস্বাভাবিক কম সময় লাগে। অর্চিষ্মান একটা নেমন্তন্নে নীল, পরের নেমন্তন্নে সবুজ, পরের নেমন্তন্নে আবার নীল, তার পরের নেমন্তন্নে আবার সবুজ পাঞ্জাবি পরে। উইথ মাই ঝাণ্ডাওড়ানো সাপোর্ট।
আমি অর্চিষ্মানের থেকে বেশি ভ্যারাইটির জামাকাপড় পরি, কিন্তু দ্রুততায় পরি এবং জামাকাপড়ের বাড়তি আর কিছুই পরি না। অন্ততঃ না পরাই প্রেফার করি। একসময় উপরোধে ঢেঁকি গিলতে হত, কিন্তু একটা পয়েন্টের পর সকলেরই এনার্জিতে টান পড়ে। 'যা পারিস কর, খেন্তিপেঁচি হয়ে ঘোর আমাদের কী' বলে উপরোধকারীরাও ক্ষান্ত দিয়েছেন, আমিও হাঁফ ছেড়েছি।
সাজ অ্যাভয়েড করার পেছনে একাধিক কারণ। কোনওটাই বুক ফুলিয়ে বলার মতো নয়। লজ্জা পাওয়ারও নয়। নিউট্রাল কারণ। একটা কারণ আমার বাবা।
জীবনে আমি বাবার কোনও কথাই শুনিনি। রেবেল বলে নয়। বাবা শোনাননি বলে। উপদেশ জিনিসটা বাবা নেনও না, দেনও না। বাবার নিজের জীবন চালানোর ক্লিয়ারকাট নীতি আছে। নীতি, মতামত, বিশ্বাস। তাদের অনেকগুলো কনভেনশনাল দৃষ্টিতে নীতিসুলভ না ঠেকলেও বাবা তাদের প্রতি অবিচল। সে সব নীতি, বিশ্বাস, মত জোর করে চাপান না বলেই হয়তো একটা পয়েন্টের পর কৌতূহল জাগে। কেমন হবে, যদি নিজেই অ্যাপ্লাই করি? বাবার নীতিগুলোর প্লাস পয়েন্ট, একশোর মধ্যে পঁচানব্বইটা কেসে এই এটা খাটবে, পাঁচটা স্পেশাল কেসে ওটা, এ রকম না। একশোর মধ্যে দেড়শোটা কেসেই বাবার স্ট্যান্ড সেম। অ্যাবসলিউট। ধ্রুব।
যেমন, দানে দানে পে লিখ্খা হ্যায় খানেওয়ালে কা নাম। যেটা তোর সেটা কেউ নিতে পারবে না সোনা, যেটা তোর নয় সেটা যত হাঁকপাঁকই করিস না কেন তোর হবে না।
কাজেই, নো হাঁকপাঁক। নো প্রাণপণ।
বাবার আর একটা নীতি হচ্ছে, হারাতে না চাইলে কেউ হারায় না। অ্যাকচুয়ালি, হারাতে চাইলেও হারায় না। হারানো অত্যন্ত কঠিন। কারণ সব রাস্তাই কোনও না কোনও রাস্তায় গিয়ে ওঠে। বাবা জীবনের অধিকাংশ রাস্তায় কাটিয়েছেন। এখনও কাটান। প্রয়োজনে নয়, স্বেচ্ছায়। এবং বাবা কখনও হারাননি। 'যোগমায়া হালদার' নামে একটা গল্প লিখেছিলাম, সেখানে নামভূমিকার মহিলার এই গুণ ছিল। যোগমায়া হালদারকে লেখার সময় বাবার লেজেন্ডারি রাস্তা চেনার কথা মাথায় ছিল।
কাজেই, যখনই মনে হচ্ছে হারিয়ে গেছি আমি, হারাইনি। রাস্তা আছে। রাস্তা বেরোবে। এগেইন, নো হাঁকপাঁক।
বাবা আর যে স্ট্যান্ডে আজীবন অটল থেকেছেন সেটা হচ্ছে বিয়েবাড়ি, অন্নপ্রাশন, শ্রাদ্ধ, ব্যাংকোয়েট, খুঁটিপুজো, গল্পপাঠ - মোটামুটি যেখানে যেখানে লোকে সেজেগুজে হল্লা করতে যায় - সে হল্লার মধ্যে এভরিটাইম, উইদাউট ফেল, তাকেই সবথেকে সুন্দর দেখায় যে সবথেকে কম সেজেছে। বা সাজেইনি।
সুন্দর হওয়ার লোভ আমার সাঙ্ঘাতিক। কাজেই আমি সাজ মিনিমাল রাখার চেষ্টা করেছি আজীবন। জীবনের সব ক্ষেত্রে।
*****
শাড়ি পেঁচিয়ে নতুন চটি গলিয়ে (নতুন, কাজেই ঘরে পরে ঘোরা যাচ্ছিল) টিপটা কপালের মাঝখানে বসেছে কি না আয়নায় দেখে নিয়ে ফ্ল্যাটভর্তি ভিড়ে অর্চিষ্মানকে খুঁজে বার করে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন দেখাচ্ছে?
অর্চিষ্মান বলল, একঘর।
অর্চিষ্মানেরও নীল পাঞ্জাবি পরা হয়ে গিয়েছিল। জিজ্ঞাসা করল, আর আমাকে?
আমি বললাম, এনিগম্যাটিক।
দুজনে খুশি হয়ে বিয়েবাড়ি চলে গেলাম। সেই চমৎকার জলাশয়। আলোয় ছাওয়া সেতু। সেতুতে ঝুগলুমামা, কাকলিমাসি, পিয়ালীমাসির সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। ছবি তোলাও শুরু হয়ে গেল। যথারীতি প্রচুর কফি খেলাম। আর ফুচকা। ফুচকাটা এত ভালো ছিল। অর্চিষ্মানের সঙ্গে কফি খেলাম, তিন্নির সঙ্গে ফুচকা খেলাম, চয়নের সঙ্গে কফি খেলাম। শ্বশুরবাড়ির চেনা, অল্পচেনা আত্মীয়দের সঙ্গে স্মলটক করলাম। সবাইকে বললাম, ফুচকাটা মিস করবেন/কোরো/করিস না। কাউকে কাউকে ফুচকার লোকেশন দেখাতে গিয়ে নিজেও আর একবার বাটি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। এর মধ্যে চাঁদভাসা জলে ভেসে ভেসে বর এল। বিয়ে শুরু হল। আমি আর তিন্নি ভালো ভিউওয়ালা সিট দেখে বসলাম। চাঁদও চমৎকার সিট পেয়েছিল। চাঁদের মতো ভালো সিট পাইনি, পরের ভালো সিটটাই আমরা নিয়েছিলাম।
মালাবদলের পালা এল। পিঁড়ি তোলার জন্য অর্চিষ্মান যত অকাজের, ছাদনা উঁচু করে ধরার জন্য ততখানিই কাজের। জিষ্ণু জিষ্ণু ডাক উঠল। অর্চিষ্মান দৌড়ে গেল। আমি আর তিন্নি, কোনও কাজে না লেগে স্মিতমুখে বাচ্চাদের হট্টগোল দেখতে থাকলাম। একবার চোখ সরে বিয়ের মঞ্চের উল্টোদিকে গেল। দুই ছায়ামূর্তি মৃদু আলোয় ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে। মা আর মিমি। বেশ রাত হয়েছে। খোলা মাঠে মাথায় হিম পড়ছে। আমরা অফ কোর্স, কুল দেখানোর জন্য শাড়ির ওপর কিছুই পরিনি। মা মিমি শাল দিয়ে মাথা মুড়িয়ে বসেছেন। মুখ ঘিরে শালের ঘের এক ইঞ্চি বেরিয়ে আছে।
তিন্নিকে ঠেলা দিলাম। ওই দেখ আমাদের ভবিষ্যৎ।
*****
প্রচুর ছবি তোলা হয়েছে বিয়েবাড়িতে। প্রফেশনালরা তুলেছেন। বাকি সবাইও তুলেছে। আমরাও তুলেছি। আমার তিন্নির চয়নের অর্চিষ্মানের.। বসে। দাঁড়িয়ে। সেলফি। রেগুলার ছবি। একটা বাচ্চা ছেলে গম্ভীর মুখে ঘুরছিল। তিলকমামার ভাইপো জানি, দিল্লিতে থাকে তাও জানি। প্রতি পুজো পয়লা বৈশাখ পৌষমেলায় মেলাগ্রাউন্ডে ওর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। কিন্তু নামটা কখনওই জানা হয় না। এই একটা ছবি তুলে দাও না গো, বলার ছুতোয় জেনে নিলাম। অপরাজিত। নিশ্চয় নিশ্চয়, বলে হাসিমুখে ছবি তুলে দিল। আজকালকার ছেলেমেয়েরা এত ভদ্র আর মিষ্টি।
আর একটা ছবি, তিন্নির তোলা। চয়ন আর অর্চিষ্মানের মাঝখানে আমি বসে ছিলাম। তিন্নি ক্যামেরা তাক করে, এদিকে তাকা, বলেছিল। ক্লিক করারও আগে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম। ছবিটার ক্যাপশন কী দেওয়া যাবে। ছোটবেলার ইস্কুলের দিদিমণির সঙ্গে হঠাৎ দেখা। তখন সবাই আমাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য হেসেছিল, কিন্তু ছবিটা এক্স্যাক্টলি সে রকমই উঠেছে।
এগুলো তো জ্ঞাতে ছবি। অনুষ্ঠানবাড়িতে অজ্ঞাতে আরও কত ছবি ওঠে। কে কখন তুলেছে টের পাওয়া যায় না। আবার অনেক ছবিতে সোজা ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসছি অথচ মুহূর্তট স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ বেরিয়ে গেছে। দিল্লি ফেরার ক'সপ্তাহ পরে তিলকমামা সে রকম একটা ছবি হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছিল।
অর্চিষ্মান আর আমি। নীল পাঞ্জাবী, সিলভার গ্রে শাড়ি। অর্চিষ্মানের হাতে কফি। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসছি।
অর্চিষ্মানকে ফরওয়ার্ড করলাম। সেকেন্ডের মধ্যে লাল হৃদয় ইমোজি এল, পিছু পিছু গোটা একটা ধ্বনিসূচক অব্যয়। বাহ্। তারপর একটা গোটা বাক্যই লিখে ফেলল অর্চিষ্মান।
আমাদের মধ্যে ওই লুকটা এসে গেছে, বল?
করে নাকো ফোঁস ফাঁস, মারে নাকো ঢুঁশঢাঁশ, নেই কোন উৎপাত, খায় শুধু দুধভাত লুক?
উঁহু। বাবার লুকটা।
অর্চিষ্মান আজীবন বলে এসেছে, বাবার (নাকতলার) যখন বছর চল্লিশ বয়স ছিল, তখন বাবাকে যে কী সুন্দর দেখতে লাগত।
নাকতলার বাবা টেক্সটবুক সুপুরুষ। তাঁকে পঁচিশ, চল্লিশ, পঁয়ষট্টি - সব বয়সেই সুন্দর লাগে। কিন্তু অর্চিষ্মান সর্বদা একটা পার্টিকুলার বয়স পিনপয়েন্ট করে কেন কৌতূহল ছিল। কেটে গেছে।
আমাদের দেড়খানা মিলের সবথেকে বড় মিল হচ্ছে চেহারা নিয়ে আন্ডারকনফিডেন্স। অর্চিষ্মানের নাকি সর্বদা মনে হয়েছে, নাকচোখমুখের দিক থেকে তো বাবার সমকক্ষ কখনওই হওয়া যাবে না, সময়ের একটা পার্টিকুলার বিন্দুতে পা রাখার সুবাদে যদি বাবার সৌন্দর্যের কিছুটা ভাগ পাওয়া যায়।
সময় যে সৌন্দর্যের একটা বড় কমপোনেন্ট সবাই জানে। যৌবনে কুক্কুরীও ধন্যা।
আমার মতে, নট নেসেসারিলি। হ্যাঁ, সৌন্দর্যের যে অংশটুকু নাকচোখ মাপজোক সেটুকুর সঙ্গে সময়ের সম্পর্ক থাকতে পারে, কিন্তু সৌন্দর্যের সবটুকু নাকচোখমাপজোক নয়। অনির্বাণ ভট্টাচার্যের মতে, মানুষের কাজ মানুষকে সুন্দর করে। একটা পডকাস্টে বলছিলেন। একমত। কাজের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মন, দৃষ্টি, বুদ্ধিও মানুষকে সুন্দর করে।
সৌন্দর্যের আরও একটা কমপোনেন্ট হচ্ছে আয়না। খুবই বি পজিটিভ ম্যানিফেস্ট মেডিটেট গোছের শুনতে লাগবে, কিন্তু আয়নায় আমরা যা দেখি, সেটা যে আমাদের চেহারার ওপর কী পরিমাণ ছাপ ফেলে কল্পনার অতীত। অর্চিষ্মানের ওর এই যে নিজের চেহারা ভালো লাগছে, তার একটা কারণ হতে পারে নিজেকে ভালো লাগছে ওর। এই বয়সের আমিটাকে (অর্চিষ্মানকে) ভালো লাগছে।
সেদিন নিজে থেকেই কথাটা তুলল। ও নাকি ভেবেছে, মাঝে মাঝেই ভাবে। এখন যদি আমরা মরে যাই, কেমন হবে? মনে হবে কি বড় তাড়াতাড়ি চলে গেলাম? জীবনের থেকে কিছুই পাওয়া হল না বলে আফসোস থেকে যাবে?
অর্চিষ্মানের মতে, থাকবে না। অন্ততঃ থাকা উচিত না। সবই তো হল কুন্তলা। প্রেম, ভালোবাসা, যৌনতা। সংসার, সঙ্গ, স্থায়িত্ব। চাকরি। ঘোরাফেরা। লোকের অল্পস্বল্প পিঠচাপড়ানি। ভ্যালিডেশন। একটামাত্র জীবন আর কী দেবে? আর কত দেবে?
ওকে বলিনি, কিন্তু কথাটা আমারও মনে এসেছে। আমি অর্চিষ্মানের তুলনায় অকৃতজ্ঞ, কাজেই স্লাইটলি অন্যভাবে মনে এসেছে, কিন্তু কয়েনের এপিঠ ওপিঠ। এই যে শোক, দুঃখ, হৃদয়ভঙ্গ - এগুলো ফিল করতে পারলাম তাও কি পাওয়া নয়? এগুলোর মধ্যে দিয়ে যাওয়ার সময় প্রাণ বেরোচ্ছিল বটে, কিন্তু একটু দূরে চলে আসার পর বেশ প্রাপ্তির মতোই তো দেখতে লাগছে। আর একটা কনফিডেন্সও জাগছে, যদি এক্ষুনি মরে না যাই সামনের দুঃখগুলোও সামলে নেব। সেগুলোও জীবনের অভিজ্ঞতায় অ্যাডই করবে, কেড়ে নেবে না।
অর্চিষ্মানের সঙ্গে ওই কথোপকথনটার পর থেকে ছবিটা আমারও পছন্দ হচ্ছে বেশ। ছবিটাতে আমাদের তেমন দুটো লোকের মতো দেখাচ্ছে যারা এক্ষুনি মরে গেলে সত্যিই আফসোসের কিছু থাকবে না। অন্ততঃ থাকা উচিত না।
(চলবে)
"গড় বাঙালিরযে পরিমাণ ঠাণ্ডা লাগে সে পরিমাণ ঠাণ্ডা কোনও মানুষের ফিজিক্যালি, বায়োলজিক্যালি, রিয়েলিস্টিক্যালি লাগা সম্ভব না। এটা পিওরলি সাইকোলজিক্যাল ঠাণ্ডা। বাবামা যে ছোটবেলায় জোর করে বাঁদুরে টুপি পরাতেন তার ট্রমা। পি টি এস ডি।"
ReplyDeleteufffff :P :P :P
হান্ড্রেড পারসেন্ট সত্যি কথা।
Deleteঅনেকদিন হয়ে গেল কোনো বিয়েবাড়ি খাইনি - দেড়-দু বছর তো বটেই। লোকজন বিয়ে করছে না নাকি? ভেরি ব্যাড! বিয়েবাড়ির পাঞ্জাবিটা আজকাল অন্নপ্রাশনে পড়ছি।
ReplyDeleteপ্রথম প্যারাগ্রাফটা পড়ে, পুরো হতভম্ব হয়ে গিয়ে, আবার ভালো করে ওই জায়গাটা পড়লাম, যেখানে সাইকেল আরোহীর বিবরণ। মে-জুন মাসে ওই পোশাক? বাঙালির শীতকাতুরে বলে একটু বদনাম আছে মানছি, কিন্তু তা বলে এই!!! অসম্ভব! বেচারার নিশ্চয় জ্বর বা কিছু হয়েছিল! এইসব ভাবতে ভাবতে, তারপর খেয়াল হলো, যে এই ঘটনাটা এখনের নয়, নিশ্চয় বেশ কিছু মাস আগের। যাক!
বয়েস আর "লুক" নিয়ে এই কোটেশনটা মনে এলো: "At 50, everyone has the face he deserves."
শেষ লাইনটা দারুন।
ওই যে দুপুর দুটো, প্রিন্স আনোয়ার শাহটাহ্ লিখলাম, ওখানে ডিসেম্বর মাসের তেরো তারিখও লেখা উচিত ছিল হয়তো, আপনি ঠিকই বলেছেন, রাজর্ষি। দু'বার ভেবেওছিলাম লিখব। কিন্তু তারপর মনের মধ্যে একটা তেরিয়া ভাব জেগে উঠল। মনে হল, বাঙালিদের ঠাণ্ডা লাগা নিয়ে যে খোঁচাটা আমি দিতে চাইছি, ডিসেম্বর লিখলে তার ঝাঁজ কমে যাবে। কারণ কলকাতা শহরে ডিসেম্বর মাসের দুপুর দুটোতেও অত ঠাণ্ডা লাগা সম্ভব না। তাই বাদ দিলাম।
Deleteআপনি জ্বরজ্বারির যে অ্যাংগলটা দিলেন, সেটা নিয়েও ভাবলাম এবং রিজেক্ট করলাম। জ্বর হলে ওই স্পিডে ওই ভিড় রাস্তায় কেউ সাইকেল চালায় না।
আপনার কোটটা নিলাম। অসামান্য কোট। কৌতূহলেও থাকলাম। পঞ্চাশ বছরের নিজের মুখটার জন্য।
মাসের উল্লেখ বাদ দিয়ে ভালোই হয়েছে - ওই এক্সট্রা অবিশ্বাস্য লাগাটা, তারপর বোঝাটা, ওটা তো বেশ উপভোগ করলাম। জ্বরের ভাবনাটা ছিল মরিয়া হয়ে দৃশ্যটাকে সম্ভাব্য গন্ডির মধ্যে আনার একটা বিফল প্রচেষ্টা।
Deleteবেশ হাসি ঠাট্টা দিয়ে শুরু হয়ে শেষটা কেমন যেন সিরিয়াস হয়ে পড়ল। তবে ওই দানে দানে পে ইত্যাদি কথাটা আমিও সাংঘাতিক মেনে চলি। আমার দাদু ওটা বলত।
ReplyDelete