যারা যারা দায়ী
উঁচু করা মুখেদের ভিড়ঠাসা অডিটোরিয়াম। মঞ্চে সুমন দে, সঙ্গে আমি, ঘণ্টাখানেকের আলাপচারিতায়। সুমনের ঠোঁট নড়ছে, আপনার এই ইলাস্ট্রিয়াস সাহিত্যিক জীবনের জার্নি . . . নুয়ে পড়ছি, না না কী যে বলেন, কিছুই তো আসলে একা করে হয়ে ওঠে না, কত মানুষ হাত বাড়িয়ে দেয়, আমার এই জার্নির মোড়ে মোড়ে কত লোক দীপ জ্বেলে গেছেন তাদের মধ্যে যার কথা না বললেই নয় তেমন একজন হচ্ছে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম আর সোমেন বসু।
ঘুম ভেঙে গেল। বাঁ হাতের মুঠো খুলে ফোন, জয়পুর থেকে আনা হাতিছাপ বেডকাভারে ছেতরে আছে। তুলে চোখের এক মিলিমিটার দূরে এনে চেক করলাম। নাহ্, এখনও বেরোয়নি।
একটা গল্প চার নম্বরে পাঠিয়েছিলাম বেশ কয়েকমাস। তারও অনেক মাস আগে থেকে গল্পটা লিখতে শুরু করেছি। যে কাজটা সবাই দু'ঘণ্টায় করে সেটা দু'বছর লাগানোর অসামান্য অভ্যেসে মাত্র কয়েক হাজার শব্দের এই গল্পটা আমি টেনে গেছি টেনে গেছি টেনে গেছি।
মানুষের স্বভাবই হচ্ছে - অর্চিষ্মান বলছে, আবার মানুষকে টানাটানি কেন কুন্তলা - ঠিকাছে আমারই স্বভাব হচ্ছে, নিজে যত গড়িমসিই করি না কেন, কথা দিয়ে যত কথা ভাঙিই না কেন, বাকি সবাইকে সুপারসনিক স্পিডে কাজ করতে হবে। যবে গল্প ছাপানোর কথা ছিল তখনই ছাপাতে হবে।
যে মাসে গল্প বেরোবে ভেবে একা একা খুশি হচ্ছিলাম, সোমেন বললেন, উঁহু, গল্প বেরোবে তার পরের মাসে। ওকে, বলে হাতের ওপর বসে হাঁটু নাচাতে থাকলাম। পরের মাস এল, গেল, গল্প বেরোল না। ব্লু টোকাইয়ের নীল কাপপ্লেটের নিচ থেকে টিস্যু টেনে বার করে চোখে চাপলাম। সো মাচ পলিউশন, ইভন্ ইনসাইড।
অবশেষে, চার নম্বরের নবতম সংখ্যা প্রকাশিত হল। এটাতে নিশ্চয় বেরোবে ভেবে আঙুল টিকটিকি করে ঘুরছিলাম। বেরোল। গল্পের লিস্ট। লিস্টে আমার নাম। গল্প নেই। সোমেন এক এক করে লেখা আপলোড করছেন, ঠিক আমার আগের নাম পর্যন্ত এসে আপলোড থেমে গেছে।
চব্বিশ ঘণ্টা যে কীভাবে কেটেছে, আমিই জানি। স্বপ্ন ভেঙে ফোন চেক করে যখন দেখলাম গল্প বেরোয়নি অর্চিষ্মানকে ধাক্কিয়ে বললাম, কী গো, আমার যে এত দুঃখ, সে বিষয়ে তুমি কী ব্যবস্থা নেবে ঠিক করলে?
অর্চিষ্মান বলল, কুন্তলা, আজ এক্সট্রা তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে। চা করবে নাকি? না করলেও অসুবিধে নেই। আচ্ছা থাক, করতে হবে না।
বাড়ি থেকে বেরিয়ে অর্চিষ্মান বাঁদিকে বেঁকল, আমি ডানদিকে বেঁকতে বেঁকতেও পিছু ডাকলাম। তাড়াতাড়ি বাড়ি এসো।
অর্চিষ্মান বলল, যাহ্, ভুলেই গেছি। আজ অন্যদিনের থেকেও দেরি হবে।
মিটিং আছে বুঝি?
অর্চিষ্মানের দাঁতের সারি দেখা গেল। নাহ্, ফয়েজের সঙ্গে দেখা করব অফিসের পর।
ফয়েজ অর্চিষ্মানের আগের অফিসের বেস্ট ফ্রেন্ড। ইউটিউবে 'দেখি জমানে কি ইয়ারি/ বিছড়ে সব বারি বারি' লুপে চালিয়ে সাড়ে সতেরো মিনিট হেঁটে কফি শপে চলে এলাম। এসেই চার নম্বরের ট্যাব রিফ্রেশ করলাম।
নোপ। নাথিং।
অর্চিষ্মানকে লিখলাম, তুমি কি ফয়েজের সঙ্গে ফোর কোর্স ডিনার করে ফিরবে? তাহলে আমিও আমার ব্যবস্থা বুঝে নেব। মেসেজের শেষে রাগত লাল মুখ সেঁটে সেন্ড করলাম।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে সোমেনের মেসেজ এল। গল্পের লিংক। ধন্যবাদসূচক তিনটি নমস্কার।
দুটো অপশন ছিল। এক, ওঁর নমস্কারের উত্তরে নমস্কার পাঠিয়ে খেল খতম করা। ইউটিউবে "আনলক ইয়োর ফেমিনিন এনার্জি" ট্যাগের আন্ডারে কন্টেন্ট ক্রিয়েটরদের উপদেশ মানলে সেটাই করা উচিত ছিল। আনন্দে লাফাবেন না, দুঃখে দোমড়াবেন না। মাথার চুল, পায়ের নখ এবং মধ্যবর্তী অঙ্গপ্রত্যন্ত থেকে 'হোয়াটেভার' এনার্জি বিচ্ছুরণ করতে করতে জীবনের মধ্যে দিয়ে হাঁটুন। মনে রাখুন, যা পাচ্ছেন সব আপনি ডিজার্ভ করেন।
দুই, ওই মুহূর্তের আমার এক্স্যাক্ট অনুভূতিকে সততার সঙ্গে উন্মোচিত করা।
সোমেনের মেসেজে লাল হৃদয় সাঁটলাম। নিজের প্রথম মেসেজে "ইয়েয়েয়েয়েয়েয়ে" লিখে দ্বিতীয় মেসেজে (ডাবল টেক্সটিং - ফেমিনিন এনার্জিকে চিরদিনের মতো ভোগে পাঠানোর ব্রহ্মাস্ত্র) হাফপ্যান্ট পরা ডিগবাজিরত মহিলার ইমোজি। পর পর পাঁচটা।
অর্চিষ্মানকে লিংক ফরওয়ার্ড করে বললাম, পোড়ো সময় করে। খারাপ লাগলে জানিয়ো। অর্চিষ্মান লিখল, ডেফিনিটলি জানাব, কুন্তলা। কিন্তু এখন বিষম কাজ, ভীষণ টেনশন। আমি বললাম, টেনশনের কিছু নেই, সব ভালো হবে। বলে ইমোজিতে চুমু খেলাম, যে রকম চুমুতে ঠোঁট থেকে লাল হৃদয় নিঃসৃত হয়।
*
এই থাকল গল্পের লিংক।
*
অফিসটাইমের পর অফিসের মিটিং-এর নোটিস এসেছে অর্চিষ্মানের। ফয়েজের সঙ্গে মিটিং ক্যান্সেল। 🙀🙀🙀🙀🙀
golpo ta likhte kotokhon legechhe jani na.... tobe etuku bolte pari every minute is well spent. Darun Laglo
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, অর্পণ।
DeleteKi osombhob bhalo laglo ! Ami mone prane chai apni prosiddho sahityika hisebe birat somman labh korun!
ReplyDeleteComment e typo hole thik kora jay na, ei matro janlam. Kintu ami jani apni bujhechen ami sahityik likhte cheyechhilam
ReplyDeleteহাহা, আপনার মন্তব্য পড়ে ডিগবাজি খাওয়ার প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে অন্য প্রসঙ্গটা হ্যান্ডল করে নিই। আ-কারের বাহুল্য নিয়ে চিন্তা করবেন না, আমি জানি ওটা আঙুল থেকে বেরিয়ে গেছে। আমারও হয় হরদম এ রকম। তাছাড়া অভ্যেস, কানে লাগা ইত্যাদির ব্যাপারও আছে। মাথার ভেতর ক্লিয়ার থাকাই বেশি জরুরি। বাকিটুকু সময়ে হবে।
Deleteতাছাড়া আপনি এমন ভালো ভালো কথা বললেন আমার গল্প নিয়ে, চাইলেও আমি আপনার ওপর রাগ করতে পারব না। মাগো কী জঘন্য হয়েছে, এরা আবার সাহিত্যিকা হওয়ার স্বপ্ন দেখে কী করে - লিখলে না হয় বল্লম নিয়ে লাফিয়ে পড়া যেত।
গল্পটা আপনার ভালো লেগেছে জেনে কত খুশি হয়েছি আর বানান করছি না। থ্যাংক ইউ।
আপনি অনেক অনেক লিখবেন, কেমন? আপনি খুব ব্যস্ত হয়ত, তবুও লিখবেন। আপনার লেখাগুলো পড়তে এত অপূর্ব লাগে! আমার ধারণা এ ব্যাপারে অনেকেই একমত হবেন। আর হ্যাঁ, এবারে মেসেজ করার আগে মোবাইলের কিবোর্ড কে বাংলায় শিফট করে নিলাম। ভুলভাল লিখলে এত খারাপ লাগে নিজেরই। এবার আমি ফেমিনিন এনার্জি আনলক করার ভিডিও দেখব।
Deleteবাহ্, এটা মচৎকার হয়েছে।
Deleteপড়লাম গল্পটা। ভালো লাগলো। কিছু ডিটেইল দারুণ।
ReplyDeleteআরো গল্প আসুক।
আর গল্পের ঘোষণার এই লেখাটাও দারুণ।
🙏
Deleteগল্পের শুরুতে দরজার ছবিটা কার আঁকা?
ReplyDeleteজানি না, রাজর্ষি।
Deleteভীষণ ভাল হয়েছে লেখাটা। এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। এরকম আরও লিখতে থাকুন, আর আমরাও পড়ে ধন্য হই।
ReplyDeleteএকটা কৌতূহল হচ্ছে। হ্যান্ডবিলটা কি ওইরকম ছবির আকারে আপনি বানিয়ে দিয়েছিলেন, না ওটা ইলাস্ট্রেটরের কৃতিত্ব?
ধন্যবাদ, সুগত। হ্যান্ডবিল আমার নির্দেশে চ্যাট জিপিটি বানিয়েছে।
DeleteThis is your best till date !
ReplyDeleteধন্যবাদ, অন্বেষা। বেস্ট যদি নাও হয়, বেটারের মধ্যে পড়বে ডেফিনিটলি।
Delete