ফোটোজেনিক
আমি জানি না কেন ছবি
তোলাটাকে এখনও লোকে শিল্প হিসেবে সিরিয়াসলি নেয় না। বলে আরে ধুর, অর্ধেক কেরামতি
তো যন্ত্রের। আর বাকি অর্ধেক ফোটোশপ। ক’বছর আগে অ্যামেরিকায় স্কুলের ইয়ারবুকের
জন্য তোলা পুঁচকে ছাত্রছাত্রীর ছবি পছন্দমতো অদলবদল কড়া নিয়ে খুব জলঘোলা হয়েছিল। স্কুলের
ফোটোগ্রাফারের তোলা ছবি দেখার পর মাবাবারা বায়না করে বলেছিলেন, ইস আমার
ছেলে/মেয়েটাকে কী বদখৎ দেখতে লাগছে...প্লিজ ফোটোশপ করে ওর দাঁতের ব্রেসটা হাওয়া
করে দিন। কিংবা চুলের ছাঁটটা বদলে ফেলুন। অথবা জন্মদাগটা উড়িয়ে দিন। কোনও কোনও
নিন্দুকে বলেছিলেন, এ আবার কী? ভগবান যাকে যেমন দেখতে করে পাঠিয়েছেন সেরকমটা থাকতে
বাধা কোথায়? আর তার থেকেও বেশি বিপদের কথা হচ্ছে, ওই কিন্ডারগার্টেন বয়স থেকে যদি
নিজের মাবাবা হাতে ধরে শিশুদের ভেতর নিজের চেহারা সম্পর্কে কমপ্লেক্স ঢুকিয়ে দিতে
শুরু করেন, তাহলে বাচ্চার ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় সেটা খেয়াল আছে?
যথারীতি তর্কটা শেষপর্যন্ত
ঘুরেফিরে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার ঝগড়ায় পরিণত হয়েছিল। আমার বাচ্চা আমি ল্যাজে কাটব
না মুড়োয় কাটব তাতে আপনার কী? আপনার ইচ্ছে হয় আপনি নিজের বাচ্চাকে কদর্য আর
আনফ্যাশনেব্ল্ করে রাখুন গে, আমার বাচ্চার কমপ্লেক্স নিয়ে আপনাকে অত ভাবতে হবে
না।
আমি বুঝতে পারছি না গোটা
ব্যাপারটায় অসুবিধেটা কোথায়। ফোটো নিজের ইচ্ছেমতো অদলবদল করা তো আজকের কথা নয়। এই
গরিব তৃতীয়বিশ্বে তো ব্যাপারটা কবে থেকেই ঘটে আসছে। আজ থেকে কুড়ি বছর কিংবা তারও
বেশি সময় আগে যখন আমার পিসির বিয়ের সম্বন্ধের ছবি তোলা চলছিল স্টুডিওয় গিয়ে, তখনও
কোনও ছবিতেই পিসিকে অবিকল পিসির মতো দেখতে লাগত না। চুল ঘন হত, কপালে ছোটবেলার
পক্সের দাগ বেমালুম হাওয়া, চোখের কোলে আবছা কাজলের আভাস। শেষে ছবি তোলার সময় এলে
বাড়ির সবাই পিসিকে বলতেন, “চল্ তোর ছবি আঁকিয়ে নিয়ে আসি।” আমিও দু’চারবার পিসির
ছবি আঁকানো দেখতে গেছি মনে আছে।
কাজেই জন্মদাগ মুছে দিয়ে,
চিবুকে সাঁটা ব্যান্ড-এড মিলিয়ে দিয়ে, উঁচু দাঁত নিচু করে দিয়ে বাচ্চাদের আরও বেশি
ফোটোজেনিক করে তোলা নিয়ে কারও কেন আপত্তি থাকবে আমি বুঝতে পারছি না।
তবে এটা বলতেই হবে,
বাকিগুলো মেনে নিলেও, রিটাচ করে ব্যান্ড-এড তুলে দেওয়াটা বিশুদ্ধ নৃশংসতা।
আজকালকার বাচ্চাদের কথা জানি না, আমি তো ছোটবেলায় ব্যান্ড-এড লাগাতে পারাটাকে একটা
প্রিভিলেজ মনে করতাম। ভীতু আর ক্যাবলা টাইপের বাচ্চা ছিলাম কাজেই স্বাভাবিকভাবে
বিশেষ চোট পেতাম না। কিন্তু যখন পেতাম, সগর্বে ব্যান্ড-এড লাগিয়ে সেটার দিকে সবার
দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ছাড়তাম না। স্কুলে থাকতেই জনসন অ্যান্ড জনসন রংচঙে ব্যান্ড-এড
বাজারে ছেড়েছিল। পরের দু’সপ্তাহ ধরে স্কুলশুদ্ধু মেয়ে হাঁটুতে, চিবুকে, আঙুলের
ডগায় ব্যান্ড-এড সেঁটে এসেছিল মনে আছে।
যাই হোক, সপক্ষে থাকি বা
বিপক্ষে, বিষয়টা জরুরি। যাদের ছবি বদলানো হচ্ছে তাদের পক্ষে, যেসব বাবামা’রা এই
বদলের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তাঁদের পক্ষে, এবং আমার পক্ষেও। কারণ আমি সুবিচার চাই। এ
যাবৎ যত ছবি তোলা হয়েছে আমার, বিশেষত
পাসপোর্ট সাইজ ছবি, যেগুলো সারাজীবনের মতো অ্যাডমিট কার্ড, আইডি কার্ড, পাসপোর্টের
পাতা থেকে ঠাণ্ডা নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থেকে আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিচ্ছে, আমি সেই
সব ছবি রিটাচ করতে চাই। উঁহু, জালিয়াতি করে নিজেকে ফোটোজেনিক করে তুলতে চাও বলে
নয়। যাতে ছবিগুলোকে সত্যিসত্যি আমারই ছবি বলে মনে হয়, সে জন্য।
আমার ভোটার আইডি কার্ডের ছবিটাকে রিটাচ করে কেউ যদি আসল কুন্তলার মতো করে দিতে পারেন আমি চিরজীবন তাঁর কেনা হয়ে থাকব।
তবে সায়েন্স যে রকম এগিয়েছে
তাতে তার পক্ষে আরও অনেক কিছু করা সম্ভব বলে আমার বিশ্বাস। বাবামা’র ওপর গভীর
অভিমান নিয়ে শিমূলতলায় ঝর্ণার সামনে পাথরে বসে ছবি তুলেছিলাম, রাগটা তো আর নেই,
রাগের কারণটাও ভুলে গেছি। খালি একটা গোমড়ামুখো ছবি অ্যালবামে পড়ে আছে। রিটাচ করে
ছবি থেকে রাগটা সরিয়ে দিতে পারেন কেউ? অথবা হোলির দিন ঝিলাম লনে তোলা গ্রুপফোটো
থেকে আমাকে নিঃশব্দে মুছে দিতে?
জানতাম, পারবেন না। কাজের
কাজ করার কারও মুরোদ নেই, যত কেরামতি শুধু ব্যান্ড-এড বেচারার ওপর। ছবিটবি নিয়ে এত
কথা বলতে গিয়ে নস্ট্যালজিক হয়ে গিয়ে পুরোনো ছবির ফোল্ডার হাতড়ে নিচের ছবিটা
বেরোলো। বুচিদিদিদের বাড়ির ছাদে তোলা। দুপুরের চাঁদিফাটা রোদ সোজা চোখের ওপর,
ঘামাচি সারাতে নাইসিল বডি পাউডারের অর্ধেক শিশি আমার গলায় উপুড় করে দিয়েছেন মা,
এবং প্যান্ট ইস্তিরি করতে ভুলে গেছেন।
প্রাণ থাকতে এ ছবি আমি
রিটাচ করতে দিচ্ছি না। কারণ এর থেকে ফোটোজেনিক আমাকে আর কক্ষনও লাগেনি।
Last line ta pore jore jore haashchi. Ki mishti lekha ta, K. Chhobi ta aro shundor.
ReplyDeletepore khoob bhalo laglo.
ReplyDeletehNya Pree, eta amar favourite chhobi.
ReplyDeleteare Nandini di, thank you thank you!
Eki char din dhure udhao keno ? Kothay gele ?
ReplyDeletebongmom, fNakibaji sref fNakibaji.....:P
ReplyDeleteboddo bhalo lekhen. maane boddo boddo bhalo. apnar fan hoye gechhi.
ReplyDeleteথ্যাঙ্ক ইউ থ্যাঙ্ক ইউ Caco Mukho. আমার লেখা আপনার ভালো লেগেছে শুনে আমি যে কি খুশি হয়েছি যদি বোঝাতে পারতাম। অনেক অনেক ধন্যবাদ।
Deletelike like like .. shob kota line jodi alada alada like kora jeto .. oshombhab bhalo .. ei tumi boi lekho na go .. pls
ReplyDeleteহাহা, আরে থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ।
Delete