অকাজের শিক্ষা
ছোটবেলায় আমাকে এমন অনেক কিছু শেখানো হয়েছিল, যেগুলো আর
কোনওদিন কোনও কাজে লাগেনি। আমার বাবামা বা মাস্টারমশাই দিদিমণিরা যে শিক্ষাগুলোকে
অপরিহার্য বলে মনে করেছিলেন, সেগুলোকে বাদ দিয়েও জীবন দিব্যি কেটে যাচ্ছে।
আবার এমন অনেক শিক্ষা যেগুলোকে আমি তখন নিতান্ত বাহুল্য মনে
করেছিলাম, “এসব আমার ছাতার মাথা কোন কম্মে লাগবে” বলে গজগজ করেছিলাম, সেই
ট্রেনিংগুলো ছাড়া আমি আজকের আমিকে কল্পনাও করতে পারি না।
তার মধ্যে একটা হল টাইপিং। আমার বাবামা কলকাতা শহরের ‘টাইপ
স্কুল জেনারেশন’-এর প্রোডাক্ট্। টাইপিং আর স্টেনোগ্রাফির জ্ঞান দুজনের সিভি-কেই
সেই বাজারে যথেষ্ট এগিয়ে রেখেছিল। কাজেই মাধ্যমিক
পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর আমার বাবা দাবি করলেন, তিনমাস বাড়িতে স্রেফ বসেবসে সময়নষ্ট
না করে আমাকে টাইপিংটা শিখে নিতে হবে।
আমি যত বললাম, “বাবা এটা কম্পিউটারের
যুগ, আজকাল আর কেউ না দেখে টাইপ করে না” বাবা কিছুতেই শুনলেন না। গ্লোবালাইজেশনের
যুগে সারা বিকেল বসে MS Word-এ ‘The Quick Brown Fox Jumps Over The Lazy Dog’ টাইপ করতে আমার চোখ ফেটে জল আসত।
এখন যখন অনলাইন হওয়া মাত্র
চতুর্দিক থেকে বন্ধুর ছেঁকে ধরে, স্ক্রিন জুড়ে ১০-১৫টা চ্যাটবাক্স খুলে আমি ঝড়ের
গতিতে এ বাক্স থেকে ও বাক্সে ছুটোছুটি করে “হাইহ্যালো হোয়াস্সাপ” করতে থাকি তখন
ভাবি, “ভাগ্যিস টাইপিং-এর স্পিড ভালো ছিল।”
অন্তত এই আত্মবিশ্বাসটুকু আমার আছে
যে কোনওদিন যদি কেউ ভুলেও আমাকে পিং করেন, তবে আমি তাঁর সঙ্গে অনেক বেশি ফালতু কথা
অনেক কম সময়ে বলতে পারব। কাজেই টাইপিং শেখা আমার জীবনে কাজে লেগেছে। বাবা শুনলে
ভয়ানক খুশি হবেন।
তবে আবোলতাবোল জিনিসপত্রও যে কিছু
কম শিখেছি তা নয়। যেমন ধরুন, হাতের লেখা ভালো করা নিয়ে খামোকা অত চাপসৃষ্টি করার
কোনও দরকারই ছিল না। গরমের ছুটির দুপুরগুলো টিভি দেখা বাদ দিয়ে বসে বসে ‘কবিদের
গুরু রবীন্দ্রনাথ’ পাতার পর পাতা লিখে হাতের লেখা অভ্যেস করার থেকে বেগার খাটুনি
আর জীবনে খেটেছি বলে মনে পড়ছে না। ছুটির শেষে স্কুলে গিয়ে দেখি স্বাতী খাতা ভর্তি
করে ‘কবিদের’ বদলে ‘কবীরের’ গুরু রবীন্দ্রনাথ লিখে নিয়ে এসেছে।
কাগজের ওপর পেন দিয়ে কবি, কবীর,
রবীন্দ্রনাথ শব্দগুল শেষ কবে লিখেছি অনেক ভেবেও মনে করতে পারছি না। ভাবতে গিয়ে ভয়
লেগে গেল হঠাৎ। বাংলায় নিজের পুরো নামটা শেষে কবে লিখেছি আমি নিজে হাতে? মধ্যমার
ওপর ভর দিয়ে রাখা পেন, তর্জনী আর বুড়ো আঙুল দিয়ে শক্ত করে ধরে? ওভাবে পেন ধরলে
লেখার স্পিড বাড়ে আর অক্ষরের ছাঁদও সুন্দর হয়। সেজকাকু দেখিয়ে দিয়েছিলেন।
শুধু যে হাতের লেখার মতো একটা
অপ্রয়োজনীয় জিনিস শিখিয়ে বড়রা আমার সময় নষ্ট করেছিলেন তাই নয়, তাঁরা আমাকে এটাও
বুঝিয়েছিলেন যে হাতের লেখার গুণগত মানের সঙ্গে মানুষের গুণগত মানের একটা সরাসরি
সম্পর্ক আছে। মানে আমার হাতের লেখা যদি কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং হয় আর আপনার
পরিপাটি লেখা যদি সাদা পাতায় অদৃশ্য সরলরেখা ধরে অনায়াসে চলে, তাহলে ধরে নেওয়া
যেতে পারে যে আপনি আমার থেকে উন্নতমানের লোক।
এর থেকে আনসায়েন্টিফিক
পেরেন্টিং-এর নমুনা আর কী হতে পারে?
যাই হোক। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।
বাবামা’রাও তো জীবনে একদু’বারই বাবামা হন, একটুআধটু ভুলভ্রান্তি তাঁদের হওাই
স্বাভাবিক।
সেদিন মেলবক্স খুলে দেখলাম মা’র পাঠানো
একটা চিঠি এসেছে। চিঠিটা এনে টেবিলে রাখার পর হঠাৎ খামের ওপর লেখা ঠিকানাটার দিকে
চোখ পড়ল।
মায়ের হাতের লেখা। ‘ওয়াই’-এর তিনটে
হাত, ডি-এর গোল দাগটা, ‘কে’-শেষ করার আলতো ভাসানো টান। পাশাপাশি রাখলে আমার লেখার
সঙ্গে খালি চোখে তফাৎ বার করে কার সাধ্য।
আমার সঙ্গে আমার মায়ের চেহারায়,
স্বভাবে হয়তো অনেক অমিল। আমাদের সময়, সমাজ, অভিজ্ঞতার হয়তো আসমানজমিন ফারাক।
কিন্তু দুজনের হাতের লেখা পাশাপাশি রাখলে এটা নিয়ে সন্দেহ থাকার কোনও কারণই নেই যে
আমি আমার মায়ের মেয়ে।
ভাগ্যিস হাতে ধরে লিখতে
শিখিয়েছিলেন মা।
Khoob bhalo laglo pore. Onekdin pore pherot eschechi blog-world e !
ReplyDeleteAmar haater lekha pore amar didi mone kore amar babar moto-n ar baba mone koren amar ma er moton-n! mone hoye dujon er e shikhya kaaj e eseche othoba noy! :)
are Raka, kemon achho? hNya, ei bishoyta anekta sei prothom bachcha hole jemon ekdol bole, "thik maayer moto" abar anyodol bole, "babar mukhe kete bosano" serokom arki.......
ReplyDeleteKhun bhalo laglo...
ReplyDeleteodbhut byapar, ei ko din agei Sugata da aar koyek jon mile ei niyei kotha hochchilo. amar hather lekha age kager thyang chilo, tar pore sorol lekha chNuye ebar boger thyang er dike jachche...kintu ami amar bangla naam ta praye protidin i class e boshe paper er ulto dike likhte thaki. bina karone...obhyash :)
ishhh ki likhechi...i mean khub bhalo laglo :-)
ReplyDeleteami tomar lekhar boro bhokto. ei lekha ta pore digun boro bhokto hoye gelam...bhison bhalo laglo
ReplyDeleteThank you Mohor.
ReplyDeleteSumana, typo niye ghabRiyo na :)...ar tumi ultodike nijer naam likhte paro! eta to timepass-er bhalo upay mone hochchhe, practice korte hobe.