উড়তে গিয়ে


গত সপ্তাহের শেষদিকটা একটা ঝটিকা সফরে খরচ হয়ে গেল। কাজের অংশটুকু বাদ দিলে এমনিতে আমার এই সফরগুলো মন্দ লাগে না। অনেকে অবশ্য মুখ বেঁকান, কিন্ত আমার সত্যি বলছি প্লেনে চাপতে এখনও দিব্যি লাগে। ধীরেসুস্থে গড়াতে গড়াতে উড়োজাহাজটা যখন রানওয়েতে ধাঁ করে তুঙ্গ স্পিড নেয় আর সমস্ত শক্তি জড়ো করে মাধ্যাকর্ষণের মুখে টেনে এক লাথি কষিয়ে ওপর দিকে লাফ মারে, জানালার বাইরে বাড়িঘর গাছপালা দিগন্তরেখা-টেখা সব হেলে মাটিতে শুয়ে পড়ে, পেটের ভেতরটা কী রকম খালি খালি লাগে আর বারংবার মাগুরমাছের মত খাবি খেয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়া কান খুলতে হয়---খারাপ লাগার কী আছে কে জানে বাবা।

আর তাছাড়া ফ্যাট ফ্রি প্রেটজেলের ফাউ মিনি প্যাকের কথাটাও তো ভুললে চলবে না।

বিদেশ থেকে দেশে ফিরলে লোকে সাধারণত কয়েকটা হাতে গোনা বিষয়েই প্রশ্ন করে থাকে।

-সেকি একটুও ফর্সা হসনি তো!

-অ্যামেরিকানরা অংকে ভয়ানক মাথামোটা হয়, না রে?

-ডালভাত জোটে? কালেভদ্রে?

আমার মেজমামি জিজ্ঞাসা করেছিলেন,

-হ্যাঁরে সোনা, প্লেনটা সত্যি সত্যি অ্যাটলান্টিকের ওপর দিয়ে পাঁচ ঘণ্টা ধরে চলে?

আমি ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলাতে মামি সত্যি সত্যি দুঃখ পেয়ে গিয়েছিলেন।

-তাহলে আর আমার অ্যামেরিকা যাওয়া হল না এ জন্মে।

প্লেন ডাঙায় ভেঙে পড়লে তাও চলতে পারে, কিন্তু জলে পড়ার ব্যাপারটায় মামির ঘোরতর আপত্তি। ডাঙায় পড়লে তো হয়েই গেল, সোজা স্বর্গলাভ। কিন্তু যদি জলে পড়ে আর যদি কপাল খারাপ হয়, প্রাণটা তৎক্ষণাৎ নাও বেরোতে পারে তো? তখন আক্ষরিক অর্থেই অকূল পাথার। কোনওমতে মুণ্ডু জাগিয়ে সাক্ষাৎ মৃত্যুর অপেক্ষায় ঘড়ি দেখ বসে বসে। ভেসে ভেসে। খানিক দূরে একটু বাদেই একটা তিনকোণা হাঙরের পাখনা উদয় হবে, দেখো। পায়ের নিচে ঝাঁক বেঁধে পিরান্‌হার দল আসবে ফিস্টি করতে, টের পেয়ো।

সজ্ঞানে স্বর্গযাত্রা কথাটা লোকে খুব বড়াই করে শ্রাদ্ধের কার্ডে ছাপে বটে, কিন্তু আমার মতে ব্যাপারটা অতি ভয়ানক। আমি নিজে যথাসম্ভব অজ্ঞান অবস্থাতেই যেতে চাই। স্বর্গ অথবা নরক, যেখানেই হোক।

আমি উদাত্ত হেসে মেজমামির পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলাম,

-আরে প্লেন অত সহজে ভেঙে পড়ে নাকি? সায়েন্স কত এগিয়েছে জান? তার থেকে বরং অটো চাপলে আজকাল প্রাণের ভয় বেশি। কোথায় কোন ম্যানহোলে ঢুকে যাবে। আর তাছাড়া প্লেনের ভেতরে বসে তুমি জলস্থল কিছু আলাদা করে বুঝতেও পারবে না। সে রকম হোলে সামনের টিভিতে ‘মানচিত্র’ চ্যানেলটা দেখবে না। ব্যস্‌ হয়ে গেল। কেল্লা ফতে।

মামি আশ্বস্ত হননি। আকাশে ওড়াউড়িকে অটো চাপার সঙ্গে এক করে দেখতে নিতান্তই গররাজি হয়েছিলেন। ট্র্যান্সঅ্যাটল্যান্টিক এয়ারলাইন আর হালতু গড়িয়াহাট রুটের অটো যে আদতে একই ব্যাপার, সেটা কিছুতেই স্বীকার করতে চাননি।

সেদিন প্রেটজেল-ট্রেটজেল সব খেয়ে ফেলে, প্যাকেটটা উল্টো করে ঝাঁকিয়ে, থাবড়া মেরেও যখন আর একটু গুঁড়ো পর্যন্ত বেরোল না, তখন আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার দিকে তাকিয়ে মেঘ দেখতে লাগলাম। দেখতে দেখতে চোখটা সবে লেগে এসেছে, হঠাৎ এক রামঝাঁকুনিতে তন্দ্রা ছুটে গেল। এয়ার পকেট না কী যেন বলে, সেখানেই পড়ল বোধহয়। নড়েচড়ে বসে আবার চোখ বোজার উপক্রম করছি, অমনি তাণ্ডব শুরু হয়ে গেল।

আর সে কী তাণ্ডব। মনে হল প্লেনটাকে কেউ যেন কুলোয় করে নাচাচ্ছে। এই ঝপাস্‌ করে মাইলখানেক নেমে আসে তো আবার ডানা ঝাপটে প্রাণপণ ওপরে ওঠার লড়াই শুরু হয়। প্লেন তো নয়, যেন তিন নম্বর বাস। রাত এগারোটার সময় জি টি রোড ফাঁকা পেয়ে পরমানন্দে ছুটেছে। পাইলট ঘন ঘন “ভয় নেই ভয় নেই” ঘোষণা করতে লাগলেন, কুল্যে দু’জন এয়ারহোস্টেস আইল ধরে দৌড়োদৌড়ি করতে লাগলেন, আগেপিছের সারি থেকে ত্রস্ত গলায় ভগবানের নাম কানে এসে পৌঁছল, আমার পাশের ভদ্রলোক সামনের সিটটাকে দুহাতে আঁকড়ে ধরে নিজেকে কুল রাখার প্রাণপণ চেষ্টা করতে থাকলেন।

আমার কোনও সন্দেহই রইল না যে হয়ে এসেছে। টাইম ইস আপ। মাথার মধ্যে মা, ঠাকুমা, বাবা আর ক্রিশ্চিয়ান বেলের মুখ পালা করে ভেসে উঠতে লাগল। এই সংকটের মুহূর্তে ভগবানকে ডাকলে কিছু সুবিধে হতে পারে কি না, বহুদিন পড়ে আমি সে ব্যাপারটা সিরিয়াসলি তলিয়ে দেখলাম। এই অবস্থায় কতক্ষণ কাটল জানি না, দু’খানা মোক্ষম ঝাঁকুনি দিয়ে প্লেনটা অবশেষে যখন স্থির হল, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি সে হতভাগা এতক্ষণে মোটে পাঁচ মিনিটও এগোয়নি।

কুঁড়ের বাদশা কোথাকার। পাহারা না দিলেই কাজে ফাঁকি দেওয়া এদের একটা অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। জঘন্য।

সব শান্ত হয়ে গেলে, পাশের ভদ্রলোকের সঙ্গে দু-একখানা নিরীহ রসিকতা বিনিময় করে আমি আবার মেঘ দেখতে লাগলাম। আর দেখতে দেখতেই আকাশে ওড়া সংক্রান্ত মেজমামির পয়েন্ট অফ ভিউটা জলের মত পরিষ্কার হয়ে গেল।

সত্যিই তো, কেন? হেঁটে, ছুটে, সাঁতার কেটে, বাসের দরজায় ঝুলেও মানুষের শখ মেটেনি, আবার আকাশে উড়তে গেছে। উড়বি যে, ডানা আছে তোর? যদি ওড়ার দরকারই থাকত তাহলে কি ভগবান বুদ্ধি করে একজোড়া ডানা জুড়ে দিতেন না পিঠের সঙ্গে? আর যদি শখ মেটাতেই হয় তাহলে গ্যাসবেলুনে চড়ে এদিকওদিক নড়বড়িয়ে খানিকটা উড়ে এলেই হয়, তা না, ছানাপোনা লটবহর নিয়ে একেবারে দেশদেশান্তরে ছোটাছুটি করতে লেগেছে। উড়তে উড়তে খাচ্ছে, ঘুমোচ্ছে, সিনেমা দেখছে, ঝগড়া করছে, বন্ধুত্ব পাতাচ্ছে।

শুধু যখন মাঝআকাশে প্লেন ঝড়বৃষ্টিবজ্রপাতের ঘূর্ণাবর্তের মধ্যে গোঁত্তা খেয়ে ঢুকে গিয়ে পালাবার পত পাচ্ছে না, তখন মাথা চুলকে ভাবছে, যেচে এই ঝঞ্ঝাটের মধ্যে পড়বার কি কোনও দরকার ছিল? আদৌ?

সেদিন সেই মুহূর্তে মনে মনে শপথ নিয়েছিলাম, প্রেটজেল যদি খেতেই হয়, ভেন্ডিং মেশিন থেকে যতখুশি কিনে খাব। আকাশে উড়তে উড়তে খাওয়ার শখ জন্মের মত কড়ায়গন্ডায় মিটে গেছে আমার। দুঃখের কথা, আরও লক্ষ লক্ষ শপথের মত, এই শপথটাও আমি রাখতে পারিনি।
      

Comments

  1. daroon laglo post ta. tomar kolom er dogay phul chondon poruk, bolte ichhe korchey!

    ReplyDelete
  2. porte porte mone holo 'tenida' porchhi... kothao jeno lekhonir khub miil achhe...
    "tokhon matha chulke bhabchhe, jeche ei jhonjhater moddhye poRar ki kono dorkar chhilo? adou?".... oshshadharon .... too good...
    plane e chorte amaro khub bhalo lage tobe frequent flyer ra kokhono kokhono ei obhigyota prapto hoechhe bolei hoyto mukh byankai... amar kopaleo erom obhogyota waiting maybe, tarpor amio oi 'dukhi smiley' der dolobhukto hobo...
    A-class likhechho...

    ReplyDelete
  3. Shampa, dhonyobad dhonyobad.

    Sohini, amar ta mone hoyna. mukh bNyaknota asole anyo kono ekta jayga theke ase. chhotora to cycle shikhte giye kotobar achhaR khay, tate ki cycle choRa theke tader mon uthhe jay? ektuo na. tomar jodi plane-e choRte ekhono bhalolage, tahole shoto jhonjhapat periyeo bhaloi lagbe, ami nishchit. lekhata tomar bhalolegechhe jene khushi. Thank you.

    ReplyDelete
  4. bah darun likhecho! tobe ki kelenkarir obhigyNota holo tomar!! r jano, ami ei lekha ta porchi ekta plane theke neme r arekta te chapar majhe airport e boshe! bhabo, kirom pet gurgur kore :(

    tobe hyan, amar plane e othar sobtheke plus point lage khawa dawa ta. eta bhebei amr besh bhalo lage j othar khanikhon baade thekei ghono ghono suswadhu khabar dey :D

    ReplyDelete
  5. Thank you Atreyee. ekhon ki baRi jawar majhpothe? khawadawata amar durdanto lage. kara je aeroplane-er khabar dekhle naak kNuchkoy ke jane, amar to ora ja dey tai khete bhalo lage.

    ReplyDelete
  6. hyan go, bari jachi. ha ki je moja lagche. baba bollo amar jonno mach ana hoyeche. uf excited lagche. :)
    tomake happy holidays janai :D

    ReplyDelete
  7. Sedin ei lekhata poRe bhablum likhi amar erakom kono abigyota nei, tarpor bhablum tin-tinkhana plane periye deshe jabo dudin por, aage pNouchhe jaai tarpor bolbo. Ekhon nirapode pNouchhe bolte pari, plane e chapay abar bhoyer ki achhe moshai? dibyi khawa-dawa-cinema dekha ar ghum. Ektu adhtu jhNakuni na hole khabar hajom hobe kikore?

    ReplyDelete
  8. haha, seta bhaloi korechhen, ke jane abar kotha theke ki nojor lege jay. ta aboshyo thiki bolechhen. emnite ja boring baapre...

    ReplyDelete

Post a Comment