ঠাকুমার সাহস



দুঃখের ঘটনার সঙ্গে আনন্দের ঘটনার তফাত হচ্ছে আনন্দের ঘটনা ঘটলে সেটা তক্ষুনি সবাইকে জানাতে ইচ্ছে করে। অন্তত লুকোতে ইচ্ছে করে না। আর দুঃখের ঘটনা ঘটলে প্রথমে সেটা নিজের কাছেই এত অবিশ্বাস্য মনে হয়, যে লোককে কী বলব, কীভাবেই বা বলব, যেটা বলব সেটা সত্যিসত্যি বাস্তবে ঘটেছে নাকি সবটাই আমার দুঃস্বপ্ন, এসব নানারকম চিন্তা মাথায় আসে।

সবথেকে বড় যে ভাবনাটা মনে আসে সেটা হল, হয়তো কাউকে না বললে ব্যাপারটা নিজে নিজেই ঠিক হয়ে যাবে?

তাই আমি এতদিন আপনাদের আমার ঠাকুমার কথাটা বলিনি। আইবুড়োভাতের কথা বলেছি, বিয়েবাড়ির কথা বলেছি, এমনকি মাটন বিরিয়ানির কথাটাও চেপে রাখিনি, কিন্তু হাসপাতালের সাদা বিছানায়, শরীরের চারদিকে লক্ষলক্ষ নল আর নাকের ওপর চেপে বসা অক্সিজেনের মুখোশ পরে শুয়ে থাকা আমার নির্বাক, নিঃসাড় ঠাকুমার কথা লিখতে আমার আঙুল সরেনি।

কিন্তু আজ সরছে, কারণ আজ আমার ঠাকুমা বাড়ি ফিরছেন। মহাসমারোহে। ডাক্তারবাবুরা বলে দিয়েছেন, আমাদের চিকিৎসা শেষ, এইবার বাড়ি নিয়ে যান, বাকিটুকু নিজের লোকের মধ্যে থাকলে, কথাবার্তা বললে, আপসে ঠিক হয়ে যাবে।

যেন হয়, যেন হয়, যেন হয়।

যেন পরের বার বাড়ি গিয়ে ওই খাঁখাঁ করা ঘরটা আর শূন্য বিছানাটা দেখতে না হয়। গত একবছর ধরেই ঠাকুমা আর বারান্দায় বসতে পারছিলেন না, নিজের ঘরেই শুয়ে থাকতেন, মাঝেমাঝে কেউ বসিয়ে দিলে খাটের ওপর বসে থাকতেন। তবুও তো থাকা? তবুও তো জানা, যে বারান্দা পেরিয়ে, সদর ঘর পেরিয়ে, বাঁদিক ঘুরে পর্দা সরিয়ে উঁকি মারলেই, একটা হাসিমাখা ফোকলা মুখ ক্ষীণকণ্ঠে বলে উঠবে, “ওয়েলকাম ওয়েলকাম, আসেন আসেন, দেখি দেখি...”

ঠাকুমাকে নিয়মিত ফোন করি না, মাসের পর মাস “কেমন আছ ঠাকুমা?” বলে মাথার পাতলা হয়ে আসা সাদা চুলে বিলি কেটে দিই না, তবু ঠাকুমা আমার পথ চেয়ে বসে থাকেন। যত রাতই হোক না কেন, প্লেন যত লেটই করুক না কেন।

আমার যে ছোটবেলাটা আমার নিজেরই মনে নেই, ঠাকুমা আমার সেই ছোটবেলাটাকে নিজের মধ্যে পুরে নিয়ে বসে আছেন। প্রহ্লাদ, সুদামা, বাসুকি, আর তাড়কারাক্ষসীদেরও। শতশত মাইল দূরের কলসকাঠি নামের একটা গ্রাম, আর নদীর ধারে পটুয়াখালি নামের একটা শহর, ঘাটে এসে ভেড়া পানভর্তি নৌকো, পুকুরের ওপর শুয়ে পড়া তালগাছ আর সেই তালগাছের ওপর ঘোড়ায় চড়ার মতো পা ঝুলিয়ে বসে সারাদুপুর কুল খাওয়া আর কুলের বিচি কে কত দূরে ছুঁড়তে পারে তার কম্পিটিশন---এই অদ্ভুত পৃথিবীটায় আমার প্রবেশের একমাত্র চাবি ঠাকুমার আঁচলে বাঁধা।

আমি এত সহজে সে চাবি হারাতে রাজি নই।

ঠাকুমার সম্পর্কে শুধু মনখারাপের কথা লিখতে আমার ভালো লাগে না। তাই পোস্টটা শেষ করার আগে আপনাদের একটা মন ভালো করা গল্প বলব। এই গল্পটাও একটা বিয়েবাড়িকে ঘিরে। এবং কী আশ্চর্য, আমি গত সপ্তাহে যার বিয়ে খেয়ে এলাম, এটা সেই টুনার বাবার, অর্থাৎ কিনা আমার জেঠুর বিয়ের গল্প।

জেঠুজেঠির বিয়ের লগ্ন পড়েছিল শেষরাত্তিরে। সন্ধ্যে হতে না হতেই বরপক্ষ, অর্থাৎ কিনা ঠাকুমার স্বামী, চার ছেলে এক মেয়ে, যাবতীয় আত্মীয়স্বজন, আর পাড়াশুদ্ধু সবাই বাসভর্তি করে চেঁচাতে চেঁচাতে চলে গেল, পড়ে রইলেন আমার ঠাকুমা। মায়েদের ছেলের বিয়ে দেখতে নেই কিনা, তাই। ঠাকুমাকে সঙ্গ দিতে রয়ে গেলেন ঠাকুমার বেতোরুগি সৎদিদি, ভবতারিণী।

ঠাকুমার মুখেই শুনেছি, তখন নাকি রিষড়া একদম অন্যরকম ছিল। চারদিকে বাঁশবাগান, সে বাগানে আবার শেয়াল ডাকে। থানা একটা ছিল বটে, কিন্তু সে রেললাইন পেরিয়ে সেই গঙ্গার ধারে, কাজেই আইনশৃংখলা পরিস্থিতিও একেবারে হিংসে করার মতো কিছু ছিল না। বাঁশবাগানের ভেতর থেকে ন’মাসেছ’মাসে একটা দুটো ডেডবডি বেরোলে কেউই বিশেষ অবাক হত না।

এই অবস্থায়, বাড়িভর্তি শাড়িগয়না নিয়ে সারারাত একলা থাকতে অতি বড় সাহসীরও বুক কাঁপত। কিন্তু আমার ঠাকুমা অন্য ধাতুতে গড়া। তিনি সবাইকে সাজিয়েগুজিয়ে বাসে তুলে দিয়ে, সারাবাড়ির দরজাজানালা ভালো করে এঁটে বন্ধ করে, ভবদিদিকে বললেন, “তুই শুয়ে পড়, আমি জেগে আছি।”

ভবদিদি বাতের ব্যথায় কাঁপতেকাঁপতে শুয়ে পড়লেন। ঠাকুমারও চোখ লেগে আসছিল, কিন্তু মাঝরাত নাগাদ হঠাৎ খুট করে একটা শব্দে তাঁর তন্দ্রা ছুটে গেল। কানখাড়া করে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না, আবার শব্দ হল, খুট।

ঠাকুমা একেবারে লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন।

শব্দটা আসছিল বাড়ির পেছনদিক থেকে। ওই দিকটাতেই জঙ্গল সবথেকে বেশি ঘন। ঠাকুমার আর বুঝতে বাকি রইল না যে চোরবাবাজির আবির্ভাব হয়েছে। তিনি আগে থেকেই সব সরঞ্জাম রেডি করে রেখেছিলেন। ঠাকুমা কাজে নেমে পড়লেন। সবার আগে দাদুর একটা ভীষণ বড় গামবুট পায়ে গলালেন আর তারপর সারাবাড়ি জোরে জোরে আওয়াজ করে হাঁটতে হাঁটতে মোটা গলায় বলতে লাগলেন, “তপন, বন্দুকটা হাতের কাছে রেখেছিস তো?”

তপন, আমার সেজকাকু, তখন সোদপুরের বিয়েবাড়িতে বসে কবজি ডুবিয়ে পাঁঠার ঝোল খাচ্ছিল। বন্দুকের ব সম্পর্কে তার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা ছিল না।

কিন্তু শব্দ থেমে গেল। ঠাকুমা বুঝলেন ওষুধ ধরেছে। কিন্তু তিনি ঘুমোলেন না। ভোর হওয়া পর্যন্ত, মাঝেমাঝেই গামবুট পড়ে বাড়িময় ঘুরে বেড়াতে লাগলেন আর আমার অনুপস্থিত সেজকাকুর নাম ধরে ডেকে কাল্পনিক বন্দুক সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে লাগলেন।

সকালবেলা বরপক্ষের গাড়ি এসে ভবদিদির ঘুম ভাঙালো। আমার দাদু উদ্বিগ্ন মুখে ঠাকুমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী গো, কিছু হয়টয়নি তো?” ঠাকুমা হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করে বললেন, “পাগল? আগে বল খোকার বিয়ে কেমন হল?”

ওইরকম সাহসী ঠাকুমার এইরকম নিড়বিড়ে নাতনি কী করে হল, সেটা ভেবেই আমি কূল পাই না।

Comments

  1. অনেক অনুভূতি গলার কাছে দলা পাকিয়ে গেল ।WONDERFUL!

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ।

      Delete
  2. bhalo laglo pore..amar boro pishir kotha mone koria dilen..apnar thakuma abar nijer paye hete baranday gia jeno boste paren...sai kamona e kori..

    ReplyDelete
  3. :-) :-) thakuma to asamanyo! duradanto galpo

    ReplyDelete
    Replies
    1. তবে? কার ঠাকুমা দেখতে হবে তো?

      Delete
  4. Thakuma jeno dibbi bhalo hoy, baranday boshe tomake welcome bolte paren. Oi kalashkathi gram er golpo shunte boro icche korche

    BongMom

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ বং মম। কলসকাঠি সত্যিই ম্যাজিকাল একটা জায়গা।

      Delete
  5. গল্পটা ভীষণ ভালো লাগলো - এ তো সত্যিকারের হোম অ্যালোন! ঠাকুমার আরোগ্য কামনা করি, আর ঠাকুমার গল্প আরো শুনতে চাই।

    ReplyDelete
    Replies
    1. নিশ্চয়, নিশ্চয় সুগত।

      Delete
  6. Jemon byapok golpo ta, temon bhalo thakuma'r chhotobelar gramer description ta :) Sotyi erokom chabi harano jaye? Na tar kono mane hoy?

    ReplyDelete
    Replies
    1. হয় না-ই তো রিয়া।

      Delete
  7. Thakumar kotha pore onek din bade amar Ammar kotha mone pore gelo. Ami thakuma ke Amma daktam. Shotti chotobelar shob smriti jeno Ammar golpo chara oshompurno mone hoy...... Prarthona kori Thakuma jeno tartari shere othen..... Amader Je ekhono onek golpo Shona baki..

    ReplyDelete
    Replies
    1. ঠিক বলেছ রণিতা। তোমার আম্মার কথা জেনে ভালো লাগল।

      Delete
  8. aha! ki shundor goppota. tomar ebong tomar poribar er sabar janne roilo anek anek shubhechha! o(n)der smriti gulo kolom er jore aaro shundor kore tolo!

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ শম্পা।

      Delete
  9. ঠাকুমারা এরকমই হয় দি। চিন্তা নেই তোমার নাতনিটিও এই কথাই বলবে দেখো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভরসা দিচ্ছ আবির? বললেই ভালো।

      Delete
  10. tomar thakumar druto arogyo kamona kori. khub bhalo laglo lekhata.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ ইচ্ছাডানা।

      Delete
  11. tomaar thakuma bhalo hoye uthun..thakumar golpo aro chaai :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. তোমার শুভকামনার জন্য অনেক ধন্যবাদ স্বাগতা। দেখি ঝুলি ঝেড়ে বার করব আরও গল্প।

      Delete

Post a Comment