পল টেম্পল ও চার্লস প্যারিস



এই পোস্টে চার্লস প্যারিস আর পল টেম্পলের গল্প "পরে বলব" বলে পালিয়েছিলাম। যদি আপনারা আগ্রহ না হারিয়ে ফেলেন, তাহলে আজ তাঁদের কথা বলব বয়সের বিচারে পল চার্লসের থেকে বড় তাই তাঁর কথাই আগে বলি।

পল টেম্পল


আগের পোস্টে রেডিওর যত গোয়েন্দার কথা বলেছি, এবং আজকের পোস্টের দ্বিতীয়ার্ধে যে চার্লসের কথা বলব, তাঁদের সবার সঙ্গে পল টেম্পলের একটা পার্থক্য আছে। বাকি সকলেই বইয়ের পাতা থেকে রেডিওতে এসেছিলেন, একা পল টেম্পল জীবন শুরু করেছিলেন রেডিওতে। উনিশশো আটত্রিশ সালে। যে বছর ফ্রান্সিস ডারব্রিজ তাঁকে নিয়ে ‘সেন্ড ফর পল টেম্পল’ নামের গল্পটি লিখে তাঁকে বিবিসি রেডিও কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেন। সেদিক থেকে দেখতে গেলে পল টেম্পল হচ্ছেন খাঁটি অর্থে রেডিওর গোয়েন্দা।

রেডিওতে জমা দেওয়ার পর ফ্রান্সিস ডারব্রিজ অবশ্য পল টেম্পলের গল্পগুলো উপন্যাস হিসেবেও ছেপেছিলেন। পরে টেম্পলকে নিয়ে চারখানা ফিচারফিল্মও বানানো হয়েছিল। কিন্তু জনপ্রিয়তায় সেগুলো রেডিওর নাটকের ধারেকাছে আসতে পারেনি।

পল টেম্পল নিজে গোয়েন্দা গল্প লেখেন, তাঁর স্ত্রী স্টিভ সাংবাদিক। (এই তথ্যটা উইকিপিডিয়ায় পড়ে আমি চমকে গেছি, বিবিসি আর ইউটিউব মিলিয়ে পল টেম্পলের প্রায় ষোলোটা নাটক শুনেও স্টিভের সাংবাদিকতার কোনও আঁচ আমি পাইনি) স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের বড়কর্তা স্যার গ্রেহাম ফোর্বস হচ্ছেন পল টেম্পলের প্রধান ক্লায়েন্ট। ক্লায়েন্ট বলাটা একটু ভুল কারণ রহস্য সমাধান করার জন্য স্যার গ্রেহাম টেম্পলকে কোনও রকম পারিশ্রমিক দেন না। তার দরকারও নেই অবশ্য। বই লিখেই টেম্পলের যথেষ্ট রোজগার হয় মনে হয়। সস্ত্রীক লন্ডনের অভিজাত পাড়ার খেলানো ফ্ল্যাটে থাকেন, এবং একজন দিবারাত্রের ম্যানসারভেন্টকেও মেন্টেন করেন। এই ম্যানসারভেন্টের নাম চার্লি। চার্লিকে আমি খুবই পছন্দ করি। কারণ খাতায়কলমে চার্লি চাকর হলেও তার হাবভাব একেবারেই চাকরের মতো নয়। পল এবং স্টিভ তাকে যা যা করতে বলেন সে নিয়মিত ঠিক তার উল্টো কাজ করে এবং হাসিমুখে বকুনি খেয়ে আবার সেই একই ভুল করে। আর নিজের জামার সঙ্গে ম্যাচিং হচ্ছে দেখলে পল টেম্পলের আলমারি থেকে টাই বার করে পরে অম্লানবদনে ঘুরে বেড়াতে তার বিন্দুমাত্র আটকায় না।

এতক্ষণে আপনারা অধৈর্য হয়ে পড়েছেন আর বলছেন “হ্যাঁ হ্যাঁ বুঝেছি চার্লি চমৎকার, কিন্তু এবার আসল কথায় এস। পল টেম্পলের গল্পগুলোয় হত কী?” গল্পে কী হত সেটা আপনাদের আমি সরাসরি বলব না। দ্য টোস্ট ম্যাগাজিনে “হাউ টু টেল হোয়াট নভেল ইউ আর ইন” নামে একটি চমৎকার সিরিজ বেরোতে দেখেছি, সেটার আদলে বলব। বা বলার চেষ্টা করব।

হাউ টু টেল ইউ আর ইন আ পল টেম্পল মিস্ট্রি 

১। পল টেম্পল আর স্টিভ কোনও এক মহার্ঘ পার্টি থেকে মাঝরাত্তিরে বাড়ি ফিরে দেখবেন বসার ঘরে স্যার গ্রেহাম ফোর্বস একজন বেচারামুখো ইনস্পেক্টরকে সঙ্গে নিয়ে বসে আছেন। (গল্প এগোলে বোঝা যাবে ইনসপেক্টরটি বুদ্ধিতেও বেশ বেচারা।) চার্লি তাঁদের হাতে হুইস্কির গ্লাস ধরিয়ে “গুড নাইট” বলে ঘুমোতে চলে গেছে।

২। স্যার গ্রেহাম খবর দেবেন কোথাও একটা খুন বা কিডন্যাপের ঘটনা ঘটেছে। তার সমাধানের দায়িত্ব তিনি পলের হাতে তুলে দিতে চান। বলাই বাহুল্য, ইনস্পেকটরটি এই ব্যবস্থায় খুশি নন এবং এর পর থেকে গোটা গল্প জুড়ে পল টেম্পলের সঙ্গে তাঁর একটা শীতল রেষারেষি চলতে থাকে।

৩। পল টেম্পল প্রথমে অনেক গাঁইগুঁই করবেন। যুক্তি দেখাবেন কেন তিনি কেসটা টেক আপ করতে পারবেন না। যুক্তি মূলত দুটোঃ
ক) উপন্যাস শেষ করার জন্য প্রকাশকের তাড়া;
খ) এই সব রক্তারক্তিতে না জড়ানোর জন্য স্টিভের কাতর অনুরোধ;

বোঝাই যাচ্ছে কোনও যুক্তিই ধোপে টিকবে না, কারণ তাহলে গল্প সেখানেই শেষ হয়ে যাবে। বুঝদার জীবনসঙ্গীর মতো স্টিভ পলকে কেসটা নেবার অনুমতি দেবেন। আর তক্ষুনি স্যার গ্রেহাম আসল বোমাটা ফাটাবেন।

৪। মৃতদেহের পাশ থেকে বা কিডন্যাপ হওয়া মেয়ের ফেলে যাওয়া হাতব্যাগের ভেতর থেকে একটুকরো সাদা কাগজ পাওয়া গেছে। কাগজে মাত্র একটি শব্দ লেখা। গ্রেগরি।

বা সুলিভ্যান।

বা ম্যাডিসন।

বা ভ্যানডাইক

প্রখর রুদ্রের গল্পের নামের বৈশিষ্ট্য যেমন অনুপ্রাস, পল টেম্পলের গল্পের নামের তেমনি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে মানুষের নাম। পল টেম্পল অ্যান্ড দ্য গ্রেগরি অ্যাফেয়ার হিট করে যাওয়াতেই বোধহয় ফ্রান্সিস ডারব্রিজ একধারসে তাঁর নাটকের নামে ভিলেনের নাম গুঁজে দেওয়া শুরু করেন। পল টেম্পল অ্যান্ড দ্য সুলিভ্যান মিস্ট্রি, পল টেম্পল অ্যান্ড দ্য কার্জন কেস, পল টেম্পল অ্যান্ড দ্য ম্যাডিসন মিস্ট্রি, পল টেম্পল অ্যান্ড দ্য কনরাড কেস, পল টেম্পল অ্যান্ড দ্য জোনাথন মিস্ট্রি, পল টেম্পল অ্যান্ড দ্য গিলবার্ট কেস, পল টেম্পল অ্যান্ড দ্য মার্গো মিস্ট্রি, পল টেম্পল অ্যান্ড দ্য স্পেনসার অ্যাফেয়ার

৫। এইবার আসল নাটক শুরু হবে (আক্ষরিক ও রূপক, দুই অর্থেই)। একের পর এক খুন, একের পর এক কিডন্যাপ। দুয়েকবার দুষ্কৃতীরা স্টিভকেও কিডন্যাপ করে নিয়ে যাবে এবং স্টিভ নিজ বুদ্ধিবলে শত্রুপুরী থেকে বেঁচে ফিরে আসবেন। পল ও স্টিভের গাড়িকে ভিলেনের গাড়ি অন্তত দু’বার ব্রিজের ওপর থেকে ধাক্কা মেরে নদীতে ফেলে দেবে। অন্তত তিনবার পোড়োবাড়ির ঘরে বন্ধ করে দরজার বাইরে থেকে শিকল তুলে আগুন লাগিয়ে দেবে।

৬। ভালো গোয়েন্দাগল্পের একটা শর্ত হচ্ছে যত বেশি সংখ্যক চরিত্রের হাতে পারা যায় মোটিভ ও অপরচুনিটি ধরিয়ে দেওয়া। পল টেম্পলের গল্পও তার ব্যতিক্রম নয়। চরিত্রেরও অভাব নেই, তাদের প্রত্যেকের অপরাধ সংঘটনের কারণের ও সুযোগেরও অভাব নেই। যেই একজনের প্রতি আপনার সন্দেহ ঘন হয়ে আসবে অমনি পরের পর্বে সে-ই খুন/কিডন্যাপড সন্দেহের খেলায় বারবার এই রকম পরাস্ত হতে হতে যখন আপনি ল্যাজেগোবরে, পল টেম্পল ঘোষণা করবেন অপরাধীর পেছনে দৌড়ে দৌড়ে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন, চাঙ্গা হওয়ার জন্য তিনি একটি ককটেল পার্টির আয়োজন করতে চান। বাঃ বাঃ, আপনার মনও নেচে উঠবে, গত তিনঘণ্টা ধরে পল আর স্টিভের সঙ্গে নদীতে ডুবতে ডুবতে, আগুনে পুড়তে পুড়তে, বোমায় উড়তে উড়তে আপনারও তখন জিভ বেরিয়ে পড়েছে, এই মুহূর্তে গল্প থামিয়ে খানিক পার্টি করে নিলে মন্দ হয় না।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে পার্টিতে আপনার নেমন্তন্ন নেই।

আরও খারাপ ব্যাপারটা হচ্ছে আপনার ছাড়া পৃথিবীশুদ্ধ সকলেরই নেমন্তন্ন আছে। পৃথিবীটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল, কিন্তু নাটক শুরুর দৃশ্য থেকে যতজনের সঙ্গে আপনার পরিচয় হয়েছে, তাদের সবার আছে। চোর পুলিশ ইনফর্মার ভ্যাগাবন্ড দারোয়ান ওয়েটার স্যার গ্রেহাম চার্লি– সবার।

৭। কারণ এই পার্টিতেই দুষ্কৃতীর মুখোশ খুলে দেবেন পল টেম্পল। কে আসল গ্রেগ্ররি? (আশা করি আপনি এতক্ষণ ভাবছিলেন না যে ভিলেন নিজের আসল নামটা কাগজে লিখে মৃতদেহের পাশে রেখে যাচ্ছিল? সেটা ভেবে থাকলে নাটক শোনার আগে গোয়েন্দাগল্প নিয়ে আরেকটু হোমওয়ার্কের দরকার আছে আপনার) কে সুলিভ্যান নামের আড়ালে লন্ডনের সবথেকে বড় ড্রাগ পাচারের গ্যাং চালাচ্ছে?

বেশ খানিকক্ষণ ধরে সন্দেহের তীর এর দিকে ওর দিকে ঘোরাতে ঘোরাতে (এবং গত তিনঘণ্টায় মূল রহস্যের শাখা রহস্য হিসেবে যেগুলো আত্মপ্রকাশ করেছে, সেগুলো একে একে সমাধান করার পর) অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসবে। পল টেম্পল, পৃথিবীর রেডিওর ইতিহাসে বিখ্যাততম গোয়েন্দা, দুষ্কৃতী মুখোশ উন্মোচন করবেন। কিন্তু . . .

বিদ্যুবেগে দুষ্কৃতী পকেট থেকে পিস্তল বার করেছে! “স্ট্যান্ড ব্যাক এভরিবডি! অর আই উইল শুট!” দাঁড়াবি তো দাঁড়া বেছে বেছে ঠিক তারই পাশে ককটেলের গ্লাস হাতে নিয়ে হাসিহাসি মুখে স্টিভ দাঁড়িয়েছিলেন, ডানহাতের পিস্তল উঁচিয়ে ধরে বাঁহাত দিয়ে স্টিভের গলা জাপটে ধরে ঘরের জানালার দিকে পিছু হাঁটতে শুরু করেছে বদমাশটা। পল চেঁচাচ্ছেন “স্টিভ!” স্টিভ চেঁচাচ্ছেন, “পল!” ঘরশুদ্ধু লোকও চেঁচাচ্ছে তবে তাদের চেঁচামেচির মানে বোঝা যাচ্ছে না। এমন সময় জানালার ঠিক কাছে গিয়ে হঠা ভিলেনের কী বোধোদয় হল, সে স্টিভকে ধাক্কা মেরে সামনের দিকে ঠেলে দিয়ে নিজে জানালা দিয়ে লাফ দিয়ে পড়ল। স্টিভ পলের বক্ষলগ্না হলেন, নিচে ভিলেন ইনস্পেকটরের বক্ষলগ্ন হল। আগের রহস্যেও অপরাধী এই পথেই পালানোর চেষ্টা করেছিল কি না, তাই বুদ্ধি খাটিয়ে ইন্সপেকটর ওই জানালার নিচেই দলবল নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন।

দাঁড়ান, যাচ্ছেন কোথায়? পল টেম্পল গোটা ঘটনাটা ঠিক করে ব্যাখ্যা করার আগেই তো গুলিটুলি চলে একাকার কাণ্ড হল, অপরাধী কে বোঝা গেলেও কেন সে-ই অপরাধী সেটা ঠিক করে বোঝা গেল না। আপনি লজ্জা পাবেন না, আমিও বুঝিনি। আমি অবশ্য কখনওই বুঝি না কে অপরাধী। একে একে সকলকেই সন্দেহ করি। শেষটায় যখন গোয়েন্দা বানান করে বলে দেন কে অপরাধী, কেন অপরাধী, তখন লজ্জায় আমার মাথা কাটা যায়। মনে হয়, “ছ্যা ছ্যা ছ্যা এটা বোঝা উচিত ছিলএই বুদ্ধি নিয়ে নাকি আমি একদিন গোয়েন্দা গল্প লেখার আশা মনে পুষি?”

কিন্তু আমিও পল টেম্পলের গল্পের শেষে লজ্জা পাই না, কারণ আমি তো দূর ছাই, স্টিভও নাকি বোঝেননি। বুঝুন, গত সাড়ে তিন ঘণ্টা ধরে যিনি পলের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করলেন, অপহৃত হয়েও একটুও না ঘাবড়ে দুর্ধর্ষ দুশমনের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে এলেন, গোটা গল্পটা নাকি তাঁর কাছেও স্পষ্ট নয়। আমি তো কোন ছার।

পল টেম্পল হাসলেন। স্যার গ্রেহাম হাসলেন। “ও স্টিভ, স্টিভ, ইউ আর রিয়েলি সামথিং” তারপর বুঝিয়ে দিলেন। স্টিভ বুঝলেন, আমিও বুঝলাম। সবশেষে স্টিভ পলের পকেট থেকে টাকা নিয়ে “ওকে ডার্লিং, আমি তবে টুপি কিনতে চললাম” বলে ডিজাইনার দোকানের দিকে হাঁটা দিলেন। পল টেম্পল মুখে আতংকের ভাব প্রকাশ করলেন, কিন্তু মনে মনে যে তিনি অত্যন্ত গর্বিত বোধ করছেন সেটা পাঁচ বছরের বাচ্চাও বুঝবে।

পোস্টের শুরুতে আপনাদের কারও কারও পল টেম্পলের গল্প শোনার যদি বা আগ্রহ জেগেছিল, আমার সমালোচনা পড়ে এতক্ষণে নিশ্চয় উবে গেছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, ওপরের সবক’টা কথা সত্যি হওয়া সত্ত্বেও পল টেম্পল আসলে ভীষণ ভালো, ভীষণ মজার, ভীষণ থ্রিলিং। একবার শুনতে শুরু করলে থামা যায় না।

তার একটা অন্যতম প্রধান কারণ অভিনয়। পল টেম্পলের চরিত্রে বিভিন্ন অভিনেতা অভিনয় করেছেন। তাঁদের মধ্যে পিটার কুকের অভিনীত পল টেম্পল সবথেকে জনপ্রিয় (যদিও আমার ক্রফোর্ড লোগানের পল টেম্পলকে সবথেকে বেশি ভালো লাগে। তবে তার কারণ হতে পারে যে আমি পল টেম্পল প্রথম শুনেছিলাম ক্রফোর্ডের গলায়।) যখন টেম্পলের গাড়িকে ধাক্কা মেরে সরু ব্রিজের রেলিং ভেঙে নদীতে ফেলে দুষ্কৃতীর গাড়ি পালাচ্ছে তখন পল ও স্টিভের আর্ত চিকার, নদীর জলে নাকানিচোবানি খেতে খেতে পলের “স্টিইইভ! স্টিইইভ!” হাহাকার, বোমা ফাটার পর জনতার ধুপধাপ পায়ের শব্দ এবং শেষ দৃশ্যে জানালা থেকে লাফ দিয়ে পড়ে পা ভাঙার সময় দুষ্কৃতীর ইংরিজি ভাষায় “মাগো গেলাম” সূচক আর্তনাদ - সব এত জ্যান্ত, এত বাস্তব, সিনেমার থেকে কোনও অংশে কম নয়।

পল টেম্পলের গল্পে পল টেম্পলের পরেই যার খ্যাতি সে করোনেশন স্কট।

করোনেশন স্কট? চরিত্রের নাম করোনেশন স্কট?

বোনাস কুইজঃ "করোনেশন স্কট"-এর জায়গায় অন্য একটি নাম আর "চরিত্রের" জায়গায় "ছবির" বসিয়ে দিলে এটা একটা চেনা বইয়ের চেনা চরিত্রের মুখের চেনা সংলাপ হয়ে যায়। বইয়ের নাম, চরিত্রের নাম আর সংলাপটাও আপনাদের বলতে হবে। (হিন্টঃ প্রশ্নটা করার সময় বক্তার গলার স্বর লো-ভোল্টেজ হয়ে গিয়েছিল)

না, করোনেশন স্কট কোনও চরিত্র নয়, করোনেশন স্কট আসলে একটি এক্সপ্রেস প্যাসেঞ্জার ট্রেনের নাম। উনিশশো সাঁইত্রিশ সালে ষষ্ঠ জর্জ আর এলিজাবেথের করোনেশন উপলক্ষ্যে ট্রেনটি চালু হয়। সে সময়ে পৃথিবীতে এর থেকে বিখ্যাত ট্রেন নাকি আর ছিল না। আমাদের গল্পে অবশ্য ট্রেনটা জরুরি নয়, আমাদের গল্পের জরুরি ব্যাপারটা ঘটেছিল পরের বছর, উনিশশো আটত্রিশ সালে। সে বছর ভিভিয়ান এলিস নামের একজন সঙ্গীতজ্ঞ ট্রেনে চেপে যাচ্ছিলেন। সেটা অবশ্য করোনেশন স্কট ছিল না, সে ট্রেনের নাম ছিল কর্নিশ রিভিয়েরা। যাই হোক, ট্রেনে চেপে যেতে যেতে একটি সুর ভিভিয়ানের মাথায় এল। তিনি সেটা লিখে ফেললেন। যেহেতু ট্রেনে বসে সেটা তাঁর মাথায় এসেছিল তাই তিনি তার নাম দিলেন ‘করোনেশন স্কট’।


এই করোনেশন স্কট-ই ছিল গোড়ার দিকের পল টেম্পল নাটকের সিগনেচার টিউন। পল টেম্পলের নাটকের থেকে এই টিউন কোনও অংশে কম জনপ্রিয় ছিল না। শোনা যায় রেডিওতে করোনেশন স্কট বাজতে শুরু করলেই রাস্তা ফাঁকা হয়ে যেত। ব্রিটেনে তো বটেই, জার্মানি, ইজরায়েল, আরও যে সব দেশে তাদের ভাষার রেডিওতে তাদের ভাষায় পল টেম্পল প্রচারিত হত, সে সব দেশেও। অনেকটা আমাদের ছোটবেলায় রবিবার সকালে মহাভারতের সময় যেমনটা হত। পল টেম্পল শোনার আগে এই কথাটা কেউ বললে আমি হয়তো বাড়াবাড়ি বলে উড়িয়ে দিতে পারতাম, কিন্তু নিজকর্ণে পল টেম্পল শোনার পর আর ওড়াই না।


চার্লস প্যারিস

এক কথায় বলতে গেলে লোকটা বাজে। শখের মাতাল অনেকেই হয়, চার্লস প্যারিস পেশাদার মাতাল। পাব দেখলে নিজেকে সামলাতে পারে না।

মদ ছাড়া আর যে জিনিসটা দেখলে চার্লস প্যারিস নিজেকে সামলাতে পারে না্ সেটাও ম দিয়ে শুরু। হ্যাঁ, লোকটা চরিত্রহীন। এবং পৃথিবীর অনেক চরিত্রহীনের তূণেই যে অস্ত্রটা থাকে সেটা চার্লসেরও আছে। চার্ম। প্রচুর। অপরিমিত। চার্লস যে মহিলা দেখে খুব হামলে পড়ে তা নয় (অনেক দোষ থাকা সত্ত্বেও চার্লস প্যারিস লোকটা ঠিক ছেঁদো নয়। অক্সফোর্ড না কোথায় পড়েছিল, সে শিক্ষাদীক্ষা রুচির ছাপ এখনও, এত অনাচারের পরেও সম্পূর্ণ মুছে যায়নি) বরং উল্টোটাই ঘটে, কিন্তু লোকটা তাতে বাধা দেওয়ার কোনও চেষ্টাই করে না। বরং সোৎসাহে সম্মতি প্রকাশ করে। সে মহিলার সংসার আছে কি না, মহিলা চার্লসের হাঁটুর বয়সী কি না এ সবে ভ্রূক্ষেপ না করেই।

ও হ্যাঁ, লোকটা বেকার। নিজেকে বেতার-অভিনেতা বলে চালায়, কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই অভিনয় করার জন্য কেউ চার্লসকে ডাকে না। চার্লস মনে করে এর কারণ তার এজেন্ট মরিসের অপদার্থতা, মরিস মনে করে এর কারণ হচ্ছে চার্লসের বদনাম। লোকটা রেকর্ডিং-এর ফাঁকে মাইকের দিকে পেছন ফিরে জ্যাকেটের ভেতর থেকে ছোট বোতল বার করে চুপি চুপি চুমুক দেয়।

আর একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপারও ইদানীং ঘটতে শুরু করেছে। বাকি কেউ খেয়াল না করলেও মরিস সেটা খেয়াল করেছে, চার্লস তো করেছেই। আজকাল চার্লস যেখানেই যায়, রেকর্ডিং স্টুডিওতে, নাটকের রিহার্সালে, কপালে শিকে ছিঁড়লে টেলিশপিং চ্যানেলে মচকানি-মলমের বিজ্ঞাপনের শুটিং-এ – সর্বত্র একটা করে মৃতদেহ বেরিয়ে পড়ে।

তখন বাধ্য হয়েই চার্লসকে গোয়েন্দাগিরিতে নামতে হয়।

চার্লস প্যারিসের গোয়েন্দাগিরির সবথেকে চোখে পড়ার মতো ব্যাপার হচ্ছে ব্যাপারটার মধ্যে গোয়েন্দাগিরির অভাব। অন্তত আমরা গোয়েন্দাগল্পের পাঠকেরা যে সব লক্ষণগুলোকে গোয়েন্দাগিরি বলে জানি। আমাদের চেনা গোয়েন্দারা যেমন একটা সুতো ধরে এগোন, এগোতে এগোতে আরেকটা সুতো বেরিয়ে যায়, সেটা টেনে আগের সুতোটার সঙ্গে জোড়েন, তারপর খুঁজতে খুঁজতে আবার একটা সুতো বেরোয়, এই করে করে শেষে দেখা যায় একটা সুন্দর সম্পূর্ণ বুনুনি তৈরি হয়েছে, গোটা অপরাধের নকশাটা সেখানে নিখুঁত ফুটে উঠেছে - চার্লস প্যারিসের গোয়েন্দাগিরিতে সে জিনিস আশা করলে আপনি হতাশ হবেন। তার প্রধান কারণ চার্লস প্যারিস গোয়েন্দা নয়। কেউ চার্লসের অপরাধী ধরে আনার দায়িত্ব দেয়নি। চার্লসও যে দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন নিয়ে খুব চিন্তিত, তেমনটা নয়। খালি একগাদা প্রত্যাশিত ঘটনার ভিড়ের মধ্যে একটা কিছু বেখাপ্পা ঘটনা বা বেমানান মানুষ দেখলে সেটা চার্লস উপেক্ষা করতে পারে না। সেই ঘটনাটা বা লোকটাকে নিয়ে নাড়াচাড়া করে, এরতার সঙ্গে সেটা নিয়ে কথা বলে। কথা মানে কথাই, জেরা নয়। পাবে বসে মদ খেতে খেতে বন্ধুত্বপূর্ণ কথোপকথন। (কথোপকথনের উল্টোদিকে মহিলা থাকলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেটা বন্ধুত্বের সীমা ছাড়ায়।)

হারক্যুল পোয়্যারোর অনুসন্ধান প্রক্রিয়ার দর্শন যদি হয় অর্ডার অ্যান্ড মেথড তবে চার্লস প্যারিসের দর্শন হচ্ছে কমপ্লিট ডিসঅর্ডার এবং আটার ল্যাক অফ মেথড। চার্লস যেন ল্যাগব্যাগার্নিসের মতো ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে চলেছে এর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একটা ক্লু পাওয়া গেল, এক মহিলার সঙ্গে ফ্লার্ট (এবং ওয়ান নাইট স্ট্যান্ড) করতে গিয়ে আরেকটা ক্লু, মরিসের সঙ্গে ফোনে ঝগড়া করতে গিয়ে আরেকটা ক্লূ, এই করতে করতে হঠাৎ চার্লস আবিষ্কার করল যে সমাধানটা ঠিক তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আমি আপনি ও অন্যান্য পাঠক/শ্রোতারা, এতক্ষণ যাঁরা চার্লস প্যারিসকে “গুড ফর নাথিং”, “অপদার্থ”, “অলম্বুষ” ইত্যাদি বলে উড়িয়ে দিচ্ছিলেন আমরা সবাই হকচকিয়ে গেলেন।

সমাধানে পৌছনোর এই গোটা রাস্তাটা মসৃণ হয় না বলাই বাহুল্য। বোতল বোতল স্কচ, নারীসঙ্গ ইত্যাদি ভালো ভালো জিনিস যেমন চার্লসের কপালে জোটে তেমন ঝামেলাও কম জোটে না। একবার তো এক সাসপেক্ট চার্লসের ওপর দিয়ে বুলডোজার চালিয়ে দিয়েছিল। আরেকবার একজন সাসপেক্ট চার্লসের বুকে গুলি চালিয়ে দিয়েছিল। (সে যে আসলে নির্দোষ সেটা চার্লস প্যারিস গোড়া থেকেই জানত এবং সবাইকে জানানোর চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সাসপেক্ট ভদ্রলোক ভয়ানক নার্ভাস প্রকৃতির, তিনি পরিস্থিতি ঘোরালো হতেই একটি পিস্তল পকেটস্থ করে ফেরার হয়েছেন। বলাই বাহুল্য, তাতে তাঁর ইমেজ পুলিশের কাছে কিছু রক্ষা পায়নি। চার্লস দেখল বিপদ, পুলিশের আগে লোকটাকে খুঁজে না বার করতে পারলে লোকটাকে আর বাঁচানো যাবে না। অনেক খুঁজে যখন চার্লস লোকটাকে খুঁজে পেল তখন সে “এ নির্ঘাত পুলিশের হয়ে আমাকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছে” মনে করে চার্লসের বুকে সোজা গুলি চালিয়ে দিল।)

এই সমস্ত ব্যাপার যখন ঘটে (হামেশাই) তখন চার্লস প্যারিস ফ্রান্সিসের দ্বারস্থ হয়। ফ্রান্সিস বুদ্ধিমান, বিবেচক, পেশাগত ভাবে সফল একজন মানুষ। ফ্রান্সিসের নিজের চালচুলো, বাড়িগাড়ি আছে। এক কথায় বলতে গেলে চার্লস প্যারিস ঠিক যা যা নয়, ফ্রান্সিস ঠিক তা-ই তা-ই।

এতক্ষণে নিশ্চয় আন্দাজ করতে পেরেছেন ফ্রান্সিস কে?

আজ্ঞে হ্যাঁ, ফ্রান্সিস চার্লস প্যারিসের স্ত্রী।

যদিও এখন ফ্রান্সিসকে স্ত্রী বলা যাবে কি না সে নিয়ে সন্দেহ আছে। প্রায় তিরিশ বছর আগে, চার্লসের ক্রমাগত ব্যভিচার ও মাতলামো সহ্য না করতে পেরে ফ্রান্সিস তাকে কান ধরে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছিল। সেই থেকে সেপারেশন চলছে। ডিভোর্স হয়নি এখনও। সে জন্য চার্লস প্যারিসের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। কারণ এই তিরিশ বছর ধরে যথেচ্ছ নারীসঙ্গ আর মাতলামোর সঙ্গে সঙ্গে সে যে কাজটা নিষ্ঠাভরে করে আসছে সেটা হচ্ছে ফ্রান্সিসের দরজায় মাথা ঠোকা আর বলা, “ওগো, আমাকে ফিরিয়ে নাও গো।”

ফ্রান্সিসের মনোভাবটা ঠিক স্পষ্ট নয়। চার্লস প্যাঁচে পড়লে সে এখনও বাঁচাতে যায়। বিশেষ করে ক্লাইম্যাক্সের দৃশ্যে, যেখানে শয়তানের সঙ্গে চার্লসের সম্মুখসমর সেখানে ফ্রান্সিস উপস্থিত থাকতে পছন্দ করে কারণ চার্লসের ওপর তার বিশ্বাস নেই। তারপর সব ভালোয় ভালোয় মিটে গেলে দু’জনে পাবে বসে একসঙ্গে মদ খায় আর গোটা ঘটনাটা নিয়ে হাসাহাসি করে। সেই ফাঁকে চার্লস তার ফাটা রেকর্ড আরেকবার বাজিয়ে নেয়। “চল, আরেকবার বিয়ে করি, ফ্রান্সিস, প্লিজ। এই তোমাকে ছুঁয়ে বলছি, এবার থেকে আর কোনও মেয়ের দিকে তাকাব না। এই মদের বোতল ছুঁয়ে বলছি জন্মের মতো মদ ছেড়ে দেব।” ফ্রান্সিস চুপ করে থাকে। ভয় হয়, এই বুঝি নরম হয়ে পড়ে। সুখের বিষয়, পরদিন সকালে একঘর ধোঁয়ার মধ্যে ঘুম ভেঙে উঠে ফ্রান্সিস যখন দেখে ব্রেকফাস্ট বানাতে গিয়ে চার্লস তার রান্নাঘর পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে, তখন তার সমস্ত সন্দেহ দূর হয় এবং “সেপারেশন” আগের মতো বলবৎ থাকে।

চার্লস প্যারিস বেশ হালের গোয়েন্দা। আমাদের ফেলুদার থেকেও হালের। চার্লস প্যারিসের প্রথম উপন্যাস লেখা হয়েছিল উনিশশো পঁচাত্তরে, লিখেছিলেন সাইমন ব্রেট। ‘কাস্ট, ইন অর্ডার অফ ডিস্যাপিয়ারেন্স’। আশির দশকে এই গল্পটির নাট্যরূপ বিবিসিতে প্রচারিত হয়। চার্লস প্যারিসের চরিত্রে অভিনয় করেন ফ্রান্সিস ম্যাথিউস।

বিল নাইয়ি চার্লস প্যারিসের ভূমিকায় নামেন অনেক পরে, উনিশশো নিরানব্বইতে। আর নেমেই কেল্লা ফতে করে দেন। সত্যি বলতে কি, এখন চার্লস প্যারিস আর বিল নাইয়ি সমার্থক হয়ে গেছেন। যদি ইচ্ছে করে চার্লস প্যারিসের নাটক শুনে দেখতে পারেন। আমার বিশ্বাস - মাতাল, চরিত্রহীন, বন্ধুবৎসল, উদার, দায়িত্বজ্ঞানহীন, রসিক এবং আপাদমস্তক ব্যাড বয় এই না-গোয়েন্দাটিকে ভালো না বেসে আপনি থাকতে পারবেন না।


*****


বিবিসি ওয়েবসাইটের এই পাতায় চোখ রাখলে মাঝে মাঝে পল টেম্পল ও চার্লস প্যারিসের নাটক চোখে পড়বে। তবে অত কষ্ট যদি করতে না চান তবে এই আমি ইউটিউবের লিংক নিচে দিয়ে দিলাম।



পল টেম্পল আর চার্লস প্যারিসের ছবির উৎস গুগল ইমেজেস। 


Comments

  1. Ekkhuni bari giye Youtube khule boshlam bole. Notun goyendar kotha jante parlei kirom mon bhalo hoye jay. :-)

    ReplyDelete
    Replies
    1. গুড, বিম্ববতী। শুনে কেমন লাগে বোলো।

      Delete
  2. লেখা, লিঙ্ক দুটোর জন্যেই উচ্চ পঞ্চ! রহস্যকাহিনী আমারও ভীষণ প্রিয় কিনা। :)
    দেখা আরম্ভ করতে হবে শীঘ্রই, এরকম একটা লেখার জন্য অনেক ধন্যবাদ কুন্তলা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, অরিজিত। আপনি বুঝবেন, ভালো গোয়েন্দাগল্প নিজে পড়ে/শুনে যতটা সুখ, প্রায় ততটাই সুখ অন্য রসিকদের পড়িয়ে/শুনিয়ে।

      Delete
  3. Answer to embedded quiz:

    "High voltage Spark"? Chhobi r naam "high voltage spark"? Low voltage golaye bollen jotayu.

    ReplyDelete
    Replies
    1. একদম ঠিক উত্তর, সম্বরণ। অনেক হাততালি আর অভিনন্দন।

      Delete
  4. Dhonyobaad Kuntala...Sompurno notun tothyo. kotokkhone sunbo tar opekkha....raat er khabar khete khete ki sunbo/dekhbo nie r bishesh chinta bhabnar dorkar porbena ekhon kodin..Bratati.

    ReplyDelete
    Replies
    1. এইবার শুনে ভালো লাগলেই ষোলোকলা পূর্ণ, ব্রততী।

      Delete
  5. Lekha pore amar ditiyo jonkei pochondo holo beshi. shune dekhbo dhire susthe. Bill Nighy bhodroloker emnitei besh khepate akta image ache, onar character gulo sobi besh eccentric type hoy. onake amar khubi adorable lage.

    ReplyDelete
    Replies
    1. বিল নাইয়িকে তুমি যে বিশেষণটায় ভূষিত করলে, কুহেলি, আমারও ঠিক সেটাই লাগে। অ্যাডোরেবল। চার্লস প্যারিসও তাই। শুনে দেখো, মনে হয় ভালো লাগবে।

      Delete
  6. Peter Wimsey ta sesh korei eder dhorbo..

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, তাড়া নেই, চুপকথা। ধীরেসুস্থে সব শেষ কোরো।

      Delete

Post a Comment