রানী (১/২)




মূল গল্প: The Queen of the Mystery
লেখক: Ann Cleeves

*****

হাতির দাঁতের হাতলটা বাহারি। সামান্য ঢেউ খেলানো দেহে খাঁজ কাটা, যাতে মুঠোর ভাঁজে নিখুঁত ফিট করে আর গ্রিপও শক্ত হয়। বাঁটের সঙ্গে ফলার সংযোগস্থলে দুদিকে দুটো সোনালি ডানার মতো বেরিয়ে আছে। ডানার ওপাশে চকচকে স্টিলের ফলা, প্রায় ছ’ইঞ্চি লম্বা। ডগা থেকে দু’ফোঁটা রক্ত চুঁইয়ে পড়ছে। যতবার ওদিকে চোখ পড়ে শিল্পীর মাত্রাবোধের প্রশংসা করি।

জানালার পাশে, এখন যেখানে আমি বেতের দোলনা চেয়ারে বসে ইউক্যালিপটাসের হাওয়া খাচ্ছি, সেখান থেকে অবশ্য রক্ত দেখা যাচ্ছে না। পুরু হ্যান্ডমেড কাগজের চিঠিটা আধখোলা হয়ে পড়ে আছে টেবিলের ওপর। ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছে শুধু আইভরি রঙের বাঁটের একটা কোণা। বাঁটের মাথায় সোনালি ডানা, স্টিলের ব্লেড, রক্ত, সব আমি স্মৃতি থেকে বললাম। রক্তের ফোঁটার দু'ইঞ্চি নিচ থেকে যে বয়ানটা শুরু হয়েছে সেটারও দুয়েকটা শব্দ এদিকওদিক করে আমি পুরোটা বলে দিতে পারি। কারণ এই চিঠিটা আমি এর আগেও অগুনতিবার পেয়েছি।

সুধী,

নিখিল বঙ্গ রহস্যরোমাঞ্চ সমিতির পক্ষ থেকে আপনাকে শুভেচ্ছা জানাই। আমাদের বহুপ্রতীক্ষিত বাৎসরিক ব্যোমকেশ সম্মান প্রদানের ঋতু আসন্ন। সপ্তবিংশতিতম ব্যোমকেশ সম্মানসন্ধ্যার আয়োজন করা হয়েছে আগামী এতই ডিসেম্বর, অমুক হোটেলের ব্যাংকোয়েট হলে।

আমরা অত্যন্ত গর্ব ও প্রীতির সঙ্গে জানাচ্ছি যে পাঠকের বিচারে আপনার রচিত অমুক উপন্যাসটি এ বছরের সেরা রহস্য উপন্যাস বিভাগে মনোনীত হয়েছে।

এ বছরের সভা সাফল্যমণ্ডিত করতে আপনার উপস্থিতি ওঁ অংশগ্রহণ কামনা করি। বিস্তারিত কর্মসূচি এই চিঠির সঙ্গে . . . ইত্যাদি।

বয়ানের নিচে ‘মুখ্য কার্যনির্বাহক, নিখিল বঙ্গ রহস্যরোমাঞ্চ সমিতি' টাইপের ওপর প্যাঁচালো সই। সই করার সময় যে পরিমাণ রাগ কার্যনির্বাহকের হয়েছে তার তিলমাত্রও বোঝার উপায় নেই। আমার অটোগ্রাফ দেখেই কি লোকে বুঝতে পারে সেই মুহূর্তে আমি কত বিরক্ত, চিন্তিত, অন্যমনস্ক, প্রতিশোধস্পৃহায় জর্জরিত?

কেয়া চেষ্টা করেছিল যাতে আমি না যাই। নমিনেশনের লিস্ট বেরোনোর পর ফোন করেছিল।

অনুদি, তুমি এবার না আসতে চাইলে উই কমপ্লিটলি আন্ডারস্ট্যান্ড। আমরা তোমাকে খুব মিস করব, বাট উই উইল আন্ডারস্ট্যান্ড।

জানি রে। আমি বলেছিলাম। কিন্তু গেলে হয়তো আমারই ভালো লাগবে। একটা চেঞ্জ অফ প্লেস। একলা বাড়িতে সারাক্ষণ . . .

ইন দ্যাট কেস, তুমি সিক্সটিনথ না এসে সেভেন্টিনথ আসতে পার। সিক্সটিনথে তো জাস্ট ডিনার ছাড়া আর কিছু নেই।

দেখি, বলে প্রসঙ্গ বদলেছিলাম। সিক্সটিনথের ডিনারটা যে শুধু ডিনার নয় সেটা আমিও জানি, কেয়াও জানে। এটাও জানে যে বাংলাভাষার যে কোনও পেশাদার রহস্যরোমাঞ্চ লেখকের কাছে গোটা ইভেন্টটার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ওটাই। লেখক, প্রকাশক, সম্পাদক, ফিল্মপ্রযোজক, সাংবাদিক, সমালোচক, টিভি, রেডিও . . . সবাই থাকবে ওখানে। সাধারণ পাঠক ছাড়া। যারা বইগুলো পয়সা দিয়ে কিনে পড়েছে। আমরা প্রেসের লোক, আমরা প্রযোজকের অফিস থেকে বলছি এইসব বলে ফ্রি কপি আদায় করেনি।

অথচ গোটা ব্যাপারটাতে পাঠকদের ভূমিকাটাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। আমার মতো পুরোনোদের মতে ব্যোমকেশের একমাত্র বিশ্বাসযোগ্যতা এখন এটাই যে গোটা ব্যাপারটা পাঠকের ভোটে হয়। এই কেয়া আর কেয়ার চ্যালাচামুণ্ডার সেটা পছন্দ নয়। কী না, সাধারণ পাঠকের ভোট আনএডুকেটেড, আনইনফর্মড। চেষ্টারটন মুখস্থ না থাকলে নাকি রহস্যগল্পের রসোদ্ধার করা যায় না। শেওড়াফুলির মেয়ের এত এলিটিজম আসে কোত্থেকে কে জানে। আমার আগে মনে হত এসব খাটুনি কমানোর ফন্দি। পুজোর সময় খবরের কাগজে, ম্যাগাজিনে, টিভিতে, রেডিওতে নমিনেশনের লিস্ট বার কর, আজকাল ওয়েবসাইটও খুলেছে, সে সব সামলাও। বছর বছর ক্যাটেগরি বাড়ানোর বেলা তো উৎসাহের অভাব নেই, উপন্যাস, ছোটগল্প, ট্রু ক্রাইম, তদন্তমূলক, ধারাবাহিক, নন-ফিকশন। তার প্রতিটি বিভাগে লাখে লাখে ভোট আসবে। শহর, গ্রাম, সারা ভারত, সারা বিশ্ব থেকে। সে সব ঝাড়োবাছো। তার থেকে পাঁচ বিশেষজ্ঞের কমিটি বসিয়ে দিলে ঝামেলা অনেক কম। তাঁরা পাঁচটা করে বই বেছে তার মধ্যে একটাকে প্রাইজ দিয়ে দেবেন। এখন সন্দেহ হয় এসব তুলে দেওয়ার পেছনে আরও একটা একটা কুমতলব থাকতে পারে। ইদানীং গোয়েন্দাগল্প নিয়ে সিনেমা বানানোর একটা ঝোঁক এসেছে। হয়তো প্রোডাকশন হাউসের সঙ্গে আঁতাত আছে। যে গল্পটা প্রোডিউসারের পছন্দ সেটাকে প্রাইজ দিতে পারলে হয়তো সিনেমার বিজ্ঞাপনে সুবিধে হবে।

ষোলোর ডিনারে এই সব হবে। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছবি তোলা হবে। সে ছবি কাগজে, ম্যাগাজিনে, টিভিতে, পাঠকরা দেখবে। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা তাঁদের বাড়ির লোককে সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন। আমার সঙ্গে আলাপ করাবেন। আমি হাসব, কথা বলব, সই দেব। আগের বছর পরিচয় হয়ে থাকলে সে কথা মনে করাতে পারলে আর কথাই নেই। যাঁদের সঙ্গে এটা করব তাঁদের অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ ওই তিন মিনিটের মনোযোগের বদলে পরের বছর  আমাকে ভোট দেবে। 

ঘর কাঁপিয়ে হাসত রঞ্জন। 

একবছর আগে তুমি কাকে দেখে হেসেছিলে সে কথা মনে রেখে লোকে তোমাকে ভোট দেবে? লোকে ভোট দেবে তোমার বই পড়ে। এমন প্লট ফাঁদবে, শেষপাতায় এমন টুইস্ট দেবে যে লোকে তোমাকে ছাড়া আর কাউকে ভোট দিতেই পারবে না।

বাইরে থেকে দেখলে সে রকমটাই মনে হয় বটে। যে লেখকদের বাজার শুধুমাত্র লেখা দিয়েই নির্ধারিত হয়। যে লোকগুলো এ কথা বিশ্বাস করে তাদের জিজ্ঞাসা করুন যে আপনাদের লাইনে, চাকরিতে, ব্যবসায়, কী দিয়ে ভালোমন্দ ঠিক হয়, বেশিরভাগই লাফিয়ে উঠে বলবে মামাকাকা দিয়ে, ধরাকরা দিয়ে, যৌবনের ছলাকলা দিয়ে। ওয়েল, লেখার লাইনটাও আর পাঁচটা লাইনের মতোই। ভালো হওয়ার সুবিধে একেবারে নেই বলব না, কিন্তু শুধু ভালো দিয়ে হয় না, আরও নানারকম কায়দাকানুন লাগে। 

আমার তো এখন মনে হয় লেখালিখির সঙ্গে অন্য পেশার তফাৎ শুধু পরিশ্রমের সঙ্গে পারিশ্রমিকের অনুপাতে। নিরানব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে সেটা পেট চালানোর মতো নয়। এমনকি নেগেটিভও হতে পারে। গোড়ার দিকে আমার যেটা ছিল। রাত জেগে গল্প লিখে কলকাতার নামি কাগজে পাঠাতাম। কম কথায় আমি তখনও সারতে পারতাম না। এই মোটা মোটা পাণ্ডুলিপি হত। বিস্তর পোস্টেজ। ফেরৎ আসত। বসে বসে সারাতাম। সারাতে গিয়ে পাণ্ডুলিপি আগের থেকে মোটা হয়ে যেত। আবার খামে পুরে স্ট্যাম্প মেরে পাঠাও। সব রঞ্জনের টাকায়। একবার ভেবেছিলাম নিজে রোজগার করব। ওদের কোঅপারেটিভের একটা স্কুল ছিল, এখনও আছে, বাগানের কম্পাউন্ডেই। সেখানে পড়ালে অন্তত পোস্টের খরচাটা উঠে আসবে। আমার ঝুলোঝুলিতে রঞ্জনই ওঁদের বলেছিল। নাম কা ওয়াস্তে ইন্টারভিউ দিয়ে আমি স্কুলে জয়েন করি। 

মাস্টার্সে জিওগ্রাফি ছিল, ক্লাস এইটে পড়াতে দিয়েছিল। সাতদিন গিয়েছিলাম। ক্লাসে দাঁড়িয়ে পর্বতের রকমফের বোঝাতাম, আর মাথার ভেতর ঘুরত পাহাড়ের ওপর কুয়াশা ঘেরা বাংলো। বাংলোর ভেতর ফার্নেস, ফার্নেসের সামনে কার্পেটের ওপর হাত পা চিতিয়ে পড়ে আছে একটি সুন্দরী সদ্য কৈশোর পেরোনো দেহ, প্রাণহীন। হ্যাঁ হ্যাঁ, আগাথা ক্রিস্টির একটা গল্পের শুরু অবিকল এই রকম। আমি নিজের গল্প বলছি না, উদাহরণ দিচ্ছি। 

আমার মুখ দেখে রঞ্জনই বলেছিল, যথেষ্ট হয়েছে। আমি বলে দেব, তোমাদের বোকা ছাত্র পড়িয়ে আমার বউয়ের মাথাব্যথা হয়েছে। আর আসতে পারবে না। গ্লানিতে মরে ছিলাম কয়েকদিন। নিজেকে অপদার্থ মনে হচ্ছিল। আমাকে চাঙ্গা করতে তখনই রঞ্জন গ্যারাজের ওপরের ঘরটা সারাতে শুরু করে। পুবের দেওয়াল কেটে ডবল জানালা, জানালার পাশে মেহগনি কাঠের চওড়া টেবিল, গদি আঁটা চওড়া চেয়ার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে লিখলেও পিঠ ব্যথা করবে না। টেবিলের ওপর ফুলদানিতে সাজানো সুষমার রোজ যত্ন করে সাজানো রডোডেনড্রনের ছটা থেকে চোখ তুললেই দেখা যাবে পাহাড়ের আবছা এবড়োখেবড়ো চুড়ো।

ওই জানালার বাইরে একদিন আমি মধুমাধবী মুখোপাধ্যায়কে প্রথম দেখি। অলৌকিকে বিশ্বাস আমার নেই, কিন্তু যা সত্যি তাকে অগ্রাহ্য করি কী করে। বসে বসে পেন কামড়াচ্ছি, কোনও আইডিয়া আসছে না, যা লিখছি ফেরত আসছে, সত্যি বলতে কি লেখাগুলো আমারও যে খুব মনের মতো হচ্ছে তা নয়। চেয়ারের গদিতে পিঠ ঠেকে গেলেই গ্লানি চড়চড়িয়ে বাড়ছে, আমার জন্য এত খরচ অথচ . . .  যখন ভাবছি সব তাকে তুলে এবার সুষমার কাছে রান্নাবান্না শিখে সংসারে মন দিই, এমন সময় একদিন রডোডেনড্রনের ঝাড় থেকে মুখ তুলে দেখলাম জানালার বাইরে ইউক্যালিপটাসের ছায়ায় মধুমাধবী মুখোপাধ্যায় দাঁড়িয়ে আছে। সোজা আমার দিকে তাকিয়ে। রক্তমাংসের মানুষের থেকেও স্পষ্ট। পরের আট মাস ওই টেবিলে আমার পাশে মধুমাধবী বসে রইল। আমি লিখলাম ‘বিষের নদী’। পাঠিয়ে দিলাম। চিঠি এল। মনোনীত। তারপরের আট মাস ধরে বাংলাভাষার সবথেকে জনপ্রিয় দৈনিকের রবিবারের পাতায় ধারাবাহিক বেরোলো ‘বিষের নদী’। 

মাত্র দেড়খানা বছর। তার ওপারে আমি বাবার পয়সায় উচ্চশিক্ষিত হয়ে বরের পয়সায় বসে খেয়ে নারীবাদের মুখে চুনকালির গ্লানিতে সিঁটিয়ে থাকা বড়লোকের আদুরে অপদার্থ বউ। আর এপারে বাংলা সাহিত্যের উদীয়মান নক্ষত্র। রয়্যালটির টাকা। বেস্টসেলার। সংবর্ধনা। ফ্যান মেল। অটোগ্রাফ। পরের বছর। নতুন বই। বেস্ট সেলার। সংবর্ধনা। ফ্যান মেল। অটোগ্রাফ। তার পরের বছর। নতুন বই। রিপিট। উদীয়মান খসে গেল। বাংলা সাহিত্যের আকাশে আমি নক্ষত্র হয়ে টিমটিম জ্বলতে লাগলাম। গত তিরিশ বছর ধরে জ্বলছি। 

ইন্টারভিউ নিতে আসা চশমা পরা চোখা ছেলেরা অবশ্য সবসময় 'রহস্য' শব্দটা গুঁজে দেয়। বাংলা ‘রহস্য’ সাহিত্যের নক্ষত্র। আমার কিছু মনে হয় না। বাংলা 'রহস্য' সাহিত্যের সবথেকে বেশি বিক্রি হওয়া লেখকও আমি। সেটার কথা অবশ্য ভুলেও মনে করাই না। ওরা সরস্বতীর পূজারী, তাহলে ঘৃণায় আমার দিকে তাকাতেও পারবে না। আমি নিজেকে সুগৃহিণী হিসেবে প্রোজেক্ট করি। সুষমার রাঁধা খাবারদাবার নিজে হাতে বেড়ে খাওয়াই। সুদৃশ্য ছাঁকনি দিয়ে রঞ্জনদের বাড়ির দেড়শো বছরের পুরোনো চায়ের সেটে সুষমার বানানো চা ঢেলে দিই। নিজে হাতে বাগান দেখাই, তকতকে করে গুছিয়ে রাখা গেস্টরুমে নিজে দাঁড়িয়ে থেকে জলের বোতল, তোয়ালে গুছিয়ে দিই। পনেরো দিন বাদে মেলে ম্যাগাজিন আসে, ছ'পাতার ফিচার ‘রহস্যের রানী’। অনেক প্রশংসার মধ্যে ঘরোয়া আর ডাউন টু আর্থ শব্দগুলোই বার বার ফিরে ফিরে আসে। আমি জানি ওই ছেলে সারাজীবনের মতো আমার পাঠক হয়ে গেছে, প্রত্যেক বছর ওই একটা ভোট আমার বাঁধা। 

প্রথম রয়্যালটির চেকটা হাতে নিয়ে আমি বিশ্বাস করতে পারিনি। হাতে নিয়ে ভূতের মতো বসে ছিলাম। রঞ্জন একাই দু’জনের সমান উল্লাস করে বেড়াচ্ছিল। বলছিল, আহা অত স্তম্ভিত হওয়ার কী আছে, এ তো হওয়ারই ছিল। সেলিব্রেট করতে সেই বিকেলেই পাঁচ কিলোমিটার দূরের গেঁয়ো বাজারে গিয়েছিলাম আমরা। রয়্যালটির পয়সায় দু’জনে কফি আর স্যান্ডউইচ। 

সত্যি বলব? সেই বিস্ময় আমার এখনও কাটেনি। অন্যান্য চাকরির সঙ্গে লেখার চাকরির এটা আরেকটা তফাৎ। আপনার কি প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার আগে মনে হয়, চাকরিটা আসলে একটা স্বপ্ন? আজকেই অফিসে পৌঁছে আবিষ্কার করবেন যে অফিসটফিস আসলে ছিল না কোনওদিন কোথাও, গোটাটাই আপনার কল্পনা? আমার হয়। তিরিশ বছর আগে টেনশন হত ছাপবে না, এখন সন্দেহ হয় বেস্টসেলার হবে না। আমার বদলে অন্য কারও গল্প নিয়ে সিনেমা বানিয়ে ফেলবে টালিগঞ্জের ঝকঝকে পরিচালক। আতংকটা আলাদা, কিন্তু তীব্রতা একইরকম। যতক্ষণ পারা যায় ভুলে থাকার চেষ্টা। কিন্তু মনে পড়বেই। তখন চারপাশটা স্লো মোশন হয়ে যাবে। হৃদপিণ্ডের চিৎকারটা ক্রমশ বাড়তে বাড়তে বাকি সব শব্দ ডুবিয়ে দেবে। বুকের ভেতর একটা টর্নেডো ক্রমশ প্রকাণ্ড হয়ে উঠবে, মনে হবে তার টানে আমার আমার সারা শরীরটা গুঁড়ো হয়ে ভুস করে মিলিয়ে যাবে এক্ষুনি।

*****

গাড়ির কাচ নামিয়ে দিলাম। মৌরির কৌটোটা নিয়ে বেরোতে ভুলে গেছি। কষ্টের সময় মুখে মৌরি দিলে আরাম হয়। আর মিনিট দশেক এগিয়ে একটা বাজার আছে। ওখানে এমনিও দাঁড়াতে হবে। অসুবিধে নেই। গাড়ি বার করতে বলেছিলাম হাতে অনেক সময় নিয়েই। তাড়াহুড়ো আর পোষায় না। বাগডোগরার কালো মসৃণ রাস্তা, বর্ষায় ভিজে চকচকে হয়ে রয়েছে। ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি হু হু করে ছুটছে।

বাজারের বাইরে গাড়িটাকে পার্ক করিয়ে ড্রাইভারকে মৌরি আর দু’চারটে টুকিটাকি আনতে পাঠালাম। এখানে একসময় স্রেফ জঙ্গল ছিল। আর একটা কাঁচা রাস্তার চৌমাথা। শনিবার শনিবার দু’চারজন ঝাঁকায় করে মালপত্র নিয়ে এসে বসত। তারপর রাস্তা পাকা হল। ঝাঁকা ঠেলাগাড়ি হল। একটা, দুটো, দশটা। এখন ঠেলা ঝাঁকা দুটোই প্রায় অদৃশ্য। পাকা বাড়ির দোকান ছাড়া প্রায় নেইই। একটা মুদির দোকান, একটা জেনারেল স্টোর, একটা সেলুন আর একটা ফার্মেসি। সাদা সাইনবোর্ডে লাল অক্ষর দিয়ে বড় বড় করে লেখা, জয়গুরু ফার্মেসি। 

ফার্মেসির দরজা ঠেলে একটা ছেলে বেরিয়ে এল। ছেলে না, এখন লোক। ওর নাম বিমল। ওর বউয়ের নাম সুমনা। ওর ছেলের নাম শুভজিৎ। জানালা দিয়ে হাত বার করে নাড়লাম। বিমল হাসতে হাসতে এগিয়ে এল। 

চললেন, দিদি? অল দ্য বেস্ট। এবারও আপনিই পাচ্ছেন। কেউ আটকাতে পারবে না। আমাদের লট চলে গেছে। 

হাসলাম। ওর বাড়ির লোকের খবর নিলাম। সুমনা? শুভজিৎ? বিমলের মুখের হাসি চওড়া হল। খুব ভালো আছে দিদি, মহা দুষ্টু হয়েছে। একদম পড়াশোনা করতে চায় না। 

বিমলকে আমি চিনি প্রায় পঁচিশ বছর। এই বাজারের ভেতরেই একটা লাইব্রেরির দোতলায় স্থানীয় সাহিত্য সমিতির তরফ থেকে আমাকে একবার সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। সাহিত্যিকরা সকলেই প্রবীণ পুরুষ, সকলেই প্রাবন্ধিক কিংবা কবি। অনুষ্ঠান শুরু হওয়ার আগেই প্রবীণ সভাপতি আমাকে জানিয়েছিলেন সাধারণত সংবর্ধনা দেওয়ার সময় নন-ফিকশন কিংবা কবিদেরই বিবেচনা করা হয়। আমি ব্যতিক্রম। এঁরা কেউই আমার লেখা পড়েননি। এঁদের বাড়ির মহিলারা পড়েছেন এবং স্বামীদের বুঝিয়েছেন যে আমি বাৎসরিক সংবর্ধনা পাওয়ার যোগ্য। তাছাড়া আমি উত্তরবঙ্গের লেখক হয়ে কলকাতা জয় করেছি সেটাও সিদ্ধান্ত সহজ করেছিল। ঘোষক ক্রমাগত আমাকে ‘দেবী’ বলে সম্ভাষণ করেছিলেন। বাঙালি ঘরের দৈনন্দিন টানাপোড়েন নিয়ে শ্রীমতী অনসূয়া দেবী জটিল রহস্যের অবতারণা করে. . . ইত্যাদি ইত্যাদি। সংবর্ধনা শেষে আমরা যখন মালা মিষ্টির প্যাকেট গাড়িতে তুলছি, তখন বিমল এসেছিল। ল্যাম্পপোস্টের আলোতে রোগা রোগা হাফপ্যান্ট পরা পা,  সদ্য গোঁফের রেখা। অটোগ্রাফের খাতা আর পেন এগিয়ে দিয়ে বলেছিল, আপনার লেখা আমার খুব ভালো লাগে। 

সেই বিমলের এখন বউ ছেলে নিয়ে ভরা সংসার। সেই বিমল এখন স্থানীয় মিস্ট্রি ক্লাবের হোতা। প্রতি বছর পুজোর মুখে আমার নতুন উপন্যাস বেরোলে বিমল সে বইয়ের ‘লঞ্চ’ আয়োজন করে, ‘লেখিকার সঙ্গে মুখোমুখি’ আলোচনাসভার আয়োজন করে। আমি সেখানে গিয়ে পাঠকদের প্রশ্নের উত্তর দিই। বই সই করি। প্রতি বছর ব্যোমকেশের আগে বিমল আর বিমলের সাঙ্গোপাঙ্গরা সমিতির ফান্ড থেকে আমার বই কিনে বিলোয়, ভোট জোগাড়ের জন্য বাড়ি বাড়ি ঘোরে। 

আমি শুধু প্রত্যেকবার এই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় ওর দোকানের সামনে থামি। ওর ছেলের কথা জিজ্ঞাসা করি। ওর বউয়ের কথা, মায়ের সায়াটিকার ব্যথার কথা।

গাড়ি ছেড়ে দিল। বিমল গাড়ির সঙ্গে দৌড়ে এল দুয়েক পা। তারপর থেমে হাত নাড়তে লাগল। আমিও হাত নাড়লাম। ওর দিকে মুখ ফিরিয়ে থাকলাম যতক্ষণ না গাড়ি বাঁক নেয়। 

*****

অনুদিইইইই! 

পৃথিবীর কোনও কোনও লোককে দেখলে আমার নিজের কল্পনাকে বাস্তব রূপ পেতে দেখতে ইচ্ছে করে। কেয়া মুন্সী তাদের মধ্যে একজন। মৃতদেহের বর্ণনা দিতে গিয়ে আমি প্রায়ই কেয়ার চেহারা কল্পনা করি। গুলি খেয়ে কেয়া পড়ে আছে, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে। ফ্যান থেকে কেয়া ঝুলছে, ঠোঁট থেকে গ্যাঁজলা বেরোচ্ছে। অথচ কেয়ার ওপর আমার এত রাগের কোনও কারণ নেই। হ্যাঁ, ও আমার বইয়ের নিন্দে করে। অফ কোর্স, আমার বইয়ের নয়। আমার বইয়ের উন্মুক্ত নিন্দে করার জায়গা এখন আর কোনও সমালোচকের নেই। কেয়া মুন্সীরও না। কিন্তু যখনই অন্য কোনও বইয়ের সমালোচনায় আমার ওপর রাগটা ফুটে বেরোয়। নিন্দে করতে গিয়ে লেখে, “কোজি, সংকীর্ণ প্রেক্ষাপটে রহস্য গল্প ফাঁদার যে ক্ষতিকারক প্রবণতা আমাদের বাংলা সাহিত্যে আছে”. . . প্রশংসা করতে গিয়ে লেখে, “সস্তা জনপ্রিয়তার লোভ কাটিয়ে যারা এখনও ঘরোয়া প্রেক্ষাপট থেকে বেরোতে পারেন না”… চাইলে আমি ব্যাপারটা বন্ধ করতে পারি। কিন্তু তাহলে খোলাখুলি যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। যেটা আমার মতে বুদ্ধিমানের কাজ নয়।

অনুদিইইইইইই…

কড়া এসির হাওয়া ফুঁড়ে কেয়ার তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বর আবার কানে এসে বিঁধল। আমার ডাকনাম কিন্তু অনু নয়। আমার মা বাবা কাকা পিসে বন্ধুবান্ধব কেউ কোনওদিন আমাকে অনু বলে ডাকেনি। রঞ্জনও প্রকাশ্যে আমার পুরো নাম ধরে ডাকত, আড়ালে আমার সত্যি ডাকনাম ধরে। কেয়া প্রথমদিন থেকেই অনুদি, প্রথম দিন থেকেই তূমি। 

ছদ্ম উত্তেজনায় আধা দৌড়ে আধা হেঁটে আয়নার মতো চকচকে কাঠের মেঝের ওপর দিয়ে হিলের খুরখুর তুলে কেয়া এগিয়ে এল। একটা টাইট হাঁটু পর্যন্ত জামা পরেছে। মিনিমাম পঁয়তাল্লিশ তো হবেই, ফিগারটা মেন্টেন করেছে ভালো। ওর পেছনে ধূমকেতুর লেজের মতো একটা ভিড়। বেশিরভাগই চেনা মুখ। অবন্তিকা সান্যাল। মৌসুমী পাল। মৌসুমীর প্রদ্যুৎ সিরিজটা আমার খারাপ লাগে না। ভিড়ের এক হাত ওপরে ভাসছে সৌরীশ সেনগুপ্তের টাক। আড়ালে লোকে বলে ও হচ্ছে বাংলা রহস্য সাহিত্যে জেন্ডার ইকুয়ালিটির টোকেন। ঐতিহাসিক ঘরানায় লেখে। গত বছর ওর গৌড়ের ওপর বেস করা উপন্যাসটা অ্যাকচুয়ালি বেশ জমাটি। এ বছর নমিনেশন আছে। 

সৌজন্যবিনিময়, আলিঙ্গন আর একে অপরের বইকে ভালো বলার পর উচ্ছ্বাস মিইয়ে এল। কেয়ার নেতৃত্বে লেখকদের ভিড় সরে গেল অন্যদিকে। রয়ে গেলেন কিছু আয়োজক। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ লেখালিখিও করেন। একজন রিটায়ারমেন্টের পর সাহিত্য ধরেছেন। গোয়েন্দাগল্প লিখছেন। আগের বছর আমাকে ওঁর প্রথম তিনটে চ্যাপ্টার পড়তে দিয়েছিলেন। গোয়েন্দার নাম মধুসূদন মাইতি। আমি দশপাতা পড়ার চেষ্টা করে ছাড়ান দিয়েছি। বলেছি, চমৎকার বাঁধুনি। তিনি জানালেন তাঁর খসড়া কমপ্লিট, এবার যদি আমি আমার প্রকাশককে . . . আমি বললাম, নিশ্চয়। তারপর তাঁর নাতির কথা জিজ্ঞাসা করলাম। প্রত্যাশামতোই, পাণ্ডুলিপি প্রকাশক উবে গেল। টানা পাঁচমিনিট রুদ্ধশ্বাস নাতিভজনার পর আমি আস্তে করে বললাম যে এবার ঘরে যাব। সকলেই বুঝদার। নিশ্চয় নিশ্চয়, এই বয়সে এতখানি জার্নি। 

প্রকাণ্ড লবির দেওয়াল ঘেঁষে সিলিং ছোঁয়া পাম গাছের বর্ডার। ইতিউতি নরম সোফাসেটি, বাহারি ঝরনা। ঠাণ্ডা সুবাসিত হাওয়ায় হালকা সন্তুরের আওয়াজ। কথোপকথনে বাধা সৃষ্টি করবে না, কিন্তু ফাঁক পড়লে সে ফাঁক ভরাট করবে। রিসেপশনের উডওয়ার্কের আড়াল থেকে নরম হলুদ আলো ছিটকোচ্ছে। ওপাশে দাঁড়ানো সারি সারি নিখুঁত মুখ। কাছে না এগিয়ে গেলে, ফুলের মতো দাঁতের হাসি দেখতে না পেলে, মিষ্টি গলার কথা শুনতে না পেলে চারপাশের সজ্জা থেকে এদের আলাদা করা অসম্ভব। 

চাবি নিয়ে পেছন ফিরতে যাব, মেয়েটি নরম গলায় ডাকল, “ম্যাম?” ফিরে দেখি ডেস্কের আড়াল থেকে মেয়েটার হাতে উঠে এসেছে মধুমাধবী সিরিজের তেইশ নম্বর উপন্যাস। মুখে এটিকেট ভঙ্গ করে ফেলার অপরাধী হাসি। এরা ভাবে অটোগ্রাফ চেয়ে এরা আমাদের বিব্রত করে। নাম জিজ্ঞাসা করলাম। মিহি গলায় মেয়েটা বলল, শ্রুতিস্মৃতা। ইদানীং ভয় হয়, কোনদিন না অটোগ্রাফ দেওয়ার আগে নামের বানান জিজ্ঞাসা করতে হয়। শ্রুতিস্মৃতাকে শুভেচ্ছা আর ভালোবাসার সঙ্গে নিজের নাম সই করে পেছন ফেরার আগেই কেয়ার শীৎকার কানে এল। 

সলেজ ধূমকেতু আবার ছুটে চলেছে দরজার দিকে। ঠাহর করার আগেই লক্ষ্যবস্তুটিকে ঘিরে ফেলেছে। আমি তাকিয়ে রইলাম। আমাকে যখন ভিড় ঘিরে ধরে তখন এ রকম দেখতে লাগে তার মানে। কিন্তু আমি তো এখানে, তাহলে ওরা ওখানে কেন? আমার পাদুটো কাঠের মেঝেতে গেঁথে রইল।

বেশ খানিকক্ষণ পর ভিড়ের পাপড়ি খুলে উন্মুক্ত হল একটি মানুষ। 

এত ছোটখাটো? পাঁচ ফুট টেনেটুনে। মোছামোছা রঙের একটা সুতির শাড়ি। হিলহীন চটি। সম্ভবত বাটার। শ্রীলেদার্সেরও হতে পারে। কাঁধ থেকে ঝুলন্ত কাপড়ের ব্যাগ। চুল টেনে পেছনে খোঁপা বাঁধা। কালো ফ্রেমের চশমার ওধার থেকে একজোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। থতমত দৃষ্টি। দোকান বাজার রেস্টোর‍্যান্টে ঢুকতে গিয়ে কিংবা সিগন্যালে দাঁড়ানো অবস্থায় গাড়ির কাচ নামিয়ে এ দৃষ্টি আমি আগে অনেক দেখেছি।  

কিন্তু এ দৃষ্টি স্পেশাল। কারণ এ দৃষ্টির আমার শত সহস্র ফ্যানের কোনও একজনের নয়, এ দৃষ্টির মালিক শর্মিষ্ঠা গুপ্ত। সাহিত্য পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন, খবরের কাগজের বইবিভাগে গত ক’মাস ধরে যার ছবি, যার প্রথম উপন্যাসের প্রশংসা আমার দিকে অহরহ চেয়ে থেকেছে। জীবনের প্রথম উপন্যাস লিখে ব্যোমকেশ রহস্য সম্মানের সেরা রহস্য ক্যাটেগরিতে মনোনয়ন যে ছাড়া আর কেউ পায়নি। আমিও না। কেয়ার সমালোচনার শিরোনাম ছিল, রহস্যের নতুন রানী? বাকিরা এতটা বাড়াবাড়ি না করলেও উচ্ছ্বাসটা সকলেরই কমন। হাতে গোনা কিছু সমালোচক আরেকটু ধৈর্য ধরার পক্ষে, অন্তত দ্বিতীয় উপন্যাসটা পর্যন্ত, কিন্তু বেশিরভাগেরই মত এ ঝড় তাৎক্ষণিক নয়।  

আমি? আমি ধৈর্য ধরার পক্ষে। গত তিরিশ বছর ধরে এ রকম নতুন রাজা নতুন রানীর দেখা আমি কম পাইনি। এখন ভাবলে হাসি পায়, কিন্তু বছর দশেক আগে কেয়া মুন্সী নিজে এই খেতাবের দাবিদার ছিল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই ধরণের জনপ্রিয়তাটা একই হাতের লেখা পড়তে পড়তে মাঝে মাঝে পাঠকের স্বাদবদলের স্বাভাবিক চাহিদা। আর কিচ্ছু না। দীর্ঘস্থায়ী জনপ্রিয়তাটা একটা সম্পূর্ণ অন্য ব্যাপার। যেটার সঙ্গে ভালো লেখার কোনও সম্পর্ক নেই। অবিশ্বাস্যরকম বেশি লোক ভালো লেখে। সত্যি বলতে কি আমার তিরিশ বছরের কেরিয়ারে খারাপ লেখা আমি প্রায় দেখিইনি। কাজেই ভালো লেখে কথাটার আমার কাছে কোনও মানে নেই। আমি কৌতূহলী জানতে এ মেয়ের আমাকে সিংহাসনচ্যুত করার ক্ষমতা আছে কি না। আমার সমান বই বিক্রির ক্ষমতা আছে কি না। টানা তিরিশ বছর ধরে বাংলাভাষার সেরা রহস্যলেখকের মুকুট পরে থাকার ক্ষমতা আছে কি না। 

শর্মিষ্ঠা গুপ্ত এখনও আমার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের ঘোরটা কেটে গেছে। এখন ওর আর কোনও সন্দেহ নেই যে আমিই আমি। মেয়েটা আমার দিকে হাঁটতে শুরু করল। 

সতর্ক হলাম। নার্ভাসনেসটা প্রকাশ হতে দেওয়া যাবে না।  

আমি আপনার খুব বড় ভক্ত। বুকের কাছে হাত জড়ো করে বলল মেয়েটা।

হেসে নমস্কার ফিরিয়ে দিলাম। 

মধুমাধবী আমার পৃথিবীর সবথেকে প্রিয় গোয়েন্দা। 

মেয়েটার বয়স এত কম ছবিতে বুঝিনি। নিঃসন্দেহে তিরিশের ওপারে। যদিও সামনের একগাছি চুল পেকেছে, আর জামাকাপড়ও পরেছে মাসিপিসির মতো।

আমি বিশ্বাস করি, ও রকম চরিত্র বিশ্বসাহিত্যে আর একটিও লেখা হয়নি।

এটাও শোনা, তবে কম। অন্তত যারা বলেছে তারা কেউই নিজেরা লেখে না। এ শর্মিষ্ঠা গুপ্ত তো? 

প্রাথমিক আবেগের ভাবটা কেটে গিয়ে মেয়েটা এখন অনেকটা সংযত।

আমার নাম শর্মিষ্ঠা। শর্মিষ্ঠা গুপ্ত।

আমি ভুরুতে বিস্ময় ফোটালাম। 

ওহ্‌হ্‌হ্‌, তুমি। তোমার কথা তো শুনেছি। 

নতুন, সাড়া ফেলা লেখকদের প্রতি এটা আমার স্ট্যান্ডার্ড উত্তর। তাদের বই পড়া সত্ত্বেও আমি কখনও বলি না যে ওহ, তোমার বই তো পড়েছি। তোমার কথা শুনেছি-র দুটো মানে হতে পারে, যে যার আত্মবিশ্বাস অনুযায়ী বেছে নেবে। এক, তোমার সম্পর্কে আমি এখনও সিদ্ধান্তে পৌঁছইনি। অথবা, আরও খারাপ, তোমাকে পড়ে দেখার মতো গুরুত্বপূর্ণ মনে করছি না। শর্মিষ্ঠার ক্ষেত্রে এ নিয়মের ব্যত্যয় করার কোনও কারণ নেই। তাছাড়া শর্মিষ্ঠা গুপ্তর বই আমি সত্যিই পড়িনি, প্রকাশকের পাঠানো কপি বাড়িতে পৌঁছোনো সত্ত্বেও। কাজেই মিথ্যাচারের পাপ হল না। কিন্তু সত্যিটাও বলা হল না। সেটা বলতে গেলে বলতে হত তোমার বই পড়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পড়িনি। কারণ তিরিশ বছরে এই প্রথম কোনও প্রতিদ্বন্দ্বীর বই পড়ে দেখতে সাহসে টান পড়েছে আমার।

মেয়েটা অপ্রতিভ হল। চোখ নামাল। ইতস্তত ভঙ্গি। নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছে। এবার নিজের বইয়ের কথা তুলবে। বলবে, আমার বইটা পড়েছেন দিদি? কেমন লেগেছে? সেরকম স্মার্ট হলে বলতে পারে, ভুলভ্রান্তি হলে শুধরে দেবেন, আপনাদের কাছ থেকেই তো শিখব।

শান্ত দুটো চোখ আবার উঠে এল আমার চোখে। 

আপনি আমার রোল মডেল ছিলেন। এখনও আছেন। আমি সবসময় আপনার মতো হতে চেয়েছি।

নিরাবরণ হাসি হাসল শর্মিষ্ঠা গুপ্ত। 


*****
                                                                                                                                   (চলবে)

দ্বিতীয় পর্ব



Comments

  1. Replies
    1. সম্ভবত আজ কালের মধ্যেই,চুপকথা।

      Delete
  2. asadharan! porer part er apekshay roilam....

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, শাশ্বত।

      Delete
  3. গল্প যেখানে থেমেছে তাতে ন্যারেটরের চেয়ে বেশি নার্ভাস পাঠক হিসেবে আমিই বোধ করছি। পরের অধ্যায়ের অপেক্ষায়, ভীষণভাবে...

    ReplyDelete
  4. Darun egoche. Bangal sahityer durbhagyo apnake akhono chakri kore khate hoi. Ar Sheorafuli-r maye der ami o pochondo kori na. Eibar ekta uponyash likhun.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে থ্যাংক ইউ, ঘনাদা। মন ভালো হয়ে গেল আপনার কমেন্ট পড়ে।

      Delete
  5. adhir agrohe apekkha korchi porer porber janyo..

    ReplyDelete
    Replies
    1. আজ পাবলিশ করার চেষ্টা করছি, কাকলি।

      Delete
  6. are katodin por galpo pelam....darunnnnnnnnnnnnnnn

    desh er feedback kemon,side e dekhlam,prachchad ta apurbo
    prosenjit

    ReplyDelete
    Replies
    1. দেশের প্রচ্ছদটা আমারও ইন্টারেস্টিং লেগেছে, প্রসেনজিৎ। এখনও পড়া শেষ হয়নি, হলে ফিডব্যাক অবশ্যই জানাব।

      Delete
  7. porer porbo ta na pora obdhi kichhu bolbo na.....

    ReplyDelete
    Replies
    1. ঠিক আছে, অপেক্ষায় থাকলাম তাহলে।

      Delete

Post a Comment