রেডি



অক্টোবরের শুরুর দিকে নাগাল্যান্ড ভবন যাওয়া হয়েছিল। অফিসের লোকজন সঙ্গে ছিল, তাই ছবি তুলিনি, অবান্তরেও লিখিনি। স্টেট ভবন ক্যান্টিনে খেতে যাওয়া আসলে যতখানি স্টেট ভবন ক্যান্টিনে খেতে যাওয়া, ততখানি কি তার থেকেও বেশি অর্চিষ্মানের সঙ্গে অপ্রত্যাশিত সময়ে অপ্রত্যাশিত জায়গায় দেখা করার মজা। সেটা এ ক্ষেত্রে হয়নি, তাই নাগাল্যান্ডকে না-চাখা স্টেট ভবনের লিস্টেই রেখে দিয়েছি এখনও। দুজনে খেয়ে এসে ব্যাখ্যান করে এসে আপনাদের জানাব। 

যাই হোক, ভবন যাওয়ার কথা উঠতে দল বাড়ানোর চেষ্টা করা হল। অফিসে যাদের ফুডি বলে পরিচিতি আছে তাদের চিহ্নিত করে প্রস্তাব দেওয়া হল। কয়েকজন রাজি হল, কয়েকজন হল না। এই দু’নম্বর দলের একজন ক’দিন আগেই Dzukou Tribal Kitchen-এ খেয়ে এসে খুব সুখ্যাতি করছিল। তাকে আমি বললাম, যাবে না কেন, চল। তাতে সে মুখ কালো করে বলল, না গো, সংযম করছি। 

কী সাংঘাতিক, কীসের? সে জানাল তার নাকি পেট ভালো যাচ্ছে না। 

আমি বললাম, সে তো ফুডিমাত্ররই হওয়ার কথা। খাবার যদি তোমাকে কাত না করতে পারল তা হলে আর তেমন খাবার খেয়ে লাভ কী। খাবারের কাছে হার মানাটাই তো ফুডির জিত। তখন সে বলল, হারব বলেই তো এখন জিতছি। পুজোয় বিরিয়ানি খেতে হবে বলে এখন খাচ্ছি না। 

বোঝাই যাচ্ছে পুজোর প্রস্তুতি লোকে শুরু করেছে অনেকদিন থেকে। আমার প্রস্তুতি এতদিন আগে থেকে শুরু হয়নি। আমার প্রস্তুতির অধিকাংশটাই বাহ্যিক চাপে। ফুটপাথে বাঁশের বেড়া যদি বসেই যায় সেদিকে তাকাব না বলে চোখ বন্ধ করে তো হাঁটা যায় না। এদিকের বেড়াহীন ফুটপাথের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে থাকা যায়, কিন্তু সেদিকে একতলা বাড়ির সমান উঁচু ব্যানারে কোন সন্ধ্যে কী প্রতিযোগিতা আর কোন শিল্পীর সমাহার ঘটা করে টাঙানো আছে।

দেরিতে হলেও নড়েচড়ে বসতেই হল। প্রথমেই ওই ক’দিনের টু ডু লিস্ট বানালাম। খাওয়া, পরা, ঘোরা। প্রথমে পরা-টা ট্যাকল করলাম। শাড়ির দোষের সীমা নেই, চলতে অসুবিধে, একগাদা অবান্তর কাপড়, গরম, লুটুরপুটুর, কিন্তু সবথেকে খারাপ হচ্ছে একশো রকম ঠ্যাকনার ব্যাপারটা। বাজার থেকে কিনে এনে পরে ফেললাম, হবে না। ব্লাউজ, শায়া, ফলস্‌, পিকো। যথারীতি সে সব কিছুই হয়নি যথাসময়ে। মা রিষড়া থেকে নতুন শাড়ি এনে পৌঁছে দিয়ে গেছেন, কোনও কোনওটা এসেছে আরও দূর দূর থেকে, পুরী কিংবা শান্তিনিকেতন, আমি সেগুলো রাস্তা পেরিয়ে দরজির দোকানে নিয়ে যেতে পারিনি। জীবনের বড় বড় ব্যর্থতার থেকে এই ছোট ছোট অপদার্থতাগুলোর গ্লানি কিছু কম নয়। মরমে মরে গিয়ে গত পরশু আলমারি থেকে শাড়ি বার করে দেখি সবক’টার ভাঁজের মধ্যে ইস্তিরি করা ম্যাচিং ব্লাউজ পরিপাটি রাখা। ফলস বসানো, পিকো সারা। 

আমি ভাবছি আমি দারুণ লায়েক হয়েছি, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, আসলে দেড় হাজার কিলোমিটার দূর থেকে মা-ই আমার জীবনটা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এখনও। 

অন্যদের পুজোর বাজারও হয়ে গেছে। বিশ্বের সবার জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী মুখস্থ করে রেখেছি, কিন্তু কে কী মাপের শার্ট পরে সেটা প্রত্যেক বছর ভুলে যাই কী করে সেটা একটা রহস্য। শাড়িকে অত গালি দিলাম, কিন্তু এই ব্যাপারে শাড়ি বেস্ট। ষোলো থেকে ছিয়াশি, সবার এক মাপ। এমনিতে সবাই বাজা মাত্র ফোন তোলে। কিন্তু দোকানে দাঁড়িয়ে পছন্দের জামা হাতে নিয়ে ফোন করুন, বেজে বেজে থেমে যাবে। শেষে বাধ্য হয়ে যেতেই হল কফি খেতে। এক চুমুক দিই, আর ফোনের দিকে আড়চোখে দেখি। শেষমেশ এল। ‘বাড়ি’ কলিং।  

করেছিলি, সোনা? 

করেছিলাম তো। শার্টের মাপ জানা গেল। তাতেও সমস্যার অন্ত নেই। বিয়াল্লিশ, চুয়াল্লিশের মাপ মুখস্থ করে এসে দেখি এদিকে সব মিডিয়াম আর লার্জ। দোকানের লোকজন কনভার্শনে সাহায্য করলেন। কিন্তু শেষটা নিজেদের চোখের ওপরই ভরসা করতে হল বেশি।

ওদিককার পাঠানো টাকা দিয়ে নিজেদের জামাকাপড়ও কেনা হল। শেষটা দেখা গেল যে সবাই সবাইকে উপহার দিয়েছে, কেবল আমি অর্চিষ্মানকে আর অর্চিষ্মান আমাকে ছাড়া। কিন্তু কী দেব? কিছুরই দরকার নেই আমাদের। ছোট বাড়িতে থাকি, অদরকারি জিনিস রাখার জায়গা নেই। তারপর একজনের কথা মনে পড়ল, যার দরকারের সীমা নেই। হলুদ এনে দিলে যার তেলের দরকার পড়ে, তেল এনে দিলে শ্যাম্পুর, ডাল এনে দিলে চালের, চানাচুর এনে দিলে যে মুখ ভেচকে বলে একটু পপকর্ন আনতে কী হয়েছিল? ইলেকট্রিশিয়ান চলে গেলে মনে করায় ওই কলটা কিন্তু পুরো বন্ধ হচ্ছে না।

আমরা বিরক্তি দেখালে আকাশ থেকে পড়ে বলে, নিজের জন্য চাইছি থোড়াই? আমার কি খিদে আছে? শখ? নাক? চোখ? মুখ? মগজ? সব তো তোমাদের জন্যই চাওয়া। 

সংসারকে জিজ্ঞাসা করলাম, কী চাও পুজোয়? বুঝলাম খুশি হয়েছে, কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করল না। বলল, অনেকদিন ধরেই যে বলছ একখানা প্রেশার কুকার দেবে? আর যদি দাওই, তাহলে ভালো কোম্পানির ভালো ডিজাইনেরই…

বাকি রইল খাওয়া আর ঘোরা। খাব তো যত্রতত্র, ঘোরার অংশটায় খানিক অভিনবত্ব আমদানির আশা রেখেছি। সি আর পার্কের ঠাকুর না দেখে থাকা যাবে না, ইচ্ছে আছে দিল্লির এদিকওদিক যাওয়ারও। লোকজনকে জেরা করে বেশ কয়েকটা প্যান্ডেলের নাম জোগাড় করেছি। তারা নাকি সব প্রাইজ পাওয়া থিম পুজো। 

অবশ্য এখানকার প্রাইজ পাওয়া পুজো দেখে কলকাতার এঁদো গলির পুজোও হেসে হেসে হেঁচকি তুলে ফেলবে। আজ সকালেই কোন একটা চ্যানেলে দেখলাম কলকাতার সেরা পুজো, সেরা কলাবউ, সেরা লুচিসুজি ঘোষণা করছে। আমার হাতের ডিমসেদ্ধ হাতেই রয়ে গেল, বললাম পুজো তো শুরুই হল না এখনও! অর্চিষ্মান বলল, আছ কোথায়, কলকাতায় পুজো শেষ হতে চলেছে। আজকাল ওখানে পুজো হয় মহালয়া টু লক্ষ্মীপুজো। শুনেই আমার ভয়ানক প্রতিবাদের ইচ্ছে হল। আমাদের কালটা কত ভালো ছিল, যতদিনের হওয়া উচিত ঠিক ততদিনের, অর্থাৎ পাঁচদিনের পুজো হত। আজকালটা কী জঘন্য। 

তারপর মনে পড়ল, আমার ছোটবেলায় সবাই বলত পুজো চারদিনের। আমি ভাবতাম মানুষ এত পাষণ্ডও হয়? ষষ্ঠীটাকে ধরছে না? মোটে পাঁচদিন, যেটা পাঁচঘণ্টার দ্রুততায় কেটে যাবে, তার থেকেও একদিন বাদ দিয়ে দিচ্ছে? আমাকে দেখেও হয়তো আজকালকার কোনও শিশু ভাবছে, নিজে বুড়ো হয়েছে বলে দেখেছ, বলছে মহালয়া নাকি পুজো না! 

পুজো যে ক'দিনেরই হোক, পাঁচ কিংবা পনেরো, আমরা প্রস্তুত। ওই ক’টা দিন থেকে আনন্দ আর আরাম (দুটো একসঙ্গে হওয়া অবশ্য অসম্ভব) নিংড়ে নেওয়ার জন্য। আপনারাও রেডি আশা করি। আমার শারদীয়ার অনেক ভালোবাসা আর ভালোচাওয়া জানবেন। সবার পুজো খুব ভালো কাটুক। 


Comments

  1. tobe ar ki .. sundar sundar chobi dekhar apekkhay :) toder pujo khub bhalo katuk, biriyani khawar ananda jeno ektuo kom na hoy! Tinni

    ReplyDelete
    Replies
    1. তোরাও অভিজিতের পুজো দেখে আয় তিন্নি।

      Delete
  2. tomar pathok ra sob pujo dekhte byasto mone hochhe :) anek shubhechha roilo, opujo bhabe katuk.

    ReplyDelete
    Replies
    1. তোমারও পুজো ভালো কাটুক, কাকলি।

      Delete

Post a Comment