এ মাসের বই/ নভেম্বর ২০১৬ঃ তিনটি নভেলা




নভেম্বর মাসের বইয়ের পোস্টের নাম হওয়া উচিত ছিল 'একটি নভেল ও তিনটি নভেলা'। নভেলটা বাদ গেল, কারণ সেটার প্রতি আমার মনোভাব এত জটিল এবং অসংবদ্ধ যে লিখতে গিয়ে প্রাণান্ত হচ্ছে। এদিকে ডিসেম্বর মাস শেষ হতে আসছে প্রায়। তাই আমি নভেল বাদ দিয়েই পোস্ট ছাপলাম। নভেলের কথা পরের মাসের (ডিসেম্বরের) বইদের সঙ্গে থাকবে। এত দেরি করে বইয়ের পোস্ট লেখার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত। 


একটা কথা আমার খুব জানতে ইচ্ছে করে।  লেখক কী করে ঠিক করেন যে কোন গল্পটা ছোটগল্প হবে, কোনটা নভেলা, আর কোনটা উপন্যাস? যে কোনও আইডিয়াকেই কি ইচ্ছে করলে ছোটগল্প, ইচ্ছে করলে নভেলা আবার ইচ্ছে করলে টেনে উপন্যাস বানানো যায়? নাকি আইডিয়াদের নিজস্ব সম্ভাবনা থাকে? লেখকের কেরামতি শুধু সেই সম্ভাবনাটাকে চিহ্নিত করায়?

*****

The Hangman/ Louise Penny


লুইস পেনির আরম্যান্ড গামাশ সিরিজের নভেলা ‘দ্য হ্যাংম্যান’। কানাডার কিউবেক অঞ্চলের থ্রি পাইনস গ্রামের পাশের জঙ্গলের একটি গাছ থেকে একদিন একটি মৃতদেহ ঝুলতে দেখা যায়। চট করে দেখে মনে হবে আত্মহত্যা। কিন্তু অফ কোর্স, চিফ ইন্সপেক্টর গামাশ একবার তাকিয়েই বুঝে ফেলবেন যে ওটা আত্মহত্যা নয়, খুন। তদন্ত শুরু হবে এবং অপরাধীরা ধরা পড়বে। 

হ্যাংম্যান আমি পড়তাম না। কারণ তার আগের খেপের রিডিং স্লাম্প চলাকালীন, ‘ইজি রিড’ হওয়ার সুবাদে আমি গামাশ সিরিজের পরপর পাঁচছ’খানা উপন্যাস পড়েছি এবং দ্বিতীয়টা প্রথমটার থেকে, তৃতীয়টা দ্বিতীয়টার থেকে এবং চতুর্থটা তৃতীয়টার থেকে ইত্যাদি . . . বেশি খারাপ লেগেছে। 

তার পরেও আমি হ্যাংম্যান পড়লাম কেন?

কারণ আরেকটা রিডিং স্লাম্প। সেলফিশ জিন ঠেলে এগোতে পারছিলাম না। আর আগের খারাপলাগাগুলোও ফিকে হয়ে এসেছিল। তাই হ্যাংম্যান শুরু করলাম। পড়লাম এবং গল্পটা শেষ করে প্লেজেন্টলি সারপ্রাইজড হলাম। গামাশ সিরিজের যাবতীয় বইয়ের মধ্যে এইটাই বেস্ট লাগল। 

তার অন্যতম কারণ শব্দসংখ্যার সীমাবদ্ধতা। গল্প ছেড়ে এদিকওদিক চলে যাওয়ার প্রবণতা, যা লুইস পেনির মধ্যে অতিমাত্রায় বিদ্যমান, সেটা এখানে করার চান্স নেই। গল্প ছোট রাখতে গিয়ে অবান্তর চরিত্রদের অকারণ ফুটেজ দেওয়ার আরামও বলি দিতে হয়েছে লেখককে। এ গল্পে গামাশ আর গামাশের সহকারী বাদে মোটা গোটা দুই চরিত্র চেনা, তাও গল্পে তাদের উপস্থিতি অকিঞ্চিৎকর। সব মিলিয়ে দ্য হ্যাংম্যান শর্ট এবং সহনীয়র থেকে খানিকটা বেশিই। পাঁচে তিন। 

*****

Rita Hayworth and Shawshank Redemption/ Stephen King


স্টিফেন কিং-এর ‘রিটা হেওয়ার্থ অ্যান্ড শশাংক রিডেম্পশন’ নভেলা শুরু করার আগে আমি ভাবলাম সিনেমাটার নামের সঙ্গে বইটার নামের মিল আছে, তার মানে কি সিনেমার গল্পের সঙ্গে কিং-এর গল্পের কোনও মিল আছে?

সত্যিটা উপলব্ধি করার পর যে গ্লানিটা জেগেছিল সেটা কাটতে লাগল মিনিট দশেক। তারপর আমি গল্পটায় ঢুকলাম। 

গল্প তো সকলেই জানেন। শশাংক হচ্ছে অ্যামেরিকার মেইন রাজ্যের একটি কাল্পনিক সংশোধনাগার। যদিও তার ভেতরের রকমসকম দেখলে আন্দাজ করা শক্ত যে সেখানে কারও কোনওরকম সংশোধন হওয়া সম্ভব। সেই জেলে অ্যান্ড্রু নামের এক উচ্চবিত্ত ব্যাংকার, স্ত্রী ও স্ত্রীর প্রেমিককে খুন করার মিথ্যে অভিযোগে সাজা কাটাতে আসে। তারপর তার জীবনে, শশাংকের তৎকালীন অধিবাসীদের জীবনে কী কী ঘটনা ঘটে তাই নিয়েই শশাংক রিডেম্পশনের গল্প। 

পোস্টারে বড় বড় করে ‘হোপ’ ইত্যাদি ছাপা দেখে সন্দেহ হতে পারে গল্পটা বোধহয় পাওলো কোয়েলহো ঘরানার, কিন্তু তা নয়। হোপ গল্পটির মূল কথা সত্যিই এবং অবিশ্বাস্য প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে যেতে বুকের ভেতরকার ‘লাইট’ অনির্বাণ রাখাটাই রিটা হেওয়ার্থ অ্যান্ড শশাংক রিডেম্পশন’-এর থিম, কিন্তু ব্যক্তিগত ভাবে আমাকে সেগুলো তত টানেনি। আমাকে টেনেছে রেড। অ্যান্ড্রু যতখানিই অবাস্তব (বা অ্যাসপিরেশনাল), রেড ততখানিই রক্তমাংসের। 

রেড শশাংকের আরেক লং-টার্ম বাসিন্দা। সম্পত্তির জন্য স্ত্রীকে খুন করে, আরও এক মহিলা এবং তাঁর নবজাতককে কোল্যাটারাল ড্যামেজ হিসেবে বলি দিয়ে, (যদিও সেটা রেডের প্ল্যানের অংশ ছিল না) রেড জেলে ঢুকেছে। এই রেডই আমাদের গল্পটা বলে। রেডের মতো কাউকে আমি চিনি না, চেনার সম্ভাবনাও প্রায় শূন্য, কিন্তু স্টিফেন কিং রেডের কণ্ঠস্বর এমন ভালো ফুটিয়েছেন যে আমার সত্যি মনে হয়েছে যে রেডের মতো রক্তমাংসের চরিত্র আমি বহুদিন দেখিনি। 

রেডকে তো ভালো লেগেছেই, তার থেকেও আমার ভালো লেগেছে নেপথ্যে থেকে রেডের গল্প বলার ভঙ্গি, বা রেডকে দিয়ে গল্প বলানোর লেখকের সিদ্ধান্ত। এই যে দরজার একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে ঘটনা ঘটতে দেখা, এইটা আমার ফেভারিট পজিশন, কী বাস্তবে, কী গল্পে। অনেকে এই ভঙ্গি পছন্দ করেন না। বলেন, বক্তার নেপথ্যচারিতা ঘটনাবলীর সঙ্গে পাঠকের দূরত্ব তৈরি করে। তাছাড়া বক্তা যদি প্লটের গুরুত্বপূর্ণ ঘুঁটি না হন তাহলে তার প্রতি পাঠকের কিছু আসা-না-যাওয়ার মনোভাব তৈরি হতে পারে, যেটা ডেঞ্জারাস। 

আমার মত উল্টো। খারাপ করে করলে হয়তো এ সব সত্যি হবে, কিন্তু ভালো করে করলে এ দৃষ্টিকোণকে মাত দেওয়া শক্ত। তাছাড়া রেড প্রধান চরিত্র না হলেও গল্পের ঘটনাস্রোতে তার অবদান অসীম। অ্যান্ড্রুর কাছের বন্ধু হওয়ার বিরল গুরুত্ব তার আছে, আবার লাইমলাইট থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার উদারতাও। 

খুঁত কি একেবারেই ধরা যায় না? যায়। আমাদের এডিটর পেপার পড়ে নাক কুঁচকে যেটাকে বলেন “ভার্বোস”। কমসম করে লিখতে পারেন না স্টিফেন কিং। সারাংশ লিখতে দিলে গোল্লা পেতেন নির্ঘাত। এই যে আশি পাতার বই, মিতভাষী লেখকের হাতে পড়লে ষাটে গোটানোই যেত বলে আমার বিশ্বাস। 

*****

Carmilla/ Joseph Sheridan Le Fanu


She used to place her pretty arms about my neck, draw me to her, and laying her cheek to mine, murmur with her lips near my ear, "Dearest, your little heart is wounded; think me not cruel because I obey the irresistible law of my strength and weakness; if your dear heart is wounded, my wild heart bleeds with yours. In the rapture of my enormous humiliation I live in your warm life, and you shall die--die, sweetly die--into mine. I cannot help it; as I draw near to you, you, in your turn, will draw near to others, and learn the rapture of that cruelty, which yet is love; so, for a while, seek to know no more of me and mine, but trust me with all your loving spirit."
And when she had spoken such a rhapsody, she would press me more closely in her trembling embrace, and her lips in soft kisses gently glow upon my cheek.

এ সব কথা আমাদের বলছে লরা। অধুনা অস্ট্রিয়ার দক্ষিণপূর্ব কোণে স্টাইরিয়া, সেখানকার এক ঘোর জঙ্গলের মধ্যে প্রাসাদে থাকে মাতৃহারা লরা আর তার বাবা। আর থাকেন সংসার আর লরাকে দেখাশোনা করার জন্য দু’জন মহিলা। তাঁরা কেউই ইংরেজ নন। তাই পাছে মাতৃভাষা বিস্মৃত হন এই ভয়ে লরা আর লরার বাবা নিজেদের মধ্যে কেবল ইংরিজিতে কথা বলেন।

সে বনের বর্ণনা শুনলেই আপনার দৌড়ে সেখানে চলে যেতে ইচ্ছে করবে।

Nothing can be more picturesque or solitary. It stands on a slight eminence in a forest. The road, very old and narrow, passes in front of its drawbridge, never raised in my time, and its moat, stocked with perch, and sailed over by many swans, and floating on its surface white fleets of water lilies.

এমন সময় এক বিচিত্র ঘটনাপ্রবাহে লরাদের বাড়িতে এক অদ্ভুত মেয়ের আগমন হয়। তার নাম কার্মিলা। সে আসার পর থেকেই প্রাসাদে এবং প্রাসাদের আশেপাশে নানারকম অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে শুরু করে। অল্পবয়সী মেয়েরা টপাটপ রহস্যময় অসুখে পড়ে মারা যায়, আমদের লরা-ও মরতে বসে। অসুখের কারণ এতক্ষণে না বুঝলে আপনি প্রতিভাবান, কার্মিলা হচ্ছে একজন লেসবিয়ান ভ্যাম্পায়ার যে অল্পবয়সী কুমারীদের বুকে দাঁত বসিয়ে রক্ত চুষে খায়।

জোসেফ শেরিডন লে ফানু কার্মিলা লিখেছিলেন ব্র্যাম স্টোকারের ড্রাকুলার প্রায় পঁচিশ বছর আগে। তখনও ছিল, এখনও কার্মিলা চাপা পড়ে আছে কাউন্ট ড্রাকুলার কালো আলখাল্লার ছায়ায়। জনপ্রিয়তার দিক থেকে না হলেও ভ্যাম্পায়ারঘরানার বিশেষজ্ঞরা চিরদিন কার্মিলার গুরুত্ব স্বীকার করে এসেছেন। প্রাচীনত্বের সুবাদে তো বটেই, তার থেকেও বেশি যৌনগন্ধী ভ্যাম্পায়ারের যে ট্র্যাডিশন চলে আসছে সেই ড্রাকুলা থেকে এই টুইলাইট অবধি, তার পথিকৃৎ হওয়ার সুবাদে। 

একটা নমুনা তো শুরুতেই দিয়েছি। লরা এবং কার্মিলার ওইরকম নিবিড় অন্তরঙ্গতার বর্ণনায় কার্মিলা ছয়লাপ। কার্মিলার সিকি শতাব্দী পরে লেখা ড্রাকুলাতেই ব্র্যাম স্টোকার যৌনতার মাত্রা অনেক কমিয়ে এনেছেন, তাছাড়া ড্রাকুলার যৌনতা মুখ্যত বিসমলিঙ্গের অর্থাৎ অনেক বেশি সামাজিক। সেদিক থেকে দেখলেও লরা এবং কার্মিলার অন্তরঙ্গতাকে সাহসিকতার বিচারে বেশি নম্বর দিতে হবে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ভিক্টোরিয়ান সমাজে, যেখানে যৌনতার নামে সবাই আঁতকে উঠে কানে আঙুল দিত সেখানে এমন গল্প লেখা হয় কী করে? এক একটা উত্তর হতে পারে সমাজটা ওরকম বলেই লেখা হয়। কার্মিলা (এবং ড্রাকুলাতেও) যৌনতা এসেছে তার ‘ইভিল’ত্ব প্রমাণ করার জন্যই। যে যৌনতার লোভ দেখায়, সে অমানুষ, ভ্যাম্পায়ার, আর যারা সে লোভের পথে পা বাড়ায় তাদের শাস্তি মৃত্যু। কার্মিলার ভিকটিমরা সকলেই মর্মরমূর্তির মতো সাদা এবং নিষ্কলঙ্কা কুমারী। শেষে এই সব মেয়েদের পুরুষ অভিভাবকরা ভ্যাম্পায়ারকে কোতল করে আবার মেয়েটিকে পাপের পথ থেকে ফিরিয়ে আনেন।

কার্মিলা পড়তে কেমন? সে সময়ের মানানসই ফুলেল ভাষা, চরিত্ররাও যথাযথ। প্রধানচরিত্রের মেয়েরা হয় ভ্যাম্পায়ার নয় ভ্যাম্পায়ারের শিকার ইত্যাদি বাদ দিলে টানটান গতি এবং শেষে রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনার মধ্য দিয়ে যবনিকাপাত। 


Comments

  1. baah... khub bhalo laglo.. sob kota porar icche roilo.. Shawshank oboshyo cinema dekhechi bole porte utsaho paini...

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, ইন্দ্রাণী। স্টিফেন কিং-এর বইটা আমার সিনেমার থেকে বেশি ভালো লেগেছে, কাজেই আপনি ইচ্ছে করলে পড়ে দেখতে পারেন।

      Delete
  2. Khali Carmilla porechhi so far. school e porte, besh bhoy peyechhilam mone achhey, tobe seta niskalonko kumari hoyar jonya noy, tar thik agei sodyo sodyo bram stroker sesh kore mone permanently dracular bhoy dhuke jaoyar jonye.

    Selfish Gene pore felo, khub interesting. Ar popular science e interest thakle seven daughters of eve, beak of finch ar phantoms in the brain porte paro.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, চুপকথা। রেকোমেন্ডেশনগুলো মাথায় রাখলাম, পেলেই পড়ব।

      Delete
  3. tomar ei book review er post gulor jonyo wait kore thaki...The selfish gene er review debe naki?
    The Double Helix, The dark Lady of DNA pore dekhte paro, bhalo lagte pare.- Bratati.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে থ্যাংক ইউ, ব্রততী। বইগুলোর নাম মনে করে রাখলাম।

      Delete
  4. কার্মিলা হচ্ছে একজন লেসবিয়ান ভ্যাম্পায়ার যে অল্পবয়সী কুমারীদের বুকে দাঁত বসিয়ে রক্ত চুষে খায়।

    jioh pagla....kakka puro..puro hollywoody plot to...besh ga chom chome..ei tumi kintu janale na sei sharodiya anondolok er sreejaat er upnyas ta kemn laglo..comedy thriller..

    prosenjit

    prosenjit

    ReplyDelete

Post a Comment