নিল গেমন'স ফার্স্ট ল + টগবগ উৎসব সংখ্যা ১৪২৪




“Picking up your first copy of a book you wrote, if there’s one typo, it will be on the page that your new book falls open to the first time you pick it up.” 
                                                                                   – Neil Gaiman’s First Law


আমার মতে বড় কথা টাইপোর চোখে পড়া নয়। টাইপোর থেকে যাওয়াটা। শুধু টাইপো হলে তবু একরকম। আরও কত কিছু যে থেকে যায়, চোখে পড়ে। কত ত্রুটি, কত গোঁজামিল। অনেককে বলতে শুনেছি নিজের লেখা ছাপার অক্ষরে দেখা নাকি নিজের সন্তানকে প্রথমবার দেখার মতো। সন্তানকে দেখে যদি কারও প্রথমেই, ‘ইস নাকটা কী বোঁচা’, ‘মাগো মাথায় কেন টাক’ ইত্যাদি মনে না হয় তাহলে তাঁর সঙ্গে আমার বিশেষ মিল নেই। 

আমাদের বঙ্কিমও বলেছিলেন, তিন মাস পরে নিজের লেখা পড়লে নাকি তাঁর ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে। ধরে নিচ্ছি, সে যুগেও টেবিল ছেড়ে প্রকাশকের টেবিল ঘুরে বই হয়ে আসতে একটা লেখার তিন মাস বা তার বেশিই লেগে যেত, কাজেই বঙ্কিমের উক্তিটাকে নিজের লেখা ছাপার অক্ষরে দেখার প্রতিক্রিয়া হিসেবেও ধরে নেওয়া যেতে পারে।

বঙ্কিম, গেমন-এরই এই, তাহলে তিনমাস পর আমার লেখার অবস্থা কী হয় ভাবুন।

নড়বড়ে গাঁথুনি, নিড়বিড়ে ভাষা, পর পর দুটো সেন্টেন্সে একই শব্দ ব্যবহার, সব বইয়ের পাতা থেকে গুলতির মতো ছিটকে ছিটকে চোখে বেঁধে। অথচ গল্পটা পাঠানোর আগে দুশোতমবার যখন চোখ বোলাচ্ছিলাম (আর একটিবারও বোলালে বমি করে ফেলতাম নিশ্চিত), এগুলো চোখে পড়েনি।

নিল গেমন আরও একটা কথা বলেছিলেন, দশ মিনিট গুগল সার্চ করে পেলাম না, প্যারাফ্রেজ করে বলছি। বলেছিলেন, তাঁর লেখক জীবনের সারাৎসার হচ্ছে  - লেখা, ছাপতে দেওয়া, ছাপা হওয়ার পর পড়ে শিউরে ওঠা এবং পত্রপাঠ পরের লেখাটা লিখতে বসা। আবার ছাপা, আবার শিহরণ, আবার লেখা, আবার ছাপা, আবার শিহরণ…

কিশোর সাহিত্য পত্রিকা টগবগ-এর উৎসব সংখ্যা ১৪২৪-এর একটা ভালো উদ্যোগ ছিল, ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের গল্পের অনুবাদ প্রকাশ। আমার দায়িত্ব ছিল কাশ্মীরী গল্প অনুবাদ করার। গল্পের লেখক এম কে রায়না ভারি ভদ্রলোক, ওঁর একটা গল্প ইংরিজি করাই ছিল, নিজেই করে রেখেছিলেন, আমি সেটা ইংরিজি থেকে বাংলা করলাম। বলাই বাহুল্য, নিজের সামান্য ফোড়ন দিতেও ছাড়লাম না। সেই গল্পটার খানিকটা তুলে দিয়েছে দেখলাম রোহণ বিজ্ঞাপন হিসেবে। পড়ে আমার শিহরণ হল। তা সত্ত্বেও, সেটাই নিচে দিচ্ছি।

টগবগ উৎসব সংখ্যা ১৪২৪ কাগজের কিনতে হলে চলে যান এইখানে

ই-বুক কিনতে হলে এইখানে 

কেনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে চাখতে হলে, এইখানে


*****

এম কে রায়না-র ‘দ্য লাস্ট গেম’ ছোট গল্প অবলম্বনে আমার অনুবাদ ‘শেষ খেলা’র উদ্ধৃতাংশ


আবার কাজে নামল লালজী। মায়ের চোখ বাঁচিয়ে রান্নাঘরের জ্বালানি কাঠকুটো হাঁটকে একটা বেশ চওড়া চ্যালা কাঠের তক্তা জোগাড় করে নিয়ে গেল রাজুভাইয়ার কাছে। নিজের গুমটির ভেতর, কানে পেনসিল গুঁজে তখন রাজুভাইয়া খুব মন দিয়ে শিরীষ কাগজ দিয়ে ঘষে ঘষে একটা কাঠের লম্বা পাটাতনকে মসৃণ করছিল। হাতের কাঠটা দিয়ে লালজী সব বুঝিয়ে দিল রাজুভাইয়াকে। পরদিন স্কুলের পরে সবাই মিলে গিয়ে দেখল রাজুভাইয়া সেই চ্যালাকাঠটাকে কেটে ছেঁটে, হাতলটাতল বসিয়ে, পালিশ-টালিশ করে দিব্যি একটা ব্যাট বানিয়ে রেখেছে। সবাই খুব খুশি হল ব্যাট দেখে, কিন্তু আসল ভয়ের কাজটাই এখনও বাকি। খুচরো পয়সাগুলো হাতে মুঠো করে লালজী জিজ্ঞাসা করল, “কত দাম ব্যাটের?” রাজুভাইয়া একবার ওদের মুখের দিকে, একবার লালজীর মুঠোর দিকে তাকাল।

“কত এনেছ?”

“চার টাকা।” মুঠো খুলে খুচরোগুলো দেখাল লালজী। রাজুভাইয়া আশ্চর্য হয়ে গেল। ব্যাটের মজুরিও তো চার টাকাই! ভীষণ খুশি হয়ে ব্যাট নিয়ে ফিরতে যাবে এমন সময় পিছু ডাকলেন রাজুভাইয়া। “ব্যাট লাগবে, বল লাগবে না?” নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করল ওরা। কাগজ গোল্লা পাকিয়ে গার্ডার পেঁচিয়ে রেডি করা আছে। রাজুভাইয়া উঠে গিয়ে দোকানের ভেতর থেকে একটা কাঠের বল বার করে দিল ওদের হাতে। বলল, “নতুন পলিসি চালু হয়েছে দোকানে, ব্যাট কিনলে বল ফ্রি।”

বসন্ত ততদিনে পুরোদস্তুর জেঁকে বসেছে মনিয়ারে। তুঁতগাছের সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে মুকুলের আভাস। হাওয়ায় কামড় উধাও। সবাই বলল, “শুভকাজে আর দেরি কেন, ম্যাচের দিন স্থির করে শত্রুপক্ষকে নেমন্তন্ন করা হোক, পিচের ধুলোয় ব্যাটাদের নাকগুলো ঘষে দেওয়া যাক।” এই ব্যবস্থায় সবথেকে বেশি যার উৎসাহ থাকবে ভেবেছিল সবাই, সেই লালজীই তেমন গা করল না। বলল, “ম্যাচ পরে হবে, তার আগে আমাদের খানিকটা প্র্যাকটিস করা দরকার।”

পরের রবিবার ভালো করে জলখাবার খেয়ে লালজী, রফিক, কুন্দন, রঘু, কবীর আর রামজী ব্যাট, বল আর তুঁতগাছের চারটে ডাল নিয়ে চলল পাড়ার বাইরের সেই কাঁটাতার ঘেরা মাঠের দিকে। ওদের সুপার সিক্স টিমের খবর এর মধ্যে চাউর হয়েছে, ওদের স্কুলেরই ছোট ক্লাসে পড়া ডজনখানেক উৎসাহী দর্শকও জুটল। মাঠের ধারে লাইন দিয়ে বসল তারা। ব্যাটিং অর্ডার স্থির করার রাস্তা আগে থেকেই ঠিক করা ছিল। চিরকুটে এক, দুই নম্বর লিখে ভাঁজ করে দুই হাতের আঁজলায় নিয়ে দাঁড়াল রামজী। চিরকুট তুলে নিল বাকি পাঁচজন। দেখা গেল লালজীর চিরকুটে বড় বড় করে লেখা আছে ‘এক’।

প্রথম বল করবে কুন্দন। নতুন বল নিয়ে কুন্দন হেঁটে হেঁটে গিয়ে দাঁড়াল উলটোদিকে। নতুন ব্যাট নিয়ে লালজী গিয়ে দাঁড়াল তিনটে তুঁতডালের সামনে। শেষবারের মতো ব্যাট ঠুকে পিচের গতিপ্রকৃতি বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করল লালজী। চোখ চালিয়ে দেখে নিল বিরোধীপক্ষের ফিল্ডারদের অবস্থান। দুই হাঁটুতে ভর দিয়ে অল্প ঝুঁকে খুনে দৃষ্টি নিয়ে লালজীকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে রঘু, রফিক, কবীর, রামজী। কে বলবে এতদিনের বন্ধু? চোখে খুনে দৃষ্টি, এক চুল ভুল করলে ‘আউট’ বলে চেঁচিয়ে উঠবে সবাই।

বুকের মধ্যে অল্প একটু কাঁপন ধরল কি লালজীর? কুন্দনকে চেঁচিয়ে বলল ও, প্রথম বলটা নেট প্র্যাকটিসের জন্য, ফলাফল যাই হোক না কেন হিসেবে ধরা হবে না। ক্যাপ্টেনের কথা অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা কারোর নেই। কুন্দন মনে মনে সবুজ খাতার পড়া ঝালিয়ে নিল। স্পিন না পেস না গুগলি? অনেক ভেবে-টেবে অল্প ছুটে এসে একটা স্পিন বল দিল কুন্দন। লালজী ডিফেন্সের ভঙ্গিতে ব্যাট তুলল, চ্যালাকাঠের ব্যাটে ঠকাস করে ঠোকা খেয়ে বল চলে গেল কুন্দনের দিকে। চটাপট হাততালি দিয়ে উঠল মাঠের চারপাশের দর্শকরা। রান হল না কোনও।

দ্বিতীয় বল। কুন্দন এবার দৌড় শুরু করেছে খানিকটা দূর থেকে। প্র্যাকটিস বল সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা করে ব্যাটসম্যানের আত্মবিশ্বাসও তুঙ্গে, বল কাছে আসার তর সইল না, এগিয়ে গিয়ে ব্যাট চালাল লালজী।

আবার ‘ঠকাস’ করে শব্দ। কিন্তু ব্যাটে তো বল লাগেনি! অথচ একটা চিৎকার উঠেছে চারদিকে, কান ফাটানো হাততালি, নিজের নিজের জায়গা ছেড়ে ফিল্ডাররা ছুটেছে কুন্দনের দিকে, সবাই মিলে জড়াজড়ি করে এখন একটাই পিণ্ড হয়ে গেছে। সবাই একদিকে, লালজী একদিকে। পেছনে ফিরে তাকাল লালজী। যা দেখল বিশ্বাস হল না তার। তিনটে ডালের মাঝেরটা মাটি থেকে উপড়ে চিৎপাত হয়ে পড়ে আছে, তখনও অল্প অল্প গড়াচ্ছে বিশ্বাসঘাতক বলখানা।



*****

গল্পের সঙ্গতে চমৎকার ছবিটি এঁকেছেন অরিজিৎ ঘোষ। 



Comments

  1. This comment has been removed by a blog administrator.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমার মনে করার কিছু নেই, দেবাশিস। আমি তো লিখিনি অরিজিন্যাল গল্প। আমার মালগুডি ডেজ কিচ্ছু মনে নেই, কাজেই মিল আছে কিনা ধরা সম্ভব নয়। আপনি বলছেন যখন নিশ্চয় আছে।

      Delete
    2. যদিও দেবাশিসের কমেন্টটা রিমুভড বাই ব্লগ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর দেখাচ্ছে, আমি কমেন্টটা রিমুভ করিনি। কেন এটা হল বার করার চেষ্টা করছি।

      Delete
  2. জানতাম আমি তোমার করা অনুবাদ ছাপা হয়ে বেরোবেই!!! দারুন ব্যাপার, অভিনন্দন!

    ReplyDelete
  3. Iye, chobi-tar songe to golper mil nei ? Na ki ami kichu bujhte bhul korlam.

    ReplyDelete
    Replies
    1. এমা, এটা তো পুরো গল্প নয়, ঘনাদা, একটা ছোট অংশ তুলে দেওয়া। ছবিটার প্রাসঙ্গিক গল্পটা এর পরে আসবে।

      Delete

Post a Comment