আর যাই করুন, মিক্স করবেন না



মান্ডি হাউসের কাছে একটা উঁচু অফিসে সেদিন যেতে হয়েছিল মিটিং-এর জন্য। যে কোনও গোত্রের মিটিংই আমার জঘন্য লাগে, তার মধ্যে সেদিনের মিটিং ছিল জঘন্যতম গোত্রের। ইটিংহীন মিটিং। প্রেমহীন বিয়ের মতোই প্যাথেটিক। 

মিটিং শেষ হল সাড়ে বারোটায়। রাস্তার উল্টোদিকে ত্রিবেণী টেরাস ক্যাফে আর রাস্তার শেষে বেংগলি মার্কেট। মার্কেটে গিয়ে চাট খেলে কেমন হয় আলোচনা চলছিল, রবিভাইসাব বললেন, বেংগলি মার্কেটের চাট ভালো কিন্তু আরও ভালো চাট হল প্রভুজির। 

প্রভুজির চাটের নাম আমি শুনেছি। দিল্লির সব চাট-উৎসাহীরাই শুনেছে। ইউ পি এস সি-র বাজখাঁই অফিসের পাশের গলিতে আরও ছোটখাটো চাটওয়ালা আছেন, কিন্তু প্রভুজির দোকানের সামনের ভিড়ই বলে দেয় ওই বনে রাজা কে। চাটু ভর্তি ঢেউ তোলা তেলের চারপাশে আধভাজা আলু আর টিক্কির ঢিপি। একদিকে গোলগাপ্পার আয়োজন, অন্যদিকে দই আর লাল সবুজ চাটনির ডেকচি। দেওয়ালে গণেশ আর শেরাওয়ালির পাশে একজন নশ্বর মানুষের ছবিতেও মালা পরানো, যাঁর মুখের সঙ্গে অনতিদূরে টোকেন নিয়ে বসে থাকা ভদ্রলোকের মুখের মিল আছে। 

একটা টিনের বোর্ডে রং দিয়ে মেনু লেখা। সবই খেতে ইচ্ছে করে কিন্তু সব তো খাওয়া যায় না, তাই অনেক ভেবে একপ্লেট আলুটিক্কি, একপ্লেট আলুফ্রাই আর একপ্লেট গোলগাপ্পার টোকেন নেওয়া হল। গোলগাপ্পা/পানিপুরি এখনও আমি কেন খাই সেটার একটা ব্যাখ্যা আমি অনেক ভেবে খুঁজে বার করেছি। বাঙালি হিসেবে গর্ব করার বিষয় এত কমে গেছে বলে। রসগোল্লার যুদ্ধে কোনওমতে হেঁচড়েমেচড়ে জেতা গেছে কিন্তু অত খাটনির জয়ে আমার রুচি নেই। আমার চাই অনায়াস, অবিসংবাদিত জয়। প্রতিবার গোলগাপ্পা/পানিপুরি খেয়ে আমি সেই জয়ের স্বাদ অনুভব করি। 

এবারেও করলাম। বাঙালি হিসেবে জন্মানোর অন্তত একটা সুবিধে সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে পরের আইটেমগুলোর দিকে এগোলাম। টোকেন হস্তান্তর হওয়ার পর চাটুর ধারে অপেক্ষারত আধভাজা টিক্কিরা হাতার ঠেলা খেয়ে ফুটন্ত তেলে পড়ে দেখতে দেখতে গনগনে বাদামি হয়ে উঠল। তারপর ওই হাতা দিয়েই টিক্কিতে চারটে খোঁচা মেরে পেট ফাঁসিয়ে তার ওপর দই, লাল এবং সবুজ চাটনি, পেঁয়াজ এবং মুলোর সরু সরু করে কাটা আচার সাজিয়ে দু’খানা কাঠের চামচ সহযোগে ভাইসাব আমাদের হাতে প্লেট তুলে দিলেন। এত খারাপ জিনিস একসঙ্গে হলে খাবার ভালো খেতে হবেই, হলও। তবে একজনের হাত টেবিল করে দুজনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চামচ দিয়ে টিক্কি কেটে খাওয়াটা গোলযোগের। আরও বিপদ, ততক্ষণে আমাদের অন্য আলু ফ্রাইয়ের প্লেটও এসে হাজির হয়েছে। 

ছোট ছোট টুকরো করা আলুভাজা গরম তেলে চাঙ্গা হয়ে ওপরে সবুজ চাটনি এবং বাড়াবাড়ি রকম মশলাপরিবৃত হয়ে আমাদের কাছে এলেন। মশলা দেওয়ার আগে ভাইসাব জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কিতনা?’ আমরা যথারীতি ‘জ্যায়াদা’ বলেছি। ঝালমুড়িতে লংকা? আলু ফ্রাইয়ে মসালা? ফুচকায় ঝাল? সব বেশি। বেশি বেশি। বেশি ঝাল দিয়ে কোনও ফুচকা মাটি হয়েছে বলে অভিজ্ঞতা নেই আমার। আর পৃথিবীতে অভিজ্ঞতা যদি আমার কোনও ব্যাপারে থেকে, এ ব্যাপারে আছে। 

ফ্রাই খাওয়ার মজা টিক্কি খাওয়ার দ্বিগুণ, যে যার টুথপিকে গেঁথে মুখে পোরো, আঙুলে দই মশলা চিটচিটে চাটনি লেগে যাওয়ার ভয় নেই। আর ওই চিটচিটে চাটনি একবার আঙুলে লাগলে আর রক্ষা নেই। হাতে হাতে ঘুরে চ্যাটচেটে হয়ে যাওয়া টোকেন একটা বড় বালতিতে সাবানজলে ঘষে ঘষে ধোওয়া হচ্ছে দেখলাম।

আলু ফ্রাই খাওয়া হল। রবিভাইসাবকে এমন সুন্দর লাঞ্চের জায়গা দেখিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ দিয়ে আমরা অফিসে ফিরে এসে বাকি দিনের কাজ সেরে বাড়ি ফিরলাম। তখনও জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ চলছিল, তাই বাড়ি ফিরে ঘর গোছালাম, ল্যাপটপ বার করে কুড়ি মিনিট টাইপ করলাম আর চল্লিশ মিনিট ল্যাব্রাডর পাপিদের প্রথম সুইমিং পুলে নামার ভিডিও দেখলাম। মেসেজ ফোল্ডারে জমে থাকা বার্গার কিং, ডাংকিন ডোনাটস, কলকাতা বিরিয়ানি হাউসের পায়ে ধরে সাধাসাধি উপেক্ষা করে ফ্রিজের খাবার গরম করে খেলাম। মায়ের কথা মনে করে একগ্লাস গরম দুধও খাওয়া হল। অর্চিষ্মান ভালোবেসে সে দুধে দু’চামচ হার্শি’জ কোকো পাউডার গুলে দিল।

মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমে ভেবেছিলাম সানডে সাসপেন্সে হাউন্ড অফ দ্য বাস্কারভিলের হাউন্ডের রক্ত জমানো চিৎকারে, কিন্তু তা নয়। ওই শীতেও গলগল করে ঘামছি, মাথা ঘুরছে, গলার কাছে যেন তিনটে বিয়েবাড়ির খাওয়া এসে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 

******


মিক্স না করা সংক্রান্ত প্রথম সাবধানবাণী শুনি জে এন ইউ যাওয়ার পর। সেই সকল রাতগুলোতে, যখন কাবেরী হোস্টেলের ছাদে বসে প্রাণপণ কুল হওয়ার চেষ্টা করছিলাম আর আমার সি জি পি এ হুড়হুড় করে নামছিল, তখন। যত খাবি খা, মিক্স করিস না। রামের সঙ্গে ভদকা না, ভদকার সঙ্গে হুইস্কি, হুইস্কির সঙ্গে বাংলা না। 

আমার মেজমামাও বলেন, মিক্স না করার কথা। মেজমামা গোল্ড মেডেল পাওয়া ছাত্র ছিলেন, যদিও তাতে কিছু প্রমাণ হয় না। পরীক্ষায় নম্বর পাওয়ার বুদ্ধি আর মানুষের সমাজে চলার বুদ্ধি দুটো সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার, এবং কোনও একটা দিয়ে অন্যটার উপস্থিতি প্রমাণ হয় না। কিন্তু আমার মেজমামার, ভাগ্নি বলে বলছি না, দুটোই পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে। মেজমামা মানা করেন বসা আর চষা মিক্স করতে। যেখানে বসবে সেখানে চষবে না, যেখানে চষবে সেখানে বসবে না। 

বসা-চষা মিক্স না করার এই নীতি বাড়িতেও পরে অনেককে মেনে চলতে দেখেছি। যেমন নাকতলার বাবা। বাবার অফিসের বন্ধু আর নাটক দেখার বন্ধু তো আলাদাই, এবং সে সব বন্ধুর সঙ্গে বাবা বাড়ির লোক মিক্স করেননি কখনও। মা করেছেন, মায়ের ছাত্রছাত্রীরা বাড়িতে আসছে, সহশিক্ষিকারা আসছেন, মা তাঁদের বাড়ি যাচ্ছেন, পিকনিকে যাচ্ছেন। এদিকে বাবার অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে বন্ধুদের সঙ্গে তিন্নিঅর্চিষ্মানের প্রথম দেখা হচ্ছে তিন্নির বিয়েতে। ‘ভাবতে পারিস?’ বলেছিল তিন্নি। সত্যি বলতে কি আমি ভাবতে পারি, কারণ অর্চিষ্মানও ওই নীতিতেই বিশ্বাস করে। আমিও করি। আমার যদি অফিসের বন্ধু থাকত তবে আমিও তাদের বাড়ির সঙ্গে মিক্স করতাম না। 

আমার বাবাও মিক্স করেন না। তাঁর নাটকের বন্ধু আলাদা ছিল, তাস খেলার বন্ধু আলাদা ছিল, এখন দীঘা আর পুরী যাওয়ার বন্ধুও আলাদা আলাদা। 

বাবার ক্ষেত্রে অবশ্য এই মিক্স না করার ব্যাপারটা বন্ধু ছাড়া অন্য দিকেও প্রসারিত হয়েছে। নেমন্তন্নবাড়িতে আজকাল বাবা মেনু দু’ভাগে ভাগ করেন। প্রথম ভাগ লেবু থেকে মাংস পর্যন্ত, দ্বিতীয় ভাগ চাটনি থেকে পান/মশলা। বাবা দু’ভাগ মিক্স করেন না। কোনও নেমন্তন্ন বাড়িতে গিয়ে যদি ঠিক করেন প্রথম ভাগ খাবেন তবে মাংস পর্যন্ত খেয়ে থেমে যান, চাটনি থেকে বাকিটুকু টেবিলের বাকিদের সঙ্গে গল্পতামাশা করে টাইমপাস করেন। আর যে বাড়িতে দ্বিতীয় ভাগ খাবেন ঠিক করেন, তখন মাংস পর্যন্ত হাত গুটিয়ে বসে থেকে তারপর চাটনি থেকে আস্তিন গুটিয়ে আসরে নামেন। বাবাকে যারা প্রথম দেখছে তারা অবাক হয়, কিন্তু বাবা যেহেতু পুরোনো হয়েছেন, বাবাকে যারা দেখছে তারা অনেকদিন ধরেই দেখছে, কাজেই অবাক হওয়াটা সইয়ে নিয়েছে।

*****

আর সেই বাবার মেয়ে হয়ে আমি প্রভুজির চাটের সঙ্গে গরম দুধ মিক্স করে ফেললাম। সেদিন রাতে যা হল, এবং যার রেশ এখনও চলছে, আমি নিশ্চিত সেটা এই মিক্স না করার গোল্ডেন রুল ভাঙার জন্যই হল। যদি শুধু চাট খেতাম কিংবা গরম দুধ তা হলে এই যন্ত্রণা এড়ানো যেত। তাই আপনাদেরও বলছি, আর যাই করুন মিক্স করবেন না।


Comments

  1. ডাংকিন ডোনাটস :( :(

    ReplyDelete
    Replies
    1. দুঃখের স্মাইলিটা কি ডাংকিন ডোনাটসের কথা মনে পড়ে বুক হুহু করার জন্য নাকি শেষ পর্যন্ত ডাংকিন ডোনাটসের এসে ঠেকার জন্য শিওর নই, ঋতম, তবে যদি প্রথমটা হয় তাহলে আমিও বলি, এই গোত্রের বাকিগুলোর থেকে (ম্যাকডি, বার্গার কিং, কে এফ সি) ডিডি আমার বেটার লাগে।

      Delete
  2. হায় রে| আমারও গত সোমবার এরকমই হয়েছিল| রাতে মাছ মাংস দুটোই খেয়ে ফেলে, ভোর সাড়ে চারটেয় ঘুম ভেঙ্গে যাওয়া, গলার কাছে বিয়েবাড়ির খাওয়া ইত্যাদি, শেষে গ্যাসের ঠেলায় মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে ঠোঁট থুতনি কেটেকুটে একসা কাণ্ড| ভাগ্য ভালো মাথাটা বেঁচেছে| আপনি এখন কেমন ?

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওরে বাবা, এ তো সাংঘাতিক, অন্বেষা। এখন সুস্থ আশা করি? আমি ওই বেছেবুছে খাচ্ছি আরকি।

      Delete
    2. 'ওরে বাবা'-ই হয়েছিল বটে ;) এখন সামলে গেছি, ওই ঠোঁটে থুতনিতে ওষুধ লাগাচ্ছি আর আপনার মতই বেছেবুছে খাচ্ছি ;)

      Delete
  3. Hahaha, bechara, khubi sangeen abastha toh, amai kintu mix er byapertay prachanda ma ER Moto

    ReplyDelete
    Replies
    1. সঙ্গিন বলে সঙ্গিন। মা শুনলে খুশি হবে কিন্তু, তুই যে এই ব্যাপারটা মায়ের মতো পেয়েছিস।

      Delete
  4. তবে আপনার ক্ষেত্রে দুধটাই বোধহয় কেলোর মূল কারণ|

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমারও তাই বিশ্বাস, অন্বেষা।

      Delete
  5. আইটেম নাম্বারে 'মিক্স করা দে' শুনে পা নাচানোর ফাঁকে খাদ্য বা পানীয়র ক্ষেত্রে সত্যিই ওই কম্মটি করলে কী হয়, তা আমি হাড়ে-হাড়ে, বা আরো সঠিক ভাবে বললে পেটে ও অন্ত্রে জানি। আন্তরিক সমবেদনা রইল।
    সংক্রান্তির দিন চাট্টি পুলি-পিঠে ম্যানেজ করে খেয়ে নিতে পারলে দেখবেন, বাংলার মা ও ঠাকুমাদের আশীর্বাদ আপনাকে ফিট অ্যান্ড ফাইন করে দেবে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সমবেদনার জন্য থ্যাংক ইউ, ঋজু। পিঠে খাওয়ার জন্য আমাদের রসরাজ ভরসা। পাটিসাপটাটা মন্দ বানায় না। আমার আবার ফেভারিট পিঠে ওটাই।

      Delete
  6. Asha kori ekhon bhalo acho Kuntala.
    Oi buffet lunch gulo te amar eyi ek e rokom obostha hoye ... mone hoye peter bhetore chicken, mangsho, chingri ar biryani ekshonge juddhe nemeche.

    ReplyDelete
    Replies
    1. এখন অনেকটা সামলে নিয়েছি, শর্মিলা। বুফে আমারও ভালো লাগে না। কোনওটাই ঠিক করে খাওয়া যায় না।

      Delete
    2. কোনটার সাথে কোনটা মিক্স করা উচিত নয় সেইটা বোঝাই মুশকিল.. বুঝে ফেলাই হল আসল..

      Delete
    3. যা বলেছিস ঊর্মি।

      Delete
  7. mandi house er kache dokan ta koathe go?? ami delhi r je du ekta jaiga chini tar modhye mandi house pore. kintu okhane gele amra ar kichu khuje na peye dubar himachal bhavan e kheyechi.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে প্রিয়াঙ্কা, হিমাচল ভবনের ঘাড়ের ওপর যে ত্রিবেণী টেরাস ক্যাফে, আমার মতে দিল্লির মুকুটে ছোট্ট একটি রত্ন। এই রইল গুগল ম্যাপের লিংক, একদিন অবশ্য করে যেও।

      https://www.google.co.in/maps/place/Triveni+Terrace+Cafe/@28.6270483,77.2311506,17.9z/data=!4m5!3m4!1s0x390cfd2cf0a98581:0x9895419ecd5a641c!8m2!3d28.6272705!4d77.2324112?hl=en

      Delete
  8. Ha jabo..Thank you. ☺️☺️

    ReplyDelete
    Replies
    1. কেমন লাগল জানিয়ো কিন্তু।

      Delete
  9. Ei mixing er rog amaro ache r barbar thekeo sikkha hoi na.Tabe amar dos nei.Baire kheye asar par e dekhi barite ma valo ranna koreche.Khabo na bala jai,bolun??Tabe apatoto jare sajjasayi hoe sab vlo eating bandho.:-((-Sunanda.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ইস, এটা খুবই খারাপ হয়েছে, সুনন্দা। তাড়াতাড়ি সেরে উঠুন এই কামনা করি।

      Delete

Post a Comment