এ মাসের বই/ডিসেম্বর ২০১৭। ২০১৭য় পড়া আমার সেরা বই।



When Breath Becomes Air/ Paul Kalanithi




 ‘Intelligence (is) not enough, moral clarity is needed.’

দু’হাজার পনেরোয় প্রকাশিত হওয়ার সময়েই পল কলানিথির মেমোয়ার ‘হোয়েন ব্রেথ বিকামস এয়ার’ সাড়া ফেলেছিল। অন্যান্য মেমোয়ারের সঙ্গে এই বইয়ের একটা তফাৎ হল, বইটি লেখার সময় ছত্রিশ বছর বয়সী পল কলানিথি জেনে গেছেন তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছে স্টেজ ফোর লাং ক্যান্সার।

মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মেমোয়ার লেখার সাহস খুব কম লোকেই দেখাতে পারে, পল কলানিথি পেরেছেন। পল কলানিথি আরও অনেক কিছু পেরেছেন, ইন ফ্যাক্ট, ক্যানসার ধরা পড়ার আগে পর্যন্ত পল কলানিথির জীবন একের পর এক ‘পারা’র মিছিল। প্রথম প্রজন্ম অভিবাসী ভারতীয় বাবামায়ের সন্তান পল সব সাবজেক্টে হায়েস্ট পাওয়া ছাত্র ছিলেন, সাহিত্য এবং সায়েন্স দুদিকেই সমান উৎসাহ এবং দখল ছিল, অবশেষে সায়েন্স বেছে স্ট্যানফোর্ডে নিউরোসার্জেন হয়ে ওঠার দশ বছরের অমানুষিক ট্রেনিং প্রায় শেষ করে ফেলেছিলেন, এমন সময় ফিনিশিং লাইন সামনে এসে দাঁড়াল। 

সবারই মনে হয়, পলেরও হয়েছিল। হোয়াই মি? 

সবাই পারে না, পল পেরেছেন। সে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উল্টে নিজেকে প্রশ্ন করতে। হোয়াই নট ইউ?

‘হোয়েন ব্রেথ বিকামস এয়ার’ একজন মেধাবী, সংবেদনশীল, শিক্ষিত, শাণিত, উদ্দীপ্ত মানুষের মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লেখা জীবনচরিত। 

পল কলানিথির পেশা তাঁকে জীবনমৃত্যু সম্পর্কে সাধারণের থেকে বেশি সচেতন করেছিল। প্রতিদিন মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়াতে হলে সম্ভবত আরেকরকমের জীবনচেতনা তৈরি না হয়ে পারে না।

Being with patients in these moments certainly had its emotional cost, but it also had its rewards. I don’t think I ever spent a minute of any day wondering why I did this work, or whether it was worth it. The call to protect life—and not merely life but another’s identity; it is perhaps not too much to say another’s soul—was obvious in its sacredness.

Before operating on a patient’s brain, I realized, I must first understand his mind: his identity, his values, what makes his life worth living, and what devastation makes it reasonable to let that life end. The cost of my dedication to succeed was high, and the ineluctable failures brought me nearly unbearable guilt. Those burdens are what make medicine holy and wholly impossible: in taking up another’s cross, one must sometimes get crushed by the weight.

অবশ্য পড়তে পড়তে আমার বার বার সন্দেহ হয়েছে, এই চেতনা পলের পক্ষে আশীর্বাদ না অভিশাপ ? কোনটা ভালো, শরীরের গতিক সম্পর্কে সম্পূর্ণ অচেতন বা আধাচেতন থেকে মির‍্যাকলের অপেক্ষায় শেষের দিনক’টা কাটানো, নাকি নিজের ভবিতব্য বাকি সবার থেকে বেশি স্পষ্ট নিজেই দেখতে পাওয়া?

At moments, the weight of it all became palpable. It was in the air, the stress and misery. Normally, you breathed it in, without noticing it. But some days, like a humid muggy day, it had a suffocating weight of its own. Some days, this is how it felt when I was in the hospital: trapped in an endless jungle summer, wet with sweat, the rain of tears of the families of the dying pouring down.

সবথেকে বেশি যে জিনিসটা আমাকে আপ্লুত করেছে, আশ্চর্য করেছে সেটা হচ্ছে মৃত্যুর গ্রাসে দাঁড়িয়ে লেখা এই বইয়ের দু’মলাটের ভেতরের প্রাণশক্তি। পল কলানিথির ‘হোয়েন ব্রেথ বিকামস এয়ার’ আমার দু’হাজার সতেরোর পড়া অন্যতম, অন্যতম ছুঁয়ে যাওয়া বই। আমি বলি আপনারাও বইটা পড়ুন এবং পড়ান।

***** 

The Music Room/ Namita Devidayal



রাগ’ন জোশের পর সুতীর্থর রেকমেন্ড করা ভারতীয় মার্গসংগীত সংক্রান্ত দ্বিতীয় মেমোয়ার পড়লাম, নমিতা দেবীদয়ালের দ্য মিউজিক রুম। পাঁচটি পার্ট, একটি প্রোলোগ এবং একটি এপিলোগ সংবলিত তিনশো দশ পাতার বই। আগের বইটির মতো এই স্মৃতিকথাটিও আর পাঁচটি স্মৃতিকথার থেকে আলাদা, এই কথার প্রধান সুতো লেখক নিজে নন, বরং তাঁর গুরু ধোন্ডুতাই কুলকার্নি। একেবারে পারম্পর্য না মেনে হলেও জয়পুর-আতরৌলি ঘরানার এই বিখ্যাত শিল্পীর গান শেখা শুরু করা থেকে নাত্থান খান, ভুরজি খান হয়ে কেসরবাই কেরকরের শিষ্যত্ব গ্রহণ পর্যন্ত সব ধাপই আছে। সংগীতজীবনের সঙ্গে সঙ্গে দেবীদয়াল তাঁর গুরুর ব্যক্তিগত জীবনেরও কথা লিখেছেন। কোলাপুর থেকে মুম্বই শহরে আসা, থাকা, দৈনন্দিন সংগ্রাম সবই। এর ফাঁকে ফাঁকে দেবীদয়ালের নিজের বেড়ে ওঠার কথা আছে, ঘরানা কাকে বলে, কোন ঘরানার কী বৈশিষ্ট্য, হিন্দুস্থানি মার্গসংগীতের ইতিহাসে হিন্দুমুসলিম অধিকারের লড়াই আছে আর আছে তৎকালীন সময়সমাজের প্রাসঙ্গিক ঘটনাবলী সংক্রান্ত আলোচনাও (বাবরি মসজিদ ভাঙা ইত্যাদি)। 

এতকিছু থাকা সত্ত্বেও আমার বইটা ভালো লাগেনি। একটা কারণ হতে পারে এর কয়েকদিন আগে পড়া শীলা ধারের রাগন জোশ-এর মতো জোরদার মিউজিক্যাল মেমোয়ার পড়ার পর সে ঘরানার অন্য যা-ই পড়ি না কেন, জোলো লাগতে বাধ্য, কিন্তু পুরো কারণটা সেটা নয়।

প্রথম কারণ, দ্য মিউজিক রুম-এর লেখনশৈলীর মধ্যে একটা দোলাচল আছে। এটা অনেক নতুন লেখকের লেখায় লক্ষ করা যায়। ব্যাপারটা মেমোয়ার না নভেল সেটা লেখক স্থির করতে পারেননি, এবং দুই রকমই লিখতে লিখতে গেছেন। এটা অবশ্য লেখকের দোষ যতখানি, এডিটরের দোষ আরও বেশি। ছোটবেলা, গান শেখার শুরু, শহরের বর্ণনা, মানুষের বর্ণনা, সবই আমরা দেখছি শুনছি দেবীদয়ালের দৃষ্টি থেকে, কিন্তু মাঝপথে হঠাৎ হঠাৎ থার্ড পার্সন আনলিমিটেড সর্বজ্ঞ দৃষ্টি দিয়ে কয়েকটি দৃশ্যের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। বইয়ের শুরুতে ধোন্ডুতাই কুলকার্নির জীবনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, একান্ত সংগোপন ও ব্যক্তিগত মুহূর্তের বর্ণনা দিয়ে শুরু করা হয়েছে। তাইয়ের নিজের বয়ানে নয়, এমনকি তাঁর মুখে শোনা দেবীদয়ালের বয়ানেও নয়, পরিষ্কার থার্ড পার্সনে। 

এ উদাহরণ আছে ভূরি ভূরি। আল্লাদিয়া খানের নাতি ‘বাবা’র সঙ্গে ধোন্ডুতাইয়ের সখ্য ছিল। তাঁরা দুজন দীর্ঘসময় একসঙ্গে গানবাজনা করতেন। লেখক লিখছেন, 

'The camaraderie between Baba and Dhondutai went well beyond the fact that they were man and woman. There was love, yes. But it was a love triangle, really, between man, woman and music. Sometimes, when Baba’s wife stood behind the door, watching the lesson, keeping her two young sons from running into the room, she felt a wincing pain within her which she could’t place. It was the knowledge that she would never be able to share with her husband the closeness that Dhondutai had, because she couldn’t speak their language.'  

‘বাবা’র যে স্ত্রীকে লেখক জীবনে কোনওদিন দেখেননি, এবং এই সব ঘটনার সময় যিনি ধারেকাছেও ছিলেন না, সেই স্ত্রী দরজার পেছনে দাঁড়িয়ে কী ফিল করছেন সেটা সন্দেহ করা একরকম, আর কনফিডেন্টলি লিখে দেওয়া আরেকরকম। ওই মুহূর্তে 'বাবা'র স্ত্রী রক্তমাংসের মানুষ নয়, উপন্যাসের চরিত্র।  

এ রকম উদাহরণ আরও আছে। 

'A few nights later, Gopaldas was over at Kesarbai’s house. They lay in bet together and discussed this great new development in her life. It was quiet, except for the distant sound of the sea lapping gently against the city. The bed cracked as Gopaldas turned on his side to face his lover, resting his head on his elbow.
‘Kesar,’ he said, gently.
‘Yes, Seth?’ She looked at her benefactor and smiled. 
‘You know what the Khansahib has said, don’t you?’
‘Yes, that I must not have any more children if I wish to learn under him.’
‘That means we must not meet like this any more,’ he whispered to her. ‘We will continue to be good friends and you will always be my confidante.’
‘Yes, Seth.’'

রিভিউ লেখার প্রধান শর্ত হচ্ছে শিল্পকর্মের রিভিউ করা, শিল্পীর নয়। কিন্তু আমি সেই শর্ত ভাঙতে চলেছি। 'দ্য মিউজিক রুম' আমার খারাপ লাগার দ্বিতীয় এবং প্রধান কারণ হচ্ছে লেখক নমিতা দেবীদয়ালকে আমার ভালো লাগেনি।

আত্মপক্ষ সমর্থনের একটা অপচেষ্টা করা যাক। সাধারণত ওয়ার্ক অফ ফিকশনে লেখককে অনেকাংশে অগ্রাহ্য করে থাকা যায় (যদিও আমার বিশ্বাস ড্রাগন আর ইউনিকর্নের প্রেমের গল্প লিখলেও সে লেখা থেকে লেখক নিজেকে বাদ দিতে পারেন না) কিন্তু যিনি নিজের জীবনের কথা লিখছেন, যে রচনার মুখ্য চরিত্র লেখক নিজেই, সেখানে লেখককে পছন্দ করা না করা প্রায় গল্পের প্রোটাগনিস্টকে পছন্দ করা না-করার মতোই স্বাভাবিক হয়ে পড়ে।

আর সেখানেই মিউজিক রুম আমার কাছে মাটি হয়েছে। ফার্স্ট পারসন থার্ড পারসন গোলমাল নয়, স্মৃতিকথা এবং জীবনীর কনফিউশন নয়, আমার কাছে দ্য মিউজিক রুম মাটি করেছেন লেখক নমিতা দেবীদয়াল স্বয়ং। 

এইখানে একবার শীলা ধারের প্রসঙ্গ তুলতে হচ্ছে। শীলা ধার প্রিভিলেজড পরিবারে জন্মেছিলেন এবং সে প্রিভিলেজ সম্পর্কে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন, কিন্তু তিনি ভারতবর্ষের প্রায় গোটা পপুলেশনের থেকে তিনি কোথায় কোথায় আলাদা সেটা আন্ডারলাইন করতে করতে জীবনের মধ্যে দিয়ে হাঁটেননি, অন্তত রাগ’ন জোশে তেমন কোনও প্রমাণ আমি পাইনি। নমিতা দেবীদয়াল সেটাই করেছেন। মুম্বাইয়ের তাঁর পশ পাড়া থেকে গুরুর নিম্নমধ্যবিত্ত পাড়ায় গান শিখতে যাওয়ার বর্ণনা প্রায় নন্দাদেবী বেসক্যাম্পে ট্রেক করতে যাওয়ার বর্ণনা। মুম্বইয়ের ট্রেনের সেকেন্ড ক্লাস কম্পার্টমেন্টে চড়ার অভিজ্ঞতার বর্ণনাও অনুরূপ। এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে, নিজেকে এই আলাদা করার প্রক্রিয়াটা লেখকের দুদিকেই সমান সক্রিয়। তাঁর ইংরিজি মিডিয়াম স্কুলের ট্যাঁশ বন্ধুদের তাঁর মার্গসংগীতের ব্যুৎপত্তির মর্ম বুঝতে অক্ষমতা এবং তানপুরাকে ফ্যালিক সিম্বল ভেবে অ্যামেরিকান সহপাঠীদের ঠাট্টা ইত্যাদিও লেখকের সমান খেদের জন্ম দিয়েছে। 

আরও চমকপ্রদ হচ্ছে দেবীদয়ালের কস্তূরী মৃগ সিনড্রোম। স্কুলের গানের কম্পিটিশনে তিনি নাম দিলেন এবং ‘naturally I won.” গোটা বইতে মিনিমাম পাঁচবার  লেখক আমাদের মনে করিয়েছেন যে ধোন্ডুতাই তাঁকে ‘কেসরবাই কেরকর’-এর সঙ্গে তুলনা করতেন। একবার ‘বাবা’কে লেখকের গান শোনানোর সুযোগ হয়েছিল। 

'I sang Raga Bhoop for Baba, and happily noticed that he responded to my full-throated rendering with great enthusiasm.'

নিজের চোখে না পড়লে আমিও বিশ্বাস করতাম না।

কবে কোথায় কোন খবরের কাগজে চার লাইন তাঁর গান এবং কেসরবাইচিত কণ্ঠের প্রশংসা বেরিয়েছিল সেটা উদ্ধৃতিচিহ্নের ভেতরে লাইন বাই লাইন তুলে দেওয়া থেকেও নিজেকে সামলাতে পারেননি লেখক।

বলাই বাহুল্য, যাঁরা নিজেকে বেশি নম্বর দেন, আশেপাশের সবাইকে তাঁদের ক্রমাগত কম নম্বর দিয়ে যেতেই হয়।  রীতিমত ছোট বয়স থেকেই আশেপাশের সমবয়সী ছেলেমেয়ের সাংগীতিক বোধের অভাব লেখকের নজর এড়ায়নি। কবে কোন সতীর্থর গান শুনে 'এ মেয়ের গান হবে না' বলে গুরু মাথা নেড়েছিলেন, সে সবও সাড়ম্বরে মিউজিক রুমে জায়গা পেয়েছে।

সত্যি বলছি, একটা সময়ের পর আমি গোটা ব্যাপারটার প্রতি এত বিরূপ হয়ে পড়েছিলাম যে বইটাতে মারাত্মক দামি কিছু লেখা থাকলেও সেটা আমার চোখ এড়িয়ে গেছে।

*****

My Name is Lucy Barton/ Elizabeth Strout



এলিজাবেথ স্ট্রাউটের ‘মাই নেম ইজ লুসি বার্টন’ একশো তিরানব্বই পাতার ছোট্ট উপন্যাস। লুসি বার্টন নিউ ইয়র্ক সিটির একটি হাসপাতালে ভর্তি। লুসির মা, ইলিনয় রাজ্যের একটি ছোট গ্রাম অ্যামগ্যাশ থেকে লুসিকে দেখতে এসেছেন। হাসপাতালের ঘরের ভেতর মা মেয়ের কথোপকথন ‘মাই নেম ইজ লুসি বার্টন’ উপন্যাসের উপজীব্য। এই কথোপকথন থেকে আমরা জানতে পারি যে লুসির সঙ্গে লুসির পরিবারের বহুদিন কোনও যোগাযোগ নেই। আমরা জানতে পারি অ্যামগ্যাশে অকথ্য দারিদ্র্য এবং প্রায় একঘরে হয়ে বড় হয়ে ওঠা লুসির ছোটবেলার কথা, নিজের চেষ্টায় সেই দারিদ্র্য থেকে পালিয়ে নিজের জীবন গড়ে তোলার কথা। এই সব পরিস্থিতিতে অনেক ক্ষেত্রেই যা হয়, যে পালালো আর যারা পড়ে রইল তাদের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়। লুসি এবং লুসির পরিবারের মধ্যে এই দূরত্ব অনতিক্রম্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। লুসির চেষ্টার অভাবে নয়। লুসি নিয়মিত ফোন করে, নিজের সন্তানদের জন্মের খবর দিয়ে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেছে, উল্টোদিক থেকে কোনও রকম চেষ্টা তো হয়ইনি বরং লুসিকে স্পষ্ট বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে যোগাযোগ রাখতে তাঁরা উৎসাহী নন। এই পরিস্থিতিতে লুসির অসুস্থতার সময় লুসির স্বামী শেষ চেষ্টা হিসেবে লুসির মাকে মেয়েকে দেখতে আসার অনুরোধ করেন, এবং মা রাজি হন।

লুসির মা স্বাভাবিক নন।  স্নেহশীল মা বলতে যে ছবিটা আমাদের মনে ভেসে ওঠে সেটার সঙ্গে লুসির মায়ের কোনও মিল নেই। তিনি নিষ্ঠুর এবং জাজমেন্টাল। গল্প এগোনোর সঙ্গে সঙ্গে লুসির ছোটবেলায় আরও অনেক ট্রমা বেরিয়ে পড়ে, লুসির বাবার যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বয়ে আনা মানসিক ক্ষত, বাড়ির লোকজনের সঙ্গে আচরণে তার প্রভাব, লুসির দাদার হোমোসেক্সুয়ালিটি ইত্যাদি। এ ছাড়াও আবছা যৌননিগ্রহের আঁচও আছে। 

এলিজাবেথ স্ট্রাউটের লেখা এটা আমার পড়া দ্বিতীয় উপন্যাস। প্রথম পড়া অলিভ কিটরিজ-এর মতোই, মাই নেম ইজ লুসি বার্টন - ও প্রধান চরিত্রদের পাশাপাশি একটা গোটা অঞ্চলের গল্প। অ্যামগ্যাশের বিবিধ চরিত্র এবং তাদের জীবনের ঘটনা এমন সুন্দর করে, অল্প কথায়, এমন সহমর্মিতার সঙ্গে লেখক বলেছেন যে অতি অল্প কথায় শেষ হলেও সে চরিত্রগুলো পাঠকের মনে থেকে যায়। 

*****

দু’হাজার সতেরোর আমার প্রিয় বই


দু’হাজার ষোলোয় যেমন একাধিক বই প্রিয় হয়ে ওঠার লাইনে লাফ দিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল, এ বছর তেমন ঘটেনি। বেশ কিছু বই ছুঁয়ে গেছে। হানা কেন্টের ‘বেরিয়াল রাইটস’, ইয়া গিয়াসির ‘হোমকামিং’ চমৎকার লেগেছে, পল কলানিথির ‘হোয়েন ব্রেথ বিকামস এয়ার’ জীবনের অনিত্যতা আবার মনে করিয়ে দিয়েছে, ডন ডে লিলো-র হোয়াইট নয়েজ কিচ্ছু বুঝতে পারিনি, সোফি হানার ‘মোনোগ্রাম মার্ডারস’, ‘ ক্লোজড কাসকেট’ বাকিদের যত খারাপ লেগেছে আমার তত লাগেনি, আবার এমিলি সেন্ট জন ম্যান্ডেল-এর ‘ষ্টেশন ইলেভেন’ আর চিম্মামান্ডা এনগোজি আদিচিয়ে-র ‘অ্যামেরিকানা’-কে মনে হয়েছে ওভারহাইপড। কিন্তু এদের কোনওটা পড়েই সেই ফিলিংটা হয়নি, যেটা স্টোনার পড়ে হয়েছিল,  আ গার্ল ইজ আ হাফ ফর্মড থিং’ কিংবা ‘ক্যাজুয়াল ভেকেন্সি’ পড়ে।

আর কে কীভাবে বইয়ের বিচার করে জানি না, আমি সর্বদা আমার ‘ফিলিং’ দিয়ে করি। বইটা পড়ার মুহূর্তটায় আমার কী ফিলিং হচ্ছিল। আমার সব প্রিয় বই পড়ার মুহূর্ত আমার মনে আছে। মায়ের সঙ্গে বসে সুকুমার সমগ্র পড়ছি, বইয়ের দোকানের সোফায় বসে হ্যারি পটার, হোস্টেলের একটিমাত্র জানালার পাশে চেয়ার টেনে বসে মিস মার্পলের পড়া গল্পগুলো আবার পড়ছি। ওই সময়টার বাকি সব ভুলে গেছি, খালি ওই মুহূর্তগুলো ভুলিনি, ভুলতে চাইও না। 

সেই ‘ফিলিং’ দিয়ে বিচার করলে গত বছরের মোটে একটি দিনের কথা আমার মনে আছে। শরীর খারাপ ছিল, একমাত্র পথ্য ছিল চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা। আমি চাদরের ভেতর শুয়ে শুয়ে একটা মোটা বইয়ের পাতা ফসফস করে উল্টোচ্ছিলাম আর অর্চিষ্মান ফোন করলে, 'না না একটুও কষ্ট হচ্ছে না, এখন রাখি, হ্যাঁ?' বলে কট করে ফোন কেটে দিচ্ছিলাম। বই যখন শেষ হল, মনে পড়ল গত পাঁচঘণ্টায় গলাব্যথা টের পাইনি, মাথাব্যথাও না। পাঁচঘণ্টায় পড়া সেই বইটাই আমার এ বছরের পড়া সেরা বই। ম্যাগপাই মার্ডারস। 



Comments

  1. Kuntala, tomar post gulo bhari inspiring..khub enjoy kori... Happy New Year !Bhalo theko...

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ,থ্যাংক ইউ, মধুজা। নতুন বছরের শুভেচ্ছা আমার তরফ থেকেও।

      Delete
  2. Paul er boita pore amio bohukkhon chup kore chhilam

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, চুপকথা, চুপ করে থাকার মতোই বই।

      Delete
  3. Magpie Murders ta age e porechi,tbe kindle a,amar ma jetake boi parar madhey ganno kare na.Pratham r tritio boi duto parbar khb iccha ache.Dkha jak katodine pore uthte pari.-Sunanda.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা সুনন্দা, আমি তো বেশিরভাগ সময় কিন্ডলেও পড়ি না। ল্যাপটপে ব্রাউজার খুলে পড়তে থাকি। পল কলানিথির বইটা ভালো লাগতে পারে।

      Delete
  4. পল কলানিথির বইটি পড়ার ইচ্ছে রইল। ম্যাগপাই মার্ডারস আমার মতেও ২০১৭-র অন্যতম সেরা বই, গুডরিডস-এ সেইমতো একখান রিভিউ করেও এসেছি। তবে উপন্যাস আমি কম-ই পড়ি, বেশি পড়ি কোনো লেখকের ছোটোগল্পের সংকলন, আর অ্যান্থলজি। তাদের মধ্যে অনেকগুলোই ভালো লেগেছে, যদিও তালিকা বানাতে বসলে চাপ হয়ে যাবে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ম্যাগপাই মার্ডারস ভালো লাগায় হাই ফাইভ, ঋজু। আমার আবার সংকলন (এক বা একাধিক লেখকের) বেশি পড়া হয় না। যদিও অনেকগুলো জমেছে বাড়িতে। দেখি, এ বছর একটা একটা করে নামানোর চেষ্টা করব। কলানিথির বইটা রেকমেন্ড করছি।

      Delete
  5. prothom boi ta porte hocche. magpie murders amaro 2017 r sera boi, jodio ami tomar moto ato boi porte pari na. magpie murders ami icche kore olpo olpo kore porte cheyechilam but ta sotteo 2diner modhye sesh hoye gechilo.

    ReplyDelete
    Replies
    1. কলানিথির বইটা পড়তে পারো, কুহেলি, মনে হয় ভালো লাগবে।

      Delete
  6. Magpie Murders porini.. Pragati Maidan book fair theke definitely nie asbo!
    HNY :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাপি নিউ ইয়ার তোমাকেও, রণদীপ। আমাদের এখনও বইমেলা যাওয়া হয়নি।

      Delete
  7. Ha ha ha!! Namita Devidayal ke as a person amar-o mote bhalo laage ni. Kintu ami oi boita theke lekhika ke shompurno minus kore diye sref Dhodutai Kulkarni-r jeebon o jeebon-dorshon hishebe otake podechhilam.

    Sheila Dhar-er shonge tulona korle Dhondutai-r jeebon khub-i jolo, kono shondeho nei. E jyano Jagyobolko-r dui bou Katyayanii (swami-shorboshyo, grihokormo nipuna) ar Maitreyi (mahabidhushi, bromhogyan-shomponna) -r modhye tulona. Orthat tulonai chole na. Kesarbai, Gangubai, Hirabai er poriprekkhite Dhondutai Hindustani Classical Music-er ekjon nobody. Jar fole onar jeebone bolar moto kahinir ekantoi obhab. Ta shotteo Dhondutai-r mulyobodh (shongeet ebong jeebon, dutoi) ebong ekakeetyo ke jebhabe Namita Devidayal futiye tulechhen, tar jonyo ami ontoto kritogyo (lekhikar byaktigoto stupidity gulo shotteo). Ota jeeboni na uponyash oi proshno ta amake kono peeda-i dey ni. Lets put it this way: they do not make them like that (Dhondutai) any more.

    Jaakge, no book is the same for any two readers. Kajei paath-parthokyo to hotei pare. Tobe boita apnake etota hotash korbe dhorte pari ni. Sorry!


    Sheila Dhar +1 ar Namita Devidayal -1 dhorle pore, amar goodwill level ei muhurte 0! Fair enough, fresh start for the new year.


    Magpie murders shombondhe amar motamot agei bolechhi, kajei ar repeat korlam na. Onyota podar iccha roilo.

    iti
    Shuteertho

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে সুতীর্থ, গুডউইলের প্রশ্নই ওঠে না। আপনি আমাকে একটা বই পড়ালেন (একাধিক পড়িয়েছেন অলরেডি, কিন্তু আমি কথার কথা বলছি আরকি) সেটার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। বই রেকমেন্ড করার বন্ধু বেশি থাকে না। বই কেমন লাগবে সেটা পরের কথা। আমার মতে অ্যাট অল কথাই নয়।

      Delete
  8. "কোনটা ভালো, শরীরের গতিক সম্পর্কে সম্পূর্ণ অচেতন বা আধাচেতন থেকে মির‍্যাকলের অপেক্ষায় শেষের দিনক’টা কাটানো, নাকি নিজের ভবিতব্য বাকি সবার থেকে বেশি স্পষ্ট নিজেই দেখতে পাওয়া?"..Benche thaka tai miracle. Amara bhison for granted nie etake.

    ReplyDelete
    Replies
    1. তা ঠিক, প্রিয়াঙ্কা 

      Delete
  9. আচ্ছা আপনার কি ভ্রমণ কাহিনী পড়া হয় না?যদি হয় তাহলে কি রিভিউ পেতে পারি ?
    আর কিভাবে কোন ব্লগার এর কাছে অনুমোদন এর অনুরোধ করতে পারি? যেসব ব্লগ বন্ধ থাকে পাবলিক এর কাছে সেসব এর কথা বলছি

    ReplyDelete
    Replies
    1. ভ্রমণকাহিনী সত্যিই আমার বেশি পড়া হয় না। পড়লে আর ভালো লাগলে (বা লোক ডেকে জানানোর মতো খারাপ লাগলেও) নিশ্চয় রিভিউ লিখব।

      প্রাইভেট ব্লগে প্রবেশাধিকার পেতে গেলে সম্ভবত ব্লগের মালিককে মেল করে অনুমতি চাইতে হয়। আমার অভিজ্ঞতা নেই, তাই এর বেশি বলতে পারলাম না।

      Delete
  10. অনেক ধন্যবাদ ।আপনার জন্য শুভেচ্ছা
    আর The magpie murders এর পিডিএফ লিংক কি কোথাও পাওয়া যাবে?খুব পড়ার ইচ্ছা ছিল ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমার লিংকের কথা জানা নেই। দুঃখিত।

      Delete
  11. বাংলা বা ইংরেজি ব্লগ যেগুলোতে অনেকটা আপনার ব্লগ এর মতোই নিত্য দিন বা বইয়ের বিষয়ে ঝরঝরে লেখা পাওয়া যায় এরকম কিছু লিংক (আপনার লিংক স গুলো বাদে )সুযোগ হলে দেওয়া যাবে কি

    ReplyDelete
  12. Bah Kuntala, boi gulor description bhalo laglo. Prothom boi ta portei hobe mone hocche. Namita debir boita ami porbona, tobe My Name is Lucy Barton amaro khub bhalo legechhe, ami Olive Kitteridge tao porbar taal e acchi.

    Magpie Murders somporke age bolechhi, bohudin bade ekta classic mystery porlam :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. এ ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ একমত, অরিজিত। ম্যাগপাই মার্ডারস আমার বহুদিন বাদে পড়া ক্লাসিক মিস্ট্রি। লুসি বার্টন ভালো লেগে থাকলে অলিভ কিটরিজ শিগগিরি পড়ে ফেলুন, আরও বেশি ভালো লাগবে।

      Delete
  13. Somproti Maurice Leblanc er srishti Arsene Lupin porchhi. Forashi chor er golpo. Maurice Leblanc Conan Doyle er somoyer lok, infact, forashi te Sherlock Holmes er somogotriyo ekjon ke srishti korar tagide uni Arsene Lupin k srishti korechhen. Sudhu tai noy, Holmlock Shears namok ekjon goyendar songe eke loriyeo diyechhen.
    Besh mojadar golpo gulo, pele pore dekhte paren.
    Obosso jodi er modhyei na pore thaken. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. পড়া নেই পড়া নেই! থ্যাংক ইউ, অরিজিত।

      Delete

Post a Comment