কাঠ



আমার পুরোনো ছবি দেখতে ভালো লাগে না। যে সব ছবিতে আমাকে দারুণ দেখতে লাগছে, সে সব ছবিও না। বাড়ির ছাদে কিংবা ইউনিভার্সিটির মাঠে, দোলের রং মেখে কিংবা রেস্টোর‍্যান্টে ক্যান্ডলাইটের আলোয়, কোনও জায়গায় কোনও পরিস্থিতিতে তোলা ছবিই না। কারণ একটা পার্টিকুলার মুহূর্তকে বন্দী করলেও ছবি দেখতে বসে আমি শুধু সেই মুহূর্তটা দেখি না, আশেপাশের অনেক মুহূর্তও দেখতে পাই। এক বা একাধিক ছায়া। একটা ফোনকল বা একটা কথোপকথন। মুহূর্তের হাসির আর সুখের ছটায় অন্ধ কুন্তলার গোচরের আড়ালে, সাত দিন কিংবা তিন মাস, ম্যাক্সিমাম ছ’মাস দূরে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে। আচম্বিতে আড়াল থেকে যখন ঘাড়ে লাফিয়ে পড়বে তখন হাসি কেমন উড়ে যাবে, সেই কল্পনায় তাদের ঠোঁট বঙ্কিম।

পুরোনো ছবি দেখলে তাই আমার আরাম হয় না। আফসোস হয়। যদি সাবধান করতে পারতাম। যদি ফোটোর ভেতর হাত বাড়িয়ে ওই অজ্ঞান, অচেতন মেয়েটার কাঁধে টোকা দিতে পারতাম। 

অত না হেসে পড়তে বস। 

*****

অর্চিষ্মানের ফোনে আমাদের দুজনের একটা ছবি আছে। বছর ছয়েক আগের। আমরা তখন আই ব্লকের বাড়িটাতে থাকতাম। ডিসেম্বর মাস ছিল। তিন্নি এসেছিল দিল্লিতে। কোনও একটা শনি বা রবি তিনজন বেড়াতে বেরিয়েছিলাম। কনট প্লেস আরও কোথায় কোথায় ঘুরে হুমাউন’স টুম্ব। আমাদের অন্যতম ফেভারিট জায়গা। তিন্নিরও ভালো লেগেছিল। হাসিহাসি মুখের প্রচুর ছবি তোলা হয়েছিল সকলের। 

এই ছবিটা তিন্নি তুলে দিয়েছিল। টুম্বে ঢোকার মুখে ডানদিকে একটা পাঁচিলঘেরা জায়গা আছে। পাঁচিলের ভেতরদিকের সারি সারি খোপে নাকি টুম্বের কারিগররা থাকতেন। পাঁচিলের গায়ে কাঠের পেল্লায় দরজা, দরজায় লোহার নাটবল্টু হীরেজহরতের মতো গাঁথা। দরজার সামনে অর্চিষ্মান আর আমি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। অর্চিষ্মানের গায়ে কালো সোয়েটার, আমার বেগুনি। কাটছি কাটব করেও না-কাটা চুল ঝাঁপিয়ে অর্চিষ্মানের ডানচোখ ঢেকে ফেলেছে। আমার চশমার কাঁচে, কুচো চুলের ডগায় সোনালি রোদ চিকচিক। খুব হাসছি দুজনে।

অর্চিষ্মান বলে, এটা আমাদের একসঙ্গে তোলা বেস্ট ছবি। 

পুরোনো ছবির সঙ্গে আমার সম্পর্ক মুহূর্তের জন্য বিস্মৃত হয়ে হাত বাড়াই। কোনটা দেখি?

একনিমেষ তাকিয়েই বুকের ভেতর ছ্যাঁৎ করে ওঠে। তাড়াতাড়ি ফিরিয়ে দিই। অর্চিষ্মান বলে, ভালো না? 

ঠোঁট টিপে ঘাড় নেড়ে ল্যাপটপের স্ক্রিনে মুখ ফেরাই। 

অর্চিষ্মানের পাশে দাঁড়িয়ে সাড়ে পাঁচবছর আগেকার যে কুন্তলা হাসছে, ও জানে না ওর জন্য কী অপেক্ষা করে আছে। 

ও জানে না, আর বছরখানেকের মধ্যে ভুল করে ড্রায়ারে ঢুকিয়ে দিয়ে সাধের বেগুনি সোয়েটার আর পরার যোগ্য থাকবে না। চশমার ফ্রেম বদলাবে আরও দু’বার। দু’বার পা ভাঙবে (আগের বত্রিশ বছরে একবারও ভাঙেনি, ভাবা যায়?)। অর্চিষ্মানের চুল আর কোনওদিন অত লম্বা হবে না, চশমার পাওয়ার বাড়বে, গোড়ালি একবার ভাঙবে, একবার থুতনি কাটবে, একবার জন্ডিস।

খালি ওই হাসি আর দুজনের ঘেঁষাঘেঁষি দাঁড়ানোর ওই আরাম আর নিশ্চিন্তি আর ভালোলাগাটুকু একই থাকবে। পাঁচবছরের গার্হস্থ্যের ঘষটানি রোদের সুখটুকুতে শান দিয়ে এত তীব্র, এত ঝকঝকে করে তুলবে যে ছবিতে চোখ ফেলা মাত্র চোখে এসে বিঁধে যাবে। গলার কাছে আটকে গিয়ে দম বন্ধ করে দেবে।

*****

আমার চশমার কাঁচ আর চুলের ডগার জীবনভরের রোদ্দুরকে, হ্যাপি কাষ্ঠজয়ন্তী।


Comments

  1. অনেক অভিনন্দন। ভাল থাকুন, কলম/ কিবোর্ড চলুক

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ, ঋতম।

      Delete
  2. Ki sundor, ki sundor. Bibahobarshikir shubhechcha! :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. অসংখ্য ধন্যবাদ, বিম্ববতী।

      Delete
  3. আপনাদের জীবন সুখের হোক। ওই যে হিন্দিতে বলে না - হাঁসি কি নজর উতারনি পড়ে - ওইরকম সুখের জীবন হোক আপনাদের।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, দেবাশিস। আপনার মুখে চপকাটলেট পড়ুক।

      Delete
  4. Aei kaath, rupo hoye, shona hoye, hera hoye shukhi hok. Bhalo theko dujoney.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ।

      Delete
  5. Happy anniversary tomader ke Kuntala! Onek shubheccha o bhalobasha niyo.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, শর্মিলা।

      Delete
  6. Happy Anniversary Kuntala-Archisman. Khub khub bhalo thakun dujone :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, অরিজিত।

      Delete
  7. Anek shubheccha😊😊 ami chobigulo abar baar kore dekhlam.orakam arekta trip e bachar kortei hobe!!

    ReplyDelete
    Replies
    1. একদম। শিগগিরই করতে হবে, তিন্নি।

      Delete
  8. Happy anniversary Kuntala di.. tomar reception er benarasi ta khub sundor chilo sob anniversary post ei amar mone pore jay.. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওহ তাই বুঝি? শুভেচ্ছার জন্য অনেক ধন্যবাদ, ঊর্মি।

      Delete
  9. শুভ বিবাহবার্ষিকী কুন্তলাদি ।এভাবেই একসাথে "ওই হাসি আর দুজনের ঘেঁষাঘেঁষি দাঁড়ানোর ওই আরাম আর নিশ্চিন্তি আর ভালোলাগাটুকু " নিয়ে আগামীর দিন কাটুক । ^_^

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, প্রদীপ্ত।

      Delete
  10. Happy anniversary Kuntala di .chobi ta ki Amra dekhte pabo?

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, প্রিয়াঙ্কা। স্যাডলি, ছবি দেখার সম্ভাবনা নেই। ভেরি সরি।

      Delete
  11. অসম্ভব ভালো লেখা, শুভ বিবাহবার্ষিকী! কিন্তু পড়তে পড়তে কেন যেন গা টা শিরশির করে উঠলো! এই সামনের অজানার ব্যাপারটা এতো সত্যি, আমরা তো আভাস পাইনা হাসি হাসি মুখে ছবি তোলার সময়..

    ReplyDelete
    Replies
    1. মনে না থাকাই ভালো বোধহয়, কাকলি, না হলে আর হাসতে হত না। শুভেচ্ছার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

      Delete
  12. মানুষকে এত ভয় দেখিয়ে কী আনন্দ পান বলুন তো? যখন আপনি ফটো দেখে ওইরকম প্রতিক্রিয়ার কথা লিখলেন তখন বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠেছিল!
    শেষে সোয়েটার! চশমার ডাঁটি!!
    এনিওয়ে, স্মরণীয় দিনটি আনন্দময় হোক। গল্পরা ডানা গুটিয়ে বসুক আঙুলের ডগায়। হাসিটা কোহিনুরের মতো ঝলমলাক আজীবন।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এমন চমৎকার শুভেচ্ছার জন্য অনেক ধন্যবাদ, ঋজু।

      Delete
  13. Amar anek anek antorik subhechchha....khub bhalo thakun apnara.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, সুস্মিতা।

      Delete
  14. যাঃ চচলে আপনি যেভাবে লিখছেন তাতে তো সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে লেখায় হয়তো আ‍্যলিয়েনদের প্রসংগ এনে ফেলবেন।অপেক্ষায় রইলাম আর শুভেচ্ছা জানালাম।

    ReplyDelete
  15. Happy anniversary Kuntala di. Jeebone kharap somoy to astei thakbe, photor modhyei nahoy bhalo somoy tuku badha pore thakuk forever. Bhalo theko.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, কুহেলি।

      Delete
  16. শুভ বিবাহবার্ষিকী কুন্তলা। এরকম আরও অনেক অনেক টিন/ক্রিস্টাল/ রৌপ্য/ স্বর্ণ ইত্যাদি জয়ন্তী পালন করুন আপনারা, আর ভাল ভাল লেখা উপহার দিতে থাকুন আমাদের। তালেগোলে উইশ করতে একটু দেরি হয়ে গেল, দুঃখিত।

    ReplyDelete

Post a Comment