চোপতা, তুঙ্গনাথ, চন্দ্রশীলা, ক্ষিরসু - শুরুর আগে



কাঁধে গিটার তুলে, উসকোখুসকো চুলে না-কাটা নখ চালিয়ে, ‘ওকে, লেটস গো’ বলার পর আমি দৌড়ে গিয়ে হাওয়াই চটি বদলে স্যান্ডেল গলিয়ে আসায় যে দাদা মাথা নেড়েছিলেন, তিনি এখন আমাকে দেখলে কেঁদে ফেলতেন।

ট্রেন বাস হোটেল বুকিং-এর স্টেজ পেরিয়ে পরিস্থিতি এখন ওলাউবার প্রি-বুক করার পর্যায়ে পৌঁছেছে। সে গাড়ি ইঞ্চি মেপে বাড়ির দরজার সামনে এসে না দাঁড়ালে মনে হয় ঠকে গেলাম।

সেই যে লালগোলা প্যাসেঞ্জারে রিজার্ভেশন ছাড়া প্রাণ হাতে করে উঠেছিলাম, পাশের সিটে আস্ত পাঁঠা বসে গোটা রাস্তা এসেছিল। ভ্রূক্ষেপ করিনি। নিজে উঠতে পেরেছি এই ভাগ্য, সহযাত্রীর বাছবিচারের বিলাসিতার অবকাশই ছিল না। এখন অনলাইন খুঁজে এসি স্লিপার বাসে টিকিট কেটেছি, বাস্তুমতে মেপেজুকে সিট বেছেছি এগারো বারো, বাসে উঠে দেখি হয়ে গেছে তেরো চোদ্দ। বেড়াতে যাওয়ার অর্ধেক উদ্দীপনা ওইখানেই স্যাঁতসেঁতে। ভাগ্যিস স্লিপারের সিট পাইনি। আশা করে যেতাম শরীরের দুই তৃতীয়াংশ দৈর্ঘ্যে কোনওমতে নিজেকে আঁটিয়ে রাজার হালে শুয়ে শুয়ে যাব, পনেরো বছরের ধুলো আরও কে জানে কী মাখা ভেলভেটের পর্দার প্রাইভেসি আমাকে আগলে থাকবে, গিয়ে যদি বেরোতো ভেলভেটের বদলে পর্দা জ্যালজেলে সুতির, হৃদয়ভঙ্গের পরিমাণটা একবার ভেবে দেখুন।

কোথাও থাকার জায়গা ঠিক না করা থাকলে মাথার ওপর ছাদ হলেই বর্তে যাওয়া যায়। কিন্তু পাঁচশোটা রিভিউ পড়ে, পাঁচ হাজার লাইন চ্যাট করে, পাঁচবার ফোন করে এন ই এফ টি করে টাকা পাঠিয়ে ঘর বুক করলে ভিউতে জন্মগত অধিকার জন্মায়। না পেলেই মাথায় রক্ত।

এগুলো ফসকে গেলে দৈবের মার হিসেবে মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু নিজেরাও তো যেচে উৎপাত কম জোটাইনি। যে রকম গরম পড়েছে, চারদিন জল না পেলে পঞ্চমদিন ফিরে গাছেদের দেখতে পাই কি না সন্দেহ। বেড়ানোর ইচ্ছের অঙ্কুরোদ্গম হওয়া ইস্তক টোটকা সন্ধান চলছে। কেউ বলছে প্লাস্টিকের বোতলে মারাত্মক সূক্ষ্ম ফুটো করে জল ভরে রেখে যাও, নয়তো ভরা বোতলের মুখ উল্টো করে পুঁতে দাও নরম মাটিতে, মাটি দরকার মতো টেনে নেবে। সে সবের ট্রায়ালও দিয়েছি বারকতক, পরিণাম আশাব্যঞ্জক নয়। 

কাঁচালংকা গাছে চারটে পাতা মুখ বার করে বসে ছিল কবে থেকে। আমরা হাল ছেড়ে দিয়েছি, দেখবি তো দেখ, বেরোনোর ঠিক আগের দিন আরও দুটো নতুন পাতা। এখন চলে গেলে যদি কিছু হয়, বাড়তি বিবেকদংশন। সেই থেকে পাগলের মতো গুগলকে খুঁচিয়ে চলেছি উত্তরের আশায়, ‘হাউ নট টু কিল ইয়োর প্ল্যান্টস হোয়াইল ইউ আর অ্যাওয়ে।’

সবের ওপর মাথার পোকা নড়েছিল, শুধু পাহাড় দেখলে শান্তি নেই, পাহাড়ে চড়ে পাহাড় দেখতে হবে। অফিস থেকে ফিরে ঝালমুড়ি + নাপতোলের সুখ জলাঞ্জলি দিয়ে মেলাগ্রাউন্ডে পাক দিচ্ছিলাম। ফ্রি অ্যাপ ডাউনলোড করে মাপছিলাম হৃদস্পন্দনের গতি, রক্তের চাপ, ঝরা ক্যালোরির পরিমাণ। পিৎজার বদলে ফ্রিজের শুকনো পটল বাছছিলাম প্রতি রাতে।

এত করে শেষরক্ষা হল কি না, প্রস্তুতি দিয়ে প্রত্যাশার শৃঙ্গ জয় করতে পারলাম কি না, নাকি হতাশার পাল্লাটাই ভারি হয়ে ঝুঁকে পড়ল, সেটা সামনের কয়েক পর্বে আপনাদের শোনাব। 
                                                                                                                         (চলবে)


চোপতা, তুঙ্গনাথ, চন্দ্রশীলা, ক্ষিরসু - শুরুর আগে
চোপতা, তুঙ্গনাথ, চন্দ্রশীলা, ক্ষিরসুঃ ১ 
চোপতা, তুঙ্গনাথ, চন্দ্রশীলা, ক্ষিরসুঃ ২
চোপতা, তুঙ্গনাথ, চন্দ্রশীলা, ক্ষিরসুঃ ৩ (শেষ)


Comments

  1. দুগ্গা দুগ্গা...

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, থ্যাংক ইউ, চন্দ্রচূড়।

      Delete
  2. শুরুতেই টানটান...

    ReplyDelete
    Replies
    1. শেষটা কেমন হয় দেখা যাক, প্রদীপ্ত।

      Delete
  3. Thank you thank you.. oi bottle futo kore gaache jol dewa r podhhoti ta dhope tikbe ki naa sandeho chilo ... tui niroson korli ... tor pahaar chora sarthok hok .. have a great time !!! :D :D

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, বৈশালী।

      Delete
  4. গাছে জল সমস্যার কোনো সমাধান কি পাওয়া গেল? আর বাস যদি উত্তরাখন্ড ট্রান্সপোর্ট এর হয়, তাহলে খুব খারাপ হবে না বলে মনে হয় (আমি অবশ্য় ভলভো পেয়েছিলাম, শোয়ার ব্যবস্থা নেই)| তাই কি ?

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমরা প্রাইভেট ভলভোয় গিয়েছিলাম, বসে বসে।

      Delete
  5. aha ki moja tomar. by the way, ei wanderlust er chotey ami kukur pushi na.

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, আমার আত্মীয়স্বজনদের দেখেছি, কুকুরবেড়াল থাকলে বেড়াতে যাওয়া মহা সমস্যা।

      Delete

Post a Comment