অমৃতসর ৫ঃ ডাল, পরোটা, আমসত্ত্ব



আমসত্ত্ব, চুরন, হজমি গুলি ও যাবতীয় মুখশুদ্ধি 

সহকর্মী বলছিলেন, অমৃতসর যাচ্ছ যখন আমসত্ত্ব নিয়ে এস, দাআআরুণ। পথের দু’পাশে আমগাছের বাড়াবাড়িটা চোখে পড়েছিল আগেই। রণজিৎ সিং-এর প্রাসাদের বাগানকে আম্রকুঞ্জ বললেও বেমানান হয় না। কাজেই আমসত্ত্ব ব্যাপারটায় ওঁরা অনেকদিন হাত পাকিয়েছেন ধরে নেওয়া যায়। খাতার ওপর পেন বাগিয়ে জানতে চেয়েছিলাম, কোন দোকান কোন দোকান? সহকর্মী বিপন্ন মুখ করেছিলেন। নাম তো জানি না, রাস্তার পাশের র‍্যান্ডম দোকান। সেখানেও  দারুণ আমসত্ত্ব পাবে। কিন্তু আমরা কি না টুরিস্ট, তারপর রিসার্চ করে করে অভ্যেসটাই গেছে খারাপ হয়ে, আমরা অমৃতসরের ‘বেস্ট’ আমসত্ত্বওয়ালার নাম জানতে চাইলাম গুগলে। 

সবাই একবাক্যে বলল, রামলুভায়া আমপাঁপড়ওয়ালা। 

লরেন্স রোডে একটি পিপল কি পেড়ের নিচে রামলুভায়ার  ঠেলাগাড়ি। বেলা এগারোটা নাগাদ জনা পাঁচেক খদ্দের দাঁড়িয়ে আছেন। বিবিধ বয়ামে গোল, চৌকো, গুঁড়ো, চ্যাপ্টা হজমিগুলি। কাঁচের বড় চৌকো বাক্সে কার্পেটের মতো গোটানো সাত রকমের, হলুদ থেকে গাঢ় বাদামীর মাঝে সাত শেডের, সাত ভ্যারাইটির আমসত্ত্ব। আপনি খেতে চাইলে ছুরি দিয়ে কেটে আপনাকে পরিবেশন করা হবে। আমাদের যে কোনও কাজ নেই, ভাইসাব বুঝতেই পেরেছিলেন নির্ঘাত তাই আমসত্ত্বের সাত রকম শেষ করে বয়াম থেকে একের পর এক হজমিগুলি বার করে আমাদের সামনে সেলোফেনের টুকরোর ওপর রাখতে লাগলেন। আইডিয়াটা হচ্ছে টেস্ট করে যেটা আপনার বেশি মনে ধরবে সেটা আপনি কিংবা বেশি করে বাড়ির জন্য নিয়ে যাবেন কিংবা ‘বানিয়ে’ দিতে বলবেন। তখন ভাইসাব পাতিলেবু রস ছড়িয়ে, সিক্রেট মশলা মাখিয়ে সেটা আপনাকে পরিবেশন করবেন। গোড়ায় কোনটা কী হজমি জিজ্ঞাসা করছিলাম কিন্তু তারপর ক্ষান্ত দিলাম। কারণ এক তো গুলিয়ে যাচ্ছিল, দুই, ফলগুলোর পাঞ্জাবী নাম শুনে চিনতেও পারছিলাম না, তিন, ততক্ষণে ভাইসাবের সামনে আরও গুচ্ছ খরিদ্দার এসে গেছেন, তাদের টেস্ট করাতে, অর্ডার সামলাতে ভাইসাব গলদঘর্ম। আমরা তাই ঝটপট সামনে যা পড়ছিল তুলে মুখে পুরছিলাম, তারপর তার থেকে তিন চারটে পছন্দ করে বললাম, বানাকে দিজিয়ে প্লিজ। 

রাম লুভায়ার আমসত্ত্ব এবং মুখশুদ্ধির কোনটা বেশি ভালো কোনটা কম ভালো এ বলা মুশকিল। নামধাম না জানাটা একটা সমস্যা তো বটেই, কিন্তু সেটার থেকেও বড় কারণ হচ্ছে সবই ভালো। আমার আর অর্চিষ্মানের ভালোর সংজ্ঞাতে অল্প অমিল হবে জানাই ছিল। অর্চিষ্মানের পছন্দ হচ্ছিল যেগুলোয় একটু মিষ্টির ভাগ বেশি। আর যেগুলোতে টকের চোটে চোখ সরু হয়ে যায়, গাল তুবড়ে যায়, চোয়ালের দুপাশ টনটন করে, আমার মতে সেইগুলোই সেরা। প্লেট তিনেক আমসত্ত্ব মাখা খেয়ে বাড়ির জন্য এক বাক্স চুরন প্যাক করে রামলুভায়াকে টা টা জানালাম।


মাসমচ্ছি

আমিষাশীদের জন্যও অমৃতসরে অপশন প্রচুর। অমৃতসরি মচ্ছির নাম সকলেই জানেন। মাছের জন্য মাখ্‌খন ফিশ অ্যান্ড চিকেন, চিকেন টিক্কা এবং চিকেনের অন্যান্য পদের জন্য বীরা চিকেন হাউস বিখ্যাত। এছাড়া দিল্লিতে যে জিনিসটাকে লোকে পায়া বলে জানে, সেটা অমৃতসরে খেতে চাইলে অনেকে পাল দা ধাবায় যান। মুরগির নানা লোভনীয় পদের জন্য সুরজিৎ ফুড প্লাজার নামও ঘুরেফিরে এসেছে। এবারের ট্রিপে এ সব কিছুর মধ্যে একটা দোকানের বুড়িই ছুঁতে পেরেছে অর্চিষ্মান। সেটা হচ্ছে বীরা চিকেন হাউস। মজিথা রোডের ধারে টিউবলাইট জ্বালা বিবর্ণ বোর্ডের নিচে বড় পুরোন দোকান। কিন্তু দোকানের সামনে নিচে গনগনে আগুনের ওপর সারি সারি কাবাব টিক্কার চেহারা এবং সুবাস সব বিবর্ণতা ম্লান করে দিয়েছে। রাত হয়ে যাচ্ছিল আর পেটেও জায়গা ছিল না বলে চিকেন টিক্কা আর নান প্যাক করিয়ে হোটেলে নিয়ে এসেছিল। খেয়ে বলেছে, হাইপ নয়, যথার্থেই মচৎকার। 


মেন কোর্স/ পরাঠা, ডাল, শাক


হরমন্দির সাহিবে মাথা ঠেকা আর ওয়াগা বর্ডারে গিয়ে জয় হিন্দ বলার পর অমৃতসরে তিন নম্বর টু ডু হচ্ছে কেসর দা ধাবাতে খাওয়া। কুলচা নিয়ে এত কাড়াকাড়ি, কেসর দা ধাবা কমপিটিশনহীন। অমৃতসরের মতো শহরের পক্ষে রীতিমত আশ্চর্য ব্যাপার। ধাবার খাবার, ডাল রুটি পরোটা শাক সবজি পরিবেশন করে একটা দোকানের নিজেকে প্রতিযোগিতার ঊর্ধ্বে নিয়ে যাওয়াটা। এখন অনেক আধুনিক ধাবা উঠে আসছে যেমন ভারাওয়ান (ইংরিজিতে দোকানের নাম লেখা আছে Bharawan, কিন্তু ওটার উচ্চারণ হবে প্রাওয়ন।) কেউ কেউ নবীন ধাবাদের পক্ষে কারণ কেসর দা ধাবার মতো অথেনটিসিটির নামে এরা খাবারে খাবলা খাবলা দেশী ঘি ঢালে না। কথাগুলোর মধ্যে সত্যতা থাকলেও থাকতে পারে। হাতে সময় নিয়ে গিয়ে এই নতুন যুগের ধাবাগুলোতেও আমাদের খেয়ে দেখার ইচ্ছে আছে কিন্তু এ বার একটি ধাবাতেই খাওয়ার সময় ছিল, আর যদি একটিতেই খেতে হয় তাহলে যে কেউ বলবেন সেটা কেসর ধাবাতেই খাওয়া ভালো।

একটা জিনিস মনে রাখতে হবে। খিদে পেয়েছে, জি পি এস খুলে কেসর দা ধাবাতে গিয়ে খেয়ে আসি করলে মুশকিলে পড়বেন। প্রথম আটকাবেন জি পি এস-এ। কেসর ধাবা গলি তস্য গলির ভেতর। আর সে সব গলি অতি উচ্চকোটির, গুগল ম্যাপের নীল বিন্দুর নাককান মুলে বাঁই বাঁই করে একই জায়গায় চরকি পাক খাওয়ায়। তাতে অসুবিধে নেই, ভারতের মতো দেশে রাস্তা বলে দেওয়ার মানুষের অভাব নেই। বীরা চিকেন হাউসের ভদ্রলোক যেমন। হোম ডেলিভারির বাজন্ত ফোন উপেক্ষা করে তিনি রামলুভায়া আমপাঁপড়ওয়ালার দোকানের রাস্তা বলে দিয়েছিলেন তাই নয়, রিসিটের পেছনে সে রাস্তার ছবি এঁকে আমাদের হাতে দিয়েও ফেরত নিয়ে নিজের বেস্ট হাতের লেখায় ‘আম পাঁপড়ওয়ালা’ লিখে দিলেন যাতে ওই কাগজটা দেখালে আমাদের আর কোনও কথাই বলতে না হয়। অমৃতসরের বাকি সবাইও সমান হেল্পফুল। দিকনির্দেশ চাইলে কাজ থামিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে হাত নাড়িয়ে নেক্সট পাঁচটা টার্ন ভালো করে বুঝিয়ে দেন। দিল্লির মতো প্রশ্ন শেষ হওয়ারও আগে হাত নেড়ে ‘পাতা নহি’ বলে হাঁটা দেন না। 

অবশ্য কেসর দা ধাবা পাতা না থাকাও অসম্ভব। খুঁজে পাওয়াটা কেসর দা ধাবার সমস্যা নয়। আসল সমস্যাটা অন্য জায়গায়। কেসর দা ধাবায় খাওয়াটা অনেকটা ভগবান কে পাওয়ার মতো। চোখ বুজে শবাসনে শুলেন আর ভগবান এসে বললেন কী বর চাই বল, হবে না। 

আমরা সেই ভুলটাই করেছিলাম। রাত আটটা নাগাদ হরমন্দির থেকে বেরিয়ে একেতাকে জিজ্ঞাসা করে অলিগলি পেরিয়ে কেসর দা ধাবায় পৌঁছে দেখি, একটুও বাড়িয়ে বলছি না, কম করে সত্তর জন লোক গলি আটকে দাঁড়িয়ে আছেন। সকলেই কেসরে খাবেন। সকলেরই হাতে টোকেন, দোকানের মাথার ওপর ডিজিটাল বোর্ডে নম্বর দপদপাচ্ছে, দেখে দেখে ঢুকে যাচ্ছেন।

আমরা সেদিন সারাদিন অন্তত দশ মাইল হেঁটেছি। পা টনটন করছে। অমৃত সার্ভ করা হচ্ছে শুনলেও একঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার এনার্জি জোগাড় করতে পারব না। চলে এলাম। কাল দুপুরে আসব। কাল বিকেলে চলে যাব, কাজেই লাঞ্চই কেসরদর্শনের একমাত্র সুযোগ। সে সুযোগের ফুল সদ্ব্যবহার করতে হবে, পৌঁছতে হবে ফুল খালিপেটে। অর্থাৎ সকালে কানহা সুইটসে পুরিভাজির প্ল্যান বাতিল। সব পরের বার হবে।

কেসর দা ধাবার টাইমিং লেখা আছে দুপুর বারোটা থেকে। ব্যাটারি অটো থেকে দোকানের সামনে নামলাম বারোটা আড়াই মিনিটে। সকালে হোটেলে এক কাপ লেমন টি তারপর রাম লুভায়ার আমসত্ত্বমাখা খেয়ে পাচকরস গলগল করে বেরোতে শুরু করেছে। কেসর খুলেছে, কিন্তু কেউ নেই। উল্টোদিকের কী যেন সুইটস নামওয়ালা দোকানে কয়েকজন লোক বসে আছেন। অর্চিষ্মান কেসরের ভেতর বসে থাকা একজনকে জিজ্ঞাসা করে জানল ওই সুইটসের দোকানেই কেসরের বসার ব্যবস্থা। ওটা ফুল হলে তবে কেসরের মূল দোকানের সিট খোলা হয়। মিষ্টির দোকানের গোটা দশেক টেবিলের সাতটা অলরেডি ভর্তি। কাঠের পিঠহীন বেঞ্চি, মার্বেলটপ টেবিল। দর্শন দিয়ে যদি অথেনটিসিটি আন্দাজ করতে হয়, একশোয় একশো।  

মিনিট দশেকের মধ্যে সুইটসের সব টেবিল ভরে গেল। লোকজন উশখুশ করতে লাগল। একজন রোগামতো পরিবেশক ঘোরাঘুরি করছিলেন, জানালেন সাড়ে বারোটায় খাবার দেওয়া শুরু হবে। সাড়ে বারোটার আগেই অন্য লোকজন আসতে শুরু করলেন, উল্টোদিকের কেসর ধাবার দোকান খুলে বসতে দেওয়া হল। ঠিক সাড়ে বারোটায় একজন বিরাট চেহারার লোক ঢুকলেন। পরে জেনেছিলাম ওঁর নাম মাখ্‌খনলাল। সেনাপতিসুলভ হাবভাব। হাত পেছনে জড়ো করে প্রতি টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে অর্ডার নিতে থাকলেন। উনি হচ্ছেন সে গোত্রের পরিবেশক যিনি লেখাটেখার ধার ধারেন না। সব অর্ডার মনে থেকে যায়। আমার সাধারণতঃ এ সব পরিস্থিতিতে নার্ভাস লাগে কিন্তু মাখখ্‌নলালের চেহারার মধ্যে ভরসা জাগানো একটা ব্যাপার আছে। 

কেসর দা ধাবায় বেশিরভাগ লোকেই পরাঠা থালি অর্ডার করেন, তাতে পরাঠা, ডাল, সবজি ইত্যাদি একইসঙ্গে পাওয়া যায়। আমরা সেটা করব না ভেবেই রেখেছিলাম। কারণ পরোটা খেলে আমাদের আর কিছু খেতে হত না। অত্যন্ত ভালো ডিসিশন হয়েছে। আমরা দুজনে মিলে নিয়েছিলাম একটা তন্দুরি রুটি, একটা জোয়ান পরাঠা। একটাও গোটা শেষ করতে পারিনি। সঙ্গে নেওয়া হয়েছিল ডাল, শাক (সর্সো দা), রাজমা এবং লস্যি।



প্রথমেই বলে নিই, এ রকম রাজমা আমি আগে খেয়েছি। কেসর দা ধাবার রাজমা চমৎকার কিন্তু লেজেন্ডারি নয়। 



লিজেন্ডারি হচ্ছে এই ডাল। এই যে ডালটি দেখছেন এটা বারো ঘণ্টা ধরে রান্না করা হয়েছে। এই রকম ডাল আমি বা অর্চিষ্মান আমরা আগে কখনও খাইনি, পরেও খাব বলে মনে হয় না। সর্ষের তেলের অভ্রান্ত সুবাস, ঘি-এর মাখোমাখোতা এবং কাঠের উনুনের ধোঁয়ার নস্ট্যালজিক ধোঁয়ার স্মৃতিবিজড়িত চ্যাম্পিয়ন। ওই একবাটি ডাল আমি আর অর্চিষ্মান মিলে চেঁচেপুঁছে শেষ করেছি। আমাদের নর্ম্যাল খোরাকিতে মির‍্যাকল। নিয়মরক্ষা পরোটা ছিঁড়ে মুখে দিতে দিতে, আর চামচে করে ডাল খেতে খেতে, মাথা নাড়তে নাড়তে অর্চিষ্মান ঘোষণা করেছে এর পর থেকে যতবার অমৃতসর তথা কেসর দা ধাবাতে যাবে আর কিছু না খেয়ে স্রেফ রুটি আর ডালই খাবে।

আমি অবশ্য ওই শাকটিও খাব। মেনুতে শাকের পাশে ব্র্যাকেটে সিজনাল লেখা ছিল। জানি না সারা বছর এটা পাওয়া যায় কি না। আমার সর্ষে শাক খেতে এমনিই ভালো লাগে। অফিসের ক্যান্টিনে বছরে দু’বার সরসো দা সাগের নামে যে বস্তুটি তৈরি হয় সেটাই আমি তৃপ্তি করে খাই, যদিও এদের ওই শাক বেটে তরল করে ফেলা রেসিপিটা আমি অত্যন্ত অপছন্দ করি। কেসর দা ধাবার সরসো দা সাগের রীতিমত আকারআকৃতি আছে, তার সঙ্গে আছে সিগনেচার স্মোকি সুবাস। চামচ চালালে বাটির নিচে সোনা রঙের সর্ষের তেলের পুকুর আবিষ্কৃত হবে। ওটা বাদ দিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করবেন না, বলাই বাহুল্য। চেষ্টা করবেন যাতে প্রতি চামচে ওই তেলের খানিকটা আপনার পেটে যায়।


আর একগ্লাস লস্যি অতি অবশ্যই অর্ডার করবেন। পেট তো এতেই ভরে যাবে, শেষ না করতে পারলে পয়সা নষ্ট - এইসব অজুহাত দেবেন না। একেকটা অঞ্চলের খাওয়াদাওয়ার ধরণধারণ, মেনু, অনেক বছরের অভিজ্ঞতায় তৈরি হয়। ওই তেল ঘি চপচপে ডাল শাক পরোটার মাঝে মাঝে এক চুমুক (মাঝে মাঝে এক চামচ, কারণ এ লস্যিতেও মালাই যথেষ্ট) ঠাণ্ডা লস্যি যখন গলা দিয়ে নামবে, তখন বুঝবেন এ ভিড় বাড়াতে আসেনি, এ না এলে সভা জমত না। চায়ের সঙ্গে টোস্ট বিস্কুটের মতো, কুলফির সঙ্গে ফালুদার মতো, পাঞ্জাবী ডালপরাঠার সঙ্গে লস্যির আত্মার সম্পর্ক; জোর করে তাদের আলাদা করতে যাবেন না।

খাওয়া শেষ করে যখন বেরোলাম, কেসর দা ধাবার গলি গিজগিজ করছে।

একটা কথা আমাকে বলতেই হবে। আমরা বাঙালি পেট নিয়ে জন্মেছি, একের বেশি দেড় ঠোঙা ঝালমুড়ি খেলে আমাদের ঢেঁকুর ওঠে, সেই আমরা ওই ডাল একবাটি চেঁচেপুঁছে খেয়ে একটা হেঁচকিও তুলিনি। পেট ভরে গিয়েছিল মারাত্মক, কিন্তু বুক জ্বলেনি, মাথা ঘোরেনি।

কেসর দা ধাবায় খাওয়ার পর আর কিছুই করার ছিল না। মগজের সমস্ত রক্ত পাকস্থলীতে ছুটেছে, মাথা ফাঁকা, চেতনা জুড়ে ঝিম ধরা ভাব। এখন সাঁইগুরুর চরণে গিয়ে বসা ছাড়া আর কোনও অ্যাক্টিভিটির কথা কল্পনা করা যাচ্ছে না। কাটরা আলুওয়ালিয়ার অলিগলি পেরিয়ে চললাম হরমন্দির সাহিবের দিকে। কেসর ধাবার ডাল খেয়ে প্রাওয়ান ধাবায় গিয়ে ভর্তা খাওয়ার প্ল্যান করেছিলাম, মনে পড়ে হাসি এসে গেল। পথে গুরদাস রামের জলেবির দোকান পেরোলাম, এও লিজেন্ডারি। পরের বার রিস্ক নেব না, আগে জিলিপি খেয়ে পরে ডালরুটির দিকে হাঁটব। গলির দুপাশে খোলা নর্দমা, সন্দেহজনক জমা জল, দুই দিক থেকে চেপে এসেছে মনিহারি দোকান, এ দোকান থেকে ও দোকানের মাথায় টাঙানো দড়ি থেকে ঝুলছে ফুরফুরে ফুলকারি ওড়না। ওদিক থেকে এক ব্যাটারি অটো, এদিক থেকে এক ব্যাটারি অটো মুখোমুখি এমন ফাঁসান ফেঁসেছে, মানুষ গলারও জায়গা নেই। কোই নেহি। পেছন থেকে এগিয়ে এলেন একজন। এক হাতে একটা ব্যাটারি অটোর সামনের চাকা ঘুরিয়ে চেপে ধরলেন, অন্যদিকের ব্যাটারি বেরিয়ে গেল। কেউ চেঁচালো না, ঘামল না। হরমন্দির সাহিবে এসে ঢুকলাম। কাল রাতে অনেক আলোয় ঝলমল করা স্বর্ণশোভা রাতে দেখেছিলাম, দিনের শোভা ভালো করে দেখব বলে দিঘি ঘিরে ঘুরতে শুরু করলাম। লংগরে বাসনকোসনের যা আওয়াজ, তাসা পার্টি লজ্জা পাবে। চারপাশের পথের কার্পেট গুটিয়ে মেঝে ঝাঁট দেওয়া হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের একজন হেঁকে হেঁকে সবাইকে সরে যেতে বলছেন আর পেছনে লম্বা নারকেলের, আমাদের বাড়িতে বলে শলা ঝাড়ু, দিয়ে ঝাঁট দিতে দিতে আসছেন একদল স্বেচ্ছাসেবী। কেউ কেউ নিচু হয়ে জোরে জোরে কার্পেটের ধুলো ওড়াতে ওড়াতে চলেছেন, কারও কারও গালে পাউডার বোলানোর ভঙ্গি। গুরুদ্বারায় তিনটি অতি জাগ্রত কুলগাছ আছে। দুখভঞ্জনী কুলের পার থেকে দিঘিতে ডুব দিলে যাবতীয় যাতনা দূর হয়, কাজেই সেই দিকে খুব ভিড়। তাছাড়া এই গাছের নিচেই হচ্ছে অঠসট অর্থাৎ আটষট্টিটি তীর্থের সমান পুণ্যওয়ালা তীর্থ। দ্বিতীয় কুলগাছের নাম লাচি বের আর আর বাবা বুধের নামে তিন নম্বর কুল গাছের নাম বাবা বুধা বের। এই গাছটি চারশো বছরেরও প্রাচীন। দিঘি ঘুরে আমরা ওই গাছের ছায়াতেই এসে বসলাম। 

জলে পা ডুবিয়ে মাথা ঠেকে যাচ্ছে কত লোক। মায়ের গায়ে ফিনফিনে সোয়েটার, হাতের কাছটা ছিঁড়ে অল্প উল আলগা হয়ে ঝুলছে, ছেলের পায়ে মোজাটা পর্যন্ত অটুট, রংচঙে। দুরন্ত ছেলেকে এক হাতে চেপে ধরে বকতে বকতে ছেলের পাগড়ির ওপর পুণ্যদীঘির জল তুলে ছেটাচ্ছে। জলে সোনার দেউলের ছায়া কাঁপছে টলটল। 

সব কি হল? হল না। কানহাইয়ালালের পুরি লৌঞ্জি বাকি রয়ে গেল, গুরচরন দাসের জলেবি খাওয়া হল না। গোভিন্দগড় দুর্গের জমজমা কামান দেখা হল না, শহর থেকে মাত্র দেড় ঘণ্টা দূরের হরিকে জলাভূমিতে উড়ন্ত পাখির ঝাঁক আর জলের নিচে সরসরানো কচুরিপানার শিকড় পেরিয়ে নৌকাবিহার হল না। কিন্তু আফসোস নেই। অম্বরসর দিল্লির পুরী। আর পুরী কি কেউ একবার গিয়ে থাকতে পারে? 

কাঁটায় কাঁটায় চারটে পঞ্চাশে তিন নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে স্বর্ণশতাব্দী ছেড়ে দিল। জানালা দিয়ে দেখলাম একটা পাতাহীন শুকনো গাছ, সর্বাঙ্গে কাটা ঘুড়ি জড়িয়ে মুখ চুন করে দাঁড়িয়ে আছে। ওকে টাটা করে বলে এসেছি, কোই নেহি, আবার দেখা হবে, শিগগিরই। 



Comments

  1. 5 tei podechhi, ar purota miliyei bolchhi: excellent hoyechhe ebarkar bornonata!!

    iti
    Shuteertho

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, সুতীর্থ।

      Delete
  2. Agerjoner motoi bolte hochhe ... boro bhalo laglo, chhobir moto shob dekhte pelam, onekgulo ichhe jaglo, janina kobey purno hobey, r etao ichhe holo j apnara jaeno khub shigri e next round ta korte paren, tahole ebarer bakigulo porer barer lekhatay porte parbo ... ekta proshno - Ambarsar ki Amritsar er Punjabi pronunciation? Second last paragraph e last line achhe kothata, jante ichhe holo tai jigyesh kora. Apnara bhalo thakben ...

    ReplyDelete
    Replies
    1. অমৃতসরের ডাকনাম বলা চলে অম্বরসর, অনুরাধা। হিন্দি সিনেমার গানের লাইনে শুনবেন "অম্বরসরিয়া মুন্ডিয়া" ইত্যাদি। আমাদেরও অমৃতসর গেলেই হয় ভঙ্গি। দেখা যাক নেক্সট রাউন্ড কবে হয়।

      Delete
    2. Besh besh, gaantar prothom kothatar thikthak maneta jana gaelo ... Thank you ... Apnara bhalo thakben ...

      Delete
    3. হাহা, আমিও ওই গানটা শুনেই নামটা প্রথম আবিষ্কার করি।

      Delete
    4. অম্বরসরটাই বোধহয় আসল নাম। আকাশের (স্বর্গ?) মতো সরোবর এরকম কিছু একটা মানে।

      Delete
  3. manosbhromon koranote tumi odwitiya

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, থ্যাংক ইউ, চুপকথা।

      Delete

Post a Comment