ইদানীং



ব্লগিং-এর স্বর্ণযুগে ব্লগ জনপ্রিয় করার বিবিধ টিপস এবং ট্রিক্সের লিস্টের একেবারে ওপরদিকেই যেটা থাকত সেটা হচ্ছে বেশি করে লিস্ট পোস্ট করার ট্রিক। লিস্ট নাকি সকলেরই পড়তে ভালো লাগে কারণ দ্রুত পড়ে ফেলা যায়। লিখতেও খাটনি কম। (এটা অবশ্য কী নিয়ে লিস্ট তার ওপর নির্ভর করবে, আপনি যদি এখন উমবার্তো একোর উপন্যাসে মেটাটেক্সচুয়াল রেফারেন্সের লিস্ট বানাতে যান তাহলে খাটনি কম হবে না, বলাই বাহুল্য, কিন্তু আমি যে ধরণের লিস্ট লিখব যেমন পাঁচটি প্রিয় রং, পাঁচটি প্রিয় ফুল, পাঁচটি প্রিয় আইসক্রিম ফ্লেভার, তাতে পরিশ্রম বেশি হওয়ার কোনও কারণ নেই।) এই সব উপদেশসম্বলিত পোস্টে বিবিধ লিস্টের আইডিয়া দেওয়া থাকত। দশটি গোপন কথা যা আপনি কাউকে বলেননি। বারোটা গর্হিত ইচ্ছে যা আপনি পূরণ করতে চান ইত্যাদি প্রভৃতি।

আমার আজকের পোস্টের লিস্ট সে রকম রোমহর্ষক নয়। নেহাতই সাদামাটা। ক্ষতি নেই, আমার লিস্ট লেখার উদ্দেশ্য ব্লগের জনপ্রিয়তা বাড়ানো কিংবা পরিশ্রম কমানোর নয়। পাতা ভরানোর একটা উদ্দেশ্য আছে বটে কারণ করে লেখার বিষয় কিছু মাথায় না এলে ব্লগের আলো নিভিয়ে বসে থাকার থেকে লিস্ট লেখা ভালো বলেই আমি মনে করি। কিন্তু সব থেকে বড় কারণ হচ্ছে স্টকে কয়েকটা বিষয় জমেছে যাদের নিয়ে পুরো একখানা পোস্ট লেখাও মুশকিল, কিন্তু আবার একেবারে ফেলে দেওয়ার মতোও নয়। বিষয়গুলোর মধ্যে সম্পর্ক শ্মশান এবং গরুর সম্পর্কের থেকেও ক্ষীণ কাজেই সেগুলো পোস্টে ব্যবহার করতে হলে লিস্ট বানানো ছাড়া উপায় নেই। 


Healthifyme: 



এটা হেলথ অ্যাপের সিজন নয়, তবে কেউ যদি পয়লা বৈশাখ থেকে স্বাস্থ্যবান হওয়া শুরু করতে চান, তাঁর জন্য হেলদিফাইমি হেলথ অ্যাপ বউনি করার এটাই আদর্শ সিজন। জানুয়ারির পিক আপ যাঁদের ঢিলে হয়ে গেছে তাঁদের ফের পিক আপ নেওয়ার জন্যও এ অ্যাপ কাজে লাগতে পারে। হেলদিফাইমি অ্যাপ বেসিক্যালি সারাদিনে কী খাচ্ছেন, কতখানি জল খাচ্ছেন, কতখানি ঘাম ঝরাচ্ছেন ইত্যাদি হিসেব রাখার অ্যাপ। 

বা খেলা। খেলাটা চমৎকার। দৌড়োদৌড়ির ব্যাপার নেই, খাটে শুয়ে ফোন খুটখুট করে খেলা যায়। যে যার ফোনে ইন্সটল করা ইস্তক আমাদের অবসরের আদল পালটে গেছে। এই যেমন গত রবিবার দু’হাতা বাঁধাকপির তরকারির মাপ ‘কটোরি’তে কত হবে সেই নিয়ে জল্পনা করে সারাদুপুর কেটে গেল। নানারকম প্রিমিয়াম প্ল্যানট্যানও আছে, টাকা দিলে সে সব প্ল্যান খুলে যায়, আরও নানারকম সুযোগসুবিধে, ডায়েটিশিয়ানের সাপোর্ট হ্যানাত্যানা মেলে, কিন্তু আমরা সে সব খুলিনি। ফ্রিতে খেলতে যত ভালো লাগছে টাকা দিয়ে খেলতে তত ভালো লাগবে না। এ অ্যাপের সবথেকে ভালো জিনিসটা হচ্ছে, পৃথিবীতে যতরকম খাবার হওয়া সম্ভব (অন্ততঃ পৃথিবীর সব খাবারের মধ্যে আমরা যা যা খেয়ে থাকি) সবেরই নাম, ধাম, নিউট্রিশনাল ইনফরমেশন আছে। এবং আমার মাতৃভাষায়। ভয়ে ছিলাম, গোলগাপ্পা কিংবা পানিপুরি টাইপ করতে হয় বুঝি, করতে হয়নি, ফুচকার নিউট্রিশনাল ডিটেলসও দিব্যি দেওয়া আছে। কালকেই দু’প্লেট ফুচকা অ্যাড করলাম কলার তুলে। নিউট্রিশনাল ভ্যালু দৈনিক ডায়েটে যোগ হয়ে গেল। সে ভ্যালুগুলো খোলসা করছি না অবশ্য। 

হেলদিফাই মি-র আর যে জিনিসটা আমার ভালো লেগেছে সেটা হচ্ছে সমস্ত মনোযোগ ওজনের ওপর না দেওয়াটা। প্রোটিন, কার্ব, ফাইবার, এই সবও পরিমাণমতো শরীরে যাচ্ছে কি না এই সবও বলে দিচ্ছে। আমি কার্ব, ফ্যাট, ফাইবার, প্রোটিন, ক্যালশিয়ামে মোটামুটি উতরে যাচ্ছি কিন্তু ম্যাগনেশিয়াম, জিংক আর আদার নিউট্রিয়েন্টস 'কুড ডু বেটার'। 

সবটাই খেলা খেলা বলব না, আমার জল খাওয়া অত্যাশ্চর্য রকম বৃদ্ধি পেয়েছে। তাছাড়া খাবারদাবারের পুষ্টিসংক্রান্ত জ্ঞানগম্যিও বাড়ার পথে। একদিন ব্রেকফাস্টে জ্যাম টোস্টের বদলে হাতে গড়া আটার রুটির সঙ্গে কড়াইশুঁটি, আদাকুচি দেওয়া আলুফুলকপির ঝুরঝুরে তরকারি খেলাম, নিউট্রিশন্যাল ভ্যালু হুড়হুড় করে বেড়ে গেল। মা শুনলে হাঁ করতেন। 'এই জানার জন্য অ্যাপ লাগল সোনা? আমাকে জিজ্ঞাসা করলে আমিই বলে দিতাম।' সে মা বলতেই পারতেন হয়তো, কিন্তু মায়ের কথা শুনতাম কি না সন্দেহ আছে। অ্যাপের কথা শুনছি, অন্তত যদ্দিন চকচকে আছে। 



Murder, She Wrote (Crime Drama TV Series / 1984-1996) 



জেসিকা ফ্লেচার। নিউ ইংল্যান্ডের মেইন রাজ্যের সমুদ্রতীরবর্তী ছোট্ট জনপদ ক্যাবট কোভ-এর বর্ষীয়সী বাসিন্দা। একসময় স্কুলে পড়াতেন, এখন বেস্টসেলার গোয়েন্দাগল্প লিখিয়ে। উপন্যাস লেখা, অটোগ্রাফ দেওয়া আর বুক লঞ্চে সারা পৃথিবী ঘোরার পাশাপাশি ক্যাবট কোভ এবং অন্যান্য জায়গায় ঘটা বিবিধ খুনের ঘটনায় প্রতি এপিসোডে জড়িয়ে পড়েন এবং ঝানু পুলিস অফিসাররা যখন নাস্তানাবুদ, তুড়ি বাজিয়ে (প্রতি এপিসোডের ঠিক তিন চতুর্থাংশের মাথায় তুড়িটা বাজান, কারণ ওই সময়েই তাঁর মাথায় ব্রেনওয়েভ খেলে) খুনি ধরে দেন।  

মার্ডার, শি রোট, অ্যানজেলা ল্যান্সবেরির অভিনয়সমৃদ্ধ একটি বিখ্যাত টিভি সিরিজ যা চলেছিল উনিশশো চুরাশি থেকে ছিয়ানব্বই পর্যন্ত, সি বি এস চ্যানেলে। দুশো চৌষট্টিটা এপিসোড। কিছু কিছু অভিনেতার জীবনে একেকটা রোল ঘটে, আর কিছু কিছু রোলের জীবনে একেকজন অভিনেতা। বিশ্ব গোয়েন্দার চলচ্চিত্রায়নে এ ঘটনা আগেও ঘটেছে। মিস মার্পল বলতে, ফেলুদা বলতে, পোয়্যারো বলতে, কলাম্বো বলতে সবার মনে একটি এবং একটিই অভিনেতার চেহারা ভেসে ওঠে। জে বি ফ্লেচার আর অ্যাঞ্জেলা ল্যান্সবেরি নিঃসন্দেহে একে অপরের জন্য ঘটেছিলেন। অ্যাঞ্জেলা ল্যান্সবেরি একজন পোড় খাওয়া বিখ্যাত অভিনেতা, সিনেমা থিয়েটারে আরও অগুনতি মনে রাখা অভিনয় তিনি করেছেন, কিন্তু তাঁকে দুনিয়া মনে রাখবে জে বি ফ্লেচার হিসেবে।

কোজি মিস্ট্রি যাকে বলে, মার্ডার, শি রোট হচ্ছে একেবারে তাই। সমস্ত খুনখারাপি টাকা কিংবা প্রেমের জন্যই ঘটে, শিশুনিগ্রহ, যৌননিগ্রহ ইত্যাদির ধারকাছ দিয়ে যায় না। সর্বদাই হ্যাপি এন্ডিং। মৃতদেহরা বেশিরভাগই জাস্ট হাত পা এলিয়ে পড়ে থাকেন, রক্ত বেরোলেও ছিটেফোঁটা, ঘিলু ছিটকে পড়েছে, অন্ত্রসিস্টেম শরীরের বাইরে গড়াগড়ি খাচ্ছে এই সব পাবেন না। দুষ্কৃতীরাও কেউই খুব খারাপ লোক নন। ডিভোর্স হওয়ার পর একা একা মদ খান না কিংবা পরকীয়া করেন না। 

অর্চিষ্মানের পছন্দ না। বলে, 'কী করে দেখ? এ রকম চিনিগোলা গোয়েন্দা সিরিয়াল?' আমি ওকে বোঝাতে পারিনি কী করে দেখি তবে আপনারা যদি দেখতে চান তবে দেখতে পারেন। আর যদি অলরেডি দেখে থাকেন তাহলে জানাবেন কেমন লাগল। 



Us (2019 Mystery/ Thriller Movie)/ Direction and Screenplay: Jordan Peele


সর্বদা উল্টোটাই ঘটে। অর্চিষ্মান সিনেমা দেখতে যাওয়ার জন্য ঝোলাঝুলি করে, আমি ‘বাবাগো মাগো’ বলে ‘বিয়ে মানে কি শুধুই কম্প্রোমাইজ?’ কেঁদেককিয়ে, হলে গিয়ে অর্চিষ্মানকে উদ্ধার করি। অনেক সময় করিও না। অর্চিষ্মান 'এনাফ ইজ এনাফ' বলে একা একাই গিয়ে সিনেমা দেখে আসে। এসে বলে, যা মিস করলে যদি জানতে।

জর্ডন পিল-এর সাড়া-জাগানো অস্কার-বাগানো আত্মপ্রকাশকারী সিনেমা 'গেট আউট’ও একাই দেখে এসেছিল। আমি যাইনি। তারপর যখন সবাই বলল আহা কী বানিয়েছে, তখন মুখে স্বীকার না করলেও মনে মনে আফসোস হয়েছিল। তাই এবার নিজে থেকেই বললাম, জর্ডন পিলের সেকেন্ড সিনেমাটা এসেছে, 'আস', দেখে আসি চল।

সিনেমাটা সম্পর্কে সবাই যা জানে সেটুকুই বলব, তার থেকে বেশি স্পয়েল করব না, এই কথা দিচ্ছি। সবাই জানে, গল্পটা হরর অ্যান্ড থ্রিলার ঘরানার। স্যান্টা ক্রুজ বিচে, উনিশশো ছিয়াশি সালে, মেলায় ঘুরতে ঘুরতে অ্যাডিলেড নামের একটি বাচ্চা মেয়ে কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে যায়। একটি ফান মিরর হাউসে ঢুকে পড়ে, যার ওপরের বোর্ডে আলো দিয়ে লেখা আছে ফাইন্ড ইয়োরসেলফ। তারপর আমরা দেখি অ্যাডিলেডের বাবামা ডাক্তারের কাছে বলছেন, অ্যাডিলেডকে তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন কিন্তু মেয়ে শকে কথা বলছে না। ডাক্তার তাঁদের বলেন সময় দিতে। সারাতে হলে সময়ই সারাবে। 

সময় সরে বর্তমানে এসে পড়ে। অ্যাডিলেড এখন লুপিতা নিয়ং’ও। স্বামী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে ভরা সংসার। স্বামীর পীড়াপিড়িতে নিজের অস্বস্তি ছাপিয়ে অ্যাডিলেড সান্টা ক্রুজ বিচে বেড়াতে যায়। সেখানে সেই ফাইন্ড ইয়োরসেলফ লেখা আলোঝলমল সাইন। হঠাৎ হঠাৎ চেনা চেনা ঠেকা একেকটা মুখ। অ্যাডিলেড অস্বস্তিতে কাঁটা হয়ে থাকে। 

সারাদিন পর চারজন ফিরে আসে রেন্টাল বাড়িতে। ছেলেমেয়েকে যে যার ঘরে শুইয়ে অ্যাডিলেড আর অ্যাডিলেডের বর গেব সবে আরাম করতে যাবে এমন সময়, লোডশেডিং। ভাবা যায়? অ্যামেরিকাতেও? আলো জ্বালানোর বন্দোবস্ত করতে করতেই অ্যাডিলেডের মেয়ে এসে খবর দেয়, লোডশেডিংএর সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি অদ্ভুত ব্যাপার ঘটছে। বাড়ির সামনের ড্রাইভওয়েতে…

'আস'-এ ভাবার মালমশলা অনেক। গরীব বড়লোক, প্রিভিলেজ আনপ্রিভিলেজ, হ্যাভ হ্যাভ-নটস। এরা কতখানি আলাদা নাকি আর কতখানি একই কয়েনের এ পিঠ ও পিঠ? কে কতখানি একে অন্যের পরিপূরক? কে ইন আর কে ইয়্যাং? এক জন যদি নেই হয়ে যায় অন্যজন কি থাকতে পারে? সবথেকে বড় কথা, হঠাৎ যদি মাঝখানের বেড়া ভেঙে দুজনকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়, এরা কি দেখে চমকে যাব যে এদের মধ্যে তফাৎ আসলে কত কম? যে কোনও মুহূর্তে আমরা ওরা আর ওরা আমরা হয়ে যেতে পারি? 

এক পক্ষের কাছে এর থেকে হরিফাইং আর কিছু হতে পারে বলে আমার জানা নেই।

এই সব ভাবনাকে একজন অতি দক্ষ, অতি ভালো গল্প বলতে পারা পরিচালক, একটি অতি বিনোদনমূলক, ঝাঁ চকচকে, দ্রুতগতি, ভালো অভিনেতাওয়ালা সিনেমার মোড়কে পুরে পরিবেশন করেছেন। যোগ্য সঙ্গত করেছে অভিনয়, সংগীত, আলোছায়া। আপনি যদি ভাবতে চান ভাবতে পারেন, না চাইলে স্রেফ একখানা টানটান ভয়ের সিনেমা দেখে পয়সা উশুল করতে চাইলেও হতাশ হবেন না। 

'আস' হচ্ছে সেইরকমের সিনেমা যা দেখে বেরোনোর পর মাথায় সিনেমাটা ঘুরতে থাকবে। একেকটা ছোট্ট নিরীহ ডায়লগ, সিনেমার শেষে বিপুল তাৎপর্যে প্রতিভাত হবে। মনে আছে, ও প্রথমে ওই কথাটা বলেছিল? কিংবা তাকিয়েছিল? আচ্ছা তার মানে কি এইটা? বাড়ি এসে দুজনে একে অপরের দিকে পিঠ ফিরিয়ে যে যার ফোনে বিশ্বের রিভিউ, অ্যানালিসিস, থিওরি পড়তে হবে। আর মাঝেমাঝে খোঁচা দিয়ে বলতে হবে, এটা পড়েছ? এটা কিন্তু ভেবে দেখিনি। 

'আস' রিলিজ করার পর থেকে সকলেই পিলের প্রথম ছবি 'গেট আউট'-এর সঙ্গে তুলনা করতে লেগেছেন। রায় সকলেরই এক, গেট আউট-এর ব্রিলিয়ান্সের বুড়ি ছুঁতে পারেননি এবার পরিচালক। তবে একই সঙ্গে সকলেই পিলের প্রতিভা সম্পর্কে নিঃসংশয়। এ ছেলে অনেক দূর যাবে। আপনাদের হররে রুচি থাকলে ‘আস’ দেখে আসতে পারেন। আমাদের দুজনের খুব ভালো লেগেছে।


Comments

  1. অনেক জমে গেল, কবে যে সময় পাব এই সব দেখার?

    ReplyDelete
    Replies
    1. না পাওয়াই ভালো, নালক। এগুলো সময় নষ্টের গোড়া। তবু যদি ইচ্ছে করে যাতায়াতের পথে কানে ইয়ারপ্লাগ গুঁজে ফোনে দেখে নিতে পারেন।

      Delete

Post a Comment