তীর্থনের তীরে গোশৈণী/ ১




গোশৈণী-র গোলমেলে বানানটা আমি জানতাম না। ইংরিজিতে কোথাও Gushaini, কোথাও Goshaini দেখে দেখে বাংলায় ‘গুশাইনি’ ‘গোশাইনি’ ইত্যাদি উচ্চারণ করছিলাম। বানজার বাসস্ট্যান্ডে কনডাক্টর যখন বাস দেখিয়ে দিতে গিয়ে নামটা উচ্চারণ করলেন ঐ-কারের ছোঁয়াটা প্রথম কানে এল। মূর্ধন্য ণ আর দীর্ঘ ঈ-টা জানা হল গোশৈণীরই বনপথে হাঁটতে হাঁটতে। যখন রাজু ভাইয়ার কটেজের পেছনের জঙ্গুলে রাস্তাটা বেরিয়ে একটা স্কুলের সামনে পড়ল। গেটের ওপর বড় বড় গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ‘গোশৈণী বরিষ্ঠ উচ্চ বিদ্যালয়’। একেই বলে শিক্ষায়তনের মহিমা। ভেতর পর্যন্তও যেতে হল না, গেট পর্যন্ত পৌঁছতেই কেমন একটা নতুন জিনিস জানা হয়ে গেল। 

পাহাড়ের কোলের, নদীর ধারের স্কুলটা ভারি সুন্দর। ছেলেমেয়ে মিলে ভলিবল খেলা হচ্ছিল, সাইডলাইনে দাঁড়িয়ে লম্বা একখানা গাছ ঝুঁকে পড়ে সেই খেলা দেখছিল। কিন্তু চমৎকার সেই স্কুলের কথা এখন নয়। পারম্পর্য রক্ষার্থে কীভাবে গোশৈণী পৌঁছলাম, পৌঁছনোর সিদ্ধান্ত নিলাম এ সব আগে সারা দরকার।

সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব একটা শক্ত ছিল না। ‘অফবিট হিল স্টেশনস নিয়ার দিল্লি’ টাইপ করলে গোশৈণীর নাম সাজেশনে আসছিল বহুদিন ধরেই। তার থেকেও বেশি আসছিল তীর্থন নদীর তীরে রাজু ভারতীর কটেজের সাজেশন। সে নাকি স্টাফ মেড অফ ড্রিমজ। অনেকদিন পাহাড় পাহাড় মন করছিল, ঠিক করলাম মহাবীর জয়ন্তী আর গুড ফ্রাইডের ছুটি মিলিয়ে তীর্থন ভ্যালি ঘুরে আসা যাক। 

মঙ্গলবার সন্ধেবেলা আই এস বি টি থেকে হিমাচল সরকারের ভলভো বাসে চড়লাম। টুকটাক বিরতি বাদ দিয়ে সারা রাত চলে বাস পাহাড়ে পৌঁছল। বিয়াস নদীর ওপর লারজি ড্যামের মুখ চেয়ে বানানো অওট টানেল, ভারতের অন্যতম দীর্ঘ টানেল, প্রায় তিন কিলোমিটার। সকাল সাতটা নাগাদ টানেলের ও প্রান্তে আলো দেখা গেল। ওপারে পৌঁছে কন্ডাক্টর আমাদের নামিয়ে চলে গেলেন মানালির পথে। আমরা ঠকঠক করে কাঁপতে লাগলাম। গন্তব্যের এক জায়গায় তাপমাত্রা দুই তিন সেলসিয়াস থাকবে জেনে তৈরি হয়েই এসেছি, কিন্তু সোয়েটার জ্যাকেট সব বাক্সের ভেতর। এদিকে দশ হাত দূরে একটা লজঝড়ে বাসের সামনে দাঁড়িয়ে একজন ‘বানজার!’ ‘বানজার!’ হাঁকছেন। ওটাই আমাদের বাস। সোয়েটার পরতে গিয়ে মিস হলে নিজেদের ক্ষমা করতে পারব না। দৌড়লাম। বাস অলরেডি প্রায় ভর্তি। লাস্টের আগের রোয়ের দুটো সিটে তশরিফ রাখতে না রাখতে বাস ছেড়ে দিল। 

অওট থেকে বানজার সাতাশ কিলোমিটার। গোটা রাস্তা তীর্থন নদী সঙ্গে সঙ্গে চলে। নদীর ধার ঘেঁষে পাহাড়। একেকটা বাঁকের মুখে পাহাড়ের ঘন জঙ্গল ঝুলে প্রায় ছুঁয়ে ফেলে নদীর সাদা ফেনা। জলের ওপর জেগে আছে ছোট বড় পাথর। অল্প কল্পনাশক্তি খরচ করলেই ভেবে নেওয়া যায় পাথর নয়, মসৃণ পিঠের মস্ত সামুদ্রিক প্রাণীরা উবু হয়ে রয়েছে জলের নিচে, তাদের চকচকে পিঠে ধাক্কা দিয়ে নদী ছুটেছে।

খুব আয়েশ করে দেখতে পারছিলাম না অবশ্য। জানালার কাঁচটা বন্ধ হয় না। ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা মুখের চামড়ায় কেটে বসে যাচ্ছে। আমার সিনথেটিকের মাস মার্কেট কুর্তা বিন্দুমাত্র প্রতিরোধ খাড়া করতে পারছে না। হাওয়া কানের ভেতর ছুরির মতো ঢুকছে। ব্যাগ থেকে তোয়ালে রুমাল বার করে কানে চেপে ধরলাম, যদি একটু আরাম হয়। 

মাইন্ড ওভার ম্যাটার করার জন্য বাসের ভেতর মন দিলাম। এ সব অঞ্চলে শিরসজ্জার বাহার খুব। উল্টোনো বাটির মতো টুপি তো ছেলেরা সকলেই পরে, যাঁরা একটু বেশি বুড়ো অর্থাৎ কিনা ব্যাকডেটেড তাঁদের টুপিতে ঝালর, পালক গোঁজা। গোশৈণী বাজারের মুনলাইট ক্যাফের ভাইসাব নিজের মোবাইলে পাহাড়ি ট্র্যাডিশনাল নাচ দেখিয়েছিলেন। মহিলারা প্রমাণ সাইজের কুল্লু শাল গায়ে পেঁচিয়ে আর ছেলেরা টুপি পরে হাত ধরে ঘুরে ঘুরে নাচছিলেন। মহিলাদের সে সব শালের দাম নাকি হেসেখেলে দশবারো হাজার। সূক্ষ্ম হাতের কাজে ঠাসা, তৈরি হতে লাগে পনেরো দিন। আমি ক্লাস ফোরে সিমলা কুলু মানালি এসেছিলাম, আশি টাকার শাল কিনে নিয়ে গিয়েছিলেন মা, নিশ্চয় ফ্যাক্টরি-মেড, ডিজাইনও বেশি ছিল না, প্লেন কালো গা। সে চাদর এখনও আছে। রোঁয়া উঠে গেছে কিন্তু সমান গরম। পুরুষনাচিয়েদের টুপির বাহার দেখেছিলাম, প্রায় টোপর বললেই চলে। ঝালর প্রায় বুক পর্যন্ত লম্বা আর টুপিতে গোঁজা পালকখানাও হাতখানেক উঁচু। সত্যিকারের কোনও এক বাহারি পাখির পালক নাকি ওটা। পাখিটাকে বধ করে ল্যাজের পালক ছিঁড়ে নিয়ে টুপিতে গোঁজা হয়েছে। শুনেই আমার নব্য জীবদরদী হৃদয় কেঁপে উঠল, এ হিংস্রতার থেকে কম বাহারি প্লাস্টিকের পালক ঢের ভালো। বাসের বুড়োরা সেই রকম নকল পালকওয়ালা টুপিই পরেছেন। মহিলারা রঙিন স্কার্ফ মাথায় বেঁধে চলেছেন। দুজন একেবারে একরকম দেখতে মহিলা, বোনও হতে পারেন কিন্তু আমার সন্দেহ হচ্ছে বন্ধুই, হেসে হেসে গল্প করতে করতে চলেছেন। 

বাসও চলেছে। লোক তুলতে তুলতে, নামাতে নামাতে, ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে। সবসময়েই যে লোক তুলতে নামাতেই থামা তেমন নয়। উল্টোদিক থেকে বেকায়দা গাড়ি এসে গেলেও থামা, রাস্তা চওড়া হচ্ছে, হুণ্ডাই-ছাপ মাল্টিন্যাশনাল ক্রেন তার বিরাট আনফিট বডি নিয়ে আগুপিছু করলেও থামা। আর আমি কানে রুমাল চেপে খোলা জানালার পাশে বসে কাঁপছি।

আপনারা এত কৃচ্ছ্রসাধন নাও করতে পারেন। দিল্লি থেকেই নিয়ে নিন গাড়ি, একেবারে রাজুভাইয়ার কটেজের উল্টোপার পর্যন্ত চলে যান। ভিউ বাসের জানালা দিয়েও যা, গাড়ির জানালা দিয়েও সমান। বরং দেখতে আরও সুবিধে। বাসে চড়ে সবাই অফিসকাছারি যাচ্ছে, 'ভাইসাব থোড়া রোকিয়ে, ফোটো লেনা হ্যায়' বললে ভাববে উন্মাদ। গাড়ি থাকলে আপনি আপনার মর্জির মালিক। ভিউ মনোমতো হলে কিংবা বমি পেলে থামান। ইচ্ছেমতো নামুনউঠুন। ছবি তুলুন বা আরাম পান।

ঘণ্টাখানেকের একটু কম সময়েই বানজার পৌঁছে গেলাম। বানজার হচ্ছে কুল্লু ডিসট্রিক্টের একটি ঘাঁটি। বাসস্ট্যান্ডে কুল্লুর মোটামুটি সর্বত্র যাওয়ার বাস পাওয়া যায়। আমরা গোশৈণীর বাস ধরব কিন্তু তার আগে সুটকেস খুলে জ্যাকেট পরব। শীতে হাড় পর্যন্ত  খটখটিয়ে গেছে, বাপ রে বাপ রে বাপ। সোয়েটশার্টের জিপ চিবুক পর্যন্ত টানতে টানতে খাকি পোশাক পরা কন্ডাক্টরদের জটলার দিকে এগোলাম। 

গোশৈণীর বাস কোনটা ভাইসাব? 

সতরাসো বত্তিস, নিলা কালার।

আমরা ঠিক গোশৈণীতেও যাব না। পথনির্দেশ অনুযায়ী গোশৈণী পৌঁছনোর এক কিলোমিটার আগে (একেবারে নিক্তি মেপেই বলা যায়, কারণ 'গোশৈণী ১’ লেখা একখানা ফলক আছে বসানো) নেমে পড়ে নদী পার হয়ে রাজু ভারতীর কটেজে পৌঁছতে হবে। চলন্ত বাস থেকে ফলক মিস হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করাতে কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিয়েছিলেন। বোল দেনা কে রাজু ভারতীকে কটেজ যানা হ্যায়। সবকো পাতা হোগা। 

দাবিটা মিথ্যে নয়। রাজু ভারতীর কটেজ সত্যিই সবকো পাতা হ্যায়। বানজারের কন্ডাক্টর ভাইসাবদের পাতা হ্যায়, সতরাসো বত্তিসের কনডাক্টরের পাতা হ্যায়, বাসশুদ্ধু সব প্যাসেঞ্জারের পাতা হ্যায়। কিন্তু বিশ্বাস করা তো ধাতে নেই। 'রাজু ভাইয়ার কটেজ এলে নামিয়ে দেবেন দয়া করে’ বলে দিয়ে যে জানালার কাঁচে নাক ঠেকিয়ে বসব, অতখানি আস্থার ক্ষমতা নিয়ে জন্মালে তো হয়েই যেত। কাজেই আমি বারদুয়েক ‘মনে আছে তো?’, 'দয়া করে রাজু ভারতীর কটেজে আমাদের নামাতে ভুলবেন না’ ইত্যাদি বলে ফেললাম। তার পর থেকে তিন সিট পেছনে বসা অর্চিষ্মানের দিকে এমনিই, কোনও কারণ ছাড়া তাকানোর উপক্রম করলেও সকলে সমস্বরে বলে উঠছিলেন, বতা দেঙ্গে বতা দেঙ্গে।

অবশেষে একজায়গায় এসে সবাই বলল, এইবার নামো। 

নামলাম। বৃষ্টিও নামল। 

পাহাড়ি বৃষ্টির কোনও মুখড়া, অন্তরা, সঞ্চারী হয় না। মেঘ চলেছে আকাশ দিয়ে ভেসে ভেসে, পাহাড় পর্বত ডিঙিয়ে যেতে যেতে যেখানে ক্লান্ত লাগল ঝপঝপ জল ঝরিয়ে হালকা হয়ে নিল। সে নিক কিন্তু আমরাও তো বানজার বাসস্টপে ঘটা করে সোয়েটশার্ট পরেছি, বাস থেকে নামার পাঁচ’সেকেন্ডের মধ্যে সে ভিজে কম্বলের মতো ফুলে উঠল। ছাতা ছিল একখানা সঙ্গে কিন্তু তখন আর বার করে কী হবে। তাছাড়া ছাতা বার করার থেকেও জরুরি কাজ আছে আমাদের একটা, রাজু ভারতী কটেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন। 

খাঁ খাঁ রাস্তায় ব্যাকপ্যাক কাঁধে আমরা দুটি প্রাণী, ঝমঝম বৃষ্টি পড়ছে। একদিকে পাহাড়, অন্যদিকে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে মহোল্লাসে ছুটেছে তীর্থন। বৃষ্টির ছাঁটে ঝাপসা চশমা বার বার অ্যাডজাস্ট করেও ফলক দেখতে পাচ্ছি না।নদীর ওপারে জঙ্গলের মধ্যে গোটাদুয়েক আবছা ঘরবাড়ি মালুম হচ্ছে কিন্তু কোনটা রাজুর? 

কিছুটা এগোতে 'গুশাইনি ১’ ফলক চোখে পড়ল। আমার ছোঁয়াচ লেগে বাসের লোকেরাও নার্ভাস হয়ে পড়েছিলেন নির্ঘাত, খানিকটা আগেই নামিয়ে দিয়েছেন। ফলকখানার এদিকওদিক মিনিটতিনেক হাঁটাহুটি করতে করতেই রাস্তা থেকে নদী পর্যন্ত নেমে যাওয়া সিঁড়ি আবিষ্কার হল। সিঁড়ির শেষে দুলছে রিভার ক্যারেজের দড়ি।


ইন্টারনেটে এই জিনিসটার ছবি দেখে ইস্তক উত্তেজনা ছিল মনের ভেতর। কাজেই আমি পেরোলাম যখন অর্চিষ্মান ছবি তুলল, অর্চিষ্মান পেরোলো যখন আমি ছবি তুললাম। এদিক থেকে ঠেলে দেওয়ার পর মাঝপথে যেতে যেতে জাড্য কমে আসে তখন ওপার থেকে টেনে নিতে হয়। মাঝপথে সেকেন্ড কয়েক থেমে থাকতে ভালোই লাগে। কেমন মাধ্যাকর্ষণকে কাঁচকলা দেখিয়ে ভাসছি। দুলছি হাওয়ায় অল্প অল্প।


অর্চিষ্মান পৌঁছলে পর ভাইয়ার পিছু পিছু মূল বাড়ির ডানদিকে একটা আলাদা কাঠামোর দিকে এগোলাম। কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠে দোতলা। ল্যান্ডিং-এ একটি ধপধপে সাদা লোমশ কুকুরের ছবি। লাল জিভ বার করে গর্বিত মুখে রিভার ক্যারেজ চড়ে তীর্থন পাড়ি দিচ্ছে।

কটেজের ঘরখানা বেশ প্রশস্ত। কাঠের মেঝে, ছাদ, খাট, সাইড টেবিল, বুককেস। ঘরের মাঝখানে কাঠের টেবিল বেঞ্চিসোফা, সোফায় মোটা কার্পেটের আসন। আমরা গিয়ে ভেজা কম্বল গা থেকে ছাড়াতে ছাড়াতেই গরম চা এবং বিস্কুট এসে গেল। শুকনো কম্বলে পা ঢুকিয়ে সোফায় লম্বা হলাম।

গোশৈণীর রাজু ভাইয়ার কটেজের ডিম্যান্ড অত্যন্ত হাই। পনেরোদিনের নোটিসে একরাতের বুকিং পেয়ে গিয়ে অবাকই হয়েছিলাম। ডিম্যান্ডের অনেক কারণ আছে। জায়গাটা নির্জন বটে কিন্তু প্রত্যন্ত বা দুর্গম নয়। আর টইটম্বুর আছে শহুরে আরাম। একলাও হওয়া হল আবার ফোর জি-ও ছাড়তে হল না। নদীর ধারে বসে টুইটার স্ক্রোল করলেন। একটুও আরাম ত্যাগ না করে প্রকৃতির কোলে গিয়ে থাকতে চাইলে রাজুর কটেজ পারফেক্ট। তবে সেই প্রকৃতিটি খুব রোমহর্ষক নয়, এটাও মনে রাখতে হবে। মানে আপনার যদি ভোরে উঠেই পাহাড়শৃঙ্গ জয় করার জন্য মন আনচান করে তাহলে রাজু ভারতীর কটেজের থেকে অনেক ভালো জায়গা আছে হিমাচল প্রদেশে। রাজু ভারতীর কটেজ অলস পাহাড়প্রেমীদের জন্য আদর্শ জায়গা। কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে বই পড়ুন, ফোন ঘাঁটুন। মাঝে মাঝে জানালা দিয়ে গাছপালা আকাশ দেখুন। পড়তে পড়তে বই কখন হাত থেকে খসে মুখের ওপর পড়বে, মুখ অল্প হাঁ করে আপনি সুখস্বপ্নে তলিয়ে যাবেন। হঠাৎ যদি চটকা ভাঙে, নিজের আচমকা নাসিকাগর্জনে কিংবা খিদের তাড়নায়, দেখবেন আপনি ঘুমিয়ে পড়ার সময় পৃথিবীটা যেমন ছিল এখনও ঠিক তেমন আছে। তীর্থনের গর্জন এক আছে, বুনো পাখির দুয়েকখানা টুঁই টাঁই এক আছে আর সব ছাপানো নির্জনতা, নৈঃশব্দ্যও আছে অবিকল। সিলিং-এর সানরুফ থেকে আসা আলোটাই যা একটু মরে এসেছে। 



তবে গোশৈণীতে শুধু হাত পা কোলে নিয়ে শুয়ে না থাকতে চাইলেও অসুবিধে নেই। ধার দিয়েই গেছে গ্রেট হিমালয়ান ন্যাশনাল পার্ক। এগারোশো বর্গ কিলোমিটার জুড়ে ফ্লোরা এবং ফনার অভূতপূর্ব সমাহার। শত শত রকমের গাছ, ফুল, প্রাণী আছে ওই জঙ্গলে। পারমিট এবং গাইড নিয়ে আপনি দু’রাত তিন দিন, তিন রাত চার দিন, এমনকি সাত রাত আট দিনের ভ্রমণেও যেতে পারেন। আমরা যাইনি, কিন্তু অর্চিষ্মানের খুব ইচ্ছে পরে কোনও এক সময় যাওয়ার।

চা পেটে পড়তেই খিদে চনমনিয়ে উঠল। সকাল থেকে তো স্রেফ দু’খানা গুড ডে বিস্কুট। রাজু ভাইয়ার কটেজে খাওয়ার জায়গা কমন। ‘নিজে বেড়ে খাও’ পদ্ধতি। আমার জন্য স্যালাড, ভাত, রুটি, রাজমা, আলু বেগুনের তরকারি, শাক, সেমুইয়ের পায়েস। দু’রকমের আচার। লাল আচারটা অল্প মিষ্টি, সবুজটা খাঁটি লংকার। পাশে বোতলে ভরা লাল রঙের প্লাম জুস, অল্প অন্য লাল শেডের রডোডেনড্রন জুস, আর সবুজ জুসও রাখা আছে, যেটার উৎস ভুলে গেছি। লালনীল শরবতে আমার রুচি নেই, অর্চিষ্মান নিজে এক গ্লাস নিয়ে আমাকে দিয়ে আরেক গ্লাস আনিয়ে দু’গ্লাসই খুব তৃপ্তি করে খেল।


ক্লান্ত শরীরে ওইরকম টাটকা গরম খাবার পেটে পড়লে যা হয় তাই হল। ঘরে গিয়ে লেপের তলায় সেঁধোলাম। বৃষ্টি তখনও অঝোরে ঝরছে, কাজেই এত খরচ করে এত দূরে বেড়াতে গিয়ে সময় নষ্টের দোষ কেউ দিতে পারবে না। ঘুম ভাঙতে একেবারে বিকেল। তখনও বৃষ্টি। চা বলতে কে যাবে? রাজুভায়ার কটেজে ইন্টারকম সিস্টেম নেই। আহা, অত কিছু থাকলে আর বাড়ির থেকে আলাদা কী হবে। টিভিও এরা চাইলেই দিতে পারত, ডিশ অ্যান্টেনা দেখা যাচ্ছে, নিজেরা দেখে। কিন্তু কাস্টমারদের দেয়নি, দিলে বনবাস-বনবাস ফিলিংটা আসবে না। অন্ধকার হয়ে এসেছে, কিন্তু আলো জ্বালাতে ইচ্ছে করছে না। চা হলে ভালো হত। আচ্ছা, আমিই যাচ্ছি না হয়। জল জমে ঘর আর ডাইনিং হলটার মাঝের পথটার মাটি প্যাচপেচে হয়ে গেছে। ডানদিকে একটা শেডের তলায় শুকনো কাঠ ইত্যাদি জড়ো করা। কাঠের ঢিপির পাশে থাবায় মাথা রেখে শুয়ে আছে দুটো ঝুপসি মতো কুকুর । একটা কুচকুচে কালো, অন্যটার কালোর মধ্যে মধ্যে ডার্ক ব্লন্ড হাইলাইটস। তাকাতে তাকাতে গেলাম, আমাকে দেখতে পেল না নাকি দেখেও পাত্তা দিল না জানি না।

চা এল, সঙ্গে প্লাস্টিকের ছোট বাক্স ঠাসা বিস্কুট। রাজু ভাইয়ার কটেজের রকমারি বিস্কুটের বাক্সের সিস্টেমটা দারুণ। পার্লে জি-ও যেমন রয়েছে, ফিফটি ফিফটিও রয়েছে, মারিও রয়েছে, গুড ডে আর একটা চিনি ছড়ানো চৌকো বিস্কুটও (নাইস নয়)। দেখেশুনে বেছেটেছে খেতে বেশ খানিকটা মনোযোগ আর সময় খরচ হয়। 


অর্চিষ্মান কয়েকখানা রিডার্স ডাইজেস্ট বুককেস থেকে নামিয়ে টেবিলে ছড়িয়ে রেখেছে, একবার এটা একবার ওটা পাতা উল্টে উল্টে নাড়ছেছাড়ছে। আমি উল্টোদিকের কেঠো সোফায় শুয়ে ফোনের অ্যাপে ‘আর্লি ইন্ডিয়ানস’ পড়ছি। আমার শরীরে পঁয়ষট্টি হাজার বছর আগে ভারতে প্রথম পা দেওয়া এক নারীর ডি এন এ থাকার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি, এতই বেশি যে আছে বলে ধরেই নেওয়া যায়। ভাবা যায়? সি আর পার্কের ঘরে বসে এ তথ্য জানতে পারলেও সমান ইমপ্রেসিভ লাগত নিশ্চয়, তবে এই বৃষ্টিভেজা বনের নির্জনতায় যেন আরও গায়ে কাঁটা দিচ্ছে।

আর পড়া যাচ্ছে না। আলো মারাত্মক কমে এসেছে। যাঃ, ফুরিয়েই গেল। লাইট জ্বালালে হয়। না জ্বালালেও হয়। চল বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। 

গাছেরা সব এখন অক্সিজেনের দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে বোধহয়। ঠাণ্ডা হাওয়ায় পাতার গন্ধ। কুকুরদুটো মাঝে মাঝে চেঁচাচ্ছে। ভালো ঠাণ্ডা আছে কিন্তু। ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে দেখ তো, দেওয়ালে লাগানো থার্মোমিটারটায় কত দেখাচ্ছে টেম্পারেচার। এই বাজারে কে টর্চের আলো ফেলছে? আচ্ছা অভদ্র তো। টর্চ না, একটা বাস আসছে বোধহয়, তার হেডলাইট। কত দূর থেকে আসছে? শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না তো? যাবে কী করে, আলো শব্দের থেকে দ্রুতগতি, ক্লাস সেভেনের জড়বিজ্ঞান। আলোতে সামনের পাহাড়টাকে কী বড় আর গা ছমছমে দেখাচ্ছে। নদীটা অনেক নিচ দিয়ে বইছে বলে দেখা যাচ্ছে না। খালি গর্জন শোনা যাচ্ছে। দিনের বেলাতে এই আওয়াজ শুনেই কল্লোলিনী মনে হয়, অথচ রাতে মনে হয় রেগে ফুঁসছে। আলো থাকা না থাকার কত তফাৎ, তাই না? কী গো? কী ভাবছ?

এই ভাবছি। বোকা বোকা ভাবনা। ওই পাহাড়টার তুলনায় আমরা কতটুকু। এই গাছটার তুলনায় আমার এক্সিসটেন্স কত কাঁচা। আমি যখন ছিলাম না তখনও নদীটা বয়ে যাচ্ছিল, আমি মরে ভূত হয়ে যাওয়ার পরেও বয়ে যাবে। এই সব বোকা বোকা ভাবনা ভাবছি। নাথিং অরিজিন্যাল। অরিজিন্যাল ভাবার ক্ষমতা নেই। খালি রচনাবইয়ে পড়া ক্লিশে অনুভূতির চর্বিতচর্বণ।

আহা, তাতে ক্ষতি কীসের। ক্লিশে ক্লিশে তখনই হয়, যখন ব্যাপারটা ট্রু। চুরি করা মহাপাপ, সূর্য পূর্বদিকে ওঠে, পরিশ্রমের বিকল্প নেই, জীবনের যা যা সারসত্য সব ক্লিশে। সত্যি আর কত অরিজিন্যাল হবে? এইসব পাহাড় গাছ নদীর তুলনায় আমার তোমার তুশ্চুপনা সত্যি, তাই ক্লিশে। তাছাড়া অরিজিন্যালিটি ওভাররেটেড। আমার তো মনে হয় এই সিচুয়েশনে দাঁড়িয়ে অনিত্যতা আর অকিঞ্চিৎকরতার ক্লিশে সত্যিটা চেতনায় না জাগলেই বরং চিন্তার কথা।

বলছ?

আলবাৎ। 

বাঁচালে।

                                                                                                                              (চলবে)


Comments

  1. River carriage bapar ta bes mojdar. ki santo snigdha chobigulo. mon vore gelo

    ReplyDelete
    Replies
    1. হ্যাঁ, আমাদেরও খুব মজা লেগেছে, সুহানি। ফেরার পথে অর্চিষ্মানের ব্যাগের হ্যান্ডেল ক্যারেজের দড়িতে জড়িয়ে গিয়ে বিঘ্ন ঘটায় ওকে প্রায় এদিকে পৌঁছেও আবার ওদিকে গিয়ে গোড়া থেকে শুরু করতে হয়েছিল। ঘটনাটায় আমি রীতিমত ঈর্ষান্বিত বোধ করেছি।

      Delete
  2. কলকাতায় এখনই যেভাবে গরম পড়েছে তাতে করে এই রকম লেখা ও ছবি খুব দরকার ছিল। গরম কালটা তোমার ঘুরতে যাওয়ার ভরসাতে উৎরে দিতে পারবো বলে মনে হচ্ছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. গরমের কথা যত কম বলা যায় ততই ভালো, প্রিয়াঙ্কা।

      Delete
  3. বৈজয়ন্তীApril 26, 2019 at 7:45 AM

    লাস্ট পাহাড় গেছিলাম কোটি কোটি বছর আগে। এমনিতেই পাহাড় পাহাড় করে হেদিয়ে মরছি, দুঃখ ভুলতে মোমো আর ম্যাগির ঝোল খাচ্ছি, সুবিধে হচ্ছেনা। তারমধ্যে আপনার এই পোস্ট। ভয়ঙ্কর চাপের ব্যাপার।

    রিভার ক্যারেজে পার হবার ছবি কই?

    ReplyDelete
    Replies
    1. ছবি আছে তো, বৈজয়ন্তী। ওই যে চ্যাপ্টামতো ছবিটা। আমি অনেক দূরে বিন্দু হয়ে ঝুলছি।

      Delete
    2. বৈজয়ন্তীApril 26, 2019 at 10:31 AM

      বোঝো..!! বলার পর ম্যাগনিফাই করে দেখতে পেলাম।

      Delete
  4. aanina keno post e comment korte parchhi na. China te thakar eta ekta asubidhe majhe majhe internet er eta seta bondho hoi koekdin er jonyo. Abar khole. Jaihok, ki darun jaigai berate gechhen...amar ei offbeat jaigagulo eto bhalo laage...
    River carriage ta besh mojar. chhobita dekhe amar goto bochhor project er kaaje Nepal er experience mone porlo. khub i remote aar durgom jaigai project....atibo khorosrota nodi boye cholechhe aar tar opor jhulonto lohar pool...ja samane dulchhe...oi korei epar opar giye kaaj kora...kichhu pool er obostha besh kharap...prai hama deoar abastha...kintu asombhob sumdor prokriti
    aaro chhobi upload korun. boro bhalo laglo ei jaigata dekhe

    ReplyDelete
  5. Aager comment ti amar kora. Kichhutei Google account theke korte parchhi na.
    ---Susmita

    ReplyDelete
    Replies
    1. এ রকম ঝামেলা আরও অনেকের হয়েছে শুনেছি, সুস্মিতা। নেপালের অভিজ্ঞতা তো রোমহর্ষক মনে হচ্ছে। তবে নেপালও খুব সুন্দর শুনেছি? আমাদের যাওয়ার ইচ্ছে আছে, দেখা যাক। ছবি আসছে আরও, দরকারের বেশিই আসছে, নো চিন্তা।

      Delete
  6. Bah bah. Ei jaigata amaar liste achhe , kajei onek subidha holo :) thank you thank you

    ReplyDelete
    Replies
    1. গোশৈণী রিল্যাক্স করার জন্য চমৎকার, অর্পণ। কিন্তু আমাদের দেখতেশুনতে আরও বেশি ভালো লেগেছে সোঝা। যদি নাও থাকো, গোশৈণী থেকে গাড়ি নিয়ে গিয়ে একদিন সোঝা, জালোরি পাস ঘুরে এসো, রাস্তাটা অপূর্ব সুন্দর।

      Delete
  7. Bah.. besh sweet jayga ta .. naam sunini age.. amar o ekta relaxing trip er plan ache.. photo dao aro..

    ReplyDelete
    Replies
    1. জায়গাটা সত্যিই সুন্দর, ঊর্মি।

      Delete
  8. দুটো পররই পড়লাম। হিমাচল আমার একটুও দেখা নেই , তোমার লেখায় খালি লোভ লাগে কবে যে যাওয়া হবে!।
    আচ্ছা ফেব্রুয়ারি হিমাচল বা উত্তরাখন্ড কেমন বলো তো?

    ReplyDelete
    Replies
    1. হিমাচল অতি সুন্দর জায়গা, প্রদীপ্ত। উত্তরাখণ্ডও, তবে আমার পক্ষপাত হিমাচলের দিকে। ফেব্রুয়ারি মাসের ব্যাপারটা একটু জায়গাভিত্তিক হবে বুঝলে। ওপরের দিকগুলোয় বরফ পাবে। এই জালৌরি পাস, সেরওলসর লেকটেকই বন্ধ থাকবে। কিন্তু আবার অনেক জায়গা থাকবেও না। যাওয়ার আগে নেট ঘেঁটে নিয়ো।

      Delete

Post a Comment