লোহা



স্বপ্ন ব্যাপারটাই গোলমেলে। কাজেই স্বপ্নের পুরুষ, নারী, চাকরিও গোলমেলে হবে স্বাভাবিক। স্বপ্নের চাকরি আমি পাইনি কাজেই মন্তব্য করতে পারব না, স্বপ্নে নারীদেরও দেখিনি। অন্তত এমন নারী দেখিনি যার কথা ‘যে ছিল আমার স্বপনচারিণী’ গানটা যতবার শুনব ততবার মনে পড়বে।

স্বপ্নের পুরুষ, অন দ্য আদার হ্যান্ড, ছিল কিছু এক সময়। বা সময় সময় বলা উচিত। অন্তত আমি ভেবেছিলাম ছিল। মানে না থাকার কোনও কারণ নেই। লিখতে গিয়ে কনফিডেন্সে টান পড়ে যাচ্ছে। ছিল না এ কি হতে পারে? যদিও স্বপ্নে কী দেখেছিলাম কবে দেখেছিলাম কিছুই মনে করতে পারছি না। ভাসাভাসা লাগছে সব। কেমন ছিল আমার স্বপ্নের পুরুষ? 

চশমা ছিল মোটামুটি ধরে নেওয়া যায়। গিটার ছিল (এই আরেকটা রহস্য। নিজে আজীবন বাঁয়া তবলা হারমোনিয়াম, অথচ স্বপ্নে সর্বদা গিটার), হাইট (বেশির দিকে), ওয়েট (কমের দিকে), মায়াদয়া (বেশির দিকে), বাজে কথা আবার কমের দিকে। তাগাতাবিজ, ডেফিনিটলি…

নাঃ, এইবার খেয়ালের পোলাওতে ঘি ঢালছি। আমি মোটেই স্বপ্নের পুরুষের এত সব বৈশিষ্ট্য কল্পনা করিনি। বড় জোর কাউকে কাউকে দূর থেকে দেখে ভেবেছি স্বপ্নের পুরুষ এই রকম বা এর কাছাকাছিই হবে নির্ঘাত। ব্যস। 

সে পুরুষের রাজনৈতিক মতবাদ? সোশ্যাল মিডিয়ায় আচরণ? মিটু-তে স্ট্যান্ড? নারীবাদের প্রতি মনোভাব? সিনেমা? সাহিত্য? মোদী না মমতা? পাহাড় না সমুদ্র? নর্থ গোয়া না সাউথ গোয়া? 

এই মুহূর্তে বাস্তবে আমার কাছে যে বিষয়গুলো নন-নেগোশিয়েবল, সেগুলো স্বপ্নে যাচাই করে নেওয়ার কথা আমার মাথাতেও আসেনি।

আমার স্বপ্ন, আমার স্বপ্ন দেখার ক্ষমতা দ্বারা সীমাবদ্ধ। এ বিষয় আমার বাস্তবের সঙ্গে তার খুব একটা অমিল নেই।

তার ওপর বাস্তবও তো ক্ষণে ক্ষণে রং বদলায়। ক’দিন ধরে মিটুতে চোয়াল আর কপালের শিরা দপদপ করল। আজ সকালে উঠে দেখলাম ফ্রিজ চলছে না। প্লাগ পয়েন্ট গেছে খারাপ হয়ে। ইলেক্ট্রিশিয়ান টাকা গুনে বাড়ি পৌঁছতে পারবেন না, আবিষ্কার করব একজস্টটাও অনড়। পেপারে কার নাম কোথায় যাবে সে নিয়ে কাল সারাদিন একটা অবিশ্বাস্য ছেঁদো বিরক্তি মাথা ঘাড় পিঠ ছেয়ে থাকবে। তরশু কেউ আমাকে অপমান করবে। পরশু আমি একজনকে অপমান করেছিলাম তার পেব্যাক। অবান্তরের পরের পোস্ট কী নিয়ে লিখব জানি না। মাথা ব্ল্যাংক। একটা গল্প নিয়ে ঘষটাচ্ছি তিন মাস, অকথ্য খারাপ হচ্ছে। একজন সাড়ে সাতাত্তর হাজারি উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি মাথার ওপর তুলে ধরে ছবি দিয়েছে ফেসবুকে। ফিনিশড ইন টু মান্থস। রান্নাঘরের ড্রেন জ্যাম। 

অফিসের ইনবক্সে খামবন্ধ ইমেল। ডিয়ার কুন্তলা, হ্যাপি টু লেট ইউ নো ডিরেক্টর আজ অ্যাপ্রেইজাল মিটিং-এর লগ্ন ধার্য করেছেন।

আমি হাত বাড়াই। কোথায় তুমি, আমার স্বপ্নের পুরুষ? বিজবিজ করে শর্ট সার্কিটের মতো আওয়াজ, চিড়িক মেরে গিটার, চশমা, দাড়ি, হাতা গোটানো পাঞ্জাবী হাওয়া। পড়ে আছে খালি পোড়া গন্ধ আর সামান্য ধোঁয়া।

চোখ খুলি। হাত ধরে আছে বাস্তবের পুরুষ। বলছে, সঅঅঅঅব ভালো হবে। আমি জানি। চেস্ট আপ চিন আপ করে যাও দেখি।

তার জানার কথা নয়। সে তো নস্ত্রাদামুস নয় যে জানবে আমি সারাবছর অফিসে কী গুল খিলিয়েছি। তবু সে জোর গলায় বলে। এবং আমি তাকে বিশ্বাস করি। 

সত্যি ভালো হবে সব? 

খারাপ হওয়ার সিনই নেই। 

আমার শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়। হৃদপিণ্ডের বেগ কমে আসে। অ্যাপ্রেইজাল মিটিং-এ ঢোকার আগে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে টের পাই আমার শিরদাঁড়াকে ঠ্যাকনা দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছে আরেকটা শিরদাঁড়া, আমার মগজের সেরোটোনিনের শীর্ণ সাপ্লাই সতেজ রেখেছে আরেকজনের আশ্বাস। আমার হৃদপিণ্ডের পাশে পাশে সমান তালে সমান লয়ে লং মার্চ করছে আরেকটা হৃদপিণ্ড। তালে তালে আবৃত্তি করছে, যো হোগা দেখা যায়েগা। ভারি তো চাকরি। উদ্ধার করে দিয়েছে যেন। কত নিমেষ, মুহূর্ত, মিনিট, ঘণ্টা, দিন, রাত, খরা, বর্ষা পার করে ফেললাম, সামনের পনেরো মিনিট তো তুশ্চু।

তার ওপারে আমি থাকব। তুমি থাকবে। আর থাকবে অ্যাভেঞ্জারস এন্ডগেম-এর দু’খানা টিকিট। সে বেছে বেছে দেখেশুনে কেটে রেখেছে। যাতে আমার সিটের অব্যবহিত পেছনে কোনও সিট না থাকে। যেখানে বসে কেউ গোটা সিনেমা লাথিয়ে আমার সিনেমা দেখা মাটি না করতে পারে।

আমার সেই বাস্তবের পুরুষটিকে আমাদের ছ’নম্বর বিবাহবার্ষিকীর অভিনন্দন জানাই। ভাগ্যিস তুমি ছিলে অর্চিষ্মান। নাহলে আমার সত্যিটা স্বপ্নের থেকেও সুন্দর হত কী করে? 



Comments

  1. বিবাহবার্ষিকীর ভরপুর শুভেচ্ছা জানাই। জীবন হিমসাগর আমের মতো মিষ্টি আর আইসক্রিমের মতো ঠান্ডা থাকুক।
    আমি জানি এতে আপনাদের পোষাবে না। তাই কর্মক্ষেত্র নামক কাটাপোনার ঝাল, আর মাঝেমধ্যে বিরিয়ানির ব্যবস্থাও থাকবে আশা করি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, অনেক ধন্যবাদ, ঋজু। আমরা পিৎজা খেতে যাওয়ার প্ল্যান করছিলামই, আপনার কমেন্ট পড়ে আইসক্রিমও জুড়ে নিলাম মেনুতে। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  2. Bibaho barshikir onek shubheccha roilo.
    Mishti lekhata pore aro ekbar ei buro boyoshe preme porte icche Kore .. .Tomar Noy kinechi...porechi.. .Thakrun
    Pore shtobdho. ...

    ReplyDelete
    Replies
    1. শুভেচ্ছার জন্য অনেক ধন্যবাদ, রণিতা। আর ঠাউরুন পড়ে ভালোলাগা জানানোর জন্যও। আমিও একবার আমার মাস্টারমশাইয়ের কাছে খুব আফসোস করছিলাম যে প্রেমের পড়ার বয়স চলে গেল, তাই শুনে তিনি মাথা নেড়ে বলেছিলেন, প্রেমে পড়ার যে কোনও বয়স হয় না এটা যখন বোঝোনি সেটাই প্রমাণ করছে যে যথেষ্ট বয়স হয়নি তোমার। আমি মাস্টারমশাইয়ের শিক্ষাটা তোমাকে রিলে করে দিলাম।

      Delete
  3. Subho Bibahobarshikir onek onek suveccha roilo. Erokom vabei aro ogunti bochor katuk eksathe anondo kore r eke onner opor vorsa kore.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, সুহানি। তোমার মুখে যা খেতে ভালোবাসো তাই পড়ুক।

      Delete
  4. happy anniversary, my dear. ভাগ্যিস অর্চিষ্মান তোমার জন্য অপেক্ষা করছিল, তাই তো তুমি পারলে মারের সাগর পাড়ি দিয়ে এসে তার হাতখানি ধরতে। এবার গাও, হাত ধরে তুমি নিয়ে চল সখা। না না, মনে মনে এটা বলাই যথেষ্ট ,জানি বন্ধু জানি তোমার আছে তো হাতখানি। সারা জীবন এভাবেই নৌকা বেয়ে যাও, এই কামনা করি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, মালবিকা।

      Delete
  5. আহা। সুস্বাদু। এই বিষয়ে আরো কিছু লেখালেখি হোক।

    ReplyDelete
  6. শুভ বিবাহবার্ষিকী কুন্তলা। হেসে খেলে আদোরে অভিমানে ভালো থেকো সারা জীবন

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, দেবশ্রী। খুব ভালো লাগল শুভেচ্ছা পেয়ে।

      Delete
  7. Happy Anniversary, Kuntala-Archisman.
    Ebhabei ashuk bare bare fire fire ei din ti, khub khub bhalo thakun dujone.

    Onek Shubheccha roilo. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, অরিজিত।

      Delete
  8. শুভ বিবাহবার্ষিকী :-)

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, সায়ন।

      Delete
  9. Anniversary er anek anek bilombito subhechchha.... Khub anonder hok apnader agami dingulo

    —-Susmita.

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, সুস্মিতা। ভালো লাগল শুভেচ্ছা পেয়ে।

      Delete
  10. Onek subheccha tomader dujon ke.. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, ঊর্মি।

      Delete
  11. khub bhalo theko dujone :) chhoy ey chhoy ey chhoylaap hoye jaak ekebare

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, এই কমেন্টটায় একেবারে ছক্কা মেরেছ প্রিয়াঙ্কা। শুভেচ্ছার জন্য অনেক ধন্যবাদ। খুব ভালো লাগল।

      Delete
  12. কদিন দেরী হয়ে গেল,তাতে কি,না ছয় বছর এর বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছার সাথে আরো আটদিনের শুভেচ্ছাও রইল আমার তরফ থেকে।
    ভারী ভালো লেখাটা। এভাবেই ভালো থেকো দুজনে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ থ্যাংক ইউ, প্রদীপ্ত। বাড়তি শুভেচ্ছার জন্য এক্সট্রা থ্যাংক ইউ।

      Delete

Post a Comment