প্রিন্টার বনাম মিনিম্যালিজম




নতুন অফিসে জাঁকিয়ে বসেছি। আগের অফিসের ড্রয়ারে যা যা রাখতাম সে সব এই অফিসের ড্রয়ারে ঢুকিয়েও জায়গা বাকি থেকে গেছে। আগের অফিসের ডেস্কের ওপর রাখা জিনিসগুলোও চোখের আড়ালে চালান করলাম। তারপর ডেস্কের দিকে তাকিয়ে খুশি হয়ে ভাবলাম, নাঃ, এতদিনে হয়েছে ডেস্কখানা মিনিম্যালিস্টের মতো মিনিমালিস্ট।

পরদিন সকালে অফিসে গিয়ে দেখি ডেস্কের ওপর একখান প্রিন্টার গ্যাঁট হয়ে বসে আছে এবং আমার ডেস্কখানা আর মিনিম্যালিস্ট নেই। 

মিনিম্যালিজমের সংজ্ঞা নিয়ে একজনের সঙ্গে একবার আলোচনা হচ্ছিল। সে জানতে চাইছিল মিনিম্যালিজম বলতে আমি কী বুঝি। বললাম, যতটুকু লাগে ততটুকু নিয়ে জীবন কাটানোই মিনিম্যালিজম। সে বলল, তা হলে পৃথিবীর সব লোকই নিজেকে মিনিম্যালিস্ট বলে দাবি করতে পারে। আমি বললাম, কী রকম? সে বলল, যদি ধর মুকেশ আম্বানি দাবি করে যে অ্যান্টিলার সাতাশ তলার প্রতিটি তলাই ওর বসবাসের জন্য লাগে আর ওই ছশো পরিচারকের একজনকে ছাড়াও ওর চলবে না, তোমার যুক্তি মেনে তা হলে কি মুকেশ আম্বানিও মিনিম্যালিস্ট হলেন না? বলে, ‘কেমন দিলুম?’ ভুরু নাচাল। আমি হাঁ বন্ধ করে, তাই তো, ঠিক তো, বলে প্রাণ বাঁচালাম।

প্রিন্টার জরুরি জিনিস। সকলেরই কাজে লাগে। কারও বেশি লাগে কারও কম। আমার বেশিরভাগ সহকর্মীদের তুলনায় আমার কম কাজে লাগে হয়তো, কিন্তু লাগে। কাজেই প্রয়োজনের যুক্তিতে প্রিন্টারওয়ালা ডেস্কের মিনিম্যালিস্ট হতে বাধা নেই। 

কিন্তু আমি যুক্তিবাদী নই। অদরকারি পাঁচটা গাছ ভিড় করে থাকলেও ডেস্ককে মিনিম্যালিস্ট শিরোপা দিতে আমার বাধবে না, কিন্তু মাত্র একখানা প্রিন্টার আমার মিনিমালিজমের সাধনা মাটি করতে যথেষ্ট।

নিজের গালে ঠাস ঠাস চড়াতে ইচ্ছে করছিল। কারণ দোষটা আমারই। ফ্লোরের বাকি সবাই তাদের ম্যাক্সিমালিস্ট সংসার পেতে রেখেছে টেবিল জুড়ে এদিকে আমার টেবিলে খাঁ খাঁ। প্রিন্টার বসিয়ে যাওয়ার জন্য একরকম নেমন্তন্নই করে রেখেছি আমি। 

পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ কল্পনা করে মাথা ঘুরতে লাগল। আমি বলব, ডেস্ক থেকে প্রিন্টার সরান। যাকে বলব সে বলবে, কিন্তু কোথাও তো একটা রাখতে হবে। আমি বলব, সেটা আমার টেবিল নয়। অন্য যার খুশি টেবিলে রাখুন গে। সেই লোকটা বলবে, আচ্ছা স্বার্থপর তো আপনি, চক্ষুলজ্জা বলে কোনও বস্তু নেই? আমি বলব, আমার চক্ষুলজ্জা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না, যা বলছি তাই করুন। লোকটা বলবে, না করলে কী করবেন? আমি বলব, তবে রে? এই দেখ তাহলে…

সকাল সকাল একটা ঘোরতর স্ট্রাগলের মধ্যে পড়তে হবে।

ব্র্যান্ড নিউ ব্র্যান্ডেড এসির হাওয়াতেও ঘাম ছুটল। যদিও রবীন্দ্রনাথ আর বুদ্ধিজীবীর পর বাঙালির তৃতীয় প্রিয়তম শব্দ স্ট্রাগল আর যদিও আমি একশো এক শতাংশ বাঙালি, আমি স্ট্রাগল ঘৃণা করি। আমি স্ট্রাগলের ঘোর বিরোধী। আমি মনে করি না স্ট্রাগল করলে চরিত্রগঠন হয়। আর যদি বা হয়েও থাকে অমন চরিত্রবান হতে আমি চাই না। আমি চাই না পৃথিবীর কেউ স্ট্রাগল করুক। কেউ যদি স্ট্রাগল করে জীবনে উন্নতি করতেও চায় আমাকে যেন করতে না হয়। আমি চাই আমার জীবন কেকওয়াক হোক। কত ধানে কত চাল টের না পেয়েই যেন আমি সারাজীবন কাটাতে পারি।

ফোন করলাম। যাকে করলে সমাধান হবে তাকে না। ওই ক্রুশিয়াল ফোনটা মাথাগরম অবস্থায় করা যাবে না। এমন কাউকে করা দরকার যে সারাজীবন আমার মাথা ঠাণ্ডা রাখার মুচলেকা নিয়েছে।

সে বলল, ওরে বাবা কুন্তলা, এটা এমন কিছু সমস্যা নয়। ফোন করে বল যে প্রিন্টার সরিয়ে দিন। গাঁইগুঁই করলে প্রস্তাব দিয়ো নিজেই অন্য ডেস্কে সরে যাওয়ার। 

তেতে উঠে বললাম, ঠিক বলেছ, ডেস্কে হয় প্রিন্টার থাকবে নয় আমি থাকব।

অত গরম হয়ে বোলো না আবার। মিষ্টি করে বোলো।

হ্যাঁ রে বাবা হ্যাঁ। গলবস্ত্র হয়েই বলব, মনের রিয়েল ভাবটা তোমার কাছে প্রকাশ করলাম।

গুড। আর যদি নতুন টেবিলে যাও, দয়া করে মিনিম্যালিজম প্র্যাকটিস কোরো না। যা সম্পত্তি আছে সব ছত্রাকার করে টেবিলের ওপর ছড়িয়ে রাখবে। না হলে যখন আবার ফ্যাক্স মেশিন বসিয়ে যাবে তখন বুঝবে মজা।

বলে ফোন কেটে দিল।

এবার ক্রুশিয়াল ফোনটা করলাম। বললাম, দয়া করে যদি আমার টেবিল থেকে প্রিন্টারটা সরিয়ে...নিতান্ত অসুবিধে হলে আমিই না হয়…

তিনি বললেন, পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করুন। বলে তিন মিনিটের মধ্যে এসে আমার টেবিল থেকে প্রিন্টার তুলে সহকর্মীর টেবিলে বসিয়ে দিলেন।

তেতাল্লিশ মিনিট বাদে সহকর্মী অফিসে এল। এসেই বলল, ওহ! 

আমি ভয়ানক মন দিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইলাম।

সহকর্মী আমার টেবিলে এসে বলল, প্রিন্টার বসিয়ে গেছে দেখেছ?

আর থাকতে না পেরে গলা ঝেড়ে ইয়ে বলে শুরু করতে যাব সহকর্মী বলল, অবশেষে একটা কাজের কাজ হয়েছে। এখন প্রিন্ট নিতে আকাশপাতাল এক করতে হবে না, সিটে বসে বসেই হয়ে যাবে। কম্যান্ড দাও, কালেক্ট কর।

সহকর্মীর মুখের দিকে তাকালাম। কোঁচকানো ভুরু দেখব ভেবেছিলাম, চোখে পড়ল ঠোঁটে হাসি। তিতিবিরক্তিতে টইটম্বুর গলা শুনব আশা করেছিলাম, খুশিমিশ্রিত উত্তেজিত কণ্ঠ কানে এল। আমার-সঙ্গেই-কেন-এমন-হয়-ঠাকুর বডি ল্যাংগোয়েজের সামনে পড়ার অপেক্ষায় ছিলাম, সহকর্মীর সারা অস্তিত্ব থেকে প্রিন্টারের মালিকানার গর্বের ছটা ঠিকরে এসে লাগল । 

বললাম, যা বলেছ।

সে গলা ঝেড়ে বলল, ইয়ে শোনো না, আমার টেবিলেই রেখেছে বলে বিন্দুমাত্র সংকোচ কোরো না কিন্তু, দরকার হলেই প্রিন্ট দিয়ো, যখন তখন, যত খুশি। ফিল ফ্রি। 

বললাম, থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ। 

*****

অবাঞ্ছিত প্রিন্টার, না পরা জামা, আধপড়া বই, ফুরিয়ে যাওয়া প্রেম - যা যা আপনার জীবনের অকারণ জায়গা দখল করে আছে, বিনা অপরাধবোধে বিদায় করুন। অন্য কেউ তাদের যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়ার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে আছে।


Comments

  1. আমার ডেস্কে গত দেড়বছর ধরে একখানি প্রিন্টার রাখা ছিল| আমার অনুপস্থিতিতেই একদা সেটি স্থান পেয়েছিল| নিজের মাসে দু তিনটের বেশি প্রিন্ট দিতে লাগে না, কিন্তু সহকর্মীদের জন্য অনেক সময় অফিস ছুটির পরেও কম্পিউটার চালিয়ে রাখতে হত| এমনকি যেদিন অফিস আসতাম না সেদিনও সারাদিন কম্পিউটার কেউ না কেউ চালাতো এবং সারাদিন চালানো থাকত| সম্প্রতি সেটি দেহ রেখেছেন আর আমার ডেস্ক থেকে বিদায় নিয়েছেন| আপাতত চার পা হেঁটে অন্য একজনের মেশিন সংলগ্ন প্রিন্টার থেকে প্রিন্ট নিতে হচ্ছে কিন্তু আমার ডেস্কের শান্তি ফিরে এসেছে| আর শেষ প্যারাটার জন্য বিশাল বড় করে হাই ফাইভ|

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, হাই ফাইভ। অন্যের ডেস্কের প্রিন্টার নিজের ডেস্কের প্রিন্টারের থেকে বেশি ভালো এ বিষয়ে আমিও একমত, সৌগত।

      Delete
  2. বৈজয়ন্তীJune 26, 2019 at 3:42 PM

    কাল রাতে এই পোস্টটা পড়েই কমেন্ট করবো ভাবলাম। তারপর ঘুম পেয়েছে, কি লিখতে কি লিখব, ভেবে কাটিয়ে দিলাম।
    কাল রাতে গোগ্রাসে পড়ে, সকালে সময় নিয়ে পড়ে, বেলার দিকে অফিসের কাজ(আজ ডেডলাইন) বাদ দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে পড়েও ভালোলাগা উপচে যাচ্ছিল।
    বন্ধুদের লিংক শেয়ার করলাম, তারাও ভালো ভালো ইমোটিকন পাঠালো।
    পুরোটা তো বটেই, বিশেষ করে শেষ প্যারাটা যে কি ভালো হয়েছে, কি বলবো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে থ্যাংক ইউ, বৈজয়ন্তী। মন ভালো হয়ে গেল। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  3. Sokal bela office e pouchhe ei lekhata porlam, mon ta ekdom furfure hoye gyalo. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনার মন্তব্য পড়ে আমারও হয়ে গেল মন, ফুরফুরে।

      Delete
  4. শেষ মোচড়টা যাচ্ছেতাই রকমের ভাল!‌ :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ, শীর্ষ।

      Delete
  5. >>>>আমি মনে করি না স্ট্রাগল করলে চরিত্রগঠন হয়। আর যদি বা হয়েও থাকে অমন চরিত্রবান হতে আমি চাই না।

    high five K...highest five :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, হায়েস্ট ফাইভ, শম্পা।

      Delete
  6. sokal bela office e ese ei lekha ta pore mejaj ki bhalo hoye gelo.. khub khub bhalo likhechen.. aar last para ta too too good..

    khub khub bhalo thakben..

    Indrani

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে থ্যাংক ইউ, ইন্দ্রাণী।

      Delete
  7. "ওরে বাবা কুন্তলা" কি উনি সবসময় বলে থাকেন ? ;)

    "অবাঞ্ছিত প্রিন্টার, না পরা জামা, আধপড়া বই, ফুরিয়ে যাওয়া প্রেম - যা যা আপনার জীবনের অকারণ জায়গা দখল করে আছে, বিনা অপরাধবোধে বিদায় করুন। অন্য কেউ তাদের যথাযোগ্য মর্যাদা দেওয়ার জন্য হাপিত্যেশ করে বসে আছে।" <3

    ReplyDelete
    Replies
    1. সবসময় না বললেও, এতবারই বলে যে বাকি সময়েও বলছে ধরে নিলে কেউ দোষ দিতে পারবে না, অন্বেষা।

      Delete
  8. হাহা, টি এফ টি ডি গুগল করে দেখে নিলাম। একটা নতুন জিনিস জানা হল। থ্যাংক ইউ, অনিন্দ্য।

    ReplyDelete
  9. ফুরিয়ে যাওয়া প্রেম এমনিই বিদায় নেবে, কিন্তু আধপড়া ব‌ই ফেলতে গেলেই অপরাধ বোধ চলে আসে আর ফেলা হয় না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. বইয়ের ব্যাপারে একমত, নালক, কিন্তু আমি কিছু ফুরিয়ে যাওয়া প্রেমকে সারাজীবন টানিত হতে দেখেছি।

      Delete
  10. OLX er "bech dal" ad ta mone pore gelo keno jani

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, ফেলে দেওয়ার কথা হচ্ছে বলে বোধহয়, চুপকথা।

      Delete
  11. শেষ প্যারাটা লা জবাব ।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, প্রদীপ্ত।

      Delete
  12. ভেরি ইন্টারেস্টিং :-) আচ্ছা তোমার 'ওরে বাবা কুন্তলা' প্রেম'টা কি ২০১২ তে শুরু?

    ReplyDelete
    Replies
    1. না তো, দু'হাজার নয়ে।

      Delete
    2. যাঃ ডেটা ফেল করল। ২০১২-১৩ সালে তুমি প্রচুর পোস্ট করতে তাই দেখে ভাবলাম।

      Delete
  13. sei .... kintu .... ise .... iye.....

    ReplyDelete
    Replies
    1. chandrabindoo mone pore galo.... "jodi bolo ari, tomakeo chhere dite pari"

      Delete
    2. এই গানটা মারাত্মক প্রিয় ছিল আমার।

      Delete

Post a Comment