স্বপ্নের গুঁতো




স্বপ্নের কার্যকারণ হয় বলে আপনি বিশ্বাস করেন? আমি কিছু কিছু ক্ষেত্রে করি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে স্বপ্নের কার্যকারণ নিয়ে সন্দেহ করা বোকামি। যে শুক্রবার আমি দু’প্লেট ফুচকা (এক্সট্রা কাঁচালংকা দেওয়া) আর একপ্লেট আলুকাবলি (এক্সট্রা কাঁচালংকা দেওয়া) দিয়ে ডিনার সারি সে শুক্রবার সারারাত স্বপ্নে পাগলা হাতির তাড়া খেয়ে সি আর পার্কের অলিতে গলিতে দৌড়ে মরলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। অ্যাপ্রাইজালের আগের রাতে ভূগোল পরীক্ষার দিন ইতিহাস পড়ে চলে যাওয়ার স্বপ্নেও না। তবে সব স্বপ্নের কার্যকারণে আমি অত্যধিক জোরও দিতে চাই না। অনেক বছর আগে এক রাতে এক দূরসম্পর্কের (কিন্তু কাছের) দিদার স্বপ্ন দেখে উঠেই মাকে ফোন করে জেনেছিলাম দিদা গত রাতে মারা গেছেন। বেশি ভাবিনি ব্যাপারটা নিয়ে। ভাবলে ভয়ে পরের রাতগুলোর ঘুম মাটি হত। আর দিদা যদি সত্যি আমাকে ভালোবেসে থাকেন (যেটা সন্দেহ করার কোনও কারণ নেই), আমাকে ইনসমনিয়ায় ভোগাতে চাইবেন না। কাজেই ঘটনাটা কাকতালীয় ধরে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছি। তাছাড়া সবকিছুর পেছনে গভীর অন্তর্নিহিত ইউনিভার্সের সিগন্যাল খুঁজতে যাওয়া আমার নাপসন্দ। আজীবন দেখে আসছি আমি ডাউনে ট্রেনের অপেক্ষায় থাকলে যত ট্রেন আপ দিয়ে যায়। আবার আমি আপে দাঁড়িয়ে থাকলে ঠিক উল্টো। এ নিয়ে ভাবতে বসলে নিজেকে জন্মহতভাগ্য মনে হবে আর কোনওদিন কোনও কমপিটিটিভ পরীক্ষায় বসা যাবে না।কাজেই ন'মাসে ছ'মাসে স্বপ্ন বাস্তবের সমাপতনে আমি উত্তেজিত হই না। 

কাল স্বপ্ন দেখলাম আমার বাড়ির গাছগুলো মারাত্মক চোট পেয়েছে। গাছগুলো রাখা একটা ছোট ঘরের ভেতর, যে রকম ঘরে আমি কোনওদিন থাকিনি বা দেখিওনি। ওভারঅল দুর্দশার ফিলিংটা জোরদার করার জন্য ওইরকম একটা ঘরের আমদানি হয়েছে মনে হয়। জন্ডিস রং দেওয়াল সিলিং, উঁচুতে একটা খুপরি জানালা, আলোবাতাস সব যা আসার সব ওই দিয়েই। যাই হোক, সেই জানালা দিয়ে কড়া রোদ এসে পড়ে যে গাছগুলোর নতুন পাতা বেরিয়েছিল, সম্পূর্ণ জ্বালিয়ে দিয়েছে। আবার কিছু গাছ, ব্রাইট, ইনডিরেক্ট লাইট যাদের বেঁচে থাকার জন্য অপরিহার্য তারা কিছুই পায়নি এবং আধমরা হয়েছে। 

ঘরের মেঝে জলে কাদায় মাখামাখি। কে বা কারা এসে বালতি বালতি জল ঢেলেছে আমার গাছেদের গায়ে। নার্সারির ভাইসাব একটা বাত ইয়াদ রাখতে বলেছিলেন, কম জলে গাছ মরে না, বেশি জলে মরে। এই ব্যাপারে মানুষের সঙ্গে গাছেদের মিল আছে। বেশিরভাগেরই, যাদের নিয়মিত খাবারদাবারের জোগান আছে, তাদের বেশি খাওয়াটাই সমস্যা, কম খাওয়া নয়। টবের অর্ধেক মাটি জলে গুলে উপচে বাইরে চলে এসেছে, ভারি হয়ে পাতারা মাথা তুলতে পারছে না। 

ঘরটা বেসিক্যালি আমার সাধের গাছেদের কবরখানা।

কেঁদে ফেলার জোগাড় হল। নতুন শখ বলেই হয়তো গাছ নিয়ে অবসেশনটা এখনও চলছে। প্রতিদিন সকালে উঠে দেখতে যাই নতুন পাতা বেরোলো কি না। পারলে ফিতে দিয়ে মিলিমিটার বৃদ্ধি মাপি। একদিন পর্দা না সরিয়ে অফিস চলে গিয়েছিলাম, বাড়ি এসে যখন আবিষ্কার করলাম গাছগুলো সারাদিন ব্রাইট ইনডিরেক্ট সানলাইট থেকে বঞ্চিত হয়েছে, গালে ঠাস ঠাস চড়াতে ইচ্ছে করছিল। দিব্যি ছিল নার্সারিতে পেশাদার মালির যত্নআত্তিতে, তাদের যেচে বাড়িতে এনে খুন করার কোনও মানে হয়? একে তো গাছগুলো পুঁচকে টবের বদ্ধ মাটিতে বন্দী। দোষটা পুরোটা আমারও নয়। বারান্দায় আউটডোর গাছ লাগানোর মতো রোদ আসে না, কিন্তু যেটুকু আসে সেটুকু ইনডোর সুখী গাছেদের ঝলসে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। একমাত্র সমাধান হচ্ছে ঘরের ভেতর ইনডোর গাছ রাখা, যারা মাঝারি এবং কম আলোতে বাঁচতে পারে। আর ঘরে রাখতে হয় বলেই খুব বড় টবে রাখা যায় না। গাছগুলো অত বড়ও হয়নি যে ওদের বড় টবে স্থানান্তরিত করা যাবে। কাজেই আপাতত ছোটো টবের কম মাটিতেই চলছে। এর ওপর যদি দরকারমতো জল আলো দেওয়াতেও গাফিলতি করি তাহলে আর ক্ষমা করার থাকে না। 

কাজেই স্বপ্নটাকে স্বপ্ন না বলে দুঃস্বপ্ন বলাই উচিত।

দুঃস্বপ্নটা কীসে ভাঙল? যখন আমি প্রাণপণে টবগুলো টানাটানি করতে লাগলাম। পুঁচকে টবগুলো স্বপ্নে কী করে যেন বিরাট বিরাট কংক্রিটের টবে পরিণত হয়ে গেছে, অফিসে যেমন থাকে। আমি সেই বিরাট বিরাট টবগুলো টেনে টেনে, জল কাদা মৃত পাতাময় মেঝেতে ঘষটে ঘষটে একটা ছোট চৌকোটার মধ্যে আঁটানোর চেষ্টা করছি যেখানে উঁচু খুপরি জানালাটা দিয়ে ব্রাইট ইনডিরেক্ট সানলাইট এসে পড়েছে…

অত পরিশ্রম করতে গিয়েই ঘুম ভেঙে গেল। ভেঙেই দেজা ভ্যু। আজ, কয়েকঘণ্টা আগেই আরেকবার ঘুম ভেঙেছিল না?  দাঁত মেজেছি, লোকজনের সঙ্গে বসে চা খেয়েছি, নেটে কুতুবমিনারের টাইমিং এন্ট্রি ফি জেনে সে তথ্য সরবরাহ করেছি। তারা যাওয়ার পর দরজাও বন্ধ করেছি। করে আবার ঘুমিয়ে পড়েছি। এখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। বাইরে ঝকঝকে রোদের আভাস। কিন্তু সে রোদের একটুও আমার ঘরে এসে পৌঁছচ্ছে না কারণ পর্দা সরানো হয়নি। 

দৌড়ে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দিলাম। গাছগুলো ব্রাইট ইনডিরেক্ট সানলাইটে ভেসে গেল।

বাথরুমে ঢুকতে ঢুকতে শুনলাম গাছগুলো বলছে, দেখেছিস, আমরা সবাই মিলে ভয়ের স্বপ্ন দেখালাম বলেই তাড়াতাড়ি উঠে পর্দা সরাল তো? না হলে কে জানে আরও কতক্ষণ ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোত আর আমাদের পড়ে থাকতে হত এই অন্ধকূপে।

এবার থেকে স্বপ্নের কার্যকারণে বিশ্বাস করব ঠিক করেছি।



Comments

  1. Replies
    1. ধন্যবাদ, সায়ন। আপনার ভালো লেগেছে জেনে আমারও ভালো লাগল।

      Delete
  2. আমি কয়েকদিন পর পর ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম চটকে সারাদিন ঢুলে, স্বপ্নের কর্ম্ফল নিয়ে মোটেও সন্দিহান না।
    লেখাটা চমৎকার হয়েছে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, প্রদীপ্ত। আমার তো অফিসে ঢুকলেই ঘুম পায়, স্বপ্ন দুঃস্বপ্ন দেখি আর না দেখি।

      Delete
  3. Ami porikkhar 7 din age swapno dekhtam kal porikkha ar Amar kichui pora hoyni.. ghum bhenge Ekta fast track routine kortam.. ei particular
    swapner karjokaron porishkar bujhe jetam.. :)

    ReplyDelete
    Replies
    1. বাহ তোর স্বপ্নের টাইমিং তো চমৎকার, ঊর্মি।

      Delete
  4. আমি সাধারণত রেজাল্ট বেরোনোর আগের দিন হারমিওনির বোগার্টের মতন একটা দুঃস্বপ্ন দেখতাম। আপনার গাছেদের সঙ্গে যে আপনার একটা টেলিপ্যাথির যোগাযোগ আছে সেইটা বেশ ভাল কথা। এরপর হয়তো দেখবেন (না দেখাই ভাল) বাড়িতে চোর ঢুকলেও আপনাকে স্বপ্নে খবর পাঠাচ্ছে গাছেরা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, এটা হলে তো ভালোই হবে, সুগত।

      Delete

Post a Comment