ওয়ার্কিং ফ্রম হোম



অফিসের ঝামেলা সামলাতে নাজেহাল হয়ে মায়ের সহকর্মী ইন্দ্রাণীমাসি বলেছিলেন, "আর কী, বসতে একটা চেয়ার দিয়েছে।"

মাসে মাসে মাইনে দিচ্ছে বলে নয়, নামের পেছনে পদাধিকার জুড়েছে বলে নয়, যুগযুগান্তের শেকল ভেঙে নারীস্বাধীনতার ঝাণ্ডা ওড়ানোর সুযোগ দিয়েছে বলে নয়। দিনের মধ্যে আট ঘণ্টার জন্য বসার একটা কেঠো চেয়ার দিয়েছে বলে, ইন্দ্রাণীমাসি অফিসের যত লাথিঝাঁটা সহ্য করতেন।

যে চেয়ারটা আমার তলা থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে গত বুধবার। বলা হয়েছে নিজের এবং বাকি সবার মুখ চেয়ে, দয়া কর, মাথা খাও, যেটুকু যা কাজের ভড়ং করার নিজের ঘরের খাটে বসে কর গে।

সেটা করতে গিয়েই বুঝলাম, বাড়ি বসে কাজ করা - "থালা বাজিয়েছি বটে কিন্তু আমি বিজেপি নই" - প্রমাণ করার থেকেও শক্ত। যে কাজটা আধঘণ্টায় হওয়ার কথা সেটা আড়াইঘণ্টা লাগছে। যেটা আড়াইঘণ্টার কাজ এ সপ্তাহে তার ডেডলাইন থাকলে? ওয়েল…

অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে ভেবেছিলাম একবার এমনি অটো চেপে অফিসের চেয়ারটা ছুঁয়ে আসি। টেলিপ্যাথির চোদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে উবার থেকে মেসেজ এল। বাইকশেয়ার থেকে প্রিমিয়াম, আমরা সব সার্ভিস বন্ধ করছি। স্টে সেফ।

মা বাবা কাকা মামা, জল দেওয়ার দাদা, সৌরভ স্টোরসের ননী সাবধান করলে একরকম। পুঁজিবাদের দালালগুলোর ব্যবসা বাড়ানোর জন্য ইনবক্সে জ্ঞানের বন্যা বওয়ানো দেখে পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। শাদি ডট কম থেকে পর্যন্ত মেল পাঠিয়েছে, ফর সেফটি, স্টে অ্যাট হোম। ফর সিকিউরিটি, ব্রাউজ আওয়ার কালেকশন। জোম্যাটো আর সুইগির মেলগুলো বিশেষ করে বিছুটি-লাগানো। কন্ট্যাক্টলেস ডেলিভারি থেকে শুরু করে আমাদের সেফটির জন্য ওঁদের নেওয়া ব্যবস্থার বিবরণ দেওয়া মাইলখানেকের ইমেল। পুরোটা স্ক্রোল করে করে নামলাম মধুরেণ সমাপয়েৎ-এর আশায়। ও হরি, কোথায় কী, নো ডিসকাউন্ট কোড, নো অ্যাট্রাক্টিভ অফার। করোনার বাজারে কপালে স্রেফ শুকনো শুভেচ্ছা।

বাড়িতে বসে কাজ করার অজস্র টিপস। বাউন্ডারি সেট করুন। আশেপাশের লোককে বুঝিয়ে দিন যে আপনি বিরক্ত হওয়ার জন্য অ্যাভেলেবল নন। আমার সে ঝামেলা নেই। লোকই নেই। বি আ মর্নিং পার্সন। এ বিষয়েও কাজ আগে থেকেই সেরে রাখা আছে। সকালে উঠে নিজের মনকে চোখ ঠারান, যেন আপনি অফিস যাচ্ছেন। অ্যাপ্লাই মেক আপ অ্যান্ড ডু ইয়োর হেয়ার।

ইয়াহ্‌, রাইট।

মেন্টেন আ ডেডিকেটেড ওয়ার্ক স্পেস।

এতক্ষণে একটা উপদেশের মতো উপদেশ। ডেডিকেটেড ওয়ার্ক স্পেস সত্যি কাজের জিনিস। আমার অফিসের চেয়ারটার কথাই ধরুন। ব্যাটার ভেতর কিছু একটা আছে, অঙ্গ ঠেকানো মাত্র ডেডিকেশনের বান ডাকে। সাহিত্যচর্চায় জীবন উৎসর্গ করার, ক্যান্ডি ক্রাশ খেলার, আধপড়া গল্পের বই শেষ করার। মোদ্দা কথা অফিসের কাজ ছাড়া আর সমস্ত কাজের মোটিভেশন, চেয়ারটা আমাকে সারাদিন ধরে জুগিয়ে যায়। এই যে অবান্তরের দীর্ঘজীবন, কার কৃতিত্ব? ভাবছেন আমার? সব ওই অফিসের চেয়ারটার। চেয়ারটা না থাকলে আমার অবান্তরের ঝাঁপ অনেক আগেই বন্ধ হত। ভাবানুবাদ? তাহলেই হয়েছে। স্বরচিত গল্প? লিখব কখন? কেনই বা লিখব? সুখে থাকতে ভূতের কিল খাব কেন?

স্রেফ ওই চেয়ারটায় বছরের পর বছর, মাসের পর মাস, দিনের পর দিন গিয়ে তশরিফ রাখতে বাধ্য হয়েছি বলে আমি এই সব আবোলতাবোল অকাজ চালিয়ে গেছি।

ওয়ার্কস্পেসের সন্ধানে বেরোলাম। বিকল্প বেশি নেই। এ ঘরের খাটের বদলে ও ঘরের খাট।

এঘর ওঘর নির্বিশেষে খাটের গঠনতন্ত্রে একটা গোলমাল আছে, যা দীর্ঘসময় ধরে (আমার ক্ষেত্রে দশ মিনিট) মাধ্যাকর্ষণের সঙ্গে যুদ্ধ করার পরিপন্থী। কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রত করার ভঙ্গিতে বসি, তারপর ক্রমে নরম হয়ে আসা শিরদাঁড়ায় একটা বালিশ গুঁজতে হয়। তারপর সে বালিশও কখন যেন নেতিয়ে পড়ে। আধঘণ্টা বাদে চটকা ভেঙে দেখি ইনবক্সে আর্জেন্ট লেখা মেল অপেক্ষা করে আছে।

অফিসের কাজ তো ছেড়েই দিলাম, আমাকে দিয়ে অফিসের কাজে ফাঁকি মারানোর যোগ্যতাও অপোগণ্ড খাটের নেই। অবান্তর লেখার কথা মনে উঠলে ক্লান্ত লাগে, গল্পের বইগুলো বোরিং ঠেকে যে ছাদের সমান হাই ওঠে, ক্যান্ডি ক্রাশ দু’দান খেলতে চোখ মুদে আসে।

খাট আমাকে খালি একটি বিষয়েই উদ্দীপ্ত করতে পারে। ঘুমোতে।

করোনা, জীবনে একখানা যতি টেনে দিয়েছে। গোড়াতে ভেবেছিলাম কমা, এখন দেখছি সেমিকোলন। কত প্ল্যান এঁটেছিলাম এই সময়গুলোর জন্য। এখনও, খাটে শুয়ে শুয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে এখনও প্ল্যানিং চলছে। এ বন্দীদশা ফুরোলে যত জমা কাজ সেরে ফেলার। প্ল্যানিং-এর সঙ্গে সঙ্গে বুকের মধ্যে একটা কাঁপুনিও চলছে। যদি ওপার বলে কিছু না থাকে। সেমিকোলনের ঢাকনা খুলে যদি ডবল দাঁড়ি আত্মপ্রকাশ করে?

পাশের বাড়ির অনি নামের বেড়ালটা (অনেকদিন ধরে সাহস সঞ্চয় করছি জিজ্ঞাসা করব, অনিটা অনির্বাণ না অনিরুদ্ধ, কোনটার শর্ট ফর্ম?) ম্যাও করল। একটা কুকুর ঘেউ করল। দূর থেকে একটা গরুর হাম্বাআআআ ভেসে এল। সজনে ডাঁটার পাতা সরসরিয়ে সাড়া দিল।

নাঃ। কুকুর বেড়াল গরুঘোড়া গাছপালা চড়াই শালিখ বেঁচেবর্তে আছে যখন, আমরাও থাকব। সবাইকে না মেরে আমরা মরব না। মরতে পারি না। আমাদের নিয়তিতে বিধাতাপুরুষ সে মরণ লিখে যাননি।

কাজেই করোনার যন্ত্রণা কাটবে। ওপারের জীবন আসবে। হয়তো স্বপ্ন পূর্ণ হবে, নয়তো মুখ থুবড়ে পড়বে। তবে স্বপ্নটপ্ন নিয়ে আমি এই মুহূর্তে লিস্ট বদারড।

আমার অফিসের চেয়ারখানা শুধু আমাকে অক্ষত ফেরত দিয়ো ঠাকুর, আর কিছু চাইব না কোনওদিন।



Comments

  1. কাজের বহর দেখবে? 5.30 এ ডেডলাইন, আমি নিশ্চিন্তে শুয়ে ফোন ঘাঁটছি, অবান্তর পড়ছি, এ জীবনে আর কিছু হলো না। যাই হোক, সুস্থ থেকো, সাবধানে থেকো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেম টু ইউ, শাল্মলী।

      Delete
  2. khub e somosyar modhye achi didi.. work from home taake lokjon work 24*5 baniye niyeche.indian colleague ra boss ke toilomordon korbe bole sokal 8ta theke raat 10ta obdhi online hoye bose thaake. jebon ekebare murchitiya ..ei shobdo ta tamil, mane holo 'shyash'

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, একটা ভালো শব্দ শেখা হল, ঋতম। এই কারণে আমি দামি চাকরিতে যাইনি। আমার আবার স্পেশালাইজেশন হচ্ছে এত কম কাজ যে করা যায় তা প্রমাণ করে বসদের ইমপ্রেস করা। দাঁত মুখ চেপে সহ্য কর, একদিন করোনা কেটে নতুন সূর্য উঠবে নির্ঘাত।

      Delete
    2. amar o ek e dosha. Tobe onyo karon. client pharmaceutical company gulo lab e jete parchhey na. ei sujoge tader mathay bose bose novel idea khelchhey ar amader IP team er matha khachhey hoy patent korte noy search kore dekhte se idea ta agei keu patent kore rekhechhey kina. Lockdown e kaj bere gechhey choturgun.

      Delete
  3. Ekta shomoy work from home ke besh ekta darun jinish money hoto...
    Tarpor last 3 bochhorer modhye adhai bochor oi korar por aar shokh kore ota korte ichhe korey na...tobe ekhon goti nei..

    ReplyDelete
    Replies
    1. কোনও কোনও দিন অফিসের লোকজন চেঁচামেচি করে গল্প করলে, মিথ্যে বলব না, ভেবেছিলাম এর থেকে ওয়ার্ক ফ্রম হোম ঢের ভালো। এখন মনে হচ্ছে ওদের নেমন্তন্ন করে এনে বলি চেঁচা মা, যত খুশি চেঁচিয়ে গল্প কর। ফাঁকা ঘরের নরকযন্ত্রণার থেকে অনেক ভালো।

      Delete
  4. করোনাতঙ্কের দারুণ আর অত্যন্ত সুখসেব্য ওষুধ। জিও কুন্তলা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, মালবিকা।

      Delete
  5. আমার তো ওয়ার্ক ফ্রম হোম দারুণ লাগে। নীচে কিছু কারণ দিলাম-

    ১। বেশ শুয়ে-বসে-দাঁড়িয়ে যেমন খুশী কাজ করা যায়।
    ২। অপছন্দের সহকর্মীদের মুখ দেখতে হয়না,গলা শুনলেই হয়ে যায়।
    ৩। টেবিলে-টেবিলে খেজুরে আলাপের সময়টুকু গল্পের বই বা সিনেমা দেখে কাটানো যায়।
    ৪। "কি খাচ্ছ", "কে বানালো" এইসব গায়ে-জ্বালা-ধরানো প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়না, ল্যাপটপের পাশে চানাচুরের বাটি নিয়ে বসে দিব্যি মুখ চালানো চলে।
    ৫। কাজ নেই, তাও সিটে ব্যাজার মুখে বসে থাকতে হয়না। সেই সময়টা দিব্যি চায়ের কাপ হাতে বিছানায় লম্বা হয়ে সিনেমা দেখা চলে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. প্রত্যেকটাই এক্সেলেন্ট পয়েন্ট, অরিজিত। কিন্তু ওই আরকি, বাধ্য হয়ে ফুচকা খেতেও ভালো লাগে না। এগুলোই যদি স্বেচ্ছায় করার অপশন থাকত, লাফিয়ে করতাম।

      Delete

Post a Comment