গেছে যে দিন



টুইটারে একজন ছবি তুলেছেন, দিল্লির সব আইকনিক জায়গার ছবি। পার্ক, অফিস, মাঠ, রেস্টোর‍্যান্ট, সিনেমা হল, মাঠ, মসজিদের সিঁড়ি, মন্দিরের চুড়ো, চায়ের ঝুপড়ি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছোলে ভাটুরে খাওয়ার উঁচু টেবিল।

সবাই ভাবে, অন্ততঃ একসময় ভাবত, আমরা হচ্ছি টো টো কোম্পানি। শুক্রবার সন্ধেয় ব্যাগ ছুঁড়ে ফেলে হাওয়াই চটি হাতে গলিয়ে সেই যে ছুট লাগাই, রবিবার রাতের আগে বাড়িমুখো হই না। নিজের এই চরিত্রবিশ্লেষণে অর্চিষ্মান মনের ভাব কী হত কে জানে, আমি নিতান্ত অপ্রসন্ন হতাম। আমার চিরদিনের শখ লোকে জানবে আমি অন্তর্মুখী টাইপস। মনুষ্যসংসর্গ এড়িয়ে চলি। অফিস থেকে ফিরে গম্ভীর মুখে যখন প্রবন্ধসংকলন খুলে বসি, আশেপাশের লোকজন ফিসফিস করে কথা বলে আর টিপটিপ পায়ে হাঁটে।

অর্চিষ্মান বলল, দেখো তো চিনতে পারো নাকি জায়গাগুলো।

আইকনিক জায়গা চেনার প্রসঙ্গ আসছে কোত্থেকে যদি জানতে চান, আসছে কারণ ছবিগুলো তোলা হয়েছে লকডাউনে। আর এটা অস্বীকার করার কোনও জায়গাই নেই যে ভারতবর্ষের যাবতীয় ভাস্কর্য, স্থাপত্য, মন্দিরমসজিদ, ভাটুরার থেকে একশো গুণ বেশি আইকনিক হচ্ছে ঠাসাঠাসি গাদাগাদি ভিড়। এ রকম আমার সঙ্গে তো হামেশা ঘটে। খাঁ খাঁ মাঠের ছবি দেখে ভাবি এটা আবার কোথায়, তারপর চোখ পড়ে মাঠের মধ্যিখানে একখানা ঢ্যাঙা স্তম্ভ, ও হরি এ যে কুতুব মিনার। কী ফাঁকা, চিনতেই পারিনি।

ভিড়হীনতার অস্বস্তিটা কাটিয়ে উঠে দেখা গেল ছবির লিস্টের নব্বই শতাংশ জায়গায় আমরা গেছি। একাধিক বার গেছি। খটখটে রোদে, ঝিমঝিমে বৃষ্টিতে, কনকনে শীতে - জায়গাগুলোতে আমাদের ছবি ফোনে আর মনে জ্বলজ্বল করছে।

রেস্টোর‍্যান্টের টেবিলগুলো পর্যন্ত চেনা গেল। জাফরি দেওয়ালঘেঁষা আমাদের ফেভারিট টেবিল না ওটা? পালং শাকের চাট, গোভিন্দ গট্টা কারি আর মসালা সোডা নিয়ে কতবার মুখোমুখি বসেছি বল তো?

যে জায়গাগুলোয় যাইনি, সেগুলোও চিনতে পারলাম। ওই বইয়ের দোকানটায় যাব যাব বলছিলাম কতবার। তুমি প্রত্যেকবার হাবিজাবি এক্সকিউজ দিয়ে ঠেকাচ্ছিলে। দেখলে তো কী হল? এখন কবে সব নিষেধ উঠবে, কবে দোকান খুলবে...

মুখ হাঁড়ি করে বসে রইলাম দুজনে। যদি দোকান না-ই খোলে আর? রোদে পুড়ে, বৃষ্টি ভিজে, প্রবন্ধপাঠ ফাঁকি দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় টো টো করা সকাল দুপুর বিকেল সন্ধেগুলো আর না আসে? বাকি জীবনটা টু বি এইচ কে-র বদ্ধ ঘরে বসে জীবন কাটানোই কপালে থাকে?

বাকি জীবনের কথা জানি না, সেদিন আমার ঘরে বসে রইলে চলত না। অর্চিষ্মান এমনিতে আমার বেরোনোতে মোটেই সঙ্গ দিতে আসে না। ওর মত হচ্ছে যদি বেরোতেই হয় একজন বেরোক, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য অ্যাট লিস্ট অন্যজন থাকবে। ঘুরেঘারে বাড়ি ফিরলে দরজা খুলে লাফ মেরে দশ হাত দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। জুতোর বাক্সের ওপর রাখা স্যানিটাইজারের বালতিপ্রমাণ শিশিটার দিকে ভুরু নাচায় আর আঙুল দিয়ে বাথরুমের দিকে দেখায়। শিগগিরি স্নান করে এসো। ভাবছি ওকে একবার জেরক্সের দোকানের ভাইসাবের কাছে পাঠাব। যিনি মাস্কটাস্কের বালাই রাখেননি আর আমার গ্লাভসের ওপর খুচরো পয়সা ঢেলে দিতে দিতে বলছিলেন, ম্যাডাম ইতনা মৎ ডরিয়ে। যিতনা ডরেঙ্গে উতনা হোনে কা চান্স বঢ়েগা।

অর্চিষ্মান বলল, বাঃ, তবে আর কী। ভাইসাবের কথা মতো চলে প্রাণটা খোয়াও।

আমাদের যৌবনের উপবনের মনকেমন ছবি দেখে ওর মগজেও রাসায়নিক ক্রিয়াবিক্রিয়া ঘটল বোধহয়, বলে উঠল, ধুউউস, চল তো তোমার কোথায় কোথায় যাওয়ার আছে আজ, আমিও যাই।

দেখবি তো দেখ, ব্যাংক আর পোস্টাপিস আর ওষুধের দোকানের বদলে আমার সেদিন যাওয়ার ছিল মার্কেটিং - এ। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত দোকানে পিড়িং পিড়িং সুরবাহারের ব্যাকগ্রাউন্ডে ঘুরে ঘুরে দুয়েকটা জরুরি পোশাকআশাক কিনব আর পছন্দ হলে গোটা দুয়েক কফি কাপ - তেমনটাই ছিল প্ল্যান। যতদূর মনে পড়ে আগের রাতে অর্চিষ্মানকে প্ল্যানের কথা বলেওছিলাম, তখন কানে ইয়ারফোন গুঁজে ল্যাপটপের দিকে হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে ছিল, সাড়াশব্দ পাইনি।

যথোপযুক্ত প্রোটেকশন দিয়ে বেরোলাম। যেই না বেরোলাম, আমাদের এতদিন পর একসঙ্গে দেখেই সম্ভবতঃ, ঠা ঠা রোদ মেঘের আড়ালে অদৃশ্য হল, মাথার চুল অল্প অল্প উড়িয়ে, সারা শরীর ঠাণ্ডা করে হাওয়া বইল। অটো চড়ে আমরা গেলাম এখান থেকে ওখান, ওখান থেকে সেখান। ভাইসাব জোরে রেডিও ছাড়লেন। অগর তুম সাথ হো, সব গম ফিসল যায়ে...

বাজার সারা হলে অর্চিষ্মান বলল, শোনো না, আমার না অনে-এ-এ-এ-কদিনের শখ ধরে ওই কায়দার মুদির, থুড়ি গ্রোসারি শপটায় যাই। যাবে? অসুবিধে হবে না তো?

চার নম্বর প্ল্যাটফর্মে গল্প জমা দেওয়ার ডেডলাইন আগের রাতেই পেরিয়েছে, এখনও কম করে পাঁচঘণ্টার কাজ বাকি।

আর যারই অসুবিধে হোক আমার হবে না গ্যারান্টি।

বন্দুক থার্মোমিটারে জ্বর মাপিয়ে শপে ঢুকলাম। যে তাকই দেখি, তাক লেগে যায়। একদম বাঁদিকে ক্লাসিক মেয়োনিজ, তার পাশেরটা গারলিক মেশানো মেয়োনিজ, তার পাশেরটা অনিয়ন মেয়ো, তার পাশেরটা অনিয়ন গারলিক, তার পাশেরটা চিলি গারলিক, তার পাশেরটা অনিয়ন চিলি - অন্ততঃ বারোখানা মেয়োনিজের শিশি পাশাপাশি রাখা। এক মহিলা এসে ছ'টা তুলে নিয়ে গেলেন। শিশির উল্টোদিকে, যেদিকটায় আমরা বেশি মনোযোগ দিচ্ছিলাম কারণ ওখানে এম আর পি লেখা থাকে, দৃকপাত করলেন না। যে কনফিডেন্সে সৌরভ স্টোরসে অর্চিষ্মান অরবিট আর টিকট্যাক আর ফটাফট তোলে, আমি ঝাল চানাচুর আর কাকাজি চিপসের ফ্যামিলি প্যাক কুড়োই, বলি, এই এগুলো এগুলো, আর হ্যাঁ, এগুলোও দিয়ে দিন না - অবিকল সেই কনফিডেন্স।

শুধু তো মেয়োনিজ নয়, হারিসা, পেরি পেরি, তাহিনি, তাজিকি আরও কতরকম। এ সব সৌরভ স্টোরসে দেখলে অবাক হতাম হয়তো, কিন্তু এখানে না দেখলেই অবাক হতে হত। থমকালাম তাকের প্রান্তে এসে, যেখানে একটা শিশির গায়ে লেখা আছে পাকা পেয়ারার পেস্ট। এটা আগেও দেখেছি। অচেনা জিনিসের থেকে চেনা জিনিসকে অচেনা অবতারে দেখলে মাথা ঘোরে বেশি। আমাদের ছোটবেলায় জনগণের গড় ওজন মিনিমাম পাঁচ কেজি কম ছিল আর টিভিতে চ্যানেলে চ্যানেলে ঘণ্টায় ঘণ্টায় রাঁধাবাড়ার অনুষ্ঠান হত না। চোদ্দপুরুষ নাম শোনেনি এমন সব উপকরণ দিয়ে, চকচকে হাতাখুন্তি নেড়ে, ঝকঝকে উনুনে, ধপধপে উর্দি পরে বাবাজেঠুর মতো দেখতে লোকজন রান্না করতেন। সে সব অনুষ্ঠানে "আংকল, লাবড়ার রেসিপি আপলোড করুন না প্লিইইজ" বলে হামলে পড়ার সাহসই পেত না পাবলিক। মনে আছে এক এপিসোডে জিগস কালরা বেগুন গোলগোল করে কেটে, দুধে ভিজিয়ে, তেলে ভেজে, দইয়ে ডুবিয়ে, মধু ছিটিয়ে পরিবেশন করেছিলেন। রুটি বেগুনভাজা খেতে খেতে দেখেছিলাম বলে সম্ভবতঃ শকটা বেশি লেগেছিল, এখনও ভুলিনি।

একেবারে খালি হাতে দোকান থেকে বেরিয়ে আসা ভালো দেখায় না, অল্প অল্প মনখারাপও হয়, তাই একটা প্লাম ওয়ালনাট আর একটা চকোলেট কেক কেনা হল। আবহাওয়া তখনও দেখার মতো মনোরম। অর্চিষ্মান বলল, চল হাঁটি। হাঁটবে?

ডেডলাইনটা মগজে একবার উঁকি দিয়ে গেল। হোয়াই নট?

ফুটপাথের রেলিং-এর ওপারে একটি বিস্তৃত বনভূমি। বৃক্ষ থেকে গুল্ম থেকে ঘাস। সবুজ জমির মধ্য দিয়ে পায়ে চলা পথ। দুএকটা কাঠের বেঞ্চি।

এই পার্কটায় আমরা কোনওদিন আসিনি, না?

আসিনি, কিন্তু সকালবিকেল দেখেছি। আকাশের মেট্রো রাজপথের দিকে আঙুল দেখলাম। অর্চিষ্মানের মুখচোখ বদলে গেল। ও-ও-ও, এটা সেই পার্কটা! মেট্রো থেকে যেটা রোজ দেখতাম?

ওই পার্কটাই বটে। তখন প্রি-ওলা/উবার জমানা। বাড়ি টু নেহরু প্লেস অটোভাড়া চল্লিশ থেকে তিরিশে নামানোর ব্যর্থ স্ট্রাগল দিয়ে দিন শুরু হত। ফেরার সময় অর্চিষ্মান রাজীব চক থেকে উঠত, আমি জহরলাল নেহরু স্টেডিয়াম থেকে। আন্দাজমতো টাইম তাক করে যে যার অফিস থেকে বেরোতাম। প্ল্যানটা হচ্ছে জে এল এন-এ ট্রেন ঢোকার সময় অর্চিষ্মান দরজার যথাসম্ভব কাছে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারবে, আমি প্ল্যাটফর্ম থেকে যতখানি পারি গলা বাড়িয়ে এদিক ওদিক দেখব। অর্চিষ্মানকে দেখতে পেলে আমি মেট্রোতে উঠব, অর্চিষ্মান আমাকে দেখতে না পেলে নেমে পড়বে।

পরিণতি, আর যাই হোক, বোরিং হত না। মেট্রো ঢুকছে, একেকটা দরজা সাঁই সাঁই করে সামনে দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে, একটা লোককে দেখলাম অনেকটা অর্চিষ্মানের মতোই দেখতে…ওই তো! ভিড়ের ওপর অর্চিষ্মানের মাথা! দরজাটা অনেক এগিয়ে গেছে, পেছন পেছন দৌড়নো সম্ভব না। আপাতত সামনের দরজাটায় উঠে পড়ব, ট্রেন বেয়ে অর্চিষ্মানের কামরায় পৌঁছনো যাবে। অর্চিষ্মান আমাকে দেখেছে কি না অবশ্য জানি না। হয়তো আমি এ দরজা দিয়ে উঠলাম, ও ওই দরজা দিয়ে নেমে পড়ল। পড়লে পড়বে, চান্স নেওয়া ছাড়া গতি নেই।

সব সময় এত রোমহর্ষক ব্যাপার হত না অবশ্য। কখনও কখনও ফাঁকা কামরায় গেটের পাশে হেলান দিয়ে দাঁড়ানো অর্চিষ্মানের চোখে চোখ পড়ে যেত। আবার এমনও হত কেউ কাউকে দেখতে পাইনি, ট্রেন থেমেছে, ভিড় পাতলা হয়েছে, দরজা বন্ধ হওয়ার টিং টিং বেজে গেছে, এমন সময়... প্ল্যাটফর্মের ওই প্রান্তে অর্চিষ্মান না? ও-ও ওই মুহূর্তে আমাকে আবিষ্কার করেছে আর আমরা উসেইন বোল্টের স্পিডে গিয়ে দুদিক থেকে ধেয়ে আসা মেট্রোর দরজা এড়িয়ে ট্রেনে উঠে পড়ছি।

এবং দুজনেই দিনগুলোর কথা সম্পূর্ণ ভুলে মেরে দিয়েছি। ভুলে মেরেছি মানে কি আর ভুলে মেরেছি? এই যে মনে পড়া মাত্র পুঙ্খানুপুঙ্খ ছবির মতো সব ঝেঁকে এল মাথার ভেতর, ভুলিনি যে তা তো বোঝাই যাচ্ছে, কিন্তু সোম-শুক্র ন'টা পাঁচটা ভাত ডালের নিচে কখন ওই দিনগুলো তলিয়ে গেছে চিরদিনের মতো, খেয়ালই করিনি।

তাই শোকপালনও করিনি।

মা ছিল, মা নেই; স্কুল লাইফ ছিল, স্কুল লাইফ নেই; মাথার চুল একসময় কালো ছিল, এখন নেই --এই সব গুরুত্বপূর্ণ থাকা না থাকার ফাঁক গলে কত দিনরাত, কত থাকা না-থাকা পালিয়ে গেছে।

চোখ তুলে তাকাইনি কারণ ওই চলে যাওয়ার শূন্যতাটা নতুন কিছু এসে ভরিয়ে দিয়েছে। মেট্রোর খেলা ফুরোতে না ফুরোতেই ওলা উবারের নতুন খেলা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রথম যেদিন মেসেজ এল "পুলিং উইথ অর্চিষ্মান", ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই অর্চিষ্মান বলে উঠল, এইই, তোমার আমার সেম পুল! আর ওর ফোনের স্ক্রিনে পষ্ট দেখলাম লেখা আছে "পুলিং উইথ কুন্তলা"। ব্যস, সেদিন থেকে আরেকটা খেলা শুরু হয়ে গেল। রান্নাঘরে টিফিনবাক্সের ঢাকনা বন্ধ করতে করতে, বারান্দায় তোয়ালে মেলতে মেলতে কো-অরডিনেশনের খেলা। সেকেন্ডের কাঁটা মিলিয়ে পুল বুক করার কো-অর্ডিনেশন, যাতে সেম পুল নিশ্চিত করা যায়। (যায় না, বলা বাহুল্য, তবু খেলতে তো বাধা নেই)। আর যদি না-ই যায় তাহলে অন্ততঃ এইটুকু নিশ্চিত করা যাক যে প্রাণ গেলেও বাড়ি থেকে বেরোনোর রেসে সেকেন্ড (ওয়েল, লাস্ট) হওয়া চলবে না। দেখ না দেখ, পেছন ফিরে টুক করে উবার বুক করে দেওয়া এবং আমারই ট্রিক আমার ওপর প্রয়োগ করে অন্য কেউ আমার আগে বুক করে ফেলছে কি না চোখে চোখে রাখা। অফিস দেরি হলেও এই সব খেলাধুলোর সময়ে টান পড়েনি কখনও।

সে খেলাও শেষ। অন্ততঃ ২০২০তে শুরু হওয়ার কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। আমার অফিসের লোকেশন বদলে গেছে, এক পুলে জায়গা পাওয়ার আর চান্সই নেই। আগে বেরোনোর কম্পিটিশনে জিততে হলে বাড়ি থেকে বেরোতে হবে তো আগে?

অর্থাৎ কি না ওই জীবনটা, ওই জীবনের যাবতীয় খেলাধুলো হারজিত সঙ্গে নিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে। হয়তো কোনও একদিন পূর্বাভাস ছাড়া লাফিয়ে পড়ে চমকে দেবে। চিনতে পারছ? নীল মাস্কের আড়ালে হাসতে হাসতে, গ্লাভস পরা আঙুলে আঙুল জড়িয়ে স্বর্গীয় দুপুরের হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে দুটো লোক, ওরা কারা? কী সাংঘাতিক, আমরা নাকি?! মেট্রো স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে হাঁদার মতো এদিকওদিক দেখছে একজন, ওটা আমি? ছুটন্ত মেট্রোর দরজার ওপারে রোগা লম্বা ইয়ারফোন গোঁজা যে ছেলেটার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ছেলেটা মুচকি হাসল, ওটাই অর্চিষ্মান? চিনতে চিনতেই স্টেশন ছেড়ে মেট্রো হাওয়া। একবিন্দু পড়ে নেই কোথাও। কাল আসবে না আবার? ঠিক এই সময় এসে যদি দাঁড়াই? কী করে আসবে, ওই টাইমটেবিল তামাদি হয়ে গেছে কবেই।

বুক হু হু করে। চলে গেছে বলে যত না, তার থেকে ঢের বেশি ওদের চলে যাওয়াগুলো টের পাইনি বলে। আর কোনওদিন আসবে না জেনেও, "এসো কিন্তু" বলে টাটা করে দিইনি বলে।

ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হাত পা এলিয়ে বিছানার ওপর পড়তে যাব, অর্চিষ্মানের "দেখে, দেখে!" আর্তনাদে হৃদপিণ্ড মুখে চলে এল। দেখি খাট জুড়ে পেপার, পেপারের ওপর চায়ের কাপ, প্লেট, প্লেটের ওপর প্লাম ওয়ালনাট। উদ্যত ছুরি হাতে মহা বিরক্ত মুখে, ভুরুটুরু কুঁচকে অর্চিষ্মান তাকিয়ে আছে। 

সকালদুপুর মেট্রো উবার -- যারা যাওয়ার তো চলেই গেছে, তাদের নিয়ে কাঁদুনি গাইতে বসে যদি চা ঠাণ্ডা হয়ে যায় খুব খারাপ হবে। তাছাড়া অর্চিষ্মান যে বেগে প্লাম-ওয়ালনাটে ছুরি চালাচ্ছে আর গপাগপ কেক মুখে পুরছে, ইমিডিয়েটলি লাফিয়ে না পড়লে হক্কের অর্ধেক তো ছেড়েই দিলাম, গুঁড়ো ছাড়া কিছু জুটবে না। সেটাও বাকি সব চলেটলে যাওয়ার থেকে কিছু কম ট্র্যাজিক হবে না। 

তাই সেদিন আর এ বিষয়ে কথা বাড়াইনি। তবে কথাগুলো তো মাথার ভেতর ঘুরছিলই, এই অবান্তরে লিখে রাখলাম।


Comments

  1. ফেসবুকটা আগেই গোল্লায় গেছিলো পলিটিক্যাল হম্বিতম্বিতে ; ফলতঃ অনলাইন আড্ডার মূলস্রোত অবান্তরভাবে ধরে রেখেছেন আপনি ও আরো কয়েকজন| তার মধ্যেও এরম মায়াময় বিকেলের আবছা সেপিয়া ছবি তুলে রাখলে চলবে? এসব বাদ দিয়ে বান্টিকে ফিরিয়ে আনুন দিকি, একটু চনমনে বিপ্লবী চিন্তার দরকার এখন | সাবধানে থাকবেন; ষষ্টকোষে কোরোনাসুরকে বধ করুন- দেবীপক্ষ শুরু হলো বলে|

    ReplyDelete
    Replies
    1. অ্যাঁ, মহালয়া কাছাকাছি বুঝি? কী কাণ্ড। ঠিকই বলেছেন হীরক, এবার নির্ঘাত প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে মহিষাসুরের মুণ্ডুর জায়গায় করোনা ভাইরাসের ওই গোলমতো, শুঁড় বার করা প্রতিমূর্তি থাকবে। আপনিও ভালো থাকবেন, মাস্ক পরে যতখানি পারা যায় পুজো উপভোগ করবেন।

      Delete
  2. Bangla theke onek doore achi bole banglai kichu bhalo lekha porar jonnyo sobsomoi mukhiye thaki.Thanks Abantor .Mohaloyar agam shubhechha neben.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনিও আমার শুভেচ্ছা নেবেন। খুব ভালো লাগল মন্তব্য পেয়ে। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  3. Uff sotti koto sadharon din gulo mone hocche ki osadharon chilo.. !! Ami sedin bus e ekjon chena bhodromohila ke dekhe hese felechilam , tarpor bujhlam uni hasi dekhte pacchen na, tarpor haat naralam.. unio haat tullen .. ki obostha.. seta vebe abar mask er vetor hese nilam...

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, এটা মজার ব্যাপার হয়েছে, ঊর্মি। তুই তো তাও চিনতে পারছিস। আমি কাউক্কে চিনতে পারছি না।

      Delete
  4. এইটা ডেঞ্জারাস হয়েছে। এমনিতেই নস্টালজিয়া আমার ভয়ানক অসুখ। তারমধ্যে কাল দুপুরেই চন্দ্রবিন্দুর প্লেলিস্ট চলছিল। 'বন্ধু তোমায়' শুনে মনখারাপের চূড়ান্ত। তারপর সন্ধ্যেবেলা কাকতালীয় ভাবে আপনার লেখা।
    কালকে রাতে আপতত সব মনখারাপ খরচ করে আজ সকালে ঠিক করলাম বেরিয়ে পড়তেই হবে। গড়িয়াহাট ডাকছে

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমি নিশ্চিত আপনি জানেন, তবে ডাকে সাবধানে সাড়া দেবেন কিন্তু, বৈজয়ন্তী। আমি আজকাল খুব অঞ্জন দত্ত শুনছি। ওই যে "কত কী করার ছিল যে" গানটা। এই আমি একসময় বুক ফুলিয়ে দাবি করতাম যে অঞ্জন দত্তের গান আমার জঘন্য লাগে। এখন বুঝেছি, একটা সময়ের কিছুই আর জঘন্য লাগে না...

      Delete
  5. আহা!মন খারাপ হয়ে গেলো কুন্তলাদি। এই করোনার থাবা থেকে বেরুতে পারিনি, আপাতত অন্তত 1 মাস পারবোও না। এসব পড়ে পড়ে একটু সাধ মেটাচ্ছি।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সেকী কেন, শাল্মলী? কিছু গুরুতর হয়েছে নাকি? আশা করছি সব সেরে যাক।

      Delete
    2. বিশেষ কিছু না, করোনা ও তার সঙ্গে আনুষঙ্গিক কিছু আধি ব্যাধি আর কি! সে যাকগে যাক, ওয়ালনাট কেকে খুউউব লোভ দিলুম।

      Delete
    3. ওরে বাবা। শিগগিরি সেরে উঠুন আর উঠে বেশি বেশি কেক খান, এই কামনা করলাম।

      Delete
  6. আহা!ওয়ালনট কেক আর মন খারাপ করা বিকেলের সুন্দর মুহূর্তের জন্যেই জীবন চলছে!

    ReplyDelete
    Replies
    1. একেবারে একমত, সুদীপ।

      Delete
  7. ashambhab bhalo likhechen Kuntala!

    Shubho Mahalaya. Bhalo thakben.

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনিও, দ্যোতনা। থ্যাংক ইউ।

      Delete
  8. কি সুন্দর পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ করলে কুন্তলা! খুব ভালো লাগলো| দুজনে মিলে বেরিয়ে পড়েছো খুব ভালো করেছো| আমরা যে কত নতুন জায়গায় হাঁটতে গেলাম এই করোনাকালে| প্রত্যেকদিন হাঁটতে যাওয়াটাই বাঁচিয়ে রেখেছে আমাকে| আমাদের পাড়ায় তিরিশ বছর ধরে বসবাস করা এক মহিলার সাথে বাড়ির কাছে একটা ওয়েটল্যান্ড পার্কে দেখা হয়ে গেল| উনি নাকি এত বছর এখানে থেকেও এই পার্কটার অস্তিত্ব জানতেন না|
    তোমার মুদির দোকানের পেয়ারার পেস্টের কথা শুনে মনে পড়লো আমিও দোকানের Latin Ametican আইল-এ ওই জিনিসটি দেখে খুব অবাক আর খুশি হয়েছিলাম| আমার মা খুব ভালো পেয়ারার জেলি বানাতেন |
    এই বেগুনের রান্নাটা আগেও কোনো পোস্টে mention করেছিলে| বেগুনের রায়তা কিন্তু অতি চমৎকার খেতে, তবে দুধ আর মধুর ব্যবহার নেই তাতে|

    ReplyDelete
    Replies
    1. অমিতা, জিগস কালরা আর বেগুনের গল্পটা আমি অন্ততঃ সতেরো বার লিখেছি অবান্তরে। প্রত্যেকবার লেখার আগে ভাবি আবাআআর লিখব? তারপর লিখে দিই।

      সত্যি, সেদিন হাঁটতে খুব ভালো লাগল। আমাদের তো ফাঁকা জায়গা কম তাই বেরোনোর রিস্ক নেওয়া যায় না, কিন্তু সেদিন সব ভয় উড়িয়ে দিয়ে বেরোতে সত্যি দারুণ লেগেছিল। স্কুলে আমাকে টিফিনে সর্বদা রুটি তরকারি দেওয়া হত, কাজেই যারা পাউরুটি জেলি নিয়ে আসত তাদের আমি মারাত্মক হিংসে করতাম। সুদেষ্ণা রায় আনত সবুজ রঙের পেয়ারার জেলি মাখানো সাদা ফুলো ফুলো পাউরুটি। সুদেষ্ণা ভীষণ ভালো ছিল, ভাগ না করে টিফিন খেত না। সুদেষ্ণার টিফিনের সেই জেলি পাউরুটি খাওয়া ইস্তক সঅঅঅঅব জেলির মধ্যে পেয়ারার জেলি, এই বুড়ো বয়স পর্যন্ত, আমার প্রিয়তম রয়ে গেছে। কেউ যদি জিজ্ঞাসা করে (আজ অবধি করেনি, কিন্তু যদি করে) আমার প্রিয়তম জেলি কী, আমি বলি পেয়ারার জেলি। স্কুল ছাড়ার পর দোকানেবাজারে অগুনতিবার পেয়ারার জেলির মুখোমুখি পড়া সত্ত্বেও আমি আজ পর্যন্ত একবারও কিনে বাড়ি নিয়ে আসিনি যদিও। কারণ নতুন করে টেস্ট করে প্রিয়তমতা সুনিশ্চিত করার কোনও দরকারই নেই। ইস্ট অর ওয়েস্ট, পেয়ারার জেলি ইজ দ্য বেস্ট।

      Delete
  9. পেয়ারার জেলি যে বেস্ট এ বিষয়ে আমিও একমত, কি তার গন্ধ কি তার স্বাদ আর কি সুন্দর রং| কিন্তু সবুজ রঙের পেয়ারার জেলি আমি তো দেখিনি এখনো, খুব সুন্দর লাল রঙের হয় তো ! আর একদম clear জেলোর মতো | সবুজ জেলি হলে হয়তো ফুড কালার দেওয়া ছিল?

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমি শিওর ছিল, অমিতা। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে হুগলী জেলার মফঃস্বলের পাড়ার দোকানের পেয়ারার জেলিতে ফূড কালার না দেওয়া থাকলে আমি খুবই অবাক হব। তবে তাতে স্বাদ একটুও টসকাতো না। আর স্বাস্থ্যও যে খারাপ হয়নি তা তো দেখাই যাচ্ছে, দিব্যি আছি আসনখানি চেপে।

      Delete
  10. না না স্বাদ বা স্বাস্থ্যজনিত কোনো চিন্তা আমার মাথায় আসেনি, শুধু সবুজ রঙের দেখিনি বলেই বলছিলাম| তবে আমি কি আর কতটুকুই বা দেখেছি! খুব ভালো লাগলো পুরো লেখাটা| বিশেষ করে উবের পুলের খেলাটা - সকালে অফিস যাওয়াটা কেমন এক্সসাইটিং হতো তাইনা

    ReplyDelete
    Replies
    1. সরি, অমিতা, আমি লাফিয়ে পড়ে ফুড কালার দেওয়া জেলির স্বাদ আর স্বাস্থ্যে প্রভাব ডিফেন্ড করতে গেছি বলে কিছু মনে করবেন না। আমি জানি আপনি আপনার কমেন্টে ওরকম কিছু পয়েন্ট আউট করতে চাননি, আমিও সেটার মোকাবিলা করতে গিয়ে প্রসঙ্গটা তুলিনি কিন্তু আমার উত্তরটা পড়ে সেরকমই ঠেকছে :(...

      কবে যে আবার অফিস যাব... আর সিরিয়াসলি পোষাচ্ছে না।

      Delete
  11. Khub bhalo laglo pore - ar mon tao kharap hoye gelo. Amader office WFH declare kore diyechhe Year end obdhi (khub sombhoboto March obdhi etai cholbe). Ekebarei bhalo lagchhena - saradin ghore bose..
    Sec 29, Cyberhub khule gechhe, kintu oi, covid er bhoye jete parchhina.

    ReplyDelete
    Replies
    1. রণদীপ, অনেক দেরি করলাম উত্তর দিতে। না না, এখন না যাওয়াই ভালো মনে হয়। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য কর, আর কী করবে। আমারও একটুও ভালো লাগছে না। মার্চ-এপ্রিল পর্যন্ত টানলে কী হবে কে জানে। আমি তো দুবেলা প্রার্থনা করছি (কার কাছে কে জানে, খুব তো চেঁচিয়ে নিজেকে নাস্তিক ঘোষণা করে বসে আছি...এ রকম দিন আসবে জানলে ভেবে দেখতাম, সিরিয়াসলি) যেন ডিসেম্বরে সব রোগবালাই উধাও হয়ে সব খুলেটুলে যায় :(

      Delete
  12. তোমার এই লেখাটা ভালো ও লাগল কারন চলে যাওয়া দিন গুলোর জন্য কষ্ট আমিও পাই ঠিক এভাবেই তাই কেউ আমার মতো করে ভাবে দেখে ভালো লাগল আর খারাপ লাগল লেখাটার জন্য নয় পুরনো অনেক সময় কে হেলাফেলা করে হারিয়ে ফেলার কষ্ট টা আবার অনুভব করলাম। ঘুরে ফিরে শুধু অতীতের দিন গুলোই ফিরে পেতে ইচ্ছে করে --- কি ভাবে বর্তমানে থাকা যায়! বল তো!

    ReplyDelete
    Replies
    1. হাহা, আমি বর্তমানেই থাকি, অনিন্দিতা। অ্যাকচুয়ালি বলা ভুল হল একটু, আমি ভবিষ্যতে থাকি। কী হবে আর কী হতে পারে ভেবে আমার বর্তমান বয়ে যায়। পুরোন দিনের কথা মাঝে মধ্যে মনে পড়ে, ব্যস।

      Delete
  13. বর্তমানে থাকতে পারাটা সব থেকে কঠিন আমার কাছে বর্তমানে, অতীতে এমন ছিল না, ভবিষ্যৎ কি হবে জানি না আর ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবি না বললেই চলে।

    ReplyDelete

Post a Comment