তামা
অ্যামেরিকান বিউটি-র শেষ দৃশ্য আমার দেখা যাবতীয় সিনেমার যাবতীয় দৃশ্যের মধ্যে প্রিয়। লেস্টার - অতৃপ্ত, অনৈতিক, অসুখী লেস্টার - মারা যাচ্ছে এবং জনশ্রুতি সত্য করে মৃত্যুমুহূর্তে লেস্টারের চোখের সামনে ভেসে উঠছে গোটা জীবন। ছিটকে ছিটকে উঠছে শৈশব কৈশোর, মুহূর্ত, মানুষ। সেই ক্রমান্বয়ে লেস্টারের চোখে শেষ ভেসে ওঠে ক্যারোলাইন। লেস্টারের স্ত্রী। অতৃপ্ত, অনৈতিক, অসুখী ক্যারোলাইন। লেস্টারের জীবনভরের অসুখের কারণ। অতৃপ্তির উৎস।
তা সত্ত্বেও, জীবনের শেষ মুহূর্তটিতে যে ক্যারোলাইনের ছবি - সম্পত্তি না, প্রাপ্তি না, প্রাণাধিক সন্তান না - ক্যারোলাইনেরই ছবি চোখে নিয়ে লেস্টার মরে যায় সেটা তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু তার থেকেও সম্ভবত বেশি তাৎপর্যপূর্ণ ক্যারোলাইনের কোন ছবিটি চোখে নিয়ে। দীর্ঘ দাম্পত্যের ক্লিষ্ট মুহূর্তদের ছবি? যা লেস্টারের সঙ্গে দর্শকরাও দেখেছেন, বেঁচেছেন গোটা সিনেমাটা জুড়ে। কেউ কেউ হয়তো ভেবেছেন এ ভাবে থেকে যায় কী করে লোকে? কেনই বা থাকে? এর থেকে কি ঢের সোজা না ছেড়ে চলে যাওয়া? ঢের বেশি আরামের, সম্মানের, প্রার্থনার?
জীবনের শেষেরও শেষ মুহূর্তে ক্যারোলাইনকে দেখে লেস্টার। আমরা দেখি। এবং চমকে যাই। এ কে? একে তো গত দু'ঘণ্টায় একবারও দেখিনি? বাস্তবকল্পনার সীমারেখা উল্লঙ্ঘন করতে যদি রাজি থাকি, তাহলে ধরে নেওয়াই যায় লেস্টারও দেখেনি বছরের পর বছর। দশকের পর দশক। তবু সে ছিল তো নিশ্চয়? জগতের আর কোথাও যদি না থাকে, লেস্টারের চোখের পাতায় ছিল। লেস্টারের জীবনের অন্তে আত্মপ্রকাশ করে সেই ক্যারোলাইন। নাগরদোলায় ঘুরন্ত। উচ্ছ্বসিত, উল্লসিত, সুখী।
মরে যাওয়ার আগে গোটা জীবনের ভেসে ওঠার থিওরিতে আমার বিশ্বাস আছে কি না নিশ্চিত নই। জীবনে দু’বার মনে হয়েছিল মরে যেতে পারি। সত্যি মরে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল নাকি মিথ্যে ভয় পেয়েছিলাম সেও জানি না । প্রথমবার নিতান্ত ছোট। গরমকালের সন্ধে। সোদপুরে জেঠুর বাড়ি থেকে গঙ্গা পেরিয়ে বাড়ি ফিরছি। মাঝগঙ্গায় পৌঁছতে না পৌঁছতে ভীষণ ঝড়। অন্ধকার নদী। নৌকো থইথই জল। মা আলতো হাতে হাঁটু থেকে আমার হাত সরিয়ে দিচ্ছেন। আমি সাঁতার জানি। মা জানেন না। আমার এ পাশে এক জোড়া বাচ্চা ছেলের সঙ্গে তাদের মা। নৌকোশুদ্ধু নৈঃশব্দ ছাপিয়ে ছেলেদের বলে চলেছেন, কোনও ভয় নেই, ভগবান আছেন।
দ্বিতীয় বার মৃত্যুর কথা মনে হয়েছিল মাটি থেকে চল্লিশ হাজার ফুট ওপরে। ততদিনে মরার আগে জীবন ভেসে ওঠার থিওরি জেনেছি, কাজেই খেয়াল করতে পারছি যে কারও কথা মনে পড়ছে না। আমি যে এক্ষুনি মরে যেতে পারি সেটাই বাকি সব কিছু ছাপিয়ে উঠেছে।
দুটো ব্যাখ্যা হতে পারে, এক, লোকে যা সন্দেহ করে আমি তাই, স্বার্থপরের ঝাড়। মরে যাওয়ার মুহূর্তেও নিজের কথা ছাড়া আর কারও কথা ভাবতে পারছি না।
দুই, সত্যি সত্যি মারা যাচ্ছিলাম না যেহেতু, সেহেতু কারও মুখ ভেসে উঠছিল না। সত্যি সত্যি যখন মরব, উঠবে।
মোদ্দা কথা, মৃত্যুর আগের মুহূর্তের ভেসে যাওয়া ছবি নিয়ে আমি নিয়মিত চিন্তা করে থাকি। এবং ধরে নেওয়া যায়, যা চলছে যদি সব সেইভাবেই চলে, সম্ভাবনা আছে সেই ছবিতে অর্চিষ্মানের থাকার।
কিন্তু কোন মুহূর্তের?
সিনেমা ভেঙেছে। মাঝরাত পেরিয়েছে অনেকক্ষণ। ভিড়ের চোটে জোরে হাঁটা যাচ্ছে না। শীতে হাড় পর্যন্ত কেঁপে যাচ্ছে। কাল ভ্যালেনটাইন’স ডে। বাড়ি যাওয়ার তাড়া নেই। গরম হতে ম্যাকডিতে ঢুকেছি। ফ্যাটফেটে টিউবলাইটের আলোয় সিলিং থেকে, দেওয়াল জুড়ে গোলাপি বিষণ্ণ হৃদয়েরা।
কসৌলির শেষ দুপুর। সন্ধেয় বাস ছাড়বে। তার আগে হাঁটব বলে বেরিয়েছি। এইচ পি টি ডি সি-র ‘রস কমন’ থেকে বেরিয়ে অল্প এগিয়ে ডানদিকে একটা রাস্তা। চল দেখে আসি। খাড়া চড়াই। অল্প পর থেকে দু’পাশে সরকারি অফিসের বাংলো। মানুষ কম। ফুল বেশি। মিনিট পনেরো এগোলে ফুলেরাও নেই। জঙ্গল। পাহাড়। কুয়াশা। এত ঘন যে নিজের দুটো হাত পর্যন্ত অদৃশ্য। অর্চিষ্মান কোথায়? ও-ও দেখতে পাচ্ছে না আমাকে। একে অপরের নাম ধরে ডাকছি। এ পথে না এলেই কি ভালো হত? পিছু ফেরাও মুশকিল। আরও দশ মিনিট হাঁটা, সামনের দিকেই। কুয়াশা কাটছে। আচমকা সব পরিষ্কার। একটা বাঁকের মুখে দাঁড়িয়ে আছি। দূরে সার বাঁধা বরফচুড়ো।
উবারের জানালা দিয়ে সরে সরে যাওয়া সকাল। চ্যাটবাক্সের দুপুর। এক কিংবা দু’নম্বর মার্কেটের সন্ধে। তেলেভাজার গন্ধ। লেবুচায়ের ওম। রাতের সি আই ডি। মেলাগ্রাউন্ডের মাঠে ঝুরঝুর ঝরে পড়া অমলতাসের হলুদ। একে অপরে বিলীন হয়ে যাওয়া দিনের পর দিনেরা। অবিকল। স্বতন্ত্র।
ত্রিবেণী ক্যান্টিনের সামনের অডিটোরিয়াম। দুপুর। ডাকের অপেক্ষা। কিংবা উঠে যেতে না পারা। পাশাপাশি বসে থাকা। কেন বসে আছি, এ প্রশ্ন একটা সময়ের পর অমূলক। কথা চলছে। কথা ফুরোচ্ছে। আবার জমছে। আশেপাশে ভিড় আসছে, বসছে, উঠে যাচ্ছে। দেখছি, আবার দেখছিও না। শুধু টের পাচ্ছি একটা রোদ্দুর, ওপেন এয়ার থিয়েটারের মঞ্চ থেকে উঠে এসে আমাদের পা, হাঁটু, গাল, চশমা বেয়ে, পিঠে ধাপ্পা দিয়ে চলে গেল।
যত দিন যাচ্ছে ছবিটার বাকি সব ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে, খালি রোদ্দুরটুকু ছাড়া।
আমি জানি না মরে যাওয়ার আগে সত্যি সত্যি গোটা জীবনটা সিনেমার মতো ভেসে ওঠে কি না। যদি ওঠেও, জীবনের কোন কোন ছবিগুলো ভেসে উঠবে সেগুলো ঝাড়াইবাছাই করে আগে থেকে অর্ডার দিয়ে রাখা সম্ভবত অসম্ভব। তবু, যদি মরতেই হয়, যদি কেউ কোথাও সত্যিই থেকে থাকে আমার পছন্দঅপছন্দ শোনার জন্য, ওই রোদ্দুরটা চোখে নিয়ে মরতে পারলে আমি দুঃখিত হব না।
Shubho Tamro bibahobarshiki!! Anek anek subhechchha apnader dujoner jonyo.
ReplyDeleteঅসংখ্য ধন্যবাদ, সুস্মিতা। খুব ভালো লাগল।
Deleteবিবাহবার্ষিকীর অনেক অনেক শুভেচ্ছা। খুব ভালো কাটুক দুজনের।
ReplyDeleteধন্যবাদ, প্রদীপ্ত।
DeleteAnniversaryr onek subheccha nio.. khub bhalo theko
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, ঊর্মি।
DeleteHappy belated anniversary!! Anek anek shuvecchha. Khub khub bhalo thakun dujonei. <3
ReplyDeleteথ্যাংক ইউ, আধিরা। খুব ভালো লাগল তোমার শুভেচ্ছা পেয়ে।
Deleteভালো থাকুন, আনন্দে থাকুন !
ReplyDeleteধন্যবাদ, রাজর্ষি।
Deleteশিরোনাম তামা ; অর্থাৎ সপ্তম বার্ষিকী?
ReplyDeleteরৌদ্রবহুল কিছু শুভেচ্ছা আর অভিনন্দন এইখানে রাখা থাক।
মতান্তরে নবম, ইন্দ্রাণী। খুব খুব ভালো লাগল শুভেচ্ছাবার্তা। থ্যাংক ইউ।
Delete