মামা আর্থ ও ভিকি কৌশল



জাড্য জিনিসটা জটিল। যে কোনও কিছুই একবার চললে বা থামলে, তাকে আবার থামানো বা গড়ানো মুশকিল। যে ব্যস্ততার কথা বলে ছিলাম সেটা বিদেয় হয়েছে। কাজেই অবান্তরে ফেরত আসতে টেকনিক্যালি অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, কিন্তু গত বাহাত্তর ঘণ্টা ধরে কেবলই ফলস স্টার্ট নিচ্ছি। একটা পোস্ট পঁচাশি শতাংশ হয়ে পড়ে আছে, বাকি পনেরো সম্পূর্ণ করতে ঘাম ছুটে যাচ্ছে।

কাজেই একদম নতুন একটা পোস্ট লিখতে শুরু করে, না শেষ করে থামব না, এমনটাই ভেবেছি। আরও একটা অসুবিধে, থামা যতটা সহজে গিয়েছিল, শুরু আর তত সহজে করা যাচ্ছে না। বাবা বাছা করে, সইয়ে সইয়ে শুরু করতে হবে মনে হচ্ছে। কাজটা সহজ করার জন্য একটা ছবি জোগাড় করেছি, ভাবছি সেটাকে বর্ণনা করে একটা পোস্ট নামাই। 

বর্ণনা বলতে একটা মজার কথা মনে পড়ল। মানে আমার মজা লেগেছিল, আপনাদের নাও লাগতে পারে। গল্পে চরিত্রদের বর্ণনা কী করে দিতে হয় সে সম্পর্কে আমি একসময় কিছু খোঁজখবর নিয়েছিলাম। কারণ আমাকে নিজের মতো ছেড়ে দিলে আমি কোনও চরিত্রের  বর্ণনা দিতাম না। সেই যে ফেলুদা তোপসেকে বলেছিল,  চরিত্র ইন্ট্রোডিউস করার সময়েই তার বর্ণনা দিয়ে দিবি না হলে পাঠক নিজের মতো করে কল্পনা করে নেবে তারপর যখন সত্যি সত্যি বর্ণনা আসবে আর পাঠক দেখবে যে তার কল্পনার সঙ্গে লেখকের কল্পনার কোনও মিলই নেই, তখন তার হেবি হতাশ লাগবে।

একমত নই, কারণ লেখক একটা লোককে মাথায় একটা শিং দিয়েই বর্ণনা করুন কি পেছনে একটা ল্যাজ, গালে ব্রণ কি কাঁধে তিল দিয়ে, পাঠক হিসেবে আমি লিস্ট ইন্টারেস্টেড। খুব খুব খুউউউউউউউউউব রেয়ার পরিস্থিতিতে গল্পের ওপর চরিত্রদের চেহারার বেয়ারিং থাকে। কাজেই সব কাজকর্ম থামিয়ে, লোকটা উচ্চতায় ছ'ফুট সাড়ে তিন ইঞ্চি, ছাতি ছেচল্লিশ, কোমর বত্তিরিশ, কাঁধ বাইশ, কবজি সাড়ে আট এই সব পেড়ে বসার কারণ দেখি না। যদি না লোকটার হাত এমন লম্বা যে জানালার বাইরে একফালি বাগানের ওপাশে দাঁড়িয়েই হাত বাড়িয়ে জানালার ভেতর বন্দুক বাগিয়ে গুলি করে দিল, কিংবা মহিলার স্কিন এত গ্লোয়িং যে সেই আলোতেই লোডশেডিং-এ মোমবাতি খুঁজে বার করে ফেলা গেল, এ ছাড়া খামোকা কে কেমন দেখতে জেনে আমি করবটা কী? পোশাকের প্যাঁচালের কথা তো বাদই দিন। কয়লাখনিতে নামার পোশাক কিংবা ক্লাউনের কস্টিউম পরে থাকলে একরকম। এ ছাড়া কার শার্টে কলার আছে, কার নেই, কার শাড়ি বমকাই কার প্রিন্টেড সিল্ক, তাতে গল্পের কী আকাশপাতাল হবে?

আমার হয় না বলেই যে সবার হবে না তেমন কোনও কথা নেই। হয়তো একটা লোক কেমন দেখতে, কী পরে আছে, সেটা জানলে লোকটাকে ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে চলাফেরা করতে কল্পনা করতে সুবিধে হয়। আমার হয় না। আমার মনে হয়, গল্পটা চলতে থাকুক, চরিত্রদের রকমসকম দেখে আকৃতিপ্রকৃতি আমি কল্পনা করে নেব। সত্যি বলতে, যদি কেউ প্রিসাইজলি বলেও দেয় কবজি সাড়ে আট আর ছাতি ছেচল্লিশ, তবুও আমার কল্পনার সঙ্গে লেখকের কল্পনার কোনও মিল না থাকতে পারে। গ্যারান্টি, থাকবে না। প্রথম কথা, ছেচল্লিশ ইঞ্চি কতখানি সে বিষয়ে আমার আন্দাজ খুবই ধোঁয়াশা। ছেচল্লিশ ইঞ্চি কল্পনা করতে হলে আমাকে প্রথমে ভাবতে হবে ছাপ্পান্ন ইঞ্চি, তারপর দশ ইঞ্চি বাদ দিতে হবে, সে সময়টায় আমি আরও ছ'পাতা গল্প পড়ে ফেলা প্রেফার করব এনি ডে।

সবার তা হয় না। সত্যজিৎ রায় আমার থেকে একশো কোটিগুণ বুদ্ধিমান ছিলেন, মানুষের/ পাঠকের চরিত্র আমার থেকে একশো কোটিগুণ বেটার বুঝতেন, গল্পের ক্রাফট আমার থেকে একশো কোটিগুণ ভালো জানতেন। কাজেই আমার কোনও সন্দেহই নেই যে চরিত্র ইন্ট্রোডিউস করার সময় তার চেহারার বর্ণনা দিয়ে নেওয়া ভালো।

ব্লগার হয়ে থাকার সুখ আর সইছে না, লেখক হওয়ার ভুত কিলিয়ে পাগল করছে, তাই এই সব ঘাপঘোপ শেখার চেষ্টা করছি। লেখা থামিয়ে ইউটিউব দেখতে গেলাম, এ বিষয়ে কার কী মত। গিয়ে চারশোটা রিলে আড়াইশো নাচ (কেউ জাজ করার আগেই বলি, অসভ্য নাচ দেখিনি, দেখেছি কেবল টাপাটিনি আর 'তোমার নৌকোর মুখোমুখি' আর 'নীল অঞ্জন ঘন'-র সহযোগে মারাত্মক পরিশীলিত নাচ, যদিও অসভ্য নাচের থেকে এক শতাংশ কম প্রাণঘাতী না) আর দেড়শো হরেকরকমবা রিল দেখলাম। কেমনভাবে কাটলে ঢ্যাঁড়সের হড়হড়ে ভাব থাকবে না, কেমনভাবে বেড়াল খেলাতে হবে ইত্যাদি। আরও চলত, যদি না নিচের বেলটা বাজত। ভাড়াটে বদল হচ্ছে, সম্ভাব্য নতুন ভাড়াটের দল পালে পালে বাড়ি দেখতে আসছে, তিন তিনটে বেল থাকা সত্ত্বেও টস্‌ করে আমাদের বেলটাই বাজাচ্ছে। ঘোর কাটল। নিচে গিয়ে মনের আসল ভাব লুকিয়ে, গলবস্ত্র ভদ্রতা করে ফিরে সার্চ দিলাম, যা দেড়ঘণ্টা আগে দেখব বলে লেখা বন্ধ করেছিলাম।

দু'পক্ষেই যুক্তি আছে অকাট্য। কেউ আমার মতো। বর্ণনা থাকুক না থাকুক, কিসু এসে যায় না। তিনি নিজের মতো একরকম করে ভেবেই নেবেন। আবার কেউ একেবারে উল্টো, বর্ণনা ছাড়া চোখে অন্ধকার। যতক্ষণ না বলা হচ্ছে একটা লোক এত ফুট লম্বা, এত ইঞ্চি চওড়া, ছাগলা দাড়ি নাকি ডাবা হুঁকো, কান কাটা খরগোস না হাঁ করা বোয়াল মাছ, ধুতি না বামচামস ততক্ষণ নাকি সে চরিত্রটা স্রেফ একখানি রক্তমাংসের দলা। একজন আরও স্পষ্টাস্পষ্টি বলেছেন, বর্ণনা বাধ্যতামূলক। না হলে হাউ উড আই নো ইফ ইউ আর টকিং অ্যাবাউট আ পারসন অর আ গোট?

সত্যজিৎ পর্যন্ত যা পারেননি, ইনি তা পারলেন। বাপ বাপ করে শিবির বদলালাম। পোশাক পর্যন্ত পৌঁছতে পারিনি, কিন্তু নাক খাড়া না খ্যাঁদা, ফর্সা না কালো, চুলের লেংথ, ভুরুর উইডথ নিয়ে ঝাড়া এক প্যারা নামিয়েছি লাস্ট দুটো গল্পে। না হলে ভাবুন, গল্পের শুরুতে একটি চরিত্র হয়তো চুপচাপ ছিল, তিন নম্বর পাতায় গিয়ে মুখ খুলতেই  পাঠক আঁতকে উঠে বলছে, ইকী, এ কথা বলে? আমি তো ভেবেছি এ বাড়ির পোষা পাঁঠা যার নাম বাড়ির লোক আদর করে রেখেছে উদিতবিক্রম।

বর্ণনা দিতে হবে, মেনে নিয়েছি। পরের প্রশ্ন হচ্ছে কীভাবে দিতে হবে।

গল্পের মাঝে সিমলেসলি বর্ণনা বুনে দেওয়ার টিপস্‌ দিয়েছেন অনেকে। ধরা যাক ফার্স্ট চ্যাপ্টারে মেন ক্যারেকটার দোকানে গিয়ে এক অসহায় বেঁটে বুড়িকে ওপরের তাক থেকে জিনিস পেড়ে দিলেন। বোঝা গেল হিরো পরোপকারী এবং লম্বা। বাজার করা হয়ে গেলে লোকটা ভারি ভারি ব্যাগ অনায়াসে তুলে নিয়ে বেরিয়ে এলেন। বোঝা গেল হিরো শক্তিশালী। আরেকটা দৃশ্যে সরু দরজা দিয়ে গলে গেলেন, অর্থাৎ হিরো রোগা।

এর থেকে আমার মতে এক প্যারায় গোটাটা সেরে দিয়ে আবার গল্পের ফেরত যাওয়া বেটার। পাঠক গাধা না। যত লুকিয়ে কিছু করার চেষ্টা, তত তা প্রকট হয় বেশি। লেখকের প্রাণপণ কায়দাটা এক সেকেন্ডে বুঝতে পেরে যাবে।

দু'নম্বর কারণ, লেখায় অত বেশি না হলেও, অন্য একটা মাধ্যমে আমি এই "সিমলেস" গোঁজার উদাহরণ দেখেছি এবং সে জিনিস দেখার পরেও যদিও নাককান মুলে কেউ ও রাস্তা পরিহার না করে তাহলে সে প্রতিভাবান।

সেই মাধ্যমটি হল, ইদানীং আমার একাধারে সখা ও শিক্ষক,  ইউটিউব। ইউটিউবের চ্যানেলের স্পনসরশিপ থাকে। বুদ্ধিমান ইউটিউবাররা সেগুলোকে স্পনসরশিপের মতো করেই দেখান। যা চলছিল থামিয়ে স্পষ্ট বলেন, এইবার অ্যাড হচ্ছে, এই হচ্ছে প্রোডাক্ট, এই তার গুণপনা, দলে দলে কিনুন, ডেসক্রিপশন বক্সে দেওয়া আমার কোড ব্যবহার করে পঁচাত্তর পয়সা ছাড় পান।

অনেকে ক্রিয়েটিভ হওয়ার চেষ্টা করেন। ট্রু ক্রাইমের গল্প চলছে। নীল নাইটল্যাম্প জ্বালিয়ে, এসি চালিয়ে, চিত হয়ে, গোড়ালি ক্রস করে, আড়াআড়ি চোখের ওপর ফেলে কানে গুঁজে শুনছি কে কাকে কোথায় কুপিয়ে, হাত পা ধড় মুণ্ডু গোড়ালি কবজি আলাদা আলাদা করে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিডের মিশ্রণভর্তি পিপেতে চুবিয়ে পিপের ঢাকা বন্ধ করেছে, এমন সময় বক্তা বলে উঠলেন, কিন্তু আপনি যদি আপনার ইন্টারনেট সার্চ উন্মুক্ত রাখতে চান তাহলে অমুক ভি পি এন কিনে ব্যবহার করা শুরু করুন। এই যে এই মুহূর্তে আপনি মুগ্ধচিত্তে খুনোখুনির গল্প শুনছেন, এদিকে যে কেউ ইন্টারনেট বেয়ে আপনার ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ছে, জেনে নিচ্ছে আপনার নাম ধাম ব্যাংকের পাসওয়ার্ড, ড্রয়ার হাঁটকে পড়ে নিচ্ছে গোপন চিঠি, ঘেঁটে নিচ্ছে অন্তর্বাসের বান্ডিল।

এতক্ষণ অ্যাসিডের ভ্যাটে ভাসন্ত কাটা মুণ্ডু যা পারেনি, নর্ড ভি পি এন-এর অ্যাড সেটা করে ফেলবে। আপনার ঘুম ছুটে যাবে, ঘাড়ে ঠাণ্ডা লাগবে, আপনি লাফ দিয়ে উঠে বসে হয়তো অর্ডারই করে ফেলবেন একপিস ভি পি এন। অবশ্যই ডেসক্রিপশন বাক্সের লিংক থেকে, কারণ আপনি দুনিয়াদার, পঁচাত্তর পয়সার ডিসকাউন্ট পাই পাই আদায় করেন।

এর তবু একরকম মানে আছে। ক্রাইম চ্যানেলের স্পনসরশিপের বিজ্ঞাপনকে ক্রাইমের দিকে নিয়ে গিয়ে প্রাসঙ্গিক করে তোলার চেষ্টা। ইউটিউবে আজকাল অনেক বাংলা চ্যানেল হয়েছে যেখানে লোকে খালি খায় আর রাঁধে, রাঁধার পর খায়, খেয়ে উঠে বাজার করতে যায়, ফিরে এসে রাঁধে, রেঁধে উঠে খায়। ক্যামেরা এঁটো পাতের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। নিজেরা খায়। সেলিব্রিটিদের ডেকে খাওয়ায়। সেলেব্রিটিরাও যান। বা যেতে হয়। প্রোমোশনের অঙ্গ হিসেবে। র‍্যান্ডম লোকের বাড়ি পাত পেড়ে খেতে হয়। খেতে খেতে আহা বাহা করতে হয়।

আত্মপক্ষ সমর্থনে বলতে পারি আমার সময় বেশি আর বিনোদনের প্রেফারেন্স অদ্ভুত। বিস্মিত ও রোমাঞ্চিত হওয়ার ক্ষমতা ও চাহিদা আমার অপরিসীম। এও যে ঘটে, ঘটতে পারে পৃথিবীতে সে দেখার তাড়নায় আমি কখনওসখনও এই সব চ্যানেলে উঁকি মারি। 

রেঁধে বেড়ে খেয়ে খাইয়ে এইসব চ্যানেলরা এত ফুলেফেঁপে উঠেছেন যে এদের স্পনসরশিপ জুটেছে। ঝামেলা হচ্ছে, এতও ফোলেনফাঁপেননি যে স্পনসরশিপ বাছাবাছি করবেন। যা আসছে লুটেপুটে নিতে হচ্ছে। ওঁদের পক্ষে উপযুক্ত হত চাল ডাল তেলের স্পনসরশিপ। আজ মা দাওয়াত বাসমতী চাল দিয়ে বিরিয়ানি রাঁধছে, বলে চালের বস্তা কাঁধের ওপর তুলে হাসিমুখে পোজ দিলেন। কিংবা পতঞ্জলি কাচ্চি ঘানি সর্ষের তেলের বোতলের লেবেল ক্যামেরার দিকে ফিরিয়ে একজন আলুভাতের ওপর ঢাললেন, আরেকজন খুব কষে লংকা ডলে ডলে মাখলেন।

কিন্তু সে সব প্রোডাক্ট এখনও ওঁদের দ্বারস্থ হচ্ছে না। হচ্ছে যত অনলাইন লটারি, অনলাইন রামি,অনলাইন সুডোকু এই সব। এঁরা যথাসম্ভব সেগুলোকে "সিমলেসলি" ভ্লগে গোঁজার চেষ্টা চালাচ্ছেন। সেদিন দেখলাম চ্যানেল মালিক বসে বসে কম্পিউটারে রামি খেলছেন, হয় মা নয় বউ রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে বলছেন, টমেটো লাগবে। বা কাঁচালংকা, ভুলে গেছি। চ্যানেল মালিক, সস্তা রিভলভিং চেয়ারে ক্যাঁচকোচ তুলে উঠলেন। আড়মোড়া ভাঙলেন। বললেন, যাই ছাদের বাগান থেকে নিয়ে আসি। সিঁড়ি বাইলেন। হাতে ধরা ক্যামেরা এমন লাফাচ্ছে যে মাথার ভেতর ভূমিকম্পের অনুভূতি। ছাদে গিয়ে আহা কী লাল টুসটুসে টমেটো, আর কী ডাঁসা লংকা জাতীয় উচ্ছ্বাস সারতে সারতেই ক্যামেরার ভয়ানক সামনে, ক্লোজস্য ক্লোজ আপে, চ্যানেলের বাড়বৃদ্ধির মুখ চেয়ে সপ্তাহে ছ'বার চিকেনমটন মণ্ডামেঠাই সহযোগে থালাভর্তি ভাত সাবড়ানো মুখমণ্ডল। চোখেমুখে আর্তি। কী রোদ বাবারে।

পরের শটে ক্যামেরা অন্য কারও হাতে, উনি টোমাটো আর কাঁচালংকার বনে দাঁড়িয়ে হাফপ্যান্টের পকেট থেকে বার করেছেন টিউব, টিপে ক্রিম বার করে সারা মুখে ঘষে ঘষে মাখছেন। মাখতে মাখতে বলছেন, এই গরমে রোদ্দুরে বেরোনোর আগে মনে করে মেখে নেওয়া উচিত মামা আর্থ ভিটামিন সি ডেইলি গ্লো সানস্ক্রিন উইথ এস পি এফ ৫০।

তারপর আপাদমস্তক বাঙালি চ্যানেলে (যে রেটে ফ্রিজকে ফ্রিঝ আর নুনকে লবণ বলেন, কাঠবাঙালও) গড়গড়িয়ে, "দিস সানস্ক্রিন ইজ প্যারাবেন অ্যান্ড সিলিকোন ফ্রি, ডার্মাটোলজিক্যালি টেস্টেড অ্যান্ড ডিজাইনড ফর ইন্ডিয়ান স্ক্রিন।"

কোম্পানির তরফে বোধহয় পরীক্ষা নেওয়া হয় যে দালালিটা যথেষ্ট ডেডিকেশনের সঙ্গে হল নাকি। তাই মাখা হয়ে গেলে, টিউবের ঢাকনায় প্যাঁচ দিতে দিতে তিনি জুড়ে দিলেন, শুধু যে বাইরে গেলে বা ছাদে টমেটো তুলতে এলেই মামা আর্থ মাখতে হবে তেমন মাথার দিব্যিও কেউ দেয়নি, ঘরের ভেতরেও খানিকটা মেখে বসে থাকতে পারেন, অসুবিধে তো কিছু নেই, সূর্যের রশ্মি কোথা কোথা দিয়ে ঢুকে পড়ে ভাবতেও পারবেন না।

যাই হোক, যেটা বলছিলাম। রিসেন্টলি একটা গল্প লিখছিলাম তাতে একজন রূপবান যুবকের বর্ণনা দেওয়ার দরকার ছিল। ঠিক করেছি জীবনে যত গল্প লিখব সবের নায়ক খলনায়ক, মোদ্দা কথা পুরুষ চরিত্ররা, সকলেই অসামান্য রূপবান হবে। সবাই ছ'ফুটের ওপর লম্বা, ভুঁড়ির লেশমাত্র থাকবে না, ভদ্র শিক্ষিত মুখভঙ্গি, ফর্সা হলে লালটু নয়, কালো হলে কুচ্ছিত নয়। সে যতই আনরিয়েলিস্টিক হোক না কেন। অন্যদিকে মেয়েরা হবে সব খ্যাঁদাবোঁচা, লেপাপোঁছা, অনুজ্জ্বল শ্যামবর্ণা। মানে রিয়েলিটিতে যেমন হয়। তারপর সেই কন্দর্পকান্তি নায়করা খেঁদিবুঁচিদের নায়িকাদের প্রেমে পড়বে। রিয়েলিস্টিক ক্যান টেক আ হাইক।

ছোটবেলায় সাইকোলজিক্যাল ফান ফ্যাক্টস-এর মধ্যে পড়েছিলাম, মানুষ নাকি না-দেখা মানুষের মুখ কল্পনা করতে পারে না। সত্যি কি না জানি না। ছোটবয়সে পড়েছি বলে মাথায় ঢুকে গেছে। কাজেই কাউকে একটা দেখে রূপবান নায়কের বর্ণনা লিখতে হবে। ভাবছি কাকে দেখে লেখা যায় কাকে দেখে  লেখা যায়, এমন সময় অর্চিষ্মানের পিং। ভিকি কৌশলের ভাইরাল নাচ দেখলে? আমাদের দেড়খানা মিলের অর্ধেকখানা হচ্ছে বিনোদনের ব্যাপারে দুজনেই ছুঁৎমার্গহীন। বললাম, না তো। অর্চিষ্মান হোয়াটসঅ্যাপে রিলের লিংক পাঠাল। আমি তিন্নিকে হোয়াটসঅ্যাপে সে রিল ফরওয়ার্ড করে বললাম, জন্মান্তর যদি থাকে আর যদি আবার মানুষ হয়ে জন্মাই যেন এ রকম দেখতে হই। তিন্নি বলল, অ্যাদ্দিনে একটা কাজের কথা বললি।

আমার সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। এখনকার ভাইরাল ভিকি নন, যদিও তিনিও যারপরনাই নয়নসুখ, মনে পড়ে গেল প্রথমবার দেখা ভিকি কৌশলকে। মাসান-এর ভিকি। পরবর্তী ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত,আমার সব গল্পের হিরোর চেহারা এই রকম হবে।



(যে ছবিটা নিয়ে পোস্টটা লিখব বলে বসেছিলাম আজ হল না। পরেরটায় হবে।)

Comments

  1. ভিকি কৌশল মাসান এ সত্যি দারুন ছিলেন
    পুরো সিনেমাটাই খুব ভালো লেগেছিলো
    আমি এখনো youtube এ খেলাম দিলাম ব্লগ বেশি দেখিনি তবে ফেসবুক এ নুন, কাঁচা লঙ্কা, শশা , পেঁয়াজ , পাতি লেবু, খাবার জল সমস্ত লিস্টি করে ছবি দেয়া পোস্ট দেখে দেখে প্রচন্ড bore হচ্ছি।

    ভালো থাকবেন খুব

    ইন্দ্রানী

    ReplyDelete
  2. ভুঁড়ি কি এতটাই খারাপ জিনিস? খ্যাঁদাবোঁচা ল্যাপাপোঁছা মেয়েরাও একটুও পছন্দ করেনা? আস্কিং ফর এ ফ্রেন্ড।

    ReplyDelete
    Replies
    1. খ্যাঁদাবোঁচা ল্যাপাপোঁছা মেয়েদের পছন্দঅপছন্দ ম্যাটার করে না। ঠিক যেমন উল্টোদিকের হরেদরেরাও চাইলেও দীপিকা পাডুকোনকে পায় না। এটাই জীবনের নিয়ম। আমি লেখক/ডিক্টেটর হিসেবে সেই নিয়মটাকে একটু বদলে দিচ্ছি আরকি। এটুকু অনেস্টলি বলতে পারি, উল্টোদিকের হরেদরেদের দলে থাকলে আমার সব নায়িকাই দীপিকা পাডুকোনের মতো দেখতে হত, নিদেনপক্ষে বোহেমিয়ান, ম্যানিক পিক্সি, কুলগার্ল।

      তবে এ সব গল্পে। বাস্তবে খ্যাঁদাবোঁচা ল্যাপাপোঁছা মেয়েরা জানে (হোপফুলি) যে সঙ্গী হিসেবে নাদুসনুদুস ভালোমানুষের সঙ্গে ভুঁড়িহীন বদমাইশের কোনও কমপিটিশনই নেই। তাছাড়া আমার আরও একটা থিওরি আছে, সেটা হচ্ছে যে যত কম চিনি তত এই সব দিয়ে বিচার করতে হয়। যাকে চিনিই না, তাকে কীসের বেসিসে পছন্দ করব বলুন? এই সব বাহ্যিক জিনিসপত্র অন্তত একটা বেঞ্চমার্ক প্রোভাইড করবে। আচ্ছা, জাতেগোত্রে মেলে। আচ্ছা, ভালো রোজগার করে। আচ্ছা, গায়ের রং ফর্সা। আচ্ছা, পেটানো চেহারা। আচ্ছা, জিরো সাইজ।

      যত চিনবেন, তত বেঞ্চমার্ক বদলাবে। আচ্ছা, হিংসুটে নয়, আর ফর্সা হওয়ার থেকে হিংসুটে না হওয়াটা আমার কাছে বেশি ইম্পরট্যান্ট, কাজেই ফর্সা আউট। আচ্ছা, প্রাণে মায়াদয়া আছে, কাজেই রোজগার কিছু কম করলে অসুবিধে নেই। আচ্ছা, হাসির কথায় হাসতে পারে, খানিকটা ভুঁড়ি ইগনোর করা গেল। আচ্ছা, আমাকে ভালোবাসে, আরও খানিকটা ভুঁড়ি ইগনোর করা গেল।

      আমার ধারণা হিসেবটা (যা অনৈচ্ছিক এবং অবচেতন) খানিকটা এইরকম ভাবে চলে আরকি।

      তবে ভুল হতে পারি। অমর্ত্য সেনকে নাকি দাদু ক্ষিতিমোহন সেন বলেছিলেন, পরীক্ষায় একদম বেশি লিখবি না, তাহলে তুই কত কম জানিস ধরা পড়ে যাবে। যে মহাভারত লিখলাম, তাতে কম জানার চান্স অত্যন্ত হাই।

      Delete
    2. eta thik bolechen. Ami kibhabe janbo 56 inch mane ki? Boi porbo naki measuring tape nie bosbo?

      Delete
    3. ছাপ্পান্ন ইঞ্চি তো ছবি দেখেই বোঝা যাবে।

      Delete
  3. সেদিন দেখলাম একজন শেফ সেলিব্রেটি কে খাইয়ে হাত ধোয়ার পর আঁচল বাড়িয়ে জোর করে হাত মোছানো হচ্ছে ওটাই নাকি বাঙালী কালচার বলে , বাবাগো বলে বন্ধ করে দিয়েছি। যাই হোক তোমার সব গল্পের হিরোরা আমার পছন্দ হয়ে গেলো ☺️

    ReplyDelete
    Replies
    1. পা-ধোয়া জল খাওয়ার কালচারটা স্কিপ করে গেছে? এইজন্যই বাঙালির কিছু হবে না।

      Delete

Post a Comment