আর্য নিবাসে আটচল্লিশ ঘণ্টা


কুন্তলা, মিড-জুলাই থেকে লুল্লু ভুত, বলেছিল অর্চিষ্মান। ক্রমাগত ঘোরাঘুরি। পয়েন্ট এ থেকে বি হয়ে সি। ফিরেই ডি, ই, সম্ভবতঃ এফ-ও। মাঝখানে নো বাড়ি-ছোঁওয়া।

লুল্লু ভুত আমাদের সেই অবস্থার কোড ওয়ার্ড, যেখানে কর্তৃপক্ষ আমাদের পিষে তেল বার করার ফন্দি এঁটেছেন।

লুল্লু ভুত হওয়ার আগে ম্যাক্সিমাম চিল করে নিতে হবে, কুন্তলা।

চেনারা বলবে তোমাদের চিল তো অলরেডি ওভারফ্লোয়িং। সেদিন গুড়গাঁওয়ায় এক বন্ধুর বাড়ি গেলাম। দরজা খোলামাত্র একটি গোল্ডেন রিট্রিভার এসে আমার দুই কাঁধে পা রেখে মুখের ওপর হাঁপাতে লাগল আর একটি তিন, একটি দেড়ের দুই শিশু গলা সপ্তমে তুলে পাক খেয়ে ঘুরতে লাগল। আর তাঁদের পঁচিশশো স্কোয়্যার ফিটের ঝিংচ্যাক ফ্ল্যাট? ঠুকে ঠুকে বাবাইয়াগার নোড়া দু’খান হয়ে যাবে; এক কোণা থেকে এক বিন্দু ধুলো বেরোবে না।

কিন্তু যার যেটা বেঞ্চমার্ক। ও সব সংসারের লোকজনের কাছে দশ মিনিট স্থির হয়ে বসে থাকাই চিল, আমাদের কাছে দরজায় ছিটকিনি তুলে ফোন সাইলেন্টে রেখে হইচইতে নতুন কিছু রিলিজ করেনি বলে একেনবাবুর টুংকুলুং রহস্য সাড়ে সতেরোতমবার দেখতে হওয়াও স্ট্রেস।

তবু মিলিয়ে নিলাম। অর্চিষ্মান ম্যাক্সিমাম চিল বলতে কী মিন করছে। রাদার, কী মিন করছে না।

এসি চালিয়ে চিৎপাত হয়ে হইচই দেখা চিল না।

নোপ।

মাঝরাতে পার্চে গিয়ে পাস্তা খাওয়া চিল না।

নোপ।

অর্থাৎ বাড়ি থেকে পালানোর চিল।

ইয়েস।

চিল ম্যাক্সিমাইজেশনের কনস্ট্রেন্ট একটাই। যা করার শুক্রবার সন্ধে থেকে সোমবার কাকভোরের মধ্যে করতে হবে। অর্চিষ্মান বলল, জয়পুরের ওয়েদার দেখো তো।

বৃষ্টি। দু’দিনই।

অর্চিষ্মানের চোখ জ্বলল। আর্য নিবাস যাবে?

মা বলেছিলেন মায়ের নাকি পরজন্ম নেই। কারণ মা যা যা পাপ করেন সঙ্গে সঙ্গে নাকি তার হাতেগরম শাস্তি পেয়ে যান। প্রায়শ্চিত্ত জমছেই না যে পরজন্মে এসে ব্যাকলগ ঠেলতে হবে।

আমারও মায়ের ধাত। কসোল পোস্টে হোটেল-কেন্দ্রিক ভ্রমণকে শেড দিলাম, কারা ফাইভস্টার হোটেলে গিয়ে সুইমিং পুলে ভুঁড়ি ভাসিয়ে ছুটি কাটায় বলে শিউরে উঠলাম - এখন নিজের কান নিজে মুলে এক্স্যাক্টলি সেই কাজ করব। জয়পুরে যাব স্রেফ আর্য নিবাসে থাকব বলে।

আর্য নিবাস অবশ্য ফাইভ স্টার না। সুইমিং পুলও নেই। থাকলেও সে পুলে আমার নামার প্রশ্ন উঠত না। কিন্তু সেটা কথা না। কথাটা হচ্ছে আমরা এবার জয়পুর গেলাম স্রেফ আর্য নিবাসে থাকব বলেই।

প্রথমতঃ, এটা দেখাদিখি-ঘোরাঘুরির ট্রিপ না। আগের বছরই হাওয়ামহলের ছাদে চড়ে, আমের প্যালেসের বান্টা খেয়ে, সিটি প্যালেসের প্রাণঘাতী লাইট অ্যান্ড সাউন্ড সয়ে এসেছি। এটা বিশুদ্ধ আরামের ট্রিপ। আর অর্চিষ্মানের মতে আরাম করার জন্য আর্য নিবাসের থেকে আদর্শ আর কিছু হয় না। জয়পুরের প্রোজেক্টের ফার্স্ট ট্রিপেই অন্য অফিসের লোকেরা আর্য নিবাসের খবর অর্চিষ্মানকে প্রথম দেয়। নিবাস-বাসের প্রথম রাতেই অর্চিষ্মান আমাকে ফোন করে।

এখানে আসব কুন্তলা।

তারপর থেকে অর্চিষ্মান যতবার জয়পুর গেছে আর্য নিবাসেই থেকেছে। যতবার থেকেছে ছবি পাঠিয়েছে। মনে করিয়েছে, আসতেই হবে।

এবার তাই শুধু আর্য নিবাস। নো হাওয়ামহল নো আমের প্যালেস নো নাহারগড়। খালি আর্য নিবাসের বারান্দায় বসে থাকা, ইচ্ছে হলে খেতে বেরোনো আর ঘুমোনো।

ভোর পাঁচটায় উবার ডেকে দিল্লি স্টেশন, আজমেরি গেট, দশ নম্বর প্ল্যাটফর্ম। আড়চোখে এগারোর দিকে তাকালাম। আগের বার এই প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষারত বন্দেভারতে কনফিডেন্টলি উঠে চণ্ডীগড় চলে যাচ্ছিলাম। এবার এগারো ফাঁকা। মনে হয় বন্দেভারত অলরেডি ছেড়ে গেছে। দশে দাঁড়ানো দিল্লি-আজমের শতাব্দীর বারো নম্বর কোচে উঠে একাত্তর বাহাত্তর নম্বর সিটে বসলাম। ট্রেন ছ’টা দশে ছেড়ে সাড়ে দশটাতে জয়পুর জংশন ছুঁল। আবার উবার অটো। ডেসটিনেশন আর্য নিবাস।

পৃথিবীতে কিছু লোক থাকে যাদের কিছুই স্মুদলি হয় না। যেমন জয়পুরের অটো ভাইসাব। পিক আপ পয়েন্টের একশো মিটার আগে এসে বলবেন চলে আইয়ে। ডেস্টিনেশনের তিনশো মিটার দূরে অফিসটাইমের রাজপথের (যার মাঝখানে একমানুষ উঁচু রেলিং) উল্টোদিকে ব্রেক কষে বলবেন চলে যাইয়ে। গুগল পে দিতে চাইলে বলবেন ক্যাশ নেহি হ্যায়? ক্যাশ দিতে চাইলে পে টি এম। আমি এ সব জায়গায় নব্বই শতাংশ কেসে ঘাড় পেতে ফেলি, দশ শতাংশে মেজাজ হারাই। এ সব জায়গায় অর্চিষ্মান বলে ইউ টার্ন লেকে উস সাইড চলিয়ে ভাইসাব। শান্ত গলায় একটুও উত্তেজনা থাকে না। উল্টোদিকের লোকটা যে অরাজি হতে পারে সে সম্ভাবনার অ্যাকনলেজমেন্ট-মাত্র থাকে না।

অটো ইউ টার্ন নিয়ে রাস্তা পার হয়ে আর্য নিবাসের কম্পাউন্ডে ঢুকল। টাকা মিটিয়ে নেমে এলাম।

অর্চিষ্মান কার থেকে শুনেছে, আমি অর্চিষ্মানের থেকে শুনেছি। আর্য নিবাস এক প্রাক্তন আই এ এস-এর প্যাশন প্রোজেক্ট। হোটেল হলেও ভাইবটা ঠিক হোটেলের নয়। দেশজ রুচি, দেশজ সংস্কৃতি উদযাপন করার তাগিদ থেকে নিবাসের স্থাপনা। রুচিটুচি ঢুকে গেলে অনেকসময়ই আই অ্যাম বেটার দ্যান ইউ-র অসহনীয় আত্মগরিমা এসে পড়ে, আর্য নিবাস, থ্যাংকফুলি, এক্কেবারে সে রকম না। দিব্যি স্বাভাবিক নমস্তে ম্যাডাম বা জাস্ট বন্ধুত্বপূর্ণ হাসি। লোকগানের সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় পাগড়ি পরা লোকজন কপালে সিঁদুর, গলায় মালা পরিয়েও যেমন অভ্যর্থনা জানাচ্ছে না তেমনি আপাদমস্তক দিশি লোকেরা ইউনিফর্ম পরে স্যালুট ঠুকে চব্বিশঘণ্টা গুড মর্নিং গুড নাইট হ্যাভ আ গুড ডে ইত্যাদি বেখাপ্পা ইংরিজি ভদ্রতাও করছে না।


সবুজ লন, লন ঘিরে বড় বড় গাছ, এক কোণে ছাউনি-ছাওয়া স্মোকিং রুম আর অর্চিষ্মানের মুখে শোনা, হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো ছবিতে দেখা, সেই বিখ্যাত বারান্দা পেরিয়ে, রিসেপশন থেকে চাবি নিয়ে দোতলায় এলাম। আমি এই ঘরটায় থেকেছি, এই ঘরটায়, ওই ঘরেও। আঙুল দেখাতে দেখাতে ভাইসাবের পেছন পেছন হাঁটছিল অর্চিষ্মান। করিডর-অন্তে দুশো পনেরো নম্বর ঘরের দরজায় চাবি ঘুরিয়ে ঢুকে, এসি, টিভি চালিয়ে, জলের ব্যবস্থা দেখিয়ে, নমস্তে বলে বিদায় নিলেন ভাইসাব। দরজা দিয়ে এসে ঘরের কোণায় দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখলাম। বিছানায় ধপাস হয়ে অর্চিষ্মান আমাকে দেখল।

আমি জানি ও কী ভাবছে।

কারণ আমি অর্চিষ্মানকে, ওয়েল, অর্চিষ্মানের চরিত্রের দুটো দিককে চিনি।

এক, আমার বর হওয়া সত্ত্বেও আমার চট-ইম্প্রেসড হওয়ার প্রতিভার ছিটেফোঁটা অর্চিষ্মান পায়নি। অর্চিষ্মান সব কিছুকেই, সবাইকেই, গ্রেন অফ সল্ট ছিটিয়ে দেখে। পূর্ণিমার রাতে তাজমহলের সামনে বসে অর্চিষ্মান হাইলি বলতে পারে, ভালো তো বটেই, কিন্তু ভালো ফোটোগ্রাফারের ভালো ক্যামেরায় তোলা ছবিতে আরও বেশি ভালো। আজ পর্যন্ত যে তিনটে ব্যাপারের শ্রেষ্ঠত্ব অর্চিষ্মান উইদাউট কোয়ালিফিকেশন মেনে নিয়েছে তারা হচ্ছে বাঙালি বিরিয়ানি, বেল জার আর ক্যালভিন অ্যান্ড হবস।

এই তৃতীয় বিষয়টির সঙ্গে অর্চিষ্মানের চরিত্রের দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটি সম্পর্কিত। অর্চিষ্মান ক্যালভিনের নীতিতে বিশ্বাসী। কিপ এভরিবডি’স এক্সপেক্টেশন লো। অন্যভাবে বললে আন্ডার-প্রমিস। ওভার-ডেলিভার হবে কি না সেটাও পরে দেখা যাবে। চুটকি বলতে শুনিনি কখনও কিন্তু ধরা যাক সারা দিনে ঘটা এমন কোনও ঘটনায়, যাতে ওর হাসি পেয়েছে, আমাকে পুনর্ব্যাখ্যান করতে গিয়ে ইনভেরিয়েবলি মাঝখানে থমকাবে। বলবে, শোনো, আমার একটু বেশিই হাসি পেয়েছিল মনে হয়,অত কিছু মজারও নয়, হ্যাঁ?


এ সব সত্ত্বেও অর্চিষ্মান যে একটা নশ্বর হোটেল নিয়ে এত ফলাও করছে তাতে অবাক হয়েছিলাম। বলিনি। অর্চিষ্মানও রিয়েলাইজ করেছিল নিশ্চয়। ট্রেন দিল্লি ছাড়ার পর থেকেই টের পেয়েছি। দিল্লি ক্যান্টনমেন্টে ট্রেন ঢোকার সময় বলল, আচ্ছা শোনো ঘরগুলো কিন্তু খুব একটা বড় না, মানে ঠিকঠাক। রেওয়াড়ি পৌঁছে বলল, আর যদি ধর ভেতরের দিকে ঘর পড়ে, পুরোনো বাড়ি তো, হয়তো ডে লাইট পাওয়া যাবে না। আলওয়ার ছাড়ার সময়ও হাঁ করেছিল, থামিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম বাথরুম অ্যাটাচড তো? ইয়েস। পদস্থ পরিষ্কার? অফ কোর্স। তাহলেই হবে।

অর্চিষ্মান আমাকে দেখল। আমি ঘর দেখলাম।

কিং সাইজ খাট, পড়ার টেবিল, প্রমাণ সাইজ কাঠের আলমারি, কোণে তিনকোণা শেলফে চা কফির সরঞ্জাম, বেডসাইড টেবিল, টিভির নিচে নিচু কাঠের টেবিলের পর হাঁটাচলার ফালি জায়গা। বাইরের আলোও, অর্চিষ্মান যেমন সাবধান করেছিল, আসছে না। আলো না ঢোকার একটা কারণ অবশ্য বাড়ির নির্মাণশৈলী। ছোট ছোট বারান্দা ঘিরে ঘরের জটলা। বারান্দামুখো ঘরগুলোতে রোদ ঢোকা অসম্ভব।

গোলাপি সাদা তিনকোণা টাইলের মেঝে। মেহগনি পালিশ আলমারির সোনালি হুড়কো, ব্রাস দিয়ে ঘষে ঝকঝকে। ক্রিমরং ছাদের চার কোণায় দু’তিনটি গাঢ় রঙে আঁকা আলপনা। যতটুকু দরকার।

সাদা বেডকভারে ছ তিন ইঞ্চি দূর দূর ভার্টিকাল মুসুরডাল রং বিনুনি। জানালায় মুসুরডাল রং পর্দা জুড়ে সাদা কল্কা, জানালার ওপর নিচে স্প্রিং লাগানো। বেডসাইড ল্যাম্পের ঢাকনির সর্ষেবাটা জমিতে সাদা নীল সবুজ খুদিখুদি ফুল। এই প্রিন্টের শাড়ি পাই তো গায়ে জড়িয়ে বসে থাকি।

দরজা খুলে বাথরুমে ঢুকি। স্পটলেস সাদা চওড়া বেসিন। কারুকার্যওয়ালা ফ্রেমের আয়নায় আমার প্রায় পুরোটাই ধরে যায়। শাওয়ার পর্দার ওপারে সাদা তোয়ালে, নীল পাথরের সাবানের পাত্র।

বাইরে এসে দরজা বন্ধ করি।

যেমন বলেছিলে তার থেকেও একশোগুণ বেশি মচৎকার।

যাক। চল নিচে যাই।

আর্য নিবাস বিলাসী নয়। আর্য নিবাসের ইউ এস পি রুচি। ইমপেক্যাব্‌ল্‌ রুচি। অসীম যত্ন। আর্য নিবাসের প্রতিটি কোণায় সে যত্নের ছাপ।

নাসিরুদ্দিন না বীরবলের চুটকিতে পড়েছিলাম, যার যেটা নেই সে সেটার আদর করে, সেই কারণেই যত্ন জিনিসটাকে আমি অনেক নম্বর দিই। ক্ষমতার খামতি ঢেকে দেওয়া যায়, এমনকি অতিক্রমও করা যায়, স্রেফ যত্ন দিয়ে। আমি ধর ছাগলা পাতা খা, কিন্তু আমার পছন্দের লোকেরা সকলেই যত্নশীল। মা। অর্চিষ্মানও জীবনের কিছু কিছু ব্যাপারে অসম্ভব যত্ন নেয়।

সাধারণতঃ কোনও জায়গায় পৌঁছে ঘরে আধশোয়া হয়ে চা খাওয়াই প্রেফার করি। কিন্তু জয়পুর গেছি আর্য নিবাসে থাকব বলে আর আর্য নিবাসে গেছি ওই বারান্দাটিতে বসব বলে।


দীর্ঘ, প্রশস্ত বারান্দায় কাচের টেবিল ঘিরে সাদা রং করা রট আয়রনের চেয়ারে, চেয়ারে সুন্দর কাপড়ঢাকা আরামদায়ক গদি। উঁচু সিলিং থেকে নিয়মিত ইন্টারভ্যালে সিলিং ফ্যান। বারান্দার এ পাশে লন, ও পাশে লাগোয়া ঘরগুলোর একটা স্যুভেনির শপ (যেখান থেকে অর্চিষ্মান আমাকে এক না, দুই না, তিন জোড়া ঝুমকো দুল উপহার দিয়েছে), একটা লাউঞ্জ, রেস্টোর‍্যান্ট। প্রায় পুরো বারান্দা পেরিয়ে ফাঁকা চেয়ারটেবিল পেয়ে বসলাম। আলংকারিক বাসনপত্র, গৃহসজ্জার জিনিস সাজানো কাঠের আলমারির পেছনে হাত বাড়িয়ে সুইচবোর্ডের তিনটে সুইচ অন আর অফ করে চতুর্থ সুইচে আমাদের মাথার কাছাকাছি ফ্যানটা চালিয়ে দিল অর্চিষ্মান।


সিংগল পট কফিতে দুজনের হয়ে বেয়ে পড়বে। রেস্টোর‍্যান্টের ভেতরে এসি। ওখানে বসলে আরাম হত হয়তো, কিন্তু এমন সুন্দর দৃশ্যের কাছাকাছি থাকার জন্য গায়ে একটু গরম লাগাতে আপত্তি হল না আমাদের। অর্চিষ্মানের মাথার পেছনে, আমার দৃষ্টির সামনে এক নর্তকী ভদ্রমহিলা, আশ্চর্য জ্যামিতিক জিমন্যাস্টিকে, যা উনি পাথরের বলেই পেরেছেন হয়তো, রক্তমাংসের অ্যানাটমিতে ও জিনিস অসম্ভব, দাঁড়িয়ে আমার দিকে হাসিহাসি মুখে তাকিয়ে রয়েছেন।


দুপুরে খেতে গেলাম থালি অ্যান্ড মোর-এ। ভাত, মিসি রুটি, ডাল, আলু পেঁয়াজের শুকনো তরকারি, গঠ্‌ঠার ঝোল, কের সাংরি, লংকার আচার, রসুনের আচার, পাঁপড়, চুরমা। ভালোই, রীতিমতো ভালোই হয়তো কারণ রাজস্থানি খাবার খারাপ করতে প্রতিভা লাগে। পাঞ্জাবি কায়দায় (আজকাল অনেক বাঙালি রান্নার চ্যানেল দেখলেও মনে হয়, প্রসেনজিৎকে দেখলে তো হয়ই ) টমেটো মহোৎসব না বাধিয়ে, স্রেফ দই, বেসন আর মশলা, কতরকম যে মশলার ভরসায় ওইরকম সিম্পল কিন্তু গর্জাস, মশলাদার কিন্তু হালকা, সুগন্ধী কিন্তু ভরপেট খাবারদাবার বানাতে স্কিল লাগে। আর চাটনি, ভাইসা। রসুনের আচার, মিরচি কে টিপোর, ওই দিয়ে আমি তিনবেলা ভাত খেতে পারি।

কিন্তু আমাদের কনট প্লেসের রাজস্থালী আমাদের রাজস্থানী থালি খাওয়ার অভ্যেস খারাপ করে দিয়েছে। থালি অ্যান্ড মোর-এর অর্ধেক বা অর্ধেকেরও কম দামে প্রায় দু’গুণ বেশি পদ। স্বাদ ক'গুণ সে আর বললাম না। তাছাড়া রাজস্থালীর মানুষজনের মধ্যে "আরেকটু খান না হলে শরীর থাকবে কী করে" ভঙ্গি আছে। মনে আছে, প্রথম দিন গোটা একখানা বাটি তুলে ডালে চুবিয়ে রসগোল্লার মতো কামড় দিতে কর্তৃপক্ষের একজন সংযমের বাঁধ ভেঙে ছুটে এসে অন্য বাটিটা হাত দিয়ে ভেঙে ডাল ঢেলে দিয়ে আবার দৌড়ে নিজের কাজে ফিরে গিয়েছিলেন।

খেয়ে সি স্কিমের কিউরিয়াস ক্যাফেতে গেলাম। আগের বার জয়পুর ঘোরার অনেকটা সময় এই ক্যাফেতে কেটেছে আমাদের। অর্চিষ্মান কাজ করল, আমি একটা ক্রাইম থ্রিলারের বাকি অর্ধেক শেষ করলাম। তারপর আর্য নিবাসে ফিরে এলাম।

অর্চিষ্মানের অলরেডি হাই উঠছে। চারটেয় ওঠা আমার অভ্যেস আছে কিন্তু ঘুমোতে ইচ্ছে করছে আমারও। হাত বাড়িয়ে সব আলোগুলো নিভিয়ে দেওয়া হল। আলমারির গায়ে লাগানো ঝকঝকে লম্বা আয়নার ওপর সরু যে হলুদ আলো জ্বলছিল, একমাত্র সেটা জ্বলতে লাগল। হাভেলির মোটা দেওয়াল ভেদ করে তাপ ঢুকতে পারছে না। তবু এসি চালালাম। বাড়ির এসির রিমোট খারাপ হয়ে গেছে দেড় বছর হল। আগেরবার সার্ভিসিং করাতে এসে আলিভাইসাব আমার ফোনে অ্যাপ সেট করে দিয়ে গেছেন। অসুবিধে একটাই, এসির ঠিক নিচে দাঁড়িয়ে হাত মাথার ওপর তুলে ফোন এসির একেবারে চরণতলে নিয়ে না গেলে এসি পিঁক করেন না। হোটেলের বিছানায় শুয়ে হোটেলের রিমোটে হাত ছোঁয়ালাম কি না বুঝতে না বুঝতে এসি চলতে শুরু করল। মনে হল সায়েন্স ফিকশনের দুনিয়ায় গিয়ে পড়েছি। আনন্দে টেম্পারেচার কমিয়ে কমিয়ে ষোলো করে ফেললাম। মনে পড়ল আলমারির ভেতরে একটা পরিপাটি ভাঁজ করা রজাই দেখেছি। বার করে আনলাম। অলরেডি নিথর অর্চিষ্মানের গোড়ালির সঙ্গে নিজের গোড়ালি ক্রিসক্রস করে রজাই চাপা দিয়ে চোখ বুজলাম।

নিভৃত, নিরালা ঘরটির মায়া আমাদের ঘিরে ক্লোরোফর্মের মতো ঘনিয়ে এল। খিদে পেলে খাওয়ার যা সুখ, ঘুম পেলে ঘুমেরও তাই। কতদিন ভালো করে ঘুম পায়নি। হাতের তালু থেকে পায়ের আঙুল, চোখের পাতা থেকে হাঁটু, কনুই থেকে কানের লতিতে মাধ্যাকর্ষণ। আমার সমস্ত কোষ রজাই আর এই নতুন কাচা সুতির চাদরে, মুসুরডালের বিনুনির ফাঁকে ফাঁকে গলে যাচ্ছে। প্রতিটি শ্বাস ক্রমে পূর্বের শ্বাসের থেকে দীর্ঘতর। এই সর্বগ্রাসী টান আমার শরীরে একটা অলমোস্ট ব্যথার জন্ম দিয়েছে যা অলমোস্ট আনন্দেরও। আমি আর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ব। অন্ততঃ কিছুক্ষণের জন্য সবকিছু ভুলে যাব -এই চাওয়াটা, এই জানাটা আমার মধ্যে তুরীয় আনন্দ আবার একই সঙ্গে তুরীয় ভয়ের জন্ম দিয়েছে, যদি এক্ষুনি কেউ আমাকে এই আসন্ন ঘুম থেকে ছিঁড়ে তুলে নিয়ে যায়?

গেল না। ভেতর থেকে কেউ আলতো গায়ে হাত রেখে ডেকে দিল। কী ঠাণ্ডা বাপরে। চোখ সরু করে রিমোট হাতড়াই। ফোন তুলে সময় দেখি।

এতক্ষণ? অর্চিষ্মানের চোখও খোলা। চশমা না পরে থাকলে আর ঘুম থেকে উঠলে ওর চোখটা এখনও ওর বালকবয়সের সাদাকালো ছবির চোখের মতো হয়ে যায়। বড় বড়, ঝকঝকে। অনেকক্ষণ উঠেছ? উঁহু, সবে। চা বলব? নিচে গিয়ে খাই চল।

এমন কিছু সন্ধে হয়নি কিন্তু দিনের আলো ফুরিয়ে এসেছে। মেঘ করেছে। পূর্বাভাস সত্যি হতে চলেছে তার মানে। দশ হাত অন্তর টুলে রাখা ল্যাম্পশেডের জাফরির ভেতর দিয়ে হলুদ আলো, করিডরের মেঝেতে গভীর ছায়ার কাটাকুটি খেলেছে। লিফটের সামনে পৌঁছে সিঁড়ি নেওয়ার প্রস্তাব দিতে গিয়ে দেখি অর্চিষ্মান নেই। কুড়ি হাত পেছনে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে দুই হাত বুকের কাছে জড়ো করে ঘাড় নিচু করে কী দেখছে। রেলিংটা অর্চিষ্মানের হাঁটু পর্যন্তও পৌঁছচ্ছে না। ফিরে এলাম।


নিচে অন্দরের চাতালের মিনি ফোয়ারা। ফোয়ারার জমা কালো জলে তন্বী লাল মাছেরা কিলবিল করছে। ঘুরছে। থামছে। মুখে মুখে ঠেকাচ্ছে। আবার ছড়িয়ে যাচ্ছে।

ভাবো, আমরা যে ওদের দেখছি ওরা টের পাচ্ছে না। টের পাবে না কোনওদিন।

এমন কি হতে পারে আমাদেরও কেউ দেখছে? আমরা টের পাচ্ছি না?

কেউ দেখছে না, কুন্তলা, কিচ্ছু দেখছে না। উই আর ফেটেড টু বি অ্যালোন। কমপ্লিটলি অ্যালোন। আমার দু'কাঁধে প্রকাণ্ড চাপড় মেরে বলে অর্চিষ্মান। ঠেলতে ঠেলতে সিঁড়ির দিকে নিয়ে যায়।

নিচে লোকজন জটলা করছে। আর্য নিবাসে রোজ বিকেলে অনুষ্ঠান হয় শুনেছিলাম। লনে স্মোকিং রুমের পাশে একটা নিচু প্ল্যাটফর্ম মতো। ওখানে গান হয়, পুতুল নাচ,বক্তৃতা। আজ বৃষ্টির সম্ভাবনা বলে লাউঞ্জে হবে। সকালবেলা ঢুকেছিলাম। তখন ঘরটা অন্ধকার ছিল আর প্রচুর চেয়ার, সোফা, জড়ো করা ছিল। এখন সে ঘর আলোময়, চেয়ার সোফা টানাটানি চলছে। আমরা বাইরের চেয়ারে বসলাম। ভাইসাব চা দিয়ে গেলেন।

বললাম, ফাংশান দেখবে? অর্চিষ্মান নন-কমিটাল ঘাড় ঝাঁকাল। গলির উল্টোদিকে আরেকটা প্রাসাদের মতো হোটেল। সে হোটেলের এমন সুন্দর লন নেই কিন্তু তার ছাদের কারুকার্যময় আউটলাইন আকাশে ইন্টারেস্টিং সিলুয়েট বানিয়েছে, যেটা ঘিরে একঝাঁক পাখি ঘুরছে। প্রাসাদের মাথায় বসছে, উড়ছে। হাসিহাসি নর্তকীর মূর্তির পেছন থেকে, একজন হলুদ সিল্কের পাঞ্জাবী, অন্যজন লাল সিল্কের পাঞ্জাবী পরা দুই যুবক বেরোচ্ছেন। এঁরাই নিশ্চয় আজ সন্ধের শিল্পী। অর্চিষ্মানের পেছন দিক থেকে আসছেন কাজেই ওকে চাপা গলায় খবরটা দিলাম। আমাদের পাশ দিয়ে পাস করার সময় একজন আরেকজনকে বললেন, এদিকেই আসতে বলল না রে?

কোনওমতে বাকি চা গিলে দৌড়ে লাউঞ্জে গিয়ে বসলাম। লাউঞ্জের সবক’টা চেয়ার ভরে বারান্দাতেও লোক বসে ছিলেন। দেখে মনে হল শুধু হোটেলের বাসিন্দারা নয়, বাইরে থেকেও লোকমুখে খবর পেয়ে শ্রোতারা এসেছেন।

অর্ণব ভট্টাচার্য সরোদ বাজালেন, নীলিমেশ চক্রবর্তী তবলা। তিনতালে ঝিঞ্ঝোটির পর ঝাঁপতালে যোগ রাগ। দেড় ঘণ্টা ব্যাপী অনুষ্ঠান শেষে লাউঞ্জ গমগম করছিল।

শিল্পী দুজনেই ঘর্মাক্ত হয়েছিলেন। লাউঞ্জে এসি না থাকার কারণে কর্তৃপক্ষ ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন। দর্শকশ্রোতারা ঘিরে ধরে অভিনন্দন, ভালোলাগা জানাচ্ছিলেন। আমরা আর ভিড় বাড়ালাম না। রাতে ডিনার খেতে গিয়ে ওঁদের দেখেছিলাম, স্নানটান সেরে খেতে নেমেছেন। তখনও চেপেচুপে রইলাম। পরদিন সকালে চায়ের জন্য নেমে যখন দেখলাম বারান্দার ও পাশ থেকে অর্ণব হেঁটে আসছেন, এ পাশ থেকে হেঁটে যেতে যেতে গলা তুলে কাল রাতের ভালো লাগার কথা জানালাম। অর্ণব হাসলেন।

কলকাতার নাকি?

কতকটা সেই রকমই।

একটা কাজ ছিল যেটা শেষ না করলে বাড়িতে থানা থেকে লোক পাঠাত, কাজেই রোববার ভোরে অ্যালার্ম দিয়ে উঠে কাজে বসলাম। পর্দাঢাকা জানালার ওপাশ থেকে ঝমঝম শব্দ আসছিল। শনিবার রাতেই বৃষ্টি নেমেছিল। অর্চিষ্মান উঠল। ব্রেকফাস্টের জন্য নিচে এলাম। মাঝে মাঝে গাড়ি এসে কম্পাউন্ডে ঢুকছিল। বাবা মা, ছেলে মেয়ে। আর্য নিবাসে অনেক স্থানীয় লোকই চাকফি খেতে, ব্রেকফাস্ট করতে আসেন, যা বোঝা গেল। সুন্দর জায়গায় বসে খেতে ভালো লাগে নিশ্চয়। আমাদের ব্রেকফাস্ট ইনক্লুডেড। মেদুবড়া, সম্বার, চিঁড়ের পোলাও, ডিম পাউরুটি, ফলফলাদি, দুধ, দই, ফলের রস। ওঁদের কফিটা চমৎকার।

আমি একটা ডবল এসপ্রেসো নিলাম। অর্চিষ্মান ক্যাপুচিনো। আশেপাশের টেবিলে লোক ভরে উঠছিল। ডানদিকে একজোড়া ছেলেমেয়ে বসেছিল। দেখতে প্রেমিকপ্রেমিকাই মনে হচ্ছে কিন্তু বুকিং-এর পর যে নিয়মাবলী এসে পৌঁছেছিল তাতে নাকি লেখা ছিল ম্যারেড কাপলস ওনলি। অর্চিষ্মান ব্যাকপ্যাক হাতড়ে বলেছিল আমার জেরক্সটা তো পাচ্ছি না গো। অরিজিন্যাল থাকিতে জেরক্সের কথা কেন? বলে আমাদের টিপছাপ দেওয়া, সই করা, মোটা প্লাস্টিকে মোড়া রেজিস্ট্রির ফর্ম বার করেছিলাম। প্রতিবার ফর্মটা বার করার পর যেমন হয়, দুজনের ছবি নিয়ে খানিকটা সময় কাটে। এরা কারা? আমরা এ রকম ছিলাম?

যদিও চেকইনের সময় কিছু দেখতে চায়নি। তাছাড়া এত গুচ্ছ গুচ্ছ বিদেশী কাপল ঘুরছে এদের সবার ম্যারেজ সার্টিফিকেট চেক করেছে নাকি?

অর্চিষ্মান বলল নিদানটা সতর্কতামূলক হতে পারে। আমার ধারণা একজন আগে এসেছে, তারপর আরেকজন একই ঘরে চেক ইন করতে যাচ্ছে- এই সব কেসে দেখতে চাইবে। কাজেই ছেলেমেয়েদুটোর প্রেমিকপ্রেমিকা হওয়ার চান্স আছে।

বাঁদিকে দুজন বসে আছেন যাঁদের হান্ড্রেড পারসেন্ট জিনের মিল আছে। দুই বোন হবেন। অল্প দূরে, সম্ভ্রমপূর্ণ দূরত্বে এক ভদ্রলোকও বসে খাচ্ছেন। বাকি দুজনের সঙ্গে জিনের মিল তো দূর, রাজ্যেরও মিল নেই। ড্রাইভার বা গাইড। ভদ্রমহিলা দুজন দারুণ গল্প করছিলেন। অভিজ্ঞতা নেই, হয়তো দুই বোন গল্প করলে এ রকমই করেন। গল্প ক্রমে হাসি, হাসি ক্রমে অট্টহাসিতে পর্যবসিত হল। লোক যখন হাসে, সত্যি সত্যি হাসে, সব ভুলে, সমস্ত লাগাম ছেড়ে হাসে, তার থেকে ছোঁয়াচে জিনিস কমই আছে। সঙ্গের ভদ্রলোক অনেকক্ষণ হাসি চাপার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে হাসিতে যোগ দিলেন। তারপর তিনজন মিলে গল্প শুরু হল।

আমরা কথা বলছিলাম ইন্ডিপেন্ডেন্স নিয়ে। জিনিসটা খায় না মাথায় দেয়। কী কী লক্ষণ থাকলে বোঝা যাবে একটা লোক ইন্ডিপেন্ডেন্ট। দুজনেরই কফি শেষ কিন্তু আলোচনা মাঝপথে। অনেক ছোটবেলায় আমার জেঠু একটা অসামান্য অবজারভেশন করেছিলেন। জেঠুর আমার মায়ের সঙ্গে খুব বনত। আমার ধারণা জেঠু নিজের বেস্ট পর্যবেক্ষণগুলো মায়ের উপস্থিতিতে প্রকট করতেন কারণ তাঁর মনে হত মা সেগুলোর কদর করতে পারবেন। জেঠু মাকে বলেছিলেন, অর্চনা, একটা জিনিস খেয়াল করেছ? যখন শনিরবিবার টিভিতে সিনেমা দেখতে দেখতে কারেন্ট যায়, সবাই কেমন বলে ওঠে, ইশ্‌শ্‌ ঠিক ভালো জায়গাটাতে গেল। আজ পর্যন্ত কাউকে বলতে শুনেছ, যাক অন্তত বোরিং জায়গাটাতে গেছে?

আমাদের কফিও ফুরোল আলোচনার ভালো জায়গাটাতেই। কাজেই আমি আরেক কাপ এসপ্রেসো নিয়ে এলাম। অর্চিষ্মানও আমার টুকে এসপ্রেসো নিয়ে এসে বসল। এঁদের কফি মেশিন দেখে অর্চিষ্মানের পুরোনো বাসনা চাগাড় দিয়ে উঠেছে। অনেক টাকা হলে একটা কফি মেশিন কিনব। বিন থেকে কফি; সব বাড়িতে বানাব। কেমন হবে? চুপ করে রইলাম। তখন নিজেই বলল অবশ্য বাড়িতে মেশিন থাকলে ক্যাফিন ওভারডোজে তোমাকে আমাকে দুজনকেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।

বৃষ্টি থামলে বেরোলাম। আগের বার সেই যে হাণ্ডি রেস্টোর‍্যান্টে গুলাবজামুনের কেসটা ঘটেছিল, সেটা আর্য নিবাস থেকে খুবই কাছে। গেলাম। ওই ছেলেমেয়েদুটোও দেখি এসেছে। আমাদের খিদে নেই বেশি। পানীয়ের সঙ্গে অর্চিষ্মান জংলি মাস নিল, আমি পনীর মাঞ্চুরিয়ান। বাদামের বদলে বাটিতে লম্বা লম্বা নোনতা মুড়ির মতো কী একটা দিয়েছে। পনীর মাঞ্চুরিয়ান যে রকম খেতে হওয়ার কথা তেমনই, জংলি মাস খেয়ে অর্চিষ্মান মুগ্ধ। এ তো লাল মাসের থেকেও ভালো। ঘোষণা করল এবার থেকে যতবার জয়পুরে যাবে ততবার জংলি মাস না খেয়ে শহর ছাড়বে না। আর্য নিবাসে থাকবে আর হাণ্ডিতে এসে জংলি মাস খাবে।

নিবাসে ফিরে এলাম। বিকেলে বেড়াতে যাওয়ার একটা আবছা প্ল্যান হচ্ছে কিন্তু আমাকে কাজ করতে হবে, অর্চিষ্মানের ঘুমের ইচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে বেড়াতে এসে আমি ল্যাপটপ খুলে বসে থাকলে অর্চিষ্মানের খারাপ লাগবে, অর্চিষ্মানের মনে হচ্ছে বেড়াতে এসে ও ঘুমোলে আমার ভাত হজম হবে না। তারপর দুজনে মিলে ক্লিয়ার করা হল যে সে রকম কিছুই হবে না, যার যা করা দরকার এবং যার যা করতে ইচ্ছে করছে, অন্যপক্ষকে বাড়াবাড়ি রকম কষ্ট না দিয়ে সেটা করাই আসলে ইন্ডিপেন্ডেন্স। আমি কাজ করলে ওর কষ্ট হবে না, ও ঘুমোলে আমার কষ্ট হবে না। এই গ্যারান্টি একে অপরকে দিয়ে আমরা যথাক্রমে ঘুমোতে ও কাজ করতে চলে গেলাম।

কাজ শেষ হল। এবার আমিও ঘুমোতে পারি। বৃষ্টি ততক্ষণে ঝেঁপে এসেছে। মেঘের গুড়গুড় কানে নিয়ে ল্যাপটপ মুড়ে রজাইয়ের তলায় ঢুকলাম। নিউরনের বনে কুয়াশা নেমে এল। মানসচক্ষে দেখলাম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে ফোয়ারার জমা জলে সাঁতার কাটছে লাল মাছের দল। ঘুরছে। থামছে। মুখে মুখে ঠেকিয়ে কথা বলছে আবার ছড়িয়ে যাচ্ছে। একটা লাল মাছ। দুটো লাল মাছ। তিনটে লাল মাছ . . .

ঘুম থেকে উঠতে বেলা শেষ। নিচে নেমে দেখি সব ভেজা। পাথর, ঘাস, বারান্দার কিনারা, বাজ পড়া গাছের কালো মৃতদেহ, জ্যান্ত গাছের সবুজ পাতা - সব। আজ পুতুলনাচের আয়োজন। নাচের পর স্থানীয় গান। আমরা আর সেদিকে গেলাম না। চা নিয়ে বসে বসে বৃষ্টি দেখলাম।


পরদিন ভোর সাড়ে চারটের সময় গাড়ি এল এয়ারপোর্টে যাওয়ার জন্য। কাল দুপুরে দেখাচ্ছিল আধঘণ্টার রাস্তা, ভোরবেলা নিশ্চয় পনেরো মিনিটের বেশি লাগবে না। পাঁচ মিনিট পর উইন্ডস্ক্রিনে জলের ফোঁটা শুরু হল। দেখতে দেখতে ঝমঝম। সারা শহর জলের নিচে। বললাম, এ তো একেবারে দিল্লিরই মতো, আধঘণ্টার বৃষ্টিতে ডুবে যায়। ভাইসাব বললেন কেয়া বতায়ে ম্যাডাম। খুব সহি সময়ে বেরিয়েছেন। আর আধঘণ্টা লেট করনে সে নাকি আর দেখতে হত না। শিওর প্লেন মিস।

মিস হল না। সিকিউরিটিমিকিউরিটি সেরে, দুজনে দু’গামলা কফি খেয়ে প্লেনে উঠে পড়লাম। অর্চিষ্মানকে জিজ্ঞাসা করলাম, যতখানি চিল হবে ভেবেছিলে হল?

তার থেকে বেশি। তোমার?

আমারও।


Comments

  1. বৈজয়ন্তীJuly 24, 2024 at 9:08 AM

    এই লেখাটা পড়ে এমন আরাম হলো না, কি আর বলব। জয়পুর কখনও গেলে, একটা আলাদা আরামের দিন তুলে রাখবো আর্য নিবাসের জন্য।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এই দুদিনের মতো আরাম আমিও খুব বেশি করিনি, বৈজয়ন্তী। জয়পুরে গেলে আর্য নিবাস ডেফিনিটলি মাথায় রাখতে পারেন। একটাই ডিসক্লেমার, ভেজিটারিয়ান খাওয়াদাওয়া। বাইরে বেরিয়ে ননভেজ খেয়ে আসার কষ্টটুকু করে নিলে বাকিটা পারফেক্ট।

      Delete
  2. Ki bhalo lekhata!! Mon bhore gelo... Apnader ghoraghuri sarthak.

    ReplyDelete
    Replies
    1. "ঘোরাঘুরি সার্থক" অংশটা পড়ে হাসলাম, সায়ন। বাকিটুকু এত খারাপ লাগে যে ঘুরেবেড়িয়ে আনন্দকণা খুঁটে খুঁটে তোলার চেষ্টায় থাকি। এই বেড়ানোটা সত্যি ভালো লেগেছিল। সে ভালোলাগাটা আপনাদের কাছে পৌঁছলেও আরও অগুন্তি আনন্দকণা জড়ো হয়।

      মন থেকে থ্যাংক ইউ।

      Delete
    2. 15 August er chhutite kothao jachchhen na?

      Delete
    3. আমাদের এখন দু'দিন আগে প্ল্যান করাটাই বিলাসিতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সায়ন। দেখা যাক। যদি কোথাও যাওয়া হয়ে যায়। বাড়িতে ঘুমোতেও পারি। এখনও কিছু জানি না।

      আপনারা কিছু প্ল্যান করলেন?

      Delete
  3. তোমাদের আরামটা বেশ টের পেলাম। যদিও আমার নার্ভ কোনো কারণে এত বেশী উত্তেজিত থাকে, বেড়াতে গিয়ে এরকম আরাম আমি করতে পারবো না। সমুদ্রের ধারের জায়গায় গেলে মনে হবে আরে একটু সমুদ্রের ধার ধরে হাঁটবো।না, পাহাড়ে গেলে মনে হবে পাহাড়ের শুঁড়িপথে না হাঁটলে ভয়ানক ক্ষতি হল।
    লেখাটা কিন্ত ভারী ভালো লেগেছে।

    -প্রদীপ্ত

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, প্রদীপ্ত।

      Delete
  4. বৈজয়ন্তীJuly 25, 2024 at 10:11 PM

    আগের কমেন্টে বলতে ভুলে গেছি, "কী কী লক্ষণ থাকলে বোঝা যাবে একটা লোক ইন্ডিপেন্ডেন্ট" --- এই আলোচনাটা সম্পর্কে জানতে ইচ্ছে করছে। মানে লক্ষণ গুলো কি কি? বড়সড় আলোচনা ছিল বোঝাই যাচ্ছে। সেরম হলে একটা নতুন পোস্টও হয়ে যেতে পারে ...

    ReplyDelete
    Replies
    1. আরে না না, সে রকম কিছু আলোচনা হয়নি, বৈজয়ন্তী। সব চেনা কথাবার্তাই। ওই ফিনানশিয়াল, ইমোশনাল এই সব স্বাধীনতা নিয়ে। একটা যেটা বোঝা গেল সেটা হচ্ছে অনেক সময় বাইরে থেকে দেখে কোনও বিষয়ের প্রতি ডিপেন্ডেন্ট মনে হলেও হতেই পারে আমরা অত কিছুও ডিপেন্ডেন্ট নই। সরিয়ে নিলে দিব্যি চালিয়ে দেব। সিগারেট ছাড়ার মতো। ইন্ডিপেন্ডেন্স আর ডিট্যাচমেন্টের সম্পর্ক নিয়েও কথা হচ্ছিল। একটা থাকলে অন্যটা থাকতে সুবিধে হয় বলেই মনে হল।

      Delete
  5. আর্য নিবাসের অবস্থানের একটা মজা আছে। সেই অর্থে ঠিকানা ছিল না আমাদের কাছে। বলা হয়েছিল অম্বর টাওয়ারের পিছনে। তো, ভিড় ভাট্টা গাড়ি, অটো, দোকান বাজার হৈ চৈএর মধ্যে দিয়ে সংসারচন্দ্র মার্গ থেকে যেই ঐ নামহীন রাস্তায় ঢুকলাম , মন খানিক দমে গিয়েই আধ মিনিটের মধ্যে যেন পুরীর সমুদ্র দেখছি প্রথমবার- অত বড় সবুজ লন, ঐ বারান্দা - সংসারচন্দ্রের থেকে দুমিনিটের পথ অথচ কত দূরে! এই তো হাওয়াবদল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এটা চমৎকার বললেন, ইন্দ্রাণী। সংসারচন্দ্রের দু'মিনিট দূরেই আর্য নিবাসেরা ঘাপটি মেরে বসে থাকে। হাওয়াবদল করতে যাওয়াই যায়।

      Delete
  6. কি যে আরাম হল কুন্তলা ,সত্যি কতদিন ভালো ভাবে ঘুম আসেনি . আমিও কিন্তু কাকিমার দলে ,যা ভুল করছি বা করছিনা শাস্তি তার থেকেও বেশি পেয়ে ফেলি . অনেক ভালোবাসা নিও |

    ReplyDelete
    Replies
    1. ক্লান্ত হয়ে ঘুমোতে যাওয়ার আরাম যে জানে সে জানে। আমিও সে রকম ঘুমোতে পারি না। সে জন্য মর্নিং ওয়াকের বদলে রাতে হাঁটা ধরেছি। যাতে অন্ততঃ সেটুকু ক্লান্তি আসে।

      মায়ের দলে থাকা আরেকটা জিনিসও ইন্ডিকেট করে, নিজের ভুল/দোষ/বোকামো বুঝতে পারা এবং স্বীকার করা। অন্য কারও কাছে না হলেও নিজের কাছে। সেটা রেয়ার।

      তুমিও আমার ভালোবাসা নিয়ো, সুমনা।

      Delete
  7. Sundor Travelodge! Aapnar blog er onek diner pathok, aapnar lekha lagto ekjayga te, kono email ID share korben ki where we can speak? Dhonyobaad, bhalo thakun aar bhalo likhun

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ। আপনি এই ঠিকানায় মেল করতে পারেন।

      abartorprolaap@gmail.com

      Delete
  8. Ki aram laglo pore! Mone hochche ekkhuni ekta rajai muri diye amio ghumiye pori. Porer bar Jaipur gele nishchoi ekhanei thakbo.

    ReplyDelete
    Replies
    1. ওই ঘুমটা আমারও আইকনিক হয়ে রয়ে গেছে, বিম্ববতী। জয়পুর গেলে আর্য নিবাসে থেকো আর হান্ডিতে গিয়ে জংলি মাস খেয়ো।

      Delete
  9. khub khub bhalo laglo. Jaypur gele amar o arya niwas e thakar icche thaklo. erokom aramer beRano bhalo lage khub.

    bhalo thakben

    Indrani

    ReplyDelete
    Replies
    1. আমার তো সর্বত্র আরাম করতেই ইচ্ছে করে, ইন্দ্রাণী। জয়পুর গেলে আর্য নিবাসে সত্যিই থাকতে পারেন। আপনিও খুব ভালো থাকবেন।

      Delete
  10. Amar favourite jaayega :-). Oder restaurant ta o khub bhalo. Aloor porota ta amader favourite. Ar oder thali r khabar khub khub bhalo ... ekdom ghoroa ranna with bangali chnowa ... ekjon bangali bhodromohila onek bochor dhore chalacchen. Next time nischoi kheo. Ar oder roof ta ekbar explore koro ... khub e shundor boshar jayega ache. Winter e darun lage.

    ReplyDelete
    Replies
    1. অ্যাঁ, আবার ছাদও আছে নাকি? এটা শিওর অর্চিষ্মানও জানে না। যাক, আবার যাওয়ার একটা শক্তপোক্ত কারণ পাওয়া গেল। থ্যাংক ইউ, শর্মিলা।

      ওঁদের রেস্টোর‍্যান্টের খাবার খেয়েছি, সত্যিই ভালো। বাঙালি ভদ্রমহিলার ব্যাপারটা জেনে খেলে আরও ভালো লাগত আমি শিওর।

      দেখাশোনা না হলেও, চেনা মানুষেরা আমার চেনা জায়গায় গেছেন শুনলে প্রায় একই সঙ্গে সে জায়গাটায় যাওয়ার ফিলিং হয় না?

      Delete

Post a Comment