পুজো ২০২৪


ষষ্ঠী

অর্চিষ্মানকে অন্ততঃ পুজোর সময় আমার সঙ্গে চিচিঙ্গার চচ্চড়ি খেতে বাধ্য করব না। নির্মলবাবুর চ্যালাচামুন্ডারা যতক্ষণে চিংড়ি ছাড়াবেন, সৌরভ থেকে নারকেলের দুধফুধ নিয়ে নেব। দুশো মিটার হবে না। কিন্তু হাঁটতে সময় লাগছে। প্রচুর নতুন দোকান। পুরোনোরা আরও এগিয়ে এসে জায়গা দখল করেছেন। খদ্দের, বিক্রেতা, ভিখিরি, পুলিশ।

শুধু মোটকা কুকুরটা এর মধ্যেও নিজের রিয়েল এস্টেট ছাড়েনি। বাজারে ঢোকার মুখটায় শুয়ে আছে। লোকের অসুবিধের কথা ছেড়েই দিলাম। ওর নিজের ভালো বুঝলেও সরে যাওয়া উচিত। যে কোনও মুহূর্তে ল্যাজে পাড়া দেবে কেউ, নয়তো আশপাশ থেকে গরম তেলের ছিটে লাগবে।

সৌরভ শেষ, বাঁদিকে বেঁকলে নির্মল, ডানদিকে অন্নপূর্ণা। শেলফ এক্সটেন্ড করে অন্নপূর্ণার ফাঁকা মেঝেটুকু ঢেকে দেওয়া হয়েছে। রসালো, টাটকা মিষ্টির উঁচু থাকে প্রতিটি খোপ ভর্তি। থাকের প্রথম সারি খালি হতে শুরু করেছে কিন্তু মিষ্টির গাড়ি বাঁক নিচ্ছে মার্কেটের পার্কিং-এ, অন্নপূর্ণার ব্র্যান্ড টিশার্ট পরা ছেলে দৌড়ে যাচ্ছে। যেখানে থাকার কথা শিঙাড়ার ঝুড়ি নেই। শেষ হয়ে গেছে অলরেডি? শুরুই হয়নি বৌদি। পুজোর ক’দিন শিঙাড়া থাকবে না।

ফুচকা খুঁজছি। আমার যিনি রেগুলার তাঁর থেকে বেটার একজন বাজারে এসেছেন। কর্পো ফুচকা। হলুদ টি শার্ট পরা ছেলের দল, হাতে গ্লাভস, মাথায় নেট। অর্চিষ্মান প্রথম যখন বলেছিল বিশ্বাস করিনি, পরে নিজে খেয়ে দেখেছি, সামান্য হলেও বেটার। বারদুয়েকই খেয়েছি। খুব লুকিয়েচুরিয়ে। দুই ফুচকার দোকানে দূরে হলেও একই সরলরেখায় কাজেই ঘাড় ঘোরালেই ধরা পড়ে যাব।

আজ ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পাওয়ার আশা নেই। রেগুলার ও সাইড ফুচকার মাঝখানে আরও চারটে ফুচকা, দুটো এগরোল, তিনটে মোমো। তারপর কাবলিদা মেশিনের স্পিডে মুড়ি বানাচ্ছেন। নতুন ফুচকাওয়ালা কাবলিদার মুড়ির পাশে বসেন। ফাঁকা। চোখ ঘুরল। পার্কিং-এর বাউন্ডারি ঘিরে টেবিল। আকাশে টাঙানো দড়ি থেকে নিয়মিত গ্যাপে চৌকো লেবেল - ফুচকা, আলুকাবলি, ঘুগনি। লেবেলের নিচে টেবিলের সামনে হলুদ জামা পরা ছেলের দল, হাতে গ্লাভস, মাথায় নেট, চিন আপ, চেস্ট আউট। বাঁশি বাজবে আর ছিলা ছিঁড়ে ছুটে যাবে। শুরু হয়ে যাবে ফুচকা, আলুকাবলি, এগরোলের অলিম্পিকস।

প্রতিযোগিতার উপক্রম দেখলেই আসন্ন হারের আতংকে বুক ধড়ফড় করে। ফুচকা ত্যাগ দিয়ে বাড়ি এলাম। প্রসেনজিৎ রান্না করে দিয়ে গেল। খেয়েদেয়ে বেরোলাম। পাড়া বলতে আজন্ম যা জেনেছি তার প-এর সঙ্গে সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও মেলা গ্রাউন্ডই আমাদের পাড়ার পুজো। এবারের ঠাকুর একচালা। ভালো হয়েছে, বল? সিংহ যে রকম স্পিরিটেড, মহিষাসুরের কপালে দুঃখ আছে। দুই হাত থাবার মতো বেঁকিয়ে মুখব্যাদান করে সিংহের ভঙ্গি নকল করে অর্চিষ্মানকে দেখাচ্ছি, অর্চিষ্মান বলছে, ওরে বাবা কুন্তলা বুঝেছি থামো, সবাই দেখছে। যেন ওখানে কারও নিজেকে ছাড়া অন্যকে দেখার ফুরসৎ আছে।


দুয়েকটা বাড়ির পুজো পড়ল রাস্তায়। নর্ম্যালের থেকে কম স্পিডে হাঁটছি, তার মধ্যে ভিড়ের একটা বড় অংশ আমার হাঁটুর উচ্চতায়, তাঁদের সামলে হাঁটতে স্পিড আরও কমে যাচ্ছে। একে অপরকে সেই সব বেঁটে ভিড়ের মেম্বারদের সাজ দেখাচ্ছি - দেখেই বোঝা যাচ্ছে পুজোয় যা যা নতুন হয়েছে সব একসঙ্গে পরে বেরোনো হয়েছে - জামা, জুতো, চুড়ি, হেয়ারব্যান্ড। হাতে বুড়ির চুল বা লিক ললিজ। যহেয়ারব্যান্ড থাকুক বা না থাকুক, প্রায় সবার মাথাতেই লাল আলো জ্বালা মহিষাসুরের শিং।

কালীবাড়ির প্রতিমা প্রতিবারের মতো একচালা, গোল মুখ, টানা চোখ। সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মানে মাদুর্গা আর ছেলেমেয়ে তো আমাদের দিকেই তাকিয়ে থাকবেন, সেটাই স্বাভাবিক, মহিষাসুর আর সিংহ পর্যন্ত ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছে। যেন ফটোগ্রাফার “সে চিজ” বলেছেন এক সেকেন্ড আগে।

কে ব্লকের কোঅপারেটিভ পুজোর লাইন বাসস্ট্যান্ড ছুঁয়েছে। ঢুকব না স্থির করে ফেলেছি, এমন সময় এদিকের পাঁচিলের গায়ে একটা গেট । ওপরে সাদা কাগজে টাইমস নিউ রোম্যানে ছিয়ানব্বই ফন্টে ‘পাস হোল্ডারস ওনলি’। গেটের দু'পাশে দু’জন পুলিস হাই তুলছেন।

দৌড়ে বাঁশের খাঁচায় ঢুকলাম। অর্চিষ্মান পেছন পেছন দৌড়চ্ছে আর বলছে, কী করছ কুন্তলা, দেখলে না কী সব পাসটাস . . . আরে দেখাই যাক না। “পড়তে পারেন না? নাকি চশমার পাওয়ার প্লাস এগারো?” ইত্যাদি অপমান করলে মাথা নিচু করে চোখের জল মুছে বেরিয়ে আসব।

মাথা উঁচু করে ঢুকে গেলাম। কোঅপারেটিভের মাঠ প্রত্যেক বছর জমজমাট। এদিকে লাইন করে খাবার দোকান, ওদিকে মাদুর্গার প্যান্ডেল, সেদিকে ফাংশানের তাঁবু। তাঁবুতে বিটের পল্লীগীতি চলছে। অর্চিষ্মান সোজা সেদিকে চলেছে। বললাম, যাঁকে নিমিত্ত করে এত কিছু তাঁকে অন্ততঃ নিয়মরক্ষা একবার দেখো, লজ্জিত মুখে দিক বদলালো। এঁদের ঠাকুরটা বিশেষ মনে নেই, তাড়াহুড়োয় দেখেছি, তবে পরাক্রমে সিংহ মেলা গ্রাউন্ড আর কালীবাড়ির মাঝামাঝি মনে আছে।

হাইটের আনডিউ অ্যাডভ্যান্টেজ খাটিয়ে অর্চিষ্মান প্যান্ডেলের পঞ্চাশ হাত দূর থেকে গায়ককে দেখে ফেলেছে। উত্তেজিত চোখমুখ। অর্ক নাকি গো!

শুনেই আমি স্পিড বাড়িয়ে, দেখি ভাই, সরি বোন বলতে বলতে এর ওর ফাঁক দিয়ে গলতে গলতে প্যান্ডেলে ঢুকে গেছি। সেই কালো গেঞ্জি, সেই দৈর্ঘ্যপ্রস্থ, সেই কোমরছোঁয়া কোঁকড়া চুল।

তবু, ইনি অর্ক নন। অসুবিধে নেই, কারণ অর্ক না হলেও ইনিও ফার্স্ট ক্লাস গাইয়ে এবং পারফর্মার। লাফিয়েঝাঁপিয়ে গাইছেন, তিনশো ষাট ডিগ্রিতে হেডব্যাংগিং করে করে ঝাঁকড়া চুল ঝাঁকড়াতর করে তুলছেন, কিন্তু বাঙালিকে চাগানো সহজ নয়। যদি না সোশ্যাল মিডিয়ায় ভার্চু সিগন্যালিং-এর সুযোগ থাকে।

এই পরিস্থিতিতে মহিলার প্রবেশ। গলায় পুজো কর্তৃপক্ষের পরিচয়পত্রের ল্যানইয়ার্ড, কাঁধে ব্যাকপ্যাক। চুলে ক্ল-ক্লিপ, গায়ে সালওয়ারকামিজ। সুদৃশ্য কিন্তু বাকি ভিড় যেমন উন্মাদের মতো ঝলসাচ্ছে তার তুলনায় মুখমোছা। মোদ্দা কথা, দেখে কারও সন্দেহই হয়নি ভদ্রমহিলা এরপর যেটা করলেন সেটা ওঁর পক্ষে করা সম্ভব।

ভদ্রমহিলা নাচতে শুরু করলেন। আলতো রবীন্দ্রনৃত্য না, উদবাহু ঠুমকা। একা একা। স্টেজের অব্যবহিত নিচের ফাঁকা জায়গাটায় যার দশ হাতের পর থেকে ভি আই পি এনক্লোজারের সাদা জামা পরা চেয়ারের সারি শুরু হয়েছে। যে সব চেয়ারে পরিশীলিত বাঙালি বুর্জোয়ারা রুচিমাখামাখি মুখে জাজমেন্টাল চোখ মেলে বসে আছেন।

ক’মাস আগে সি আর পার্কের মোড়ে মোড়ে বড় বড় ফ্লেক্স টেঙেছিল। সাদা ব্যাকগ্রাউন্ডে সারি সারি গোল। গোলের ভেতর সারি সারি পুরুষের মুখ। কালীবাড়ির ভোটের দুই যুযুধান পক্ষ। একদলের গড় বয়স অন্যদলের থেকে পঁচিশ বছর কম। বুড়োহাবড়ারা অচলায়তনের পাহারাদার, যা কিছু আলুভাজা প্রাণ দিয়ে আগলাবেন, অন্যদল উত্তুরে হাওয়ার রথে চেপে হারেরেরে ধেয়ে আসছেন, প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন ক্ষমতায় এলে ভি আই পি এনক্লোজারের ট্র্যাডিশন বাতিল করবেন।

চশমা চোখ থেকে আড়াই মিলিমিটার এগিয়ে ধরে ম্যানিফেস্টোর যে ক’টা পয়েন্ট পড়েছিলাম, তার মধ্যে এটাই লাস্ট ছিল। তারপরই সিগন্যাল সবুজ হয়ে গেল, আমাদের অটো একটা টোটোকে প্রায় উল্টে দিয়ে মোড় পেরিয়ে গেল। টোটোওয়ালা চেঁচিয়ে বর্ণময় নাম ধরে অটোওয়ালাকে ডাকলেন আর আমি অর্চিষ্মানকে বললাম, মনস্থির করে ফেলেছি। দিতে দিলে আমার ভোট নবীনরাই পাচ্ছেন। মেলা গ্রাউন্ডে অনুপম রায় শুনতে গিয়ে আমাকে তোমাকে চার ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল আর ভি আই পি-র ফাঁকা সারিতে কিছু লোক বসে বসে ঢুলছিল, মনে আছে? ইয়ার্কির একটা সীমা থাকা দরকার।

অর্চিষ্মান অনুপম রায়ই ভুলে গেছে, চার ঘণ্টা দাঁড়ানো তো ছেড়েই দিলাম।

কে ব্লকে ভি আই পি এনক্লোজার ছিল কি না মনে নেই, কিন্তু সমস্ত ফার্স্ট বেঞ্চারদের নিয়ম মেনেই প্রথম দিকের সারির দর্শকশ্রোতারা খুব স্থির হয়ে বসে ছিলেন। এই টাইপের পাবলিক জয়তী চক্রবর্তীর অনুষ্ঠানে পারফেক্ট, কিন্তু একটুখানি সাড়ার আশায় ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে যিনি মাথায় রক্ত তুলে ফেলছেন তাঁর জন্য আরেকটু রক্তগরম শ্রোতা চাই। যারা শিল্পীর সঙ্গে গাইবে, নাচবে, হুপহাপ শব্দ করবে। সব ভুলে গা ভাসাবে। ফার্স্ট বেঞ্চে সে ব্যবস্থা করা যায় না এমন কোনও কথা নেই, কিন্তু তার জন্য চেয়ারের সামনে ত্রিপল পাততে হয়। ত্রিপলের লোকজনও গা ভাসাতে জানে।

এই পরিস্থিতিতে ল্যানইয়ার্ড, ব্যাকপ্যাকশোভিত মহিলা নাচতে শুরু করলেন। রবীন্দ্রনৃত্য নয়, উদবাহু ঠুমকা। নাচলেন, নাচতেই থাকলেন এবং বুঝিয়ে দিলেন সহজে থামবেন না। লোকে সাহস বলতে এরোপ্লেন থেকে লাফানো বোঝে, আমি বুঝি এক মাঠ অচেনা লোকের সামনে নাচা। অর্ক লুকঅ্যালাইক (ওঁর নাম জেনে আসা উচিত ছিল কারণ ভদ্রলোক/ছেলেটি সত্যিই অসামান্য গাইছিলেন) গান থামিয়ে থ্যাংক ইউ বললেন। মহিলা সে সবে কান না দিয়ে নেচে চললেন, দুয়েকজন সুসজ্জিতা, লজ্জিত মৌমাছির মতো ঘুরে ঘুরে ফিরে যেতে লাগলেন, অবশেষে একজন লজ্জার মাথা খেয়ে নেমে পড়লেন তারপর দশ গুনতে না গুনতে প্যান্ডেলশুদ্ধু সাহসিনীরা হইহই করে ফাঁকা জায়গা ভরিয়ে ফেললেন।

ব্যাকপ্যাক মহিলা হাত ওপরে তুলে তালে তালে নাড়তে নাড়তেই সরে এলেন। তবে একেবারে মাঠ ছাড়েননি, যতক্ষণ গান চলল আশেপাশে ঘুরছিলেন, নাচে টেম্পো ঢিল পড়ছে দেখলেই এগিয়ে গিয়ে খানিকক্ষণ নেচে বাকিদের পুনরুজ্জীবিত করে আবার পেছনে চলে যাচ্ছিলেন। সর্বক্ষণ লাইমলাইট অধিকার করে থাকেননি।

একেই বলে লিডারশিপ। আমি আর অর্চিষ্মান একমত হলাম।

খেয়েই বেরিয়েছি বাড়ি থেকে কিন্তু অর্চিষ্মান কাবাবের গন্ধ পেয়েছে। এদিকে গালিব, আল আজিজ, কাঠি রোল সেন্টারের বিরাট বিরাট স্টল, ওদিকে বিজলী গ্রিল, রুপসা, আরও কী কী সব বাঙালি নামের দোকান। গালিবের প্রায় হাজার স্কোয়্যার ফিটের দোকান। তন্দুরে শোয়ানো সারি সারি শিকে কাবাব ঝলসাচ্ছে, মাইক্রোওয়েভে রুমালি রি-হিট হচ্ছে। অন্ততঃ পনেরো জন কর্মী কাজ করছেন। মালিকপক্ষের বলে যাঁদের বোধ হচ্ছে তাঁরা সকলেই প্রায় অর্চিষ্মানের সমান উঁচু, চওড়ায় দেড়া। জিম করা গুলি টিশার্ট ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে। মাঠ ভর্তি এজেন্ট মেনু নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, দোকানের সামনে এক ভদ্রলোক, দুই হাতে মেনু নাড়তে নাড়তে “আসো বসো খুব ভালো মিষ্টি দোই রোসোগোল্লা আমি তোমাকে বালোবাসি” গলা ফাটাচ্ছেন।

অর্চিষ্মান গালিবের এই প্রবল প্রতাপান্বিত দোকান থেকে যখনই খায়, মূলতঃ পুজোতেই - বিষাদবিধুর হাসি সহকারে বিস্ময় প্রকাশ করে। একদিন নাকি অমুকদা আর তমুক হোস্টেলে ফিরে বলেছিল নিজামুদ্দিনে একটা দারুণ কাবাবের হোল ইন দা ওয়াল আবিষ্কার করে এলাম। তার পরের শনিবার সবাই মিলে সেই দোকানে গেল, প্যাঁকাটি বেঞ্চে বসে কাবাব খেল আর খাওয়ামাত্র বুঝে গেল জীবনভরের একটা সম্পর্কের শুরু হচ্ছে।

সে টিমটিমে গালিবে আমিও গেছি। অর্চিষ্মানের সঙ্গে। অর্চিষ্মানের বন্ধুদের সঙ্গে। একসময় নিজে কাবাব খেয়েছি। তারপর থেকে অন্যরা খেয়েছে আমি থামস আপ নিয়ে বসে থেকেছি। সেই প্যাঁকাটি বেঞ্চে।

এখন সেই গালিব সি আর পার্কের দুর্গাপুজোতে হাজার স্কোয়্যার ফিটের দোকান দিয়ে ঘণ্টায় একশোটা করে কাবাব, কাঠি রোল, টিক্কা বিক্রি করছে। ভাবা যায়?

মা বিস্কুট ছাড়া চা খেতে পারতেন না, অর্চিষ্মান কোল্ড ড্রিংকস ছাড়া কাবাব খেতে পারে না। পাঁচশো মিটার দূরে পেপসির স্টল থেকে কুড়ি টাকার পেট বোতল কিনে আনলাম। সেই ব্যাকপ্যাক মহিলার লিডারশিপে প্যান্ডেলশুদ্ধু মহিলা নাচতে শুরু করার পর অর্ক লুকঅ্যালাইক বুদ্ধি খাটিয়ে প্লেলিস্ট গাইতে শুরু করেছিলেন। সোহাগ চাঁদবদনি ধনী, সুন্দরী কমলা নাচে ইত্যাদি। ফাংশানের তাঁবু থেকে গর্জন পুরীর সমুদ্রে জোয়ারের ঢেউয়ের মতো ফুলে ফুলে উঠছিল।

কাবাবের প্লেট নীল ডাস্টবিনে ফেলে পেপসির তলানিতে চুমুক দিতে দিতে এক্সিট গেটের দিকে হাঁটছে অর্চিষ্মান, এমন সময় অর্ক লুকঅ্যালাইক ধরলেন ‘তোমার ঘরে বাস করে ক’জনা মন জানো না’। যে রকম হুংকার ছিটকালো, অর্চিষ্মানের শার্ট টেনে ধরলাম। যদি কেউ গালিবের কাবাবের শিক আগুন থেকে তুলে আমার সারা গায়ে ছ্যাঁকা মারে, সব মার্কশিট ছিঁড়ে কুটিকুটি করে, মহিষাসুরের বুক থেকে ত্রিশূল টেনে বার করে স্ট্রিকনিনে চুবিয়ে আমার বুকে বেঁধায় তবুও আমি এখন বাড়ি যাব না।

ততক্ষণে নাচের ভাইরাস ফাংশানের তাঁবু ছাড়িয়ে মাঠে ছড়িয়েছে। অন্ততঃ দুটো নাচের জটলা তৈরি হয়েছে। সে সব এড়িয়ে তাঁবু পর্যন্ত পৌঁছইনি, গাইয়ে ধরলেন ‘পিরিতি কাঁঠালের আঠা লাগলে পরে ছাড়ে না’। মনে হল একটা শব্দব্রহ্মের বোমা সি আর পার্কের আকাশেবাতাসে ফাটল। সে বোমার রেশ কমলে, বাজনাটাজনা থামিয়ে গাইয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা একবার বুকে হাত দিয়ে বলুন তো এই পিরিতির আঠার কষ্ট কে কে টের পাননি?

চারটে, ওয়েল, ম্যাক্সিমাম পাঁচটা গলা। তিনটে প্রায় অশ্রুত। ওদিকের ভিড় থেকে একটা মেয়ের রিনরিনে স্পষ্ট গলা আর এদিকে আমার কানের পাশে পনেরোটা বাইশ টু পঁচিশ ভদ্র দেখতে বাচ্চা ছেলে আকাশপাতাল এক করে নাচছিল তাদের একজন চেঁচিয়ে স্বীকার করল, আমি পাইনি। করেই লজ্জা পেয়ে গেল।

একটা গলা পর্যন্ত ভর্তি প্যান্ডেলে মোটে পাঁচজন? একটা জাতের এত লোক প্রেম করে বেড়ালে সে জাতের উন্নতি হবে কী করে?

গান হল, তার থেকেও বেশি নাচ হল। অর্চিষ্মান দু'হাত দিয়ে আমার দু'কাঁধ তালে তালে ঝাঁকাতে লাগল। কানের কাছে মুখ নামিয়ে বলতে লাগল প্যান্ডেলের কোন কোণে কোন মেয়েটার আসলে নাচার ইচ্ছে কিন্তু অপদার্থ প্রেমিক তার সে ইচ্ছেতে সায় দিচ্ছে না। তারপর সাড়ে এগারোটা না এগারোটা চল্লিশে আলো কাঁপতে শুরু করল। কেউ বন্ধ করে দিচ্ছে নাকি? আলো স্টেডি হল। আবার কাঁপল। আবার স্টেডি হল। ধুত্তেরি বলে বেরিয়ে পড়লাম।

বাড়ির দিকে হাঁটছি। বাবার কাঁধে ঘুমন্ত শিশু, মায়ের হাতে প্লাস্টিকের নতুন বন্দুক। রাস্তার দু’পাশে ভিখিরির দল। প্রতিবন্ধীর জটলা। দুটো শিশু মাটিতে পাতা চাদরে শোওয়া, তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে বছর পনেরোর কিশোরী। দুজন দুঃখী দেখতে মানুষ, একজনের হাতে টিন, অন্যজনের উঁচু করা হাতে ‘ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসার্থে টাকা দিন’ অনুরোধসম্বলিত প্ল্যাকার্ড। একটা ছেলে, সাত বা আট, হাতে বেলুনের গোছা, পা খালি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ব্যথা করছে বলে বাঁশে হেলান দিয়ে আছে।

প্রসেনজিৎও বাড়ি ঢুকছে। তোমাদের প্যান্ডেলে দেখলাম না তো? আমরা কে-ব্লকে ছিলাম। তুমি? আমি এখানেই। হাত তুলে মেলা গ্রাউন্ডের প্যান্ডেল দেখাল প্রসেনজিৎ। আমাদের ওখানে খুব নাচ হল। আমার এখানেও।

কাল দেখা হবে। গুডনাইট।

টেক্কা বহুরূপী - কোনওটাই দিল্লিতে রিলিজ করেনি। রেগে কাঁই হয়ে আছি। যে যা বানায় সব তো দৌড়ে গিয়ে দেখি। আর কত পাশে দাঁড়ালে পুজোর একটু বাংলা সিনেমা দেখতে পাওয়ার বিলাসিতা কপালে জুটবে? ঘোল হিসেবে জি ফাইভে সুমন ঘোষের কাদম্বরী চালাল অর্চিষ্মান। কঙ্কনা কাদম্বরী, পরম্ব্রত রবীন্দ্রনাথ। ঘুম আসার বদলে চটে গেল। ম্যাগি বানিয়ে খেলাম। শুকনো শুকনো, ঝাল ঝাল।


সপ্তমী

গোটা দিন গেল পিপিটি বানাতে। একটা প্রেজেন্টেশন যেটা শুরুই করিনি, শেষ করে জমা দিতে হল। এই সপ্তমী একসময় গোটা পুজোয় আমার ফেভারিট ছিল। জীবনের কী হাল করেছি।


অষ্টমী

এখন ভোরগুলো ঠাণ্ডা। ছাতিম আর শিউলির গন্ধভরা। ঢাক বাজছে। মেলা গ্রাউণ্ডের প্যান্ডেলের রান্নাঘরের একটা আলোকিত ফালি দেখা যাচ্ছে। কোমরে গামছা বেঁধে দুই মহিলা তোড়জোড় করছেন। মাসখানেক ধরেই প্যান্ডেলট্যান্ডেলের চোটে মেলা গ্রাউন্ডে হাঁটা যায় না, আই ব্লকের অর্নামেন্টাল পার্কে হাঁটি।

হাঁটা শেষে চাবি ঘুরিয়ে ঘরে ঢুকে দেখি অর্চিষ্মান উঠে পড়েছে। শোনো, অর্ক মেসেজ করেছে। ফাঁকা থাকলে জি কে টু এম ব্লক মার্কেটে লাঞ্চে মিট করতে বলছে। কী বলব?

বলবে যে কুন্তলা বিশ্বাস করতে পারছে না যে এখনও এমন বন্ধুরা আছে যারা ওর কথা মনে রেখে পুজোর দিনে দেখা করতে চায়।

ওরা থালাইভারে দেখা করতে চাইছিল, যেটা সম্ভবতঃ টেম্পোরারিলি ক্লোজড। অর্চিষ্মানকে চেক করতে বলছি। অর্চিষ্মান কনফার্ম করছে। ইডলিনামা সাজেস্ট করছি। ইডলিনামার ক্লেম হচ্ছে এঁরা ইডলিদোসা ব্যাটার গ্রাইন্ডিং স্টোনের আবিষ্কর্তা। মেনুতে তথ্যটা পড় থমকে গেছিলাম। আমরা আবিষ্কারটাবিষ্কার সাধারণতঃ যে সব জিনিসের সঙ্গে অ্যাসোসিয়েট করি সে সব এই সব জিনিসপত্র নয়। শিলনোড়া কে আবিষ্কার করেছে? হামানদিস্তা কে আবিষ্কার করেছে? দরজার খিল, চটি, ঝাঁটা - কে আবিষ্কার করেছে? বা “কেউ” কি আবিষ্কার করেছে? এ সব কি অনেক মানুষের কালেক্টিভ জ্ঞান বা পরীক্ষানিরীক্ষার পরিণতি নয়?

এর থেকেও অদ্ভুত আবিষ্কারের দাবি আরেকজায়গার শুনেছি। জয়পুরের রাওয়াত মিষ্টান্ন ভান্ডার দাবি করছেন ওঁরা রাজস্থানের বিখ্যাত কচুরি আবিষ্কার করেছেন।

বাই দা ওয়ে, একটা গোটা রাজ্য যদি রসগোল্লা আবিষ্কারের ক্রেডিট নেয় সেটা ডেফিনিটলি যুক্তিযুক্ত এবং আমি মরতে দম তক সে দাবির পক্ষে গলা ফাটাব। তা বলে একটা স্পেসিফিক দোকানের রান্নাঘরে একটা জেনেরিক খাবার আবিষ্কার হয়েছে দাবি করলে তর্জনী মাথার পাশে ঘুরিয়ে সরে আসব।

ইডলিনামার গেটে অর্ক শম্পার সঙ্গে দেখা। বাকিরা অলরেডি ঢুকে গেছে। ওপরে উঠতে একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটল। আমাদের একজন দূরের আত্মীয়ের একজন দূরের আত্মীয় - যিনি সি আর পার্কে থাকেন না কিন্তু সি আর পার্কের প্রতি হুল্লোড়ে - পয়লা বৈশাখ, পুজো, পৌষমেলা, বইমেলা ইত্যাদিতে ওঁর সঙ্গে আমাদের দেখা হবেই। কলকাতা না হলেও সি আর পার্কের প্রচুর মাঠ, প্রচুর প্যান্ডেল, প্রচুর লোক। কাজেই ব্যাপারটা যতটা অবশ্যম্ভাবী মনে হচ্ছে ততটাও না।

এ বছর ষষ্ঠীর দিন সকালে উঠে ওঁর কথা মনে করেছি। অষ্টমীর দুপুরে ইডলিনামায় দেখা হয়ে গেল। কোণের টেবিলে সস্ত্রীক বসে আছেন।

অর্চিষ্মানকে পরে বলেছিলাম, এই প্রত্যেকবার দেখা হওয়াটা ইন্টারেস্টিং না?

অর্চিষ্মান বলেছিল, ইন্টারেস্টিংতর ব্যাপার আরেকটা আছে।

কী রকম?

প্রতিবারই ওঁদের দুজনের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়, প্রতিবারই হয় ভদ্রলোক এগিয়ে আসেন নয় আমরা এগিয়ে যাই, গিয়ে হাই হ্যালো করি। এবং প্রতিবারই ভদ্রমহিলার ভাবভঙ্গি থেকে স্পষ্ট হয় যে উনি আমাদের কমপ্লিটলি বিস্মৃত হয়েছেন।

ইডলিনামাতেও এক্স্যাক্টলি তাই হল। দেখা হল। ভদ্রলোক ভুরু তুলে হাসলেন, ভদ্রমহিলা ভদ্রতাপূর্ণ হেসে তাকিয়ে রইলাম। ভদ্রলোক এই নিয়ে পনেরোতম বার ভদ্রমহিলাকে আমাদের পরিচয় দিলেন, ভদ্রমহিলা যে রকম নাতিশীতোষ্ণ ঘাড় নাড়লেন, ষোলতম বার পরিচয় করাতে হবেই। কেউ আটকাতে পারবে না।

খাওয়াদাওয়া হল। মাটনের পুর ভরা ইডলি, পোডি ইডলি, মাশরুমের বড়া, বিরিয়ানি, মাটন সুক্কা, পরোটা দিয়ে কড়াইকুডি কারি - আমার জন্য নিরামিষ, বাকিদের জন্য চিকেন না মাটন ভুলে গেছি। বাটারমিল্ক আর কী একটা তেঁতুলগোলা পানীয়, ডেজার্টে ফিল্টার কফি তিরামিসু। খাওয়া শেষ কিন্তু গল্প সবে শুরু। পাশের ব্লু টোকাইতে গিয়ে বসলাম। তেরো মিনিট ধরে একশো তিরিশ ডেসিবেলে আলোচনার পর সিদ্ধান্তে আসা হল তিনটে এসপ্রেসো, তিনটে ফ্রেঞ্চ প্রেস, একটা হট ও একটা কোল্ড অ্যামেরিকানো - সবাই অর্চিষ্মানের দিকে তাকাল, যথারীতি এখনও মনস্থির করতে পারেনি। তারপর খবর পাওয়া গেল ফ্রেঞ্চ প্রেস হবে না, তার বদলে পোর ওভার।

সেদিনের যত ছবি উঠেছে সর্বত্র সবাই মিষ্টি হেসে, আমি হাত নেড়ে কাউকে কিছু একটা বোঝাচ্ছি। কফি শপ থেকে বেরিয়ে জি কে টু-র প্যান্ডেল। প্যান্ডেল থেকে উঠে সি আর পার্কের ঠাকুর দেখার প্ল্যান। ঠাকুরও দেখা যেতে পারে আবার কোনও একটা প্যান্ডেলে চেয়ার পেতে বসে গল্পও করা যেতে পারে।

এর পরেও যদি মুখ না খুলি যে বসে থাকার আরেকটা জায়গা আমার জানা আছে - যেটা প্যান্ডেলের মতো সুসজ্জিত না হলেও ডেফিনিটলি প্যান্ডেলের থেকে শান্তিপূর্ণ - তাহলে মরার পর সোজা নরক। সবাই রাজি হল আমাদের বাড়িতে যেতে। কিন্তু তার আগে আমরা কালীবাড়ির ঠাকুরটা দেখব, লাইন বুঝে মেলা গ্রাউন্ডের ঠাকুরও।

কালীবাড়িতে ঢুকতে গিয়ে অর্কর পকেট থাবড়ে সিগারেটের প্যাকেট ধরে ফেলে আর ঢুকতে দিচ্ছে না। শম্পা অপরাজিতা আগে আগে প্যান্ডেলের ভেতরে চলে গেছে, অর্চিষ্মান অর্ক ব্যাজার মুখে সিকিউরিটির গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে। আমি কোনদিকে যাব বুঝতে পারছি না। অশোকাঙ্কুররাই বা কোথায়। ফাইন্যালি একে একে সবাইকে দেখা গেল। অর্ক অর্চিষ্মানও হাসতে হাসতে আসছে। ওরা নাকি প্যাকেট ভালো করে লুকিয়ে তারপর অন্য গেট দিয়ে ঢুকেছে, এমন মুখ করে যেটা দেখে কেউ সন্দেহ করবে না যে এরা সিগারেট খেতে পারে। জ্যোতিষ্মানকে যেমন কোনও গেটেই করেনি।

বাড়িতে ঢুকে বসেছি, প্রসেনজিৎ, কৃষ্ণা একই সঙ্গে এসে হাজির। মেলা গ্রাউন্ডে স্পেশাল পুজো দিয়ে স্পেশাল প্রসাদ পেয়েছে ওরা, আমাদের জন্যও নিয়ে এসেছে। শুশুনিয়া পাহাড়ের সাইজের ফ্রায়েড রাইসের ঢিপি, গাজর বিন কড়াইশুঁটিতে কার্পণ্য করা হয়নি, বাটিভর্তি মটর পনীর, টমেটোর চাটনি। প্রসেনজিতের আজই শেষ ডিউটি, নবমী দশমী ছুটি। আজকেও রান্নার কিছু নেই, শুধু চা। ন’জন লোক, দশ কাপই করো। কীসে করবে? কীসেই বা দেবে? এত কাপ আছে আমাদের?

প্রসেনজিৎ বলল, তুমি বেরোও, আমি দেখছি। প্রসেনজিৎ আমাকে ওর সঙ্গে রান্নাঘরে থাকতে অ্যালাউ করে না। চা করে কাপটাপ জুটিয়ে যে ট্রে-টাতে বসিয়ে নিয়ে এল সেটা সম্ভবতঃ জীবনে প্রথমবার দেখছি। এটা কার? প্রসেনজিৎ কি নিজের বাড়ি থেকে নিয়ে এল নাকি? বিজয়ায় চাওয়ার লিস্টে একটা যোগ হল। নিজের বাড়ির বাসনকোসনের প্রতি মনোযোগ।

ডিনারে সবাই মিলে হিমালয়ান কিচেনে যাওয়া হল। আলু সদেকো, ঝোল চিকেন মোমো, পর্ক সেকুয়া, মাটন রোস্ট এবং সবার একবাক্যে ফেভারিট, কমপ্লিমেন্টারি আলু কো আচার। এই সব খেয়েই সবার এত পেট ভরে গেল যে মেন ডিশ অর্ডার করা হল না। ডিনার সেরে বেরিয়ে টাটার পালা। এত ভালো লাগে তবু যোগাযোগ রাখি না কেন কে জানে।

ভোগ ও ভক্তির উচ্ছিষ্টে কালীবাড়ির পেছনের ভ্যাট উপচে পড়ছে। আঁচলে নাক টিপে দ্রুত পেরিয়ে এলাম। আকাশের চাঁদটাকে মনে হচ্ছে কেউ সুতো দিয়ে হাফ করে কেটেছে।


নবমী-দশমী

আজ কোনও মজা শেডিউল করা নেই। কফি শপে যাব। শাড়ি পরেই বেরিয়েছি, মাদুর্গা যদি আচমকা মজা জোগাড় করে মাথায় ছুঁড়ে মারেন। মোড়ের দোকানে অর্চিষ্মান মিল্ক শেক খেল। পাশের মাঠে দক্ষিণায়নের পুজোতে - যেখানে কাল সবাই মিলে কফি শপ থেকে বেরিয়ে ঢুকেছিলাম, একগাদা ছবি তুলেছিলাম, যে সব ছবিতে সবাইকে খুশি দেখাচ্ছিল - ঢাক বাজছে। যাবে? নাকি সোজা কফি শপ?

শেকওয়ালা বললেন, চলে যাইয়ে, লাস্ট দিনই তো হ্যায়।

চারদিনের পুজোর থেকে চিটিংবাজি পৃথিবীতে কমই আছে। নিজেকে বুঝিয়েছি আজ নবমী, কিন্তু ঘড়ি ফাস্ট করে রাখলে যেমন আসল সময়টা বেশি করে মনে থাকে তেমনি বলছি নবমী, লিখছি নবমী, কিন্তু ঘুম থেকে উঠে ইস্তক বুঝতে পারছি ভোরটা দশমীর, রোদটা দশমীর, আকাশবাতাস, গাছের পাতা, কুকুরের ল্যাজ, মাদুর্গার চোখ - সব দশমীর।


আরতি হচ্ছে। ধোঁয়ায় প্রতিমা অস্পষ্ট, ধুনোর গন্ধে বাতাস ভারী। এই প্যান্ডেলে পাড়া ভাইব প্রবল। "অমুকদা, তমুকবৌদি, এদিকে আসুন" হেঁকেডেকে গ্রুপ ফোটো তুলছেন। আমরা পেছনের সারির দুটো চেয়ারে বসলাম। অর্চিষ্মান বলল, তোমরা কাল কী গল্প করলে গো?

এগারো জনের গ্রুপে গল্পের সাবগ্রুপ তৈরি হয়। কাল আমার আর ওর সাবগ্রুপ আলাদা ছিল। দুজনে দুজনের গ্রুপের গল্প জড়ো করলাম। খুব আলাদা নয়। দুজনেই ভয়ে ভয়ে ছিলাম, বন্ধুরা বুদ্ধিমান, আমরা যে সারাদিন হইচইতে একেনবাবু রিপিট ওয়াচ আর আনন্দবাজার অনলাইনে এর ক'টা বিয়ে ওর ক'টা পরকীয়া - শুনলে নির্ঘাত শিউরে উঠবেন। তারপর দুজনেই আবিষ্কার করেছি, আমরা সকলেই সেম জিনিস দেখি, সেম জিনিস শুনি এবং সে সব দেখেশুনে সেম লজ্জা পাই।

আরতি শেষ। অর্চিষ্মান ওঠার নাম করছে না। চারপাশে পাড়ার লোকেরা ঘুরছেন ফিরছেন। শিঙাড়া খাচ্ছেন। উঠে গিয়ে জল নিয়ে এলাম। একজন বয়স্ক মহিলা পরিবারের লোকজনে হাত ধরে ধীরে ধীরে মণ্ডপে ঢুকছেন, খুবই অশক্ত।

একদিন ইনিও প্যান্ডেলে দৌড়তেন, হ্যাঁ?

হুম্‌ম্‌। এদের মতো। পাশ দিয়ে দুটো বাচ্চা দৌড়ে গেল। সেই বয়সের বাচ্চা যখন খেলা মানে গলা সপ্তমে তুলে দৌড়নো। কে কার পেছনে বা সামনে দৌড়চ্ছে সেটাও জরুরি নয়।

জীবনচক্রের সত্যিটা দেখে ফেলে অর্চিষ্মান দুঃখ পেয়ে গেছে। চল কুন্তলা, উঠি। কফিশপে গেলাম। কফি খাওয়া হল, ছবি তোলা হল, কাজের ভঙ্গি করা হল। ঘণ্টাদুয়েক পর অর্চিষ্মান, সি পি আর-এর পর শ্বাস ফিরে পাওয়া মানুষের মতো লাফ দিয়ে উঠে বলল, রাহুল ঘাড় পেতেছে।


রাহুলের বেড়ালদের জন্য খেলনা ইঁদুর কিনে পেট শপ থেকে বেরোচ্ছি, ভদ্র ছেলেটি বলল, হ্যাপি দশেরা। আমিও বললাম। এও বললাম যে আমিও বলব বলব ভাবছিলাম (এটা অবশ্য মিথ্যে নয়, সত্যিই বলব ভাবছিলাম, কারণ দশমী কাল হলেও দশেরা আজই)। সাতপাঁচ ভেবে বলিনি।

উবার নয়ডা চলল। এক অবাঙালি দুর্গা টেম্পো চড়ে ভাসান চলেছেন। চোখ সরিয়ে নিলাম। আজ সারাদিন স্লো করে রাখা ঘড়ির সময়টাতেই বিশ্বাস করব। তাছাড়া কোন একটা পঞ্জিকামতে তো কালই দশমী। জ্যাম পার হয়ে ওখলা ব্রিজ। যমুনার ওপর দিয়ে ট্যাক্সি করে শাড়ি পরে অর্চিষ্মানের সঙ্গে বন্ধুর বাড়ি যাচ্ছি, বন্ধু ভালো ভালো রান্না করে খাওয়াবে। আজ বিকেলটা ডেফিনিটলি আনন্দকণা।

রাহুলের নতুন বাড়ি দেখে সেকেন্ড হ্যান্ড গর্বে ডগমগ হলাম। কত রান্না যে করেছে রাহুল। সবক’টা পদই আমি খেতে পারি, অর্চিষ্মানের জন্য এক্সট্রা খালি মেটেচচ্চড়ি। প্রত্যেকটা রান্না অপূর্ব। খাওয়ার আগে এবং পরে কাম্বোডিয়া থেকে রাহুলের আনা জিন খাওয়া হল। মেঝেতে দরি পেতে, সোফায় হেলান দিয়ে বসে রইলাম। বারান্দার বাইরে বিকেল, সন্ধে হয়ে গেল। চারপাশে বহুতল উঠছে, আকাশে বেলভেডিয়ার নামের একটা বিরাট ক্রেন স্তব্ধ হয়ে আছে। ক্রেনটা কি গত কয়েক ঘণ্টায় অল্প ঘুরে গেছে নাকি এতেই ভুল দেখছি? হলুদ আলো জ্বালিয়ে দিল রাহুল। রাহুলের বেড়ালরা ঘুরে ঘুরে দেখে যাচ্ছিল। সম্ভবতঃ বলাবলি করছিল, এরা এখনও যায়নি?


দশমী

কফি শপে দলে দলে সিঁদুরলেপা বাঙালিরা ঢুকছে। টানাটানি করে টেবিল জোড়া লাগিয়ে বসছে। হাহা করে হাসছে। গত পাঁচদিন রাস্তার এদিক ওদিক থেকে যত্রতত্র বাংলা ছিটকে ছিটকে এসেছে। সপাট বাংলা। দাপুটে বাংলা। গতজন্মের কোনও এক বিকেলবেলায় হস্টেলের গেট ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, আরও দু’তিনজন ছিলেন এমন সময় মহিলাকণ্ঠে চিৎকার। মহিলা একজনের নাম (উত্তর ভারতীয় নাম) ধরে ডেকে গলা ফাটিয়ে ফেলছিলেন।

বিশুদ্ধ চেঁচানি, আর্তনাদ নয়, কাজেই চিন্তা হয়নি। ‘কে রে ভাই’ গোছের ফিলিং হয়েছিল। কেউ বোধহয় প্রশ্নটা উচ্চারণ করেছিলেন। জটলায় একজন সাদা পাজামাপাঞ্জাবী পরে মালয়মন্দিরে কালীমাতাকে পুজো দিয়ে কপালে সিঁদুরের টিকা দিয়ে ফিরেছিলেন, মুচকি হেসে বলেছিলেন, হ্যাজ টু বি আ বেংগলি উওম্যান। বলেই আমার উপস্থিতি খেয়াল পড়েছিল, লজ্জা পেয়ে জিভ কেটেছিলেন। সরি, ইয়ার।

পুজোর পাঁচদিন সব বাঙালিই বেংগলি উওম্যান, চেঁচিয়ে ছাড়া কথা বলে না, অট্টহাসি ছাড়া হাসে না। কাল থেকেই আবার সব মিনমিনে, ম্যাদামারা হয়ে যাবে। হোয়াটসঅ্যাপ খুলে সবাইকে শুভ বিজয়া লিখছি। পরশুর দেখা হওয়ার পর যোগাযোগ বাড়ানোর নানারকম উপায় বার করার চেষ্টা হচ্ছে। অনলাইন বুকক্লাব খুললে কেমন হয়? যোগাযোগও থাকে আর আনন্দবাজার অনলাইনে এর ক'টা বিয়ে ওর ক'টা পরকীয়া করে বেড়াতে হয় না। অপরাজিতা আর আমার একটা চিঠি লেখালিখির ব্যাপার চলেছিল একসময়। কাগজের চিঠি। আবার শুরু করলে কেমন হয়? সকালে নিজের ঠিকানা পাঠিয়ে ওর ঠিকানাটা নিয়ে নিয়েছি। যাই, পাশের স্টেশনারি দোকান থেকে কাগজ, খাম আর নতুন পেন কিনে নিয়ে আসি।

অর্চিষ্মান কী একটা ফ্রেঞ্চ ক্যাফে খুঁজে বার করেছে, রাতে সেখানেই খাব। এখান থেকে ডিরেক্টলি যেতে পারি বা বাড়ি গিয়ে সেখান থেকেও। যখনই যাই, প্যান্ডেলে আর যাব না। এ বছরের মতো ঠাকুর দেখা শেষ আমার। সকালে হাঁটা থেকে ফেরার পথে একবার প্যান্ডেলে ঢুকেছিলাম। সাড়ে ছ’টা মতো হবে, প্যান্ডেলের ধার ঘেঁষে রাখা সোফায় কিছু লোক চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছিল। মাঠে মাটি খোঁড়ার একটা গাড়ি আর তিনটে ট্রাক বাঘের মতো দাঁড়িয়ে ছিল। পুরোহিত মশাই আর দু’জন মহিলা প্রতিমার পায়ের কাছে ঘোরাঘুরি করছিলেন।

এ শান্তি থাকবে না। একেবারে নিশ্চুপ হয়ে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো উৎসব জ্বলে উঠবে। বরণের লাইন, ঢাকের তাল, নাচের উল্লাস, সিঁদুরের প্রলেপ। সে মুহূর্তের আলাদা মহিমা। কান থেকে মহীন খুলে দাঁড়ালাম। কিছু কিছু দেখা ওয়ান টু ওয়ান হতে লাগে। ফেস টু ফেস। কিছু চাইতে আসিনি। পুরোটাই যদি মার্কেটিং গিমিক না হয় তাহলে তো বানান করে বলে দেওয়ার দরকার নেই কী চাই। এখন জাস্ট চুপ করে দাঁড়ানো। মুখটা এক বছরের মতো মনে করে রাখা। মাথার ভেতর আরও কয়েকটা মুখের ওয়ান ওয়ে মিছিল। একটা বড় দেরি করে ঘুম ভাঙা ভোর। আরেকটা বড় তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাওয়া বিকেল। কিছু কথা নিজেকে দেওয়া (যার মধ্যে একটা নিজের বাড়ির বাসনকোসন সংক্রান্ত)। পরের বছর দশমীর ভোরে ফাঁকা প্যান্ডেলে আবার যদি সামনে এসে দাঁড়ানোর সুযোগ হয়, মিলিয়ে নেব।

সব ভালো হবে। খারাপ হলেও অসুবিধে নেই। উঠে হাঁটু ঝেড়ে নেব।

আপনাদেরও সব ভালো হবে। শুভ বিজয়া।

Comments

  1. শুভ বিজয়া কুন্তলা। পুজোর লেখার জন্যও সত্যিই অপেক্ষা করে ছিলাম। খুবই ভালো লাগললেখাটা, টুকরো টুকরো ঘটনা জুড়ে জুড়ে পুজোর ছুটির গল্প।

    এই অংশটা পরে নিজের মনে মনে হাসলাম : "এমন সময় অর্ক লুকঅ্যালাইক ধরলেন ‘তোমার ঘরে বাস করে ক’জনা মন জানো না’। যে রকম হুংকার ছিটকালো, অর্চিষ্মানের শার্ট টেনে ধরলাম। যদি কেউ গালিবের কাবাবের শিক আগুন থেকে তুলে আমার সারা গায়ে ছ্যাঁকা মারে, সব মার্কশিট ছিঁড়ে কুটিকুটি করে, মহিষাসুরের বুক থেকে ত্রিশূল টেনে বার করে স্ট্রিকনিনে চুবিয়ে আমার বুকে বেঁধায় তবুও আমি এখন বাড়ি যাব না।"

    ভালো থাকবেন। এবার কি শারদীয়া আনন্দমেলা কেনেননি? পুজোর সিনেমা রিলিজ হলো একটাও, নয়ডায় আসে তো ?

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, সায়ন। আমি এত লেট করি সবেতে, নিজেরই খারাপ লাগে। কবে থেকে লিখতে শুরু করেছি, শেষই হয় না।

      অন্যান্য সময় চট করেই চলে আসে। নয়ডাতেই আসে মূলতঃ, কিন্তু এবার একটাও এল না। অন্ততঃ বুকমাইশো, যা আমরা সকালবিকেল রিফ্রেশ করেছি, দেখায়নি। গোপনে এসে চলে গেলে জানি না, তবে সে রকম হওয়ার কোনও কারণ নেই।

      আপনারা সবাই মিলে খুব ভালো থাকবেন। অনেক শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা রইল।

      Delete
  2. প্রদীপ্তOctober 17, 2024 at 5:34 PM

    শুভ বিজয়া কুন্তলাদি। খুব ভালো লাগলো পুজোর লেখা। বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারার থেকে ভালো সময় আর কাটানো আর কিই বা হতে পারে। তোমাদের পুজো চমৎকার কেটেছে পড়ে খুব ভালো।লাগলো।
    - প্রদীপ্ত

    ReplyDelete
  3. বৈজয়ন্তীOctober 17, 2024 at 9:39 PM

    কফি খেতে খেতে লেখাটা তারিয়ে তারিয়ে পড়লাম, খুব ভালোলাগার লেখা। কালই এক বন্ধুর সাথে পুজোর, পুজোর নস্টালজিয়ার, পুজোর বাঙালীর, ইত্যাদি গভীর বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছিলো। আপনার লেখায় আরো কিছু পয়েন্ট পেলাম।

    যাকগে, পুজো সুন্দর কেটেছে, বছরটাও ভালো কাটুক। শুভ বিজয়া।

    ReplyDelete

Post a Comment