একমাস না


প্রায় দু'মাস হতে চলল। কারণ আমার পরিশ্রম করে লেখা শেষ পোস্ট লখনৌ। নভেম্বরের এক তারিখে পাবলিশ হয়েছিল। সাতাশে নভেম্বরের পোস্টের যাবতীয় পরিশ্রম ফার্নান্দো পেসোয়া-র। আমার ক্রেডিট খালি টোকায়।

কেন দু'মাস ধরে কিছু লিখছি না তার যুক্তি যেমন আছে, আবার নেইও। আমি একটা দুঁদে স্কুলে পড়তাম। চেনা বৃত্তে সমীক্ষা চালিয়ে দেখেছি সব স্কুলেরই বড় ক্লাসের থেকে নিচু ক্লাসে দুঁদেগিরি বেশি হয়। দিদিমণিরা বেশি দুঁদে হন। নিয়মকানুন দুঁদেতর হয়। সে সব নিয়মকানুন মানার পুরস্কার এবং ভাঙার তিরস্কারও। 

নিয়ম ভাঙার শিরদাঁড়া আমার তখনও ছিল না কাজেই ডিরেক্ট তিরস্কার এড়াতে অসুবিধে হয়নি। তবে জিনিসটা কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছি। জায়গা পেলে সর্বদা ফার্স্ট বেঞ্চে বসতে শিখিয়েছিলেন মা। তখন মায়ের কথা শুনে চলতাম কাজেই ফার্স্ট বেঞ্চে বসতাম। আর ফার্স্ট বেঞ্চ ছিল দিদিভাইয়ের পুরস্কার ও তিরস্কার বিতরণী সভার ভি আই পি সিট।

মূলতঃ তিরস্কারই। আমাদের সংস্কৃতিতে পুরস্কারের প্রতি অনাস্থা পাভলোভিয়ান। আদর করলেই বাঁদর। স্কুলে বেত মারা ফের চালু করলেই বাঙালিরা ফের জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন । ভালো করলে, "আরও ভালো করতে হবে", আমাদের আদর্শ প্রতিক্রিয়া।

ফার্স্ট বেঞ্চের ভি আই পি সিটে বসে আমি আমার ছোটবেলার স্কুলের দুঁদে দিদিভাইদের তিরস্কারপ্রদান ও চরিত্রগঠনের ভি আই পি সাক্ষী হতাম। চরিত্রগঠনের পিলার ছিল সব খাতাবই মনে করে স্কুলে আনা। খাতা না আনাকে ক্লাস ওয়ান ফেলোনি হিসেবে গণ্য করা হত এবং দিদিভাইরা নিজস্ব এনার্জি অনুযায়ী শাস্তির ব্যবস্থা করতেন। কেউ কেউ সোজা হাত চালাতেন। অপেক্ষাকৃত নিড়বিড়েরা শান্তিপূর্ণ শাস্তির দিকে যেতেন। কেউ ক্লাসের ভেতর, কেউ ক্লাসের বাইরে দাঁড় করিয়ে দিতেন।

কিন্তু এঁদের সবার থেকে আলাদা, সম্পূর্ণ অন্য লিগের হতেন দু-একজন। অপরাধী নোটখাতা (যে খাতাটা কোনও বিষয়ের নয়। আজ আমি স্কুলে কী কী করলাম সেটা লিখে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে বাড়ির লোককে দিয়ে সই করিয়ে আনার) আনতে ভুলে গেছে আবিষ্কৃত হওয়ার পর তিনি প্রথম পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড নীরবতা পালন করতেন। এই পঁয়তাল্লিশ সেকেন্ড তাঁর শরীরের একটিও পেশি নড়ত না। নাকের পাটা ফুলত না। নিথর শীতল দৃষ্টি অপরাধীর ওপর নিবদ্ধ থাকত অপরাধীর ওপর, যার বয়স আট, শ্রেণি তৃতীয়, সেকশন-এ।

আমি আজীবন মেন্টেন করে এসেছি যারা কখনও নিজের ওপর কন্ট্রোল হারায় না তাদের থেকে ডেডলি আর কেউ নয়। যারা রাগ হলে চেঁচায়, দুঃখ পেলে কাঁদে, হাসি পেলে পেট চেপে গড়াগড়ি খায় - তাদের হ্যান্ডল করা যে কোনও দু'বছরের শিশুকে হ্যান্ডল করার সমান সোজা। যাঁদের বোঝাই যায় না তিনি রেগেছেন না দুঃখ পেয়েছেন নাকি খুশি হয়েছেন - তাঁদের নিয়ে মহা মুশকিল। বিশেষ করে আমার মতো লোকের পক্ষে, যাদের অস্তিত্বের অভিধানে কন্ট্রোল বলে কোনও ব্যাপার নেই। এ ধরণের লোকের সঙ্গে আমার জীবনে দু-একবার মোলাকাত হয়েছে এবং পরিণতি - ওয়েল, শুধু এটুকুই বলা যাক - ওয়াজ নট প্রিটি।

অবশেষে দিদিভাইয়ের ঠোঁট ফাঁক হল।

সকালে খেতে ভুলে গেছিস?

ছোট্ট মাথা - তেলমাখা কালো চুলে দুটো ঝুঁটি, ঝুঁটিতে লাল ফিতের ফুল - দু'দিকে নড়ল।

টিফিন পিরিয়ডে খেলতে ভুলে গেছিস?

ছোট্ট মুখ হাঁ করেছে, কিন্তু না-টা গলার ভেতর আটকে গেছে।

হুম্‌ম্‌।

যে মুহূর্তে আমি আমার দু'হাত কি-বোর্ডের ওপর কিউ ডাবলিউ ই আর টি ফর্মেশনে উদ্যত করি এবং টাইপ করার উপক্রম করি যে আমার ভীষণ কাজ তাই অবান্তর লেখার টাইম নেই, দিদিভাইয়ের নিশ্চল মুখমণ্ডল, নিথর চোখ এবং অতল সারকাজম মনে পড়ে যায়।

ক্যান্ডি ক্রাশ খেলতে সময় পেয়েছি?

বাঙালি সেলিব্রিটিদের একশোবার শোনা পডকাস্ট একশো একবার শোনার?

জীবনটা একেবারে নষ্ট হয়ে গেল মাথার ভেতর লুপে চালিয়ে অন্ধকার ঘরে শুয়ে চোখের জল ফেলার?

খালি অবান্তরে অর্থপূর্ণ উপস্থিত বলার আর কমেন্টের উত্তর দেওয়ার সহবতের সময়ে টান পড়েছে।

হুম্‌ম্‌।

সেদিনই অর্চিষ্মানের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। মানুষের মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা ঐশ্বরিক। যখন বলেরা আকাশে এবং আমার চোখ বলে - মনে হয় এটাই আদর্শ অবস্থা। আবার গেণ্ডুকেরা যখন ভূপতিত এবং ছত্রাকার, পরাজিত আমি ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে ভাবি এই ভালো। আকাশে তুলে ছোঁড়াছুড়ি করেই বা কী তিস মার খাঁ হয়ে যাব? আমি তো মোটে দুটো বলের জাগলারি দেখাচ্ছিলাম, তাও হাস্যকর রকম স্লো মোশনে। ওই তো ও আটটা বলের খেলা দেখাচ্ছে, আর ও ষোলটার। আর অমুকের হাত তো এত স্পিডে চলছে যে বল গোনাও আমার ক্ষমতার বাইরে।

কাজেই থাক বল মাটিতে। থাক অবান্তর ফাঁকা।

বড়দিন এসে যায়। ক'দিন ধরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। একে ডিসেম্বর তায় মেঘ। রাতের থেকেও অন্ধকার সকাল। বাড়িময় লাগেজ আনপ্যাক করতে হবে। অবান্তরে পোস্ট লিখতে হবে। কত লোককে ফোন করতে হবে। চুয়াল্লিশ হয়ে গেল, জীবনটাও তো বাঁচতে হবে।

অন্ধকার ঘরে একা একা ঘুরি। অর্চিষ্মান দুটো লেপের তলায় স্থির। ঘড়ির কাঁটা ভদ্রস্থ নম্বর ছুঁলে জিজ্ঞাসা করি, আমরা বেরোব না?

বেরোব তো। বলেই আবার ছ'ইঞ্চি ঘুমের নিচে।

নাহ্‌, কেউ ভালোবাসে না আমাকে। আর কেউ ভালো না বাসলে বাড়ি গুছোনো যায় না, অবান্তর লেখা যায় না, কমেন্টের উত্তর দেওয়া যায় না, বাঁচা তো দূর অস্ত। কেউ ভালো না বাসলে একমাত্র যেটা করা যায় সেটা হচ্ছে ক্যান্ডি ক্রাশ খেলা।

তাই খেলছি এমন সময়, মেরি ক্রিসমাস। লেপের ফাঁকে হাসিহাসি মুখ, চকচকে চোখ।

বেরোব না আমরা?

মাথার ভেতরের কুয়াশা কেটে রোদ্দুর। সেরোটোনিনের ড্রিপ। টপ টপ টপ। 

চা খাবে? 

যদি দাও।

দৌড়ে গিয়ে কেটলি অন করি। এক কাপ চা খেলেই তো মন ভালো হত। না খেয়ে বসে আছি কেন কে জানে।

রিমোটটা কোথায়? রিমোটের কথাও এতক্ষণে মনে পড়ল, স্ট্রেঞ্জ।

প্রসেনজিৎ বেল বাজাচ্ছে। ক্রিসমাস ইভে পার্টিতে গেছিল বলে কাল আসেনি। আজও বিকেলে পার্টি তাই সকালে কাজ সারতে এসেছে। অর্চিষ্মান জেলাসিতে নীল। এত পার্টি পাচ্ছে কোথায়! প্রসেনজিৎ রুটি বেলতে বেলতে পাড়ার খবর দিচ্ছে। আমরা যখন ছিলাম না মেলা গ্রাউন্ডে কালচারাল অনুষ্ঠান হয়েছিল - ইমন চক্রবর্তী গাইতে এসেছিলেন। নামজাদা শাস্ত্রীয় বাঁশুরিয়া, ধ্রুপদী সরোদিয়ারাও ছিলেন।

ইমনকে তো গাইতেই দিল না।

কেন, অনেক রাত হয়ে গেছিল বুঝি?

কীসের রাত? সাড়ে দশটা মোটে। তাতেই নাকি বাবুদের শব্দদূষণ হয়ে যাচ্ছে। তারপর যা ক্যাঁচাল লাগল।

লেপটেপ ফুঁড়ে অর্চিষ্মান সোজা হয়ে বসেছে বিছানায়। কী হয়েছে, শুনি শুনি।

প্রসেনজিৎ রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে শোওয়ার ঘরের দরজার ফ্রেমে হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। আটাময় মুঠো শরীর থেকে নিরাপদ দূরত্বে হাওয়ায় ভাসিয়ে রাখে। এই যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হল - ক, খ আর গ-এর কোলাবরেশনে - প্রতিবছরই হয়, কিন্তু অন্য মাঠে। এ বছর সে মাঠে কী যেন ঝামেলা হয়েছে তাই ওরা মেলা গ্রাউন্ডে এসেছে।

তাতে অনুস্বর, বিসর্গ, চন্দ্রবিন্দুর রাগ হয়ে গেছে। বুঝেছি। অর্চিষ্মানের চোখমুখ অবিকল সরখাওয়া বেড়াল।

রাগ বলে রাগ? দশটা থেকে তাড়া মারতে শুরু করেছে, সাড়ে দশটায় তুলে দিয়ে তবে শান্তি। আওয়াজে নাকি ওদের কানের পর্দা ফেটে যাচ্ছে।

অনুস্বর, বিসর্গ, চন্দ্রবিন্দুর পৌষমেলাও তো শুরু হল বলে।

হল তো। তখন ওরা দৌড়ে আসবে ফাংশান বন্ধ করতে। দেখো না কী হয়। আসন্ন হুলাবিলার প্রত্যাশায় ডগমগ প্রসেনজিৎ রান্নাঘরে ফেরত যায়।

আমি আর অর্চিষ্মান চোখাচোখি করি। আগেরটা মিস হয়ে গেছে, এটার এক মিনিটও মিস করা চলবে না। যত ঠাণ্ডাই লাগুক, যত হাই-ই উঠুক, লোকে যত বেসুরোই গাক, রাত দশটা থেকে মেলা গ্রাউন্ডের মাটি কামড়ে পড়ে থাকতে হবে।

অর্চিষ্মান গালে টুথব্রাশ গুঁজে ঘোরাঘুরি করে। আমি জিনসে ডান পা গলাই। অর্চিষ্মান বাথরুমে ঢুকে ছিটকিনি দেয়। আমি ভাবতে থাকি।

অর্চিষ্মান যতক্ষণ ভেতরে, কাবার্ডের একেবারে পেছনদিকে হাত কালেকশনের লালতম কামিজটা বার করে আনি। গলা থেকে ঝুল পর্যন্ত শুধু একটা সোনালি জরির বিভাজিকা বাদ দিলে নিরবচ্ছিন্ন, নিরলস, নির্মম, আলোপেছলানো লাল। । জিনস থেকে পা মুক্ত করে কামিজের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া চকমকে সোনালি রঙের চুড়িদারে গলাই।

অর্চিষ্মান বাথরুম থেকে বেরোয়। বলে, ওহ্‌।

ঘরে স্ত্রী রেখে বাথরুমে গেছিল, বেরিয়ে দেখছে স্ত্রী-এর জায়গায় ক্রিসমাস ট্রি।

অর্চিষ্মান আর একবার বলে, ওহ্‌,তারপর শ্যাওলা সবুজ পাঞ্জাবীটা, যেটায় আলো পড়লে চকচক না করলেও চিকচিক তো করেই, বার করে পরে নেয়।

লাইফটাইফ অনেক বড় ব্যাপার, বারংবার যেটা প্রমাণ পেয়েছি, মাই অ্যাকশন ইজ মাই মেসেজ। পাঞ্জাবীগুলো পড়ে পড়ে বোর হচ্ছে, ছুটিছাটায় একটা পরতে পার ইচ্ছে করে - এ সবে কোনও কাজ হয় না। নিজে শাড়ি পরে রেডি হলে তার থেকে বেশি কাজে দেয়।

দিল্লির ধূসর পঁচিশে ডিসেম্বরে আমরা লালসবুজ হয়ে বেরিয়ে পড়েছি। কফি শপে এসে যে যার ল্যাপটপ খুলে বসেছি। বলগুলো কুড়িয়ে কুড়িয়ে তুলছি। বলের সংখ্যা, হাতের স্পিড - হু কেয়ারস? অচেনা কথাও কিছুই নেই বলার, কিন্তু চেনা কথা জমেছে অনেক। শুধু মাথাতে না, গুগল ডকসেও। কোনওটা দু'হাজার, কোনওটা চার হাজার শব্দ হয়ে পড়ে আছে। তাদের থেকে যে পাঁচশো শব্দ কাটলে আর যে সাতান্নটা শব্দ জুড়লে গোটাটা একটা আগামাথাওয়ালা চেহারা পায় সেটাই করে ওঠা হচ্ছে না। হোপফুলি, শিগগিরই হবে।

স্যান্টাবেবি আপনাদের মনস্কামের মোজা কানায় কানায় পূর্ণ করুক, এই কামনা করি।

Comments

  1. এই তো - তিনদিন বা তারও কমের মধ্যেই কি সুন্দর একটা লেখা দিয়ে দিলেন!

    "ঘরে স্ত্রী রেখে বাথরুমে গেছিল, বেরিয়ে দেখছে স্ত্রী-এর জায়গায় ক্রিসমাস ট্রি।" - দারুন!

    আজকাল আমার জন্যে "সেই সব হারিয়ে যাওয়া সোনালী দিন"এর মধ্যে ওই সময়টাও পরে, যখন অফিসের কাজ ডেস্কটপে হতো, ল্যাপটপ দেবার চল ছিল না। অফিস থেকে বেরোনো মানে সত্যিই কাজ শেষ, কোনোভাবেই অফিসের কাজ আর করা যাবে না। যখন প্রথম অফিসের ল্যাপটপ পাই, তখন প্রায় এক বছর মতো সেটা অফিসের লকারেই রেখে যেতাম, বাড়ি নিয়ে যেতাম না। তারপর অবশ্য এই অভ্যেস আর টিকিয়ে রাখতে পারিনি।

    আপনাদের জন্যেও বড়দিনের শুভেচ্ছা রইলো।

    ReplyDelete
    Replies
    1. থ্যাংক ইউ, রাজর্ষি। আমার আজকাল মনে হয়, কাজ আছে বলে হয়তো বেঁচেই গেছি। কাজ না থাকলে আরও কথা বলতে হত, আরও ইন্টারঅ্যাকশন। সেগুলো জোগাড় হত কোথা থেকে, কী করে যীশুই জানেন।

      Delete

Post a Comment