তালমার রোমিও জুলিয়েট , অল উই ইম্যাজিন অ্যাজ লাইট
*স্পয়লার আছে। স্পয়লার ছাড়া কিছু নেই।*
পুজো পার করে দিল্লির হলে টেক্কা এসেছিল, বহুরূপীও। হোয়াটসঅ্যাপে মেসেজও এসেছিল। কাটছি কিন্তু। হুমকি বললে হুমকি, মত নেওয়া বললে মত নেওয়া। টিকিট কাটা হল, দুটো সিনেমাই দেখা হল।
সে সব নিয়ে কিছু না বলাই ভালো। তার থেকে তালমার রোমিও জুলিয়েট নিয়ে বলা বেটার। বাংলার গ্রামীণ সেট আপে রোমিও জুলিয়েটের পুনর্কল্পনা ও নির্মাণ। আমার ভালো লেগেছে। আমি মন্দার দেখিনি। অর্চিষ্মান মন্দার দেখেছে। অর্চিষ্মান বলেছে তালমার মন্দারের থেকে বেটার।
আর কিছু বুঝি না তাই গল্প নিয়েই বলতে হবে। গল্প আর অভিনয়টভিনয়। অভিনয়ও বুঝি না। জীবনে করিনি। অর্চিষ্মানকে জিজ্ঞাসা করতে গেলাম ও অভিনয় বোঝে কি না। ইফ ইয়েস, ভালো অভিনয় বলতে ও কী বোঝে।
আজকাল আমাদের টাইমপাসের একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে অভিধান তৈরি করা। বা দুজনের অভিধান মিলিয়ে নেওয়া। ছোটবেলায় ধারণা ছিল যে ভাষা ধ্রুব। টাকার মতো। কাবলিদার তিরিশ টাকা যা আমার তিরিশ টাকা এক্স্যাক্টলি তা না হলে বিকেলের ঝালমুড়ির সিসটেম ধসে যাবে। তেমনি 'না মানে না', 'হ্যাঁ মানে হ্যাঁ' না হলে মানবসভ্যতা দাঁড়াবে না।
কিন্তু ঝালমুড়ি এক বেলার, সংসার চব্বিশঘণ্টার। সংসারের মধ্যে কয়েকটা দিন সপ্তাহ মাস বছর বাস করলেই বোঝা যায় হ্যাঁ না-এর স্কোপ প্রায় নেই। হতেও পারে, দেখা যাক, কে ঝানে-র অংশগুলোই প্রকাণ্ড। গোটাটা দাঁড়িয়ে ভালো মন্দের, উচিত অনুচিতের, মূল্যের আর বোধের ওপর। আর এগুলো আমগাছের বৈজ্ঞানিক নাম নয় যে আড়াইশো বছর আগেও যা ছিল আড়াইশো বছর পরেও তা থাকবে। আড়াই বছরে সব ভোল পালটে ফেলে।
ছোটবেলায় এগুলো অত বোঝা যায় না। বা বয়সের ঘাড়ে বন্দুক রাখা উচিত হবে না, পুরোটাই বুদ্ধির খেলা। যেটাই হোক, ছোট বোকারা বা বোকা ছোটরা এগুলো ভীষণ ক্লিয়ার কাট মনে করে মাঠে নামে, তারপর টের পায় যে ক্লিয়ারের ক-ও নেই পুরোটাই ধোঁয়াশা। তাছাড়া সংসারের সদস্যরাও তো চলমান। গত পনেরো বছরে আমি আর অর্চিষ্মান দুটো অন্য লোক হয়ে গেছি, আমাদের বিশ্বাস, বাউন্ডারি সবই বদলেছে। রেগুলার মিলিয়ে নিতে হয় - গরম চা কতটা গরম, শুকনো বাথরুম কতটা শুকনো, ম্যাগিতে কতটা জল। বার্ষিক স্বাস্থ্যপরীক্ষার মতো নিয়মিত চোখে চোখে রাখতে হয় - দাম্পত্য কী? ভালোবাসা কারে কয়? আমি কী জানি, তুমি কী মানো। বা গত সপ্তাহে যা মানতে এ সপ্তাহেও সেটাই মেনে চলছ কি না। নাকি অন্য কিছু উঁকিঝুঁকি মারছে?
তালমারে অনির্বাণ ভট্টাচার্যকে দেখে যখন দুজনেই বললাম, নাহ, ছেলেটা ভালো অভিনয় করে, রিফ্লেক্সে বেরিয়ে গেল, ভালো অভিনয় কাকে বলে তোমার মতে?
অর্চিষ্মান বলল, একই অভিনেতা ভালো লোকের পার্ট করলে যদি ওয়ার্ম ফাজি ফিলিং ঘটে আর বদ লোকের পার্ট করলে টিভির দিকে রিমোট ছুঁড়তে ইচ্ছে করে তাহলে সেটা ভালো অভিনয়।
তুমি যেটা বললে সেটাকে অভিনয় বলে। স্রেফ অভিনয়। ভালো অভিনয় নয়।
পরদিন লাঞ্চে হোয়াটসঅ্যাপ জ্বলল। শোনো, যিনি খারাপ সিনেমাতেও (সিরিজ, নাটক, যাত্রাপালা - হোয়াটেভার) ভালো অভিনয় করেন তিনিই ভালো অভিনেতা।
তালমার বাজে সিরিজ নয় (অন্ততঃ আমার লাগেনি), কাজেই সেখানে অনির্বাণ ভালো অভিনয় করলে ওঁকে ভালো অভিনেতা বলা যাবে না। সাতটা বিশ্রী বাংলা সিনেমা মনে পড়ল। বাকিরা আশানুরূপ ভয়াবহ কিন্তু অনির্বাণ তার মধ্যেও দৌড়েছেন। কাজেই ওঁকে ভালো অভিনেতা বলা যাবে।
শুধু অনির্বাণের কথা বলা উচিত হবে না। মোস্তাকের নেমেসিস সোমনাথের চরিত্রে অনুজয়, কী ভালো। অনেক অভিনেতা তাঁদের নাম জানি না, কিন্তু হইচই-এর ব্যোমকেশ সিজন এইট-এর 'ব্যোমকেশ ও পিঁজরাপোল'এ - যা সিনেমাসিরিজ মিলিয়ে ইদানীং কালের বেস্ট ব্যোমকেশ আমার মতে - ভালো লেগেছিল, এখানেও লেগেছে। সবার নাম জানি না বলাও উচিত নয়। সোমনাথের ছোটবেলার বন্ধুর চরিত্রে দুর্বার শর্মা, সিদ্দিকির চরিত্রে বুদ্ধদেব দাসকে চিনতে পেরেছি।
কিছু না বুঝলেও নিষ্ঠা জিনিসটা বোঝা যায়। কে ধারে কাটছে, কে ভারে। তালমারের পেছনের যত্ন স্পষ্ট।
তালমারের সংলাপ আনরিয়েলিস্টিক্যালি রিয়েলিস্টিক। মানে শুনে মনে হচ্ছে চরিত্ররা যে যার নিজের ভাষায়, স্বরে কথা বলছে - বা চরিত্রদের দেখে যে ধরণের মানুষ বলে আমি মনে করছি বললে এভাবেই কথা বলবে। কিন্তু আবার রিয়েলিস্টিক নয়ও। কারণ রিয়েলিটিতে লোকে যে ভাবে কথা বলে, অ্যাঁ ওঁ, ইয়ে, মানে-মণ্ডিত, পয়েন্টে পৌঁছতে যে পরিমাণ সময় নেয় যদি পৌঁছয় অ্যাট অল, সে ভাবে ডায়লগ লিখলে দর্শকরা উঠে চলে যাবে। তালমারের সংলাপ গল্প এগোয়, চরিত্র ফোটায়। যে সংলাপ শুনে মনে হয় না মঞ্চ ভর্তি রাজাগজারা তরবারি উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে এদিকে দাশু (যার মঞ্চে থাকারই কথা না) সবার ডায়লগ একাই বলে যাচ্ছে।
ভালো লেখার আর দুই পিলার - ভালো প্লট ও ভালো চরিত্র। অর্চিষ্মান প্রো প্লট, আমি প্রো ক্যারেকটার। অফ কোর্স, ট্রুথ লাইজ ইন দা মিডল। তাছাড়া ও রকম আলাদাও করা যায় না। চন্দ্রিল ভট্টাচার্য বলেছেন, অভিনয় ভালো হয়েছে কিন্তু আলোটা একটু কেঁপে গেছে - এ ভাবে ভালো সিনেমা হয় না। সবটাই ভালো হতে হয়। স্টিকফিগারের মতো চরিত্র দিয়ে ঘনঘোর প্লট ফেঁদে উমদা গল্প নামিয়ে দেওয়া যেমন প্রায় অসম্ভব, গোলমটোল রক্তমাংসের চরিত্রদের নিয়ে প্লটের ধার না ধারা ভালো গল্পের উদাহরণ . . .
বিশ্বসাহিত্যে ভূরি ভূরি। যাই হোক, সে নিয়ে এখানে তর্ক বাধিয়ে লাভ নেই।
তালমারের প্লট সবাই জানে। গত চারশো বছর ধরে জানে। ওর ভালো খারাপের আলোচনা করে লাভ নেই। কিন্তু ভালো প্লট এনশিওরস নাথিং। আপনি মহাভারতের প্লট এনে দিন, সত্যনাশ করে রেখে দেবে। অর্চিষ্মানের মতে এর পর কী হবে সেটা জানার যদি উৎসাহ থাকে সেটাই হচ্ছে ভালো প্লট। যে গল্প পড়তে পড়তে, শুনতে শুনতে, দেখতে দেখতে কেউ 'তারপর?' বলে ওঠে না সে গল্পের থেকে দুর্ভাগ্যজনক আর কেউ নেই।
'কী হল'-র প্রতি উৎসাহ বাঁচিয়ে রাখার আমার মতে সব থেকে ফুল প্রুফ রাস্তা হচ্ছে 'কেন হল' স্পষ্ট করে বলা। এ কী হল -র থেকেও কেন হল। যে যেটা করছে, কেন করছে? সেখানেই প্লট, ক্যারেকটার ডি এন এ-র প্যাঁচে জড়িয়ে যায়। গল্পের লজিক রক্ষা করে চরিত্রের লজিক।
লজিকটা সর্বজনগ্রাহী হওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। যেমন ধরা যাক অর্চিষ্মানের মতে দুটো অ্যাডাল্ট লোক কার সঙ্গে প্রেম করবে সে নিয়ে বাড়ির লোকের এত কথা কীসের? যদি মনে হয় ভুল হতে চলেছে তাহলে ঠাণ্ডা মাথায় বলতে পারো যে এটা মনে হয় না ঠিক হচ্ছে, তলিয়ে ভেবে দেখো। ব্যস, ওই পর্যন্তই। তা সত্ত্বেও যদি লোকজন সে ভুল করার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে চুপ করে তাকিয়ে দেখা আর মাথা নাড়া ছাড়া অ্যাবসলিউটলি কিচ্ছু করার নেই। সে জায়গায় রানা-জাহানারার বাড়ির লোকজন? অর্চিষ্মানের মতে কমপ্লিটলি ইললজিক্যাল।
বললাম, হতে পারে। কিন্তু রানা-জাহানারার লজিকটাই বা কোথায়? প্রেম কী? অক্সিটোসিন সেরোটোনিনের চার ফোঁটা ককটেল। সে জন্য নিজেদের পরিবার, প্রিয়জনদের ধ্বংস করে দিচ্ছে? ইজ ইট ওয়র্থ দা রক্তারক্তি? সবাই যদি ঘাড়ও পাতে, প্রেম যদি সফলও হয়, কোন ল্যাজটা গজাবে? একটা বিয়ে নামবে। তিনদিনের সার্কাসে তিনশো ভুত খাবে। প্রেমের যদি বা মহান হওয়ার চান্স আছে, বিয়ের নেই। বাস্তবে ছাড়ুন, কল্পনাতেও না। আজ পর্যন্ত মহৎ দাম্পত্য নিয়ে বিশ্বের প্রতিভাধরস্য প্রতিভাধর গল্প ফাঁদতে পারেননি। শেক্সপিয়ারকেই দেখুন। সব জুলিয়েটই বিয়ের পর ক্যাথরিনা। মহৎ পিতৃত্ব নিয়ে গল্প লেখা হয়েছে? ইয়েস। মহৎ মাতৃত্ব নিয়ে? হেক ইয়েস। মহৎ পরকীয়া? লাইব্রেরির লোহার তাক বেঁকে যাচ্ছে। মহৎ বিয়ে?
হয়নি। কারণ বিয়ে মহৎ হয় না। মহৎটহৎ হওয়ার পক্ষে বিয়ে টু রিয়েল। টু রক্তমাংসের।
মহৎ বিয়ের ফিকশন পড়তে চান তো ইউটিউবে যান। কার প্রেম হচ্ছে না, কার প্রেম টিঁকছে না, কার প্রেম করতে গিয়ে বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে - সম্পর্কের যে কোনও রকম জটিলতার আঁচসম্পন্ন আলোচনার নিচে দু'ধরণের কমেন্ট পাবেন। প্রথম দল বলবেন, এই জন্য তো আমি সারা জীবন একলা চল রে-র নীতি নিয়েছি। সম্পর্কটম্পর্ক দুর্বলদের জন্য। আমার জন্য সকালে স্টোইসিজম, বিকেলে বেঞ্চ প্রেস।
দ্বিতীয় দল হচ্ছেন মহৎ বৈবাহিক। গতকাল বিয়ের চুয়াল্লিশ বছর পূর্ণ হয়েছে, চুয়াল্লিশ বছরে প্রেম চুয়াল্লিশগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, চুয়াল্লিশ সেকেন্ডের জন্য উল্টোদিকের লোকটাকে দেখে ভালোবাসা ছাড়া আর কোনও অনুভূতি জাগেনি।
অর্চিষ্মান বলছে, আহা তোমার বারো বছর লাগল, এ বেচারারা তো বারোঘণ্টাও পায়নি। তুমি তোমার নাককানমলা অভিজ্ঞতা দিয়ে যেটাকে সেক্সের ধুনকি বলে চিনছ, ওরা সেটাকেই ভাবছে মহৎ প্রেম। যেটাই হোক না কেন, যত ভুলই মনে হোক না কেন, কথাটা হচ্ছে বাগড়া দেওয়ার কোনও রাইট নেই।
শুধু রোমিও জুলিয়েটের প্রেম নয়, মোস্তাক-জানের প্রতিশোধস্পৃহাও আমার যুক্তিবুদ্ধির বাইরে। প্রেমে কাঁচি করলে আমার নিরানব্বই রকম প্রতিক্রিয়া হতে পারে, কিন্তু মোস্তাক আর মোস্তাকের জানের রকমটা যে হবে না সেটা প্রায় কাল সূর্য কোনদিকে উঠবে-র নিশ্চয়তায় বলে দেওয়া যায়।
ভালো লেখক যেটা করতে পারেন এত অমিল সত্ত্বেও ওই দু'জনকে আমার কাছে সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে পারেন। সেটা কী করে করা যায় আমি ভেবেছি। অর্চিষ্মানের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনাও করেছি। সিদ্ধান্তে এসেছি - যে ট্রুথ ট্রুথ করে সবাই চেঁচিয়ে মরে এইখানেই ট্রুথের কেরামতি। যে কোনও অনুভূতিই বিশ্বাসযোগ্য, যদি তা নিখাদ হয়। ঘৃণা, প্রতিশোধ, প্রেম - মুখোশ খুলে সামনে দাঁড়ালে, নিজে ফিল করি না করি, তাদের অ্যাকসেপ্ট করে নিতে আমরা বাধ্য। স্মার্টনেস ছাড়াও মানুষের যে আরও আবেগ অনুভূতি থাকতে পারে, মানুষ যে একই সঙ্গে অসহায় এবং অত্যাচারী হয়, একই সঙ্গে প্রেমিক ও প্রেমের নেমেসিস, একই সঙ্গে বন্ধু ও বিশ্বাসঘাতক - চরিত্র লেখার সময় সেটা কেউ মনে রেখেছে দেখলে তার ওপর ভক্তি হয়। চরিত্রায়ণ ভালো হওয়ার আরও একটা প্রমাণ হল, শেষে যখন সব মরেঝরে শেষ, যারা বেঁচে গেল তাদের বাঁচাটা মরার থেকেও মারাত্মক হল - কমপ্লিটলি নিজেদের দোষেই - তাদের দেখেও আপনার এক রকম হবে বুকের ভেতর। মনে হবে ডেকে বলেন, কেন করতে গেলি এত ঝামেলা? ভালো হল?
তাছাড়া যুক্তিটুক্তির তফাৎগুলো আসলে অনেকটাই পরিস্থিতি, কন্ডিশনিং - এই সব ওপরের। যতটা আলাদা মনে হচ্ছে তত আলাদা হয়তো নই। যে দৃশ্যে বন্দুক হাতে প্রবল দৌড়োদৌড়ির মধ্যে এক মুহূর্তের বিরতিতে মোস্তাক বলল, বেঁচে থাকার থেকে বড় শাস্তি আর কিছু নেই, বলতে বলতে মুখটা কেমন হয়ে গেল, গলাটাও কেমন শোনাল, চোখের কোলে দু'সেকেন্ড টলটলিয়ে যে অশ্রুবিন্দু ফিরে গেল, আমার আর মোস্তাকের ইতিহাস ভূগোল অক্ষাংশ দ্রাঘিমাংশ জীবনবিজ্ঞান ভৌতবিজ্ঞানে কোনও মিল না থাকা সত্ত্বেও, সেটা আমার গাল বেয়েই গড়াল।
হাই ফাইভ মোস্তাক, হাই ফাইভ।
একটা দৃশ্যের কথা মাঝে মাঝেই ভাবি। রোমিও আর জুলিয়েট দুজনে পাশাপাশি বসে আছে। বসে বসে ভবিষ্যতের কথা ভাবছে। তুমি কী করবে। আমি কী করব।
আর কী নিয়েই বা ভাববে? অতীতে আগুন লাগিয়ে এসেছে, বর্তমানও যায় যায়। পড়ে আছে ভবিষ্যৎ।
একজন বলল, আমার তো শুধু সাজতে ভালো লাগে। আর কিছু ভালো লাগে না। অন্যজন একসময় ফুটবলটা ভালো খেলত, প্রেমের মুখ চেয়ে তাতে লাথি মেরে এসেছে।
বদলে পেয়েছে একটা প্রেম। একটা মহাকাব্যিক প্রেম। পনেরোশো সাতানব্বই থেকে টিকে আছে। আরও পনেরোশো সাতানব্বই বছর হেসেখেলে টিকবে।
ছোটবেলার কথা ভাবলে আজকাল প্রধান যে অনুভূতি হয় সেটা টুপি পরার। কত স্টাইলের। কত সাইজের রংবেরঙের টুপি। তাদের মধ্যে সবথেকে নির্মম টুপিটা সম্ভবতঃ যোগ্যতার। ওয়র্থের। ওয়র্দিনেসের। কিছু পাওয়ার জন্য কিছু হয়ে উঠতে লাগে না। দানে দানে পে লিখ্খা হ্যায় খানেওয়ালে কা নাম। প্রেম প্রেম পে লিখখা হ্যায় পানেওয়ালে কা নাম।
*****
তারপর আমরা আরেকটা সিনেমা দেখলাম। অল উই ইম্যাজিন অ্যাজ লাইট। শহরের সীমিত হলে সীমিত শো-তে জন্য রিলিজ করেছিল। তক্কে তক্কে ছিলাম। মানে দুজন মিলে ঠিক করেছিলাম যে অর্চিষ্মান তক্কে তক্কে থাকবে। যথাসময়ে হোয়াটসঅ্যাপ জ্বলল। কাটছি কিন্তু।
একটি বম্বে শহর। তিনটি মহিলা। সিনিয়র নার্স প্রভা। জুনিয়র নার্স অনু। হাসপাতালসংলগ্ন চায়ের দোকান চালানো পার্বতী। জীবনের তিনটি স্টেজ। প্রভার বিয়ে হয়েছে এবং আট বছর বা এগারো বছর বা ওই রকমই একটা কোনও সময়কাল ধরে বর হাওয়া। বেসিক্যালি বিয়ের পর থেকেই। অনুর বিয়ের বয়স হয়েছে এবং একটি প্রেমিকও। মুসলমান। পার্বতীর বর মারা গেছে, পার্বতীর বাইশ বছরের বাড়ি ভাঙা পড়ছে এবং পেপার নেই বলে পার্বতী তাড়া খাচ্ছে।
সিনেমার শুরুতেই বোঝা যায় তিন মহিলার সঙ্গে বম্বে শহরও 'অল উই ইম্যাজিন'-এর চরিত্র। নোংরা বম্বে। ঘিঞ্জি বম্বে। ভিড় ট্রেন আর অবিরাম বৃষ্টির অনিত্য বম্বে। অনিশ্চয় বম্বে। নেপথ্য কণ্ঠ বলে, বাইশ বছর বম্বেতে আছি কিন্তু এখনও বম্বেকে আমি বাড়ি বলে উঠতে পারিনি। কবে চলে যেতে হয়। বম্বেতে থাকতে হলে এই অনিশ্চয়তা আত্মস্থ করে থাকতে হবে।
'অল উই ইম্যাজিন...' সিনেমাটা কী নিয়ে সে নিয়ে অনেক আলোচনা শুনলাম। সেন্স অফ ইম্পার্মানেন্স নিয়ে হতে পারে। বম্বে শহরের ইমপার্মানেন্স। মানুষগুলোর ইমপার্মানেন্স। অনু ক্রমশঃ একটা বাঁকের মুখে এসে দাঁড়াচ্ছে, যেখানে ওকে প্রেমিককে প্রকাশ্যে আনতে হবে। পার্বতীর বাইশ বছরের বাসা ভাঙা আর একটা ইমপার্মানেন্স-এর দ্যোতক। একমাত্র প্রভা, ওয়েল, প্রভা একদিক থেকে দেখলে ইমপার্মানেন্ট তো নয়ই, পার্মানেন্টও না। স্ট্যাগন্যান্ট। স্তব্ধ হয়ে যাওয়া জীবন, রুদ্ধ হয়ে যাওয়া বেঁচে থাকা। সে রুদ্ধতা প্রভার চোখেমুখে, নীরবতায়, শরীরে যে ভাবে ফোটে - ছুটন্ত বম্বের ব্যাকড্রপে প্রভা একবার চোখ মেলে তাকালেই সব কেমন স্লো মোশন হয়ে যায় - কানি কুস্রুতিকে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। কানির মতো স্ট্রাইকিং চেহারার মানুষ শেষ কবে দেখেছি মনে করতে পারি না। কিন্তু প্রভার এই থেমে থাকা কি পার্মানেন্স? নাকি এই ত্রিশঙ্কু জীবনও আসলে ইম্পার্মানেন্স-ই?
অনেক জায়গায় লিখেছে 'অল উই ইম্যাজিন...'-এর বিষয় ফিমেল ফ্রেন্ডশিপ। তিনজন ফিমেল। তিনজন ফ্রেন্ড। কাজেই সিনেমাটা ফিমেল ফ্রেন্ডশিপ নিয়ে বলা যেতেই পারে।
জাকির খান নামক বিখ্যাত হাস্যকৌতুক শিল্পীর একটি বিট ইউটিউব শর্টস্-এর সাজেশনে আসে মাঝে মাঝে। 'ফ্রেন্ডশিপ' নিয়ে ষাট সেকেন্ডের মজাদার কমেন্টারি। ফ্রেন্ডশিপ না, ফ্রেন্ডশিপের একটা সাবসেট নিয়ে। লড়কোঁ কা ফ্রেন্ডশিপ। হামলোগোঁ কা ফ্রেন্ডশিপ।
জাকির দক্ষ কৌতুকশিল্পী। পটু ভাষামিস্ত্রিও। পুরুষ বন্ধুত্বের বর্ণনায় পৌরুষময় বিশেষণ ব্যবহার করেন। হামলোগোঁ কা ফ্রেন্ডশিপ হার্ডওয়্যারড। ওয়েল্ডেড। রোজ ফোনে পি এন পি সি করতে হয় না, কিন্তু মাঝরাতে ফোন এলে হাজার সিসি-র বাইক ভটভটিয়ে পৌঁছে যাওয়া হয়।
এক তো ষাট সেকেণ্ডের বেশি মনোযোগ দাবি করেনি, তার ওপর জাকিরের গল্প বলার ওয়ার্ল্ডক্লাস কারিকুরি। লাখ লাখ লোক শর্টটি দেখেছেন। আমিও যেহেতু একবার দেখেছি আমার সাজেশনে মাঝে মাঝেই ফিরে ফিরে আসছে।
যতবার আসে ততবার দেখি। জাকিরকে দেখে যে বুদ্ধিমান মনে হয়েছিল তার কনফার্মেশন পাই। বুদ্ধিমানেরা যা বলেন, আসলে প্রায় কখনওই তা বলার উদ্দেশ্য থাকে না। বুদ্ধিমানদের টেক্সটে সাবটেক্সট প্রায় অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু যতবার শর্ট চলতে শুরু করে আর জাকির 'হামলোগোঁকা ফ্রেন্ডশিপ', 'লড়কোঁ কা ফ্রেন্ডশিপ' শুরু করেন - টের পাই সাবটেক্সটমেক্সট নয়, ব্যাপারটা দিনের আলোর মতোই ক্লিশে। শর্টটা মেল ফ্রেন্ডশিপ নিয়ে এত শব্দ খরচ করলেও, জাকিরের যাবতীয় বক্তব্য অপর ফ্রেন্ডশিপটি নিয়ে।
সাম্প্রতিক একটি চালু সিনেমার দৃশ্য মনে পড়ে। নিজেকে ফেমিনিস্ট বলে চালাই খবর পেয়ে একজন বলেছিলেন, তাহলে তো তোমাকে এই ফিল্মটা দেখতেই হবে। ভাবা যায় না, নাকি। এই অসীম জনপ্রিয় ছায়াছবির একটি দৃশ্যে দুই বয়স্কা, দুই যুবতী উপস্থিত। দুজন বয়স্কা ও এক তরুণী বধূমাতা। অন্য বহিরাগত তরুণীটি সিনেমার হিরো। পিতৃতান্ত্রিক সমাজসংসারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে নিজের ব্রুট বরের বদলে ভালো বরের সঙ্গে ভালো শ্বশুরবাড়িতে এসে উপস্থিত হয়েছেন এবং এ বাড়ির মেয়েদের সঙ্গে ইমিডিয়েট বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলেছেন। অল্পবয়সী বধূটিকে নিজের প্যাশন অনুসরণ করতে উদবুব্ধ করছেন এবং ওই দৃশ্যে পাশাপাশি বসে অন্তরঙ্গ হাসাহাসি করছেন।
বর্ষীয়ান মহিলারা স্নেহ, প্রশ্রয় ও সামান্য বিষাদ নিয়েই হয়তো সে হাসাহাসির দিকে তাকিয়ে থাকেন। একজন ডায়লগ বলার জন্য হাঁ করেন।
আমি ভাবি এই বুঝি বলবেন, ওই পরিস্থিতিতে একমাত্র যা বলা সম্ভব বলে আমার বুদ্ধিতে কুলোয়। বাহ্, দেখেছ, এদের কেমন সুন্দর বন্ধুত্ব হয়ে গেছে?
কিন্তু তিনি তা বলেন না। তিনি এই দু'জনকে বাইপাস করে ইন জেনারেল নারীজাতি ও নারীজাতির বন্ধুত্ব সম্পর্কে একটা গ্র্যান্ড সত্য উচ্চারণ করেন।
আক্ষেপে গলা চুবিয়ে বলেন, মেয়েরা কত রকম সম্পর্ক তৈরি করে জীবনে - শাশুড়ি বউ, ননদ ভাজ, হ্যানাত্যানা - যে সম্পর্কটা মেয়েরা তৈরি করতে পারে না সেটা হচ্ছে বন্ধুত্ব।
জাকির খান যেখানে জাস্ট নীরবতা দিয়ে মেয়েদের মহৎ বন্ধুত্বের অধিকার দিতে অস্বীকার করেন, লাপাতা লেডিজ দায়িত্ব নিয়ে, বুক ফুলিয়ে ঘোষণা করে, মেল ফ্রেন্ডশিপের মিথিক্যাল উচ্চতায় আরোহণ করা তো দূর অস্ত, মেয়েরা ফ্রেন্ডশিপ ব্যাপারটাই পারে না।
কিন্তু লাপাতা লেডিজকে সিরিয়াসলি নেওয়ার দরকার নেই। কারণ লাপাতা লেডিজের লেডিজরা কেউ রক্তমাংসের লেডিজ নন। তাঁদের বাতাসে হাত ঘুরিয়ে কিংবা জাদুকরের টুপি থেকে বার করা হয়েছে। এঁরা কেরিয়ারমনস্ক, ক্ষেতিবাড়ি জানেন। এই লেডিজদের সবথেকে বড় সুবিধে এঁদের বিপ্লব আমাদের মতো উদারমনাদের বিন্দুমাত্র অসুবিধেয় ফেলে না। এমন কিছু দাবি করে না যাতে প্রগতিশীলদের পকেট বা মূল্যবোধে টান পড়ে। একটি মেয়ে আরও পড়াশোনা করে চাকরি করতে চায়। অন্যজনের স্ট্রাগল মেনলি এসে দাঁড়ায় স্বামীর নাম উচ্চারণ করায়। লাপাতা লেডিজের লেডিজরা ভারতবর্ষের এমন প্রান্তে বড় হয়েছেন যেখানে এঁদের স্বামীর নাম মুখে আনতে বারণ করা হয়েছে কিন্তু জাতপাত মানতে শেখানো হয়নি। র্যান্ডম চাওয়ালার ঘরে ঢুকে তার সঙ্গে দিব্যি খাওয়াদাওয়া করেন, মা পাতিয়ে ফেলেন।
শুনুন, আমি দাবি করছি না সিনেমাকে ইন্টারসেকশনালিটির লেকচার হতে হবে। আমার তো বরং উল্টো মত। আর যাই হ', লেকচার হোস না। কেউ যদি তবু লেকচার দিতে বদ্ধপরিকর হন, আমার তখন অন্য লেকচারগুলো, যেগুলো তিনি আস্তে করে চেপে গেলেন, বেশি করে মনে পড়বে। নিজের সুবিধেমতো সিলেবাস সেট করে, সোজা সোজা চ্যাপ্টার বেছে পড়িয়ে, নিজেই নিজের কপালে প্রগতিশীলতার তিলক এঁকে দৌড়ে অস্কারে পৌঁছে গেলেও আর যে-ই ইম্প্রেসড হোক, আমি হব না।
প্রভা অনু পার্বতী - লাপাতা লেডিজ নন। আমার মতো লেডিজ। আমার চেনা অধিকাংশ লেডিজের মতো লেডিজ। আমার দেখা অধিকাংশ জেন্টসের মতো লেডিজ। প্রভা অনু পার্বতীর বন্ধুত্বও আমার দেখা অধিকাংশ লেডিজ ও জেন্টসের বন্ধুত্বের মতোই। দায়িত্বজ্ঞানহীন, সুবিধেবাদী বন্ধু নিজের মাইনে উড়িয়ে রুমমেটকে এ মাসের ভাড়াটাও দিয়ে দিতে বলে। আগেও এ ঘটনা ঘটেছে এবং পরেও ঘটবে গ্যারান্টি। নরম মনের বন্ধু ঘাড় পাতে। আবার নরম মাটি সর্বদাই নরম মাটি থাকবে সে রকম ভেবে নেওয়ার কারণ নেই। প্রভার খটখটে জীবনে একজন প্রেমিক গোছের লোক হাজির হওয়ার পর অনু উচ্ছ্বসিত যৌবনাবেগে যখন হয়তো অতশত না ভেবেই লোকটির হাত খপ করে ধরে ফেলে তখন প্রভা, সাত চড়ে রা না কাড়া প্রভা, নিজের নিয়তিকে বিন্দুমাত্র রেজিস্ট না করা প্রভা, অনুকে প্রম্পটলি 'বেশ্যা' বলে দেয়।
প্রভার ভালোমানুষির বারংবার সুযোগ নেওয়া অনু এই অপ্রত্যাশিত অ্যাটাকে থমকে যায়। চুপ করে চোখের জল ফেলে। বাড়ি এসে গম্ভীর মুখে জামা ছাড়ে। আবেগের মাথায় রিঅ্যাক্ট করে ফেলা প্রভা, চোরের মতো দরজায় এসে দাঁড়ায়। নিচু গলায় বলে - সরি।
তারপর দুজনে পাশাপাশি শুয়ে গল্প করে।
হামলোগোঁ কা ফ্রেন্ডশিপ অ্যায়সা হি হোতা হ্যায়। আপলোগোঁ কা ফ্রেন্ডশিপ ভি অ্যায়সা হি হোতা হ্যায়। মানুষে মানুষের সব সম্পর্কই, ফ্রেন্ডশিপ শুদ্ধু, অ্যায়সা হি হোতা হ্যায়। ভালোমন্দ মেশানো রক্তমাংসের দুটো হোমোসেপিয়েন্স বন্ধুত্ব পাতিয়ে হঠাৎ হরিশ্চন্দ্র হয়ে ওঠে না। যারা সেটা বোঝার মতো বুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও নিজেদের অতিমানবিক বানানোর ইগোমর্দন চালিয়ে যান, তাঁদের প্রতি আমার মাথা নাড়া ছাড়া আর কিছু থাকে না। আর নিজেদের ইগো মালিশ করতে গিয়ে যাঁরা "অন্য দলের" লোকদের প্রতি নিজেদের আজন্মের কন্ডিশনিংজাত বিদ্বেষকে ধ্রুবসত্য বলে চালান, তাঁদের প্রতি, ওয়েল...
যাকগে মরুকগে।
অল উই ইম্যাজিন আরও একটা জিনিস দেখায়, যেটা অনেক বুড়ো বয়সে পৌঁছে আমি চিনতে পেরেছি এবং চেনার পর জিনিসটার প্রাদুর্ভাবের ব্যাপকতাও টের পাচ্ছি। অহিংস হিংস্রতা। প্রভার বিয়েটাই দেখুন। প্রেম নেই, পার্টনারশিপ নেই, সঙ্গ নেই, সেক্স নেই। আস্ত বরটাই হাওয়া হয়ে গেছে। শুধু আছে আগুনে সেঁকা লোহা কপালে চেপে ধরা “ম্যারেড”/ “বিবাহিত”/ “টেকেন”-এর গনগনে ব্র্যান্ডিং। সমাজসংসার শ্বশুরভাশুর - কে এই ব্র্যান্ডিং মুছতে পারমিশন দেবে ভুলে যান, মেয়েটা নিজেই নিজেকে অনুমতি দিতে পারবে না।
প্রভার বর প্রভাকে ছেড়ে দিয়েছে। আবার একেবারে ছেড়েও দেয়নি। প্রভার নাগালের বাইরে দাঁড়িয়ে (যেখানে প্রভার ফোন যাবে না) হঠাৎ কোনও হাওয়া-দেওয়া বিকেলে হয়তো মনে পড়েছে, একটা লাল টুকটুকে রাইস কুকার পাঠিয়ে দিয়েছে। এ ছেড়ে যাওয়ার মধ্যে কোনও হিংস্রতা আপাতভাবে নেই। প্রভার বর প্রভাকে মারেনি, ধরেনি, ঝগড়া করেনি, তোমার থেকে ওকে আমার বেশি পছন্দ গোছের কষ্ট দেয়নি, জাস্ট ছেড়ে দিয়েছে। একটা জামার মতো।
ভাবুন। চড় মারলাম না, রেপ করলাম না, এমনকি 'যা বোঝ না তা নিয়ে কথা বোল না' পর্যন্তও গেলাম না। জাস্ট একটা জামা, বা গেঞ্জি, বা গামছা, বা মোজার সঙ্গে গুলিয়ে ফেললাম।
বম্বে পার্বতীকে উগরে দেয়। যে ভয়টা অনাম্নী নেপথ্য কণ্ঠ পাচ্ছিলেন - বম্বেকে বাড়ি বলতে ভয় লাগে কবে ফিরে যেতে হয় - পার্বতীর জীবনে সত্যি হয়। বাড়ি ভাঙা পড়ে। পেপারহীন পার্বতী তাড়া খায়। প্রভা নিজের চরিত্র অনুযায়ী বন্ধুকৃত্য করার চেষ্টা করে। পার্বতীর বাড়ি গিয়ে পেপার খোঁজে, সঙ্গে করে দয়ালু উকিলের বাড়ি যায় কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয় না।
পেপার নেই বলে একটা লোকের বাইশ বছর বসবাসের অধিকার শূন্য হয়ে যাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে পার্বতী প্রশ্ন তোলে। পার্বতীর সঙ্গে সম্পূর্ণ ঐকমত্যে দাঁড়িয়েও প্রশ্নটা আমার কানে লাগে। এটা কি পার্বতী বলল? নাকি পরিচালক পায়েল কাপাডিয়া বললেন? চা বেচে বলে পার্বতীর থেকে আমি পেপারসংক্রান্ত কথাবার্তা আশা করছি না তেমন নয়। আমার অসুবিধে হচ্ছে কারণ এই পেপারসংক্রান্ত ইস্যু ও বক্তব্যটার হেডলাইনিকরণ ঘটে গেছে। পার্বতীকে আমি গত এক ঘণ্টা ধরে দেখছি, পার্বতী আমার কাছে রক্তমাংসের হয়ে উঠেছে আর রক্তমাংসের মানুষ হেডলাইনে কথা বলে না। পায়েল আমার কাছে কাল্পনিক, হেডলাইনে কথা নিশ্চয় পায়েলই বললেন।
তাতেও আপত্তির অবকাশ না থাকতে পারে। আর্টিস্ট যদি নিজের আর্টে কথা না বলেন আর কোথায়ই বা বলবেন? তবু, বাকিটা এত রিয়েলিস্টিক যে এইটুকু হেডলাইনের গুঁতোও গায়ে লাগে।
যে পার্বতী মারাত্মক তেজের সঙ্গে হাত নেড়ে বলেছিল, বেরোতে হলে আমার ডেডবডি বেরোবে বাড়ি থেকে, কত গুণ্ডা পাঠাবে পাঠাও, সেই পার্বতী সব গুছিয়ে, ছেলের ছোটবেলায় পাওয়া গ্রিটিংস কার্ড প্যাক করে গ্রামের বাড়ি রওনা দেয়। ফিমেল ফ্রেন্ডরা সঙ্গে যায়। প্রভা যায় প্রভার মতোই। কোনও গুপ্ত মোটিভ ছাড়া, পার্বতীর সংসার পাততে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে। অনু যথারীতি যায় নিজের স্বার্থ পকেটে পুরে। বাকি দুজনকে না জানিয়ে প্রেমিককে আসতে বলে। অকপট বম্বে শহর দুজনকে সেক্সের সুযোগ দেয়নি, সমুদ্রতীরের খোলামেলা গ্রাম গোপনীয়তার সুযোগ করে দেবে সেই আশায়।
তিনজন মিলে বাসে চড়ে পার্বতীর গ্রামে যায়। ঘিঞ্জি, নোংরা, ভেজা, ভিড় বম্বে থেকে খোলা আকাশের নিচে, উদার সমুদ্রের তীরে। ইলেকট্রিসিটিহীন বাড়িতে ঢুকে পার্বতী বাসি মদের বোতল বার করে। রেডিও চালিয়ে ইনপ্রম্পটচু ডান্স পার্টি। পরোক্ষ পার্টিসিপেন্ট হয়ে প্রভা হাসে। প্র্যাকটিক্যাল অনুর ভেতর থেকে ইন্ট্রোস্পেকটিভ অনু বেরিয়ে আসে। বর্তমানের স্বার্থ মেটাতে ব্যস্ত অনু ভবিষ্যতের দিকে চোখ তুলে তাকানোর সুযোগ পায়। ফাঁকা গুহায় প্রেমিকের গা ঘেঁষে বসে বলে, দশ পনেরো বছর পরে কী হবে? অনুর মনে হয় ফিউচারটা ওর ঘাড়ের ওপর এসে পড়েছে। যে ফিউচারটার জন্য ও প্রস্তুত নয়।
আর আবারও, ওই মুহূর্তে, অনুর আকারপ্রকার, অনুর পরিস্থিতি, অনুর সমস্যাসমাধানের সঙ্গে এককণা মিল না থাকলেও, প্রেমিকের সঙ্গে মিলনের গোপনীয়তা রক্ষার্থে অনুর মতো বোরখা জোগাড়ে নামতে না হলেও এবং খুব রোমহর্ষক কিছু না ঘটলে ভবিষ্যতে নামার চান্স ক্ষীণ হলেও - অনু আমার অনুভূতির ভেতর, আমি অনুর উপলব্ধির ভেতর ঢুকে পড়ি।
হাই ফাইভ অনু, হাই ফাইভ।
পরিস্থিতি, প্রিভিলেজ, জন্মের জোর - মানুষের সুখদুঃখ, অসহায়তার মাত্রা, বাঁচামরা অনেকটা সোজা করে, অনেকটা কঠিন। কিন্তু আমার মনে হয় সেই সব দিনরাতের বাঁচামরা পেরোতে পেরোতে যে পলি আমাদের মধ্যে পড়ে, সে পলিতে জীবনের যে আউটলাইনটা ক্রমশঃ ফুটে ওঠে, সেটা মোস্তাক, অনু, কুন্তলার জন্য খুব বেশি আলাদা নয়।
সমুদ্রতীরে কাটানো এই এক আশ্চর্য দিনে প্রভার জীবনে এক আশ্চর্য ব্যাপার ঘটে। বাস্তবতার কোন ডায়মেনশনে - সে নিয়ে যাদের সঙ্গে কথা বলেছি সবার এক এক রকম মত বেরিয়েছে। কিন্তু ডায়মেনশনটন ইমমেটেরিয়াল। বাস্তব বা কল্পনা - ঘটনা যেখানেই ঘটুক, প্রভার জীবনে সে ঘটনার প্রভাবটাই গুরুত্বপূর্ণ। গোটা সিনেমায় এই সম্ভবতঃ এই প্রথম এবং শেষ, প্রভা নিজের জন্য একটা উত্তর বাছে। বেছে তার পাশে দাঁড়ায়। এই উত্তর পাওয়া ও উত্তরের সঙ্গে দাঁড়ানো কি প্রভাকে দোলাচল থেকে স্থিরতার দিকে নিয়ে যায়? নাকি একটা অতিদীর্ঘ স্থবিরত্ব থেকে মুক্তি দিয়ে জীবনের বহমানতার অংশ করে তোলে?
উত্তর পাওয়ার আগেই সিনেমা শেষ হয়ে যায়। হ্যাপি এন্ডিং স্যাড এন্ডিং-কে কাঁচকলা দেখিয়ে, জাস্ট এন্ড হয়ে যায়। যাশ্শালা টুকু বলারও সুযোগ না দিয়ে মোস্তাকের ডবল দাঁড়ি পড়ে যায়। প্রেম মেলে না, প্রতিশোধ নিভে যায়। নাথিং গেটস রিজলভড। নাথিং। পার্বতীর ইলেক্ট্রিক কানেকশন কবে আসবে? অনুর বাড়ি থেকে মুসলমান জামাই মেনে নেবে? মুসলমান জামাইয়ের বাড়ি থেকে হিন্দু বউমা?প্রভার জীবনে আরেকটি ডক্টর মনোজ আসবে? যদি আসেও, প্রভা কি মহান ম্যারেজের মুকুট মাথা থেকে নামিয়ে পেন্নাম ঠুকে 'চললাম' বলতে পারবে?
হু কেয়ারস? জীবনদেবতা অন্ততঃ করেন না। কয়েকটা অবান্তর সালতারিখের মাইলস্টোন পুঁতে, অর্থহীন সাফল্যব্যর্থতা চাওয়াপাওয়ার কমা কোলন হাইফেন বসিয়ে জীবনটাকে জীবনী বানিয়ে তোলার জন্য যতই হাঁকপাঁক করি না কেন, আসলে তো গল্প নেই কোথাও। শুরু নেই, শেষ নেই, তাৎপর্য নেই, কার্যকারণ নেই, টীকাটিপ্পনী নেই। কোনও প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। কোনও সমস্যার সমাধান হয় না। বর পাওয়ার বর চাইলে মাথায় দমাস করে রাইস কুকার এসে পড়ে।
প্রভা, পার্বতী, অনু, পেসোয়ার সেই মিডল অফ দা রোড-এ - যা এখানে সমুদ্রের তীর - বসে থাকে। অনুর চালাকি ধরা পড়ে যায়। প্রেমিক অসমবয়সী ফিমেল ফ্রেন্ডদের কাছে আত্মপ্রকাশ করে। অপরিচিত সুপুরুষ যুবকের সামনে আনস্মার্ট পার্বতী, প্রভার কানে কানে হাঁটুর বয়সী ফিমেল ফ্রেন্ডের প্রেমিকের রুজিরুটির খবর নেয়।
টিমটিম আলোজ্বলা দোকানে অশ্রুত সংগীতে চা-দোকানের কিশোর নাচতে থাকে। ক্যামেরা পিছোয়। পাথার অকূল, আকাশ অসীম হয়ে ওঠে। মানুষগুলো ফুটকি, গল্পগুলো বিন্দু হয়ে যায়। স্থানকালপাত্রের সীমানা ঘেঁটে যায়, সমস্যাগুলো আউট অফ ফোকাস। কিছু না পাওয়ার, কোথাও না পৌঁছনোর, শুধু বয়স বেড়ে যাওয়ার বিষাদ, শান্তি, ও উজ্জ্বলতা চোখে সহস্র সূচ ফোটায়। অল উই ইম্যাজিন অ্যাজ লাইট-এর শেষ দৃশ্য আমার কাছে বেঁচে থাকার মতোই লাগে প্রায়। সহ্যাতীত সুন্দর।
Comments
Post a Comment