রান আপ


এই পোস্টটা (পরের কয়েকটা পোস্টও, যা আশা করি আমি লিখে উঠতে পারব) ইন্দ্রাণীর জন্য।


দশমীর লাঞ্চে দিল্লি এন সি আর থেকে জনতা সি আর পার্কে আসবে। সেই সব লজিস্টিকস সামলানো এবং আরও মজাশিকারের জন্য হোয়াটসঅ্যাপে 'দুর্গা পুজো মিট' গ্রুপ খোলা হয়েছে। সিংহভাগ নাস্তিক, গুটিকয়েক অজ্ঞেয়বাদী ও মুষ্টিমেয় বিশ্বাসী-বিভীষণ মিলে হইহই করে পুজোর প্ল্যান হচ্ছে।

তবে এ সব লেবেল ওপর ওপর। বিশ্বাস অতি গোপন বস্তু। জ্ঞাতে অজ্ঞাতে, কনশাসে সাবকনশাসে কে যে কী লালন করছে কে জানে। কিছু একটা করছে বলেই আমার বিশ্বাস। সেদিনই একজনকে জ্ঞান দিচ্ছিলাম, আমরা অধিকাংশই বিশ্বাসের বাতাবরণে বড় হয়েছি। 'বিশ্বাসী' আমাদের ফ্যাক্টরি সেটিং। অত সোজা নাকি বেরোনো?

অর্চিষ্মানের দাবি, অতই সোজা।

বললাম, ওয়ার্ল্ড কাপ নিয়ে যারা উত্তেজিত তারা যদি ক্রিকেট/ফুটবলের ভক্ত হয়, পাঠান/জওয়ান ফার্স্ট ডে লাস্ট শোয়ে দেখার আনন্দে যারা লাফায় তারা যদি শাহরুখ খানের ভক্ত হয়, তাহলে পুজোর একমাস আগে থেকে যারা শ্যামাচিত্রাঙ্গদার রিহার্সাল দেয় বা হোয়াটসঅ্যাপে গ্রুপ খুলে কোথায় কোথায় কী কী খাওয়া যাবে নিয়ে গজল্লা করে তারা কী? কী তারা? আচ্ছা হিন্ট দিচ্ছি। তারা হচ্ছে ভ ক-য় ত।

অর্চিষ্মান বলল, সিনেমা হলে বা শোওয়ার ঘরে ভুতের সিনেমা দেখার সময় যে আমার গায়ে ঘেঁষটে, দুই চোখ চাপা দিয়ে আঙুলের ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাক, যেন তাতে কম ভুত দেখা যাবে আর কম ভুত দেখা গেলে কম ভয় লাগবে, তুমি কি বিশ্বাস কর ভুত বলে কিছু আছে?

না। ভয় আছে কিন্তু ভুত নেই।

শিওর?

হান্ড্রেড পার সেন্ট শিওর।

ঠিক তেমনি দুর্গাপুজোয় এগরোল কাবাব খাওয়ার সঙ্গে ভক্তির সম্পর্ক জিরো। শ্যামাসংগীতের প্লেলিস্ট বানানো দিয়ে আস্তিক নাস্তিক বিচার করা উন্মাদনা।

রিচার্ড ডকিন্স নিজেকে কালচারাল খ্রিষ্টান/অ্যাংলিক্যান বলে গালি খেয়েছেন, অর্চিষ্মানের মতে যা সম্পূর্ণ অনুচিত। অর্চিষ্মানও গর্বিত কালচারাল হিন্দু হিসেবে আইডেন্টিফাই করে।

অর্চিষ্মান শিহরিত হল। কুন্তলা, আমি কোনও কিছুর সঙ্গে গর্বিত হিসেবে আইডেনটিফাই করি না। ছি ছি ছি। কাটো এক্ষুনি। গর্বিত, কালচারাল, হিন্দু সব কেটে দাও। আচ্ছা আমাকেই পুরোটা কেটে দিলে হয় না? অর্চিষ্মানের মুখ কাতর হল।

হয়। কিন্তু তাহলে পুরো লেখাটাই কেটে দিতে হয়। শুধু এই লেখাটা নয়, যা যা এত বছর ধরে লিখেছি, আরও যা যা বাকি জীবনে লিখব, সব কেটে দিতে হবে। কারণ তুমি ছাড়া আমার আর কোনও বিষয় নেই লেখার।

অর্চিষ্মান দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেল। বউয়ের ক্রিয়েটিভিটির হাঁড়িকাঠে বেচারা বলিপ্রদত্ত। সেদিন এক বন্ধুর সঙ্গে মতান্তরের কথা মনে পড়ল। সে বলছিল, সম্পর্কের সাফল্যের জন্য কিছু কিছু জিনিস মেলা নন- নেগোশিয়েবল, কুন্তলা। আমি বললাম, ধুস। কারা কাদের সঙ্গে প্রেম করে দেখিসনি? সে পিছু হটে বলল, আচ্ছা প্রেম ছেড়ে দিচ্ছি। কিন্তু এটা তোকে মানতেই হবে যে বিয়ে টেকানোর কিছু নন-নেগোশিয়েবলস্‌ থাকেই।

মেনে নিলাম কারণ ম্যাটার করে না, কিন্তু এটারও সৎ প্রতিক্রিয়া 'ধুস'। ছোটবেলায় ও রকম মনে হয়। জীবনানন্দ মুখস্থ না বলতে পারলে প্রেম করতে পারব না, বিজেপিকে ভোট দিলে বিয়েবাড়িতে বুফের লাইনে মুখ ঘুরিয়ে নেব। নন-নেগোশিয়েবল আবার কী। সবই নেগোশিয়েবল। ভাবুন, আনন্দবাজারের পাত্রপাত্রী কলাম। অর্চিষ্মান লাল পেন বাগিয়ে বসেছে। অ্যাড পড়ছে আর ঘচাং ঘচাং কাটছে। নন নেগোশিয়েবল, নন নেগোশিয়েবল, নন নেগোশিয়েবল। তারপর একটা অ্যাড। উজ্বল শ্যামবর্ণা, সঙ্গীতনিপুণা, মফস্বলে একতলা পৈতৃক বাড়ি। যার সঙ্গে বিয়ে হবে সারাজীবন তাকে নিয়ে ইন্টারনেটে পচা গল্প লিখবে। নামধাম, দৈর্ঘ্য প্রস্থ উচ্চতা, বেগুনে অ্যালার্জি থেকে  ফটাফট অ্যাডিকশন কিচ্ছুটি বাদ দেবে না।

কোন জায়গাটা নেগোশিয়েবল মনে হচ্ছে? অথচ অর্চিষ্মান তো করেছে নেগোশিয়েশন। ডে ইন ডে আউট করে চলেছে।


এ বিষয়ে অর্চিষ্মানের সঙ্গে গত পনেরো বছরে অন্ততঃ পনেরোশো ঘণ্টা আলোচনা হয়েছে। (অবান্তর থেকে অর্চিষ্মানকে বাদ দেওয়া নিয়ে নয়, ওটা নিয়ে একমিনিটও আলোচনা হয়নি বাস্তবে। ওপরের কথোপকথন সম্পূর্ণ বানানো)। বিশ্বাসঅবিশ্বাস নিয়ে আলোচনার কথা বলছি। এখনও কেউ কাউকে পুরো কনভিন্স করতে পারিনি। এমন নয় যে আমি কনভিন্সড না হয়ে চমৎকার আনন্দে আছি। অবিশ্বাসীদের আমি পছন্দ করি, মনপ্রাণ দিয়ে তাদের মতো হতে চাই। আমার জীবনের অন্যতম অ্যাসপিরেশনাল আইডেনটিটি হচ্ছে অবিশ্বাসী। সে জন্যই ভয় করে, বাকি সব অ্যাসপিরেশনের মতো নির্ঘাত এটাও আমার দ্বারা পূর্ণ হয়নি। তেমন বিপদে পড়লেই বিশ্বাস করে ফেলব।

অর্চিষ্মান বলে, প'নে পঁয়তাল্লিশেও যখন করনি চান্স কম। তবে, অর্চিষ্মান সান্ত্বনা দেয়, চাপ নিয়ো না কুন্তলা, তুমি হচ্ছ সহি অবিশ্বাসী। এত অবিশ্বাসী যে নিজের অবিশ্বাসেও বিশ্বাস করতে পারছ না। বলে ওর গায়ে যত জোর আছে, জোগাড় করে আমার পিঠ চাপড়ে দেয়।

*

সহি ভেজাল যাই হই, দশমী দ্বিপ্রহরে সবাই একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া করব। কোরিয়ান না নেপালি না ইথিওপিয়ান নিয়ে আলোচনা চলছে, একজন এসে বলল এরা কারা রে? পুজোর দিনে কোরিয়ান খাওয়ার তাল করছে? তাতে গ্লোবাল কুইজিনের গাড়ি ব্রেক কষেছে। সম্ভবতঃ জি কে থ্রি-র ওহ ক্যালকাটা-তেই যাওয়া হবে, যদি জায়গা পাওয়া যায়। সাকেতে ছ’ নম্বর বালিগঞ্জ প্লেস খুলেছে, একাধিক লোকে বলেছে দারুণ। অর্চিষ্মান সেদিন রিল দেখাল। একজন বললেন, বাঁচা গেছে, ভালো বাঙালি খাবার খেতে হলে এখন থেকে সাকেতে গেলেই হবে, সি আর পার্কের খোন্দলে আর ঢুকতে হবে না। আমি রেগে গিয়ে রিল পাল্টে দিলাম।

খাওয়ার পর প্যান্ডেলে ঘুরে ঠাকুর দেখার প্ল্যান। গ্রুপে হ্যাঁ হ্যাঁ বলেছি, কিন্তু সে প্ল্যান কতটা কার্যকরী হবে জানি না । এক, এখানে দশমীর সকাল দশটা থেকে প্যান্ডেল খুলতে শুরু করে। দুই, যদি নাও খোলে, ছ’নম্বর বালিগঞ্জে লুচি কষা মাংস আম পান্না খেয়ে এসে শাড়ি পাঞ্জাবী পরে ঘুরে ঘুরে ঠাকুর দেখার এনার্জি থাকবে না। তাছাড়া সি আর পার্কে একাধিক পুজোর এ বছর স্বর্ণজয়ন্তী। সবাই খুব ত্রিপল টাঙিয়ে চুপি চুপি প্যান্ডেলের ইন্টেরিয়র সাজাচ্ছে। কে ব্লকে-র মাঠে আনন্দমেলা অলরেডি হয়ে গেছে, গোটা সময়টা স্বেচ্ছাসেবী-শৃঙ্খল প্যান্ডেল ঘিরে ছিল, কেউ ভেতরে উঁকি পর্যন্ত দিতে পারেনি। সে সব চমৎকার সাজসজ্জা দেখতে যা ভিড় হবে প্যান্ডেল অক্ষত থাকলেও ঢোকা যাবে না।

আমাদের খুব ইচ্ছে আগের বছরের মতো সবাই আমাদের বাড়িতে আসুক লাঞ্চের পর, কিন্তু বাড়ির যা অবস্থা তাতে আমাদের কোথাও যাওয়ার নেই বলেই থাকতে পারছি। অর্চিষ্মান বলল, তোমাকে তোমার একটা প্রিয় কাজ দিচ্ছি কুন্তলা, কী কী করতে হবে লিস্ট করে ফেল। আমি গুগল শিট খুলে টেমপ্লেট গ্যালারি খুলে প্রোজেক্ট ম্যানেজমেন্টের টেমপ্লেট খুলে করে টাইপ করে ফেললাম। নাম দিলাম প্রোজেক্ট_পুজো। প্রাইমারি ক্যাটেগরি বাড়ি পরিষ্কার, কেনাকাটা আর বিবিধ। এদের আন্ডারে পঁচিশটা করে কাজ আছে, সেগুলো রাইট জাস্টিফিকেশন করে অর্চিষ্মানের সঙ্গে শেয়ার করলাম।

অর্চিষ্মান কেয়া বাৎ বলে শিটে আরও কতগুলো টাস্ক জুড়ে ফেরত পাঠাল। তার মধ্যে একটা ইলেকট্রিক কেটলি সারানো। সেটা আবার বোল্ডে লিখেছে।

*

নতুন ইলেকট্রিক কেটলি কেনার সতেরো দিনের মাথায় খারাপ হয়ে গেছে। অর্চিষ্মান বলছে কেটলি নিরপরাধ, দোষী আমি। কারণ আমি চুয়াত্তর টাকা নিরানব্বই পয়সা বাঁচাতে প্রেস্টিজের বদলে পিজিয়ন কোম্পানির কেটলি কিনেছি।

কনফ্লিক্ট রেজলিউশনের ক্লাসে এসক্যালেশন পড়িয়েছিল । ধরা যাক, কনফ্লিক্ট হচ্ছে, একজন চা খেয়ে কাপ সিংকে নামিয়ে রাখেনি। অন্যজনের তাতে ভয়ানক অসুবিধে হচ্ছে। যার অসুবিধে হচ্ছে সে এই কনফ্লিক্ট তিন ভাবে ফ্রেম করতে পারে।

এক, তুমি চা খেয়ে কাপ সিংকে নামিয়ে রাখলে আমার সুবিধে হয়।

দুই, তুমি কখনওই চা খেয়ে কাপ সিংকে নামিয়ে রাখ না।

তিন, তুমি কখনও চা খেয়ে কাপ সিংকে রাখ না কেন জান তো? কারণ তুমি নার্সিসিস্ট।

অর্চিষ্মান ক্রিয়েটিভ বউ পেয়েছে আর আমি পেয়েছি অ্যানালিটিকাল বর। অ্যানালিটিকাল মাইন্ড তাই সব কিছুর সর্বদা অ্যানালিসিস করে। সবার করে বলা ভুল হল। বস্‌ এক্সট্রা পেপার লিখতে দিলে নিশ্চয় "আপনি সবাইকে খাটিয়ে মারেন কেন জানেন তো" বলে শুরু করে না। বস্‌ কেন, কারও সঙ্গেই করে না। ওটা আমার জন্য স্পেশাল। আমার তো আজকাল মনে হয়, আমাকে অ্যানালাইজ করা অর্চিষ্মানের ক্ল্যাশ অফ ক্ল্যানস খেলার থেকেও বেশি পছন্দের কাজ।

আমার ব্যাপারটা পছন্দ নয়। এককোটি বার বলেছি, অর্চিষ্মান সমস্যাতে ফোকাস কর, লাফিয়ে আমার চরিত্র বিশ্লেষণে চলে যেয়ো না। কিন্তু অর্চিষ্মান চালিয়ে গেছে।

অবশ্য চালিয়ে যাওয়া একদিক থেকে ভালোই। যে কোনও দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কের সাফল্যের মাপকাঠি, অবভিয়াসলি, তার দৈর্ঘ্য। আর দৈর্ঘ্য বজায় রাখতে গেলে চালিয়ে যেতে হবে। সবাই ভাবে প্রেম ভালোবাসা একনিষ্ঠতাই বুঝি চালিয়ে যাওয়ার। ভুল। চালিয়ে যাওয়ার উপযুক্ত মতান্তরও আবশ্যক। লো স্টেক বিরোধ, যা উথলে উঠে স্থিতাবস্থা মাটি করবে না অথচ দরকারমতো বিরক্তির মৃদু আঁচ জোগান দেবে।

নার্সিসিস্ট বলেনি, কিন্তু আমি যে পাঁচটাকা (পাঁচ না, পঁচাত্তর, কিন্তু ওই মুহূর্তে সেটা মনে করানো যায় না) বাঁচাতে গিয়ে সর্বদা, স র ব দা, একটা মহার্ঘ ঝামেলা পাকাই, সেটা আমার চরিত্রের কোন দিক থেকে আসে সেটা নিয়ে আমাকে ভেবে দেখতে অনুরোধ করল অর্চিষ্মান। আমি, হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে ঠিক আছে আমারই যখন দোষ তখন আমিই কেটলি সারাব, বলে বটল গ্রিন টি শার্ট - যেটার বুকে বাংলায় “এবার সন্ন্যাস নেব” লেখা - গলিয়ে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত চটি ফটফটিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শুনলাম অর্চিষ্মান বলছে, আস্তে নামো, পড়ে গিয়ে পা ভাঙলে প্যান্ডেলে ঘোরা মাটি হবে।

ফুরফুরে হাওয়া, নীল আকাশে সাদা মেঘ, মেলা গ্রাউন্ডের প্যান্ডেলের ফিনিশিং-এর ঠুকঠাক, সোমনাথের চায়ের সাইকেল-দোকানের মাথায় অর্চিষ্মানের সমান পুজোর ইভেন্ট নির্ঘণ্টে কলকাতার শিল্পীদের সারি সারি হাসিমুখ দেখতে দেখতে রাগ উবে গেল। আমার হাত থেকে কেটলি নিয়ে, আলো জ্বলছে কিন্তু জল গরম হচ্ছে না নালিশ শুনে, কর্মচারী মালিকের দিকে তাকিয়ে বলল, এলিমেন্ট খারাব হুয়া হ্যায়, হ্যায় না ভাইয়া?

দেখ লে। বলে মালিক উদাসমুখে শরতের আকাশবাতাস দেখতে থাকলেন। আমাকে বললেন, কাল এখানে গোটা একটা ব্লকের মহিলারা ঠাকুর বরণ করার জন্য এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে ছিল।

আমি বললাম, ও হরি ওঁরা গানের দল নন?

কাল ফুচকা খেতে খেতে ওই মহিলাদের আমরাও দেখেছি। পঁয়ত্রিশ ডিগ্রি চলছে দিল্লিতে, তার মধ্যে ওই রকম মাড় দেওয়া তাঁবুর মতো লাল শাড়ি পরে পঁচাত্তর জন জটলা না দেখে থাকা অসম্ভব।

কনুই মেরে অর্চিষ্মান জানতে চেয়েছিল, কী ব্যাপার মনে হচ্ছে তোমার?

কী আবার ব্যাপার। চারদিকে ফাংশান হচ্ছে। তাদেরই একটা থেকে কোরাস গেয়ে ফিরছেন অথবা গাইতে যাচ্ছেন।

কর্মচারী কেটলির স্ক্রু খুলতে খুলতে বললেন, এলিমেন্টই খারাব হুয়া হোগা।

মালিক বললেন, রামোঃ, গাইবে কেন। ঠাকুর এল তারপর সবাই মিলে নাচতে নাচতে প্যান্ডেলে নিয়ে গেল।

বোলা থা, এলিমেন্টই খারাব হুয়া হ্যায়।

আমার কেটলির এলিমেন্ট এক্সপোজড, কেটলির বডিতে সাঁটা। খারাপ হওয়ার চান্স বেশি। কিনলে সবসময় কনসিলড এলিমেন্টের কেটলি কিনবেন, বউদি। একটু দাম পড়বে কিন্তু ওয়ার্থ ইট। এটা কোন কোম্পানির?

বলে মালিক কেটলির ঘেঁটি ধরে তুলে নাম পড়লেন। 

পিজিয়ন। অ। মালিক কেটলি নামিয়ে রাখলেন।

বাড়ি এসে সরল মনে সে অর্থপূর্ণ অ-র বর্ণনা দিতে অর্চিষ্মান অট্টহাস্য করল।

মোদ্দা কথা, কেটলি সারানো যাবে না, নতুন কিনতে হবে। রিটার্ন উইন্ডো দশ দিনের মাথায় ফুরিয়েছে। অ্যামাজনে ঢুকে কেটলি বাছতে শুরু করলাম। কনসিলড এলিমেন্ট দেখে তিনটে কেটলি বেছে, ইয়েস, প্রেস্টিজ, প্রেস্টিজ এবং প্রেস্টিজ, তাদের লিংক অর্চিষ্মানকে পাঠালাম। অর্চিষ্মান এক নম্বরটা পছন্দ করল। অর্ডার দিলাম।

*

গুগল শিটে কেটলি কেনার স্টেটাস 'নট স্টার্টেড' বদলে 'ইন প্রোগ্রেস' করছি, দুর্গা পুজো মিট গ্রুপে নোটিফিকেশন এল।

আকাশবাণীর লিংক।

কথা হল, কাল যারা যারা চারটেয় উঠে শুনবে গ্রুপে লিখবে। আমি তানানানা করে রাত দুটোয় শুতে গিয়ে ঘুম ভেঙে দেখি চারটে বেজে গেছে। দৌড়ে গ্রুপে ঢুকে "উপস্থিত" লিখেই ফোন খুলে রেডিও চালু করে অর্চিষ্মান আর আমার কানের ঠিক মাঝখানে ফোন রেখে ভলিউম ঠেলে হায়েস্টে নিয়ে গেলাম। দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যারিটোনে বললেন জাগো, অর্চিষ্মান ঘুম ভেঙে গলায় হাওয়া আটকেটাটকে একশা হল। কী হয়েছে কুন্তলা? রেগে গেছ?

গান হতে লাগল, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ কেঁদে ফেললেন, অর্ধঘুমন্ত অর্চিষ্মান প্রশ্ন করতে লাগল এটা কে গাইছে? এটা কার গলা? আমি অর্চিষ্মানকে বললাম, বাণীকুমার চন্দ্রিলের দাদু, জানো নিশ্চয়। অর্চিষ্মান বলল, জানি । পরের বছর ও  আমাকে এই খবরটা দেবে। মোটামুটি জীবনে যতবার মহালয়া শুনব এই ফান ফ্যাক্ট দেওয়া নেওয়া করব। অর্চিষ্মান ঘুম ও জাগরণের ঢেউয়ে দুলতে থাকল, আমি শুয়ে শুয়ে দেখতে লাগলাম। নাইট ল্যাম্প জ্বালা ঘরে মায়ের ছায়া। টুলে উঠে আলমারির মাথায় রাখা এইচ এম ভি রেডিওর বোতাম ঘোরাচ্ছেন। টুল থেকে নেমে রান্নাঘরে যাচ্ছেন। আশপাশের ঘর থেকে জনতা সশব্দ হাই তুলে, কেশে, ইয়া ধূম্রেক্ষণ চণ্ডমুণ্ড মথনী গেয়ে উঠে জানান দিচ্ছে আমরাও উঠে গেছি, আমাদের চায়ের জলও নিয়ো। রেডিও থামলে টিভি চালু হবে আর আমি মায়ের নাকের ডগা দিয়ে সকাল ছ'টার সময় টিভি দেখতে বসে যাব। মা কিস্যু করতে পারবেন না। হার মেনে চায়ের কাপ নিয়ে নিজেও টিভির সামনে বসে পড়া ছাড়া।

অর্চিষ্মান ঠিকই বলে হয়তো। কাল দুটোর পর শুয়ে চারটের সময় এই উন্মাদের মতো মহালয়া শোনার পেছনে কতটা সর্বভূতেষু? কতটা মরে ভুত হয়ে যাওয়া কতগুলো মানুষ?

সুপ্রীতি ঘোষ, আরও কারও মত কেয়ার করি না, আমার মতে মহালয়ার মেগাস্টার, গাইছেন, তোমায় হারা জীবন মম, তোমারি আলোয় নিরুপম, আমার বালিশ ভিজে চুপড়ি, যাদের সঙ্গে মহালয়া শুনতাম সবাই হাওয়া কিন্তু কী আলোই না জ্বেলে গেছে, এই অ্যাপোক্যালিপসেও অনির্বাণ। 

নতুন একজন এসেছে, আমার পাশে শুয়ে মহালয়া শোনার জন্য। না এলে, না থেকে গেলে - আমার কিছুই করার থাকত না। কপালকে থ্যাংক ইউ বলতে আর সত্যি সত্যি যে আছে ভেরিফাই করার জন্যও অর্চিষ্মানকে ছুঁয়ে থাকি, মহালয়া শেষ হয়, মিষ্টি গলার ঘোষক মহালয়ার মহারথীদের নাম বলেন, স্পনসরশিপের লিস্ট। গলা বদলে যায়। মিষ্টত্ব একই থাকে, অল্প বাড়ে বরং। এবার আপনারা শুনুন রূপম ইসলামের পুজোর গান।

ইমিডিয়েট প্যানিক। বালিশের সমুদ্রে ফোন চাপা পড়ে গেছে, অর্চিষ্মানকে ঠেলছি, ফোন দেখেছ? চশমা? অর্চিষ্মান আবার জেগে উঠে জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছে আমার রাগ হল কীসে এমন সময় রূপম ওঁর গলা রকস্টার পিচে তুলে রকস্টার কম্পনে গেয়ে ওঠেন। এক্স্যাক্ট লাইন মনে নেই, কিন্তু উনি মা হয়ে যাবেন বা মা উনি হয়ে যাবেন, এই ধরণের একটা জটিল আইডেন্টিটি ফিউশন। ঠিক এই মুহূর্তে অর্চিষ্মান আমার ফোন খুঁজে বার করে স্টপের চৌকো বাটন ছুঁয়ে সব থামিয়ে দেয়।

ওর পর ঘুমোনো অর্চিষ্মানের পক্ষেও সম্ভব নয়। আমরা দাঁত মেজে ব্লু টোকাই চলে গেলাম। জি কে টু-তে দুটো ব্লু টোকাইয়ের ডানদিকেরটায়। আমাদের হোম অ্যাওয়ে ফ্রম হোম, চব্বিশঘণ্টা খোলা।

মার্কেটের মোড়ে অটো থেকে  নেমে ব্লু টোকাইয়ের দিকে হাঁটছি। উল্টোদিক থেকে এক দম্পতি আসছেন, স্পষ্টতঃই প্রাতঃকালীন দৌড়োদৌড়ি সেরে। এঁরা আমার ব্লু টোকাই-পরিচিত। অর্চিষ্মানও দেখেছে। এবং স্বপ্নেও কল্পনা করেনি যে এঁর সঙ্গে আমাদের ভাষাতুতো মিল থাকতে পারে। প্রথম যেদিন জানতে পেরেছিলাম মহিলা বাঙালি, একা ছিলাম। অর্চিষ্মানকে লিখেছিলাম। ওই মহিলা বাঙালি, বুঝতে পেরেছিলে?

কোন মহিলা?

বর্ণনা দিয়েছিলাম। অর্চিষ্মান চিনেছিল। লিখেছিল, হ্যাট। হতেই পারে না।

নিজেদের বাঙালি চিহ্নিতকরণ অ্যান্টেনার অ্যাকিউরেসি নিয়ে আমাদের দেমাক প্রচুর, সে অ্যান্টেনা কেন ফেল পড়ল? আমাদেরই দোষ। আমার ডিপ্রেসড ঝোড়ো কাক লুক বাঙালি মহিলাদের বেঞ্চমার্ক নয় মানছি, কিন্তু আমাকে বাদ দিলেও ইনি বাড়াবাড়ি পরিপাটি। ইংরিজি ছাড়া বলেন না, পডকাস্ট ছাড়া শোনেন না। যে সব দোকানের জামাকাপড় পরে ঘোরেন সে সব দোকানে জীবনে ঢুকিনি, ঢোকার চান্সও নেই। চুল একটি এদিক থেকে নড়ে না।

কয়েকদিন পর বেরোল, শুধু বাঙালি না, ব্যানার্জি।

সামলাতে পারিনি। গায়ে পড়ে বলেছি, ম্যাডাম, মাইসেলফ অলসো ব্যানার্জি। আই মিন, বন্দ্যোপাধ্যায়।

মাই ফাদার ওয়াজ আ বন্দ্যোপাধ্যায়। ঠোঁট টিপে সফিস্টিকেটেড হেসেছিলেন ভদ্রমহিলা। দ্যাট ওয়াজ টু মাচ ফর মি সো আই শিফটেড টু ব্যানার্জি।

সেই থেকে টুকটাক কথা হয়। স্ট্রিক্টলি নন-বাংলায়। শান্ডিল্যতুতো গলাগলি দেখিয়ে সোনার কেল্লা-র ডায়লগ বলে হাই ফাইভ এখানে চলবে না জানতাম, চেষ্টাও করিনি। সেই সব কথাবার্তা থেকেই জেনেছি উনি দু'বছর ধরে জাহাপনাহ্ ফরেস্টে প্রাতঃভ্রমণে যান, দশমাস আগে একদিন বোর হয় হাঁটা থামিয়ে দৌড়তে শুরু করেন। গতমাসে সফলভাবে কোয়ার্টার ম্যারাথন অর্থাৎ সাড়ে দশ কিলোমিটার দৌড়ে এসেছেন।

আমি ইম্প্রেসড। আরও ইমপ্রেসড, ভোর সাড়ে পাঁচটায় কত লোক দৌড়তে গেছিল শুনে। মিনি, মিডি, কোয়ার্টার ও হাফ মিলিয়ন মিলিয়ে দৌড়বীর সাড়ে তিন হাজার। এ রকম আরও প্রচুর ম্যারাথন দৌড় কোম্পানি আছে, যাদের মাধ্যমে সারা বছর ধরে হাজার হাজার দিল্লিবাসী সকালবেলা উঠে কিলোমিটার কিলোমিটার দৌড়চ্ছে।

ভাবতে পারছ? অর্চিষ্মানকে লিখেছিলাম।

চাইছি না। অর্চিষ্মান লিখেছিল।

ভদ্রমহিলা জানালেন, সে নাকি চমৎকার ব্যবস্থা। পথিপার্শ্বে ট্র্যাভেল-সাইজড জলের বোতল সাজানো চিয়ার-টেবিল, হুপ হাপ চিৎকার করে উৎসাহদান, সঙ্গে সঙ্গে দৌড়নো অ্যাম্বুলেন্স, দৌড়শেষে সারি সারি কিওস্কে কোল্ড প্রেস কমলাজুস থেকে ছোলেভাটুরে । ছোলেভাটুরের কিয়স্কে শেষটায় সিকিউরিটি ডাকতে হয়েছিল।

আমি চিরকাল বলে আসছি, লোকে যত গালি দেয় দিল্লি অত খারাপও না।

মহালয়ার দিন ভোর সাড়ে ছ'টায় ব্লু টোকাইয়ের রাস্তায় ওঁদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমরা যাচ্ছি, ওঁরা ফিরছেন। ব্লু টোকাই থেকেই। এর আগে একদিন ভোরবেলা ব্লু টোকাইতে বসে ক্যান্ডি ক্রাশ খেলছিলাম, জানি এই সময় ওঁরা দৌড় শেষ করে প্রাতঃকালীন কফি নিয়ে বাড়ি যান, বেলার দিকে আবার আসেন।

ভদ্রমহিলা হাত তুললেন। অল্প আতংকিত হলাম। এ যাবত আমিই সর্বদা ওঁর গায়ে পড়ে কথা বলেছি, উনি নিজে থেকে কখনও শুরু করেননি।

ওয়াজ মহালয়া টুডে?

ইয়েস।

ইশ্‌শ্‌, ম্যানিকিওরড আঙুলেরা কপাল ছুঁল। মিসড ইট।

ওঁরা আমাদের পেরিয়ে গেলেন, আমরা ওঁদের পেরিয়ে গেলাম। অর্চিষ্মান বলল, আমি না এখনও সামহাউ প্রসেস করতে পারি না যে এ বাঙালি।

আমিও পারছিলাম না, কিন্তু এবার পেরে গেছি। শুভ বিজয়ার কোলাকুলি সাবলীলতায় সেরে ফেলতে পারব।

Comments