পুজো ২০২৫
পঞ্চমী
দুপুরে কেনাকাটা করতে গেছিলাম। অর্চিষ্মানের জন্য একটা গাঢ় বাদামী টি শার্ট কেনা হল আর একটা ফেডেড ডেনিমের শার্ট - ফুলহাতা। সপ্তমী ও দশমীতে অর্চিষ্মান ওই শার্টটা পরেছিল, অবভিয়াসলি হাতা গুটিয়ে, এবং অতীব সোন্দর প্রতিভাত হইতেছেল।
বাড়ির জিনিসপত্রও কিনলাম। গ্লাস ভাঙতে ভাঙতে তিনটেয় এসে ঠেকেছে। আমরা বোতল থেকে জল খাই, আমাদের বাড়িতে ন’মাসে ছ’মাসে যে সব ভালোমানুষেরা আসেন, যদি আসেন, বোতল থেকেই জল খান। আরে গ্লাস দরকার নেই, বোতল নিয়ে আয়। ভান করি যেন বোতল আনা ছাড়া আমাদের বিকল্প আছে। কিন্তু এনাফ ইজ এনাফ। যত বোহেমিয়ানই নিজেদের ক্লেম করি না কেন, গ্লাসহীন বাড়িতে থাকা বাড়াবাড়ি।
গ্লাস কেনা হল, বালিশের ওয়াড়। শপিং করা আমাদের কাছে সাত হাত মাটি কোপানোর সমান। হোমস্টপ না কী একটা দোকান, কোটি কোটি কাপ প্লেটের মধ্যে কোটি কোটি সেলসপিপল। আমরা একতলা দু'তলা ঘুরে গ্লাস কিনছি, বালিশের ওয়াড় কিনছি, পেছন পেছন ঘুরছেন। ছুরিতে রিবেট চলছে ম্যাম। বড় বড় ছুরি, খুব ধার। দেব?
এই সব কিনতে কিনতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেল, আমার পা টনটন করতে থাকল। বললাম, উবার ডাকছি। অর্চিষ্মান বলল, তোমার জামা? বললাম, হবে'খন। এখন বাড়ি চল। কোটি কোটি ব্যাগ সামলাতে সামলাতে ট্যাক্সিতে চড়লাম, নর্ম্যাল দিনে পনেরো মিনিটও লাগে না, সে রকম দক্ষ ড্রাইভার হলে 'সন্দেসে আতে হ্যায়' শুরু হয়ে শেষ হওয়ার আগে বাড়ি পৌঁছে দেন। তবু আমরা সতর্কতার অপশন নিলাম। পঞ্চমীর বিকেল, হয়তো জ্যাম থাকবে। প্রসেনজিৎকে ফোন করলাম। ছ’টার বদলে সাড়ে ছ’টায় এসো।
সাড়ে ছ ‘টায় ট্যাক্সির জাস্ট সামনের দুটো চাকা সি আর পার্কে ঢুকেছে। কে ব্লকে সোনার কেল্লা প্যান্ডেলে লাইন পড়েছে, সাবিত্রী পর্যন্ত নিথর ট্র্যাফিক। সাতটা বাজতে পাঁচে বাড়ি ঢুকলাম। প্রসেনজিৎ রেডি হয়ে ছিল, বেল বাজাল। বললাম, রান্না কিছু করতে হবে না, বাড়ি গুছিয়ে চলে যাও। তাড়াতাড়ি যাও কারণ আমাদের আবার সিনেমা দেখতে বেরোতে হবে। দেবী চৌধুরানী, যত কাণ্ড কলকাতাতেই - দুটোই দিল্লিতে এসেছে। দেবী চৌধুরানী প্রোমোশনের অংশ হিসেবে নায়িকারা ঘোড়ায় চড়ে হাতিবাগানে ঘুরছেন দেখে পাঁচ মিনিট প্রাণায়াম করতে হয়েছিল, ও জিনিস ফুল লেংথ দেখা রিস্ক ভেবে যত কাণ্ড কলকাতাতেই-এর টিকিট কেটেছি। কেমন দেখলাম, আপনাদের দেখা উচিত কি না, সে সব পরে হবে। না হলেও অসুবিধে নেই।
সি আর পার্ক থেকে এই ক’দিন কোথাও যেতে গেলে বা সি আর পার্কে আসতে হলে হেঁটে হেঁটে কালকাজী পর্যন্ত আসতে হয়, তারপর অটো নিয়ে নেহরু প্লেস। দু'জনের কেউই আয়না দেখা টাইপ নই, কিন্তু নেহরু প্লেসের পি ভি আর আইনক্স-এর দোতলায় ওঠার সিঁড়ির বাঁদিকের দেওয়ালের আয়নাতে প্রতিবার নিজেদের দেখি। এই আয়নাটায় আমাদের দাম্পত্য দেখা যায়। একা যেমনই দেখতে হই না কেন, অর্চিষ্মানের পাশে মন্দ না। অর্চিষ্মানেরও একই মত। এই আয়নাটাতে আমাদের ভালো দেখায়, তাই না?
ষষ্ঠী
হ্যালো, বাবা?
বাবাগো, বাবা কীসের মধ্যে বসে আছেন? এত আওয়াজ কীসের? তুমি কি মণ্ডপে নাকি?
বাবা বাড়িতেই। মাইকের চোঙা ঠিক আমাদের বাড়ির দিকে তাক করে লাগিয়েছে, তাতে ওই নরক গুলজার। ভয়ে ভয়ে বাবাকে জিজ্ঞাসা করছি, বাবা নিঃসঙ্গ ফিল করছেন কি না। আমি এত বেড়িয়েখেলিয়ে বেড়াচ্ছি, বাবার পুজো হয়ত খাঁ খাঁ।
বাবার পাঁচদিনই বুকড। ষষ্ঠী টু দশমী। আজ পাড়ায় অনাথ আশ্রম থেকে বাচ্চারা আসবে। খাওয়াদাওয়ার, উপহার দেওয়া ও বাচ্চাদের সঙ্গে আলাপচারিতা। বাবা রেডি হচ্ছেন। বাকি চারদিনেরও এজেন্ডা জানিয়েছিলেন বাবা, হিংসের চোটে মনে রাখতে পারিনি। ফোন রেখে অর্চিষ্মানকে ঠেলে তুললাম। অর্চিষ্মান, নেক্সট পাঁচদিনের জন্য ফান অ্যান্ড গেমসের ব্যবস্থা কর, জলদি। অর্চিষ্মান বলল, ফান অ্যান্ড গেমস পরে হবে কুন্তলা আগে কর্তব্য। জীবনের জোয়াল ঠেলা। এক সেট জামা ধোপাবাড়ি দিতে হবে, এক সেট ড্রাই ক্লিনিং। চারটে এক্সটেনশন কর্ড খারাপ হয়ে পড়ে আছে, ইলেকট্রিশিয়ানের দোকানে দিতে হবে। আমাদের একটা খতরনাক ফোন চার্জার আছে, গুঁজলেই এক্সটেনশন ফট ফট ফাটতে থাকে। শেষটা ফাটার পর ভিলেন আইডেন্টিফাই করা গেল। চার্জার ফেলে দিয়ে নতুন এক্সটেনশন কর্ড কিনতে গেলাম। সুমন ভুরু কোঁচকাল। এই সেদিন একটা নিয়ে গেলেন না? বললাম। সুমন আমার দিকে লিটারেল হাঁ করল। এক্সটেনশন কর্ড ফাটছে আর আপনি কিনে যাচ্ছেন? বললাম, হ্যাঁ। এটা কত নম্বর কিনবেন? বললাম, চারটে ফেটেছে কাজেই পাঁচ। সুমন, আমার থেকে অন্ততঃ পনেরো বছরের ছোট, বলল, বেচব না। বাড়ি যান। খারাপগুলো ফেলে দিয়েছেন?
ফেলব ফেলব করছি।
ফেলবেন না, নিয়ে আসুন।
ষষ্ঠীর দিন সকালে অর্চিষ্মান দুই হাতে দুই ধোপার প্যাকেট, আমি এক হাতে চারটে এক্সটেনশন কর্ডের থলি ঝুলিয়ে চললাম। দুজনে একই দিকে চলেছি, রাস্তার দু’দিক দিয়ে। যেতে যেতে অর্চিষ্মান ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে প্রতিবেশীর সঙ্গে দেখা হয়ে যাওয়ার মতো হাসছে।
এই অদ্ভুত আইডিয়াটা অর্চিষ্মানের। অনেক কাজ সারার থাকলে আমার স্ট্র্যাটেজি হচ্ছে বাচ্চাদের হাঁটা শেখার স্ট্র্যাটেজি। আইস স্কেটিং-ও নাকি বাচ্চারা ওই ভাবেই শেখে। যত স্পিডে, যথাসম্ভব দূরত্ব কভার করে ধুপ করে পড়ে যাওয়া। আমিও হাতের কাছে যা পাওয়া যাচ্ছে দিয়ে শুরু করি, যতক্ষণ এনার্জি থাকে চালাই, এনার্জি শেষ হলে শুয়ে পড়ি। যেটুকু বাকি থাকে, থাকে।
অর্চিষ্মান মাথা নাড়ে। কুন্তলা, আগে ভাবো। কী ভাবে, কোনদিক থেকে অ্যাটাক করবে। অর্চিষ্মান ভেবে স্থির করেছে। আমি ইলেকট্রিক্যালসের দোকানে যাব, ও কাচার ব্যাপার সামলাবে। তিনটে দোকানই এক্স্যাক্ট একদিকে, কিন্তু এফিশিয়েন্সির জন্য একসঙ্গে যাওয়া যাবে না। আলাদা আলাদা যেতে হবে।
কাজেই সেই মুহূর্তে অর্চিষ্মান দুই হাতে দুই ঘেমো জামাপ্যান্টের থলে নিয়ে রাস্তার ওদিক দিয়ে চলেছে, আমি এক হাতে এক্সটেনশন কর্ডের ব্যাগ ঝুলিয়ে রাস্তার এদিক দিয়ে চলেছি। অর্চিষ্মান মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে হাসি হাসি মুখে আমার দিকে তাকাচ্ছে। এই অদ্ভুত পরিস্থিতি সহ্য না করতে পেরে ধুত্তেরি বলে রাস্তা ক্রস করে অর্চিষ্মানের পেছন পেছন ড্রাই ক্লিনিং-এর দোকানে ঢুকে পড়লাম। অর্চিষ্মান বলল, একী, এফিশিয়েন্সি কম হয়ে যাচ্ছে, বেরোও বেরোও। বলে আমাকে বার করে দিল।
সুমনের দোকানে গেলাম। সুমন এক্সটেনশন কর্ডের ব্যাগ নিয়ে বলল, ওকে বউদি। আমি বললাম, কবে ফোন করব? সুমন বলল, বউদি ডেসপারেশন ইজ নট কুল, ইচ্ছে হলে আমিই ফোন করব। আপনার নম্বর দিন। সাহিল, ভাবীজিকি নম্বর লিখলে। সাহিল শার্পি দিয়ে এক্সটেনশন কর্ডের পেছনে আমার নম্বর লিখে নিল।
ডেসপারেশন কি সাধে? আমাকে কেউ কোনওদিন ফোন করেনি, সুমন বা সাহিলও করবে না জানতাম। কাল বিকেলে নিজেই সেধে গিয়ে সারানো এক্সটেনশন কর্ডগুলো নিয়ে এসেছি।
কিছু রোদ। বাপরে বাপ। আমার শ্যামবর্ণ বেগুনি হয় হয়। একজন সাহেব জাঁকালো ধুতিপাঞ্জাবী পরে বাজারে ঢুকছেন। “অসাম” বলে ভারতনাট্যমের মুদ্রা করলাম, সাহেব খুশিতে নুয়ে পড়লেন। সকাল সাড়ে ন’টা, ফুচকার স্টল রেডি হচ্ছে। আমার ফুচকা খেতে ইচ্ছে করছে। ষষ্ঠীর সকালে একা একা ফুচকা খাওয়া মহিষাসুরোচিত হব ভেবে অর্চিষ্মানকে ফোন করছি। অবশেষে ধরল। কুন্তলা, তুমি ফুচকা খাও, দিদি বই পাঠিয়েছে, ডেলিভারির লোক বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে ফোন করছে, আমি যাচ্ছি।
ফুচকা খেয়ে এদিক থেকে বাড়ির দিকে যাচ্ছি, অর্চিষ্মান বই ডেলিভারি নিয়ে বাড়ি থেকে এদিকে আসছে। মাঝখানে মেলা গ্রাউন্ডে ঢাক বাজছে। দু’দিক থেকে এসে মেলা গ্রাউন্ডের গেটে কনভার্জ করে দুজনে ঢুকে গেলাম।
কাল পর্যন্ত ঠাকুরের মুখ কাগজ ঢাকা ছিল, এখন খোলা। চটি খুলে সামনে এগিয়ে গেলাম। এই প্রথমবারই যা খুঁটিয়ে দেখা। এর পর তো ঝাড়লণ্ঠন আর খাওয়াদাওয়া। <
অর্চিষ্মান বলল, সুন্দর হয়েছে, বল?
সুন্দর তো হয়েইছে। এক চালা ঠাকুর। আমার ফেভারিট। তবে সবাই যেন একটু দূরে দূরে। আমার ঘেঁষাঘেঁষি ঠাকুর ভালো লাগে।
দুর্গাঠাকুরের প্রতিমা মধ্যে যে একটা অসামঞ্জস্য, ফ্যাসিনেটিং। মাঝখানে এই রকম রক্তারক্তি চলছে, মা একটা খুন করতে চলেছেন, বা বলা যায় না হয়তো নিজেই খুন হয়ে গেলেন, অথচ চারজন সন্তান হাসি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে। কোনও দুর্গার হিংস্র মুখ, কথাকলি চোখ। কিছু মূর্তিতে মহিষাসুর দাঁত খিচিয়ে খাঁড়া উঁচিয়ে মারতে এদিকে ঠাকুর ত্রিশূল মাটিতে বিঁধিয়ে দর্শকদের উদ্যত ফোনের দিকে মিষ্টি হেসে তাকিয়ে। দাঁড়া তোকে পরে খতম করব, আগে পোজ দিয়ে নিই।
আমি মহিষাসুরকে সমীহ করি। বছর বছর হারছে, অথচ ফাইট দেওয়াতে কোনও ফাঁকিবাজি নেই।
মেলা গ্রাউন্ডের ইঁদূরের স্টেজ ফ্রাইট। গণেশের ধুতি আঁকড়ে মুখ তুলে 'আমাকে কোলে নাও' ভঙ্গি করছে। পেঁচা ফুল ব্লোওন বিপিডি। শিকারীর ভঙ্গিতে দুই ডানা তুলে দাঁড়িয়ে। অর্চিষ্মানকে বলছি, ডানাটা দেখছ ? অর্চিষ্মান বলছে, গোঁফটা দেখ। দেখার মতোই। পেঁচাকে ফেরোশাস বানাতে একটা সরু মোচড়ানো গোঁফও দিয়েছে।
অর্চিষ্মান খাবারের দিকে চলেছে। এখনও তো কিছু বসেনি। লিট্টির ছাতু মাখা চলছে বিরাট থালায়। পেঁয়াজ কুচোনো হচ্ছে। অর্চিষ্মানের ফেভারিট কাবাব কোর্মা কালিয়ার স্টলের সারি, সকাল দশটায় শ্মশান।
অর্চিষ্মান চকলেট ভ্যানিলা মিক্সড সফটি নিল। আমি কালা খাট্টা চুসকি। দুটো নিয়েই রাস্তায় হাঁটা যায় কাজেই বেরিয়ে পড়লাম। হেঁটে হেঁটে ব্লু টোকাইতে চলে এলাম।
কাজ হচ্ছে, আবার হচ্ছে না। অদ্ভুত দিন। এই রোদ, এই মেঘ। শরতের রোদের ঝিলিমিলি নেই। পুরোটাই ঝাঁ ঝাঁ। অর্চিষ্মান নতুন টি শার্ট পরেছে। আমি পুরোনো জামা পরেই এসেছি। কী করে পরব, আমার তো নতুন জামা হয়নি। কাল নতুন জামার না হওয়ার প্রতি যত কুলনেস বোধ করছিলাম, ততটা আর করছি না। 'কী হবে নতুন জামা' ক্রমশঃ 'দরকার নেই আমার নতুন জামার' চেহারা নিচ্ছে।
এমন সময় একজন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। আমার চেনা। বাচ্চা ছেলে। আমি একটি গায়ে-পড়া কুকুরছানার পার্সোন্যালিটি অ্যাংশাস অ্যাটাচমেন্ট বলাতে চোখ কপালে তুলেছিল। আপকো অ্যাটাচমেন্ট থিওরি পতা হ্যায়? ভেবেছে হনুমান চালিসাই পতা হ্যায় বুঝি।
যাই হোক, সে ছেলে মেরুন পাঞ্জাবি পরে ব্লু টোকাইয়ের দরজা ঠেলে ঢুকল। ইউথ। যৌবন। যখন ছিল মর্ম বুঝিনি, কিন্তু স্বপ্নের মতো মনে পড়ে এবং আমার মতো অপদার্থের কপালেও যে এ জিনিস ঘটেছিল সে ভেবে কৃতজ্ঞ বোধ করি। কখন এল, কখন গেল, কতদিন থাকল - কিছুই মনে নেই আর, কিন্তু সবার যখন আসে আমারও এসেছিল নিশ্চয় এই ভেবে বিস্মিত হই।
অর্চিষ্মানের সঙ্গে এই নিয়ে কথা হয়। বহিরঙ্গ মিস করার কিছু নেই আমার, অর্চিষ্মানও নাকি ভেতরটা মিস করে। বলে, এ রকম ছিলাম না আগে। আগে কত সহজে অ্যাকসেপ্ট করতে পারতাম। একটা লোককে দেখার পাঁচ মিনিটের মধ্যে জাজ করে ফেলি। খারাপগুলো আগে চোখে পড়ে। ব্রেন, মন, হৃদয় সবই জমাট বেঁধে যাচ্ছে।
ভেতর বাহির যে কারণেই হোক, যৌবন সুন্দর। চারপাশটাও চাঙ্গা করে তোলে। ধ্যাষ্টামোর ডালা বন্ধ করে বললাম, এনাফ ইজ এনাফ, চল জামা কিনব। অর্চিষ্মান বলল, আমি তো কেনো কেনো বলে বলে মুখে রক্ত তুলে ফেললাম, কুন্তলা। আমি বললাম, জানি তো। আমারই মাথা খারাপ, তুমি নির্দোষ।
এ বাজারের সুবিধে, আমাদের পছন্দের সব দোকানই আছে। ফ্যাবইন্ডিয়ায় ঢুকে গেলাম। একটা সাদার ওপর ফ্যাকাশে নীলের সুতি, আর একটা পেঁয়াজ রঙের সিল্কের কুর্তা কিনে দিল অর্চিষ্মান। আর একটা সোনালি পাজামা।
আরও কিছুক্ষণ কাজের ভঙ্গি করে আমরা বাড়ি চলে এলাম।
ষষ্ঠী রাত
দশমীতে বাড়িতে বন্ধুরা এসেছিল, সবারই ইউনিভার্সিটিতে নাকি নিজস্ব জাতীয় সংগীত চালু হয়েছে। গর্ব কম পড়ে যাচ্ছে। জন্মের গর্ব, জাতের গর্ব, গায়ের রঙের গর্ব, শিক্ষার গর্ব, অশিক্ষার গর্ব, জাতীয়তাবাদের গর্ব, গ্লোবাল সিটিজেনশিপের গর্ব, ভাষার গর্ব, ফুডি হওয়ার গর্ব, উপোস করার গর্ব, লিঙ্গপরিচয়ের গর্ব, যৌনপরিচয়ের প্রাইড। সেকুলার হওয়ার গর্ব, ফেকুলার না হওয়ার গর্ব। পলিটিক্যালি কারেক্ট এবং ইনকারেক্ট হওয়ার গর্ব। তারকভস্কি দেখা এবং না দেখার গর্ব। স্কুল কলেজের গর্ব বোঝাতে এতদিন হুডি ছাপালেই চলত, এখন জাতীয় সংগীত লিখে সুর করে গাইতে হচ্ছে। কথা সুর আলাদা, ভাব সেম। আমরা সেরা। আমাদের মতো আর কেউ নেই, কিছু নেই। সব শালা আমাদের তুলনায় নিকৃষ্ট।
আমার আর অর্চিষ্মানেরও আছে। জাতীয় বলা যায় না, সাংসারিক সংগীত বলাই উচিত হবে। একটা হচ্ছে, হেউ। একটা হচ্ছে, ভালো কী খাওয়া যায়? আর একটা, চল বেরোবে?
তিন নম্বর সংগীত কে গাইল মনে নেই, দু’জনের মধ্যে কেউ একটা। বেরিয়ে পড়লাম।
যদিও নতুন জামা কেনা হয়েছে, রোজকার জামাই পরেছি। অ্যাট লিস্ট, আমার জামাটা বাইরে যাওয়ার। অর্চিষ্মান বেরিয়েছে কালো ট্র্যাকসুট আর একটা পনেরো বছরের পুরোনো টি শার্ট পরে, যেটার হেম খুলে সুতো ঝুলছে। আমি অর্চিষ্মান নন-অর্চিষ্মান কারও চেহারা বা পোশাক নিয়ে মন্তব্য করারই পক্ষপাতী নই। সেই আমিও পারলাম না। টেনে সুতোটা ছিঁড়ে বললাম, এ রকম জামা পরে কেউ ষষ্ঠীর দিন বেরোয়? সবাই তোমার দিকে তাকাচ্ছে।
অর্চিষ্মান বলল, সেটাই কি উদ্দেশ্য নয়? বিশ্বশুদ্ধু লোকের আইবল আকর্ষণ করা? বাকিরা পাগলের মতো সেজে যা পারেনি, আমি না সেজেই তা অ্যাচিভ করেছি।
প্রসেনজিৎ মেলা গ্রাউন্ডের প্যান্ডেল থেকে বেরোচ্ছিল। হাত নেড়ে বলল, এখানে ঢুকতে পারবে না। লাইন দেখো গে যাও। সত্যিই পারব না।বাঁশের ব্যারিকেড অলরেডি মচমচ করছে। পুলিসে ছয়লাপ। ভলান্টিয়ারের ফুরফুর বাঁশি। ফুরফুরডি ব্লকের প্যান্ডেলে চলে গেলাম। ঠাকুর প্রতি বছরের মতো সাবেকি ও সুন্দর। সাংস্কৃতিক মঞ্চে লোক্যাল লোকজনের নাচ হচ্ছে, এর পর লোক্যাল লোক গাইবেন। ভি আই পি সেকশনটেকশন নেই। ডেকোরেটরের নোংরা চেয়ার একসময় সারিতে সাজানো ছিল, এখন যে যার মতো টেনে টেনে ফ্যানের তলায় নিয়ে গিয়ে জটলা পাকিয়েছে। কেউ কিচ্ছু শুনছে না, কিচ্ছু দেখছে না, গপ্পাচ্ছে, কিন্তু নাচগান শেষ হলে জোরে জোরে হাততালি দিচ্ছে।
ভরতনাট্যম কত্থক ফিউশন নাচ হচ্ছিল। মাস্টারমশাই নিজে মনে হয় ভরতনাট্যমের লোক। কারণ, পক্ষপাতিত্ব উদোম। এঁরা মঞ্চের দুই তৃতীয়াংশ দখল করে হাত ফুল স্ট্রেচ করে পা ছুঁচ্ছেন, কত্থকের তিনজন কোণে ঘুচিমুচি হয়ে বাঁই বাঁই পাক খাচ্ছেন। দুটো চেয়ার পাওয়া গেছিল, অর্চিষ্মান ‘যাই ফিশফ্রাই খেয়ে আসি’ বলে আই এফ বি-র স্টলে চলে গেল। ‘চেয়ার রাখো,’ আদেশ দিয়ে। ফোন ছাড়া কিছুই নিয়ে বেরোইনি। চেয়ারে মালিকানার প্রমাণ হিসেবে রাখতে যাব, হাতের নিচ থেকে চেয়ার নিয়ে একজন চলে গেলেন। যে রকম তাকালেন, ছাই হয়ে যাইনি যে আশ্চর্য।
অর্চিষ্মান এসে এমন ভাব করল যেন আমি ক্যাবলা বাংলা মিডিয়াম বলে চেয়ার রাখতে পারিনি, ও থাকলে সাউথ পয়েন্ট সপ্রতিভতায় দুটো হাত দুটো পা তুলে একাই চারটে চেয়ার দখল করে রাখত। আমি, গলতি হো গয়া সরকার, মাফ কর দিজিয়ে, বলে নিজের চেয়ারের অর্ধেকটা ওকে ছেড়ে দিলাম। দুজনে একই চেয়ারে হাফ হাফ বসে নাচ দেখতে থাকলাম।
সরি, নট সরি, মাস্টারমশাই সবথেকে খারাপ নাচেন। ছাত্রীরা খুবই পরিশ্রম করে নাচছিলেন। মাস্টারমশাই একটুও রিহার্সাল দেননি, স্টেজে মারার তাল করেছেন। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। আরও একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে বাকি সবাই কত্থক ভরতনাট্যমের নিয়মমাফিক সেজেছেন, এরা কোঁচা দিয়ে শাড়ি, ওঁরা ঘেরওয়ালা কুর্তা, মাস্টারমশাই কেন যেন শিব সেজে চলে এসেছেন। ডাউন টু দা লাস্ট ডিটেল। জটাফটা, সাপফাপ। ওই সাজে গটগট করে স্টেজে হেঁটে বেড়াচ্ছেন, মাইক ধরে টানাটানি করছেন। অর্চিষ্মান অসভ্যের মতো হাসছিল। এত দুলে দুলে যে আমি অর্ধেক চেয়ার থেকে বেরিয়েই যাচ্ছিলাম। হাসতে হাসতে অর্চিষ্মান একটা থিওরি দিল, মাস্টারমশাই শিব সেজেছেন বলে বেশি হাস্যকর লাগছে। আমি বললাম, হ্যাট, মানুষ যে কোনও দেবতা সাজলেই ভণ্ড এবং হাস্যকর লাগে। মাস্টারমশাই গণেশ সাজলে হাস্যকর লাগত না?
অর্চিষ্মানের মতে লাগত না। গণেশ, কৃষ্ণ, হনুমান, সন্তোষী মা - সব অ্যাকসেপ্টেবল, শিব ছাড়া।
আই এফ বি-র দুটো মাছভাজা মেশিনের একটা খারাপ হয়ে গেছে, এখন একটাতে গোটা ডি ব্লকের মাছ ভাজা হচ্ছে। মেশিন যে খারাপ যে হয়েছে সেটা ওঁরা ডিসক্লোজ করছেন পেটিএম পেমেন্ট হয়ে যাওয়ার পর। কুড়ি মিনিট পর আসুন বলে হাঁকিয়ে দিয়েছে। অর্চিষ্মান দশ মিনিট পর পর যাচ্ছে আর হাঁকানি খেয়ে ফিরে আসছে। দশ মিনিট পর পর আমি ফুল চেয়ার জুড়ে বসছি আবার অর্চিষ্মান ফিরলে হাফ চেয়ার ছেড়ে দিচ্ছি।
একবার ফিরে অর্চিষ্মান বলল, যা অদ্ভুত সিচুয়েশন যদি দেখতে। একটাই মেশিন, মাছ ভাজছে। দোকানের ভেতর প্রচুর বিক্রেতা, দোকানের বাইরে প্রচুর ক্রেতা মেশিনটার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেশিনের জায়গায় অর্চিষ্মান থাকলে নাকি অ্যাংজাইটিতেই খারাপ হয়ে বসে থাকত।
অবশেষে মাছভাজা পাওয়া গেল।
ফিশ ফ্রাইয়ের দোকানের পাশে ট্যারো আলপনা-র দোকান। ভবিষ্যৎ জানা নিয়ে অর্চিষ্মানের উত্তেজনার কথা আগের বছরই লিখেছিলাম। বিজয়া করতে তিলকমামার বাড়ি গেছিলাম, বারান্দার দোলনায় দুলছিলাম, সামনের ক্যাবিনেটে একটা গোলাপি বেণীমাধব শীলে চোখ পড়েছে। ঠিক চোখে পড়েছে অর্চিষ্মানের। লাফ দিয়ে নিজের রাশিফল খুলে পড়তে লেগেছে। পড়তে পড়তে হাসি হাসি মুখ ক্রমশঃ ঘনিয়ে উঠল। এক তারিখে অসুখ, দু'তারিখে চিন্তা, তিন টু পনেরো টানা দুঃখ। মামি বলছে, জিষ্ণু ওটা আগের বছরের, তাতেও আশ্বাস পাচ্ছে না। বাড়ি এসেও বারদুয়েক বলেছে, একটা বেণীমাধব শীল কিনবে? ব্লিংকিটে পাওয়া যাচ্ছে কি না দেখো না।
ট্যারো দেখলেও অর্চিষ্মানের অজানাকে জানার বাসনা ঠেলা দিয়ে ওঠে। ঠেলায় অসুবিধে নেই, অসুবিধে হচ্ছে পেটে খিদে মুখে লাজে। ট্যারো কার্ড পড়িয়ে নিজের যুক্তিবাদী ইমেজ বিন্দুমাত্র কালিমালিপ্ত করবে না, কাজেই ক্রমাগত আমাকে ঠেলছে , যাও যাও আলপনাদি একা বসে আছেন, গিয়ে তোমার যা জিজ্ঞাসা করার করে এস।
আমার কিছু জিজ্ঞাসা করার নেই।
বাজে কথা বোলো না, যে প্রশ্নটা ভেবে ভেবে রাতে ঘুমোতে পারছ না সেটাই আল্পনাদির কাছে জানতে চাও। মরার আগে বিখ্যাত হবে কি না।
আচ্ছা তাহলে জিজ্ঞাসা কর যে বর মরার আগে বিখ্যাত হব কি না।
যেতাম, কিন্তু পার প্রশ্ন একশো টাকা দেখে পিছিয়ে এলাম। অর্চিষ্মান আরও পাঁচ মিনিট ঠেলাঠেলি করে ক্ষান্ত দিল চারপাশের ঘটনাবলীতে মনোযোগ দিল। একজন সবে হাঁটতে শিখেছেন, শিখেই বিশ্বের যত চুমকি আছে সব বসানো একজোড়া জুতোর মালিক হয়েছেন। এক পা ফেলে জুতোর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছেন, দাদু চল চল ঠেলা দিতে আবার অন্য পা তুলে মাটিতে ফেলে মুগ্ধ দৃষ্টিপাত। আমি শিকারী বাজের দৃষ্টিতে চারদিক মাপছি, চেনা কেউ বেরোয় কি না। বেরোলেই লাফিয়ে গিয়ে গল্প করব। বেরোল। ডাক্তারবাবু। ষষ্ঠীর পক্ষে বাড়াবাড়ি সেজে সস্ত্রীক ফাংশান দেখতে এসেছেন। আরও দু'জনের সঙ্গে দেখা হল। ব্লু টোকাইয়ের পরিচিত। খুঁজলে আরও বেরোত, অর্চিষ্মান বলল, রক্ষা কর কুন্তলা। আর লৌকিকতা কোরো না।
ভয়াবহ গরম। লোকে সিল্কের পাঞ্জাবী পরে, ফুল কভারেজ ফাউন্ডেশন মেখে গলগল করে ঘামছে। ফাউন্ডেশনের দোষ নেই, পাগলের মতো হিউমিডিটি চলছে। সিন্ধি সাই-য়ের দোকানে হুলিয়ে কোকুম শরবত বিক্রি হচ্ছে। নাচ শেষ, অর্চিষ্মানের ফিশফ্রাইও। এদিকের একটা দোকানে মকটেল বিক্রি হচ্ছে। অল মকটেলস এইটি রুপিস। আমি লেমন সোডা নিলাম অর্চিষ্মান মোহিতো না কী নিল। মা বাবা ছেলে, বা মা বাবা ভাইপো। অবাঙালি। কিছু পরিশ্রমী, ননস্টপ হাত চলছে। অর্চিষ্মান নিচু গলায় বলছে, ব্যবসা করা কী কঠিন না? সবাই আনন্দ করছে আমি শরবত গুলছি, ভাবো। আমি পারতামই না। তুমি পারতে? আমি শরবত নিয়ে থ্যাংক ইউ বলে বেরোতে বেরোতে বললাম, উঁহু। সেই জন্যই তো ওই গেঞ্জিটা আমার নেই। অর্চিষ্মান বলল, কোন গেঞ্জি?
ভদ্রলোকের গেঞ্জিটা দেখলে না? কমলা রঙের ওপর চনমনে সাদা অক্ষরে লেখা 'স্টে হাম্বল হাস্ল হার্ড'?
প্যান্ডেল থেকে বেরোচ্ছি, গান শুরু হল। এই ভদ্রলোকের গান আগেও শুনেছি, কিশোরকুমারের গলায় গান করেন। অর্চিষ্মান তখনও ট্যারো নিয়ে ভেবে চলেছে। বলল, যাওনি যে ভালোই করেছ। আলপনাদির স্ট্র্যাটেজি কী হত বল তো? একটা উত্তর এমন জায়গায় শেষ করা যাতে তুমি পরের প্রশ্নটা করতে বাধ্য হও। মানে তোমাকে বলতেন, বিখ্যাত হবে কিন্তু তার আগে একটা কাজ করতে হবে। ব্যস। এবার তুমি কাজটা জানার জন্য নিশ্চয় পরের প্রশ্নটা করবে আরও একশো টাকা দিয়ে।
ডি ব্লক থেকে মেন রোডে আসার পথটা খালি খালি। অন্ধকার অন্ধকার। পাঁচশো মিটার গেলেই লোকে পদপিষ্ট হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু ওই স্ট্রেচটুকু পেরোতে পেরোতে একজন শুনি হিন্দিতে বলছেন, পতা হ্যায়, রাত কো টিমোরপুর অ্যায়সা রহতা হ্যায়।
পরের বছর থেকে টিমোরপুর হি যানা, ভাইসাব। যত্তসব।
এমন সময় ভাইয়াআআআ, ভাইয়াআআআ, ভাবীইইই, ভাবীঈঈঈ। ডাকাত পড়ার মতো চেঁচাচ্ছে। কেউ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে তার দিকে না তাকালেও যেমন বুঝতে পারি, তেমনি নাম না নিলেও চেঁচানিটা যে আমাদের উদ্দেশ্যেই, স্পষ্ট বুঝতে পারলাম। আমাদের ধোপা ভাইয়া এবং ভাবী। অর্চিষ্মান মাথা চাপড়ে দৌড়ে গেল। দৌড়নোর দরকার ছিল না, কিন্তু সকালে জামাকাপড় কাচতে দিয়ে ভুলে গেছি সেটার অ্যাপোলজি বোঝাতে ওই দৌড়। কেউ যদি গাড়ির স্পিড কমিয়ে আমাকে রাস্তা পার হতে ইশারা করেন, তাহলে আমিও দরকার না থাকলেও দৌড়ে রাস্তা পার হই। ওটা হচ্ছে ওঁর কনসিডারেশনের বদলে আমার থ্যাংক ইউ।
প্যাকেট নেই, ইস্তিরি করা জামার বোঝা হাতে নিয়েই চলেছে অর্চিষ্মান। গলি থেকে বেরোলাম। দু'নম্বর মার্কেটের সামনে থেকে জনস্রোত লাইন দিয়ে মেলা গ্রাউন্ডের দিকে চলেছে। মেলা গ্রাউন্ডের মঞ্চে বিটের গান হচ্ছে। নাচের উল্লাস শুনতে পাচ্ছি। বললাম, ঢুকবে? অর্চিষ্মান বলল, তুমি কি পাগল কুন্তলা, লাইন দেখেছ? আমি বললাম, লাইন তো রোজ থাকবে, ঢুকবই না নাকি?
আচ্ছা, কাল যত লাইনই থাক, ঢুকব।
ছাতিমের গন্ধ অলরেডি ছড়াতে শুরু করেছে। অর্চিষ্মান বলল, এটা আমার কাছে দিল্লির গন্ধ। তোমার?
আমারও। অর্চিষ্মানের ভাঁজ করা কনুইয়ে হাত গলিয়ে বললাম। এ এক অলীক মুহূর্ত। চারদিকে আলো, রোশনাই, বেলুন, আলোজ্বলা মহিষাসুর সিং, কাঞ্জিভরম, সিল্কের পাঞ্জাবী, শাড়ি, গাউন, ক্রপ টপ। এর মধ্যে আমি আর অর্চিষ্মান, বিভিন্ন ডিগ্রির ধুদ্ধুড়ে জামাকাপড় পরে ধোপাবাড়ির জামাকাপড় হাতে নিয়ে, ছাতিমের গন্ধে ভাসতে ভাসতে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরছি।
সপ্তমী
আজ ওয়ার্ক ফ্রম হোম নিয়েছিল অর্চিষ্মান। আমি সকালেই ব্লু টোকাই চলে গেছিলাম, অর্চিষ্মান দুপুরে গেছিল। বিকেলে বাড়ি ফিরে আবার ডি ব্লকের প্যান্ডেলে গিয়েই বসেছিলাম। সা রে গা মা পা-র ফাইন্যালিস্ট আরাত্রিকা গাইলেন। আবার মকটেল খেলাম। এবার দুজনেই লেমন সোডা। আরাত্রিকা রবীন্দ্রসংগীত গাইছিলেন। বাড়িতে এসে আমরা ইউটিউবে দেবব্রত বিশ্বাসের রবীন্দ্রসংগীত চালিয়ে শুনলাম একের পর এক। এটা একেবারেই আরাত্রিকাকে অ্যাটাক নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গাওয়ার ধরণ বদলে যাওয়ার অবজারভেশন। আমার আজকাল গান শুনলে, বিশেষ করে বাংলা গান, বিশেষ করে রবীন্দ্রসংগীত, মনে হয় বড় বেশি নুয়ে পড়া। দাঁত চাপার দোষ গিয়ে নুয়ে পড়ার দোষ ঢুকেছে। আমার থিওরি হচ্ছে, বাঙালির কাছে গানের সুর তাল লয় সম্পূর্ণ ব্যাকসিট নিয়ে সম্পূর্ণ কথাপ্রধান হয়ে উঠেছে। প্রতিটি লাইনের প্রতিটি কথা প্রাণপণ ফিলিং দিয়ে গাইছে সবাই। আমার কানে মোটেই সুবিধের ঠেকছে না, বাকিদের জানি না। সেদিন একজন ভায়ের মায়ের এত স্নেহ গাওয়ার সময়, স্নেহটা এমন আলতো করে উচ্চারণ করলেন যে আর একটু হলে তাল কেটে যাচ্ছিল।
অষ্টমী
আজকেও বাড়ির দিকে মুখ করা চোঙা থেকে গাঁকগাঁক অঞ্জলির শব্দ হচ্ছে। বাবা চমৎকার ব্রেকফাস্ট করে ফেলেছেন। দোকানেও যেতে হয় না বাবার, ভালো ভালো খাবার বাড়ি বয়ে আসে বাবার কাছে। সকালে খিচুড়ি নিয়ে এল কেউ, রাতে মাটন আনবে আর একজন। আমরা অত লাকি নই। আমাদের মজা করতে হলে শিকারে বেরোতে হয়। কাল ওয়ার্ক ফ্রম হোম নিয়েছিল অর্চিষ্মান। আজ আবার আজ আলাদা আলাদা সব। বিচ্ছিরি।
আজ কালীবাড়িতে মোদী আসছে। ঝাঁট দেওয়া রাস্তা, আবার করে ঝাঁট দেওয়াচ্ছে। ষষ্ঠীতে দিল্লির চিফ মিনিস্টার নাকি কোন প্যান্ডেলে এসে ধুনুচি নাচ নেচেছেন। জি কে টু-র এম ব্লকের দক্ষিণায়ন পুজো মার্কেটের পার্কেই হয়। মাইকে বলা হচ্ছে ফুল ছুঁড়বেন না, ঝুড়ি যাচ্ছে, ঝুড়িতে ফেলুন।
ছোটবেলায় অষ্টমী ঢুকলেই মন খারাপ হত। কারণ দুপুর মানেই তো সন্ধে। ইন্টারভ্যাল মানেই তো দি এন্ড। মাঝবয়স মানেই তো… যাক গে।
পাঁচ নম্বর টেবিলে সেটল করে ল্যাপটপ খুলেছি, ব্লু টোকাইয়ের দরজা খুলে খুলে এক দুই তিন চার করে বাঙালি ঢুকছে। এ তল্লাটে বাঙালি এমনিতেও ঘোরাঘুরি করে। আমাকে আগেও লোকে বলেছে, অল দিজ পিপল আর ফ্রম ক্যালকাটা। ক্যাফেতে ক্যাফেতে নাকি "কলকাত্তা কে লোগ ভরে পড়ে হ্যায়"। স্বাভাবিক, গড়িয়াহাট বাজারে কসবার লোক ঘুরবে না তো কি আমি ঘুরব? কিন্তু সারা বছর আমরা চুপচাপ ঘুরি, বেশি লাফালাফি করি না। সেটার কারণও আন্দাজ করা অসম্ভব নয়।। অর্চিষ্মান ওর এক বন্ধুর অভিজ্ঞতা বলেছিল, আমি এখনও কল্পনা করতে পারি না, অকল্পনীয় বলেই সত্যি হলেও হতে পারে। দু’জন বাঙালি ছেলে নাকি গ্রিন লাইন চড়ে টিকরি বর্ডারের কাছে বাহাদুরগড় না কোন স্টেশন দিয়ে বাংলায় কলকল করতে করতে চলেছিল, উল্টোদিকে এক স্থানীয় লোক বসেছিলেন তিনি "ইতনি বাংলা কিউ বে," বা সিমিলার অনুভূতি প্রকাশ করে দুজনের গালে ঠাস ঠাস করে চড় কষিয়ে নেমে গিয়েছিলেন।
আমাকে শরদ বলেছে, রাস্তার ওদিকের ব্লু টোকাইতে নাকি সব কলকাতার লোক, সে জন্য ওকে ক্যাফে চেঞ্জ করে রাস্তার এদিকের ব্লু টোকাইতে আসতে হয়েছে। বলে শরদ লজ্জা লজ্জা মুখে আমার দিকে তাকিয়েছিল আমি কত জোরে ফেটে পড়ি দেখতে, হাই ফাইভ দিয়ে বলেছিলাম, আমি হলেও পালাতাম। কলকাতার লোক, ডেঞ্জারাস। স্যাম্পল এক একটা।
এখন প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ত্রিশূল নিয়ে আমাদের ব্যাক আপ এসে গেছে, কাজেই বাঙালিদের কনফিডেন্স আকাশ ছুঁয়েছে। পাঞ্জাবীরা সারাবছর বেন্টলি নিয়ে যা করতে থাকে, আমরা এই পাঁচদিন তন্তুজ পরে টোটো চড়ে তার ওপর দিয়ে যাই। আমরা গটমট করে হাঁটছি, চেঁচিয়ে বাংলা বলছি। এই ক’দিন সি আর পার্ক ও তার সন্নিহিত অঞ্চল দেখলে মনে হয়, পৃথিবীর যত বাঙালি একটা মস্ত বেলুনে পুরে আকাশে তুলে, সে বেলুনে পিন ফুটিয়ে দিয়েছে কেউ, আর নীল ধুতি লাল পাঞ্জাবী কাঁথা স্টিচ পরা বাঙালি আকাশবাতাস থেকে ঝরে পড়েছে।
এগারোটা বাজতে না বাজতে ব্লু টোকাই পশ্চিমবঙ্গ হয়ে গেল। আশি পারসেন্ট ক্লায়েন্টেল ধুতি, শাড়ি, পাজামা, পাঞ্জাবী। পঞ্চাশ পারসেন্টের নামের আগে শুভ, শেষে জিৎ।
যত ভাবি বাঙালির নিন্দে করব না, অন্ততঃ পুজোর দিনক’টা, কিন্তু অনিন্দিত হতে বাঙালিদেরও তো কিছু দায়িত্ব নিতে হবে? নিন্দেও না, এই পয়েন্টে জাস্ট অসহায় চেয়ে দেখা। এই যেমন একটা ফ্যামিলি ঢুকল। বাবা মা, ছেলে। ছেলে সম্ভবতঃ স্কুলের শেষ বছরকয়েক। ফ্রেন্ডলি ফ্যামিলি, একে অপরকে রীতিমত পছন্দ করেন। ছেলের প্রতি অতি স্নেহপ্রবণ। ছেলের নাম অনি। অনি নামের কিশোরদের যেমন দেখতে হওয়ার কথা ঠিক তেমন দেখতে। শান্ত, পাতলা ফ্রেমের চশমা, সবুজ পাঞ্জাবী সাদা পাজামা। বাবা মা কফি নিয়েছে, অনি ওয়াটারমেলন কুলার না কী একটা।
ব্যস। মা ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। কী? না কুলারে বরফ বেশি পড়ে গেছে। অনি, বরফ খেলে গলা ব্যথা করবে কিন্তু, অনি। অনি, লেটস আস্ক দেম ফর আ স্পুন, তুলে ফেলে দাও। অনি, তুমি কিন্তু কথা শুনছ না। অনি। অনি। অনি। অনিরও জেদ চেপে গেছে, সে কুলারের গ্লাস মায়ের নাগালের বাইরে রাখতে চেয়ারে বসে বসে যতটা লাফালাফি করা সম্ভব, করছে। মা, কাম ডাউন, প্লিজ। বাবা বলছেন, বেবি প্লিজ কাম ডাউন।
আর একজন মা, দুই মেয়েকে পাস্তা না কী একটা কিনে দিয়েছেন। মেয়েরা এক গ্রাস করে মুখে পুরছে আর মা বলছেন, আর খেয়ো না, তাহলে ভোগ খেতে পারবে না। যতক্ষণ পাস্তা শেষ না হল, মেয়েরাও খেয়ে গেল, উনিও বলে গেলেন। শেষটা আবার দলমত জোগাড় করতে আশেপাশের বাঙালিদের বলছিলেন, আরে এখন খেলে ভোগ খেতেই পারবে না। আমি জানি তো।
সে জায়গায় অবাঙালি বাচ্চা? এই কফিশপেই দেখি। দৌড়চ্ছে, ডিগবাজি খাচ্ছে, চেয়ার তুলে দোকানের বাইরে ছুঁড়ে ফেলছে, দুমদাম করে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ছে, শেফ বলছেন, বাহার যাও বাহার যাও, পাঁচজন দামড়া অ্যাডাল্ট, দৃকপাতমাত্র করছেন না।
অর্চিষ্মান একটা ইন্টারেস্টিং পর্যবেক্ষণ করেছে। সেটা হচ্ছে শুরুতে বাঙালি বাবামা বাড়াবাড়ি রকম কন্ট্রোল করেন বটে, ডাইনে যাও বাঁয়ে যাও, কান ঢাকো ঠাণ্ডা লেগে যাবে, কিন্তু বাঙালি বাচ্চারাই অ্যাকচুয়ালি বড় হয়ে বাবামাকে কাঁচকলা দেখিয়ে জীবন চালায়।
ঠিকই বলেছে। এই অনি, আর কয়েকবছর পর থেকে একটি ভালো কথাও শুনবে না। সায়েন্স পড়ার বদলে কমার্সে ঢুকবে, একে বিয়ে কর বলে দৌড়ে গিয়ে ওকে বিয়ে করে ফেলবে। আর যে স্যাম্পল ব্লু টোকাইয়ের রান্নাঘরে ঢুকে পড়ছিল, সে একটা সিংগল ফটাফট মাম্মিপাপার অনুমতি না নিয়ে খাবে না।
বৃষ্টি নামল। ষষ্ঠী সপ্তমী যে রেটে ঘামিয়েছে, নামবে জানতাম। অর্চিষ্মান হোয়াটসঅ্যাপে লিখল, আঁধি আসছে কুন্তলা। দিল্লিতে একটা ঝড় ওঠে, ভয়ানক কালো করে আসে, তার পর একটা হাওয়া দেয়। তখন দিল্লি, এন সি আর, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, পশ্চিম রাজস্থান ও উত্তর-পশ্চিম গুজরাটের যত ধুলো, আকাশে উড়তে থাকে। এই চলে আধঘণ্টা। তারপর গুনে গুনে দু’মগ জল পড়ে আকাশ থেকে, তাতে সব ধুলো গুলে কাদা হয়। চারপাঁচটা বিরাট বিরাট গাছেরা দেহ রাখে, আর সবাই বলে উফ, কেয়া আঁধি আয়ি থি।
বৃষ্টি থামলে দৌড়ে বাড়ি চলে এলাম। অর্চিষ্মানের এই সব দিনে ফেরা এত ঝামেলা। একে পুজো, তায় বৃষ্টির ঝামেলা। অর্চিষ্মান ফিরল। বেশি কষ্ট হয়নি নাকি। প্রসেনজিৎ আজই শেষ আসবে। আজও রান্না কিছু করার নেই, ফ্রিজ ঝেড়েঝুড়ে শেষ। তবু আসবে, ঝাঁটফাট দিয়ে চলে যাবে। গত চারপাঁচদিন ধরে বাইরে খাওয়া চলছে। তা বলে অষ্টমীতে তো ভেতরে খাওয়া যায় না। আমাদের হোমবাউন্ড-এর টিকিট কাটা আছে। হলে ঢোকার আগে খেয়ে ঢুকব।
কোথায় খাওয়া যায়, কোথায় খাওয়া যায়। ফ্লেমিং ওয়ক-এই গেলাম। পাড়ার চাইনিজ দোকান। পুরোনো দোকান। ছোটবেলায় বছরে দু’বার বাইরে খেতে যে চাইনিজ রেস্টোর্যান্টগুলোয় যেতাম তাদের মতো। শান্ত, নিভু নিভু আলো। মেনুতে গ্রেভি চাউমিনটাই যা নেই।
চেনা বাচ্চা বাঙালি ছেলের দল, আসুন দাদা, আসুন বউদি বলে বসাল। আমরা লেমন করিয়েন্ডার সুপ ওয়ান বাই টু করলাম। আর চিলি গারলিক ফ্রায়েড রাইস আর স্পাইসি মিক্সড ভেজ টাইপের কিছু নেওয়া হয়েছিল, ভুলে গেছি।
এই দোকানটা উঠে গেলে কষ্ট হবে আমার। অর্চিষ্মান জানাল। আমারও। সেই কবে থেকে খাচ্ছি এখানে। এ দোকানের প্রায় সব টেবিলে বসেছি আমরা। সেই সব টেবিল এখন ভর্তি হয়ে লোকেরা এসে দাঁড়িয়ে আছে। লোক মানে বাঙালি। ভালোও লাগছে, আবার অসুবিধেও হচ্ছে। বাঙালিদের নিয়ে চর্চা করা সবথেকে আরামের, কিন্তু বাংলায় যে চর্চা করা যায় না সেটা অসুবিধের। আর প্রেম, কলহ ও পি এন পি সি - বাংলা ছাড়া আর কোনও ভাষায় করা আমার পক্ষে অসম্ভব। খুব ফিসফিসিয়ে আমরা যে'কটা পয়েন্ট আলোচনা করতে পারলাম তা হল, এক, কিছু লোক খেতে খেতে কথা বলে না। তিনজন, জানালার পাশের টেবিলে বসে টোটাল সাইলেন্সে ডিনার করলেন । দুই, কিছু লোকের পার্মানেন্ট বিরক্তিমাখা মুখ। লোকে কী পরিমাণ কম হাসে, সেটা আমি ইদানীং রিয়েলাইজ করেছি। অচেনা লোকের সঙ্গে বা বিনা হেসে ইন্টারঅ্যাক্ট করা আমি কল্পনা করতে পারি না। অনেকেই পারেন, হয়তো প্রেফারই করেন।
কিন্তু সেদিন দোকানে যে আমাদের মনোযোগ সবথেকে বেশি আকর্ষণ করেছিল সে একজন পাঁচবছরের মহিলা, নাম পরে জেনেছিলাম, ওজস্বিনী। অফ কোর্স, ওজস্বিনী নিজে আমাদের নাম বলেনি, ও নাম জনে জনে বলা প্রভূত খাটনির ব্যাপার, কিন্তু ওজস্বিনী খুবই তেজস্বিনী। সে হেসে গেয়ে নেচে, প্রতিবাদস্বরূপ একবার ফ্লেমিং ওয়কের ছাদ ফাটিয়ে কেঁদে, আমাদের মনোরঞ্জন করছিল। বাবামা আশেপাশের টেবিলের সবাইকে সরি সরি বলছিলেন, আমরা বলছিলাম সরি কীসের, এত এনার্জি দেখলেও ভালো লাগে।
এখনও সময় আছে। একবার নবপল্লীর ঠাকুর দেখে যাই। এই নবপল্লীতে/পকেট ফর্টিতে আমি ক্যাকটাস দেখেছি, অঞ্জন দত্ত দেখেছি, অর্চিষ্মান চন্দ্রবিন্দু দেখেছে। সি আর পার্ক এখন গরিব হয়ে গেছে, এ লিস্ট সেলিব্রিটি প্রায় আসেই না। যাই হোক, পরশু ডি ব্লকে যে ভদ্রলোক গাইছিলেন, আজ নবপল্লীতে গাইছেন। ভালোই গাইছেন। নবপল্লী বা পকেট ফরটির ঠাকুর সবসময় সুন্দর হয়। এবারও হয়েছে। ঢোকার মুখে একদল বাচ্চা দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিল। এরা কিছু ছবি তুলতে পারে, বাপ রে বাপ। মেশিনের মতো। অশোকাঙ্কুর বলল এইবারের পুজোতে নাকি ও খেয়াল করেছে, ছবি তোলার থেকেও বেড়েছে ছবি তোলার এনটাইটলমেন্ট। আশেপাশে কে মরল কে বাঁচল দেখার প্রয়োজন মনে করছে না। রাস্তা আটকে ছবি তুলে চলেছে।
বৃষ্টিতে মাঠভর্তি কাদা। দেখে চল দেখে চল বলাবলি করতে করতে অর্চিষ্মান ছ্যাপ করে জলজমা কাদার মধ্যে পা ফেলল। আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। এই এক্স্যাক্ট কাণ্ড পঞ্চমীতেও করেছিল। 'যত কাণ্ড' দেখে ফেরার পথে প্যান্ডেলে ঢুকে 'দেখি ভালো কী পাওয়া যাচ্ছে' বলে কাবাবের দোকানে গিয়ে চিকেন শিককাবাব রোল না কী একটা অর্ডার দিয়েছিল, সয়া চাপ রোলের উদার অফার প্রত্যাখ্যান করে আমি দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাড়ি ফেরার সময় জিজ্ঞাসা করলাম, রোলটা ভালো? বলল, ওই আরকি, মেয়োনিজফেয়োনিজ দিয়ে একাকার করেছে। আমি বললাম, তুমি তো লোকটার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে ছিলে! লোকটা একেকটা বোতল তুলে ঝাঁকাচ্ছিল আর তুমি নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে ছিলে। আমি স্পষ্ট দেখেছি।
অর্চিষ্মান রোলে কামড় দিতে দিতে বলল, সেটাই তো ইন্টারেস্টিং। একেবারে ভিভিডলি দেখলাম, জানো। অলমোস্ট স্লো মোশনে। লোকটা টমেটো, কাসুন্দি, চিলি সস পেরিয়ে মেয়োনিজের শিশি তুলল। ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে রোলে ঢালল।
তবু কিছু বললে না? রোককে রোককে, বেঁধে বেঁধে, আস্তে লেডিস? কিছু মাথায় এল না?
অর্চিষ্মানের নাকি ঠিক সেই মুহূর্তে কী রকম আউট অফ বডি এক্সপেরিয়েন্স হচ্ছিল। কেমন যেন মেন্টাল প্যারালিসিস। দেখছে কিন্তু বলতে পারছে না।
নবপল্লীর মাঠে জলে নেমে পড়ার সময়ও সে রকমই কিছু একটা এক্সপেরিয়েন্স ঘটে থাকবে। তবে অর্চিষ্মানের একটা কথা সত্যি। যে জায়গাটা খালি সেটা তো একরকম বোঝা যায়। বাকি মাঠটা কর্তৃপক্ষ কার্পেটে ঢেকে রেখেছেন। পাটাতনটন কিছু পাতেননি। তাতে চোরাবালি এফেক্ট হয়েছে। কার্পেটে ডান পা রাখলেন, কাদায় দেবে গেল, বাঁ পা দিব্যি শক্ত মাটিতে। মাঠশুদ্ধু লোক দুই হাত ছড়িয়ে ব্যালেন্স করতে করতে ঘুরছে। আমরা এক্সিট খুঁজে পাচ্ছে না। এন্ট্রিতে এক রোগা ভদ্রলোক যে রকম প্রতাপে লাঠি আছড়াচ্ছেন, নিয়ম ভেঙে যে সেখান দিয়ে বেরিয়ে যাব, সাহস হচ্ছে না। একেতাকে জিজ্ঞাসা করেও এক্সিট পাওয়া গেল না, এক্সিটের বদলে এমারজেন্সি এক্সিট বেরোল। এমারজেন্সিতেই কাজ চালিয়ে নিতে হবে। পাঁচিলের গায়ে একটা ভাঙা মতো, তার মধ্যে আবার একটা গাছ উঠেছে, গাছ আর পাঁচিলের মধ্যে একটা পা কোনওরকমে রাখা যায়। একজন অ্যামেরিকান নাগরিকও ওই ফাঁকা দিয়ে এমারজেন্সিতে কেন, স্বাভাবিক সময়েই গলতে পারবে না। আমি এ সব ভাবছি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে,অর্চিষ্মান একেবেঁকে পাঁচিলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে বলল, সত্যি যদি এমারজেন্সি হয় আর লোকে এই এক্সিট দিয়ে বেরোতে যায়... আমি বললাম, হ্যাঁ, দুঃখের সিন।
নবমী
আজ বৃষ্টিতে ভেসে যাক, মোদি স্বয়ং এসে ধুনুচি নাচুক, লাইন সি আর পার্ক ছেড়ে অলকনন্দা পৌঁছে যাক আমি কে ব্লক দেখছি। অর্চিষ্মান না গেলে একাই চলে যাব।
অর্চিষ্মানও দেখি গেল সঙ্গে সঙ্গে। দেশবন্ধু সমিতির গেট থেকে কে ব্লকের প্যান্ডেলের লাইন শুরু হয়েছে। লাইনে ঠিক আমার পেছনেই দাঁড়াল। লাইন গুটি গুটি এগোতে থাকল। রাস্তার ওপার থেকে একটি ছেলে ব্যস্ত হয়ে দৌড়ে এসে, ইয়ে কেয়া কে ব্লক কা লাইন হ্যায় জিজ্ঞাসা করে উত্তর নিয়ে চলে গেল। আমি সামনের ভদ্রলোকের উদ্দেশ্যে চোখ ঘুরিয়ে বললাম, অর কিসকা হোগা? ভদ্রলোক সজ্জন, উনিও চোখ ঘোরালেন। এই ধরণের লাইনে বেশ একটা কমরেডারি তৈরি হয়। মিনিট পঁচিশ কাটার পর ভদ্রলোকের সামনে দাঁড়ানো তিনটে মেয়ে খবর আনতে গেল। পনেরো মিনিট পর খবর আনল যে আরও পঁয়তাল্লিশ মিনিট দাঁড়াতে হবে।
শুনে সামনের পাঁচজন তীরের মতো বেরিয়ে গেলেন। আমি সিরিয়াসলি পিছু ডাকব ভাবলাম, আরে যাচ্ছেন কোথায় দাঁড়িয়ে থাকুন, অর্চিষ্মানের মাথা নাড়ার ভয়ে ডাকলাম না।
অফ কোর্স, পনেরো মিনিটের মধ্যে আমরা প্যান্ডেলে ঢুকে পড়লাম।
কে ব্লকের প্যান্ডেল, আগেই বলেছি, সোনার কেল্লার আদলে বানানো হয়েছিল। অনেকে বলেছে, যাদের মধ্যে অশোকাঙ্কুরও পড়ে, কিছুই কেল্লা হয়নি। প্যান্ডেলের টঙে যে ময়ূরটা রেখেছে, সেটা দেখে বুঝতে হবে যে ওটা সোনার কেল্লা। যাই হোক, কেল্লা সোনার হোক না হোক, আমরা ঢুকলাম। উন্মাদের মতো ভিড়। স্বেচ্ছাসেবী বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো কোথায় মজা করে ঠাকুর দেখে বেড়াবে, না গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে এদিকে যান ওদিকে যান, এই গেট দিয়ে ঢুকতে পারবেন না এখানে পাস লাগবে, না দাদা আপনার ভোটার আই ডি আপনার পাস না - এই সব করে গলা ভেঙে ফেলছে। ঠাকুর দেখে নাচাগানার দিকে গেলাম। কে গাইছেন চিনতে পারলাম না। স্বাস্থ্যবান এবং শুনে মনে হল ভাইরাল। আমি না হয় ব্যাকডেটেড, ভাইর্যালটাইর্যাল জানি না, অর্চিষ্মান আধুনিক যুগের ছেলে ও-ও নাকি জানে না। সারাদিন ফোনের দিকে তাকিয়ে কী দেখে ভগবানই জানে। ভাইরাল ভদ্রলোক তেমন ভালো গান না, কিন্তু আসর জমাতে জানেন। দর্শকদের জিজ্ঞাসা করছেন, কী গাইব? ললিপপ লাগেলু?
মনে হল সি আর পার্কের আকাশ চুরমার হয়ে কে ব্লকের মাঠে ঝরে পড়বে। আমি ললিপপ লাগেলু কী জানি না, অর্চিষ্মান এটা জানে। ভোজপুরি ভাইর্যাল সংগীত।
গাইয়ে বললেন, ললিপপ লাগেলু অ্যালাউড নেহি হ্যায়।
বাঙালি কিছু রেসিস্ট। হিন্দি আগ্রাসন ঠেকানোর দম নেই যত রংবাজি ভোজপুরির ওপর। দর্শকসমুদ্রে হতাশার মেক্সিক্যান ওয়েভ। কোই নেহি। গাইয়ে সান্ত্বনা দিলেন। রঙ্গবতী অ্যালাউড হ্যায়।
ঢেউ আছড়ে পড়ল।
লেকিন পহলে থোড়া রোম্যান্টিক কুছ হো যায়ে।
প্রেলিউড বাজল। চিনি চিনি। আসল চিনি, রিমিক্স চিনি। কিশোরকুমার চিনি, অরিজিৎ সিং চিনি। সবুজ সমুদ্রের সামনে লাল শাড়ি পরে নাচছেন শ্রীদেবী, অক্ষয়কুমারকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আছেন সোনাক্ষী সিনহাও চিনি।
হর কিসি কো নহি মিলতা… মাইক দর্শকের দিকে ঘুরেছে, গোটা প্যান্ডেল গলা ফাটিয়ে রিপ্লাই দিচ্ছে, ইহাঁ পেয়ার জিন্দগি মে।
মাইক আবার গায়কের দিকে। খুশ নসিব হ্যায় হাম জিসকো হ্যায় মিলা ... মাইক আবার এদিকে, ইয়ে বাহার জিন্দগি মে।
গলা ফাটিয়ে গাইছি বটে কিন্তু গানের প্রেমিসের সঙ্গে একমত নই। আমাকে ব্লু টোকাইয়ের একজন বলেছে, পেয়ার হোনা চাহিয়ে কায়ানাত সে। ইয়ে সেলফিশ লাভ ঢুন্ডতে ঢুন্ডতে ওয়ার্ল্ড হ্যাজ গন টু পিসেস। হান্ড্রেড পার সেন্ট একমত। প্রেম হবে শুধু মানুষের সঙ্গে, তাও আবার ছ’ফুটের কম হলে চলবে না, পঞ্চাশ কেজির বেশি হলে বাতিল, দুধে আলতার এক্স্যাক্ট শেডই চাই, কোমরছাতির এক্স্যাক্ট প্রোপরশন।
শুধু এদিক থেকে ওদিকে প্রেম হলে চলবে না, ওদিক থেকে প্রেম পাইপয়সা গ্রাম মিলিগ্রাম মেপে ফেরত পেতে হবে।
আর যারেই কউক, এরে ভালোবাসা কয় না। জগতে ভালোবাসার অভাব নেই। আমরা ভালোবাসতে জানি না। লাভ ইজ আ স্কিল। ভালোবাসতে জানলে অনেককে, অনেক কিছুকে ভালোবাসা যায়।
সামনে অল্পবয়সী ছেলের দল, সবাই প্রায় আমার থেকে এক হাত করে লম্বা। একজন বলল, চল ঠাকুর দেখে আসি, বাকিরা বলল, আরে দর্শনওয়র্শন তো হোতা রহেগা। পহেলে গানা সুন লে তে হ্যায়।
এ ছেলের হবে। মা এ ছেলেকে আশীর্বাদ না করে কৈলাসে ফিরবেন না।
বিজলী গ্রিলের স্টলের সামনেটা অফিসটাইমের শেয়ালদা। কাবাবের ধোঁয়ায় বাতাস ঘন। অর্চিষ্মানকে চেঁচিয়ে বলছি, কিছু খাবে? অর্চিষ্মান মাথা নাড়ছে। কী মনে করে ব্যাগ থেকে ফোন বার করছি। অর্ক কলিং। টেলিপ্যাথি। আমি আধঘণ্টা পর ওই প্রথম ফোন চেক করেছিলাম। চেক না করলে শুনতেই পেতাম না।
অধিকাংশ জনগণ দিল্লিতে এসে বিভিন্ন এয়ারবিএনবি-তে ঢুকে গেছে। কাল লাঞ্চে দেখা তো হচ্ছেই, আজ ডিনারে ফাউ দেখা করতে কারওরই আপত্তি নেই। অর্ক শম্পা দুর্গাবাড়ি থেকে বেরিয়ে ক্যাফে ডোমা যাচ্ছে। অপরাজিতা, জ্যোতিষ্মান, কাকিমা, অশোকাঙকুর বসন্তকুঞ্জের হলে হোমবাউন্ড দেখছে, সিনেমা শেষ করে আসবে। আমরাও ডোমাতে যাব, কিন্তু যেতে হলে আগে কে ব্লক থেকে বেরোতে হবে। কালকের নবপল্লী প্যান্ডেলের সেম ইস্যু, এক্সিট পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া গেছে। এক্সিটের সামনে একটা মেয়ে, যে একটু আগে ওই গেটে লোকজনের সঙ্গে ভোটার আই ডি নিয়ে চেঁচাচ্ছিল, এই গেটে আধার কার্ড নিয়ে লড়ে যাচ্ছে।
মানবসভ্যতার অভিযোজনের যে স্টেপটা কর্মকর্তা হয়ে ওঠার বা অ্যাট লিস্ট হতে চাওয়ার, আমার আর অর্চিষ্মানের মিস হয়ে গেছে। এটা কেন কেউ যেচে হতে চাইবে, আমরা সিরিয়াসলি ভেবে পাই না। অনেকেই পান। এক বন্ধু বলছিল, আর জি কর কেসে ফেসবুকে গ্রুপ খুলে রাতদখল অরগ্যানাইজ করার সময় নাকি জনতা, 'আমাকে অ্যাডমিনে অ্যাড কর, অ্যাডমিনে অ্যাড কর, কেউ আমাকে অ্যাডমিনে অ্যাড করছে না কেন, মিছিলে যাব না কিন্তু বলে দিচ্ছি,' করে পাগল হয়ে যাচ্ছিল।
ব্যারিকেড পেরিয়ে, ব্যারিকেডে পেঁচানো শেকল টপকে পেরিয়ে রিং রোডে পড়লাম। অটোর সমুদ্র। সি আর পার্কে ঢুকতে দিচ্ছে না তাই সি আর পার্কের সীমানার বাইরে বসে সবাই থাবা চাটছে। আমি উবার ডাকছি, যা পাওয়ার চান্স স্লিম। সি আর পার্কের দশ মাইলের মধ্যে কেউ যেচে আসবে না এখন। অর্চিষ্মান রানিং অটো ধরার জন্য দৌড়োদৌড়ি করছে। বিয়ের কী উপযোগিতা অনেকে জিজ্ঞাসা করে, এমনকি অর্চিষ্মানও বলে আর দশ বছরের মধ্যে নাকি বিয়ে উঠে যাবে এবং উঠে যাওয়াই উচিত। ইট মেকস জিরো সেন্স। কোনও সেন্সিবল লোকের এই ব্যবস্থায় যেচে ঢোকার কথা না। নিজেকে ননসেন্স ভাবতে ভালো লাগে না, তাই আমি চুপি চুপি একা একা বিয়ের উপযোগিতা খুঁজতে থাকি। একটা পাওয়া গেছে। এবার থেকে এই এক্স্যাম্পলটা দেওয়া যাবে। নবমীর রাতে অটো পাওয়ার প্রব্যাবিলিটি বাড়াতে দলে দলে বিয়ে করুন। আমার উবার এখনও লোকেটিং ড্রাইভার, ওদিক থেকে কুন্তলা! একটা অটোর সামনে বুক পেতে দাঁড়িয়ে হাওয়ায় হাত দোলাচ্ছে অর্চিষ্মান। দৌড়ে গিয়ে উঠে পড়লাম। অর্চিষ্মান বলল, দুশো বলছে, আমি দরাদরি করিনি।
দরাদরির প্রশ্ন নেই। আমি তো ভেবেছিলাম সাড়ে তিনশো চারশো হাঁকবে।
ওই তো, ডোমার বাইরের আধো অন্ধকারে অর্ক শম্পা! এক বছর পর দেখা হচ্ছে। একটা বেড়াল দরজার বাইরে বসে ম্যাও ম্যাও করে ল্যাজ আলতো আলতো আছড়াচ্ছে। আমি দরজা খুলতে দোকানের ভেতর ঢুকে গেল। একটা থ্যাংক ইউ পর্যন্ত না। ভেতরে একজন কুকুরও ঘোরাঘুরি করছিলেন।
ডোমা, কোরিয়ান ক্যাফে। আমরা মাঝে মাঝেই যাই। অর্চিষ্মানের তো কোরিয়ান পছন্দই, আমারও ডোমার ঢিলেঢালা, বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ। তাছাড়া, অবান্তরে এই নিয়ে আগেই কথা হয়েছে, দিল্লিতে যে হাতে গোনা কোরিয়ান খাবার আমরা খেয়েছি, একমাত্র ডোমার খাবার আমার মিষ্টি লাগেনি।
আমরা ঢুকেছি প'নে দশটায়। দশটায় দোকান বন্ধ হবে, পাঁচমিনিটের মধ্যে সব অর্ডার, ফাইন্যাল দিয়ে দিতে হবে। বুঝুন। চারজন পৌঁছেছি। চারজন এখনও বাইরে, কাজেই আমাদের আটজনের অর্ডার দিতে হবে। দিলাম। দেওয়া শেষ হল। বাকিরা ঢুকল। ওরাও হোমবাউন্ড দেখে ফিরছে। ওদেরও অভিনয় ভালো এবং সব মিলিয়ে সিনেমাটা খারাপ লেগেছে। খাওয়া শুরু হল। অর্ডার মোটামুটি ঠিকই দিয়েছিল, শুধু কিমবাপ দরকারের বেশি হয়ে গিয়েছিল।
আমরা খেতে খেতেই কর্তৃপক্ষ বেরিয়ে গেলেন। দুটো শান্ত মিষ্টি বাচ্চা ছেলে, বোধহয় দোকানেই থাকে, খাওয়া শেষ হলে আমাদের বাইরে বার করে দরজা বন্ধ করে দিল।
অর্চিষ্মান আবার একটা সিনেমা দেখতে যাবে, লেট নাইট শো। ওয়ান ব্যাটল আফটার অ্যানাদার। এক সপ্তাহে তিনটে সিনেমা হলে দেখা আমার পক্ষে শারীরিক মানসিকভাবে অসম্ভব, আমি বাড়ি ফিরব। অর্চিষ্মানের উবার এসে গেল। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আমারও। অর্চিষ্মান ফোন বন্ধ করে দেবে কারণ ওকে রাতে উবার ধরে ফেরার জন্য চার্জ বাকি রাখতে হবে, কিন্তু বেচারা আমি বাড়ি না ঢোকা পর্যন্ত সাহস করে ফোন বন্ধ করতে পারছে না। অস্বস্তি হচ্ছে না তো, লোকটা ঝামেলার মনে হচ্ছে না তো এই সব খবর নিয়ে চলেছে। এত কথা বলা লোক ঝামেলার হতে পারে না। ননস্টপ অর বতাও অর বতাও করে ফোনে কথা বলে চলেছে। এত কথা লোকে বলে কী করে, এত কথা শোনার লোকই বা জোটায় কোত্থেকে কোথায় ভগবান জানে।
অর্চিষ্মান হলে ঢুকে গেছে। আমার সবে দেশবন্ধু কলেজের সামনে ড্রপ হল। আমি বলছি ফোন বন্ধ করে দাও। অর্চিষ্মানের ট্রেলার শুরু হয়ে গেছে, আমি সরুন ভাই, একটু দেখি বোন বলে বাড়ির দিকে দৌড়চ্ছি। ওয়ার্নার ব্রাদার্সের লোগো স্ক্রিনে ফুটে উঠেছে, আমি সিঁড়ি দিয়ে উঠে ঘরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে লিখছি, অর্চিষ্মান টাচডাউন হয়ে গেছে, এবার ফোন বন্ধ কর।
অর্চিষ্মান ফিরল রাত দুটোর পর। বাজে মিস করলে। ফাটাফাটি সিনেমা।
দশমী
প্রচুর চ্যাট চালাচালি, সাজেশন দেওয়ানেওয়ার পর অবশেষে সৌমেন্দুর সাজেশনে আমরা ৬, বালিগঞ্জ প্লেসে, বিজয়া দশমীর বুফে খেতে যাচ্ছি। দেড়টায় যাওয়ার কথা হয়েছিল। বুকিং করতে গিয়ে সৌমেন্দু জেনেছে হয় দুপুর সাড়ে বারোটায় জায়গা পাওয়া যাবে, নয় রাত সাতটায়।
একই গন্তব্যে আলাদা আলাদা পৌঁছনো লোকজনের দেখা হওয়া নিয়ে যেটুকু কনফিউশন হওয়ার ছিল হল। আমরা হেথায় তোমরা কোথায় পেরিয়ে ভেতরে গেলাম। বান্টির সঙ্গে আমি শিওর ছিলাম পনেরো বছর পর দেখা হল, বান্টি বলল, হ্যাট, মাঝে একবার অমুকের বাড়ি দেখা হল তো। তোমার অলরেডি স্মৃতিভ্রংশ হচ্ছে কুন্তলাদি। আমার আর ওর জীবনের ভেন ডায়াগ্রামের কাটাকুটির সময়টাতে যে সব লোকজন কমন পড়েছিল তাদের সম্পর্কে রোমহর্ষক স্ক্যান্ডালও দিল বান্টি।
অতীব সুসজ্জিত দোকানে বেলুন ফেটে বাঙালি ঝরে পড়ার ফিলিং। প্রচুর খাবার। বাঙালিত্বের নাড়ি ধরে টান দেওয়া খাবার। ঘি পোস্ত দেওয়া আলুভর্তা। তিল বাদাম ভর্তা, মরিচ পেঁয়াজ ভর্তা, ভাত, বাসন্তী পোলাও, রাধাবল্লভী, আলুরদম, পাতুরি, মাটন, রসগোল্লা, পায়েস, দই, মিহিদানা। আরও অনেককিছু। টাইপ করার এনার্জি পাচ্ছি না। আমার আলু ঘি সেদ্ধ উইথ পোস্ত ভালো লেগেছে, চাপড়ঘণ্টও অপূর্ব। আমিষাশীদের বাজারে পাতুরি হিট। রসগোল্লা খাইনি, গুড়ের পায়েস, বেকড মিহিদানা ও রাবড়ি ভালো, দইটা বাড়াবাড়ি রকম ভালো। বাই দা ওয়ে, সি আর পার্কে 'সন্দেশ' বলে একটা মিষ্টির দোকান খুলেছে, দেখেছি, কিন্তু অন্নপূর্ণার প্রতি একনিষ্ঠতায় যাইনি। সেদিন আমাদের বাড়িতে এসে অশোকাঙ্কুর আর কে যেন বলল, সন্দেশ-এ তসলিমা নাসরিন মিষ্টি খেতে আসেন। শুনে কাল অর্চিষ্মান টানতে টানতে সন্দেশে নিয়ে গেল। সন্দেশ-এর দইও বেশ, বেশ ভালো।
খাবার তো ভালোই, কিন্তু আমার ভালো লেগেছে অন্য একটা জিনিস। যাওয়ার আগে খাবারের আইডিয়া দেওয়ার জন্য সৌমেন্দুই সম্ভবতঃ একটা দশমীর বুফের মেনু জোগাড় করে গ্রুপে দিয়েছিল। মেনুর ওপর বড় বড় করে ছাপা 'বাজল তোমার আলোর মেনু'।
খেয়ে উঠে গাড়ি ট্যাক্সি অটো করে আমাদের বাড়ি আসা হল। আমাদের বাড়ি কোনওমতেই তেরো চোদ্দ জনের বসার মতো নয়। কিন্তু এরা সুজন, চেপেচুপে ঠেলেঠুলে বসল। বড় গ্রুপের গল্পের একটা নিজস্ব কোরিওগ্রাফি থাকে। লিঙ্গ, বয়স, পছন্দ, বন্ধুত্ব, পেশা, নেশার ভিত্তিতে এক একবার এক এক বিন্যাস। এই সব বিন্যাস ও পুনর্বিন্যাসের মধ্যেই একটি রোমহর্ষক ঘটনা ঘটল। সিঁড়ি বেয়ে কারা যেন উঠে আসছে। অভিজিৎদা। অভিজিৎদা খুবই ভালো লোক, তা বলে রোমহর্ষক বলাটা বাড়াবাড়ি। রোমহর্ষক হচ্ছে অভিজিৎদার পেছন পেছন যিনি ঢুকলেন। রাজাবাবু। অভিজিৎদার অগুন্তি পোষ্যের মধ্যে একজন। সি আর পার্ক গ্রেটার কৈলাশ অঞ্চলে অভিজিৎদার প্রচুর পোষ্য আছে, মাঝে মাঝেই রোববার দেখি অভিজিৎদা মুখে মাস্ক পরে হাতে ইঞ্জেকশন নেড়িদের পেছনে দৌড়োদৌড়ি করছে। ইনি বোধহয় অভিজিৎদার বাড়িতেই থাকেন। অভিজিৎদা বলল, হরি হরি, এটা তোদের বাড়ি? পাশের বাড়িতে রাজাবাবুর বেস্টফ্রেন্ড থাকে, অভিজিৎদা নাকি রোজই আসে।
রাজাবাবু ফ্রেন্ডলি বটে। সে যে কী ব্যস্তসমস্ত, এই বারান্দায় চলে যাচ্ছে, এই বাথরুমে গিয়ে বালতি থেকে জল খেয়ে ফেলছে। আবার সবার মাঝখানে এসে মেঝের ফাঁকা যেটুকু বাকি আছে ধুপ করে শুয়ে পড়ছে। একেবারে নট নড়নচড়ন। আবার ঠিক গুনে গুনে দশ হওয়ার পর লাফ মেরে উঠে ব্যস্তসমস্ত ঘোরাঘুরি। আমরা সবাই পালা করে রাজাবাবুকে আদর করলাম। এগিয়ে পিছিয়ে, উপুড় হয়ে চিত হয়ে রাজাবাবু আমাদের গাইড করছিলেন ঠিক কোন জায়গাটায় আদর করতে হবে। অবশ্য সবার যে একই রকম প্রতিক্রিয়া তা নয়। অনেকেই ভয় পায়। দূরত্ব বজায় রাখে। আমি একসময় যে রকম ছিলাম।
সবার বাড়ি যাওয়ার সময় হয়ে গেল। অপরাজিতারা বেরিয়ে গেল। আমরা হেঁটে হেঁটে দু’নম্বর মার্কেট পর্যন্ত গেলাম। আমি আর শম্পা ফুচকা খেলাম। ও বেচারা দাদরির ফুচকা খেয়ে অভ্যস্ত, সি আর পার্কের ফুচকা খেয়ে মুগ্ধ। তারপর লেমন টি। আশপাশে থেকে জোরে জোরে কথা ভেসে আসছিল। মানে জোরে তো সবাই কথা বলছে, এক্সট্রা জোরে। চেনা চা-দাদা বলছিলেন, যত আজেবাজে লোকে ভরে গেছে, মাল খেয়ে এসে বাওয়াল দিচ্ছে। কাল শেষরাতে নাকি সিরিয়াস বাওয়াল হয়েছিল। নেহাত দাদা তখন ছিলেন না, থাকলে…
থাকলে দাদা কী করতেন আমিও শুনেছি, শম্পাও শুনেছে, সে আর এখানে লিখছি না। তবে দাদার না থাকাটা ইনভলভড সব পক্ষের পক্ষে ভালোই হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস।
সবাই চলে গেল। আমরা বাড়ি চলে এলাম। কুর্তা এদিকে পাজামা ওদিকে ছুঁড়ে বডি ফেললাম। অর্চিষ্মান অবশ্য শুতে পারছে না। আধোঘুমে উশখুশ উশখুশ টের পাচ্ছি। অবশেষে আবার সংসারের জাতীয় সংগীতটা আবার গেয়েই ফেলল অর্চিষ্মান। কুন্তলা, চল বেরোই।
এখন? কোথায়?
কোথাও একটা।
খিদে নেই তো।
খাব না, এমনি বসব।
ধড়াচূড়া কুড়িয়ে, গলিয়ে বেরোলাম। তখন দশটাটশটা হবে। ঘণ্টাতিনেক আগেই ওদের ছাড়তে এই রাস্তা দিয়ে হেঁটেছি, তখনও কত লোক ছিল, এখন ফাঁকা। মেলা গ্রাউন্ডের গেটের সামনে একটি মেয়ে, আমার তুলনায় বাচ্চাই, ফুচকার বাঁশের ডমরু আর একটা ব্যাগ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মূল মালপত্র নিয়ে হয়তো আর কেউ চলে গেছে। একটা বছর ছয়েকের বাচ্চা দৌড়োদৌড়ি করে অটো ধরার চেষ্টা করছে।
অটো ধরে আবার জি কে টু গেলাম। ইউ মি বলে একটা দোকান আমাদের পছন্দের। টেবিল পেতে দাঁড়াতে হল। রাস্তার জানালার পাশে সিট পেলাম। আমি গ্রিনহাউস সুপ নিলাম, অর্চিষ্মান পর্ক বাও। খাওয়া সেরে অটো ধরে বাড়ি এলাম। দু'ঘণ্টা আগের থেকেও বদলে গেছে জায়গাটা। সন্ধে সাতটা, রাত দশটা আর রাত বারোটার একটু পরে -একই জায়গার এই রকম আশ্চর্য পরিবর্তন ঘটতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস হয় না।
চৌরাসিয়ার পানের দোকানের দিকে হাঁটছি। বড় শহরের মেজরাস্তায় যতখানি আলো থাকার কথা আছে। আমি অর্চিষ্মানকে দেখতে পাচ্ছি, অর্চিষ্মান আমাকে দেখতে পাচ্ছে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় সালসা ট্যাংগো ক্লাসের বিজ্ঞাপনের ফাইন প্রিন্টও পড়তে পারছি। তবু এই সব রোজকার আলো ছাপিয়ে একটা অদৃশ্য অন্ধকার ছেয়ে আছে। অন্ধকারটা কোথা থেকে আসছে সেই নিয়ে আমার একটা থিওরি আছে। আমাদের পেছনের মেলা গ্রাউন্ডের প্যান্ডেলে, সামনে গলির ভেতর ডি ব্লকের প্যান্ডেলে, একটু দূরে কালীবাড়ি, কে ব্লক, বি ব্লক এবং আরও ছোটখাট বাড়ির প্যান্ডেলে যে প্রদীপগুলো একা একা জ্বলছে, অন্ধকারটা তাদের মিলিত অবদান।
অর্চিষ্মান মাউন্টেন ডিউ কিনছে। কাচের বোতলে খেতে হবে। ফ্যান্টা খেলে বাড়ি নিয়ে যাওয়া যায়, কিন্তু অর্চিষ্মানের মাউন্টেন ডিউই ইচ্ছে। আর একটু দাঁড়িয়ে যাই। তাড়া তো নেই। আমার ফোন কাঁপছে। র্যাপিডো মেসেজ করেছে। গোটা পুজো জুড়ে র্যাপিডো আমাকে শুদ্ধ বাংলায় মেসেজ করেছে। একটি ন ণ গোলায়নি, 'পরে' বোঝাতে 'আগে' বলেনি। আমি অলমোস্ট শিওর, কথাবার্তা এগোলে, পরিস্থিতির উদ্ভব হলে 'স্বীকৃতি'ই বলবে। মান্যতা না।
র্যাপিডোর মেসেজ। ভার্বেটিম না, প্যারাফ্রেজ। মনখারাপ? কেন? আর তো মোটে তিনশো ষাট দিন।
সিডাকশনের অন্যতম স্ট্র্যাটেজি কী বলুন তো? আনফিনিশড বিজনেস তৈরি করা। পরিচয় আধো থাকতে থাকতে হৃদয়ের দ্বার রুদ্ধ করা। আধোখানি কথা সাঙ্গ না হওয়ার আগে ফোন নামিয়ে রাখা। মাদুর্গা খেলাটা জানেন এবং তাঁর নশ্বর প্রতিপক্ষদের থেকে মাচ, মাচ বেটার খেলেন। সেই যে অপরাজিতা 'পুজো মিট' গ্রুপ খোলা থেকে বল গড়াতে শুরু করে মহালয়ার ভোর চারটেয় থেকে পিক আপ নিল, শেষের পাঁচ দিন ধরে শব্দ আলো বর্ণ চুমকি কিশোরকণ্ঠ ট্যারো রিডিং-এর ফানুসে চড়ে তুঙ্গে উঠল, যে মুহূর্তে আমাদের বিশ্বাস হতে শুরু করল যে সকাল দশটায় চুসকি, রাত দুটোয় সিনেমা দেখে ফেরাই আমাদের নিও নর্ম্যাল, দোকা ঘরে একশোবার দেখা একেনবাবু একশো একবার দেখতে দেখতে রুটি বাঁধাকপি খাওয়া নয়, গমগমে কোরিয়ান ক্যাফেয় বন্ধুদের সঙ্গে কিমবাপই আমাদের কর্মফল, সেই মুহূর্তে দপ করে সব নিভে গেল।
হার্ড স্টপ।
অস্বস্তি তো হবেই। ঘুম তো আসবেই না। মন তো ক্লোজার চাইবেই। কে দেবে ক্লোজার? যার দেওয়ার সে মেলা গ্রাউন্ডের মাটি খুঁড়ে বানানো মেকশিফট পুকুরে লটবহর সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে ডুব দিয়েছেন। তাছাড়া ক্লোজার কেউ কাউকে দেয় না। নিজেদেরই জোগাড় করে নিতে হয়। অর্চিষ্মান বেরিয়ে পড়ে ঠিকই করেছে। চেনা পাড়ার চেনা দোকানের জানালার পাশে অর্চিষ্মানের উল্টোদিকে আমি, আমার উল্টোদিকে অর্চিষ্মানের চিরচেনা বুদবুদের ভেতর বসে পৃথিবীটার দিকে তাকিয়ে থাকার নর্ম্যালে যত তাড়াতাড়ি ফিরে যাওয়া যায় ততই ভালো।
গ্রুপে এখনও টুকটাক কথা চলছে, দেখা করার ক্যালেন্ডার বানানো হচ্ছে। বেড়াতেও যাওয়া যায়। দল বেঁধে বিপাসনা। বা পন্ডিচেরি। দেখা হওয়া, বেড়াতে যাওয়া পয়েন্ট না। আমি জানি, বাকিরাও জানে। পয়েন্ট হচ্ছে যে আমাদের ইচ্ছে করছে দেখা করতে, একসঙ্গে সময় কাটতে। এই যে বান্টি বলছে আমার ভীমরতি হয়েছে বলে আমি ভাবছি ওর সঙ্গে আমার সঙ্গে পনেরো বছর দেখা হয়নি, পয়েন্টটা ইজ নট প্রিসাইজ পনেরো অর পাঁচ, পয়েন্টটা হচ্ছে আমার এই ফিলিংটা যে বান্টির সঙ্গে আমার প নে রো ব ছ র দেখা হয়নি। এ ফিলিং তো পনেরো মিনিটের অদর্শনেও হতে পারে। বা পনেরোশো বছরেও আর দেখা হবে না সে সত্য জানার পরেও।
গ্রুপে ক্ষীণ হয়ে আসা মেসেজের স্রোত একসময় বন্ধ হবে। তারপর মেসেজ না করার জাড্য সেট ইন করবে। নীরবতার জাড্য। অদর্শনের জাড্য। যতদিন না পরের বছর গ্রুপ খোলা হয়। খুললেই হুড়মুড় করে সব ফেরত আসবে। কারণ সিডাকশনের বীজ বোনা হয়ে আছে বুকের ভেতর। মাপমতো আলোবাতাস নোটিফিকেশন পেলেই লকলক করে মাথা তুলবে।
সে আলোবাতাসের অপেক্ষায় থাকা যাক। অপেক্ষাই আনন্দ। প্রতীক্ষাই প্রেম। এ বছরের বিজয়াই সামনের বছরের মহালয়া।
অনেক, অগুন্তি, অসংখ্য শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা জানবেন।
Comments
Post a Comment